অশুভ সংকেত – ডেভিড সেলজার
অনুবাদ : কাজী মাহবুব হোসেন
প্রথম প্রকাশঃ নভেম্বর, ১৯৮২
সূচনা
চোখের পলকে ঘটনাটা ঘটে গেল। দীর্ঘ সময় লাগাই যেন গ্যালাক্সির বিশাল আয়তন আর আকার-আকৃতি অনুযায়ী মানানসই হত—কিন্তু বাস্তবে নিমেষেই শেষ হয়ে গেল ব্যাপারটা।
কেপ হ্যাটির জ্যোতিষাগারে পর্যবেক্ষণরত যুবক জ্যোতির্বিৎ টেলিস্কোপের ভিতর দিয়ে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে চেয়ে রইল আকাশের দিকে। সুইচ টিপে ক্যামেরা চালু করতে একটু দেরি করে ফেলেছে সে, তাই আর তিনটে তারা-মণ্ডলী ভেঙে চুরমার হয়ে আবার একত্রে মিলিত হবার ছবিটা ক্যামেরায় ধরা পড়ল না। কর্কট, মকর আর সিংহ রাশির তারা থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা টুকরোগুলো চুম্বকের মত পরস্পরের দিকে অমোঘ আকর্ষণে আকৃষ্ট হয়ে যেন জাদুমন্ত্রের বলে একটা অদ্ভুত কালচে উজ্জ্বল আভার তারায় পরিণত হল। আলো একবার নিষ্প্রভ, আবার জোরাল হয়ে উঠছে। সেই সাথে থরথর করে কেঁপে কেঁপে উঠছে বিশ্ব—ব্রহ্মাণ্ড নাকি তার টেলিস্কোপ ধরা হাতটা উত্তেজনায় কাঁপছে বলেই এমন মনে হচ্ছে?
জ্যোতির্বিৎ একবার ভাবল এটা বুঝি তার নিজস্ব কল্পনা। কিন্তু না—পৃথিবীর গভীর থেকে উঠে আসছে একটা অস্পষ্ট শব্দ। মানব কণ্ঠস্বর কিন্তু কেমন যেন বিকৃত। তারার আলোর সাথে শব্দও বেড়ে উঠছে। গুহায়, খোলা মাঠে, মাটির নিচে, ঘরে সব জায়গাতেই জড়ো হয়েছে ওরা—ধাত্রী যেন হাতে হাত মিলিয়ে মাথা নত করে হাজারে হাজারে সবাই স্তব করছে নবজাত শিশুকে। আকাশে বাতাসে স্বর্গে নরকে পাতালে আওয়াজ উঠেছে। অশুভ সংকেত!
ষষ্ঠ মাস, ষষ্ঠ তারিখ, ষষ্ঠ ঘন্টা। বাইবেলের পূর্বভাগে ঠিক এই সময়েরই উল্লেখ আছে। এই মুহূর্তেই পৃথিবীর ইতিহাস পাল্টে যাবে। বিগত কয়েক শতকের যুদ্ধ, দুঃখ-দুর্দশা, অরাজকতা আর অসন্তোষের ঘূর্ণিস্রোত, এই সবকিছুই আসল নাটক মঞ্চস্থ হবার আগেকার প্রস্তুতি। অন্তিম যুদ্ধের জন্যে মানুষ উপযুক্ত ভাবে তৈরি হয়েছে কিনা তা যাচাই করার কষ্টিপাথর। সীজারের সময়ে তারা হর্ষধ্বনি করেছে, পৈশাচিক আনন্দে উপভোগ করেছে ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টানদের সিংহের পেটে যাওয়ার দৃশ্য; হিটলারের সময়ে উপভোগ করেছে জু’দের প্রতি অত্যাচার আর গণহত্যা। গণতন্ত্র বিলুপ্তির পথে। নেশাপানিতে আসক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে স্বাভাবিক দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ধারা। খুব কম দেশেই স্বাধীনভাবে ঈশ্বরের উপাসনা করতে পারে মানুষ। নিরীশ্বরবাদের ভক্তদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। লাওস থেকে লেবানন পর্যন্ত আজ ভাই ভাইয়ের বুকে আর ছেলে বাপের পিঠে ছুরি হানতে দ্বিধা করছে না। স্কুলের ছেলেমেয়েদের বাস থেকে শুরু করে হাটে বাজারে নির্বিচারে চলেছে বোমাবাজি। এসবই প্রস্তুতির সূচনা পর্ব।
বাইবেল-শাস্ত্রে পণ্ডিত লোকেরাও লক্ষ্য করেছেন, শেষ যুদ্ধের আগে যে-সব ঘটনা ঘটবে বলে বাইবেলে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, ঠিক সেই সব ঘটনাই বর্তমানে ঘটে চলেছে একের পর এক। বাইবেলে বর্ণিত রোমান সাম্রাজ্য বর্তমানের কমন—মার্কেট হিসেবে গড়ে উঠেছে। ইসরাইলী জু’রা তাদের প্রমিস্ল্যাণ্ড আর হারানো শক্তি ফিরে পেয়েছে। এইসব লক্ষণ আর পৃথিবী জোড়া দুর্ভিক্ষ, অরাজকতার সাথে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়া, সবই ওই একই ইঙ্গিত দিচ্ছে। বাইবেলের ব্যাখ্যায় ঠিক এই রকম ঘটবে বলেই ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে।
সীমাহীন আকাশে তারাটা যতই উজ্জ্বল হচ্ছে কোলাহলও ততই বেড়ে উঠছে। ওর শক্তির প্রভাবে পৃথিবী-কেন্দ্রের বেসল্টের ভিত কেঁপে কেঁপে উঠছে পুরানো শহর মেগ্াইডোতে ধ্বংসাবশেষের মাঝে বসবাসকারী বুড়ো বুগেনহাগেনও অনুভব করছেন এই কম্পন—দু’চোখ বেয়ে টপ টপ করে জল গড়াচ্ছে তাঁর—সব হিসাব আর প্রতিরোধ চেষ্টা বুঝি বিফলে গেল তাঁর। ইসরাইলের অদূরেই মরুভূমিতে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা কাজের মাঝে একটু থমকে দাঁড়াল। তাদের পায়ের তলায় মাটি থরথর করে কাঁপছে।
ওয়াশিংটন থেকে রোম যাওয়ার পথে বোয়িং ৭৪৭ এর ফার্স্টক্লাসে বসে রবার্ট থর্নও টের পেল এই দোলা। অন্যমনস্কভাবে ভাগ্যে না জানি কি আছে ভাবতে ভাবতে সিট বেল্ট বেঁধে নিল সে। এই ঝঞ্ঝার কারণ যদি সে জানত তবু তার করার কিছুই ছিল না, আসলে অনেক দেরি হয়ে গেছে। সে জানে না, রোমের অসপিডাল ডি স্যান্টোর মাটির তলার একটা ঘরে ঠিক সেই মুহূর্তেই পাথরের
ঘাঘাতে নবজাত এক শিশুর মাথা গুঁড়িয়ে দেয়া হল। শিশুটা ছিল তারই সন্তান।
Leave a Reply