অবরোধ
০১. পাহাড়টার নাম গ্রে বাট
শহরের পশ্চিম সীমান্তে সতর্ক শান্ত্রীর মতো দাঁড়ানো পাহাড়টার নাম গ্রে বাট। শহরের ঠিক মাঝখান থেকে ক্রমশ ঢালু হয়ে শেষ বাড়িটার মোটামুটি শদুয়েক গজ দুরে হঠাৎ খাড়া ওপর দিকে উঠে গেছে প্রায় পাঁচশো ফুট। রাত। পাহাড়ের পাথুরে দেয়ালে উদীয়মান চাঁদের রূপালি আলো প্রতিফলিত হয়ে ঝিলমিল করছে। শীতের সময় মাঝে মাঝে বড়সড় পাথর চাই গড়িয়ে পড়ে নীচে, পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা বসতিটাকে যেন পিষে মারতে চায় নির্মমভাবে।
দশটা বেজেছে বেশিক্ষণ হয় নি। ঘুমের চাদরে মুড়ি দিয়েছে গোটা গ্রে বাট শহর। নিঝুম প্রকৃতি কেবল বাট স্যালুন, বাফেলো স্যালুন আর ডেলহ্যান্টিস মারকেন্টাইল স্টোর-এ এখনও আলো জ্বলছে। শহরের প্রধান সড়ক বাট স্ট্রীটের ঢালের শেষ প্রান্তে শেরিফের অফিসেও আলো দেখা যাচ্ছে।
বাট স্ট্রীটে হাঁটছে সোনিয়া ম্যাকনেয়ার, একা। খাড়া পাহাড়ের ছায়ায় দাঁড়ানো বাড়িতে ফিরে যাচ্ছে।
স্বচ্ছন্দ সাবলীল ভঙ্গিতে এগোচ্ছে মেয়েটা; মাঝে মাঝে থেমে ঘাড় ফিরিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চাইছে চাঁদের দিকে। এক বাক্স রিবন রয়েছে হাতে, কোরা শর্ট-এর দোকান থেকে ফিরছে ও; বিয়ের পোশাকের চূড়ান্ত ট্রায়াল দিয়ে এল।
সোনিয়া ম্যাকনেয়ার, ছিমছাম গড়ন, চলাফেরায় কিশোরী-সুলভ চপলতা, সারাক্ষণ হাসি লেগে আছে দুঠোঁটে, চোখজোড়ায় চঞ্চল দৃষ্টি। আগামী রোববারের পরের রোববারেই ওর বিয়ে, অধীর আগ্রহে দিন গুনছে।
স্যাটারলিদের পুরোনো বাড়ির ছায়ায় মৃদু নড়াচড়ার শব্দে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল সোনিয়া। অন্ধকার থেকে এলোমেলো অথচ দ্রুত পায়ে এদিকে এগিয়ে আসছে একটা লোক।
ভেতরে ভেতরে একটু চমকে উঠলেও ভয় পেল না সোনিয়া, দাঁড়িয়ে পড়ল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চেনার চেষ্টা করল লোকটাকে, পারল না। দৌড়ে পালানোর কথা ক্ষণিকের জন্যেও ওর ভাবনায় এল না। গ্রে বাট-এ রাতে রাস্তায় বেরোনো মেয়েদের জন্যে মোটেই বিপজ্জনক নয়।
অগ্রসরমান লোকটা গ্রে বাটের কেউ নয়, যখন বুঝতে পারল, দেরি হয়ে গেছে। অপরিচিত এবং নেশাগ্রস্ত দৌড়বে বলে ঘুরে দাড়াল সোনিয়া। গেটের কাছে এসে পড়েছে আগন্তুক। হ্যাচকা টানে গেট খুলেই সোনিয়ার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। পা বাড়ানোর সুযোগ পেল না সোনি, ধরা পড়ে গেল।
চিৎকার করার জন্যে মুখ খুললও, নোংরা একটা হাত চেপে বসল মুখের ওপর; প্রচণ্ড চাপে দম বন্ধ হয়ে এল। পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নিল ওকে আগন্তুক। গেট দিয়ে ঢুকে নির্জন অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।
সহসা তীব্র আতঙ্ক ভর করল সোনিয়ার বুকে। প্রবল বেগে হাত, পা, ছুঁড়তে শুরু করল ও; কামড়ে দিতে চাইল মুখে চেপে বসা হাতে। কেবল আরও শক্ত হলো হাতের চাপ। শরীরের সর্বশক্তি করে করে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করল সোনিয়া, লাভ হলো না। লোকটা অসম্ভব শক্তিধর, তার সাথে ও পারবে কেন?
দিশে হারিয়ে ফেলল সোনিয়া। অজানা ভয় বাড়তি শক্তি যোগাল ওকে। কিন্তু সাড়াশির মতো শক্ত দুটি হাতের চাপ এতটুকু কমল না। হাত পা ছুঁড়ছে, ও, আঁচড়ে দিচ্ছে লোকটার মুখে, কিন্তু কোনও পরোয়াই করছে না সে।
হাঁপাচ্ছে এখন আগন্তুক, নিঃশ্বাসের তপ্ত ছোঁয়া লাগছে সোনিয়ার চোখে মুখে। লাথি মেরে শূন্য ঘরের দরজা খুলল লোকটা, ঢুকে পড়ল ভেতরে।
এক হাতে সোনিয়াকে শরীরের সঙ্গে চপে রেখে অন্য হাতে টান মেরে, ফড়ফড় করে ওর পোশাক ছিড়ে ফেলল লোকটা; তারপর ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলল।
ভয়ে, আতঙ্কে চিৎকার করতেও যেন ভুলে গেছে সোনিয়া। করুণ আবেদন ঝরল, ওর কণ্ঠে, দয়া করো! হায় খোদা, দয়া করো:
কিন্তু বৃথা, কাকুতি মিনতিতে গলল না কঠিন পাথর। শুরু হলো ওর জীবনের ভয়ঙ্করতম এবং লজ্জাকর অভিজ্ঞতা। বাধা পেয়ে খেপে উঠছে লোকটা প্রতিমুহূর্তে, হিংস্র জানোয়ারের মতো হুঙ্কার দিচ্ছে। দুহাতে ক্রমাগত চড় বসাচ্ছে সোনিয়ার মুখে। অবশেষে একসময় চেতনা হারাল সোনিয়া, নিথর হয়ে পড়ে রইল।
সারা গায়ে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে জ্ঞান ফিরল সোনিয়ার; সেই সঙ্গে অপার্থিব আতঙ্ক আর সীমাহীন লজ্জা ভর করল মনে কবরের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে বাড়িটায়, একা পড়ে আছে ও।
উঠতে গিয়ে ব্যর্থ হলো সোনিয়া; হামাগুড়ি দিয়ে, পোশাক খুঁজল। কয়েকটা ছেড়া টুকরো ছাড়া কিছু পাওয়া গেল না। একটা চেয়ারে ভর দিয়ে কোনওমতে উঠে দাড়াল ও।
বেতস পাতার মতো কাঁপছে থরথর করে। চিন্তা করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। টলমল পায়ে একটা খোলা দরজার দিকে এগোল সোনিয়া; দরজা পেরিয়েই হোঁচট খেলো, হুমড়ি খেয়ে পড়ল একটা বিছানার ওপর। বিছানার চাদরে দুর্গন্ধ, তবু গায়ে জড়িয়ে নিল, শুয়ে রইল ওভাবেই। কাঁপছে, হু-হুঁ করে কাদছে মেয়েটা।
বেদনার্ত হৃদয়ে একটা ভাবনাই জেগে উঠছে বারবার: মাত্র এক ঘণ্টা আগেও ফুলের মতো নিষ্পাপ সুন্দর জীবন ছিল ওর; অথচ এখন কিছুই অবশিষ্ট নেই।
আস্তে আস্তে কাঁপুনি থামল। কিছুটা ভাবতে পারছে এখন। ক্রমশ ক্রোধ জেগে উঠছে মনে। যে লোকটা ওর সর্বনাশ করল, প্রচণ্ড ঘৃণা বোধ করছে তার প্রতি।
ওর এই ক্ষতি কোনওদিন পূরণ হবার নয়, কিন্তু আর কিছু না হোক, লোকটাকে তো অন্তত শাস্তি দেয়া যায়।
ময়লা চাদর গায়ে জড়িয়ে উঠে দাঁড়াল সোনিয়া; এলোমেলো পায়ে বেরিয়ে এল বাইরে।
উঠোন পেরিয়ে বড় রাস্তায় এল। দুটো স্যালুনের বাতিই নিভে গেছে, আঁধারে ডুব দিয়েছেডেলহ্যান্টিস মারকেন্টাইল; কিন্তু শেরিফের অফিসে এখনও আলো দেখা যাচ্ছে।
বাড়ি ফিরবে না শেরিফের অফিসে যাবে স্থির করতে এক মুহূর্তের বেশি সময় নষ্ট করুল না সোনিয়া; সোজা শেরিফের অফিসের দিকে ছুটে গেল। অন্ধকার, নিস্তব্ধ রাতে গলা বেয়ে উঠে আসা আর্তনাদ ঠেকানোর আর কোনও উপায় নেই।
.
শেরিফের জীর্ণ পুরাতন সুইভেল চেয়ারে বসে ডেস্কের উপর সবুট পা তুলে দিয়েছে ক্লিফ ফ্যারেল। কেন যেন অস্থির বোধ করছে; মাত্র এক হপ্তা পর ওর বিয়ে, সেটাই হয়তো কারণ। ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠল ক্লিফের ঠোঁটে, সোনিয়া ম্যাকনেয়ার যার হবু স্ত্রী, অস্থির তো তার লাগবেই।
দীর্ঘদেহী একহারা গড়নের যুবক ক্লিফ ফ্যারেল; মেহদীন পাকানো শরীর; কদিন আগে ছাব্বিশে পা দিয়েছে। বছর দুই হলো, জেস স্টোন বাট কাউন্টির শেরিফ হবার পর থেকে ও ডেপুটি শেরিফের দায়িত্ব পালন করে আসছে।
পাহাড় চূড়ার জমাট বরফের মতো নীলাভ ওর চোখ, সুন্দর করে ছাটা মাথাভর্তি সোনালি চুল। মুখে সব সময় অমায়িক হাসি লেগে আছে। কিন্তু প্রয়োজনের মুহূর্তে এই হাসিমাখা মুখই চোখের পলকে কঠিন হয়ে ওঠে।
অ্যাশট্রেতে সিগারেট ঠেসে নিভিয়ে, ডেস্ক থেকে পা নামিয়ে উঠে দাঁড়াল ক্লিফ ফ্যারেল। আর্তনাদ করে উঠল চেয়ারটা।
হাঁটতে হাঁটতে জানালার সামনে এসে দাঁড়াল ও; তারপর ঘুরে সেলব্লকের দরজার কাছে এল, অন্যমনস্কভাবেই লাথি হাঁকাল গরাদে। আজ কয়েদী নেই জেলে, খামোকা বসে না থেকে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেই ভালো হত।
আবার জানালার কাছে এসে বাইরে চোখ ফেরাল ফ্যারেল। নিকষ অন্ধকার। কিছু দেখা যাচ্ছে না রাস্তায়। তবে ওপাশের দোকানপাটের আবছা কাঠামো ধরা যাচ্ছে। অস্থির ভাবটা আবার ফিরে এল ওর মধ্যে।
ঢালু রাস্তায় ক্ষীণ নড়াচড়া ধরা পড়ল ক্লিফের চোখে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল ও। পরমুহূর্তে এক টানে দরজা খুলে বেরিয়ে এল। ক্ষণিকের জন্যে মেয়ে কণ্ঠে ফুপিয়ে ওঠার শব্দ এল কানে ছুটে এল সোনিয়া, দুহাতে বুকে টেনে নিল ক্লিফ।
বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে কিছু বলতে চাইল সোনি, কিন্তু একটা শব্দও বেরোল না মুখ দিয়ে। দুহাতে ওকে কোলে তুলে নিল ফ্যারেল। অফিসে ঢুকে পা দিয়ে ঠেলে দরজা বন্ধ করল, তারপর কম্পিত অবিশ্বাসভরা কণ্ঠে বলল, কী হয়েছে! দোহাই খোদার, বলো, তোমার কী হয়েছে?
একটা লোক! টানা দেয়া তারের মতো কাঁপছে মেয়েটা। নিজেকে সামলাতে পারছে না। খটাখট বাড়ি খাচ্ছে দুপাটি দাঁত।
কে? ভয়ঙ্কররকুম শান্ত ক্লিফ ফ্যারেলের কণ্ঠ; হিংস্র দৃষ্টি ফুটে উঠেছে দুই চোখে, যেন জ্বলছে দপদপ করে।
ওর বুকে মাথা গুঁজে রেখেছে সোনিয়া, কাঁপছে। চিনি না। স্যাটারলিদের ভাঙা বাড়ির উঠোনে লুকিয়েছিল। হায় খোদা…!
আরও শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরল ক্লিফ। যেন এভাবেই মেয়েটার মনের সব ভয় দূর করা যাবে, কাপুনি থ্রামবে। মৃদু কণ্ঠে বলল, তাকে আমি ধরব, সোনি। যেভাবেই হোক!
অসহায়ের মতো সোনিয়াকে ধরে বসে আছে ক্লিফ, সান্তনা দেয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। সোনিয়ার মুখের দিকে তাকাল। ঠোঁট দুটো কেটে গেছে, রক্ত বেরোচ্ছে, ফুলে উঠছে। এক চোখে চোট লেগেছে, কালশিটে পড়ে গেছে ওখানে। চামড়া ছড়ে লাল হয়ে গেছে এক পাশের গাল।
চলো, তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিই?
না। প্লিজ, ক্লিফ, এখন না!
অফিসের কাউচে সোনিয়াকে শুইয়ে দিল, ফ্যারেল। হাঁটু গেড়ে বসল পাশে। দ্বিধাগ্রস্ত। এই মুহূর্তে সোনিয়ার কাছে থাকা দরকার, ওকে একা রেখে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু এখানে বসে থাকার অর্থ দুবৃত্তকে বিনা বাধায় পালানোর সুযোগ দেয়া।
উঠে দাঁড়াল ক্লিফ ফ্যারেল। ওঅশ স্ট্যান্ডের গামলায় ঠাণ্ডা পানি ঢেলে একটা তোয়ালে ভিজিয়ে আস্তে আস্তে সোনিয়ার রক্তাক্ত মুখ মুছে দিল। ভয়ার্ত চোখে ক্লিফের দিকে তাকাল সোনিয়া, দৃষ্টিতে বেদনা, সীমাহীন গ্লানি। প্রায় নিঃশব্দে নড়ে উঠল ওর ঠোঁটজোড়া। ওকে খুন করতে হবে, ক্লিফ! যেভাবে পারো! শাস্তি দাও লোকটাকে, ওর কারণেই আমাদের বিয়ে ভেঙে গেল!
