অমর কণ্টকের আনাচে-কানাচে – সোনালী ঘোষাল
অমর কণ্টকের আনাচে-কানাচে – সোনালী ঘোষাল
প্রথম প্রকাশ: ২০১৮, ১৮ ডিসেম্বর
.
উৎসর্গ
আমার তিন জামাতা সনাতন, স্পন্দন ও কিশোরকে
.
ইংরেজি সাহিত্যের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা সোনালী ঘোষালের জন্ম কলকাতায়। সিঁথি রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ সারদা বালিকা বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিনের শিক্ষিকা জীবন। মৌলিক কবিতা ও শিশুসাহিত্য রচনার সঙ্গে অনুবাদ কর্মেও যুক্ত, দুরারোগ্য ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও লেখনী ও অনুবাদকর্ম অব্যাহত। প্রকাশিত কবিতার বই ‘অবসরে’। অনূদিত গ্রন্থ ‘ভূকম্পনের নেপথ্যে’, ‘লাতিন আমেরিকার শ্রেষ্ঠ গল্প’, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘মঙ্গলবারের ভাতঘুম ও অন্যান্য গল্প’, কর্তার সিং দুগ্নলের ‘একটি সংগীতের জন্ম ও অন্যান্য গল্প’।
.
অমরাণাং কণ্টক:— অমর কণ্টক, মানমর্দারউদ্দমস্থল।
তীর্থভূমি ভারতবর্ষে সুপ্রাচীন বৈদিক যুগ থেকে প্রখ্যাত মুনি ঋষিদের তপস্যাধন্য অমর কণ্টক এক অতি প্রসিদ্ধ তীর্থক্ষেত্র। তপোভূমি নর্মদা-তট ভৃগু, নারদ, ব্যাস, চ্যবন, জাবালি, কপিল, দুর্বাসা, মার্কন্ডেয়, শুক্রাচার্য প্রভৃতি তপস্বীগণের সিদ্ধ তপস্থলী।
এই পবিত্র তীর্থভূমির আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে পুরাণ মাইথোলজি ও ইতিহাস। ভ্রমণ পিপাসু মানুষ যাঁরা ধর্ম ছাড়াও ভ্রমণে মুক্তি খুঁজে পান, তাদের কাছেও এই তীর্থক্ষেত্র এক বিস্ময়। তারই প্রতিচ্ছবি এই গ্রন্থে।
.
‘‘মেঘ এই যে আম্রকূট পর্বতের কথা কহিলাম! ও শুধু নামে নহে, সত্যিই ওর শিখর দেশটি আমগাছে ভরা। তাই ওর নাম আম্রকূট। মেঘতেল কুচকুচে মিশমিশে কালো চুলের বেণীর মতো তোমার রঙ। তুমি গিয়া যখন ওই পাণ্ডুবর্ণ নৈবেদ্যকার শৃঙ্গের ওপর বসিবে, তখন আকাশ হইতে দেবদম্পতিরা নীচের দিকে চাহিলেই দেখিবেন, যেন ধরণী সুন্দরীর পীন পয়োধর শোভা পাইতেছে।’’
অলকাপুরীতে নির্বাসিত যক্ষ বিরহে কাতর। মেঘকে অনুরোধ করেছেন পত্নীর খবর নিতে। মহাকবি কালিদাস তাঁর বর্ণনায় আশ্চর্য সুন্দর ছবি এঁকেছেন নর্মদার উৎসমুখ অমরকণ্টক পর্বতের। পাহাড়ি পথের দুধারে অজস্র গাছ। এপথের আকর্ষণই আলাদা। গিরিখাদ আর গাছগাছালির বিচিত্র বিন্যাস, বাতাসের গুনগুনানি, মহুয়ার নেশার মতো মাতাল করে দেয়।
একদিকে সাতপুরা আর বিন্ধ্য পর্বত। মাঝে মেখল পাহাড়ের চূড়ায় পুণ্যতোয়া নর্মদার তটে পুণ্যতীর্থ অমরকণ্টক। রামায়ণ মহাভারত থেকে শুরু করে মার্কণ্ডেয় পুরাণ, এমনকি মহাকবি কালিদাসের মেঘদূত, সর্বত্রই এই অমরকণ্টকের নয়নাভিরাম দৃশ্যের কথা বলা হয়েছে।
সতীপীঠ পরিক্রমায় অমরকণ্টক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য মা নর্মদার জন্য।
গোটা অমরকণ্টক মন্দিরময়। সবচেয়ে দর্শনীয় স্থান হল মা নর্মদার মন্দির। বহু প্রাচীন বিন্ধ্য পর্বতমালার একটি শৃঙ্গ হল অমরকণ্টক। এখান থেকেই পৌরাণিক নদী নর্মদার যাত্রা শুরু। উদ্গমস্থল দিব্যতীর্থ হিসেবে মানা হয়। শাক্ত গ্রন্থ অনুযায়ী, চণ্ডিকা পীঠ নামে খ্যাত। গঙ্গা উপাসনার নদী, সরস্বতী জ্ঞানের নদী, নর্মদা তপস্যার নদী। শিবের তপস্যা সাক্ষাৎ নর্মদা হিসেবে উঠে এসেছে।
শত শত বছর ধরে কুণ্ডে উঠে আসা জল বেরনোর জন্য রয়েছে একটি নালার সংযোগ। এর নাম গোমুখনালা। গোমুখনালার ভিতর দিয়ে নর্মদা এসে পড়েছে কোটি তীর্থে। পুরাণ অনুযায়ী শিব বিষ পান করলেন। বিষের জ্বালায় ছটফট। অমরকণ্টকে এসে জ্বালা জুড়োল। দেখলেন সবাই ধ্যান করছে। শিব ৫ হাজার বছর ধ্যানে বসলেন। গলার ঘাম থেকে সৃষ্টি হল নর্মদার। মহাদেব চোখ খুলে তাঁকে দেখে প্রসন্ন হলেন। স্বয়ং মহাদেবের তপস্যার ফল নর্মদা।
কথিত আছে, নর্মদার উৎসমুখের সন্ধান পান মরাঠা রাজা প্রথম বাজীরাও। তারপর থেকে ধীরে ধীরে বিশেষ পরিচিতি পায় এই তীর্থ।
অমরকণ্টক আবার সাধন তীর্থ। কথিত আছে, পাশাখেলায় হারের ক্ষত জুড়োতে নর্মদার তীরে ধ্যান করেছিলেন প্রথম পাণ্ডব যুধিষ্ঠির। পুরাণ বলে, নারদ, বশিষ্ঠ, কপিল, ভৃগু, দুর্বাসার মতো মহান মুনি ঋষিরা তপস্যা করেছেন নর্মদা তীর্থ অমরকণ্টকে।
ঝাউ, পাইন, শাল, সেগুনের সৌন্দর্য দেখতে দেখতেই কপিলধারা। কয়েকশো ফুট নিচে আছড়ে পড়ছে জলধারা। কিশোরী যেন প্রথম যৌবনে পা দিয়েছে কপিলধারায় এসে। মা নর্মদার প্রতিটি কাঁকড়ই হল শঙ্কর। এই গহন অরণ্যে জলপ্রপাতের সামনে বসে দীর্ঘকাল তপস্যা করেছিলেন কপিলমুনি। তা থেকে জলপ্রপাতের নাম কপিলধারা। জনশ্রুতি-অমরকণ্টকে এসে কপিলধারা দর্শন করলে মোক্ষলাভ হয়।
অশ্বত্থা সর্ববৃক্ষাণাং। কৃষ্ণও বলেছে—সিদ্ধানাম কপিলৌ মুনি…। বারবার প্রয়াগ গিয়েও সেই পুণ্য হয় না, একবার অমরকণ্টক আর কপিলধারা দর্শন করলে যা হয়। পাথরের গায়ে আছড়ে পড়ার পর, নর্মদার জল সরু ধারা হয়ে বয়ে গিয়েছে আরও গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। কপিলধারার উল্লেখ আছে স্কন্দ পুরাণে। মাথা উঁচু করে জেগে মৌন পর্বত, একেবারে ধ্যানস্তব্ধ। কপিলধারার বিরামহীন ধারাপাত। সব মিলিয়ে অমরকণ্টক এক মায়াময় অধ্যাত্মভূমি। নর্মদা সমস্ত নদীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। আর অমরকণ্টক হল একাধারে শৈব পীঠ, তন্ত্র পীঠ ও অঘোর পীঠ। তপস্যার উত্তম ভূমি নর্মদা তট। এখানে তপস্যা করলে, অন্য যে কোনও স্থানে তপস্যার চেয়ে অধিক ও দ্রুত ফল লাভ হয়। তাই প্রাচীনকাল থেকে সমস্ত মুনি ঋষি সাধনক্ষেত্রে হিসেবে নর্মদা তটকে বেছে নিয়েছেন। তার অন্যতন কারণ এর শক্তি মাহাত্ম্য। নর্মদা মন্দির থেকে ৪৩ কিলোমিটার দূরে শোনমূঢ়া। এখানে শোন নদীর উৎপত্তি স্থলে গড়ে উঠেছে দেবী শোনাক্ষীর মন্দির, যা একান্ন সতীপীঠের অন্যতম পীঠ। দক্ষযজ্ঞে সতীর প্রামত্যাগের পর, মহাদেব যখন তাঁকে কাঁধে নিয়ে জগৎ পরিভ্রমণ করছেন, তকন ভগবান বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে দেবীর দেহ খণ্ডবিখণ্ড করেন। দেবীর দেহের বিভিন্ন অংশ যেখানে যেখানে পড়েছে, সেখানে গড়ে উঠেছে মহাশক্তিপীঠ। কথিত আছে, শোনমূঢ়ায় দেবীর বাম নিতম্ব পড়েছিল।
যেখানে সতী, সেখানেই শিব। শোনাক্ষী দেবীর মন্দিরের পাশেই রয়েছে শিবলিঙ্গ। শঙ্কর এখানে মহাকাল ভদ্রসেন নামে পূজিত হন। সতীপীঠের স্থান নির্বাচন নিয়ে মতভেদ যাই থাক না কেন, অমরকণ্টকের স্থান মাহাত্ম্য নিয়ে কোনও সংশয় নেই। তীর্থভূমি ভারতের বুকে এই জায়গাখানি সাধু, সন্ত, মহাত্মা, তীর্থ অভিলাষীদের যুগ যুগ ধরে আহবান করে চলেছে। লিঙ্গরূপেন সুচিরং প্লবয়ামি তব ক্রোড়ে শিবলিঙ্গ হয়ে কন্যার কোলে তিনি নিত্যকাল ভেসে বেড়াবেন। মেয়ে নর্মদাকে নাকি এমনই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ভগবান শঙ্কর। নর্মদার বুকের সব পাথরই তাই শিব। কালের স্রোতে আমরা প্রত্যেকেই ভেসে চলেছি। কবে কোথায় কোন্ কূলে গিয়ে ঠেকব, কেউ জানি না। ক্ষণিকের বুদবুদের মতো জীবনে এই শিবময় মাতৃভূমিকে প্রণাম।
.
