অসাধু সিদ্ধার্থ – জগদীশ গুপ্ত
প্ৰথম প্ৰকাশ ―১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ (১৩৩৬ বঙ্গাব্দ)
উৎসর্গ
জ্ঞানপিপাসু শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে
.
জগদীশ গুপ্ত ও অসাধু সিদ্ধার্থ
জগদীশ গুপ্তের পুরো নাম জগদীশ চন্দ্র সেনগুপ্ত; জন্ম ৫ জুলাই, ১৮৮৬ এবং ২২শে আষাঢ়, ১২৯২ বঙ্গাব্দ; মৃত্যু ১৫ এপ্রিল, ১৯৫৭। ভারত উপমহাদেশের অন্যতম বাঙালি ঔপন্যাসিক এবং ছোটগল্পকার। জগদীশ গুপ্ত কথাসাহিত্যিক হলেও সাহিত্যিক জীবনের প্রারম্ভে কবিতা লিখেছেন। তার একটি কবিতা সংকলনও আছে।
জগদীশ গুপ্তোর পৈত্রিক নিবাস ফরিদপুর জেলার খোর্দ মেঘচারমি গ্রামে। পিতা কৈলাশচন্দ্র গুপ্ত কুষ্টিয়া আদালতের বিশিষ্ট আইনজীবী ছিলেন। পিতার কর্মসূত্রে জগদীশ গুপ্ত কুষ্টিয়া জেলার আমলাপাড়ায় তার বাল্যকাল কাটে। কলকাতা সিটি কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন জগদীশ গুপ্ত। অতঃপর কলকাতা রিপন কলেজে ভর্তি হন। ১৯০৭ সালে এফ. এ পরীক্ষা দিয়ে কলেজের পাঠ ত্যাগ করেন। পরবর্তীতে কলকাতা কমার্শিয়াল ইন্সটিটিউট থেকে শর্টহ্যান্ড ও টাইপরাইটিং শিক্ষা গ্রহণ করেন।
বীরভূম জেলার সিউড়ি জজকোর্টে টাইপিস্টের চাকরি লাভ করেন ১৯০৮ সালে। সেখানে ৪/৫ বছর চাকরি করার পর উড়িষ্যায় সম্বলপুরে একজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়রের অফিসে পুনরায় টাইপিস্টের চাকরি গ্রহণ করেন ১৯১৩ সালে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মনোমালিন্য ঘটায় চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। অতঃপর কলকাতার “জাগো’স ইঙ্ক” নামের ফাউন্টেনপেনের কালি তৈরির একটি কারখানা খোলেন। এ ব্যবসায় উন্নতি করতে না পেরে ১৯২৭ সালে বোলপুরের চৌকি আদালতে আবারো টাইপিস্টের চাকরিতে যোগদান করেন। সেখানে একটানা ১৭ বছর চাকরি করার পর ১৯৪৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর কুষ্টিষায় বাস করতে থাকেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর কুষ্টিয়া ত্যাগ করে কলকাতায় গমন করেন ও সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।
কবি হিসেবে তিনি প্রথমে আত্মপ্রকাশ করলেও ছোট গল্পকার-রূপে বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন লাভ করেন। ‘বিজলী’, ‘কালিকলম’, ‘কল্লোল’ প্রভৃতি সেকালের নতুন ধরনের সকল পত্রিকাতেই গল্প প্রকাশ করেছেন। গল্প ও উপন্যাসের ক্ষেত্রে প্রকাশভঙ্গির স্বাতন্ত্র্যের জন্য সাহিত্যিক মহলে বিশিষ্ট স্থান দখল করেছিলেন।
ছোটগল্পের বিশিষ্ট শিল্পী ছিলেন জগদীশ গুপ্ত। গভীর জীবনবোধ, সুঠাম কাহিনিবিন্যাস ও চরিত্রচিত্রণের নৈপুণ্যে তার ছোটগল্প সমৃদ্ধ হয়েছে। মনোবৈকল্য ও মনোবিশ্লেষণ এবং দুঃখময়তার নিপুণ বর্ণনায় তার শিল্পকর্ম এক অসাধারণ সৃষ্টি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। সামাজিক অন্যায় অবিচারের চেয়ে অদৃষ্টলিপিই দুঃখময়তার কারণ বলে তার গল্পে বিশ্লেষিত।
জগদীশ গুপ্তের গল্পগ্রন্থ : বিনোদিনী (১৩৩৪); রূপের বাহিরে (১৩৩৬); শ্রীমতি (১৩৩৭); উদয়লেখা (১৩৩৯); শশাঙ্ক কবিরাজের স্ত্রী (১৩৪১); মেঘাবৃত অশনি (১৩৫৪); স্বনির্বাচিত গল্প (১৩৫৭)
উপন্যাস : অসাধু সিদ্ধার্থ (১৩৩৬); লঘুগুরু দুলালের দোলা (১৩৩৮); নিষেধের পটভূমিকায় (১৩৫৯); কলঙ্কিত তীর্থ (১৩৬৭); রোমন্থন
জগদীশ গুপ্তের কবিতা-সঙ্কলন: অক্ষরা
জগদীশ গুপ্তকে নিয়ে গবেষক তার স্মৃতিচারণ থেকে যা বলেন :
গড়িয়ার কাছে রামগড় কলোনির আজকের চেহারা দেখলে সেই সময়ের কোনো হদিস পাওয়া মুশকিল। আশির দশকের গোড়ায় রামগড় কলোনিতে তখনো পায়ে চলা মেঠোপথ, ফাঁকা ফাঁকা মাঠ, চারচালা আটচালার আটপৌরে বসতি। আমি তখন নেহাতই ছোকরা, তরুণ সাংবাদিক। একটা অ্যাসাইনমেন্ট পেয়ে মহাউৎসাহে খুঁজে বের করেছিলাম প্রয়াত জগদীশ গুপ্তের বাসা। খোঁজখবর নিয়ে জেনেছিলাম, জগদীশ গুপ্তের স্ত্রী চারুবালা দেবী তখনো বেঁচে; বয়স অনেক হয়েছে, পাড়ার মেয়ে-বউরা তাঁর দেখাশোনা করে। এত বয়সে তিনি কতটা স্মৃতিচারণ করতে পারবেন, সন্দেহ ছিল। কিন্তু কিছু যদি বলতে পারেন! যা বলেন, সেটুকুই তো লাভ।
তিনি ঠিক কী বলেছিলেন এতদিন পরে তা আর ভালো মনে নেই। খবরের কাগজে প্রকাশিত ইন্টারভিউটাও কবেই হারিয়ে গেছে। এর কয়েক মাস পর চারুবালা দেবী মারা যান। তবু অতীতের কুয়াশা হাতড়ে যেটুকু মনে পড়ে―চারুবালা দেবী বারবার বলার চেষ্টা করছিলেন স্বামী জগদীশ গুপ্তের নির্লিপ্ত জীবনযাপনের কথা। ঘরের একটা কোনা দেখিয়ে বলছিলেন, ওই তো ওখানে তিনি বসে থাকতেন। লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে, কখনো খালি গায়ে। শীতকালে একটা চাদর। বইপত্তর নাড়াচাড়া করতেন। শেষদিকে চোখে ভালো দেখতেন না। ডাক্তারও দেখাতেন না। তার মধ্যেই লেখালিখি চলত। দুটো উপন্যাস শেষ করেছিলেন। অন্ধকার নেমে গেলে মাঝে মাঝে এস্রাজ নিয়ে বসতেন। গান-বাজনায় ছিল দারুণ ঝোঁক।