কে বুলেছে! কেন একথা বলছ? না হয় একটু চোট পেয়েছ, তাতে কী? দুদিনেই সেরে যাবে। বিয়ে ভাঙার প্রশ্নই উঠে না।
সোনিয়ার চেহারা দেখে লোকটার টুটি কামড়ে ছিড়তে ইচ্ছে করছে ফ্যারেলের। অস্ফুট কণ্ঠে সোনিয়া বলল, আমার মতো মেয়েকে কেউই কথা শেষ হলো, না, কান্নায় ভেঙে পড়ল!
চলো তোমাকে বাড়ি দিয়ে আসি, বলল ফ্যারেল, তারপর ডাক্তারের কাছে যাব।
এবার আপত্তি করল না, সোনিয়া। হতাশার ছাপ ওর চেহারার প্রতিটি রেখায়। ওকে কোলে তুলে নিল ক্লিফ ফ্যারেল। সোনি, আমি একবিন্দু বাড়িয়ে বলছি না, তোমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যেও না, বলতে পারো স্বার্থপর হয়ে পড়েছি, তোমাকে ছাড়া বাঁচব না আমি।
ওর কথা সোনিয়া শুনেছে কিনা বুঝল না ক্লিফ। ভাষাহীন শূন্য দৃষ্টি ফুটে উঠল ওর চোখে। আতঙ্কে শিউরে উঠল ক্লিফ। সোনিয়াকে নিয়ে জেলহাউস থেকে বেরিয়ে এল, দ্রুত এগোল ওদের বাড়ির দিকে।
একটু পরেই গেটে পৌঁছে গেল, লাথি মেরে গেট খুলে প্রায় ছুটল দরজার উদ্দেশে। পা দিয়ে দুরজায় ধাক্কা মেরে, অধৈর্যভাবে অপেক্ষা করতে লাগল। এখন কাঁপছে না সোনিয়া। ওর চেহারা দেখতে পাচ্ছে না ফারেল, কিন্তু বুঝতে পারছে, এখানে আসার ফাঁকে ভয়ঙ্কর পরিবর্তন এসেছে মেয়েটার মাঝে।
ধুলো-মলিন জানালার কাঁচের ওপাশে আলোর আভাস দেখা গেল।
পরমুহূর্তে দরজা খুলে গেল।
আমি ক্লিফ, কর্কশ কণ্ঠে বলল ফ্যারেল, সোনিকে নিয়ে এলাম। মারাত্মক একটা দুর্ঘটনায় পড়েছিল ও। সোনিয়াকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল ক্লিফ। প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও দ্রুত সামলে নিয়ে একরাশ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল সোনিয়ার বাবা জুলস ম্যাকনেয়ার। হাউমাউ কান্না জুড়ে দিল সোনিয়ার মা।
দ্রুত দোতলায় এসে সোনিয়াকে বিছানায় শুইয়ে দিল ফ্যারেল। মুহূর্তের জন্যে দাঁড়িয়ে ওর ভীত-সন্ত্রস্ত চেহারার দিকে তাকাল। শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠবে ওকিন্তু মনের ওপর যে আঘাত লেগেছে?
ঠোঁটজোড়া বেঁকে গেল ওর; ঘাড় ফিরিয়ে সোনিয়ার বাবা-মায়ের দিকে তাকাল। দোহাই লাগে, আপনারা অস্থির হবেন না! চোট পেয়েছে সোনি, আপনারা নন। এখন আপনাদেরই ওকে সাহস যোগাতে হবে। আপনাদের সাহায্য, সহযোগিতা ওর সবচেয়ে বেশি দরকার এই মুহূর্তে
ওর কর্কশ কণ্ঠস্বরের কারণেই কিনা কে জানে, সোনিয়ার বাবা মাকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হলো ক্লিফ। এখুনি ডাক্তার আনছি আমি, আবার বলল ও।
তাড়াতাড়ি নীচে নেমে অন্ধকার রাস্তায় বেরিয়ে এল ক্লিফ ফ্যারেল। একদৌড়ে দুব্লক দূরে ডাক্তারের বাড়িতে পৌঁছুল। হাঁপাতে হাঁপাতে করাঘাত করল দরজায়।
বাড়ির ভেতরে আলো জ্বলল। দরজা খুলে দাঁড়াল ডাক্তার রুফাস বোনার, এম ডি, ঢিলেঢালা ফ্লানেরের শার্ট তার গায়ে, উস্কোখুস্কো মাথাভর্তি চুল।
জলদি তৈরি হয়ে নাও, ডাক্তার, বলল ফ্যারেল। সোনির অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে!
ভেতরে এসো, কর্কশ অথচ স্পষ্ট ডাক্তারের কণ্ঠস্বর।
ভেতরে ঢুকে দরজা আটকাল ক্লিফ। মুহূর্তের জন্যে ওকে জরিপ করল ডাক্তার। তারপর ঘুরে শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। অ্যাক্সিডেন্ট? কীভাবে? শোবার ঘর থেকে প্রশ্ন করল সে।
একটা লোক, সোনিয়া চেনে না, কোরা শর্টের দোকান থেকে ফেরার পথে হামলা করেছে ওকে।
ওকে কী…?
ডাক্তার শব্দটা এড়িয়ে যাওয়ায় সারা শরীর আড়ষ্ট হয়ে গেল ফ্যারেলের। কঠিন কণ্ঠে জবাব দিল, হ্যাঁ, মেরেছে। কেমন যেন করছে এখন। আমি…আতঙ্কে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে আমার ডাক্তার!
প্যান্ট আর জুতো পরে শার্ট গায়ে চাপাতে চাপাতে বেরিয়ে এল ডাক্তার বোনার। ফ্লানেলের শার্টটা, খোলে নি; ওটার নীচের অংশ প্যান্টের নিচে গোঁজায় কোমরের কাছে বেঢপভাবে ফুলে আছে।
বোতাম লাগিয়ে প্যান্টের নীচে ভালো করে শার্টটা টেনে দিল ডাক্তার। কোট, টুপি আর দরজার পাশের টেবিল থেকে ব্যাগ তুলে নিয়ে বলল, চলো!
ডাক্তারের পেছন পেছন বাইরে এসে দরজা আটকে দিল ক্লিফ।
লোকটাকে ধরতে পেরেছ?।
না। তবে ধরব। ডাক্তারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দ্রুত এগোল ক্লিফ। ক্রমেই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে ও। সোনি ভালো হবে তো, ডাক্তার? মেয়েরা এসব সামলে উঠতে পারে?
কেউ পারে কেউ পারে না। বিয়েটা ভেঙে দিচ্ছ নাতো? পাগল? সোনির কী দোষ?
অস্পষ্ট শব্দ করল ডাক্তার, সন্দেহমিশ্রিত কণ্ঠে বলল, কিন্তু পরে-শহরের সবাই যখন জানবে?।
কেউ জানবে না… থেমে গেল ফারেল। কথাটা ঠিক নয়, যত চেষ্টাই করুক, জানাজানি হবেই, গোপন রাখা যাবে না। আর জানাজানি হলেই বা, কী আসে যায়?
সেটা অবশ্য তোমার ওপর নির্ভর করে।
সোনিয়াদের বাড়িতে পৌঁছুল দুজনে, গেট খুলে ভেতরে ঢুকল। দোরগোড়ায় অপেক্ষা করছিল জুলস ম্যাকনেয়ার, নিঃশব্দে ঢোকার জায়গা করে দিল।
দোতলায় উঠে গেল ডাক্তার বোনার। ওপর থেকে সোনির মায়ের কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। অসহায়ের মতো সোনির বাবার দিকে তাকাল ক্লিফ।
বেজন্মাটাকে ধরো, ক্লিফ, জীবন দিয়ে হলেও!বলল জুলস ম্যাকনেয়ার।
০২. সোনিয়াদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে
সোনিয়াদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে, ক্ষণিকের জন্যে পোর্চে দাঁড়াল ক্লিফ, ভুরু কুঁচকে বাট স্ট্রীটের দিকে তাকাল। শহরটা এখন আর, অন্ধকারে ডুবে নেই।
ওধারে অন্তত ছসাতটা বাড়িতে আলো জ্বলে উঠেছে। জুলস ম্যাঁকনেয়ারের কাছ থেকে হারিকেন চেয়ে নিয়েছে ক্যারেল, দ্রুত স্যাটারলিদের পরিত্যক্ত বাড়িটার দিকে এগোল ও।
সোনিয়াদের কয়েকটা ঘর পরেই ডেল পোমরয়ের বাড়ি। গেটের সামনে দাঁড়িয়েছিল সে, ক্লিফ কাছে আসলে জানতে চাইল, সোনিকে নিয়ে গেলে না তখন? কী ব্যাপার? আমি কোনও কাজে আসতে পারি?
অসহায় অবস্থায় ফাঁদে পড়েছে বলে মনে হলো, ক্লিফের। এতক্ষণ নিশ্চয়ই চুপ করে বসে থাকে নি পোমরয়। সোনিকে নিয়ে যেতে দেখেছে ওকে। এতগুলো ঘরে বাতি জ্বলছে যখন, তার মানে সময় নষ্ট না করে রাষ্ট্র করেছে সে খবরটা।
ঠিক আছে, জবাব দিল ক্লিফ, এসো।
কী হয়েছে?
অচেনা এক লোক, সোনিকে থেমে গেল ফ্যারেল, কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছে না।
শুয়োরের বাচ্চা! পোময়ের কণ্ঠে নিখাদ বিদ্বেষ ঝরল।
প্রাথমিক ধাক্কা ধীরে ধীরে সামলে নিচ্ছে ক্লিফ, প্রচণ্ড ক্ষোভ জেগে উঠেছে মনে: অতীতে কখনও এরকম অনুভূতি হয় নি; ঘূণায় যেন কাঁপছে সারা শরীর। পাষণ্ডটাকে এই মুহূর্তে হাতে পেলে ছিড়ে কুটি কুটি করে ফেলত ও।
স্যাটারলিদের বাড়ির গেটে পৌঁছুনোর আগেই চারজন লোক যোগ দিল ওদের সঙ্গে। কারও হাতে রাইফেল, কেউ বইছে শটগান। চাপা অথচ হিংস্র কণ্ঠে কথা বলছে সবাই। গেটের সামনে থামল ক্লিফ। এখানে দাঁড়াও তোমরা। আমি দেখছি ভেতরে কেউ আছে কি না।
মেটো পথ ধরে এগোল ফ্যারেল, দরজা গলে ভেতরে ঢুকল। মেঝেয় সোনিয়ার ঘেঁড়া কাপড় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। হারিকেনের ম্লান আলোয় জ্বলজ্বল করে উঠল ক্লিফের দুচোখ আগুন জ্বলছে যেন।
হারিকেন টেবিলে রেখে সোনিয়ার পোশাকের ছেড়া টুকরোগুলো কুড়িয়ে নিল ফ্যারেল, টেবিলে বিছানো একটা নকশা ভোলা রুমালে বাঁধল। তারপর খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল পুরো কামরা। অন্ধ-আক্রোশে রীতিমতো জ্বলছে ও। অনুসরণ করার জন্যে সূত্র চায়, ঘোড়া হাঁকিয়ে বেরিয়ে পড়তে চায়। কিন্তু দিনের আলো ছাড়া ট্রেইল খুঁজে পাওয়া যাবে না, সুতরাং এই মুহূর্তে ধাওয়া করা সম্ভব নয়। পুরো ঘর তন্ন তন্ন করে তল্লাশি করেও কোনও সূত্র পেল না ক্লিফ।
হারিকেন হাতে কাপড়ের পুঁটলিসহ বেরিয়ে এল বাইরে। ডেল, বলল পোমরয়কে, যাও, শেরিফকে খবর দাও।
দ্রুত পা বাড়াল ডেল পোমরয়। আবার কথা বলল ক্লিফ, আরেকজন গিয়ে লেক্স মেসির কাছ থেকে জেনে আসো আজ রাতে অপরিচিত কাউকে স্যালুনে দেখেছে কি নাঃ আর ফ্র্যাংক হাইটের কাছে যাও একজন। ওরা কারও খোঁজ দিলে মন দিয়ে বর্ণনা শুনে এসো।
নির্দেশ পালন করতে এগিয়ে গেল দুজন। এবার অন্য দুজনের দিকে ফিরল ক্লিফ। তোমরা বাড়ি ফিরে যেতে পারো। আপাতত তেমন কিছু করার, নেই।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও আদেশ পালন করল ওরা। ভুরুজোড়া ফের কুঁচকে উঠল ফ্যারেলের, সোনিয়ার ক্ষতবিক্ষত বিধ্বস্ত চেহারা ভাসছে চোখের সামনে; ওর ভীত-আতঙ্কিত ভাব, কম্পিত কণ্ঠস্বর আর ভয়ার্ত দৃষ্টি মনে পড়ছে। বেঁচে থাকার আকাক্ষা যেন হারিয়ে ফেলেছে মেয়েটা।
চাপা কণ্ঠে খিস্তি করে উঠল ফ্যারেল। জানোয়ারটাকে ধরতে পারলে নরক যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করত ও, তাতে হয়তো খানিকটা কমত ওর অস্থিরতা।
জেলহাউসের দিকে পা বাড়াল ক্লিফ। অজান্তেই বুকের কাছে হাত উঠে এল, শার্টের পকেটে সাটা ব্যাজে আঙুল বোলাল।
মনের এই অবস্থায় ব্যাজ পরে থাকা ঠিক নয়। কারণ তা হলে কাল এটার মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হরে ও..
কিন্তু ব্যাজ খুলে ফেলল না ক্লিফ ফ্যারেল, হাত নামিয়ে আনল। আইন ফ্যারেলদের পারিবারিক পেশা। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত ওর দাদা টেক্সাস রেঞ্জার ছিল; বিশ বছরেও বেশি বাট কাউন্টির শেরিফের দায়িত্ব পালন করেছে ওর বাবা।
হঠাৎ মোড় ঘুরে ডান দিকের একটা শাখা-পথ ধরল ক্লিফ, দ্রুত, পা ফেলে এগোল।
রাস্তাটার শেষ মাথায় পৌঁছে ঘুরে ঝোঁপঝাড়ের মাঝে দাঁড়ানো একটা শ্যাকের দিকে এগিয়ে গেল, দরজার কাছে এসে কড়া নাড়ল।
খানিকপর হারিকেন জ্বলে উঠল ভেতরে। গভীর ফাসফেঁসে কণ্ঠস্বর ভেসে এল। কে? ঢুকে পড়লেই তো হয়!