অমর কণ্টকের আনাচে-কানাচে
বেড়ানোর নেশা আমার রক্তে, বাবার থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। বাবা তখনকার দিনে নামকরা এক বিদেশী কোম্পানীর উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন। কিন্তু তাঁর ছিল দেশভ্রমণের ঝোঁক। তাই কোম্পানী ছেড়ে রেলে যোগ দিলেন। মনে মনে এই আশা পোষণ করেছিলেন যে ফার্স্ট ক্লাশ পাশ পেয়ে সপরিবারে বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়াতে পারবেন। কিন্তু বিধি বাম। যখনই বাবা কোথাও যাবার প্ল্যান প্রোগ্রাম করতেন, অমনি মা বলে উঠতেন, রবি কবি সারাজীবন দেশে বিদেশে প্রচুর ঘুরেছিলেন। তবুও তিনি লিখেছিলেন,
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ঘাসের ডগার উপরে
একটি শিশির বিন্দু।
আসলে প্রকৃতিকে দর্শন করার মত অন্তর্দৃষ্টির দরকার। তোমার রেল তোমাকে ট্রেনযাত্রার জন্য পাশ দেবে কিন্তু আটজনের থাকা খাওয়ার খরচ বহন করবে কি? বাবা হতাশ হয়ে আমাকে (তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যাকে) বলতেন, বুঝলি রে মা, বাইরে ঘুরতে গেলে সংসার জীবনের একঘেয়ে সময়-সারণী থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। মনের ক্লান্তি, অবসাদ দূর হয়ে পরম শান্তির আস্বাদ পাওয়া যায়। নতুন করে বাঁচার, আবার কর্মযজ্ঞে লেগে পরার উদ্যম আসে। তাই আমাদের কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি। কিন্তু আমার তো দু’চোখ ভরে দেখার নেশা, জানার নেশা প্রাণে,
দেশ ভ্রমণের নেশা আমায় তাই তো এত টানে।
তাই বড় হবার পর যখনই সুযোগ পেয়েছি ছুটে গিয়েছি অজানার সন্ধানে। কেননা—
আকাশ ডাকে, বাতাস ডাকে, ডাকে সকল তারা,
সবার ডাকে সাড়া দিতে সদাই মাতোয়ারা।
আমার এই সুদীর্ঘ জীবনে পাহাড়ের ডাকে সাড়া দিতে ছুটে গিয়েছি দার্জিলিং, সিমলা, কুলু, মানালি, শিলং, পেলিং, রোটাংপাস, খাজিয়ার ভ্যালি, লাভা, লোলেগাঁও, মিরিখ, কেদারনাথ, বদ্রীনাথ। কেদার দর্শনের পর ওখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলোকন করে অভিভূত আমি চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। মনে হয়েছিল আমি কৈলাস দর্শন করলাম কিন্তু আমার গর্ভধারিণী মা, শাশুড়ি মাতা, দিদিমা জীবনে কোনো কিছুই দেখতে পেলেন না। শুধু হাঁড়ি ঠেলে আর বই পড়ে জ্ঞানতৃষ্ণা মেটাবার চেষ্টা করে জীবন কাটিয়ে দিলেন। আমি ধন্য, আমি স্বচক্ষে এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারছি। ঊষর মরু হাতছানি দিয়ে আমায় ডেকে নিয়ে গেছে সুদূর রাজস্থানের মরু রাজ্যে। ছোট্ট মুকুলের সঙ্গে সঙ্গে জয়সলমিরে সোনার কেল্লার অতুলনীয় সৌন্দর্য আমাকে আজও আচ্ছন্ন করে রেখেছে। দু’চোখ ভরে দেখেছি শাহজাহানের অমর সৃষ্টি তাজমহল, আন্দামানের নীল অতলে প্রবাল রাজ্যে প্রবেশ করে মাছ আর বিভিন্ন জলচর প্রাণীর জলকেলি দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছি। ভাইজ্যাকের ভোরা কেভ, ভীম বৈঠকায় আদিম মানুষদের হস্তশিল্প, খাজুরাহোর স্থাপত্যশৈলী, অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির, সোমনাথ মন্দির, দ্বারকা, ভেট দ্বারকা, ভূস্বর্গ কাশমীরের জিরো পয়েন্ট, পহেলগাঁও ও অন্যান্য স্থান, কেরালার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দর্শনে বিস্ময়বিমূঢ় আমি। বেনারসের দশাশ্বমেধ ঘাটের সন্ধ্যারতি যেমন আমার মন ছুঁয়ে গেছে, তেমনি মণিকর্নিকা ঘাটের অনির্বাণ চিতার লেলিহান শিখা মানুষের অবশ্যম্ভাবী পরিণতির কথা মনে করিয়ে দিয়ে মনকে ভারাক্রান্ত, উন্মনা করে তুলেছে। তামিলনাড়ুতে হোটেলে বসে আমি কন্যাকুমারীর আলোকমালায় সজ্জিত বিবেকানন্দ রকের অপরূপ রূপ সুধা পান করেছি। শারীরিক প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে ছুটে গিয়েছি বিবেকানন্দের স্মৃতিধন্য রকে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে উপাসনাগৃহে প্রবেশ করে শান্ত নির্জন ঘরে বসে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে ঠাকুর শ্রী মা ও বিবেকানন্দের ধ্যান করতে করতে গৌরবান্বিত বোধ করেছি। ইতিহাস প্রসিদ্ধ এইসব স্থান পরিদর্শন করে তৃপ্ত আমি আরও দেখার জন্য আজও উন্মুখ হয়ে থাকি।
এছাড়াও আমি গেছি হরিদ্বার, রাঁচির হুড্রু, জোনা, দশম ফলস্, রাজরাপ্পার দেবী ছিন্নমস্তার মন্দির। দু’পাঁচ দিনের ট্যুরে গেছি অসংখ্যবার পুরী, দীঘা, তাজপুর, গাদিয়ারা, দেওঘর, বকখালি, মুকুটমণিপুর, মন্দারমণি। পন্ডিচেরী ভ্রমণ আমাকে আবিষ্ট করেছে।
ক্যানসার বিজয়ী সত্তর বছরের বৃদ্ধা, বাতের ব্যথায় কাবু হয়েও এখনও বেড়ানোর নেশা ত্যাগ করতে পারিনি। এখন তো কুণ্ডু স্পেশালের মতো ট্র্যাভেল এজেন্সির সাথে একা একা যাওয়া সম্ভবপর হয় না। তাই আমার তিন কন্যা, জামাতা, নাতনীরা কোথাও যাবার পরিকল্পনা করলে খুশিতে ডগোমগো হয়ে উঠি।
প্রতি বছরের মতো এবারেও গ্রীষ্মের ছুটিতে কিশোর, রম্যানি পাহাড়ে যাবার কথা বললে আমি শারীরিক কারণে যেতে আপত্তি জানাই। তাই কিশোর অমরকণ্টক, নর্মদা ভ্রমণের ইচ্ছায় আসা যাওয়ার প্লেনের টিকিট বুক করে। শুনেছিলাম নর্মদা দর্শন ভাগ্যের ব্যাপার। তাছাড়া জায়গাটা আমার অদেখা হওয়ায় আমি খুশি হয়ে সম্মতি জানাই।
মে মাসের কুড়ি তারিখে কলকাতা বিমানবন্দর থেকে SPICE JET এর ৩.৩০ মি এর উড়ানে আমি, আমার ছোট কন্যা রম্যানি, আমার জামাতা কিশোর আর নাতনী বহ্নিশিখা জব্বলপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ৫.৩০ মিনিটে প্লেন থেকে নেমে আগে থেকে বুক করা গাড়িতে চেপে গেলাম মধ্যপ্রদেশ স্টেট ট্যুরিজম্ ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের কলকাতা থেকে বুক করা মোটেল মার্বেল রক-এ। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল অবধি ভাড়া ১৫০০ টাকা। ভেড়া ঘাটে অবস্থিত এই হোটেলে তিনতারা হোটেল এর সুযোগ সুবিধা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, সুইমিং পুল, পার্ক, প্রচুর অর্কিড। এখান থেকে নর্মদা নদীর খানিকটা অংশ দেখা যায়। এখানকার কর্মচারীরা অসম্ভব বিনয়ী, সাহায্যকারী, আতিথেয়তাপূর্ণ। খাবার দাবারের মান বেশ ভালো। কমপ্লিমেন্টরি ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা রয়েছে। ডাইনিং রুম সংলগ্ন একটা ঘরে মার্বেল পাথরের তৈরি জিনিসপত্র বিক্রয়ের ব্যবস্থা আছে।
নর্মদা তটভূমির প্রধান আকর্ষণ জব্বলপুরের পরমাশ্চর্য বস্তু মার্বেল রকস্। আগের দিন রাতে কিশোর জানিয়ে দিয়েছিল যে আমরা ওখানকার কড়া রোদ এড়াবার জন্য ভোর ভোর বেরিয়ে নর্মদা নদীতে নৌকা চড়ে যাব মার্বেল রকস্ দেখতে। সেই মতো পরদিন সকাল ৫.৩০ মিনিটে উঠে চা বিস্কুট খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভেড়া ঘাটে পৌঁছলাম। তারপর তিনজনের জন্য নৌকা ভাড়া করে রওনা দিলাম মার্বেল রক দেখার উদ্দেশ্যে। নর্মদা নদীর জল স্বচ্ছ, পরিষ্কার। নদীর দ্বারা সৃষ্ট মার্বেল খোদিত হয়ে প্রায় ৮ কিমি দীর্ঘ অভাবনীয় সুন্দর প্রবেশ পথে নৌকা আমাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পরিদর্শন করানোর জন্য নিয়ে চলল। মার্বেলের রঙ কোথাও ধবধবে সাদা, কোথাও শ্যাওলার কারণে সবুজ, কোথাও নীল, কোথাও আবার হরিদ্রাভ। পাহাড়ের গায়ে মাঝে মাঝে কতকগুলি খোঁদল—কোনোটা হাতির পায়ের মতো, কোনোটা ঘোড়ার ক্ষুরের মতো। দু’চোখ ভরে প্রকৃতির এই রূপমাধুরী আমি উপভোগ করেছি। নৌচালক গাইডের মুখে শুনলাম পূর্ণিমা রাতে সুরক্ষিত মার্বেল রকের উপর চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয়ে স্বপ্নময় পরিবেশ সৃষ্টি করে। কিন্তু আমরা থাকাকালীন পূর্ণিমা তিথি না পড়ায় সেই অপরূপ সৌন্দর্য দর্শন থেকে বঞ্চিত হয়েছি। এখানে মার্বেলের তৈরি অনেক মূর্তি পাওয়া যায়। তবে মূর্তিগুলোর বেশিরভাগেরই মুখ চোখ পরিষ্কার বোঝা যায় না বলে কিনিনি।
