অলকনন্দা – নারায়ণ সান্যাল
অলকনন্দা (উপন্যাস) – নারায়ণ সান্যাল
উৎসর্গ
শ্রীমতী রানী লাহিড়ী চৌধুরী
অর্থাৎ, ছোড়দিকে
প্রথম প্রকাশ : ১৯৬৩
রচনাকাল : ১৯৬২
কৈফিয়ত
অলকনন্দা বইটি ষাটের-দশকে লেখা।
বস্তুত একই আঙ্গিকে পরপর দুটি গ্রন্থ রচনা করি। অলকনন্দা এবং মনামী। আত্মকথার ঢঙে। অর্থাৎ লেখক শ্রুতিধরমাত্ৰ-স্টেনোগ্রাফারের মতো ডিকটেশন নিয়ে গেছেন। যা বলবার তা চরিত্ররা নিজেরাই বলেছে। দুটি কাহিনী রচনা করার পরে এই স্টাইলটা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাবার ইচ্ছাটা চলে যায়। স্বভাবগত পল্লবগ্রাহিতায় অন্য বিষয়ের, অন্য আঙ্গিকের দিকে ঝুঁকেছিলাম। অলকনন্দা কিছুদিন বাজারে ছিল না। পরিবর্তিত সংস্করণ প্রকাশ করলেন নিউ বেঙ্গল প্রেস (প্রাঃ) লিঃ। তাদের ধন্যবাদ।
ঘরে-বাইরে পড়তে বসে আমার মনে একটা খটকা জেগেছিল। নিখিলেশ, সন্দীপ আর বিমলা–তিনজনেই কোন অলৌকিক ক্ষমতাবলে আয়ত্ত করল তাদের সৃষ্টিকর্তার অননুকরণীয় রচনাশৈলী? মনে হয়েছিল, সৃষ্ট চরিত্রগুলি যদি রবিঠাকুরের ভাষার হুবহু নকল করতে অপারগ হত তাহলে প্রতি পরিচ্ছেদের মাথায় কোনটা কার আত্মকথা সেটা জানানোর প্রয়োজন থাকত না। চোখে-দেখার নাটক যেদিন থেকে কানে-শোনার বেতার-নাট্যের রূপ নিল, সেদিন থেকে শুধু বাচনভঙ্গি আর কণ্ঠস্বর শুনেই আমরা বক্তাকে চিনে নিতে শিখেছি। ছাপা-উপন্যাসে কণ্ঠস্বর অনুপস্থিত, হস্তাক্ষরও। কিন্তু বাচনভঙ্গি? ভাষার বিন্যাস? ম্যানারিজম? প্রত্যেকটি চরিত্র যদি নিজের নিজের ঢঙে কথা বলে তাহলেও আমরা চিনে নিতে পারব কোনটা কার আত্মকথা! সেই পরীক্ষাটাই করেছিলাম—ঐ দুটি বইতে।
এই যে বিশেষ রচনাশৈলী—অর্থাৎ লেখক তার সৃষ্ট-চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে তাদের ভাষায় পাঠকের সঙ্গে কথা বলবেন—সেটি বাংলা ভাষায় কে প্রথম আমদানি করেছিলেন তা বলার অধিকার আমার নেই। ভাষাবিদ ও বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপকেরা সে কথা বলবেন। আমার তো মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঘরে-বাইরেতে এই আঙ্গিকটা গ্রহণ করেছেন বঙ্কিমচন্দ্রের রজনী (প্রথম প্রকাশ ১৮৭৭) অনুসরণে। সেই উপন্যাসেই প্রথম দেখতে পাই বঙ্কিমকে থামিয়ে দিয়ে রজনী-শচীন্দ্র-লবঙ্গলতা অমরনাথের দল আসর জমিয়ে বসেছিল। ওদের কলকোলাহলে বঙ্কিম একবারও মুখ খুলতে পারেননি। উপন্যাস শুরু হবার আগে এবং টাইটেল-পেজ এর পরে অতি সামান্য পরিসরে লেখকের মুখবন্ধ! দুই অর্থেই।