ভেতরে ঢুকল ক্লিফ ফ্যারেল। হারিকেন টেবিলের ওপর রেখে উস্কোখুস্কো চুলে হাত বোলাল ও, বাবা জ্যাকব ফ্যারেল। হাত বাড়িয়ে একটা প্যান্ট নিয়ে পরল, চেয়ার টেনে বসে পড়ল।
জ্যাকব ফ্যারেল, প্রৌঢ়, ছিপছিপে গড়ন, ছফিটের মতো লম্বা; দৈহিক গড়ন দেখেই অনুমান করা যায়, একদিন চমৎকার স্বাস্থ্য ছিল তার। সারা মুখে অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন জ্যাকব ফ্যারেলের; শরীর আর হৃদয়টাও ওর ক্ষতবিক্ষত, ভাবল ক্লিফ, কিন্তু বাইরে থেকে.একদম টের পাওয়া যায় না।
তবে লোকটার চোখ দুটো আজও অতীতের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির স্মৃতি জাগিয়ে দেয়। পলক তুলে ছেলের দিকে তাকাল জ্যাকব ফ্যারেল। মাঝরাতে আমার ঘুম ভাঙানোর কারণ?।
ব্যাপারটা সত্যিই জরুরি।
সেটাই তো জানতে চাইছি!
সোনিয়া…কোরা শর্টের দোকান থেকে ঘরে ফিরছিল, আচমকা এক লোক হামলা করেছে ওকে অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে…
রেপ করেছে?
হ্যাঁ, মারধোরও করেছে।
তো আমার কাছে এসেছ, কেন, তাকে ধরতে না গিয়ে? নাকি সেটাও আমাকে বলে দিতে হবে?
কী করতে হবে আমি জানি, বলল ক্লিফ ফ্যারেল। সেজন্যেই তোমার কাছে এসেছি।
বাজে বকো না!
সকালের আগে ট্রেইল করা সম্ভব নয়,রই মধ্যে আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ডেপুটি শেরিফ হিসেবে যদি যাই, লোকটাকে জ্যান্ত ফিরিয়ে আনতে বাধ্য থাকব আমি, কিন্তু সেটা সম্ভব হবে কিনা জানি না। এই মুহূর্তে বেজন্মাটার গলা টিপে ধরা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই পারছি না।
জ্যাকব ফ্যারেলের চেহারা থেকে বিরক্তির ছাপ খসে পড়ল। তিক্ত স্মৃতির ভারে চোখের পলকে দশ ব্লছর বয়স বেড়ে গেল যেন। দ্বিধা দেখা দিল দৃষ্টিতে। দুহাঁটুর মাঝে মেঝের দিকে তাকাল সে।
যে কথা জানতে এসেছিল, জেনে গেল ক্লিফ। এককালে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান কঠিন মানুষ ছিল বাবা, কোমরে ঝোলানো পিস্তল-চালাত ক্ষিপ্র হাতে। বহুবার তার চেয়ে ক্ষিপ্রতর লোকের মোকাবিলা করেছে, আইন-শৃঙ্খলাহীন বাট কাউন্টিতে জ্যাকব ফ্যারেলই ছিল একমাত্র আইন
সেই সময়, যখন কদাচিৎ এদিকে আসত সার্কিট জাজরা, যখন জুরীদের প্রাণের ভয় দেখিয়ে কিংবা অর্থের বিনিময়ে হাত করত অপরাধীরা, তখন, প্রায়শই, একই সঙ্গে বিচারক, জুরী আর জল্লাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হত জ্যাকব ফ্যারেলকে। বন্ধু আসামী গ্রেপ্তারে বাধা দিতে গিয়ে মারা পড়েছে ওর হাতে। লাশ নিয়ে মাথা উঁচু করে শহরে ফিরে এসেছে ও।
জ্যাকবের মতো মানুষেরাই এই বুনো-বর্বর দেশে আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু অসীম ক্ষমতা, উদ্ধৃত করে তুলেছিল ওকে, নিজেকে স্রষ্টার মতো ক্ষমতাবান ভাবতে শুরু করেছিল সে।
ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকাল বুড়ো ফ্যারেল। বুকের ওই ব্যাজ যদি রাখতে চাও, জ্যান্ত ফিরিয়ে এনো ওকে। কিন্তু লোকটাকে খুন করার উদ্দেশে বেরোতে চাইলে, ব্যাজ খুলে রেখে যেয়ো। ক্লিফের চোখের দিকে তাকাল না সে, ফাঁকা শোনাল তার কণ্ঠস্বর।
ঘুরে দাঁড়াল ক্লিফ ফ্যারেল। নিপ্রাণ কণ্ঠে আবার কথা বলল জ্যাকব। একান্তই যদি মারতে হয়, আগে নিশ্চিত হয়ে নিয়ো, লোকটা সত্যি অপরাধী কি না।
ধন্যবাদ, বাবা, বলল ক্লিফ। তোমার ঘুম ভাঙানোর জন্যে দুঃখিত।
ও কিছু না, সারা রাত তো জেগেই থাকি। গুড লাক।
নীরব-নিথর রাস্তায় বেরিয়ে এল ক্লিফ। ঝোঁপ আর জংলায় ভরা উঠোনে। দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত! কপালে চিন্তার রেখা-বাবার হাতে প্রাণ হারানো শেষ লোকটার কথা মনে পড়ে গেছে।
তখন ওর বয়স পনের, এক সকালে পরিশ্রান্ত ঘোড়ায় চেপে ফিরে এল বাবা; পেছনে আরেকটা ঘোড়া, সেটাও ক্লান্ত, পিঠে আড়াআড়িভাবে ফেলে রাখা একটা লাশ। এখনও স্পষ্ট মনে আছে লোকটার চেহারা: খুব বেশি হলে বছর কুড়ি বয়স; মাথাটা ঝুলছে, বিস্ফারিত ঘোলাটে দুটি চোখ, শক্ত হয়ে চেপে বসা দাঁতের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এসেছে কালচে জিহ্বা বীভৎস!
গর্বে ওর বুক ফুলে উঠেছিল সেদিন। একটু বমি বমি ভাব লাগলেও এতটুকু খাদ ছিল না ওর অহঙ্কারে। কিন্তু ঠিক এক সপ্তাহ পর চুরি করতে গিয়ে বমাল ধরা পড়ল এক লোক, প্রচণ্ড মারের মুখে স্বীকার গেল: বাবার হাতে প্রাণ হারানো লোকটা নয়, সে-ই আসল অপরাধী।
এখনও মনে আছে ক্লিফের, সেদিন থেকেই ঘুমের ঘোরে প্রলাপ বকতে শুরু করল বাবা সারারাত বিছানায় গড়াগড়ি যেত, যেন ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখছে। মাত্র ছমাসের মাথায় শক্তিমান সুপুরুষ জ্যাকব ফ্যারেলের চেহারা পাল্টে গেল, পরাজিত বিধ্বস্ত এক মানুষে রূপান্তরিত হলো সে।
ব্যথিত মনে দ্রুত প্রধান সড়কে উঠে এল ক্লিফ। বাঁক নিয়ে অন্ধকারে দাঁড়ানো সোনিয়াদের বাড়ির দিকে একবার তাকিয়ে শেরিফের আলোকিত অফিসের দিকে এগোল।
ধেৎ, খামোকই ভাবছে, তেমন কোনও সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন না-ও হতে পারে! পলাতক লোকটা, গ্রেপ্তারে বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে লড়াই অনিবার্য, সেক্ষেত্রে লাশ নিয়েই ফিরতে হবে ওকে।
সোনিয়ার কথা মনে পড়তেই আবার ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল ক্লিফ। অমন ফুলের মতো নিষ্পাপ মেয়ের সর্বনাশ করেছে যে পশু, তাকে খুন করতে বাধা কোথায়? কী লাভ হবে বাঁচিয়ে রেখে? লোকটাকে জ্যান্ত ধরা যদি সম্ভব হয়ও বিচারের ব্যবস্থা করা যাবে নাঃ লিঞ্চ মব ছিনিয়ে নিয়ে ধারেকাছের কোনও একটা গাছে লটকে দেবে তাকে।
পাথুরে জেল হাউসে ঢুকল ক্লিফ ফ্যারেল। শেরিফ জেস স্টোন এসে গেছে, লেক্স মেসি, ফ্রাংক হাইট এবং ওদের খোঁজে যাদের পাঠিয়েছিল, তারাও আছে।
ছোটখাট স্বাস্থ্যবান লোক স্টোন, তামাটে চেহারা, জুলফির কাছে চুলে পাক ধরেছে, টাক পড়তে শুরু করেছে মাথায়; মুরের মতো প্রকাণ্ড একজোড়া, লোমশ হাত, তার সঙ্গে মানানসই আঙুল। বন্দুকবাজ নয় জেস স্টোন, ক্ষিপ্র হাতে অস্ত্র চালাতে জানে না; প্রতি কদমে নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করে। গোয়ার অথচ কিছুটা অলস প্রকৃতির লোক সে, প্যসি ছাড়া কিছুতেই কাউকে ধাওয়া করতে বেরোবে না; কিন্তু শূন্যহাতে সে ফিরে এসেছে, এমন নজিরও নেই।
সহানুভূতিশীল দৃষ্টিতে ক্লিফ ফ্যারেলের দিকে তাকাল শেরিফ। কী হয়েছে, ক্লিফ? খুলে বলো দেখি আমায়?
ক্লিফ বলল, এখানে পায়চারি করছিলাম, ভাবছিলাম কাজ-কর্ম নেই যখন ঘরে ফিরে যাব কিনা। হঠাৎ জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখি বিছানার চাদর গায়ে জড়িয়ে দৌড়ে আসছে সোনি, কেমন যেন দিশেহারা একটা ভাব চেহারায়। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে ওর কাছে গেলাম। ও বলল, দোকান থেকে বাড়ি যাচ্ছিল, হঠাৎ স্যাটারলিদের বাড়ি অন্ধকার ছায়া থেকে বেরিয়ে ওকে আক্রমণ করেছে লোকটা, জোর করে নিয়ে গেছে খালি বাড়িতে।
কাপড়ের পুঁটুলিটা ডেস্কে রাখল ক্লিফ। সোনিকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আবার গিয়েছিলাম ওখানে। এগুলো ছাড়া আর কিছু পাই নি!
ডেস্কের কাছে এসে হাত বাড়াল স্টোন। বাধা দিল ফ্যারেল। না। যেভাবে আছে, থাকুক।
হাত সরিয়ে নিল স্টোন। ক্লিফ আবার বলল, ব্যাপারটা সোনি সংক্রান্ত তাই চেয়েছিলাম যাতে জানাজানি হয়। কিন্তু ওকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার সময় ডেল পোমরয় দেখে ফেলে, আমি বেরিয়ে আসার আগেই পাড়া প্রতিবেশীকে জাগিয়ে তোলে সে।
পোমরয়ের দিকে তাকাল স্টোন। দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টাই জানালার কাছে বসে থাকো নাকি?
লাল হয়ে গেল পোমরয়ের চেহারা। অনর্থক আমায় গাল দিচ্ছ, শেরিফ। ইদানীং রাতে আমার ঘুম হয় না, জানালার পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে থাকি। তাতে দোষ কী?।
প্রথমে লেক্স মেসি তারপর ফ্র্যাংক হাইটের দিকে তাকাল ক্লিফ। অচেনা কাউকে দেখেছ তোমরা?
মাথা নাড়ল মেসি। কিন্তু হাইট বলল, দুজনকে দেখেছি, ভবঘুরে ধরনের ছিল দুজনেই।
একসঙ্গে?
মাথা নাড়ল হাইট। না, কেউ কাউকে চেনে বলে মনে হয় নি।
ভেতরে ভেতরে দমে গেল ক্লিফ। ব্যাপারটাকে সহন: সরল ভেবেছিল, কিন্তু একই সময়ে শহরে দুজন অপরিচিত লোকের উপস্থিতি জটিল করে দিল সব কিছু। সোনি লোকটার চেহারার একটা বর্ণনা দিতে পারবে কিনা কে জানে! অন্ধকারে কিছু বোঝার কথা নয়। ওর কছ থেকে সাহায্য আশা না করাই ভালো।
ওদের চেহারার বর্ণনা দিতে পারো? হঠাৎ প্রশ্ন করল ও।
চোখ কুঁচকে উঠল হাইটের। দাঁড়াও, মনে করে দেখি। হায় খোদা, ক্লিফ, রোজ কত অচেনা লোকই তো আসছে যাচ্ছে, সবার চেহারা মনে রাখা কি মুখের কথা?
তবু চেষ্টা করো।
করছি। আরও ছোট হয়ে এল হাইটের দুচোখ। দুজনই বলিষ্ঠ গড়নের লোক, লম্বা চওড়ায় মোটামুটি তোমার মতোই হবে। পরনে কাউহ্যান্ডের পোশাক ছিল, ধুলো-ময়লায় একাকার। একজনকে একটু বেশি ক্লান্ত মনে হয়েছে আমার, পিস্তল ছিল না এর কাছে; অন্যজনের কোমরে পিস্তল দেখেছি। আরও কুঁচকে উঠল ওর ভুরু দুটো। আর কিছু মনে পড়ছে না, ক্লিফ। দুঃখিত।
ভালো করে ভেবে দেখোনতুন কিছু মনে আসতে পারে।
আচ্ছা। মনে এলে তোমাকে জানার। এবার তা হলে যাই? খুব ক্লান্ত লাগছে।
একসঙ্গে মাথা দোলাল ক্লিফ আর স্টোন।
সবাই বাড়ি চলে যাও, বলল শেরিফ, দরকার হলে ডাকব।
প্যসির ব্যবস্থা করবে?
দেখি। পরে জানাব।
বেরিয়ে গেল ওরা। ক্লিফের দিকে তাকাল স্টোন। আমি যা ভাবছি তুমিও কি তাই?