ভাবতে অবাক লাগে, নিজের সাধনা সম্পর্কে কতখানি আত্মবিশ্বাস থাকলে সারাজীবন এমন নির্লিপ্তভাবে কাটিয়ে দেওয়া যায়। জগদীশ গুপ্ত এমন একটা যুগে লেখালেখি শুরু করেছিলেন, যখন কল্লোলিত হয়ে উঠছে কল্লোল যুগ। রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার আলোয় তখন বিকেলের স্নিগ্ধতা। শরৎচন্দ্র বড় অনায়াসে দখল নিয়েছেন বাঙালি পাঠকের মন। অথচ এমন এক পালাবদলের সময়ে দাঁড়িয়েও জগদীশ গুপ্তের পপুলিজমের ধারপাশ দিয়ে গেলেন না। গ্রাহ্য করলেন না সেন্টিমেন্ট বা রোমান্টিকতার তীব্র জনমোহিনী আকর্ষণকে। উলটে ‘পয়োমুখম’ গল্পে অর্থপিপাসু কবিরাজ-বাবার সামনে তাঁরই দেওয়া মারণ ওষুধ নামিয়ে রেখে বিদ্রোহী ভূতনাথ বলে ওঠে : ‘এ বৌটার পরমায়ু আছে তাই কলেরায় মরল না, বাবা! পারেন তো নিজেই খেয়ে ফেলুন।’ ভাবতে অবাক লাগে, সেই ১৯২৭ সালে এ-গল্প লিখছেন জগদীশ গুপ্ত, যখন পিতৃতান্ত্রিকতার রশি বাঙালির গার্হস্থ্য জীবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। জগদীশবাবুর গল্পের নায়ক ভূতনাথ সেই বাঁধনকে মোটেও গ্রাহ্য করছে না। তার চোখে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে অর্থলোলুপ বাবার বারবার ছেলেকে বিয়ে দিতে চাওয়ার আসল সত্যটি। বাবার দেওয়া ওষুধ খেয়ে প্রথম স্ত্রী মরেছে ভেদবমি হয়ে। দ্বিতীয় স্ত্রীরও মৃত্যু হলো একই ভাবে, ভেদবমির ভয়ানক ধাক্কায়। তৃতীয় স্ত্রীর অসুখের আগেই ভূতনাথ বুঝে গেল, তার তৃতীয় শ্বশুরের কাছ থেকে গোপনে টাকা চেয়ে পাঠাচ্ছেন কবিরাজ বাবা। কিন্তু পুত্রবধূর ইষ্টসাধনের কোনো অভিপ্রায় তাঁর নেই। চিকিৎসকের ছদ্মবেশে তিনি আসলে এক গোপন আততায়ী।
প্রেম নয়, প্রকৃতি নয়, সৌন্দর্যসাধনার নিভৃত নকশিকাঁথা নয়, জগদীশ গুপ্ত তাঁর গল্প-উপন্যাসগুলোকে ধরতে চেয়েছেন চরিত্রের জটিল আলো-আঁধারির দিক থেকে। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘মানুষের বিচিত্র প্রবৃত্তির সঙ্গে যার যত পরিচয়, যত অন্তর্দৃষ্টি, তার গল্প তত বিচিত্র হইবে। কিন্তু জীবনভর সেই প্রবৃত্তির সুলুক-সন্ধান করতে গিয়ে তাঁর কপালে জুটেছে প্রত্যাখ্যান, জুটেছে ‘অ্যান্টি হিরো’র স্রষ্টার অভিধা, বলা হয়েছে : ‘জগদীশ গুপ্ত আগাগোড়া তিক্ত রুক্ষ ও নৈরাশ্যবাদী। তাঁর লেখা পড়লে আমাদের মূল্যবোধগুলি প্রবলভাবে নাড়া খায় এবং আমরা অস্বস্তিবোধ করি’ (সুবীর রায়চৌধুরী)। পরবর্তীকালে সুনীল বঙ্গোপাধ্যায় তো সটান বলে দেন : “তিনি কোনোকালেই সাধারণ পাঠকের মন জয় করতে পারেননি। ইদানীং তিনি সমালোচক ও গবেষকদের মধ্যেই আবদ্ধ।’
অথচ এই অপেক্ষা কি প্রাপ্য ছিল জগদীশ গুপ্তের? সারাজীবন তিনি ছিলেন উপেক্ষিত-অবহেলিত। বিশেষ শ্রদ্ধা বা সম্মান তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসেননি প্রভাবশালী কোনো প্রকাশক। কেউ তাঁকে কোনো সাহিত্য পুরস্কার পদক উপাধি বা সংবর্ধনা দিয়ে সম্মানিত করেনি। জগদীশবাবুর সুহৃদ নন্দগোপাল সেনগুপ্ত ক্ষোভের সুরে লিখছেন : ‘মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারী বাংলায় যাঁরা সাহিত্য ব্যাখ্যার নামে মোটা মোটা বর্ণনাত্মক গ্রন্থপঞ্জি লেখেন, সেই ‘বিদ্বজ্জন’ তাঁর লেখা কখনো পড়ে দেখেননি। সিনেমা রাজ্যের শিল্পপ্রভুরা কোনোদিন তাঁর বইকে রূপ দেননি। উপেক্ষিত এবং প্রায়-অপরিচিত থেকেই বিদায় নিয়েছেন তিনি পৃথিবী থেকে।’
তীব্র অভিমান ছিল স্ত্রী চারুবালা দেবীর মনেও। অন্তরঙ্গ স্মৃতিচারণায় চারুবালা বলছেন : “নিজে লিখতেন খুব মনোযোগ দিয়েই, রেখেও দিতেন যত্ন করিয়া, কিন্তু আর কেহ কিছু যত্ন লইতেন না। সবাই অশ্রদ্ধাই করিয়াছে। নিজে মনে মনে ক্ষুণ্ন হইলেও মুখে কিছু বলিতেন না। চিরদিন লোকের কাছে অবহেলা-অশ্রদ্ধাই পেয়ে এসেছেন। কোনো কথা বলেন নাই। চুপচাপ নিজের কাজ করিয়া গিয়াছেন।’
জগদীশ গুপ্ত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎ পূর্বসূরি ছিলেন বলে সাহিত্যমহলে একটা কথা চালু আছে। মানিকবাবুর ডায়েরি বা চিঠিপত্রে অবশ্য এই প্রচলিত লোকশ্রুতির কোনো সমর্থন নেই। কিন্তু জীবনযাপন তাঁরা কীভাবে করবেন, সাহিত্যের ভাবনা আর আঙ্গিক কোন পথে চালিত করবেন―এ-ব্যাপারে দুজনের আশ্চর্য কিছু মিল ছিল। মানিকবাবু ছাত্রদশাতেই ঠিক করে নিয়েছিলেন, সাহিত্যক্ষেত্রে বড় হবেন। দাদাকে লেখা চিঠিতে তিনি জোরের সঙ্গে জানাচ্ছেন―এই শপথ তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। এবং সে-কাজ করতে গিয়ে অতিতরুণ বয়সে নিজের মন আর মননের ওপর এত বেশি চাপ দিয়ে ফেলেন যে, শরীর-স্বাস্থ্যের কথা মাথাতেই রাখেননি। নিজের স্বপ্নের জগতে ঢোকার জন্য অদ্ভুত এক জেদ, শরীরকে