আঁধারে গোপন খেলা – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত
দেব সাহিত্য কুটীর প্রাইভেট লিমিটেড
প্রচ্ছদ : রঞ্জন দত্ত
উৎসর্গ :
যাঁরা ডুবে থাকেন বইয়ের পাতায়, সেই প্রিয় দম্পতি
সোমা ব্যানার্জি ও শিবাজী ব্যানার্জিকে
.
ভূমিকা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে৷ হিটলারের জার্মান বাহিনী দখল করে নিচ্ছে একের পর এক ভূখণ্ড৷ জলে-স্থলে সর্বত্র যেন ফুয়োরারের বাহিনী অপ্রতিরোধ্য৷ বিশেষত সমুদ্রযুদ্ধে হিটলারের রণপোত আর সাবমেরিন হানা কাঁপন ধরাচ্ছে জার্মানির বিপক্ষে থাকা মিত্র- শক্তির বুকে, ইংল্যান্ডের বুকে৷ হিটলারের নৌবাহিনীর সাফল্যের প্রধান কারণ, তাদের সাংকেতিক সামরিক বার্তা প্রেরণের কৌশল, যা পাঠ করতে পারছে না মিত্রশক্তির সামরিক বাহিনী৷ ঘটনাচক্রে মিত্রবাহিনীর হাতে এল জার্মানদের গোপন বার্তা প্রেরক একটি যন্ত্র— এনিগমা৷ ব্রিটিশ সামরিক বিভাগ সেই যন্ত্রের গোপন বার্তা পাঠোদ্ধারের জন্য কিছু অসামরিক ব্যক্তিকে নিয়ে চেষ্টা চালাতে লাগল৷ অত্যন্ত দুরূহ কঠিন সে কাজ, কারও কারও মতে সে কাজ ছিল অসম্ভব৷ স্বয়ং হিটলারও সে কথাই মনে করতেন৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত অসম্ভব সম্ভব হল, এনিগমা যন্ত্রের বার্তা প্রেরণ ও সেই সাংকেতিক বার্তা পাঠের কৌশল উন্মোচিত হল৷ যার ফলে উন্মোচিত হল জার্মান বাহিনীর গোপন সামরিক কৌশল, পরাজিত হতে শুরু করল জার্মান বাহিনী৷ অবশেষে পতন ঘটল হিটলারের৷ সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতে ‘এনিগমা’ রহস্য উদঘাটনের ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আয়ু বেশ কয়েক বছর কমে গিয়েছিল, রদ করা গেছিল আরো কয়েক লক্ষ মানুষের জীবনহানি৷ আর এর কৃতিত্ব কোনো রাজনীতিবিদ বা সামরিক কর্তার নয়, এ কৃতিত্বের দাবিদার এক তরুণ৷ তাঁর নাম অ্যালান টিউরিং৷
তিনি একাধারে এক দৌড়বিদ, ম্যারাথনার, অঙ্কবিদ, প্রযুক্তিবিদ৷ যিনি আধুনিক কম্পিউটার ভাবনার জনক৷ যিনি প্রথম বলেছিলেন, প্রমাণ করে দেখিয়েছিলেন, হ্যাঁ, ‘যন্ত্রও ভাবতে পারে!’ চার্চিল থেকে হিটলার যাঁর নাম জানতেন, আইনস্টাইন যাঁর কাজ সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, ‘ফেলো অব দি রয়াল সোসাইটি’ সহ বিভিন্ন সম্মানে ভূষিত সেই অ্যালান টিউরিং৷ এনিগমা কোডের পাঠোদ্ধারের মতোই রোমাঞ্চকর, হয়তো বা তেমনই গোপন তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবন কাহিনি৷
আসলে এ কাহিনি এক মানুষের সফলতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা অচেনা, অজানা প্রেমকাহিনি৷ তাঁর জাগতিক সফলতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা অন্য এক গোপন খেলার কাহিনি৷ আঁধারে যে গোপন খেলা চলত তাঁর দেহ-মনে, সে খেলাই কি শেষ পর্যন্ত টিউরিং-এর জীবন থেকে কেড়ে নিল সবকিছু? তাঁকে মুছে ফেলল? নাকি আরো কোনো গোপন ষড়যন্ত্র ছিল তার পিছনে? তাঁর জীবনের সফলতাই কি তাঁকে ঠেলে দিয়েছিল তাঁর রহস্যময় অন্তিম পরিণতির দিকে?
না, এ কোনো মানুষের জীবনের, সফলতার, টিউরিং-এর জীবনের বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের, দুরূহ গাণিতিক বা বিজ্ঞানের কাহিনি নয়, এক প্রেমিক, এক ব্যক্তিমানুষের জীবনযন্ত্রণা, ভালোবাসার আখ্যান৷ বিজ্ঞান প্রসঙ্গ হয়তো এসেছে, তা নিতান্তই সরলভাবে অ্যালানের কাজকে বোঝাতে৷ তার চেয়ে বেশি কিছু নয়৷ এ কাহিনিতে খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে সেই অ্যালানকে যে অ্যালান অপরিচিত হলেও যেন আমাদের চেনা কোনো মানুষ৷ যে ক্ষতবিক্ষত হয়, পুলকিত হয় আঁধারে গোপন খেলায়৷ শুধু দৌড়বিদ নন, অ্যালান খেলতে ভালোবাসতেন বুদ্ধির খেলা—দাবা খেলা৷ কিন্তু জীবনের দাবা খেলাতে সময়, নাকি অ্যালান, শেষে কিস্তিমাত করেছিল কে?
অ্যালান টিউরিংকে নিয়ে বাংলাতে নানা বিজ্ঞান-ভিত্তিক প্রবন্ধ রচিত হলেও তাঁর রোমাঞ্চকর, রহস্যময় জীবন কাহিনি নিয়ে বাংলাতে উপন্যাস রচনার এটাই প্রথম প্রয়াস৷ ব্যতিক্রমী এই চরিত্রকে নিয়ে লেখার সময় টিউরিং প্রসঙ্গে নানা তথ্য দিয়ে আমাকে সাহায্য করেছিলেন বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা অগ্রজ সাহিত্যিক শ্রী অনীশ দেব৷ টিউরিং-এর কাজ সংক্রান্ত অনেক কঠিন বিষয় তিনি সরলভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন আমাকে, যাতে আমি পাঠকদের সামনে সহজভাবে তুলে ধরতে পারি৷ কৃতজ্ঞতা জানাই অনীশ দেবকে৷ এই উপন্যাসটি স্থানাভাবে কিছুটা সংক্ষিপ্তভাবে প্রকাশিত হয়েছিল শারদীয়া নবকল্লোলে৷ এবার এ বইয়ে পূর্ণাঙ্গ রূপ নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে—আঁধারে গোপন খেলা৷
পরিশেষে কৃতজ্ঞতা জানাই দেব সাহিত্য কুটীরের কর্ণধারদ্বয় রাজর্ষি মজুমদার ও রূপা মজুমদারকে, ব্যতিক্রমী ও বিতর্কিত বিষয় নিয়ে এই উপন্যাস তাঁদের ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রতিষ্ঠান থেকে বই আকারে প্রকাশ করার জন্য৷
হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত
কলকাতা
Leave a Reply