হোটেল আর লিভারি বার্ন, বলল ক্লিফ।
চলো।
হারিকেন নিভিয়ে ক্লিফের পিছু পিছু বেরিয়ে এল জেস স্টোন। পাশাপাশি হোটেলের দিকে এগোল। নিঃসঙ্গ একটা হারিকেন টিমটিম করে জ্বলছে হোটেলের লবিতে।
প্রথমে স্টোনকে ঢুকতে দিল ফ্যারেল, তারপর নিজেও ঢুকল। শাদা টাইলের মেঝেতে বুটের শব্দ তুলে ডেস্কের দিকে এগিয়ে গেল ওরা।
ডেস্কের ওপর মাথা রেখে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছ ক্লার্ক হিউগি স্মিদার। রেজিস্টার খাতা ঘুরিয়ে দেখল শেরিফ স্টোন। তারপর ক্লিফের দিকে ফিরে মাথা নাড়ল। লিভারি বার্ন-এই যেতে হচ্ছে, বলল সে।
০৩. শেরিফের পাশাপাশি হাঁটছে ক্লিফ
শেরিফের পাশাপাশি হাঁটছে ক্লিফ, মোটামুটি নিশ্চিত সে, লিভারি বার্ন-এর খড়ের গাদায় অন্তত একজনকে ঘুমন্ত অবস্থায় পাবে।
কিন্তু আস্তাবলে কেউ থাকলে, তার নির্দোষ হবার কথা, অচেনা শহরে কোনও মেয়েকে রেপ করে অপরাধীর পালিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। তবে লোকটা যদি পাড় মাতাল হয় উল্টো কিছু ঘটা বিচিত্র নয়।
যতই প্রতি পদক্ষেপে সম্ভাব্য অপরাধীর সঙ্গে দূরত্ব কমে আসছে ততই অস্থির হয়ে উঠছে ফ্যারেল! দুহাত মুঠি পাকিয়ে গেছে, রাগ সামলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। সোনিয়ার ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত চেহারা মনে পড়ছে। বারবার; ওর ভাষাহীন দৃষ্টি যেন তাড়া করছে-ক্লিফকে।
যাই হোক নির্ধারিত দিনে সোনিকে বিয়ে করবে ও। কিন্তু মেয়েদের ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা না থাকলেও এটুকু বুঝতে পারছে, মন থেকে ওকে সহজভাবে গ্রহণ করতে অনেক সময় নেবে সোনিয়া। চোখদুটো আচমকা কুঁচকে উঠল ফারেলের। সোনিয়াকে ভালোবাসে ও, নিজের করে পেতে চায়। কিন্তু খোদা জানে সেজন্যে কতদিন অপেক্ষা করতে হবে!
আকাশ-ছোঁয়া বিরাট লিভারি বার্ন-এর হলদে কাঠামো আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে আঁধারে। এটার চিলেকোঠায় কমপক্ষে পঞ্চাশটন খড় রাখার জায়গা আছে। খড়ের মজুদ এখন শেষ হয়ে এসেছে। সুতরং চিলেকোঠা মোটামুটি ফাঁকাই থাকবে।
আস্তাবলের প্রশস্ত দরজা হাট করে খোলা, বাতাসে ঘোড়ার নাদি, চামড়া আর খড়ের গন্ধ। স্টলগুলো থেকে ঘুমন্ত ঘোড়ার নড়াচড়া টের পাওয়া যাচ্ছে।
তুমি এখানে অপেক্ষা করো, মৃদু কণ্ঠে বলল জেস স্টোন। আমি নিকোলাসকে জিজ্ঞেস করে আসি।
বিশাল দরজার সামনে অপেক্ষা করতে লাগল ক্লিফ, চোখ কুঁচকে অন্ধকার ভেদ করে, ভেতরটা দেখার চেষ্টা করছে। ও-পাশের খোলা দরজার চৌকো আকৃতি ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছে না। ওদিকে কেউ পালানোর কসরত করলে ধরা পড়ে যাবে।
ট্যাকরুমের দরজা খুলল জেস স্টোন। খানিক পর নিকোলাসের ঘুমজড়িত কণ্ঠস্বর শোনা গেল। ধীর পায়ে ফিরে এল শেরিফ। নিকোলাস বলছে, একজন আগন্তুককে আজ চিলেকোঠায় ঘুমোতে দিয়েছে সে, ওপরেই আছে এখনও। আমি এই মই বেয়ে উঠছি, তুমি পেছন দিকে চলে যাও।
দুপাশের মই বেয়ে ওপরে উঠল ওরা, প্রবল হয়ে উঠল খড়ের গন্ধ। নতুন একটা গন্ধ লাগল নাকে-দুর্গন্ধ।
আধিভৌতিক ছায়াদের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল ক্লিফ ফ্যারেল। টানটান হয়ে রয়েছে ওর শরীরের প্রতিটি পেশী। হারিকেন বাম হাতে চালান করে সম্ভাব্য বিপদ মোকাবেলার জন্যে ডান হাত মুক্ত করে নিল ও। সামনে থেকে স্টোনের চিৎকার শোনা গেল। কে আছ এখানে! মাথার ওপর হাত তুলে, বেরোও, জলদি!
অখণ্ড নীরবতা। সাড়া নেই। ডান হাত থাবা পাকিয়ে রেখেছে ক্লিফ। এই মুহূর্তে কাউকে খুন করতে পারলে আর কিছু চায় না, সে দোষী না নির্দোষ কিছু এসে যায় না। এখানে কাউকে পাওয়া গেলে, তার হাত বা মুখে সামান্য আঁচড়ের দাগ দেখলেই হয়তো বিনা দ্বিধায় খুন করে বসবে ও। অন্য কোনও প্রমাণের অপেক্ষা করবে না। কিন্তু একজন আইনের লোকের পক্ষে এ-ধরনের চিন্তাভাবনা কি শোভা পায়?
চিলেকোঠার সামনের দিকে ঈষৎ আলোড়ন ধরা পড়ল ক্লিফের চোখে। একধারের নোংরা, খড়ের বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল এক লোক।
পোশাক থেকে খড়ের কুটো ঝাড়ল, আড়মোড়া ভাঙল; তারপর উবু হয়ে সম্ভবত টুপি কিংবা জুতোর দিকে হাত বাড়াল। কিন্তু ফ্যারেলের-তীক্ষ্ণ কণ্ঠ তাকে থামিয়ে দিল। একদম নড়ো না! মারা পড়বে!
দুপাশ থেকে এগিয়ে গেল ক্লিফ আর স্টোন। দুজনেরই ডান হাত মুক্ত, বাঁ হাতে হারিকেন। ফ্যালফ্যাল করে প্রথমে ক্লিফ তারপর স্টোনের দিকে তাকাল লোকটা।
মোটামুটি ক্লিফের সমান লম্বা, তবে ওর তুলনায় কিছুটা শুকনো। পরনে নোংরা শতচ্ছিন্ন পোশাক, খড়ের কুটো লেগে আছে। মাথায় দীর্ঘ উস্কোখুস্কো চুল, সারা মুখে দাড়ি গোঁফের জঙ্গল। কতদিন স্নান করে নি খোদা মালুম, বোটকা গন্ধ বেরোচ্ছে।
কর্কশ ঠাণ্ডা কণ্ঠে ওকে জিজ্ঞেস করল স্টোন, পিস্তল আছে, মিস্টার?
মাথা নাড়ল আগন্তুক।
এবার প্রশ্ন করল ক্লিফ ফ্যারেল, কর্কশ কণ্ঠস্বর। কী নাম?
হেলম্যান। জিম হেলম্যান।
হারিকেন উঁচিয়ে আগন্তুকের চেহারা খুঁটিয়ে পরখ করল ডেপুটি শেরিফ। ক্ষতচিহ্ন খুঁজছে। আছে, আগন্তুকের ডান গালে, জুলফির কাছে একটা কাটা দাগ।
রাগে জ্বলে উঠল ফ্যারেল; আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ঘটল যেন। ডান হাতে ঝট করে হেলম্যানের কলার ধরল ও। শুয়োরের বাচ্চা, তোমার গাল কাটল কী করে?
বিস্ময়ে বিস্ফারিত হলে হেলম্যানের চোখজোড়া। অজান্তেই হাত বাড়িয়ে ক্ষতে আঙুল ছোঁয়াল সে। কাটা গাছের সঙ্গে ঘষা লেগে… চুপ করে গেল হেলম্যান, ঢোক গিলল।
নাকি, হারামজাদা, কারও নখের দাগ?
ক্লিফ! ওকে শান্ত করার চেষ্টা করল স্টোন।
সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল হেলম্যান। দাঁড়াও! কী করেছি বলবে তো?
লোকটার কলার ছেড়ে দিল ফ্যারেল; নইলে, জানে, হারিকেন ফেলে বা হাতুও উঠিয়ে আনবে ও, হত্যা করার চেষ্টা করবে আগন্তুককে।
তোমাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হচ্ছে, রূঢ় কণ্ঠে বলল স্টোন।
কেন? কসম, খোদার, কী দোষ করেছি বলো?
হাত দিয়ে ওকে সামনে ঠেলে দিল জেস স্টোন। ক্লিফের সন্দেহ হলো বাধা দেয়ার চেষ্টা করবে লোকটা। করুক, মনে মনে প্রার্থনা করল ও।
কিন্তু সিদ্ধান্ত বদলাল আগন্তুক। অসংলগ্ন পা ফেলে সামনে এগোল। লোকটার টুপি আর জুতো তুলে নিল ক্লিফ। অনুসরণ করল ওকে।
মই বেয়ে স্টোন নীচে নামল আগে, ওর পেছনে হেলম্যান, জুতো আর টুপি নীচে ফেলে সব শেষে নামল ফ্যারেল। হেলম্যানের পায়ের দুটো মোজাই ভেঁড়া, আঙুল দেখা যাচ্ছে। জুতো পরে নিল সে, টুপিটা মাথায় চাপাল। ফের ওকে ধাক্কা দিল স্টোন। ওদের আগে আগে লিভারি বার্ন ছেড়ে বেরিয়ে এল হেলম্যান।
নিজেকে বঞ্চিত মনে হচ্ছে ক্লিফের; ফলে আরও খেপে উঠছে। ও যাকে খুঁজছে, সে হেলম্যান নয়। নিষ্ঠুর হিংস্র গোঁয়ার কেউ হবে অপরাধী; যাকে দেখলে স্পষ্ট বোঝা যাবে একমাত্র তার পক্ষেই সোনিকে অপমান করা সম্ভব। কিন্তু হেলম্যানের মাঝে অসহায় একটা ভাব ছাড়া কিছু নেই।
জেলহাউসে পৌঁছুল ওরা। হেলম্যানের কয়েক কদম পেছনে থেকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকে জরিপ করছে ফ্যারেল। আগে ভেতরে ঢুকে বাতি জ্বালল স্টোন। তারপর হেলম্যান ঢুকল, পেছনে ফ্যারেল।
হাতের হারিকেন নেভাল ও, নিভিয়ে দিল স্টোনেরটাও। বন্ধ করল দরজাটা।
এবার, ব্যাটা, কথা বল। সারা রাত ছিলে কোন চুলোয়?
ক্লিফ, স্টোন তারপর আবার ক্লিফের দিকে তাকাল হেলম্যান। কেন, ওই চিলেকোঠাতেই। দশটার পর থেকেই ওখানে ছিলাম!
নিকোলাস তোমাকে উঠতে দেখেছে?
স্ট্যাবলম্যান? একশোরার! আমার কাছ থেকে ম্যাচের কাঠিগুলো সে-ই তো কেড়ে রাখল।
তার আগে? কর্কশ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল ডেপুটি শেরিফ ফ্যারেল।
স্যালুনে, বাট স্যালুনে।
মদ গিলছিলে?
ঈষৎ লাল হলো হেলম্যানের চেহারা। শুধু এক গ্লাস বিয়র খেয়েছি। একটা নিকেল ছিল, সেটা দিয়েই বিয়র কিনেছি, খেয়েছি ফ্রি-লাঞ্চ কাউন্টারে।
মেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই কতদিন?
মেঝের দিকে চেয়ে জবাব দিল হেলম্যান। অনেকদিন। আমার মতো, লোকের কাছে মেয়েরা আসবে কেন?
হাত দুটো দেখি?
বিনা আপত্তিতে নির্দেশ পালন করল হেলম্যান।
উল্টো দিক।
হাত ওল্টাল হেলম্যান। আঙুলের গিঁটে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ক্ষতচিহ্ন খুঁজল ক্লিফ। সোনিয়াকে আঘাত করার সময় ওর দাঁতে লেগে কেটে থাকতে পারে। কিন্তু তেমন কিছু পাওয়া গেল না। এতে অবশ্য প্রমাণ হয় না লোকটা নির্দোষ।
স্টোন বলল, সেলে ঢুকিয়ে দাও ব্যাটাকে।
সেলব্লকের দরজার দিকে ইশারা করল ক্লিফ। হাঁটো।
আড়ষ্ট হয়ে গেল হেলম্যান। কী আশ্চর্য! কি দোষ করেছি বলবে না?
জবাব দিতে মুখ খুলল ফ্যারেল, কিন্তু আগেই কথা বলে উঠল শেরিফ। মনে করো বাউণ্ডেলের মতো ঘুরে বেড়ানোটাই আপাতত তোমার দোষ। যাও, এবার হাজতে ঢোকো।
হেলম্যানের চেহারায় স্বস্তির ছাপ পড়ল। ক্লিফের সঙ্গে হাজতের দিকে পা বাড়াল। ঢুকে পড়ল একটা সেলে। দড়াম করে দরজা আটকাল ফ্যারেল, তালা লাগাল, শেরিফের ডেস্কের ওপর ছুঁড়ে ফেলল চাবিটা।
ওর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল স্টোন। নাহ, আমরা যাকে খুঁজছি এলোক সে নয়।
দরজার সামনে এসে দাঁড়াল ক্লিফ ফ্যারেল, অগ্নিদৃষ্টিতে বাইরে তাকাল। তারপর হঠাৎ ঘুরে স্টোনের মুখোমুখি হলো। ছসাতজন লোক দাঁড়িয়ে আছে বাইরে।
দরজার দিকে এগিয়ে এল স্টোন। কবাটে লাগানো কাঁচের ফোকর দিয়ে উঁকি দিল। কিছু করছে না, বলল ক্লিফ, স্রেফ চুপচাপ দাঁড়িয়ে এদিকে তাকিয়ে, আছে।
জবাব দিল না স্টোন। টান মেরে দরজা খুলল। তারপর কর্কশ কণ্ঠে চিৎকার করে জনতার উদ্দেশে বলল, তোমাদের ঘরে যেতে বলেছি না!