নিদারুণ অবহেলা―সারাজীবন মানিকবাবু এভাবেই কাটিয়ে গেলেন! জগদীশ গুপ্তের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা অনেকখানি তাই। বাবা ছিলেন কুষ্টিয়ার পসারওয়ালা আইনজীবী, আদালতে ভালো প্র্যাকটিস, লোকজন মান্যগণ্য করে। তিনি চেয়েছিলেন জগদীশ তাঁর পেশাতেই আসুক। জগদীশবাবু কিন্তু মোকদ্দমা, মক্কেল, মামলা আর দলিল-দসস্তাবেজের এই পেশা প্রথম থেকেই পছন্দ করেননি। তিনি বেছে নিলেন আদালত চত্বরে টাইপিস্টের চাকরি, সরকার যেমন যেমন কাজ দেবে, তেমন তেমন তাকে টাইপ করে দিতে হবে। এই কাজে যে সম্মানহানির আশঙ্কা আছে, তাচ্ছিল্য দেখাতে পারে আশপাশের লোকজন বা আত্মীয়স্বজন―তা নিয়ে কোনোদিন তাকে বিড়ম্বিত হতে দেখা যায়নি। স্বাধীন পেশাকেই সম্মানজনক মনে করেছেন, সেই বৃত্তির সুবাদে বহু মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণশক্তিতে তাদের জীবনযাপন, জটিলতা, দুঃখ-সুখ, মনের গভীরে প্রবৃত্তির সর্পিল ওঠাপড়া লক্ষ্য করেছেন―আর এসব অভিজ্ঞতার রসায়নে তাঁর লেখায় উঠে এসেছে এমনসব অভাবনীয় চরিত্র, বাংলা সাহিত্যে আগে কখনো যাদের দেখা যায়নি। নিজের উপলব্ধি আর সিদ্ধান্তের প্রতি এরকম অবিচল নিষ্ঠা, মনোরঞ্জনের তরল স্রোতকে সন্তর্পণে ডিঙিয়ে যাওয়ার ঋজুতা লেখক হিসেবে জগদীশ গুপ্তকে এত আলাদা করে দিয়েছে যে, জীবদ্দশায় এমনকি মৃত্যুর পরেও দশকের পর দশক ধরে মুষ্টিমেয় পাঠক ছাড়া তাঁর লেখা কেউ সেভাবে পড়লই না।
এমন হয়েছে, মানুষকে বোঝার জন্য হয়তো বহুক্ষণ রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে রইলেন জগদীশবাবু। কুলি-কামিনদের ঝগড়া দেখছেন, কলতলায় মেয়েদের ঝগড়া দেখেছেন ঠায় দাঁড়িয়ে। সঙ্গে স্ত্রী রয়েছেন, ওর হুঁশ নেই। হঠাৎ কখনো গ্রামে চলে গেলেন। মনের মতো মানুষ পেলে তার সঙ্গে জমিয়ে বসে গল্প। স্বভাবে চাপা অন্তর্মুখী হলেও মজলিশি আড্ডায় জমে যেতে বেশিক্ষণ লাগত না। বেশ ভালো বাজাতেন হারমোনিয়াম, বাঁশি, এস্রাজ আর বেহালা। আর এই চারটি যন্ত্রের সৌজন্যেই জমজমাট হয়ে উঠত আড্ডা। কুষ্টিয়ায় যখন থাকতেন, প্রতিবেশী নন্দলাল সরকারের বাড়িতে চলে যেতেন আড্ডার লোভে। সঙ্গে দেদার চলত চা আর সিগারেট। কর্মসূত্রে সম্বলপুর বা বোলপুরে যখন ছিলেন সেখানেও অনেক বন্ধু, বাড়িতে মাঝে মাঝে তাঁদের খেতে বলতেন। কিন্তু তেমন কেউ জানতেও পারত না, শীর্ণকায় এ-মানুষটি শহরের বড় পত্রিকায় লেখেন। হঠাৎ যখন কোর্টের মধ্যে তাঁর নামে মানি অর্ডার আসত, লোকে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করত ও টাকা কীসের? বিড়ম্বিত জগদীশবাবু মৃদুস্বরে জবাব দিতেন, গল্পটল্প লিখি তো। তাই ভারতবর্ষ টাকা দিয়েছে।
আজ এতকাল পরেও ঠিক বোঝা যায় না, জগদীশ গুপ্তের মতো একজন অন্তর্মুখী নির্লিপ্ত লেখকের গ্রন্থ-সমালোচনায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অমন কোমর বেঁধে নেমে পড়েছিলেন কেন। পরিচয় পত্রিকার প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যায় জগদীশবাবুর লঘুগুরু উপন্যাস নিয়ে রবীন্দ্রনাথের এক দীর্ঘ গ্রন্থ-সমালোচনা বেরোয়। সেকালে তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে রবীন্দ্রযুগকে অগ্রাহ্য করার যেরকম একটা হিড়িক এসেছিল, হতে পারে লঘুগুরুর সমালোচনা তারই এক অনিবার্য প্রতিক্রিয়া। জনে-জনে সবাইকে তো পাকড়াও করা যায় না। রিয়ালিজমের নাম দিয়ে শৌখিন আধুনিকতাকে মুখের মতো জবাব দিতে তাই হয়তো কবিগুরু ‘বেচারা’ জগদীশ গুপ্তকেই বেছে নিয়েছিলেন। নিজের স্বভাবসিদ্ধ উদারতায় বলে নিতে ভোলেননি : ‘এ-কথা মানতে হবে রচনা―নৈপুণ্য লেখকের আছে।’ তারপরেই লেখেন : ‘আধুনিক একদল লেখক পণ করেছেন তারা পুরাতনের অনুবৃত্তি করবেন না। কোনোকালেই অনুবৃত্তি করাটা ভালো নয় একথা মানতেই হবে। মানুষের এমনসব প্রবৃত্তি আছে যার উত্তেজনার জন্য গুণপনার দরকার করে না। অত্যন্ত সহজ বলেই মানুষ সেগুলোকে নানা শিক্ষা অভ্যাসে লজ্জায় সংকোচে সরিয়ে রেখে দিতে চায়, নইলে এরা জীবনকে জঙ্গল করে তোলে। আমার বলবার কথা এই যে, সেসকল তাড়িখানায় সাহিত্যকে সস্তা করে তোলে রিয়ালিজমের দোহাই দিয়ে তার ব্যবসা চালানো কল্পনার দুর্বলতা ঘটাবে।’ (অভিজিৎ দাশগুপ্ত, কালি কলম, https://www.kaliokalam.com)
জগদীশ গুপ্ত নিয়ে আরেক গবেষকের মন্তব্য প্রসঙ্গত উল্লেখ্য