২২ তারিখ বৈকাল চার ঘটিকায় যাতায়াত বাবদ চারশো টাকা দিয়ে একটা অটো ভাড়া করে গেলাম ধূঁয়াধর জলপ্রপাত দেখতে। নদীর একদম সামনে পৌঁছে দেখা যায় জলপ্রপাতটিকে। নানা বর্ণের বড় বড় পাথরের চাঙরে নর্মদার বুক ভরে আছে। সেই দুর্গম পার্বত্য বাধাকে হেলায় চূর্ণ বিচূর্ণ করে পর্বতভেদী প্রচন্ড বেগবতী নর্মদা প্রায় ৩০ মিটার উঁচু থেকে বিপুল গর্জনে আছড়ে পড়ছে প্রায় চল্লিশ ফুট নীচে—প্রপাতের আকারে। কোটি কোটি জলকণা ও বুদ্বুদের চঞ্চল নৃত্য চোখের সামনে পুঞ্জীভূত বাষ্প সৃষ্টি করছে ধূম্রজাল। তাই এর নাম ধূঁয়াধারা বা ধূয়াধর। প্রকৃতির এই অসামান্য সৌন্দর্যলীলা আমি বিমুগ্ধ নয়নে উপভোগ করেছি। বিন্দু বিন্দু জলের ফোঁটা যখন গায়ে মাথায় পড়ছিল, তখন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছি। কিন্তু একটা ব্যাপার আমায় অবাক করে দিয়েছে। এখনকার ছেলেমেয়েদের সেল্ফি তোলার প্রবণতা এত বেশি যে দলে দলে সবাই আসছে আর নামমাত্র সৌন্দর্য উপভোগ করে নানান ভঙ্গীমায় বিভিন্ন দিক থেকে নিজেদের ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। দুজন দম্পতি আর তাদের বাচ্চাদের দেখে তো হতবাক্ হয়ে গিয়েছি। তাদের পুরুষ সঙ্গী আর বাচ্চারা সুইমিং কস্টিউম পড়ে প্রবেশ পথের সামনে বড় বড় পাথরবেষ্টিত স্থানটায় সাঁতার কাটার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে আর একজন মহিলা পাথরের উপর বসে সারাক্ষণ তাদের ছবি মোবাইলে বন্দী করে রাখছে। মনে হচ্ছিল হয়তো বা তারা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করা অপেক্ষা পরবর্তী সময়ে মোবাইল বন্দী ছবি দেখে বেশি আনন্দ পাবে। হয়তো তারা এই সত্য উপলব্ধি করেছে যে তাৎক্ষণিক এই আনন্দ ক্ষণিকের কিন্তু ছবি চিরকালীন। এখানে রোপওয়ের ব্যবস্থা আছে কিন্তু আমরা চাপিনি। রাস্তার এক পাশে অনেক পসারি নানান পসরা সাজিয়ে বসেছে। কেউ বা কুলের আচার, নুন মাখানো আম, তেঁতুল বিক্রি করছে। আবার বেশিরভাগ লোকই মার্বেলের নানান মূর্তি হাতে গড়ে সেগুলো বিক্রি করছে। এখানকার অধিকাংশ লোকের জীবিকা মার্বেলের তৈরি চাকি, খল, নুড়ি ইত্যাদি বিক্রি করা।
এবার আমাদের গন্তব্য পেঞ্চ। অনলাইনে বুক করা গাড়িতে চেপে আমরা ২৩ তারিখে সাত সকালে পেঞ্চের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। এখানে আমরা উঠলাম মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজম্ এর পেঞ্চ কিপলিং তিতলি কোর্ট নামক হোটেলে। চারদিকে প্রচুর গাছপালা ঘেরা এই রিসর্টটি পেঞ্চ ন্যাশনাল পার্কের সন্নিকটে। বানরের উৎপাত থাকায় খাবার জায়গা পুরো জাল দিয়ে ঘেরা। আমরা পৌঁছেই শুনলাম জঙ্গল থেকে একটা চিতাবাঘ এখানকার কিচেনে ঢুকে বসেছিল। জনৈক কর্মচারী কিচেনে ঢুকে সেটাকে দেখতে পেয়ে ভয়ে আধমরা না হয়ে সাহস সঞ্চয় করে কিচেনের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেয়। বনবিভাগে যোগাযোগ করলে বনরক্ষীরা এসে ঘুমপাড়ানি গুলি ছুঁড়ে বাঘটাকে ঘুমের রাজ্যে পাঠিয়ে খাঁচাবন্দী করে বনে রেখে আসে। খবরটা ওখানকার স্থানীয় কাগজে ছাপা হয়েছে। খবরটা শুনে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। বিশেষতঃ রাতে ডিনার খেতে যেতে বেশ ভয় ভয় করছিল। এখানে নানারকম ফুলের গাছে ভরা সাজানো গোছানো পার্ক, সুইমিং পুল রয়েছে। ঘরগুলো প্রশস্ত, সুসজ্জিত। কর্মচারীদের অতিথিদের প্রতি ব্যবহার হার্দিক, মধুর। ঘর সংলগ্ন বারান্দায় বসে বানরদের বাচ্চা সমেত গাছে গাছে দোল খেতে, এগাছ থেকে ও গাছে লাফালাফি করতে, গাছের ফল, কচি পাতা খাওয়ার দৃশ্য দেখে সময় কাটানো যায়।
পেঞ্চের প্রধান আকর্ষণ ন্যাশনাল পার্ক। পেঞ্চ ন্যাশনাল পার্ক মধ্যপ্রদেশের সিওনি আর ছিন্দওয়ারা জেলায়। পেঞ্চ নদী উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে পার্কটাকে দক্ষিণ ও পূর্বে অর্ধভাগে ভাগ করেছে বলে এখানকার নামকরণ হয়েছে পেঞ্চ। সুরক্ষিত এই বনাঞ্চল ১৯৬৫ সালে অভয়ারণ্য বলে ঘোষিত হলেও ১৯৭৫ সালে জাতীয় উদ্যানের মর্যাদা পায়। ১৯৯২ সালে এটি বাঘ সংরক্ষণ অঞ্চল অভিধায় ভূষিত হয়। ছোট ছোট পাহাড় দিয়ে ঘেরা এই বনাঞ্চলটিতে টিক ও অন্যান্য গাছের সমারোহ। দক্ষিণ দিকে সাতপুরা পর্বত মালা পর্যন্ত বনভূমিটি বিস্তৃত। এখানে রোদের তেজ প্রখর এবং বৃষ্টিপাত কম হয় বলে গাছ পালাগুলিতে সবুজের আধিক্য কম। জুন, জুলাই, আগস্ট মাসে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় বলে পর্যটকদের ভ্রমণ বন্ধ থাকে।
২৪শে মে ভোর পাঁচটায় খোলা জিপ আমাদের নিয়ে রওনা দিলো জঙ্গল সাফারির উদ্দেশ্যে। রিসর্ট থেকে আমাদের ব্রেকফাস্ট প্যাক করে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রথমে আমরা গেলাম মহারাষ্ট্রের দিকের জঙ্গলে। শুরুতেই একদল বানর তাদের ছানাপোনা নিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। আরও কিছুটা যাবার পর আমরা একদল হরিণ হরিণীকে শাবকসহ নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখলাম। জঙ্গলে চিতল, সম্বর, বল্গা হরিণ, অল্পসংখ্যক ময়ূর, একটা বাইসন দেখতে পেলাম। তারপর আমাদের চিরআকাঙ্খিত জঙ্গলের রাজার দর্শন মিললো। বাঘ মামা তার ভাবগম্ভীর মূর্তি নিয়ে দুল্কি চালে নানান ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে দু’দুবার রাস্তার এপার থেকে ওপারে গিয়ে সমস্ত পর্যটকদের আনন্দ বর্ধন করল। দেখে মনে হল সে দর্শকদের এভাবে আনন্দ দিতে অভ্যস্ত। অন্ততঃ চোদ্দ পনেরোটা জিপের পরিভ্রমণকারীরা নানান ধরনের ক্যামেরায়, মোবাইলে তাকে বন্দী করে রাখল ভবিষ্যতের সাক্ষী হিসাবে।
মনে অপার আনন্দ নিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে, কফি খেয়ে রিসর্টের ঘরে গিয়ে একটু জিরিয়ে নিয়ে স্নান সেরে গেলাম মধ্যাহ্ন ভোজনে। দুপুর তিনটে ত্রিশ মিনিটে আবার জিপে উঠে বসলাম। এবার আমাদের গন্তব্য মধ্যপ্রদেশের দিকের অভয়ারণ্য। মধ্যাহ্ন সূর্য তখন তার প্রখর উত্তাপে চারদিক উত্তপ্ত করে তুলছে। এখানকার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হল এই তাপে লু বইতে থাকে। শরীর, চোখ মুখ জ্বালা করে কিন্তু একফোঁটা ঘাম হয় না। এখানকার মানুষজন বাইরে বেরোতে বাধ্য হলে মুখ গামছা, কাপড়, রুমাল বা ওড়নায় ঢেকে ফেলে। তাদের চোখে থাকে রোদ-চশমা আর মাথা বাঁচানোর জন্য শিরস্ত্রাণ হিসাবে টুপি বা তোয়ালে। আমরাও সেভাবেই নিজেদের সুসজ্জিত করে নিলাম। মোটামুটি শুনশান রাস্তায় পর্যটক ছাড়া আর যাদের দেখা মেলে তারা হল কাঁচামিঠে আম নিয়ে স্থানীয় পসারি। এর মধ্যেই অবশ্য মোদী সড়ক যোজনা প্রকল্পে রাস্তা বাড়ানোর জন্য কিছু লোকজনকে দেখলাম ফিতে হাতে মাপজোখ করে চুন ছড়াতে, খুঁটি পুঁততে। ঠিক চারটেতে প্রবেশ দরজা খোলা হলে আমাদের জিপ স্টার্ট দিল। এখানকার পরিবেশে অনভ্যস্ত আমাদের চোখ মুখ ঝলসে যাচ্ছিল কিন্তু বন্যপ্রাণী দেখার আনন্দ আমাদের কাবু করতে পারেনি। জঙ্গলও আমাদের নিরাশ করেনি। বরং আমাদের কষ্টে প্রলেপ দিয়েছে। কেননা এখানকার জঙ্গলে আমরা প্রচুর পরিমাণে হরিণ, হরিণী, ময়ূর, ময়ূরী, বানর, হনুমান, একটু দূর থেকে নীলগাইদের দেখেছি। একটা শেয়ালকে বন মুরগীর পিছনে ধাওয়া করতেও দেখলাম কিন্তু শিকারের পরিণতি দেখতে পাইনি। অসম্ভব তেষ্টাতে জল খেতে গিয়ে দেখলাম ফ্রিজ থেকে আনা বরফ ঠান্ডা জল ফুটন্ত জলে পরিণত হয়েছে। তাই তৃষ্ণা নিবারণ আর হল না। সবশেষে ফিরে আসার সময় আমরা একটা বাঘ বাবাজীকে জলাশয়ে জল খেতে দেখলাম। জল খাওয়া শেষ করে হেলতে দুলতে সে একটা অপেক্ষাকৃত সবুজ ঝাঁকড়া গাছের নীচে শুয়ে পড়ল। তারপর এপাশ ওপাশ ফিরে হাই তুলতে তুলতে ঘুমিয়ে পড়ল। মনে হল কোন দলছুট হরিণকে শিকার করে তার হাড়, মাংস মজ্জা আয়েশ করে খেয়ে মধ্যাহ্নভোজনপর্ব শেষ করে সুখ নিদ্রায় ঢলে পড়ল। তার আশপাশে নানান ধরনের জলচর পাখি, ময়ূর ময়ূরীদের ঘুরে বেড়ানো, মাঝে মাঝে উড়াল ডানা মেলে ওড়াউড়িও তার নিদ্রায় ব্যঘাত ঘটাতে পারল না। তার ঘুম ভাঙার অপেক্ষায় আর খানিকক্ষণ থেকে আমরা ফিরে এলাম। হোটেলে ফিরে শুনলাম এভাবে জঙ্গলের বাঘ দর্শন নাকি ভাগ্যের ব্যাপার। অনেকে কান্হা, বান্ধবগড় গিয়ে বাঘ দেখতে পায়নি। কিন্তু আমি আমার জীবনের প্রথম জঙ্গল সাফারিতে গিয়ে দু’দুটো ট্রিপে তিন তিনটে বাঘ দেখতে পেয়েছি। জীবনের সায়াহ্নে এসে আর হয়তো জঙ্গল যাওয়া হবে না। তাই ঈশ্বরই বোধহয় আমার সাধ পূরণ করলেন।