ব্যাটা ধরা পড়েছে, তাই না, জেস?
একজনকে ধরেছি, কিন্তু ওই দোষী জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। যাও ঘরে ফিরে যাও সবাই।
ছেলে ভুলানো কথায় লাভ নেই, জেস। তুমি ভালো করে জানো ওটাই আসল হারামজাদা!
না, জানি না। কাল আবার জেরা করা হবে ওকে। তখন যদি দেখা যায় সে নির্দোষ, ছেড়ে দেব।
চেঁচিয়ে উঠল কেউ একজন। জেলে যখন ঢুকিয়েছ, ওই শালাই দোষী?
বিদ্রূপ ঝরল জেস স্টোনের কণ্ঠে। কাউন্টি পে-রোলে তোমার নাম লেখার ভাবছি, পোমরয়, কিছু টাকা বেঁচে যাবে। একাই জুরী আর জাজের, কাজ চালিয়ে নিতে পারবে অনায়াসে। ফিরে এসে সশব্দে দরজা বন্ধ করল, স্টোন, যথাস্থানে বসাল হুড়কোটা।
দরজার দিকে ফিরল ক্লিফ ফ্যারেল। পাঁচশো মাইলের মধ্যে এত মজবুত, সুরক্ষিত জেল কোথাও নেই, ভাবল ও। দুফুট চওড়া, আগাগোড়া পাথরের তৈরি দেয়াল, চৌকো বীমের ওপর বসানো ছাদ, কমপক্ষে চোদ্দ ইঞ্চি পুরু দুই বর্গ ফুটের একেকটা পাথরখণ্ড দিয়ে তৈরি হয়েছে মেঝে। এই জেল ভেঙে আসামীকে বের করে নেবে, এমন কেউ এখনও জন্ম নেয় নি।
জানালার শিকগুলো প্রায় এক ইঞ্চি মোটা, মাত্র তিন ইঞ্চি পর পর বসানো পাথরের বেশ গভীরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে ওগুলোর দুপ্রান্ত। বাইরে যাবার একমাত্র দরজা দুই ইঞ্চি পুরু ওক কাঠের তক্তায় তৈরি, ভেতর থেকে খুলে না দিলে জোর করে এখানে ঢোকা কঠিন।
ঘড়ির দিকে তাকাল ক্লিফ। রাত দুটো। ঘণ্টাখানেকের ভেতর ট্রেইল করার মতো পর্যাপ্ত আলো ফুটে উঠবে। স্টোনের উদ্দেশে ও বলল, আমাদের একজনের এখানে থাকা উচিত। তোমার আপত্তি না থাকলে আমি ট্রেইল, করতে চাই, জেস।
কাঁধ ঝাঁকাল জেস স্টোন, আপত্তির কী আছে। তোমারই তো যাওয়া দরকার।
ধন্যবাদ।
প্যসি লাগবে?
এক মুহূর্তের জন্যে দোটানায় ভুগল ক্লিফ ফ্যারেল। তারপর মাথা নেড়ে অসম্মতি জানাল। প্যসি ছাড়াই অনেক ঝামেলা সামাল দিতে হবে আমাকে। দরজার দিকে তাকাল ও। লিঞ্চিংয়ের পাঁয়তারা করছে শহরবাসীরা, ভাবল।
যেমন তোমার ইচ্ছে, বলে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল স্টোন, তারপর নিরাসক্ত কণ্ঠে বলল, নিজে সবার বিচার করত তোমার বাবা, সেটাই তার কাল হয়েছিল জীবনে। একবার মাত্র ভুল করেছে এবং একটা ভুলই ধ্বংস করে দিয়েছে তাকে। তুমিও একই ভুল করো না যেন।
একদৃষ্টে কয়েক মুহূর্ত স্টোনের দিকে তাকিয়ে থাকল ক্লিফ ফ্যারেল। কী করবে নিজেই বুঝতে পারছে না। খানিক আগে হেলম্যানের গালে ক্ষতচিহ্ন দেখেই তাকে খুন করতে খেপে উঠেছিল ও।
অপর লোকটার মুখোমুখি হবার পর কী ঘটবে কে জানে? জানতে পারলে ভবিষ্যতে ও শেরিফ হতে পারবে কিনা বোঝা যেত।
আস্তাবল থেকে ঘোড়া নিয়ে আসি, স্টোনের উদ্দেশে বলল, ক্লিফ ফ্যারেল।
মাথা দুলিয়ে সায় দিল শেরিফ। বাইরে বেরিয়ে এল ফ্যারেল। দরজা বন্ধ করে, হুড়কো বসাল স্টোন, বুঝিয়ে দিল, জনতাকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছে।
চেঁচিয়ে উঠল পোমরয়। কোথায় যাচ্ছ, ক্লিফ?
ঘোড়া আনতে।
প্যসি নিয়ে বেরোবে?
না। আমি একাই যাচ্ছি।
ভিড়ের মাঝে হেসে উঠল কে যেন। আরেকজন বলল, বাপকা বেটা!
লিভারি বার্ন-এর দিকে এগোল ক্লিফ ফ্যারেল। ওর বাবা সব সময় যেভাবে ফিরে আসত-ঘোড়ার পিঠে পলাতক আসামীর লাশ ফেলে-ওর কাছেও তেমনি কিছুই আশা করছে শহরবাসীরা।
হয়তো সেরকম কিছুই করবে ও। কে জানে? কানের কাছে সোনির কণ্ঠস্বর বাজছে: ওকে খুন কর, ক্লিফ। খুঁজে বের করে ওকে খুন কর!
সোনির ইচ্ছে তাই। ও নিজেও. তা-ই চায়।
আস্তাবল থেকে একটা বিশাল বাদামী গেল্ডিং ভাড়া করল ক্লিফ। এই শহরে এর চেয়ে শক্তিশালী, ঘোড়া আর নেই। সযত্নে ঘোড়ার পিঠে জিন চাপিয়ে জেলহাউসে ফিরে এল ফ্যারেল। ইতিমধ্যে আলোর আভাস দেখা দিয়েছে পুব দিগন্তে; ভোরের আগমনবার্তা ঘোষণা করছে।
জেলহাউসে ঢুকল ফ্যারেল। একটা রাইফেল বাছাই করল, দুবাক্স কার্তুজ নিল। অতিরিক্ত এক বাক্স কার্তুজ নিল পয়েন্ট ফোর-ফোর পিস্তলটার জন্যে। চাদর আর বর্ষাতি নিতে ভুল করল না।
বাইরে এসে স্যাডলে বাঁধল সব। রাস্তার ওধারে এখনও দাঁড়িয়ে আছে জনতা, তাকিয়ে আছে জেলহাউসের দিকে। একটা বোতল থেকে মদ খাচ্ছে পালা করে।
স্যাডলে চেপে সোনিয়াদের বাড়ির দিকে এগোল ক্লিফ। চারদিকে আবছা অন্ধকার। কী ভেবে হঠাৎ ঘুরে ডাক্তার বাড়ির পথ ধরল ও। রান্নাঘরে আলো জ্বলছে দেখে পেছনের দরজায় টোকা দিল।
নাশতা সারছিল ডাক্তার, স্বাগত জানাল ওকে। এসো। এসো, নাশতা করে নাও।
ভেতরে ঢুকল ক্লিফ। কফি ঢেলে দিল ডাক্তার। কাপে চুমুক দিল ডেপুটি। যে প্রশ্নটা এতক্ষণ খুঁচিয়ে চলছিল, অবশেষে জিজ্ঞেস করল। ওকে কেমন দেখলে, ডাক্তার? ভালো হবে তো?
মুখ ভর্তি রুটি নিয়ে মাথা দোলাল ডাক্তার। উঠে দাঁড়াল সে। তাওয়ায় চাপানো রুটিটা উল্টে দিল। তারপর ক্লিফের দিকে না ফিরেই বলল, ঘুমের ওষুধ দিয়ে এসেছি, ঘুমোচ্ছে ও, ঘুম থেকে উঠলে মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠবে। দেহ-মনে মারাত্মক চোট পেয়েছে মেয়েটা, সেই সঙ্গে একটা প্রবল ধাক্কা। দৈহিক আঘাত সামলে নিতে পারলেও মানসিক ধাক্কা সামলে উঠতে স্বভাবতই সময় লাগবে কিছুটা।
বিয়েটা পিছাতে হবে না তো?
মুহূর্তের জন্যে, ফ্যারেলের দিকে তাকিয়েই দৃষ্টি সরিয়ে নিল ডাক্তার। সেটা করলে মারাত্মক ক্ষতি করা হবে মেয়েটার। যে ভাবে হোক বিয়েটা সেরে ফেল। কিন্তু শুরুতে ওর কাছ থেকে বেশি কিছু আশা করতে যেয়ো না।
কফি পান শেষে ডাক্তারকে ধন্যরাদ জানিয়ে বেরিয়ে এল ক্লিফ ফ্যারেল। খালি চোখে মাটি দেখা যাচ্ছে, ট্রেইল করার সময় হয়েছে।
০৪. সোজা হোটেলের দিকে এগোল ফ্যারেল
কোনওদিকে না তাকিয়ে সোজা হোটেলের দিকে এগোল ফ্যারেল। ভোরের হিমেল হাওয়া বইছে। চারদিক কেমন যেন থমথম করছে। হোটলের রান্নাঘরে বাতি জ্বলছে, পেছনের দরজার দিকে পা বাড়াল ও।
হোটেলের বাবুর্চির কাছ থেকে কফি, বেকন, ময়দা, আর কিছু শুকনো মাংস নিল সঙ্গে নেয়ার জন্যে। সব কিছু একটা ব্যাগে ভরে স্যাডলের পেছনে বেঁধে ফেলল ওটা। তারপর স্যাডলে চেপে ঘোড়াকে হটিয়ে নিয়ে শহর ছেড়ে বেরিয়ে এল। জেলহাউসের সামনে যারা জটলা পাকাচ্ছিল তারা আপাতত বিদায় নিয়েছে। কফির-কাপে চুমুক দিয়ে সময় কাটাতে গেছে হয়তো-ভাবল ফ্যারেল।
সঠিক ট্রেইল খুঁজে পেতে কষ্ট হবে। ভুল হবার আশঙ্কা ষোল আনা। তবে যতটা ভাবছে ততটা অসুবিধে নাও হতে পারে; ও যাকে খুঁজছে, সাধারণ অশ্বারোহীর তুলনায় নিঃসন্দেহে দ্রুত ঘোড়া হাঁকাবে সে; সুতরাং তার ট্রেইল আলাদা করে চেনা যাবে।
শহর সীমান্তে পৌঁছে হঠাৎ দুপাশ থেকে চেপে এসেছে বাট স্ট্রীট, রাসলার ক্রিকের এপাশে ডানে বাঁক নিয়েছে, চলে গেছে দক্ষিণে। সেতু পেরিয়ে স্যাডল থেকে নামল ফ্যারেল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রাস্তা জরিপ করল।
শুকনো বালিতে অসংখ্য ট্রাক, কিন্তু ট্র্যাকিংয়ে দক্ষ ক্লিফ ফ্যারেল, কয়েক মুহূর্তের পর্যবেক্ষণেই দ্রুত গতিতে ছুটে যাওয়া একটা ঘোড়ার ট্র্যাক আবিষ্কার করল।
ধীরে ধীরে ঘুম ভেঙে জেগে উঠছে প্রকৃতি। রক্তিম আভা লেগেছে পুব আকাশে।
আবার স্যাডলে উঠে বসল ফ্যারেল। ভুরু কুঁচকে রাস্তার দিকে তাকাল। এগোতে শুরু করেছে গেল্ডিং। ঘোড়ার ট্র্যাক দেখতে তেমন অসুবিধে না হলেও অসংখ্য ট্র্যাকের মাঝে নির্দিষ্ট ছাপটা প্রতিক্ষণে আলাদা করে নজরে রাখতে চোখের ওপর চাপ পড়ছে।
ট্রাক অনুসরণ করে প্রায় মাইল খানেক এগোল ফ্যারেল। এখানে ঘোড়া ঘুরিয়েছে অশ্বারোহী। ক্লিফও তাই করল। এবার অনেকটা সহজ হয়ে এল অনুসরণের কাজ। ছোটার গতি বাড়াল ও। কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছে যেন এটাই আসল ট্র্যাক হয়।
পুব আকাশ ফর্সা হলো। আরও একবার ঘোড়া থেকে নামল ফ্যারেল। হাঁটু গেড়ে বসে ঘোড়ার পায়ের ছাপ পর্যবেক্ষণ করল।
কয়েক ঘণ্টা আগে এপথে গেছে অশ্বারোহী, আন্দাজ করল। ট্র্যাক চিনতে ভুল না হলে সময়ের অনুমান সঠিক হওয়ার কথা।
এখানে এসে চলার গতি কমিয়ে এনেছে আগন্তুক, বুঝতে পারল ক্লিফ। মিলে যাচ্ছে। অপরাধ সংঘটনের পর ঝড়ের গতিতে ঘোড়া দাবড়ে শহর থেকে বেরিয়ে এসেছে লোকটা। কিন্তু ঘোড়াটাকে মেরে ফেলার ইচ্ছে নেই তার, তাই গতি কমাতে বাধ্য হয়েছে।
আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্য করল ফ্যারেল, সামনের মোড়াটার খুরে ক্ষয়ে যাওয়া নাল পরানো। পেছনের দুপায়ের নাল অপেক্ষাকৃত নতুন, তবে ওগুলোরও পেছনের দিক ক্ষয় হয়ে গেছে। সম্ভবত অনেকদিন ধরে রুক্ষ বন্ধুর পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে লোকটা।
ট্রেইল অনেকটা মানুষের চেহারার মতো, ভাবল ক্লিফ, একজন মানুষের চেহারার বর্ণনা দিতে গেলে অনেক সময় এমন দাঁড়ায়, ওই বর্ণনার সঙ্গে অন্তত হাজারখানেক লোকের মিল পাওয়া যায়। কিন্তু লোকটার চেহারা কেমন জানা থাকলে, অন্য কারও সঙ্গে গুলিয়ে ফেলার ভয় থাকে না।
সন্তুষ্ট ক্লিফ আবার স্যাডলে চেপে সামনে বাড়াল। এপথ শেষ হওয়ার আগেই ফেরারী সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা যাবে। বোঝা যাবে, আগন্তুক ভদ্রলোকের মতো স্বাভাবিকভাবে খোলা প্রান্তরের ওপর দিয়ে গেছে না ধরা পড়ার ভয়ে ট্রেইল গোপনের চেষ্টা চালিয়েছে।
ইতিমধ্যে সূর্য উঠে পড়েছে, গরল ঢালছে অকৃপণ হাতে। যেদিকে তাকাও বিস্তৃত বিরান সমভূমি। মাঝে মাঝে দূরে দিগন্তের কাছে গ্রে বাটের মতো দু-একটা পাহাড় দেখা যায়, সতর্ক প্রহরীর মতো মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কখনও কখনও সংকীর্ণ ওঅশ চোখে পড়ছে, খাড়া পাহাড়ের মতো ওগুলার তীর।
এ-এলাকার অন্ধিসন্ধি ক্লিফ ফ্যারেলের নখদর্পণে। জানে একশো মাইলের মধ্যে কোনও জনবসতি নেই। পায়ের নীচের মাটি চালু হয়ে ক্রমশ ওপর দিকে উঠে গেছে, প্রায় পঞ্চাশ-ষাট মাইল দূরে সিডার আর পিনন পাইনে ছাওয়া একটা গিরিপথ অতিক্রম করে আবার নীচে নেমেছে। মরুভুমির মতো বিশুষ্ক একটা প্রান্তর পেছনে ফেলে শোশন ক্রিকের উপত্যকায় শেষ হয়েছে পথের। শোশন ক্রিকে পৌঁছার আগেই পলাতক, লোকটাকে ধরতে হবে, নইলে ফসকে যাবে শিকার।
ক্লিফের দুই চোখে বরফের শীতলতা; চেহারায় ইস্পাতের কাঠিন্য। আজ শিকারীতে পরিণত হয়েছে ও, সীমাহীন আক্রোশ নিয়ে চলেছে শিকারের সন্ধানে।
সহসা বুঝতে পারল, ক্লিফ, সামনের লোকটা ট্রেইল গোপনের চেষ্টা করুক, এটাই চাইছে সে। অপরাধের প্রমাণস্বরূপ এরকম কিছু সাক্ষ্য পাওয়া দরকার।
অবশ্য এমনও হতে পারে, লাঞ্ছিত মেয়েটা লজ্জার কথা গোপন রাখবে ভেবে ট্রেইল আড়াল করার প্রয়োজনই বোধ করবে না সে।
ক্লিফের বিষণ্ণ চেহারায় করুণ হাসি ফুটে উঠল। দুনিয়ার কোনও ল অফিসার কখনও এমন করবে না-নিজেই আসামীর বিচার করতে চাইছে, তার মৃত্যুদণ্ড কামনা করছে মনে প্রাণে।
আসামীকে ধরার পর কী করবে? বিবেকের কাছে জবাব খুঁজল ফ্যারেল। অনেক ভেবেও যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর মিলল না। কী করবে জানে না ও। তবে ফেরারী লোকটার আচরণের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে, সে বাধা, দিলেহত্যা করা ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না; কিন্তু আত্মসমর্পণ করলে।
এসব ভাবনা ঝেড়ে ফেলে সোনিয়ার কথা ভাবতে চাইল ফ্যারেল। মনে পড়ল কাল কীভাবে দৌড়ে আসতে দেখেছিল ওকে। শেরিফের অফিসের তুলনায় বাসা কাছে হওয়া সত্তেও ওর কাছেই ছুটে এসেছে সোনিয়া।
ওর ওপর পুরোপুরি নির্ভর করেছে সোনি, বলেছে অপমানের প্রতিশোধ নিতে। সক্রোধে মাথা নাড়ল ক্লিফ, না চাইলেও মনের গভীরে বার-বার জেগে উঠছে একটা প্রশ্ন: লোকটা যদি দোষী না হয়?