বাংলা সাহিত্যে জগদীশ গুপ্ত কবি হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন। কিশোর বয়স থেকেই জগদীশ গুপ্ত কবি গোবিন্দদাসের (১৮৫৬-১৯১৮) অনুকরণে প্রেমের কবিতা লিখতেন। জীবনের শেষদিন পযর্ন্ত তিনি প্রেমের কবিতা চর্চা করেছেন। তাঁর প্রথম সৃষ্টি থেকে শেষ পযর্ন্ত প্রেম কাব্যই ছিলো অবয়ব। তবে কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও ছোট গল্পকার রূপে বাংলা সাহিত্যে তিনি স্থায়ী আসন লাভ করেছিলেন। ‘বিজলী’, ‘কালিকলম’, ‘কল্লোল’ এবং সেই সময়ের নতুন ধরনের সকল পত্রিকাতেই তাঁর গল্প প্রকাশিত হতো। গল্প ও উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের জন্য তখনকার সময়েই সাহিত্যিক মহলে বিশেষ স্থান পেয়েছিলেন তিনি। মূলত ছোটগল্পের নান্দনিক সমাজ বাস্তবতার শিল্পী ছিলেন জগদীশ গুপ্ত। গভীর জীবনবোধ, সুনিপুণ কাহিনীবিন্যাস ও চরিত্রচিত্রণের নৈপুণ্যতায় তাঁর ছোটগল্প সমৃদ্ধ ও সার্থক হয়েছে। মনোজগৎ মনোবিশ্লেণ এবং দুঃখময়তার নিপুণ বর্ণনায় তাঁর শিল্পকর্ম এক অসাধারণ সৃষ্টি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে বাংলা সাহিত্যে। সামাজিক অন্যায়-অবিচারের থেকে অদৃশ্যময় ভাবনার কারণ তাঁর গল্পে বেশি বিশ্লেষিত হয়েছে। জগদীশ গুপ্তর গল্প সম্পর্কে অধ্যাপক মাহবুবুল আলম তাঁর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন―‘বাংলা সাহিত্যে জগদীশ গুপ্ত অবচেতন মনের গতির প্রথম শক্তিমান শিল্পী। তাঁর রচনার প্রধান গুণ নির্মম নিরাসক্তি। তাঁর কাহিনীর নায়কেরা সাধারণ জাতির নিচু শ্রেণীর মানুষ। এক দুর্বার, অনিবার্য, নিয়তিবাদ, তাঁর কাহিনীর মূল সুর। এক অন্ধশক্তি মানুষের ভাগ্য নিয়ে খেলা করে। তাঁর গল্পে মানুষ যেন এক অন্ধশক্তির পুতুল।’
ঔপন্যাসিক হিসেবে যথেষ্ট সুখ্যাতি ও পারদর্শিতা অর্জন করেলেও জগদীস গুপ্ত গল্পকার হিসেবেই অত্যাধিক সুনাম অর্জন করেছিলেন। ১৩৩১ সালের ফাল্গুন ও কার্তিক সংখ্যায় জগদীশ গুপ্তের প্রথম গল্প ‘পেয়িং গেস্ট’ দ্বিতীয় ‘পল্লী শ্মশান’ প্রকাশিত হয়। বাংলা ১৩৩৪ ও ইংরেজি ১৯২৭ সালে কুষ্টিয়ার মোহিনী মিলের তৎকালীন ম্যানেজিং ডিরেক্টর দেবী প্রসাদ চক্রবর্তী ওরফে কানু বাবু তাঁর নয়টি গল্প নিয়ে ‘বিনোদিনী’ নামক গল্পগ্রন্থ প্রকাশ করেন। জগদীশ গুপ্তের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে তাঁর সুহৃদদের বাইরে বোধ হয় ‘মানসী ও মর্মবাণী’ (শ্রাবণ ১৩৩৫) পত্রিকাতেই তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘বিনোদিনী’কে (পৌষ ১৩৩৪) উপলক্ষ করে আনুষ্ঠানিক আলোচনার সূচনা হয়। রবীন্দ্রনাথও ‘বিনোদিনী’ সম্পর্কে প্রশংসা করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘ছোটগল্পের বিশেষ রূপ ও রস তোমার লেখায় পরিস্ফুট দেখিয়া সুখী হইলাম।’ কবির এ যাবৎ কালের প্রাপ্ত তথ্যানুসারে জগদীশ গুপ্তর জীবদ্দশায় প্রায় ৩৫টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিলো। এর মধ্যে অধিক উল্লেখযোগ্য ৮টি গল্পগ্রন্থ ও ১২টি উপন্যাস। গল্পগ্রন্থগুলো হলো―রূপের বাহরে (১৯২৯), পাইক শ্রীমিহির প্রামাণিক (১৯২৯), শ্রীমতি (১৯৩১), উপায়ন (১৯৩৪), শশাঙ্ক কবিরাজের স্ত্রী (১৯৩৫), গতিহারা জাহ্নবী (১৯৩৫), মেঘাবৃত অশাণি (১৯৪১), নন্দা আর কৃষ্ণা (১৯৪৭) এবং, স্বনির্বাচিত গল্প (১৯৪৭)। উপন্যাস হলো―অসাধু সিদ্ধার্থ (১৯২৯), মহিষী (১৯২৯), লঘুগুরু (১৯৩১), দুলালের দোলা (১৯২৯), রোমস্থন (১৯৩০), উদয় লেখা (১৯৩২), তাঁতল সৈকত (১৯৩৩), সুতিনী (১৯৩৩), রতি বিরতি (১৯৩৪), যথাক্রমে (১৯৩৫), নিষেধের পটভূমিকা (১৯৫২), দয়ানক মল্লিক ও মল্লিকা (১৯৩৯) এবং, কলঙ্কিত তীর্থ (১৯৬০)। এছাড়া বাঁকি গ্রন্থগুলিও প্রকাশিত হয়েছিলো বিভিন্ন সময়ে। তাঁর কবিতা গ্রন্থের নাম ‘অক্ষরা’। ১৯৩৩ সালের ‘দীপিকা’ পত্রিকায় ‘এক প্রহরের পায়ের তলায় ‘ উপন্যাসের বিজ্ঞাপনের অস্তিত্বও সে সময় লক্ষ করা গিয়েছিলো। তবে বর্তমান প্রজন্মের কাছে এসকল তথ্য আজ অলৌকিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আদি কথার একটি, রসাভাস, হাড়, আশা ও আমি, পয়োমুখম ইত্যাদি গ্রন্থগুলি জগদীশ গুপ্তের অসাধারণ সৃষ্টি।
বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বিশ্ব যখন হতাশা, দুরাশা, মানবতার অপমৃত্যু, ব্যর্থতা আর গ্লানির বিষে জর্জরিত; তখন ফ্রয়েডীয় সর্বোপরি ‘ঈশ্বরপরংস’ চিন্তা-ভাবনার সুর প্রতিধ্বনিত করেছেন জগদীশ গুপ্ত তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে। ফ্রয়েডীয়কে জগদীশ গুপ্ত কতটুকু জানতেন―চিনতেন তা বলা বাহুল্য। কিন্তু ফ্রয়েডীয় যৌন―মনস্তত্ত্বের ভাব জগদীশ গুপ্তের শিল্পীমন ও রচনায় পড়েছিলো। জগদীশ গুপ্তের রচনায় আবিষ্কৃত হয়েছে মানুষের মন, মৌনতা, যৌনতা, বিশ্বাস, অভ্যাস, প্রবণতা ও আচরণগত বিস্ময়কর ঘটনার প্রতিচ্ছবি। সুন্দর মুখোশের আড়ালে হঠাৎ হঠাৎ বেরিয়ে এসেছে বিকৃত মুখের ছবি। এই সূত্রে অনেকেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিল্প-মানসে জগদীশ গুপ্তের প্রভাব অনুমান করেছেন। মানিকের ‘পূর্বসূরি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন তিনি। তৎকালীন সময়ে কেউ কেউ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে জগদীশের ‘মন্ত্রশিষ্য’ বলে উল্লেখ করেছেন। কেউ আবার ‘পরোক্ষ প্রভাব’ স্বীকার করেছেন। তবে এ বিষয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বীকারোক্তি কখনো মেলেনি। অশোক গুহের মতে―‘…এঁরা দুজনে একই কলমের, একই স্কুলের লেখক, স্বগোত্র। দুজনই আঞ্চলিক ভাষার সুষ্ঠু প্রয়োগ করেছেন, দুজনেই বিশ্লেষণী বুদ্ধিতে সমুজ্জ্বল, দুজনেই হাতড়ে বেড়িয়েছেন কার্য-কারণ।’ এছাড়া বাংলা সাহিত্যের “কল্লোল” যুগে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১) ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়সহ (১৯০৮-১৯৫৬) বহু সাহিত্যিককে তিনি সাধারণভাবে মাটি ও মানুষের কাছে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন অত্যন্ত সহজ ভাবেই।
জগদীশ গুপ্ত সমন্ধে উপমহাদেশের বিশিষ্ট লালন গবেষক ও প্রাবন্ধিক আবুল আহসান চৌধুরী তাঁর ‘পতিতার ভূত: রবীন্দ্রনাথ ও জগদীশ গুপ্ত’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন―‘রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র বাংলা কথাসাহিত্যের যে আদর্শ নির্মাণ করেছিলেন, উত্তরপর্বে সেই রুচি, রূপ, রীতি ও বিশ্বাসকে অগ্রাহ্য ও বিচূর্ণ করে কথাসাহিত্যে যে পালাবদল এসেছিল, এক ভিন্ন অর্থে জগদীশ গুপ্ত ছিলেন তার প্রধান ঋত্বিক। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনার কার্য-কারণ সূত্রে পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক কাঠামোর অন্তর্গত সংকট ও সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে জীবন-অন্বেষা ও সমাজ-বাস্তবতার যে শিল্প-ভুবন নির্মিত হয়েছিল, তিনিই ছিলেন তার উদ্বোধক ও শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি। মানুষের অস্তিত্বের সংকট, মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, তার প্রবল প্রবৃত্তির নগ্ন রূপের বিস্ময়কর উন্মোচন ঘটেছে তাঁর সাহিত্যে, যার তুলনা বা সাদৃশ্য পূর্বাপর বাংলা সাহিত্যে প্রায় দুর্লক্ষ্য। জীবনের প্রত্যয় ও প্রত্যাশা কীভাবে বিনষ্ট হয়েছে প্রবৃত্তি আর সমাজ-শাসনের যৌথ ক্রিয়ায় তার রূপায়ণও এখানে স্পষ্ট। প্রকৃতপক্ষে এক ‘শাস্ত্রবিরোধী’ শিল্প-ধারার প্রবর্তন করে তিনি কথাসাহিত্যের ভূগোলকে সম্প্রসারিত করেছেন। অথচ এই ব্যতিক্রমী অনন্য শিল্পসাধক স্বকালে উপেক্ষিত, উত্তরকালে প্রায়-বিস্মৃত। প্রচারকণ্ঠ, আত্মমুখী, নির্লিপ্ত স্বভাবের এই ‘অন্তরালের সাহিত্যিকে’র প্রতি তাঁর সমকালে প্রসিদ্ধ প্রকাশক, পেশাদার সমালোচক কিংবা বৃহত্তর পাঠকসমাজ, কারোরই তেমন মনোযোগ আকৃষ্ট হয়নি। তবে এ-কথা আশা আর আনন্দের যে, জগদীশ গুপ্ত সম্পর্কে উত্তরকালের পাঠক―সমালোচক-প্রকাশকের আগ্রহ ও অনুসন্ধিৎসা জেগেছে, ফলে এই সৎ প্রয়াসে হয়তো পূর্বযুগের অবহেলা, কর্তব্যচ্যূতি ও অমনোযোগের ক্ষতিপূরণ হতে পারবে।’
কালের বিবর্তনে আজ জগদীশ গুপ্তর অসাধারণ সাহিত্য সৃষ্টি এখন সাহিত্যের আড়ালে। একবিংশ শতাব্দীর এই অত্যাধুনিক যুগে জগদীশ গুপ্ত কে খুঁজে পাওয়া দুরূহ ব্যাপার। কোন স্মৃতি নেই। জনসম্মুখে সাদৃশ্য নেই। জগদীশ গুপ্তের পিতা ছিলেন কুষ্টিয়া আদালতের বিশিষ্ট আইনজীবী। পিতার কর্মসূত্রে জগদীশ গুপ্ত কুষ্টিয়া জেলা শহরের আমলাপাড়ায় বাবা কৈলাস চন্দ্র গুপ্ত ও মা সৌদামিনী দেবীর ঘরে ১৮৮৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃকনিবাস রাজবাড়ী জেলার (তৎকালীন ফরিদপুর জেলা) খোর্দ মেঘচামী গ্রামে। বাবার কর্মস্থলে বেড়ে উঠলেও সময় পেলেই স্ত্রী চারুবালা গুপ্তকে নিয়ে জগদীশ গুপ্ত তার পূর্বপুরুষের বাস্তুভিটা ‘মেঘচুম্বী গ্রামের আনন্দ ভবনে এসে দীর্ঘ সময় কাটাতেন। এই গ্রামের ঐতিহ্য রাজা সীতারাম রায়ের গড়, রামা সুন্দরী স্টেট, চন্দনা নদীর তীর ঘেঁষা পুড়াভিটা ও ছাইভাঙা গ্রামের মাটি আর মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে অভিজ্ঞতার জ্ঞান থেকে রচনা করেছেন তাঁর অসামান্য গল্প, নাটক, উপন্যাস, কবিতা আর প্রবন্ধ। তবে ১৯৫৭ সালে ১৪ এপ্রিল জগদীশ গুপ্তের মৃত্যুর পর স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে কোন প্রতিভাবান শিল্পী-সাহিত্যিক বা ইতিহাসবিদ ব্যক্তি কিংবা সরকারি-বেসরকারিভাবে কোন প্রতিষ্ঠান উদ্যোগ গ্রহণ করেননি এই কিংবদন্তি সাহিত্যিক পুরুষকে নিয়ে। যা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের সাহিত্যের ইতিহাসের জন্য কলঙ্কিত অধ্যায়। কিন্তু তিনি আমাদের যা দিয়ে গেছেন তা সাহিত্যের ইতিহাসে অমর সৃষ্টি। শত ব্যস্ততা, শত সাহিত্যিক, শত উৎসবের মধ্যেও এই অবহেলিত সাহিত্যিক জগদীশ গুপ্তর রচিত নীরব সাহিত্য যদি আমাদের মধ্যে কখনো কখনো একটু উৎসাহ আশা ও ভালোলাগার জন্ম দেয় তাহলেই সার্থক হবে তাঁর রচনা। এই হোক প্রজন্মের প্রত্যাশা ও ছোটগল্পের নান্দনিক সমাজ বাস্তবতার শিল্পী জগদীশ গুপ্তর ছোট গল্পের সার্থকতা।