ফেরার পথে দেখলাম দু’দুটো গাড়ি থেকে বানর হনুমানদের উদ্দেশ্যে জলের ছোট ছোট পাউচ ফেলা হচ্ছে। রাস্তার ধারে জড়ো হওয়া শাবক সমেত মায়েরা সেই জল সংগ্রহ করছে। মনে হয় এখানে জলের খুব অভাব। তবে আশার কথা বেশ খানিকটা অন্তর অন্তর রাস্তার ধারে ডিপ টিউবওয়েল বসানো আছে। স্থানীয় মেয়েরা সারি দিয়ে কলসী ভর্তি করে কাঁখে মাথায় জল বয়ে নিয়ে নিজেদের গন্তব্যে ফিরে যাচ্ছে। জঙ্গল সাফারিতে যাওয়া আসার জন্য দুটি ট্রিপের জিপভাড়া দশ হাজার টাকা।
পঁচিশ তারিখ সকাল ন’টায় প্রাতরাশ সেরে রওনা দিয়ে আমরা জব্বলপুর থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে বার্গিতে পৌঁছলাম। এখানে আমাদের বিশ্রামস্থল মৈকাল রিসর্ট। মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজম এর এই টু-স্টার হোটেলটির অবস্থান ভারি সুন্দর। বারান্দায় দাঁড়ালে বা ঘরের জানলা খুলে দিলে নর্মদা নদী আর বার্গি ড্যাম দেখতে পাওয়া যায়। সন্ধ্যাবেলা বারান্দায় বসে নর্মদা নদীর অবিরাম বয়ে চলা দেখতে দেখতে সময় সুন্দর কেটে যায়। প্রশস্ত খোলামেলা সুসজ্জিত ঘরটাতে আলো বাতাসের প্রাচুর্য লক্ষণীয়। জব্বলপুর-নাগপুর সংযোগকারী সাত নং ন্যাশনাল হাইওয়ের কাছে বার্গি গ্রামে নর্মদা নদীতে এই বাঁধ দেওয়া হয়েছে বলে এর নামকরণ করা হয়েছে বার্গি ড্যাম। এটি একটি বিশাল শান্ত রিজার্ভার। একে দেখে শান্ত নদী বলে ভ্রম হতে পারে। এখানে বর্ষার আধিক্য না থাকায় ড্যামটি দেখে ম্যাসেঞ্জার বাঁধের মতো আনন্দ পাইনি। স্থানীয় লোকদের মুখে শুনলাম জুনের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হওয়ার ফলে ঐ সময় জলপূর্ণ ড্যামটি দেখতে ভালো লাগে।
এখানকার অন্যতম আকর্ষণ ক্রুজ রাইড, মোটর বোট রাইড, স্পীড বোট রাইড। ক্রুজ রাইডে সকাল দশটা থেকে বিকাল ৬টা পর্যন্ত নর্মদা ভ্রমণ করা যেতে পারে। প্রবেশমূল্য বড়দের মাথাপিছু ২০০ টাকা।
মৈকাল রিসর্ট থেকে হাঁটা পথে সামান্য কিছুক্ষণ গিয়ে বড় বড় পাথরের সিঁড়ি পেরিয়ে এবড়ো খেবড়ো মেঠো সিঁড়ি নেমে ক্রুজে চাপলাম। আমার হাঁটার কষ্ট দেখে অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে জাহাজে উঠতে সাহায্য করল। দোতলায় সিঁড়ি বেয়ে ওঠা দুষ্কর হবে মনে করে নীচের ডেকেই বসেছিলাম। ভেতরে গদি মোড়া সোফা। মাঝখানে চেয়ার টেবিল। এয়ার কন্ডিশনার, পাখা, আধুনিক সব ব্যবস্থা মজুত। কিন্তু আসলেই গলদ। জানলার দুপাশে সোফাগুলো এমনভাবে সাজানো যে বসে বাইরের দৃশ্য কিছুই দেখা যায় না। এই বয়সেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে হয়েছে। অবশ্য অন্যান্য যাত্রীদের তেমন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল বলে মালুম হল না। কেননা প্রত্যেকেই অল্পবয়সী দম্পতি, তাদের ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে এসেছে। তারা বেশিরভাগ সময়টাই বাইরের ডেকে দাঁড়িয়ে সেল্ফি তোলায় ব্যস্ত থেকেছে। একজন স্থানীয় নবদম্পতি তো নানান পোজে ছবি তুললো, আনন্দ করলো। কোনো কোনো বাচ্চা আবার ভেতরে হিন্দী ফিল্মের নকলে নাচ করছিল। মাঝে মাঝে তাদের সঙ্গের মা কিংবা বাবা তাদের সেই নাচ মোবাইলবন্দী করতে লাগল। আন্দামানের ক্রুজ রাইডে এই সমস্যায় পড়তে হয়নি। ভেতরের আসনে বসেই বাইরের সবকিছু দেখতে পাচ্ছিলাম। রম্যানির স্পীড বোট রাইডে চাপার মনোগত বাসনা থাকলেও আমার কারণে তাকে তার ইচ্ছা দমন করতে হয়েছিল।
ছাব্বিশ তারিখে বার্গি থেকে সকাল ১০টায় প্রাতরাশ সেরে আমরা রওনা দিলাম অমরকণ্টকের পথে। বার্গি থেকে যাবার পথে জব্বলপুরের নারাই নালায় দেখলাম রাণী দুর্গাবতীর সমাধিস্থল। দুর্গের মতো চারিদিক ঘেরা অঞ্চলে ইতিহাসপ্রসিদ্ধ বীরাঙ্গনা রাণীর হাতির পিঠে যুদ্ধরত মূর্তি আর একদিকে তাঁর পুত্র বীর নারায়ণের মূর্তি।
মোঘল আমলের ইতিহাসে রাণী দুর্গাবতীর বীরবিক্রমে যুদ্ধ পরিচালনার কথা জেনেছিলাম। এখানে গাইডের মুখে তাঁর জীবনের ইতিকথা শুনতে পেলাম। প্রসিদ্ধ চান্দেলরাজ কিরাত রাইয়ের পরিবারে ১৫২৪ সালের ৫ই অক্টোবর উত্তরপ্রদেশের বান্দায় কালিঞ্জের দুর্গে তাঁর জন্ম। গোঁড় রাজপুত সাম্রাজ্যের রাণা সংগ্রাম শাহর পুত্র দলপত শাহের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবার সূত্রে দুটি রাজ্য পারিবারিক অচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা পড়েন। ১৫৪৫ সালে তাঁদের একমাত্র পুত্র বীর নারায়ণের জন্ম। নাবালক পুত্রকে রেখে খুব অল্পবয়সে দলপাত শাহ মারা গেলে রাণী দুর্গাবতী গোঁড় রাজ্যের রাজত্বভার গ্রহণ করেন। দেওয়ান কেওহার আধার সিংহা এবং মন্ত্রী ম্যান ঠাকুর সাম্রাজ্যকে সুষ্ঠভাবে পরিচালনার কাজে তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। ১৫৫০ থেকে ১৫৬৪ সাল পর্যন্ত তাঁর রাজত্বকাল। ভারতের ইতিহাসে চান্দেল রাজবংশের খ্যাতি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য। এই কারণেই চান্দেল রাজা বিদ্যাধর মহম্মদ গজনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে সমর্থ হন। চান্দেল রাজবংশের সাহসিকতা এবং পৃষ্ঠ পোষকতার ঐতিহ্যকে আরও গৌরবান্বিত করে তোলাই ছিল রাণী দুর্গাবতীর স্বপ্ন। সাতপুরা পর্বতে অবস্থিত তাঁর রাজধানী চৌরাগর দুর্গ যুদ্ধ পরিচালনার কৌশলগত অবস্থানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। রাণীর আমলে ১৮টি সরোবর তাঁর দুর্গকে চারদিক থেকে ঘিরেছিল। কালের কপোলতলে ধ্বংস হয়ে একটিমাত্র টিকে আছে। শেরশাহের মৃত্যুর পর সুজাত খান মালবার রাজ্য দখল করে নিজ সাম্রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি কল্পে রাণী দুর্গাবতীর রাজ্য আক্রমণ করলে রাণী তা বীর বিক্রমে প্রতিহত করেন। ১৫৬২ সালে আকবর মালবারের শাসনকর্তা রাজ বাহাদুরকে পরাস্ত করে রাজ্যটিকে মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। এরপর তাঁর দৃষ্টি পড়ে রাণীর সাম্রাজ্যের দিকে। আকবরের অনুমতিতে আসফ খান রাণীর রাজ্য আক্রমণ করলে তিনি সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ পরিচালনার জন্য রাণী একদিকে গৌড় আর অন্যদিকে নর্মদার পাহাড়ী অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত নারাই নালায় যান। কিন্তু মুঘলদের সুশিক্ষিত ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে অসম যুদ্ধে হার মানেন। যুদ্ধক্ষেত্রে প্রচণ্ড আহত হয়ে তরবারির আঘাতে তিনি নিজের জীবন বিসর্জন দেন। ১৫৬৪ সালের ২৪শে জুন মাত্র ৩৯ বছর বয়সে প্রবল পরাক্রমশালী এই বীরাঙ্গনার জীবনাবসান ঘটে। তাঁর এই শহীদ দিবসটি আজও মধ্যপ্রদেশে ‘‘বলিদান দিবস’’ হিসাবে পালিত হয়।
সমাধিস্থলে অবস্থিত ভগ্নপ্রায় দুর্গগুলো সময়ের অভাবে আর দেখা হয়নি। বিষণ্ন মন নিয়ে আমরা আবার গাড়িতে উঠে বসলাম। বার্গি থেকে অমর কণ্টক যাবার রাস্তাটা অসাধারণ। গাড়ির গতি রোধকারী কোনো বাম্পারের বালাই নেই। কালো পীচের আস্তরণে ঢাকা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তার দু’পাশে অসংখ্য সুউচ্চ গাছ দু’পাশ থেকে হেলে পড়ে পরস্পরকে আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় থেকে সবুজ আস্তরণে ঢাকা তোরণ পথ সৃষ্টি করে সবাইকে সাদর অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। সবুজের সমারোহ মনের আরাম, চোখের শান্তি দান করেছে।