আরও কথা আছে: কে অপরাধী সে বিচার করার অধিকার কি ওর আছে? যদি ভুল করে ফেলে?
অনুসরণ করতে এখন কষ্ট হচ্ছে। আরও কয়েক মাইল পথ অতিক্রম করার, পরও অবস্থার পরিবর্তন হলো না। কখনও কখনও পাথুরে এলাকা বেছে নিয়ে এগিয়েছে পলাতক ঘোড়সওয়ার ফলে আরও দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে কাজটা। কয়েকবার ক্যাটল-ট্রেইলের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল সামনের ট্রাক। এদিকে কোনও জলাশয়ের দিকে গেছে, হয়তো জানোয়ারের দল। ধূর্ত লোকের পাল্লাতেই পড়া গেছে!-ভাবল ফ্যারেল, ট্রেইল গোপনে ইন্ডিয়ানদের মতো দক্ষ সে। তবে ট্র্যাকিংয়ে ক্লিফ কম যায় না। লোকটার ক্যাটল-ট্রেইল বেছে নেয়ার কারণ জলের মতো পরিষ্কার: গরু-মোষের আরেকটা পাল গেলেই তার ট্র্যাক নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে; কিন্তু অঘটন ঘটার আগেই পৌঁছুতে পেরেছে ফ্যারেল।
ভুরু কুঁচকে, ট্রেইলের দিকে তাকিয়ে আছে ক্লিফ, ভাবছে, এ গতিতে এগোলে শোশন ক্রিকে পৌঁছুনোর আগেই লোকটার, দেখা পাওয়া যাবে তো?
ব্যাকুল চেহারায় ফেরারীর ছোটার গতি আন্দাজ করার চেষ্টা করল ক্লিফ, নিজের গতি তুলনা করল, স্পষ্ট হয়ে গেল: এখনও বিস্তর ব্যবধান দুজনের মাঝে।
কমপক্ষে ওর পাঁচ ঘণ্টা আগে যাত্রা শুরু করেছে, লোকটা, ট্রেইল অনুসরণের ঝামেলা নেই তার, অনায়াসে দ্রুত ছুটতে পারছে। কিন্তু ক্লিফের অবস্থা এর ঠিক উল্টো।
দূরত্ব ক্রমে বাড়ছে। লোকটাকে অতিক্রম করে সামনে যাবার একটা উপায় বের করতে না পারলে ব্যবধান বাড়তেই থাকবে, চিরদিনের মতো হাতছাড়া হয়ে যাবে শিকার।
চোখ কুঁচকে আছে ফ্যারেলের। এলাকা সম্পর্কে জানা খুঁটিনাটি প্রতিটি তথ্য মনে মনে নেড়েচেড়ে দেখল। তারপর, হঠাৎ স্পরের খোঁচা লাগাল ঘোড়ার পেটে।
ঠিক যেখানে মরুভুমির শুরু, একটা খাড়া পাথুরে ব্লাফ আছে ওখানে। ওইপথে মরুভুমিতে পৌঁছুনোর মাত্র তিনটে ট্রেইল। তিনটেই সংকীর্ণ। ওগুলোরই একটা ব্যবহার করতে হবে লোকটাকে।
কিন্তু ওদিকে না গিয়ে যদি পুব, কিংবা পশ্চিমে যায় তাকে আর ধরা যাবে না। আবার ট্রেইল ধরে এগোলেও তার নাগাল পাওঁয়া অসম্ভব, অনায়াসে কেটে পড়বে আগন্তুক। শোশন ক্রিকে একবার পৌঁছুতে পারলে মাইলকে মাইল কোনও চিহ্ন না রেখে উধাও হয়ে যাবে সে। সুতরাং ঝুঁকি না নিয়ে উপায় নেই।
সিদ্ধান্ত নিতে যা দেরি, প্রাণপণে ঘোড়া হাঁকলো ক্লিফ। ফেরারীর সঙ্গে দূরত্ব কমানোই এখন জরুরি, প্রয়োজনে সারারাত ঘোড়া হাঁকাতে রাজি আছে
ও। ট্রেইল ছেড়ে এলেও, এগোনোর সময় মাটির দিকে নজর রাখতে ভুল করছে না ক্লিফ। বলা যায় না ট্র্যাক মিলেও যেতে পারে।
সারা দিনে দুবার লোকটার ট্রাকের দেখা পেল ফ্যারেল, খানিকটা স্বস্তি পেল ও, ওর অনুমান ভুল হয় নি।
দুপুর গড়িয়ে গেল। ঘোড়া থামিয়ে পনের মিনিটের মতো বিশ্রাম নিল ফ্যারেল। ঘোড়াকে পানি খাওয়াল। গোটা কয়েক শুকনো ফল খেয়ে ক্যান্টিন থেকে ঢকঢক করে পানি খেলো। তারপর আবার পথে নামল, এগোল দ্রুত গতিতে।
আস্তে আস্তে ওপর দিকে উঠছে মাটি, সেজ আর সিডারে ঢাকা এবড়োখেবড়ো রুক্ষ প্রান্তরে পৌঁছুল ফ্যারেল। এখানে পলাতকের সঙ্গে দূরত্ব যদি মাইলখানেক হয়, টের পাবেন না ও। আরও ওপরে উঠে এল ক্লিফ। সিডারের স্থান দখল করল স্ক্রাব পাইন।
বিকেল হলো। উত্তপ্ত প্রকৃতি, বালি উড়ছে চারদিকে। ক্লান্ত ঘোড়া নিয়ে একই গতিতে ছুটছে ফ্যারেল। এতক্ষণে আগন্তুকের সঙ্গে দূরত্ব আরও কমে আসার কথা। সন্ধ্যা নাগাদ তাকে অতিক্রম করে যাবার ক্ষীণ একটা আশা আছে।
তখন অনুমান করতে হবে, খাড়া ব্লাফ থেকে নেমে যাওয়া তিনটে ট্রেইলের কোনটা পাহারা দেয়া লাগবে। তারপরও ভুল করেছে কিনা ভেবে উৎকণ্ঠায়, থাকতে হবে প্রতিটি মুহূর্ত।
সূর্যাস্তের আধ ঘন্টা আগে আবার থামল ক্লিফ ফ্যারেল। ছোট করে আগুন জ্বেলে বেকন ভেজে রুটি সেঁকল; তারপর কফি তৈরি করে রুটি আর বেকন ভাজা দিয়ে তৃপ্তির সঙ্গে খেল। ওদিকে নিশ্চিন্ত মনে ঘাস খেয়ে চলছে ঘোড়াটা। খাওয়া শেষ হলে ঘাসের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল ক্লিফ, চোখ মেলে দিল আকাশের দিকে; নানা রঙের খেলা চলছে ওখানে। সারা দিন এড়িয়ে গেলেও এবার সিদ্ধান্ত নেয়ার চেষ্টা করল ক্লিফ। সরাসরি সমস্যার কথা ভাবতে চায় না ও, কিন্তু না চাইলে কী হবে, মনে পড়ে যায়। সোনিয়ার কথা ভাবলেই অনিবার্যভাবে মনে আসে ওর লাঞ্ছনার কথা, কী করবে ভাবলে চোখে ভাসে বাবার বিধ্বস্ত চেহারা একবার, একটা ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আজ তিলেতিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মানুষটা। সিদ্ধান্ত নিতে ভুল হলে ওর পরিণতিও বাবার মতো হবে।
সারা দিন অনুসরণ করার পর ক্লিফ, মোটামুটি নিঃসন্দেহ, সামনের লোকটা ট্রেইল গোপনের যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। তাতে অবশ্য প্রমাণ হয় না সে-ই কাল সোনিয়াকে রেপ করেছে। হয়তো অন্য কোথাও কোন অপরাধ করেছে, তাই আইনের হাত থেকে পালানোর চেষ্টা করছে সে।
চিন্তিত এবং উদ্বিগ্ন মনে, উঠে বসল ফ্যারেল। আগুন নিভিয়ে দিল। ল্যাসো ছুঁড়ে ঘোড়া ধরে পিঠে জিন চাপাল, গুটিয়ে নিল দড়িটা, তারপর, স্যাডলে উঠে দক্ষিণে রওনা হলো।
এগিয়ে চলেছে ফ্যারেল। আস্তে আস্তে রঙ পাল্টে ধূসর হলো আকাশ, গোধূলি লগ্ন। একটা দুটো তারা দেখা দিল আকাশে। কিছুক্ষণ পর চাঁদ উঠবে, রূপালি ছটা তার আগমনবার্তা ঘোষণা করছে।
গ্রে বাট থেকে ষাট মাইল দূরে এসে পড়েছে ক্লিফ, আরও অন্তত তিরিশ মাইল পথ পাড়ি দিতে হবে।
ঘোড়াকে বিশ্রাম দেয়ার জন্যে কিছুটা মন্থর গতিতে এগোচ্ছে ও। উত্তেজিত স্নায়ু শান্ত করার চেষ্টা করছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে।
মাঝরাতের দিকে ব্লাফের কাছে পৌঁছুল ক্লিফ ফ্যারেল। সামনে, নীচে বিস্তীর্ণ ঊষর প্রান্তর, বিরান; ভেসে যাচ্ছে চাঁদের আলোয়। কয়েক মাইল আগে একটা ঝর্নায় ঘোড়াকে পানি খাইয়ে ক্যান্টিন ভরে নিয়েছে ক্লিফ। ঘোড়াটা একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে ব্লফের কিনারে বসে পড়ল ও, শুরু হলো অপেক্ষা। এখান থেকে মরুপ্রান্তরের অনেকদূর পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায়, অপেক্ষা করার জন্যে উপযুক্ত স্থান। সকালে আবার পথে নামলে ফেরারীর ঘোড়ার খুরের ঘায়ে ধুলো উড়বে স্পষ্ট দেখা যাবে।
চোখ দুটো বারবার বুজে আসতে চাইছে ফ্যারেলের, এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল ও। স্বপ্ন দেখল, ভয়াবহ অদ্ভুত সব স্বপ্ন; চমকে থেকে থেকে উঠে বসল। রাতের হিমেল হাওয়াতেও ঘেমে নেয়ে উঠেছে।
অবশেষে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। যখন ঘুম ভাঙল, রাত পেরিয়ে গেছে, দিগন্তে ভোরের আভাস।
উৎকণ্ঠায় একলাফে উঠে দাঁড়াল ক্লিফ। পুরোপুরি ভোর হতে এখনও অনেক দেরি বুঝতে পেরে, হাঁপ ছাড়ল। ব্লাফের কিনারায় দাঁড়িয়ে মরুভূমির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল।
কিছু দেখা গেল না, দেখা যাবার কথাও নয়, এত তাড়াতাড়ি লোকটার বেরোবার সম্ভাবনা কম।
কয়েকটা বাসী রুটি আর বেকন ছিল, ওগুলো দিয়েই নাশতা সেরে নিল ফ্যারেল। পেট পুরে পানি খেল ক্যান্টিন থেকে। তারপর সিগারেট বানিয়ে একটা পাইন গাছে ঠেস দিয়ে বসে আয়েশ করে টানতে লাগল। মরুভূমির দিক থেকে নজর সরাল না।
কোন স্পন্দন নেই। এদিকে তাপ-তরঙ্গের তাণ্ডব নৃত্য শুরু হয়েছে মরুর বুকে। মরুভূমির একঘেয়ে দৃশ্যে ঈষৎ বৈচিত্র্যের ছোঁয়া দিয়েছে ছড়ানো ছিটানো কিছু ক্যাকটাস, বৈরী প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে অদ্ভুত চেহারা নিয়ে টিকে আছে কোনওমতে।
সময় বয়ে যাচ্ছে। সূর্য উঠে এসেছে আকাশে। কিন্তু কোথাও কোনও নড়াচড়া নেই।
ভুল করে ফেলল না তো, ভাবল ফ্যারেল। উদ্বেগে কুঁচকে উঠল ভুরুজোড়া। কিন্তু ভুল হলেও এখন শোধরানোর উপায় নেই। দুপুর পর্যন্ত এখানে অপেক্ষা করবে ও, এর মধ্যে যদি।লোকটাকে দেখা না যায়, ব্যাকট্র্যাক করে আবার তার ট্রেইল খুঁজে বের করতে হবে। ওকে পাকড়াও না করে ফিরবে না ক্লিফ।
একটা মাছরঙা পাখি কিছুক্ষণ আশপাশে উড়ে বেড়াল, তারপর পালিয়ে গেল। বাচ্চাসহ একটা হরিণ একশো গজের মধ্যে এসে পড়েছিল, হঠাৎ গেল্ডিংটা লাফিয়ে উঠলে ভয়ে পালাল।
গরম বাড়ছে। সূর্যরশ্মি পাথর আর নীচের মরুভূমিতে প্রতিফলিত হয়ে চোখ ঝলসে দিচ্ছে।
আচমকা অকাক্ষিত বস্তুর দেখা পেল ক্লিফ। ডানে, দুএক মাইল দূরে, মরুভূমিতে ধুলোর মেঘ। একটা শুকনো ওঅশ থেকে সমতল মরুপ্রান্তরে উঠে এল এক ঘোড়সওয়ার।
ঝটপট তৈরি হয়ে নিল ক্লিফ ফ্যারেল। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল সামনের অশ্বারোহীর ট্রেইলের উদ্দেশে দ্রুত ছুটছে ও।
উত্তেজিত হয়ে পড়েছে ক্লিফ। ওর অনুমান মোটেই ভুল হয় নি।
ঝড়ের বেগে ঝাড়া দশ মিনিট ঘোড়া হাঁকাল ক্লিফ, ট্রেইলের মাথায় এসে পড়ল। ঘোড়া ঘুরিয়ে নামতে শুরু করল ঢাল বেয়ে।
প্রায় মাইল তিনেক এগিয়ে রয়েছে লোকটা। ওপর থেকে দূরের, মরুভূমির দিকে তাকাল ফ্যারেল, কোন দিকে যাওয়া যায়?