(https://m.facebook.com/theArshinagar/posts/597698803703694: )
জগদীশ গুপ্তের প্রথম উপন্যাস অসাধু সিদ্ধার্থ। এটি প্রথম কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ (১৩৩৬ বঙ্গাব্দ) এর প্রকাশক ছিলেন রাখহরি শ্রীমানী এন্ড সন্স থেকে। এই উপন্যাসে কেন্দ্রীয় চরিত্র সিদ্ধার্থ যার প্রকৃত নাম নটবর। যে বৈষ্ণবীয় গর্ভে এক ব্রাহ্মণের জারজপুত্র। জারজপুত্র নটবরের জীবনের টানাপোড়েনই উপন্যাসে মৌলবিষয়। ঔপন্যাসিক মানবরহস্যের অতলান্ত খনন করতে বদ্ধপরিকর। পৃথিবীতে মানুষ অসাধ হয়। কিন্তু জন্মই যদি অসাধু হয় তবে সে দায়টা কার? সেই দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন ঔপন্যাসিক। নটবরের উক্তিতে তাকে জানা যায়। প্রসঙ্গত :
নটবর সেকথা কানেও তুলিল না। রজতের দিকে চাহিয়া অসঙ্কোচে বলিল―ভগবান জানেন আমি নিরপরাধ। নিয়তির চক্রান্তে ভালোবেসেছিলাম। ভালোবাসার তাড়নায় আর প্রতিদানের লোভে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছি। কিন্তু আমি তো সেই মানুষ। (পৃষ্ঠা-১৫২)
অসাধু সিদ্ধান্ত উপন্যাসের আখ্যান বর্ণিত হয়েছে আঙ্কিক সংখ্যায়। ঔপন্যাসিক নটবরের জীবনসংলগ্ন বিভিন্ন ঘটনা একসূত্রে গেঁথে আখ্যানবিন্যাস করেছেন। বর্ণনার ভঙ্গিতে বিশ্লেষণাত্মকরীতি পরিগ্রহিত হয়েছে। উপন্যাসে মোট সতেরটি প্রচ্ছদ আছে। এই সতেরটি পরিচ্ছেদের ঘটনা একসূত্রে গেঁথে তিনি উপন্যাসের প্লট সংস্থান করেছেন।
এই উপন্যাসের বিচিত্র চরিত্রের সন্ধান মেলে। নটবর, অজয়া রজত কাশিনাথ, রাসবিহারী, দেবরাজ বিমল প্রধান অপ্রধান চরিত্র মিলে এই উপন্যাসের কাঠামো নির্মিত। কেন্দ্রীয় চরিত্র নটবর ও অজয়া। চরিত্রগুলো প্রত্যেকের প্রেক্ষণবিন্দু থেকে উজ্জ্বলতর। নটবর চরিত্র জীবনের গভীর রহস্যলোকের কর্ণধার। যে কি না মানবজন্মের রহস্য উন্মেচনে বদ্ধপরিকর।
উপন্যাসটির ভাষারীতিতে সাধুভঙ্গির ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। গুরুগম্ভীর সাধু ভাষা হলেও কাব্যময়তার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। ঔপন্যাসিক এই উপন্যাসের ভাষাকে বিদ্যাসাগরীয় রীতিতে করার মানসে কিছু কারুকাজ ও প্রকৃতি বর্ণনার মুখোমুখি হয়েছেন। এই উপন্যাসের ভাষাতে সংলাপধর্মী বৈশিষ্ট্যও প্রতিভাত হয়েছে। যেমন :
সিদ্ধার্থের মনে হইল, জীবনের অন্তহীন ধারা একটিমাত্র স্তবকে সীমাবদ্ধ হইয়া একটি রেখায়র সম্মুখে গতিহীন হইয়া পড়িয়াছে। ঐ রেখাটি উত্তীর্ণ হইতে সিদ্ধার্থেও মন কিছুতেই চাহিল না।
সিদ্ধার্থের মরা হইল না। (পৃষ্ঠা-৮)
উপন্যাসের ঘটনা সংঘটনের জন্য পরিবেশের সবিবেশ গুরুত্ব আছে। ঔপন্যাসিক শুধুমাত্র ঘটনা সংঘটনের স্থান হিসেবে পরিবেশ নির্মাণ করেন না, উপন্যাসের বিষয় ও জীবনদর্শন মূর্ত করতেও উপন্যাসের পরিবেশ নির্মিত হয়। আলোচ্য উপন্যাসের পরিবেশ হিসেবে ভৌগোলিক পরিবেশের পাশাপাশি স্থানিক পরিবেশের বর্ণনা আছে। পরিবেশ নির্মাণে প্রতীকময়তারও আশ্রয় নেন ঔপন্যাসিক।
উপন্যাসের পরিচর্যারীতিতে ঔপন্যাসিকের সজাগ মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। দৃষ্টিকোণে সর্বোজ্ঞতা আছে। সবমিলে উপন্যাস শিল্প জীবনের তয়োধীঘেরা অজস্র তরঙ্গমালার স্পন্দন সেটি প্রতিভাত হয়েছে আলোচ্য উপন্যাসে
জগদীশ গুপ্তের শিল্পরচনার পশ্চাতে তার নিজেরই কথা উদ্ধৃত করা যায় :
এত লোক থাকিতে আমারই এই গল্পগুলি লিখিবার কি দরকার পড়িয়াছিল তাহার একটু ইতিহাস আছে। সেই অনাদি নর ও নারী।
আমার স্ত্রী আলসে মানুষ দু’চক্ষে দেখিতে পারেন না। আমি হাত পা গুটাইয়া নিস্তব্ধ হইয়া বসিয়া আছি দেখিলেই তিনি আমার হাতে একটি পয়সা দিয়া বাজারে পাঠাইয়া দেন; বলেন, ধনে নিয়ে এস; কোনোদিন বলেন, পান; কোনোদিন, কাঁচালঙ্কা; কোনোদিন, সোডা; কোনোদিন, মউরি; কোনোদিন আর কিছু। কিন্তু ঐ এক পয়সার; কোনোদিন তার বেশী নয়।
হঠাৎ একদিন আপত্তি করিয়া বসিলাম, এবং আমার সে দুর্মতির শাস্তি তিনি হাতে হাতেই দিলেন; তাঁর সেই অননুকরণীয় ভূভঙ্গী সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিল; বলিলেন,―আর কোনো উপকার না হোক, বাতের হাত থেকে বাঁচবে।
পয়সাটি হাতে করিয়া ধনে আনিতে রওনা হইলাম। আসা-যাওয়ার বাজার সওয়া ঘণ্টার পথ; এবং পথের সমস্তটাই বাত-নিবারক।
এমনি করিয়া অমূলক বাতের ভয়ে বাজারে হাঁটিতে হাঁটিতে হঠাৎ ফাঁকি দিবার একটি ফন্দি মিলিয়া গেল।
পরদিনই কাগজ আর পেন্সিল লইয়া উদ্ধনেত্র এবং চিন্তাগ্রস্ত হইয়া বসিলাম, এবং বসিয়াই রহিলাম। প্রিয়ম্বদা ঘরে ঢুকিয়া লিখিবার সারঞ্জামগুলি লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, ও-গুলো নিয়ে কি হচ্ছে?