অন্নপ্পুর জেলার জৈন মন্দিরের সামনে মধ্যপ্রদেশ স্টেট ট্যুরিজম-এর অমরকণ্টক হলিডে হোমে আমাদের থাকার ব্যবস্থা আগে থেকেই করা ছিল। চারদিকে গাছ গাছালি, পাখপাখালিতে ভরা মনোরম উদ্যানের মাঝখানে এই হলিডে হোম। আম, জাম, কাঁঠাল, জামরুল, পেয়ারা গাছের সমারোহ। অন্ততঃ ছয়/সাত খানা আমগাছে বড় বড় আম ঝুলছে। প্রবেশের মুখেই গোলাপবাগ। অজস্র লাল রঙের গোলাপ আরও নানান ধরনের ফুল বাগানের শোভা বর্ধন করেছে। সামনের লনে পর্যটকদের খেলাধূলার ব্যবস্থা রয়েছে। পরিষেবা ও খাবারের মান বেশ ভালো। কিন্তু এখানে আমিষ মেলে না বলে নাতনীর খুব অসুবিধা হয়েছে। ঘরগুলো প্রশস্ত না হলেও সুসজ্জিত। কর্মচারীরা অতিথি বৎসল। অত আম দেখে উৎসাহিত আমার কন্যা আম মাখা খাবার কথা জানালে মধ্যাহ্নভোজের সময় দেখলাম অন্যান্য অর্ডার করা খাবারের সঙ্গে আম বাটাও একটা বাটিতে রাখা হয়েছে। পরম তৃপ্তি সহকারে আমরা তা খেয়েছি। এখান থেকে নর্মদা কুণ্ড হেঁটে যাওয়া যায়।
অমরাণাং কণ্টকঃ—অমর কণ্টক, মা নর্মদার উদ্গমস্থল।
তীর্থভূমি ভারতবর্ষে সুপ্রাচীন বৈদিক যুগ থেকে প্রখ্যাত মুনি ঋষিদের তপস্যাধন্য অমর কণ্টক এক অতি প্রসিদ্ধ তীর্থক্ষেত্র। তপোভূমি নর্মদা-তট ভৃগু, নারদ, ব্যাস, চ্যবন, জাবালি, কপিল, দুর্বাসা, মার্কন্ডেয়, শুক্রাচার্য প্রভৃতি তপস্বীগণের সিদ্ধ তপস্থলী। স্বয়ম্ভু মহাদেবের তেজ থেকে উদ্ভুত হয়ে ক্ষুদ্রধারা মা নর্মদা ধীরে ধীরে পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে ১২৮৯ কিমি পথ অতিক্রম করে গুজরাট রাজ্যের ভারুচ শহরের নিকটবর্তী মিঠিতলাই নামক স্থানে আরব সাগরে বিলীন হয়ে গেছেন। অমর কণ্টক শোন, ব্রহ্মপুত্র, জোজিলা (জ্বালাগঙ্গা) নদীরও উদ্গমস্থল। স্বয়ং মহাদেব অমরকণ্টক নাম ধারণ করে স্বয়ম্ভুলিঙ্গ রূপে এ স্থানে বিরাজ করেন। যার প্রমাণ মেলে যত্র তত্র শিবলিঙ্গের প্রাচুর্য্যে।
২৭ তারিখ ভোর ভোর রওনা দিলাম নর্মদা কুণ্ড দর্শনে। উঁচু নীচু পাহাড়ী পথে স্থানীয় বাসিন্দাদের বাড়িঘর দেখতে দেখতে একজায়গায় গাড়ি থেকে নামলাম। সেখানে দুপাশের দোকানে নর্মদা মাঈয়ের পুজোর প্রয়োজনীয় উপাচার, নানাধরনের প্লাস্টিকের বোতল (পরে দেখলাম পুণ্যার্থীরা বোতল ভরে কুণ্ডের জল নিচ্ছেন যাতে পবিত্র জলপান করে সর্বপাপ মুক্ত হওয়া যায়, অন্তিমকালে মোক্ষ লাভ হয়)। একটা দোকানে দেখলাম পুরাণ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত রাখা রয়েছে বিক্রীর উদ্দেশ্যে। ঘোরানো লোহার দরজা পেরিয়ে মন্দির চত্বরে প্রবেশ করার জন্য পা বাড়ালাম। কিছুক্ষণ এগিয়ে এক বিশাল তোরণের সামনে এলাম। তোরণের বাইরেও প্রচুর দোকান, মন্দিরের শ্বেতশুভ্র তোরণের মাথায় চূড়ার সারি। তোরণ পেরিয়ে বিশাল চত্বরের মাঝখানে একাদশ কোণ বিশিষ্ট এক কুণ্ড—যার পরিধি ২৬০ হাত, আট দশ হাত গভীর স্থির কাকচক্ষু জল, বাঁধানো সিঁড়ি। এই হল পরম পবিত্র নর্মদা কুণ্ড যেখানে থেকে উদ্ভুত হয়েছেন দেবাদিদেব মহাদেবের তেজ সম্ভুতা নর্মদা। শাস্ত্রানুসারে কুণ্ডটিকে বিশা যন্ত্র বলে। কুণ্ডের পশ্চিমে একটা নালা পাথর বাঁধানো চাতালের নীচ দিয়ে নিঃসারিত হয়ে ৫০-৬০ ফুট দূরে গোমুখ নামক ছিদ্র পথে কোটি তীর্থে জমা হচ্ছে। কোটি তীর্থের পাশে গায়ত্রী কুণ্ড আর সাবিত্রী কুণ্ড। আসলে কোটি তীর্থ এক ত্রিবেণী সঙ্গম।
নর্মদা কুণ্ডের প্রস্তর মণ্ডিত চত্বরের চারিদিকে ছোট বড় ২৭টি মন্দির। প্রতিটি মন্দির পাথরের, দেওয়ালগুলো শ্বেতশুভ্র, প্রত্যেকটি উচ্চ চূড়া বিশিষ্ট, আয়তনের তুলনায় মন্দিরগুলোর উচ্চতা অনেক বেশি। কুণ্ডের মধ্যে উত্তরদিক ঘেঁষে শ্রী পার্বতী এবং অমর কণ্ঠেশ্বর মহাদেব মন্দির। পুবমুখী মন্দিরে নর্মদা মায়ের কালো নিরাভরণা কষ্টিপাথরের মূর্তি—আকর্ণবিস্তৃত চক্ষু, উন্নত নাসা, ক্ষীণ কটি তপস্বিনীভঙ্গী। দুই পাশে দুই দ্বাররক্ষী জয় ও বিজয়। আদিকন্যকা শক্তির প্রতীক মহাকুমারী অপলক দৃষ্টিতে সামনের পশ্চিমমুখী মন্দিরের অভ্যন্তরস্থিত পিতা অমর কণ্টকেশ্বর মহাদেবের দিকে তাকিয়ে আছেন। অমরনাথ মন্দিরের সামনে গোরক্ষনাথ মন্দির ও গৌরীশংকর মন্দির। এছাড়াও এখানে রয়েছে শ্রী অন্নপূর্ণা মন্দির, কার্তিক মন্দির, রামদরবার, উত্তর পশ্চিম কোণে রোহিনীমাতা মন্দির, শ্রী ঘন্টেশ্বর মন্দির, রামজানকী মন্দির, শ্রী সূর্য মন্দির, শ্রী একাদশী মন্দির, শ্রী দুর্গা মন্দির, শ্রী হনুমান মন্দির ও আরও অনেক মন্দির। দূর থেকে মন্দিরটিকে মন্দিরময় দুর্গের মতো লাগে। নর্মদা মায়ের দিকে দাঁড়ালে ডানদিকে রয়েছে শঙ্করাচার্য স্থাপিত পাথরের খোদিত ভৈরবী চক্র।
নর্মদা মন্দিরের প্রতিষ্ঠাকাল সম্পর্কে কোনো প্রামাণ্য গ্রন্থ পাওয়া যায় না। জনশ্রুতি যে এখন যেখানে নর্মদাকুণ্ড, সেখানে দশ বারো শতাব্দীর আশেপাশে কোনো এক সময় বাঁশবনের মধ্যে লুক্কায়িত ছিল নর্মদার উৎস। কুণ্ডটি আবিষ্কার করে জনৈক রেবা নায়েক এখানে মন্দির নির্মাণ করেন কিন্তু কালের গর্ভে তা বিলীন হয়ে যায়। মারাঠারাজ দ্বিতীয় পেশোয়া প্রথম বাজীরাও পরবর্তীকালে তা পুনরুদ্ধার করে মন্দিরের সংস্কার করান। বেণুবনের মধ্যে প্রকাশিত হওয়ায় নর্মদেশ্বর শিবের অপরনাম বেন্বেশ্বর। পরবর্তীকালে ইন্দোরের হোলকার, নাগপুরের ভোঁসলা, বরোদার গাইকোয়াড, গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া রাজারা বিভিন্ন সময়ে মন্দির সংস্কার করে মায়ের উদ্গম কুণ্ড, স্নানকুণ্ড এবং কাপড় কাচার কুণ্ড নির্মাণ করান। ইন্দোরের মহারাজা ১৯২৯ সালে নর্মদেশ্বর মন্দির সংস্কার করান। ১৯৩৯ খৃস্টাব্দে বর্তমানে দৃশ্যমান উদ্গম কুণ্ড, স্নানকুণ্ড, মন্দির পরিসরের সুউচ্চ প্রবেশদ্বার সমেত পাঁচিল তৈরী করিয়ে দেন রীবার মহারাজ গুলাব সিং। নর্মদা মন্দিরের প্রবেশ মুখে যে তোরণ তা মুসলিম শৈলীতে নির্মিত ,কেননা ওখানকার স্থানীয় অধিবাসীদের কথায় তোরণ নির্মাণের মুখ্য কারিগর ছিলেন মুসলিম। প্রাচীর সমেত তোরণটি নির্মাণের পর মহারাজ মন্দির দর্শনে এসে তা দেখে প্রবেশদ্বারের শীর্ষে গণেশ মূর্তি স্থাপন করান।
আমরা ঘুরে ঘুরে সমস্ত মন্দিরগুলি প্রদক্ষিণ করলাম। দলে দলে তীর্থযাত্রী জয় নর্মদে, জয় জয় হরদেব বলতে বলতে মন্দিরে প্রবেশ করে প্রবেশ পথের সামনের একটা জায়গায় হাত পা ধুয়ে শিবের মূর্তিতে দুধ জল ঢেলে পূজো করছেন। প্রায় সকলেই সঙ্গে আনা ধুতুরা ফুলের মতো দেখতে একরকম ফুল, নারকেল দিয়ে নৈবেদ্য সাজিয়ে মাকে উৎসর্গ করছেন। অনেককে দেখলাম নিষেধ থাকা সত্ত্বেও প্রণামী কয়েন বাক্সে না ফেলে উদ্গম কুণ্ডে ছুঁড়ে ফেলছেন, সঙ্গে আনা পাত্রে কুণ্ডের জল ভরে নিচ্ছেন। উদ্গম কুণ্ডে স্নান করা নিষিদ্ধ। স্নান না করে যাওয়ায় আমি পূজো দিইনি। মনে মনে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছি। বেশ খানিকক্ষণ সিঁড়ির ধাপে বসে থাকার পর ৭-৩০ মিনিটে মায়ের আরতি দেখে দেহে মনে অপার শান্তি নিয়ে হোটেলে ফিরে এসেছি।
সেদিনই বেলা একটা নাগাদ গাড়ি করে রওনা দিলাম প্রাচীন রঙমহল ও নর্মদা সংলগ্ন অন্যান্য দ্রষ্টব্য স্থানগুলো পরিদর্শনে। নর্মদা মন্দিরের প্রাচীর ছাড়িয়ে পূর্বদিকে খানিকটা গিয়ে চোখে পড়ল পুরাতাত্ত্বিক বিভাগ কর্তৃক সংরক্ষিত বেশ সাজানো গোছানো নয়নাভিরাম এক গুচ্ছ প্রাচীন মন্দিররাজি। প্রবেশদ্বারের দক্ষিণে সুন্দর সবুজ ঘাসের নরম গালিচা। লাল পাথরের তৈরি জীর্ণ মন্দিরগুলি কলচুরি শাসকদের শিল্প ও স্থাপত্যকলার সাক্ষ্য বহন করছে। অলংকারবিহীন সাধারণ বিন্যাসযুক্ত মন্দিরগুলোতে মুখ্য মণ্ডপ, অন্তরাল আর গর্ভগৃহ বিদ্যমান। মণ্ডপের বাইরের দেওয়ালগুলি খোলা, ছাদগুলি অলংকৃত স্তম্ভের উপর নির্মিত। নয়নমুগ্ধকর কারুকার্যমণ্ডিত মন্দিরগুলি হল—রঙ মহল, কেশব নারায়ণ মন্দির (বিষ্ণু মন্দির), মৎস্যেন্দ্রনাথ মন্দির, কর্ণ মন্দির, জোহিলা মন্দির, সূর্যকুণ্ড, পাতালেশ্বর মন্দির ও রাজ রাজেশ্বরী মন্দির।
প্রাচীন মন্দিরের পূবদিকে পারস্যশৈলীতে ১৬টি স্তম্ভের উপর নির্মিত পাতালেশ্বর মন্দির আমাদের সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছে। ভূমি থেকে প্রায় ১০ ফুট নীচে স্থাপিত পাতালেশ্বর মহাদেব খুব জাগ্রত। আদি শঙ্করাচার্য এই মন্দিরের স্থাপয়িতা। নর্মদা কুণ্ডের সঙ্গে পাতালেশ্বর মহাদেবের যোগাযোগ রয়েছে। পূজারীর মুখে শুনলাম প্রত্যেক বছর শ্রাবণ মাসের শেষ সোমবার শিবলিঙ্গ নর্মদার জলে ভরে যায়।
শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরের মতো মন্দিরের অভ্যন্তর তাপদগ্ধ পর্যটকদের আরাম দিয়ে ক্লান্তি দূর করে দেয়। তীব্র দহনজ্বালা থেকে মুক্তি পেতে আমাদের মত আরও অনেকে এখানে বিশ্রাম করেছে।