সেই মুখবন্ধে বঙ্কিম বলছেন, উপন্যাসের অংশবিশেষ নায়ক বা নায়িকা-বিশেষের দ্বারা ব্যক্ত করা, প্রচলিত রচনা-প্রণালীর মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না, কিন্তু ইহা নূতন নহে। উইলকি কলিন্সকৃত The Woman in White নামক গ্রন্থ প্রণয়নে ইহা প্রথম ব্যবহৃত হয়। এ প্রথার গুণ এই যে, যে-কথা যাহার মুখে শুনিতে ভাল লাগে, সেই কথা তাহার মুখে ব্যক্ত করা যায়। এই প্রথা অবলম্বন করিয়াছি বলিয়াই, এই উপন্যাসে যে-সকল অনৈসর্গিক বা অপ্রাকৃত ব্যাপার আছে, আমাকে তাহার জন্য দায়ী হইতে হয় নাই।
যে-কথা যাহার মুখে শুনিতে ভাল লাগে-একশ দশ বছর আগে বঙ্কিমের সেটা খেয়াল ছিল। ঘরে-বাইরেতে সেটা কিন্তু আমরা পাই না। বিমলা, সন্দীপ আর নিখিলেশের চিন্তাধারা, জীবনবোধ, আদর্শের যতই পার্থক্য থাক–তারা তিনজনেই হুবহু-রবিঠাকুরের ভাষায় কথা বলে। বঙ্কিমের চরিত্র সে ভুল করেনি।
পরিচ্ছেদের মাথায় কোনটি কার আত্মকথা যদি লেখা না থাকতো তাহলেও বঙ্কিম-পাঠকের সেটা বুঝে নিতে কোনো অসুবিধা হত না। অশিক্ষিতা রজনী সমাসবদ্ধপদসমৃদ্ধ বঙ্কিমীভাষায় লিখতে যেমন অসমর্থ ঠিক তেমনি ভাবেই শচীন্দ্রনাথ চোখের মাথা খেতে পারে না। লবঙ্গলতা যে অলঙ্কারে অভ্যস্ত (আগুনে-সেঁকা-কলাপাতার মতো শুকাইয়া উঠিবে) অমরনাথ সে ভাষায় কথা বলতে পারে না।
তুলনায় সন্দীপ, বিমলা, নিখিলেশ একে অপরের ভাষা হুবহু নকল করে গেছে।
একটা কথা। রজনীর চেয়ে ইন্দিরা বয়সে চার বছরের বড়। বোধ করি সেই ইন্দিরাই প্রথম বিদ্রোহিণী, যে বঙ্কিমকে বকলমা দিতে অস্বীকার করে। ইন্দিরা বঙ্কিমের পঞ্চমা কন্যা। ইন্দিরার যে চারজন বড় বোন ছিল তারা অনেক গুণের অধিকারিণী; কিন্তু এ দিক থেকে ইন্দিরা অনন্যা! ফুলমণি ব্যতিরেকে বাংলা সাহিত্যে ইন্দিরাই প্রথমা! দুর্গেশনন্দিনী, কপালকুণ্ডলা, মৃণালিনী এবং বিষবৃক্ষের কুন্দনন্দিনী নিজেদের কথা নিজেরা বলতে সাহস পায়নি—বকলমা-র নীচে টিপছাপ দিয়ে সৃষ্টিকর্তা বঙ্কিমকে তারা বলেছিল—আমাদের কথা আপনিই বরং বলুন।
ইন্দিরা তা বলেনি। বলেছিল—আপনি থামুন দেখি! আমার কথা আমি নিজেই বলতে পারব।
ইন্দিরা বঙ্গদর্শনের প্রথম বর্ষের চৈত্র সংখ্যায় (১২৭৯, মার্চ, ১৮৭২) প্রকাশিত। বঙ্কিম-কথিত উইলকি কলিন্স-এর The Woman in White প্রকাশিত হয় ১৮৬০ সালে। অর্থাৎ ইংরাজ-তনয়া ঐ শ্বেতাম্বরা ছিলেন বঙ্কিমতনয়া ইন্দিরা-র চেয়ে মাত্র বারো বছরের বয়োজ্যেষ্ঠা! ফুলমণির আত্মকথা-র নায়িকা আরও ত্রিশ বছরের প্রাচীন।
একশো পনেরো বছর পরে আজকাল আর উপন্যাসের নায়িকাকে ওভাবে সাহস করে এগিয়ে আসতে দেখি না। তারা আর কথাসাহিত্যিককে ধমকে থামিয়ে দিয়ে বলে না : থামুন। আমার কথা আমিই বলব!
নারায়ণ সান্যাল
চৈত্র শেষ, ১৩৯৩ (1987)
Leave a Reply