উদ্ধনেত্র তাঁহার দিকে নামাইয়া মনে মনে হাসিয়া বলিলাম,―বাজারে আর যাচ্ছিনে। প্রকাশ্যে বলিলাম, একটা গল্পের কথা ভাবছি!
এবং, প্রিয়ম্বদার ঠোঁটের কোণে হাসির উদয়শিখরে অতিশয় তীক্ষ্ম হাসির একটি অঙ্কুর উঠিতে দেখিয়াই মনের লঘু ভাবটা একনিমিয়ে কাটিয়া গেল; তাড়াতাড়ি করিয়া বলিলাম,―সবাই ত’ গল্পটল্প লেখে দেখি, দেখি আমিও যদি দৈবাৎ পেরে উঠি―বলিয়া অত্যন্ত কাপুরুষের মত শুষ্কমুখে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলাম, যেন গল্প লিখিতে পারিয়া উঠিব কি না সেই মুহূর্তে সেইটাই আমার নিদারুণ ভাবনা।
কিন্তু আসল কথা, আসা-যাওয়ার বাজার পুরো সওয়া ঘণ্টার পথ, এবং বাতের ভয় আমার নাই।
কি ভাবিয়া প্রিয়ম্বদা আমাকে সে-যাত্রা ক্ষমা করিয়া ফিরিয়া গেলেন।
হঠাৎ এক ধাক্কা―
ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া বসিয়া দেখিলাম, প্রিয়ম্বদা সম্মুখে দাঁড়াইয়া হাসিতেছেন। বলিলাম,―একটু তন্দ্রামত এসেছিল।–বলিয়া এমনি করিয়া একটু হাসিবার চেষ্টা করিলাম, যাহার মত হৃদয়বিদারক ব্যাপার জগতে খুব কম ঘটে।
গল্পের প্লট যাহার উপর লিপিবদ্ধ করিবার অভিপ্রায় ছিল, সেই কাগজখানা প্রিয়ম্বদা ফস করিয়া টানিয়া লইয়া সশব্দে পড়িতে লাগিলেন, শ্রীশ্রীদুর্গাপূজার ঘটনা, হাইকোর্ট; ওয়াটার-টাওয়ার; এক পয়সার মিঠেকড়া তামাক; ঢোঁড়া মিয়া; মালিনী তোর রঙ্গ দেখে অঙ্গ জ্বলে যায়; পয়সার দুটো শঁশা, বিভূতি চৌধুরী, রামনবমী; তারি সনে দেখা হ’লে; হাতুড়ে।
টানিয়া টানিয়া পড়িতে লাগিলেন; আর, আমার মনে হইতে লাগিল মানুষের সব দুর্গতিরই যদি সীমা থাকে তবে তা আসিতে কত দেরী?
এ-সব গল্প বিলেত পাঠাবে না দেশী কাগজেই দেবে? বলিয়া কাগজখানা আমার পাশে ছুড়িয়া দিয়া প্রিয়ম্বদা চলিয়া গেলেন।
ঘাড়ের উপর জগদ্দল বিপদের পাথর চাপিয়া রহিল, কিন্তু দমিলাম না,―বহুক্লেশে পাঁচদিনের দিন গল্প একটী তৈরী হইল; এবং তাহাকেই অবলম্বন করিয়া আরো চারদিন বাজারকে ফাঁকি দিলাম।
কিন্তু সে যন্ত্রণাও ভুলিবার নয়।
এই হইল সুরু; এবং এখনও সেইভাবে চলিতেছে। বসিয়া বসিয়া খুঁটি ঠেস দিয়া কলম নাড়িয়া যদি ফাঁকি দেওয়া যায় তবে কে এখন ধনে আনিতে বাজারে দৌড়ায়?
যাহার জন্মের ইতিহাস এইরকম সে যে মানুষকে আনন্দ দিবে, নূতন কিছু দিবে সে বিশ্বাস আমার কদাপি নাই।
আমার দুইটি অশেষ হিতৈষী পরমবন্ধুর সহায়তায় এই গ্রন্থ র মুদ্রিত হইল; শ্ৰীযুত শান্তিরাম চক্রবর্ত্তী মহাশয়ের উদ্যোগ এবং শ্রীযুত ব্রজজনবল্লভ বসু মহাশয়ের অর্থানুকূল্য। আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা এবং শুভেচ্ছা তাঁহারা গ্রহণ করুন।
আবরণপত্রের চিত্রখানি পরিকল্পনা করিয়াছেন প্রসিদ্ধ শিল্পী শ্রীযুক্ত দীনেশরঞ্জন দাস। আমি তাঁহার নিকট ঋণী রহিলাম। (সূত্র : http://galparong.blogspot.com /2014/08/blog-post)
জগদীশ গুপ্ত নিয়ে গবেষকের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য : বিশ শতকে বাংলা সাহিত্যে যে বিস্ময়কর আধুনিকতার সূচনা, তার বড় কৃতিত্ব কল্লোল পত্রিকার (প্রতিষ্ঠা ১৯২৩, কলকাতা)। পরে উত্তরা, প্রগতি, কালিকলম, পূর্বাশা অনেক পত্রিকাই কল্লোলের অনুসরণে আধুনিক সাহিত্য সৃজনের পৃষ্ঠপোষক হয়। সাহিত্যের এই নবতর উদ্বোধন কল্লোল যুগ নামে পরিচিত। বিশ ও ত্রিশের দশকের প্রতিভাধর কবি ও কথাসাহিত্যিকদের আবির্ভাব এই সাহিত্য আন্দোলনেরই ফসল। এ যুগের সূচনাকালে বাংলা সাহিত্য ছিল রবীন্দ্র প্রভাবে পরিকীর্ণ। একদল সৃষ্টিশীল তরুণ পাশ্চাত্য আধুনিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন এবং রবীন্দ্র-ধারার বাইরে গিয়ে একটি স্বতন্ত্র ও মৃত্তিকা সংলগ্ন সাহিত্যরূপ দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। তাঁরা কেবল উচ্চতর জীবনের গল্পই শোনাননি, শুনিয়েছেন জীবনের ক্লেদ-গ্লানি, লোভ, অসহায়ত্ব, জিঘাংসা এবং রুখে দাঁড়ানোর কথা। ফ্রয়েড এবং মাক্সের দর্শন তাঁদের প্রভাবিত করেছিল দারুণভাবে। চেয়েছিলেন। তাঁরা কেবল উচ্চতর জীবনের গল্পই শোনাননি, শুনিয়েছেন জীবনের ক্লেদ-গ্লানি, লোভ, অসহায়ত্ব, জিঘাংসা এবং রুখে দাঁড়ানোর কথা। ফ্রয়েড এবং মাক্সের দর্শন তাঁদের প্রভাবিত করেছিল দারুণভাবে।