ডানে একটা দীর্ঘ অথচ নিচু রিজ দেখা যাচ্ছে। সামনের অশ্বারোহীকে অতিক্রম করে যেতে চায় ও, রিজের বামে রয়েছে সে।
উচ্চতায় বিশ থেকে পঁচিশ ফুটের মতো হবে রিজটা, ওপাশ দিয়ে এগোলে এদিক থেকে ওদের দেখতে পাবে না, লোকটা।
ট্রেইলের শেষ মাথায় পৌঁছে ডানে ঘোড়া ঘোরাল ফ্যারেল। রিজের মাথা পেরিয়ে ছুটল। একনাগাড়ে কিছুক্ষণ সামনে এগোল ও, মাঝে মাঝে বায়ে তাকিয়ে নিশ্চিত হলো, আগন্তুক ওর উপস্থিতি টের পায় নি।
মোটামুটি প্রয়োজনীয় দূরত্ব অতিক্রম করা গেছে নিশ্চিত হয়ে বাঁ দিকে বাঁক নিল ও। আরও আধ মাইলের মতো এগিয়ে রিজের চূড়ায় উঠল, তাকাল পেছনে।
মুহূর্তের জন্যে থমকে গেল ফ্যারেল। অশ্বারোহীকে যেখানে দেখরে ভেবেছিল, নেই। আরও পেছনে, ব্লাফের দিকে তাকাতেই ধড়ে প্রাণ এল, আসছে অশ্বারোহী, মাইল দেড়েক দূরে রয়েছে।
ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ক্লিফের ঘোড়া, হাঁপাচ্ছে। আর আত্মগোপন করার দরকার নেই, ঘোড়া নিয়ে মন্থর গতিতে সোজা আগন্তুকের দিকে এগোল ক্লিফ।
থমকে দাঁড়াল অশ্বারোহী। মুহূর্তের জন্যে নিশ্চল পাথরের মূর্তিতে পরিণত হলো। ঘোড়াকে বিশ্রামের সুযোগ দিয়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে ক্লিফ। আবার পিছু ধাওয়া করার প্রয়োজন হলে ছোটার জন্যে প্রচুর শক্তি লাগবে ঘোড়াটার।
আচমকা পুব দিকে ঘোড়া, ঘোরাল আগন্তুক। অনুসরণ করল ক্লিফ। গতি বাড়াল সে। ক্লিফও গতি বাড়াল।
হঠাৎ রাশ টেনে ঘোড়া থামাল লোকটা। ধোঁয়ার একটা কুণ্ডলী দেখল ক্লিফ মুহূর্তের জন্যে। শখানেক গজ দূরে ছিটকে উঠল বালি। তার পরপরই রাইফেলের গর্জন শুনতে পেল।
সতর্ক সঙ্কেত। পরিষ্কার জানিয়ে দিল লোকটা: যেই হও, দূরে থাকো।
কিন্তু থামল না ফ্যারেল। নতুন ধোঁয়ার কুণ্ডলীও চোখে পড়ল না। আবার দিক বদল করল আগন্তুক। সোজা পুবে যাচ্ছে, একতালে ছুটছে তার ঘোড়া।
ওর সমান্তরাল পথে ঘোড়া হাঁকাল ক্লিফ। গতিপথ বদল করার ফলে পিছিয়ে পড়েছে। মাইল খানেক সামনে রয়েছে ফেরারী। সমান তালে ঘোড়া ছুটিয়ে দূরত্ব কমিয়ে আনতে শুরু করল ক্লিফ।
ছোটার গতি একটু না কমিয়ে কোনাকুনি বামে এগোতে শুরু করল ও। হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটে। দুপুরের আগেই অবসান ঘটবে এ নাটকের। আগন্তুকের ঘোড়া পরিশ্রান্ত, এভাবে বেশিক্ষণ ছুটতে পারবে না ওটা।
ধীরে ধীরে মাঝের দূরত্ব আধমাইলে নামিয়ে আনল ফ্যারেলপোয়া মাইল…হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠল ও, থামো!
লোকটা শুনেছে কিনা বোঝা গেল না, কিন্তু ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেছে নিশ্চয়ই। ক্লান্ত ঘোড়ার পেটে স্পর দাবাল সে। ফ্যারেলও স্পারের খোঁচা দিল গেল্ডিংয়ের পেটে, লাফিয়ে সামনে ছুটল ওটা।
গুলি করার চেষ্টা করছে না আগন্তুক; সামনে ঝুঁকে ঘোড়ার পিঠের সঙ্গে মিশে গিয়ে ছুটছে। কিন্তু ক্রমশ দূরত্ব কমিয়ে আনছে ক্লিফ।
আবার চিৎকার করে উঠল ও, দাঁড়াও! তোমাকে গ্রেপ্তার করা হলো!
ক্লিফ আগন্তুকের আনুমানিক পঞ্চাশগজের মধ্যে পৌঁছুতে লাফিয়ে স্যাভল থেকে নামল সে, ডিগবাজি খেয়ে উঠে দাঁড়াল, চট করে উঠে এল তার রাইফেল, খেঁকিয়ে উঠল।
আগেই পিস্তল বের করে নিয়েছে ফ্যারেল, আগন্তুকের বড় জোর বার চোদ্দগজ দূরে রয়েছে ও। দূরত্ব কমছে, দ্রুত। ইচ্ছে করলে এখুনি লোকটাকে হত্যা করতে পারে, আত্মরক্ষার খাতিরে সে অধিকার ওর আছে।
কিন্তু হৃৎপিণ্ড বরাবর গুলি ঢুকিয়ে মুহূর্তে মেরে ফেলে ওকে বাঁচিয়ে দিতে চায় না ক্লিফ।
সোনিয়ার মতো প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে একে। অবশ্য এটাই লোকটাকে বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র কারণ নয়। হঠাৎ বাবার শেষ প্রত্যাবর্তনের কথা মনে পড়ে গেছে ওর একই ভুলের পুনরাবৃত্তি চায় না ক্লিফ।
একলাফে স্যাডল থেকে নেমে গড়িয়ে সরে গেল ও। আবার গর্জে উঠল, আগন্তুকের রাইফেল। পায়ের কাফে বুলেটের ধাক্কা অনুভব করল ও।
ক্রোধে অন্ধ হয়ে গেল ফ্যারেল, ঝাঁপিয়ে পড়ল. লোকটার ওপর। রাইফেলের উত্তপ্ত ব্যারেল জাপটে ধরল দুই হাতে, হ্যাচকা টানে কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল পঞ্চাশ ফুট দূরে। হোলস্টারের পিস্তলের দিকে হাত বাড়াল লোকটা, পরক্ষাণে ক্লিফের হাটু আঘাত হানল তার মুখে, পিস্তল ধরা হাতের কজি ধরে মুচড়ে দিল ক্লিফ। খসে পড়ল অস্ত্রটা, লুফে নিল ক্লিফ, ঘুরিয়ে সজোরে নামিয়ে আনল আগন্তুকের মাথায়, একপাশে লাগাল আঘাতটা। ভাঙাচোড়া ভঙ্গিতে, উত্তপ্ত বালিতে লুটিয়ে পড়ল লোকটা।
হাঁপাচ্ছে ক্লিফ, ঘন ঘন ওঠানামা করছে বুক, লোকটার দিকে তাকাল ও। তারপর এলোমেলো পায়ে ঘোড়র কাছে এসে স্যাডল থেকে ক্যান্টিন খুলে ঢকঢক করে পানি খেল, ক্যান্টিনটা রেখে ঘোড়া নিয়ে ধরাশায়ী শত্রুর কাছে ফিরে এল। একে বাঁচিয়ে রাখা কি ঠিক হলো? কিন্তু এ. ছাড়া আর কী করার আছে?
০৫. অপেক্ষা করছে ক্লিফ ফ্যারেল
অপেক্ষা করছে ক্লিফ ফ্যারেল। পিস্তলের আঘাতে আগন্তুকের কপালের এক পাশে কেটে গেছে, রক্ত বেরোচ্ছে ক্ষতস্থান থেকে ভোলা মুখ থেকে ক্ষীণ ধারায় রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। আধ বোজা দুচোখে ঘোলাটে দৃষ্টি, ঘোরের মধ্যে। আছে যেন লোকটা।
ক্লিফ যা আন্দাজ করেছিল, লোকটার বয়স তার চেয়ে কম, চব্বিশ পঁচিশের বেশি নয়।
রুক্ষ অথচ সুদর্শন চেহারা, খোঁচা খোঁচা দাড়ির আড়ালে প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে মুখটা; মুখাবয়বে হতাশার ছাপ।
অনেকদিন পালিয়ে বেড়াচ্ছে লোকটা, ভাবল ফ্যারেল। অনবরত অপরাধ করছে আর ছুটছে এখান থেকে সেখানে।
আগন্তুকের পাঁজরে, বুটের ডগ দিয়ে পুঁতো দিল ফ্যারেল। ওঠো, শুয়োরের বাচ্চা!
ককিয়ে উঠল লোকটা। কুঁকড়ে দুভাজ হয়ে গেল, যেন আত্মরক্ষা করতে চাইছে। সাবধানে, আবার খোঁচা লাগাল ক্লিফ, ডান হাতে তৈরি রেখেছে পিস্তল।
আস্তে আস্তে উঠে বসল আসামী, যন্ত্রণায় বিকৃত চেহারা। এক মুহূর্ত পর নিষ্পলক চোখে ফ্যারেলের দিকে তাকাল সে, দৃষ্টিতে বিষ ঝরছে। দাঁত মুখ খিচে, খেঁকিয়ে উঠল লোকটা। এর মানে?