তারপর আমরা নর্মদা মন্দিরের পূর্বদিকে প্রায় ১ কিমি. হাঁটা পথে মাঈকী বাগিয়া বা মায়ের বাগানে পৌঁছে গেলাম। এটি অরণ্য ও পাহাড়ের রাজ্যে এক সুপরিকল্পিত বিশাল, অতি প্রাচীন, মনোরম উদ্যান। মেকল রাজার কন্যারূপে জন্মগ্রহণকালে নানা জাতীয় ফল ও ফুলে ভরা এই বাগানে মা নর্মদা তাঁর সখীদের সঙ্গে খেলা করতেন, বসন্তোৎসবে দোলনায় দুলতেন। এখানকার জলের কুণ্ডটি চরণোদক কুণ্ড নামে পরিচিত। বাগানে মা নর্মদার অতিপ্রিয় গুলবাকাগুলি ফুলের প্রচুর গাছ চোখে পড়ে। এই ফুল থেকে তৈরী ওষুধ চক্ষুরোগে উপকারী। এই ফুলের সুর্মাও এখানে কিনতে পাওয়া যায়। একান্ত শান্ত পরিবেশ। চারদিক যেন স্বর্গীয় আনন্দ ও আধ্যাত্মিক সুখের পরিপূর্ণ এক বাতাবরণ।
এবার আমাদের গন্তব্যস্থল শোন নদের উৎসস্থল শোন মুড়া, স্থানীয় ভাষায় শনে মারা। অনেকগুলো বড় বড় পাথরের সিঁড়ি বেয়ে আমরা নেমে এলাম শোন নদীর মূল উদ্গম স্থলে। এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ মনোমুগ্ধকর। চারদিকে জঙ্গলে ভরা। পাখিদের কলকাকলি ও বানরদের মুখ নিঃসৃত ধ্বনি ছাড়া এক শান্ত নির্জন পরিবেশ। চারিদিকে বড় বড় পাথরগুলো শেকলের মতো জাল দিয়ে ঘেরা। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম বর্ষাকালে প্রবল বেগে বৃষ্টিপাত হলে নদীর জল সব ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে বলে এই সতর্কতা। শোণভদ্রের মিলিত জলধারা ১৫০ মিটার দূরে পাহাড়ি গিরিখাদ বেয়ে জলপ্রপাতরূপে মোটা লোহার রেলিং এর তলা দিয়ে ভীমবেগে ঝাঁপিয়ে পড়ছে হাজার হাজার ফুট নীচে। শোন নদের উদ্গমস্থলের সামনে শ্রী সোমেশ্বর মহাদেব ও মা দুর্গার মন্দির রয়েছে। আমরা সেসব দর্শন করলাম। একজন সাধুজীকে শোন আর নর্মদার সঙ্গমস্থল কোথায় জিজ্ঞাসা করায় উত্তর পেলাম এই দুটি প্রবাহ কোনদিনই মিলিত হয়নি। শোণ নদ পাঁচশো মাইল দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে বিহারের রাজধানী পাটনার কাছে গঙ্গায় মিলিত হয়েছে আর নর্মদা মিলিত হয়েছে আরবসাগরে। তিনি এ প্রসঙ্গে লোকমুখে প্রচলিত এক সুন্দর কাহিনী আমাদের নিবেদন করলেন। যুগযুগান্তর পূর্বে মৈকালরাজের রাজধানী ছিল মৈকাল পর্বতে। অপূর্ব রূপবতী নর্মদা ছিলেন তাঁর একমাত্র কন্যা। তার সৌন্দর্য ও লাবণ্যের খ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। নর্মদা ফুল আর শিবের ভক্ত ছিলেন বলে মৈকাল রাজ তাঁর আদরিণী কন্যার জন্য এক সুরম্য উদ্যান বানিয়ে দেন। মায়িকী বাগিয়া নামক সেই উদ্যানে তিনি তাঁর দুই প্রিয় সখি হিম্লা আর ঝিম্লার সাথে ঘুরে বেড়াতেন। নিত্য শিবের আরাধনা করতেন। একদিন রাজপুত্র শোণভদ্র সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করে সেখানে উপস্থিত হন। শোণ ভদ্রের অনিন্দ্যকান্তরূপ নর্মদার চোখে মোহাঞ্জন পরিয়ে দেয়। শোণভদ্রও প্রথম দর্শনে নর্মদার প্রেমে পড়ে যান। প্রেম ঘনীভূত হলে শোণভদ্র আত্মপরিচয় দিলেন। শিবকে সাক্ষী রেখে উভয়ের মধ্যে বাগ্দান পর্ব সমাপ্ত হয়। পিতাকে নিয়ে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজা মৈকালের কাছে তাঁর কন্যার পাণিপ্রার্থী হবার ঐকান্তিক বাসনায় শোণভদ্র নিজ রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেন এবং দুর্ভাগ্যক্রমে যুদ্ধ বিগ্রহে জড়িয়ে পড়েন। এদিকে দু’বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল। শোণভদ্রের দিক্ থেকে কোনো বার্তা না আসায় অধৈর্য মৈকালরাজ অন্যত্র মেয়ের বিবাহ স্থির করেন। নিরুপায় নর্মদা মাতা পিতার চাপে বাধ্য হয়ে যেদিন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন ঠিক তার পরদিনই শোণভদ্র পিতাকে নিয়ে এসে উপস্থিত হলেন। সব শুনে শোণভদ্র নর্মদাকে অভিশাপ দিলেন যে যেহেতু সে তাঁদের প্রেমের অবমাননা করে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তাই সে এবং তাঁর দুই সখী নদীতে পরিণত হবে। ক্রোধান্বিত নর্মদাও অভিশাপ দিলেন—বিনাদোষে, সবকিছু না জেনে তাঁকে অভিসম্পাত করার কারণে সেও নদে পরিণত হবে। সেই থেকে প্রেমে ব্যর্থ এই দুই বিরহীর উৎসস্থল অমর কণ্টক হলেও নর্মদা হলেন পশ্চিমাভিমুখী আর শোণের গতি উত্তর পূর্বাভিমুখী।
এবার আমরা চললাম নর্মদা নদীর পশ্চিমে আট কিমি দূরে কপিলধারা পরিদর্শনে। খানিক দূর যাবার পরে কপিল ধারায় প্রবেশের মুখে গাড়ি আটকে দিল। শুনলাম হাঁটা পথে যেতে হবে। কিন্তু আমাদের চালকের উপস্থিত বুদ্ধিতে দুশো টাকা ঘুষ দিয়ে অন্যান্য V.I.P. দের মত ভেতরে গাড়ি নিয়ে প্রবেশের অনুমতি পেলাম। সেখানে পৌঁছে দেখলাম নর্মদার স্ফটিক জল গর্জন করতে করতে একটা গহবরে আছড়ে পড়ছে। এই হল নর্মদার প্রথম জলপ্রপাত—কপিলধারা। এখানে নর্মদা মাত্র দশ বারো হাত চওড়া। পর্যটকদের দেখার জন্য ভিউ পয়েন্ট করে দেওয়া আছে। নর্মদা নদীর ওপরে একটা লোহার সেতু পার হয়ে কপিলেশ্বরে পৌঁছলাম। শুনলাম মহামুনি কপিল এখানে দণ্ডায়মান অবস্থায় শিবের তপস্যা করেছিলেন।
কপিল ধারাকে বাঁ দিকে রেখে নিচে ঘন জঙ্গলের মধ্যে আরও কিছুটা নেমে চোখে পড়ল নর্মদার দ্বিতীয় জলপ্রপাত দুধ ধারা। এখানকার জলের ধারা দুধের মতো সাদা। জলপ্রপাতের উচ্চতা দশ ফুট। দুর্বাশা মুনির তপস্যাস্থল। ফার্ণ, বনফুল আর রাশি রাশি বুনো গোলাপ স্থানটাকে রমনীয় করে তুলেছে।
ফেরার পথে এলাম জৈনদের উপাসনা গৃহে। প্রচুর লোক সমাগম হওয়ায় উপাসনা গৃহের ভিতর প্রবেশ না করতে পেরে চারপাশটা ঘুরে গেলাম আদি জৈনদের মন্দির। মন্দিরটিতে সারাই পর্ব চলায় ভেতরে না গিয়ে বাজারে ঢুকে টুকিটাকি জিনিসপত্র কিনে ফিরে এলাম রিসর্টে।
বৈকালিক চা পর্ব শেষ করে আমরা নর্মদা মন্দিরের দক্ষিণে সোনামুড়া যাবার রাস্তার সামান্য দূরে শ্রীযন্ত্র মহামেরু মন্দির পরিদর্শনে চললাম। মন্দিরের রাস্তার পাশের একটা আশ্রমে যাবার পথে উঠে মন্দিরটিকে সুন্দরভাবে পর্যবেক্ষণ করলাম। যন্ত্রের ন্যায় নির্মিত এই মন্দিরটি লক্ষ্মী মন্দির। মন্দিরের গাত্রে সুন্দর দেবদেবীর ভাস্কর্য বিদ্যমান। সবুজ বনাঞ্চলে ঘেরা এই মন্দিরের ভেতরে একপাশে একটি সুন্দর লেক এবং উত্তরে এক বিশাল জলাধার বর্তমান। বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে থাকা মন্দিরটির প্রবেশ পথের চারদিকে দুর্গসমন্বিত ফটকটি সরস্বতী, কালী, ভুবনেশ্বরী আর লক্ষ্মীদেবীর আকর্ষণীয় ভাস্কর্য মণ্ডিত মুকুটে সুশোভিত। স্বামী সুকদেবানন্দজী মন্দিরটির প্রাণপুরুষ।
গঙ্গা, যমুনা, গোদাবরী, সরস্বতী, নর্মদা, সিন্ধু, কাবেরী এই সাতটি পবিত্রতম নদীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ নর্মদা। এদের মধ্যে গঙ্গা আর সরস্বতী নদীর উৎসমুখ আগেই দর্শন করেছি। এবার দেখলার নর্মদা নদীর উদ্গমস্থল। স্কন্দপুরাণ অনুযায়ী সরস্বতীর জলে তিনদিন, গঙ্গায় একদিন স্নান করলে পবিত্র হওয়া যায় আর নর্মদার জল কেবলমাত্র দর্শনেই সর্বপাপ দূরীভূত হয়। কিন্তু পুত পবিত্র হওয়া বা পুণ্য অর্জন করে মোক্ষ লাভ আমার অভিপ্রেত নয়। আমার বাসনা এইসব পবিত্র নদী দর্শনে অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনা, মনকে নদীর মতই স্বচ্ছ করে গড়ে তোলার সাধনে ব্রতী হওয়া আর সৎচিন্তা, সৎকর্ম করার শক্তি অর্জন করা।
২৮শে মে মা নর্মদা আর অমর কণ্টকেশ্বরকে মনে মনে বিদায় বার্তা ঘোষণা করে বেরিয়ে পড়লাম জব্বলপুর বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে। নীড়হারা পাখিরা এবার নীড়ে ফেরার বাসনায় উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। প্রায় আট ঘণ্টা যাবার পর জব্বলপুরের একনামীদামী চীনা রেস্তোঁরায় মধ্যাহ্ন ভোজন পর্ব সারলাম। তারপরই পৌঁছে গেলাম বিমানবন্দরে। স্পাইসজেটের পাঁচটা চল্লিশের উড়ানে ফিরে এলাম কলকাতা। আবার সেই পরিচিত শহর, আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব। আবার সেই মন উচাটন পরের বার হেথা নয়, হোথা নয় অন্য কোনোখানে ভ্রমণের অপেক্ষায়।
.