কল্লোল যুগের প্রায় অপরিচিত কিন্তু অনন্য কথাসাহিত্যিক জগদীশ গুপ্ত (১৮৮৬ ―১৯৫৭)। তিনি কল্লোল কালের হলেও কখনোই কল্লোলীয় সাহিত্য আন্দোলনের মূল ধারার সঙ্গে যুক্ত হননি। এমনকি কখনো কল্লোলের অফিসেও যাননি, কেবল তাঁর লেখা পাঠিয়েছেন। কয়েকজন প্রকাশক ছাড়া অন্যদের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয়ও ছিল না। প্রচারের বাইরে থেকে নিভৃতে, নির্জনে সাহিত্যচর্চা করে গেছেন। কিন্তু এমনই অভিনবত্ব তিনি নিয়ে এসেছিলেন যে, সমকাল এবং উত্তরকাল কেউই তাঁকে সাদরে গ্রহণ করতে পারে নি। কেবল বোদ্ধা সাহিত্যিক মহলে তাঁর অটুট গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তিনি আধুনিক কথাসাহিত্যের নির্মাতা বা প্রথম আধুনিক গল্পকার। রবীন্দ্রনাথ―প্রভাতকুমার-শরৎচন্দ্রের সাহিত্য বলয়ের বাইরে গিয়ে তিনি অদৃষ্টপূর্ব এক সাহিত্য জগত নির্মাণ করেছেন। মোটামুটিভাবে ১৯২৬ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তাঁর কথকতার কাল। সাহিত্য সমালোচক সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন,
জগদীশ গুপ্ত কল্লোলের কালবর্তী এবং সঙ্গে সঙ্গে একথাও সত্য যে কল্লোলের যা মূল বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত ছিল তা একমাত্র জগদীশ গুপ্তের রচনাতেই অভিব্যক্ত।
জগদীশ গুপ্তের পরিবারের আদিনিবাস বর্তমান বাংলাদেশের রাজবাড়ি জেলায়। পিতা কৈলাশচন্দ্র গুপ্ত, মাতা সৌদামিনী দেবী এবং স্ত্রী চারুবালা গুপ্তা। পিতার কার্যোপলক্ষে তাঁরা কুষ্টিয়ায় বাস করতেন। কৈলাশ গুপ্ত ছিলেন কুষ্টিয়া আদালতের নামকরা আইনজীবী এবং বিখ্যাত ঠাকুর এস্টেটের আইন উপদেষ্টা। তাঁদের আত্মীয়কুলে অনেকেই আইনজীবী ছিলেন। জগদীশ গুপ্তের পরিবারের সাথে কয়েকজন সাহিত্যিকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তাঁর মা সৌদামিনী দেবী নিবিষ্ট সাহিত্য পাঠক ছিলেন। বঙ্কিম, মধুসূদন, হেমচন্দ্র, রমেশচন্দ্রের রচনার সাথে তাঁর পরিচয় ছিল, যা জগদীশ গুপ্তকে সাহিত্যিক হয়ে উঠতে প্রাণিত করেছিল।
জগদীশ গুপ্তের শৈশব অভিজ্ঞতা অনেক বিচিত্র। তাঁদের কুষ্টিয়ার বাড়ির প্রতিবেশে অনেক গণিকার বাড়ি ছিল, যাঁরা বিভিন্ন বাড়িতে ঝিয়ের কাজ, আতুর পাহারার কাজ করতেন এবং ঘর ভাড়া করে থাকতেন। তাঁদের সাথে গুপ্ত পরিবারের সম্পর্ক ছিল আত্মীয় বা প্রতিবেশীর মতই ঘনিষ্ঠ। জগদীশ গুপ্তকে তাঁরা ছেলেবেলায় দেখাশোনাও করতেন। তাঁর মা কখনো এই মহিলাদের ঘৃণার পাত্র হিসেবে দেখেননি বরং অনেকের সাথেই আন্তরিক সম্পর্ক রেখেছিলেন। জগদীশ গুপ্তের অনেক গল্প উপন্যাসে গণিকা চরিত্র এসেছে। চৌদ্দ-পনের বছর বয়সে তিনি একবার কুষ্টিয়ার গড়াই নদীতে সাঁতার কাটতে গিয়ে ডুবে যাচ্ছিলেন। তাঁর সতীর্থ সতীনাথ কর্মকার তাঁকে বাঁচিয়ে আনেন। তাঁর স্ত্রী চারুবালা গুপ্তা অনুমান করেন, এ ঘটনা তাঁর দিবসের শেষে গল্পের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকতে পারে।
জগদীশ গুপ্ত কুষ্টিয়া হাই স্কুলের ছাত্র ছিলেন। কিন্তু এখানে তিনি পড়া শেষ করতে পারেননি। কারণ, তিনি পাঠ্যপুস্তকের আড়ালে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস পড়তেন এবং ভাওয়ালের কবি গোবিন্দচন্দ্র দাসের কবিতার অনুকরণে নারীপ্রেমে কাতর কবিতা লিখতেন, যা বড়রা পছন্দ করতে পারেন নি। তাঁকে কলকাতায় পাঠানো হয়। সেখানে তিনি এন্ট্রান্স পাশ করে রিপন কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু এখানেও তিনি লেখাপড়া শেষ করেন নি। তাঁর পিতার ইচ্ছা ছিল তিনি আইন বিষয়ে পড়া শেষ করে ওকালতি করবেন। এতবড় পরিবারের সন্তান হয়েও শেষ পর্যন্ত তিনি টাইপিস্ট হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর পেশাকে সামান্য বিবেচনা করে তাঁর পরিবার লোকলজ্জা ও মর্যাদার ভয়ে তাঁকে কুষ্টিয়ায় চাকরি করতে দেননি। তিনি কিছুকাল ফাউন্টেন পেনের কালি তৈরির ব্যবসা করেছিলেন, নাম ছিল Jago’s Ink, কিন্তু এক্ষেত্রেও তিনি ব্যর্থ হন। অনুমান করতে কষ্ট হয় না, সাহিত্যে আত্মনিবেদনের জন্যই তাঁর জীবনের এই উচ্চাভিলাষহীনতা। (সূত্র : https://tuhintalukder.wixsite.com/writing/single-post)
জগদীশ গুপ্ত এভাবেই হয়ে উঠেন অনন্য। কথাসাহিত্যের তাঁর আছে একটা বিশেষ স্থান। সেই শিল্পময় স্থানের জন্য তিনি যেমন স্মরণীয় তেমনি বরণীয়।
শাফিক আফতাব
সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
লতিফ ভূইয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ
ঢাকা।
Leave a Reply