পরিশিষ্ট:
মা নর্মদা মাহাত্ম্য
‘অমরাণাং কণ্টকঃ’—অমরকণ্টক। মা নর্মদার উদ্গমস্থল। তীর্থভূমি ভারতবর্ষে অমরকণ্টক একটি অন্যতম পবিত্র তীর্থ। যা সনাতন ঋষি, সাধু, সন্ত, মহাত্মা তীর্থ অভিলাষীদের যুগ যুগ ধরে আহবান করেছে।
ধরিত্রীকে দিব্য ব্রহ্মনদী ও বিষ্ণুনদী বিদ্যমান। কিন্তু একমাত্র রুদ্রনদী ‘নর্মদা’। নর্মদা নদীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠা। রুদ্রের তেজ থেকে উৎপন্ন। স্থাবর-জঙ্গম সবকিছু তিনি ত্রাণ করে সর্বসিদ্ধি প্রদান করেন। আমরা জানি পূজা-অর্চনা-তর্পণাদিতে আচমন ও আসনশুদ্ধির পর জলশুদ্ধির একটি মন্ত্র আছে—
গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরী সরস্বতী
নর্মদে সিন্ধু কাবেরী জলেহস্মিন্ সন্নিধিং কুরু।।
গঙ্গা, যমুনা, গোদাবরী, সরস্বতী, নর্মদা, সিন্ধু, কাবেরী—এই সাত নদীকে ভারতবর্ষের সবচেয়ে পবিত্রতম নদী বলে মানা হয়। আর নর্মদা এই সমস্ত নদীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। স্কন্দপুরাণ অনুযায়ী সরস্বতীর জলে তিন দিন, যমুনার জলে সাত দিন, গঙ্গার জলে এক দিন স্নান করলে পবিত্র হয়। কিন্তু নর্মদার জল কেবলমাত্র দর্শন করলেই পবিত্র হয়। শুধু তাই নয়, তপস্যার উত্তম ভূমি নর্মদা তট। নর্মদা তটে তপস্যা করলে অন্য যে কোনও স্থানে তপস্যার থেকে অধিক এবং দ্রুততর ফল লাভ হয়। তাই প্রাচীনকাল থেকে সমস্ত মুনি-ঋষিরা তাদের সাধনক্ষেত্র হিসাবে নর্মদা তটকেই বেছে নিয়েছেন।
মহাভারতের বনপর্বে আমরা দেখি দূ্যত ক্রীড়ায় পরাজিত রাজ্যভ্রষ্ট যুধিষ্ঠির অশান্ত মন নিয়ে তীর্থ পর্যটনে যাচ্ছেন। ধৌম্য মুনি তাঁকে তীর্থে তীর্থে পরিব্রাজনের পরামর্শ দিয়েছেন। তখন সেখানে পুলস্ত্যমুনি এলেন। তিনি যুধিষ্ঠিরের ইচ্ছা জেনে খুব আনন্দিত হয়ে বললেন—যুধিষ্ঠির তুমি অন্য তীর্থে তো যাবেই কিন্তু ত্রিলোকপ্রসিদ্ধ মা নর্মদাকে অতি অবশ্যই দর্শন করে আসবে। সেই কাহিনির সূত্র ধরেই আমরা স্কন্দপুরাণের রেবা খণ্ডে পাই নর্মদার উৎপত্তির বিবরণ।
যুধিষ্ঠির উপস্থিত হলেন সপ্তকল্পজীবী মার্কণ্ডেয় ঋষির আশ্রমে। সেখানেই তিনি কৌতূহলী হয়ে ঋষি মার্কণ্ডেয়কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে ভগবন্! ত্রিলোকে প্রাণীগণের মধ্যে আপনিই দীর্ঘায়ু। সপ্তকল্পের অবসান পর্যন্ত আপনার আয়ু। অতএব আমাকে দয়া করে সপ্তকল্পের বিবরণ বর্ণনা করুন। কল্পক্ষয় হলে সমস্ত কিছুই নষ্ট হয়। আপনি তখন কীভাবে বেঁচে থাকলেন? সাগরগামী নদ-নদীর মধ্যে কোন কোন নদ লুপ্ত হয় আর কোন কোন নদী সেই সময় বিরাজমান থাকে?
মার্কণ্ডেয় যুধিষ্ঠিরের এতগুলি প্রশ্নের উত্তরে বললেন—হে ধর্মনন্দন যুধিষ্ঠির! কল্পান্তরে সমস্ত সমুদ্র ও নদী লয় হয় কিন্তু কেবলমাত্র সরিদ্বরা নর্মদা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না। একমাত্র নর্মদা নদীই বিদ্যমান থাকে। কল্পান্তরে সমস্ত জগৎ যখন জলমগ্ন হল, তখন আমি একটি বিশাল মাছ দেখলাম। সেই মৎস্যরূপী পুরুষ আমাকে বললেন—‘তুমি আমার কাছে এস’। আমি তখন মৎস্যরূপী বিশাল পুরুষের আশ্রয়ে গিয়ে বিশ্রাম নিলাম। দেখলাম মনু এবং অন্যরাও সেখানে আশ্রিত। আমরা জলপূর্ণ জগৎ ভ্রমণ করতে করতে দেখলাম সাগরের মধ্যে এক কামগামিনী পুণ্যা নদী বয়ে যাচ্ছে। সেই নদীর জলরাশি তরঙ্গায়িত, সাদা ফেনা। নদীর মধ্যে কণকোজ্জ্বল এক রমণী বিদ্যমান। মনু সেই রমণীকে জিজ্ঞাসা করলেন—হে মনোহরাঙ্গি! তুমি একা একা কেন ঘুরছ? তোমার নাম কী? সমস্ত নদী, সাগর, পর্বত যখন নষ্ট হয়েছে তখন তুমি একা একা জলরাশিতে ঘুরছ, নিশ্চয়ই এর কোনও কারণ আছে। হে দেবী, তুমি আমায় তা জানাও।
দেবী তখন বললেন—আমি ঈশ্বরের শরীর থেকে উৎপন্ন হয়েছি। আমি রুদ্রজা। আমাকে পাপনাশিনী নদী বলে জানবে। যাঁরা আমার আশ্রয় নেয় তাঁদের কোনও ভয় থাকে না। হে দ্বিজ, আমি তোমাদের রক্ষার জন্য এখানে এসেছি।
এই পর্যন্ত শুনে যুধিষ্ঠির বললেন, আপনার কথায় আমার খুব কৌতূহল হচ্ছে। দয়া করে দেবীর পরিচয় বলুন। তিনি কার সন্তান?
মার্কণ্ডেয় বললেন—হে যুধিষ্ঠির! পরমেষ্টী ব্রহ্মার রাত শেষ হলে প্রভাত মুহূর্তে মনু যখন জগৎ সৃষ্টি আরম্ভ করেন তখন তাঁকে আমি এই প্রশ্ন করি যে, হে ভগবন্! চন্দ্রনিভাননা, পদ্মপলাশলোচনা কন্যা, যে ‘আমি রুদ্রজা’ বলে আত্মপরিচয় দিলেন তিনি কে?
মনু উত্তর দিলেন—হে বৎস, পুরাকালে শান্ততনু শিব উমার সঙ্গে নিখিল বিশ্বের মঙ্গল কামনায় ঋক্ষ শৈলে (মেখলে পর্বত) কঠোর তপস্যা করেছিলেন। কঠোর তপস্যা করতে করতে শঙ্করের শরীর থেকে ঘাম ঝরতে লাগল। সেই ঘাম থেকে মহাপুণ্যা সরিদ্বরা এক নদী উৎপন্ন হয়। তুমি একেই কন্যারূপে দর্শন করেছ। পরে সেই নদী দিব্যদেহ ধারণ করে শিবশঙ্করের ডান পায়ের উপর দাঁড়িয়ে সত্যযুগে দশ হাজার বছর রুদ্রের আরাধনা করেন।
একসময় সমাধি ভঙ্গ হল শিব শঙ্করের। তাকিয়ে তিনি দেখলেন দিব্যলাবণ্য ও তপশ্চর্যাজনিত জ্যোতির বিচ্ছুরণে সমগ্র পর্বতমালা আলোকিত করে তাঁর ডান পায়ে দাঁড়িয়ে তপস্যারতা এক কন্যাকে। মাথায় তাঁর সুপিঙ্গল জটাভার। বা হাতের কব্জিতে কমণ্ডলু। ডান হাতের আঙুলে অক্ষমালা।
কুমারীর ধ্যান ভঙ্গ করে রুদ্রদেব তাকে জিজ্ঞাসা করলেন—হে মহাভাগে! তুমি কে? তোমার তপস্যায় আমি প্রীত। তোমার মনের অভীষ্ট আমায় ব্যক্ত কর।
দিব্যকন্যা উত্তর দিলেন—আমি আপনারই অংশভূত, আপনার কণ্ঠ থেকে আমি উদ্ভূত। আমি আর কী বর চাইব? কেবল এই প্রার্থনা—আমি ঠিক যেন চিরকাল আপনার সঙ্গে নিত্যযুক্ত হয়ে থাকতে পারি। হে প্রভু! প্রলয়কাল উপস্থিত হলে যখন স্থাবর-জঙ্গম বিনষ্ট হবে আমি তখন যেন অক্ষয়া হই। সমস্ত পর্বত, নদ, নদী, সাগর যখন লয়প্রাপ্ত হবে তখনও আমি যেন বিলুপ্ত না হই। যে সকল পাতক, উপপাতক ও মহাপাতক ভক্তিযুক্ত হয়ে আমার জলে অবগাহন করবে তারা যেন কলুষমুক্ত হয়। দেবগণ সর্বদা যেন আমার পূজা করেন। হে ত্রিদশেখর! যারা ব্রহ্মহত্যাজনিত পাপ করবে তারাও যেন আমার জলে অবগাহনমাত্রই পাপমুক্ত হতে পারে। সকল যজ্ঞানুষ্ঠানের যে ফল, আমার জলে অবগাহনেও যেন মানুষ সেই ফললাভ করে। দান, উপবাস, তীর্থ অবগাহনে যে ফল হয় আমার জলে স্নান করলেও যেন সেই ফল হয়। আমার তীরে যারা আপনার অর্চনা করবে তারা যেন মৃত্যুর পর আপনার লোকে যায়। হে নিখিলদেব আপনি মা উমার সঙ্গে আমার তীরে সর্বদা বাস করুন। আপনি যদি আমায় বরদানের যোগ্য বলে মনে করেন, তবে আমি যেন মহাপাতকনাশিনী বলে ত্রিলোকে বিখ্যাত হই।
কন্যার প্রার্থনা শুনে তৃপ্ত মহেশ্বর বললেন—হে প্রিয় বরাননে! তুমি আমার দেহ থেকে সমুদ্ভূতা। তাই তুমি নিখিল কলুষের মোচনকর্ত্রী এ বিষয়ে কোনও সংশয় নেই। হে দেবী। কল্পক্ষয়কালে যারা তোমার উত্তর কূলে বাস করবে সেই তীরবাসী সমস্ত কীট-পতঙ্গ, তরু, গুল্ম, লতাদি সহ প্রাণীগণ সদ্গতি প্রাপ্ত হবে। যে সব ধর্মপ্রাণ দ্বিজ মৃত্যুকাল পর্যন্ত তোমার দক্ষিণতীরে বাস করবে, দেহাবসানে তারাও পিতৃপুরে যাবেন। হে কন্যা! তোমার প্রার্থনানুসারে আমিও শরীরান্তর পরিগ্রহ করে উমার সঙ্গে তোমার তীরে বাস করব। হে দেবী! আমার আদেশে ব্রহ্মা, ইন্দ্র, চন্দ্র, বরুণ, বিষ্ণু ও সাধ্যগণ তোমার উত্তর তীরে বাস করবেন এবং পিতৃগণসহ আমি দক্ষিণ তীরে অবস্থান করব।
এবছর যুধিষ্ঠির ঋষি মার্কণ্ডেয়কে প্রশ্ন করলেন—হে ঋষিসঙ্ঘ রুদ্রদেহ থেকে উদ্ভূত সরিদ্বরা মহাদেবীর নাম নর্মদা কীভাবে হল?
মার্কণ্ডেয় বললেন, হে যুধিষ্ঠির! শঙ্করের ঘাম থেকে এই যে কন্যা আবির্ভূত হল তাঁর রূপের কোনও তুলনা হয় না। দেব ও দানবগণ তাঁকে দেখে মোহিত হল। কে তাঁকে লাভ করবে সেই প্রতিযোগিতা আরম্ভ হল। রমণীরত্ন এই দিব্যরূপা কন্যা হাবভাব ও বিলাস দ্বারা সবাইকে মোহিত করে তুলল। সবাই শঙ্করের কাছে সেই কন্যাকে বিয়ে করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন।
মহাদেব তাঁদের বললেন—তোমাদের মধ্যে যে অধিক বলসম্পন্ন সেই এই কন্যাকে স্ত্রীরূপে পাবে। মহাদেবের কথা শুনে দেব-দানবগণ দিব্য কন্যার কাছে গেলেন। কিন্তু কন্যার মন জয় করতে তাঁরা ব্যর্থ হলেন। তখন সবাই স্থির করলেন শক্তির দ্বারা জয় করবেন তাঁকে। শিব সবই দেখছেন চোখের আড়াল থেকে। তিনি মহাপরীক্ষার দ্বারা গড়ে-পিটে নিতে চান নিজের কন্যাকে। দেবতাদের দূরভিসন্ধি বুঝতে পেরে মহাতেজা কন্যা সেখান থেকে অন্তর্হিত হল। দেবতারা দেখলেন কন্যা একযোজন দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই সেখানে গেলেন। কন্যাও তিন, চার ক্রমে শতযোজন দূরে দূরে অবস্থান করতে লাগলেন। এইভাবে সবাই মিলে তাঁর পিছু পিছু ধেয়ে গেলেন। তাঁরা যেদিকেই তাকান দেখেন কন্যা সেখানেই সহস্ররূপ ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছেন। এই লুকোচুরি খেলা চলল হাজার দিব্য বছর। কেউই রুদ্রঅঙ্গসম্ভবা কন্যার নাগাল পেলেন না। দেব-দানবগণের এই অবস্থা দেখে মহাদেব খুবই আনন্দিত ও কৌতুক বোধ করলেন। দেব-দানবদের গর্ব চূর্ণ হল। কুমারীর মহাশক্তির কাছে সবাই পরাজিত হলেন।
কন্যা পিতা শিবের কাছে উপস্থিত হলেন। তখন পিনাকপাণি শঙ্কর কন্যাকে সম্বোধন করে বললেন—তোমার ক্ষমতায় সুরাসুরগণ লজ্জা পেয়েছে। তোমার আনন্দময় খেলা দেখে আমি খুবই আনন্দ পেয়েছি। দেব-দানবদের প্রতি এই ‘নর্ম’দান হেতু তোমার নাম হল সরিদ্বরা ‘নর্মদা’। আজ থেকে তুমি আমার আনন্দ বিলাসের ক্ষেত্র হলে। ‘নর্ম’ অর্থাৎ পরম পরিতৃপ্তি প্রদায়িনী পরম সুখ ও আনন্দদায়িনী মহাকুমারী শক্তির প্রতীক তুমি। আর বর দিচ্ছি—
‘গর্ভে তব বসিস্যামি পুত্রোর্ভূত্বা শিবাত্বজে।
মম ত্বম্ অপরামূর্তিঃ খ্যাতা জলময়ী শিবা।।’
আজ থেকে তুমি আমার জলময় রূপ হলে। হে শিবাত্মজে! তুমি জলময়ী শিবা। তোমার পুত্র হয়ে তোমার কোলে নিত্যকাল আমি বিরাজ করব। এই বলে শঙ্কর সেই শীলবতী সুশোভনা কন্যা নর্মদাকে মহাসমুদ্রের হাতে অর্পণ করলেন। নর্মদা তখন ঋক্ষ শৈল থেকে (মেকলে পর্বত) সাগরের দিকে প্রবাহিত হলেন।
শুধু তাই নয়, মহাদেব আরও বললেন—‘লিঙ্গরূপেণ সুচিরং প্লবয়ামি তব ক্রোড়ে’। দেখ কন্যা আমি এখন থেকেই তোমার কোলে শিবলিঙ্গ হয়ে চিরকাল ভেসে বেড়াব। নর্মদার বুকের সব পাথরই তাই শিব—‘হর কঙ্করই শঙ্কর’। নিজের কন্যার বুকে তিনি নিজেই সচলরূপে বিরাজ করেন।
এরপর যুধিষ্ঠির জানতে চাইলেন নর্মদার নাম রেবা কেন? তখন মার্কণ্ডেয় শিবশঙ্করের বরদানের প্রভাবে নর্মদা বিপুল শৈলকে ভেদ করে মহার্ণবে পতিত হয়েছিল। যখনই তিনি শিলা ভেদ করে মহার্ণবে পতিত হন তখনই মহারবে দিগ্দিগন্ত প্লাবিত করে প্রবাহিত হন। এই জন্য এর নাম হয়েছিল ‘রেবা’। শুধু তাই নয় দুঃখী, অভিশাপগ্রস্ত লোককে বিপাপ (পাপমুক্ত) করেন বলে এর অন্য নাম বিপাপা। আবার মানুষের দুঃখ মোচন করেন বলে এর নাম ‘বিপাশা’। নর্মদার জল নির্মল, বিমল। প্রলয়ের সময় জগৎ তমোময় হলেও নর্মদা মহাপ্রভাময়ী ছিলেন। তাই পণ্ডিতগণ ‘বিমলা’ নামেও অভিহিত করেন। নর্মদা ক্ষরিত হয়ে প্রবাহিত হলে বিশ্ব মুদিত হয়। তাই লোকে ‘করভা’ বলে। নর্মদা দর্শনমাত্রই ত্রিলোকরঞ্জিত হয়, এই লোকরঞ্জনের জন্য নর্মদার অন্য নাম ‘রঞ্জনা’।
নর্মদার ‘রেবা’ নামকরণের পৌরাণিক বাদে একটি লৌকিক কাহিনিও জানা যায়। আজ যেখানে নর্মদার উদ্গম কুণ্ড অতীতে সেখানে ছিল বাঁশবন এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ছিল বনজ ঔষধি গাছে পরিপূর্ণ। ছিল প্রচুর হরীতকী ও আমলকী গাছ। আমলকী, হরীতকীসহ বনজ ঔষধি সংগ্রহের জন্য অনেক গরিব মানুষেরা দুর্গম এই অরণ্যঘেরা পার্বত্য অঞ্চলে হিংস্র জন্তুর হাতে মৃত্যুর ভয়কে উপেক্ষা করে আসতেন। তেমনই একজন গরিব বনজ ঔষধি বিক্রেতা রেবা নায়েক। যিনি অন্য অনেকের মতোই দুর্গম এই অরণ্যঘেরা পার্বত্য অঞ্চলে হিংস্র জন্তুর হাতে মৃত্যুর ভয়কে উপেক্ষা করে আসতেন। রেবা নায়েকের সঙ্গে কখনও কখনও তার মেয়ে আসত।
একদিন আমলকী, হরীতকী এবং অন্যান্য ঔষধি সংগ্রহ করতে করতে দুপুর হয়ে গেলে রেবা নায়েক রান্নার ব্যবস্থা শুরু করলেন। তিনি মেয়েকে বললেন, যাও ওই বাঁশবনের ভেতরে যে জলের ধারা আছে, সেখান থেকে জল নিয়ে আসো। বাঁশবনের জলের উৎসে জল নিতে গিয়ে বালিকা পা পিছলে কুণ্ডে পড়ে যায়। এদিকে সময় বয়ে যায়। মেয়ে আসছে না। রেবা নায়েক মেয়েকে খুঁজতে থাকলেন। নাম ধরে জোরে জোরে ডাকতে থাকলেন। কিন্তু মেয়ে কোথায়? উদ্ভ্রান্ত পিতা কাঁদতে থাকলেন।
সহসা আকাশ থেকে দৈববাণী হল—রেবা তুমি কেঁদো না। তোমার মেয়ে আমার কাছেই আছে। আমি আমার মহিমা প্রচারের জন্য তোমার মেয়ে হয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলাম। আমিই মা নর্মদা। বাঁশবন থেকে বের হওয়া জলই আমার উদ্গম। তুমি আমার উদ্গমস্থলে একটি মন্দির নির্মাণ কর এবং শোন আজ থেকে আমি ‘রেবা’ নামেই খ্যাত হব। তা হবে সর্ব পাপমোচনের জপমন্ত্র। তুমি আমার মহিমা প্রচার কর। সেই থেকে নর্মদেশ্বর শিবের অপর নাম রেবেশ্বর।
রেবা নায়েক তখন বলল—কিন্তু মা, আমি তো খুবই গরিব। আমি কীভাবে মন্দির নির্মাণ করব?
দৈববাণী হল—হে রেবা! তোমার থলিতে তুমি আজ যে বনজ সম্পদ কুড়িয়ে রেখেছে গিয়ে দেখ সবই বহুমূল্য রত্ন হয়ে গেছে। তুমি সেগুলি দিয়েই আমার মন্দির নির্মাণ কর।
রেবা নায়েক মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করে দিলেন। আজ যে নর্মদা মন্দির আমরা দেখি যদিও সেটা রেবা নায়েকের নির্মিত মন্দির নয়। কালের গর্ভে সে মন্দির বিনষ্ট হয়ে গেছে। কয়েক শতাব্দী পরে নাগপুরের ভোঁসলে রাজারা নর্মদা উদ্গম কুণ্ড, স্নানকুণ্ড নির্মাণ করেছিলেন। পরে রেবার মহারাজ গুলাব সিংহ ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে মন্দির নতুন করে তৈরি করেন।
Leave a Reply