ধর্ষণের অভিযোগে তোমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এখনও মারা যাও নি সেটা তোমার সাত পুরুষের ভাগ্য।
মুহূর্তে লোকটার চোখে আতঙ্ক ঠাই নিল। ক্লিফ বলল, ওঠো, ঘোড়ায় চাপো।
উঠে দাঁড়াল আগন্তুক। টলতে টলতে পা বাড়াল ঘোড়ার দিকে, কোনওমতে স্যাডলে উঠে বসল। পায়ের ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে, বুঝতে পারছে ক্লিফ, হাঁটুর নীচ থেকে গোড়ালি পর্যন্ত প্যান্ট রক্তে ভিজে সপসপ করছে। কিন্তু আপাতত কিছু করার নেই।
হঠাৎ ঘোড়ার খুরের শব্দে ঝট করে ঘাড় ফেরাল ফ্যারেল। ঊর্ধ্বশ্বাসে। ঘোড়া হাঁকিয়ে পালানোর চেষ্টা করছে, আসামী।
দাঁতে দাঁত চেপে খিস্তি করল ক্লিফ। চোখের পলকে স্যাডলে চেপে সঁই করে ঘোড়া ঘুরিয়ে আগন্তুকের পিছু নিল। পিস্তলটা কোমরে গুঁজে ল্যাসো,তুলে নিল হাতে।
ধর্ষণের অভিযোগ শুনলে যে কোনও লোকের বুদ্ধি-শুদ্ধি লোপ পাওয়া স্বাভাবিক, ভাবল ফ্যারেল। এরকম অভিযোগে অভিযুক্ত বেশিরভাগ লোকই আদালতে দাঁড়ানোর সুযোগ পায় না। তাই বলে একে পালাতে দেবে না ক্লিফ।
অল্পক্ষণেই আগন্তুকের কাছাকাছি এসে পড়ল ও, ল্যাসো ছুঁড়ে দিল। নির্ভুল নিশানা, লোকটার মাথার ওপর দিয়ে নেমে এসে বুকের ওপর চেপে বসল ফাসটা, হাত দুটোও আটকা পড়ল। রাশ টানল ফ্যারেল, দাঁড়িয়ে পড়ল গেল্ডিংটা। অদৃশ্য টানে শূন্যে উঠে গেল আসামী, পরমুহূর্তে ধপাস করে আছড়ে পড়ল তপ্ত ধুলোয়।
দৈহিক ক্লান্তি, ক্ষতস্থানের যন্ত্রণা আর সুযোগ পেয়েও লোকটাকে হত্যা করে নি বলে নিজের ওপর ক্ষোভ-সব মিলে হঠাৎ যেন দিশেহারা করে দিল ফ্যারেলকে ঝট করে ঘোড়া ঘুরিয়ে নিল, ও, গায়ের জোরে স্পার দাবাল ওটার পেটে।
ছুটতে শুরু করল ঘোড়াটা, পেছনে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলল বন্দীকে। প্রায় একশো গজ এগোনোর পর থামল ফ্যারেল, মাটিতে শায়িত আগন্তুকের কাছে এসে শীতল চোখে তাকাল। যাও, ঘোড়ায় চাপো। ফের এরকম করলে খারাপ হয়ে যাবে।
কোনওমতে উঠে দাঁড়াল আগন্তুক, পরমুহূর্তে দড়াম করে আছাড় খেলো। আবার উঠল সে, আপ্রাণ চেষ্টায় ল্যাসোর ফাস থেকে মুক্ত করল নিজেকে। দড়িটা গুটিয়ে ফেলল ক্লিফ। আগন্তুকের গায়ের সঙ্গে সেঁটে থেকে ঘোড়ার কাছে এসে লোকটা স্যাডলে ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করল। লালচে চোখে ঘৃণা ভরা দৃষ্টি নিয়ে ক্লিফের দিকে তাকাল আগন্তুক। গ্রে বাট-এ ফিরে যাচ্ছ তুমি, বলল ক্লিফ। এগোও।
নড়ল না আগন্তুক, চাপা কণ্ঠে বলল, এর জন্যে তোমাকে পস্তাতে হবে। ওখানে পৌঁছুনোর আগেই তোমাকে খুন করব আমি!
এসব কথা শুনতে শুনতে কান পচে গেল! কী নাম?
রেগান। ল্যুক রেগান।
আচ্ছা। এবার এগোও। রাস্তা তো চেনাই আছে।
আমার রাইফেল?
বিচারে যদি খালাস পাও, ফিরে এসে নিতে পারবে।
কীসের বিচার! বিচারের পরোয়া আমি করি না। আর এমন একটা অভিযোগ মাথায় নিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়াব? অসম্ভব!
কঠিন দৃষ্টিতে ল্যুক রেগানের দিকে তাকাল ক্লিফ ফ্যারেল। তা তো ঠিকই। কাল রাতে কাকে রেপ করে এসেছ, জানো?
আমি কোনও মেয়ের গায়ে হাত দিই নি।
ধমকে উঠল ক্লিফ ফ্যারেল। মিথ্যক! এই মুহূর্তে স্যাডলের ওপর তোমার লাশ পড়ে থাকার কথা! আগামী হপ্তায় ওই মেয়েটার সাথে আমার বিয়ের কথা ঠিক হয়ে আছে!
রক্ত, ধুলো আর দাড়িতে ঢাকা থাকলেও রেগানের চেহারা রক্তশূন্য হয়ে গেছে বুঝতে বেগ পেতে হলো না। বিস্ফারিত হয়ে গেল তার চোখ ভয়ের ছাপ পড়ল। ডাহা মিথ্যে কথা! বলল সে। কাল কোনও মেয়েকে ছুঁয়েও দেখি নি আমি! খোদার কসম, সত্যি বলছি, কোন মেয়ের গায়ে হাত দিই নি!
জবাব দেয়ার প্রবৃত্তি হলো না ফ্যারেলের। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল রেগানের দিকে। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল রেগান, তারপর কম্পিত ভয়মেশানো কণ্ঠে বলল, আসলে তুমি আমার বিচার চাও না! আমি জানি, সুযোগ পেলেই আমাকে খুন করবে তুমি
সুতরাং সুযোগটা যাতে না পাই সেদিকে খেয়াল রেখো। আবার পালানোর চেষ্টা কোরো না। অনেক কষ্টে সামলে রেখেছি নিজেকে, অনন্তকাল এভাবে চলবে না। তোমাকে খুন করার জন্যে আমার হাত নিশপিশ করছে, খোদার ওয়াস্তে কথাটা মনে রাখার চেষ্টা করো।
ক্লিফের অগ্নিদৃষ্টির সামনে নুয়ে এল রেগানের মাথা। ঘোড়া ঘুরিয়ে ফিরতি পথ ধরল সে।
পেছনে রইল, ক্লিফ। রেগানকে ধরে বিন্দুমাত্র গর্ব অনুভব করছে না ও, নিজের ওপর বিরক্তি বোধ করছে। রেগানকে জীবিত ফিরিয়ে নিয়ে সোনির কতখানি ক্ষতি করতে যাচ্ছে, ওর চেয়ে বেশি কেউ জানে না।
জোর করে রেগানকে আদালতে দাড় করাতে চায় ও। এর ফলে সবার সামনে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে সোনিকে, বিচার যত সংক্ষিপ্ত হোক, ঘটনাটার কথা সহজে ভুলবে না কেউ।
পিস্তলের আঘাত ছাড়াও রেগানের মুখে আরও কিছু ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। আত্মরক্ষার তাগিদে হয়তো ওকে আহত করার চেষ্টা করছে সোনি, ঝোঁপ ঝাড়ে খোঁচা লেগেও কেটে গিয়ে থাকতে পারে। রেগানের চওড়া কাঁধের দিকে ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে তাকাল ফারেল।
গ্রে বাট-এর জেলখানায় আটক হেলম্যানের কথা মনে পড়ল। দুজনের মধ্যে রেগানই অপেক্ষাকৃত নীচ প্রকৃতির। ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন হলে রেগানকেই দোষী হিশেবে বেছে নেবে ও নির্দ্বিধায়। কিন্তু ও জানে, এভাবে কাউকে বিচার করা অযৌক্তিক, নিরীহ গোবেচারা চেহারার লোককেও অনেক সময় ভয়ঙ্কর অপরাধী হতে দেখা যায়।
হঠাৎ এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলল ফ্যারেল। কে অপরাধী স্থির করার দায়িত্ব ওর নয়, আদালতের; আদালতই নির্ধারণ করবে দোষী কে, রেগান না হেলম্যান?
আস্তে আস্তে মরু-প্রান্তর পেরিয়ে এল ওরা। খাড়া ট্রেইল বেয়ে উঠে এল ব্লফের চূড়ায়। আরও এগিয়ে পাইন আর সিডারের নিবিড় অরণ্যে ঢুকল। পর্বতমালা পার হয়ে ঢাল বেয়ে নামল সমতল তৃণভূমিতে।
একটা ঝর্না দেখে সেদিকে এগিয়ে গেল ওরা। ঘোড়াদুটোকে পানি খাওয়াল, দুজনের ক্যান্টিন ভরে নিল। তারপর রেগানকে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামিয়ে দুহাত বেঁধে দড়ির শেষ মাথা ওর গেন্ডিংয়ের স্যাডলহর্নের সঙ্গে পেঁচিয়ে দিল। এবার ঝর্নার ধারে বসে পড়ল ও, আহত পায়ের প্যান্টের পায়া গুটিয়ে নিল।
গত কয়েক ঘণ্টায় অসাড় হয়ে গেছে পা-টা। এতক্ষণ যতদূর সম্ভব আলতোভাবে স্যাডলে পা রেখেছিল ও। ভারসাম্য রক্ষার জন্যে আহত পা ব্যবহার করতে গেলেই নরক যন্ত্রণায় ভুগতে হয়েছে।
দাঁতে দাঁত চেপে ঝর্নার পানিতে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে নিল ফ্যারেল। যন্ত্রণায় ফ্যাকাসে হয়ে গেল চেহারা। শার্টের কোনা ছিড়ে টাইট করে ব্যান্ডেজ বাঁধল-প্রায় পোয়া ইঞ্চি গভীর, আধ ইঞ্চি চওড়া আর প্রায় ছ থেকে আট ইঞ্চি দীর্ঘ ক্ষতস্থানে। ঘৈমে নেয়ে উঠল ও। ক্ষতটা অবশ্য মারাত্মক নয়, ওর পঙ্গু হয়ে পড়ার ভয় নেই।
ব্যান্ডেজ বাঁধা শেষ করে উঠে দাঁড়াল ক্লিফ। খুঁড়িয়ে রেগানের কাছে গেল, ঘোড়ায় চাপতে সাহায্য করল ওকে। নিজেও স্যাডলে উঠে বসল। এগোতে শুরু করল রেগান, ওকে অনুসরণ করল ক্লিফ, চিল দিয়ে ধরে রাখল দড়িটা।
বেশ কয়েক ঘণ্টা কেটে গেল। বহু মাইল পথ পেছনে ফেলে এন্তু ওরা সূর্য ডুবল। খোলা প্রান্তরের ওপর দিয়ে ছুটে আসছে ঠাণ্ডা হাওয়া। যাত্রা বিরতি করল ক্লিফ ফ্যারেল। আগুন জ্বেলে অবশিষ্ট বেকটুকু ভেজে নি; গোটাকতক রুটি বানাল। রেগানের হাতের বাঁধন খুলে খেতে দিল তাকে।
খাওয়া শেষ হলে রেপানকে সিগারেট খাওয়ার জন্যে খানিকটা সময় দিল ও। তারপর আবার বেঁধে ফেলল ওকে, ওর তীব্র আপত্তি উপেক্ষা করে পা দুটোও বাঁধল। ঘাসের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল ক্লিফ, আকাশের মিটিমিটি তারার দিকে তাকাল।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল ও। ঘুমোলেও সবগুলো ইন্দ্রিয় সজাগ, সামান্য শব্দে ঘুম টুটে যাচ্ছে, তাকাচ্ছে রেগানের দিকে। কিন্তু গভীর ঘুমে অচেতন বন্দী, একটুও নড়াচড়া নেই।
সকালে ঘুম থেকে উঠল ফ্যারেল। আগুন জ্বেলে কফি তৈরি করল। অবশিষ্ট শুকনো ফলের অর্ধেক রেগানকে দিয়ে বাকি অর্ধেক নিজে খেলো। তিন কাপ কফি খেলো ও, রেগান দুকাপ।
আগের মতো হাত বাঁধা অবস্থায় ঘোড়ায়, চাপল রেগান, দড়ির প্রান্ত ক্লিফের হাতে রইল। রওনা হলো ওরা। গ্রে বাটে পৌঁছুতে অনেক বাকি। কেমন আছে সোনি?-ভাবল ফ্যারেল।
গত দুদিনে মুখের ক্ষত হয়তো শুকিয়ে এসেছে, ব্যথাও কমেছে হয়তো, কিন্তু ওর মনের অবস্থা?
ক্রোধের সঙ্গে রেগানের দিকে তাকাল ফ্যারেল।
আজই গ্রে বাট-এ পৌঁছুবে ওরা। ঘোড়া দুটো সুস্থ থাকলে দুপুর নাগাদ গ্রে বাট-এর দেখা পাওয়া যাবে।
শহরে ফেরার কথা মনে হতেই ম্লান হয়ে গেল ফ্যারেলের চেহারা। বীরের সম্বর্ধনা ওর জন্যে অপেক্ষা করছে না। স্টোন ছাড়া গ্রে বাট-এর অন্য কেউ ওর, কাজের যৌক্তিকা স্বীকার করবে না।
পায়ের ক্ষত সাক্ষ্য দিচ্ছে রেগানকে হত্যা করার সুযোগ এবং অধিকার ছিল ওর। হত্যা করাটাই ন্যায়সঙ্গত ছিল। কিন্তু তা না করায় সোনিও ওর ভালোবাসা সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়বে, কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর পরিস্থিতি সৃষ্টি করায় হয়তো ঘৃণা করবে।
দুপুর দুটোর দিকে গ্রে বাট-এর চূড়া নজরে এল ক্লিফের। সেতু পেরিয়ে বাট স্ট্রীটের মাথায় পৌঁছুতে শোয়া চারটে বেজে গেল।
ঘাড় ফিরিয়ে ক্লিফের দিকে তাকাল ল্যুক রেগান। দুচোখে কেমন যেন দিশেহারা ভাব। এতক্ষণ যে উদ্ধত ভাব ছিল, আত্মবিশ্বাস ছিল, হঠাৎ করে সব উধাও হয়ে গেছে, তীব্র আতঙ্ক ভর করেছে তার মনে।
লিঞ্চ মবের হাতে ছেড়ে দিতে নিশ্চয়ই এত দূর আনো নি আমায়? জিজ্ঞেস করল সে।
রাস্তার দিকে চোখ ফেরাল ফ্যারেল। বাট স্ট্রীটের প্রতিটি লোক দাঁড়িয়ে পড়েছে, পাথর হয়ে গেছে যেন জাদুমন্ত্র বলে, নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে এদিকে।
হঠাৎ একদল লোক দৌড়ে গেল জেলহাউসের দিকে, ভিড় করে দাঁড়াল।
একসঙ্গে দ্রুত এগিয়ে যাব আমরা, রেগানকে বলল ফ্যারেল, জেলের সামনে পৌঁছেই স্যাডল থেকে নেমে দরজার দিকে খিচে দৌড় লাগারে। কোনও বদমতলব থাকলে ভুলে যাও, নইলে, কসম খোদার, জনতার হাতে ছেড়ে দেব তোমাকে। বোঝা গেছে?
কীসের মতলব! বিশ্বাস করো, জেলে ঢুকতে আর কখনও এত উতলা হই নি আমি!
তা হলে ছোট।
নিষ্ঠুরভাবে ক্লান্ত ঘোড়ার পেটে স্পার দাবাল ক্লিফ আর ল্যুক রেগান। ধূলি-ধূসর রাজপথে ঝড় তুলে ছুটল ঘোড়া দুটো, ধুলোর মেঘ উড়ল পেছনে।
ফুটপাথে দাঁড়ানো জনতা, তাকিয়ে আছে ওদের দিকে, কঠিন চেহারা। জেলের সামনে লোকের ভিড় বাড়ছে, আরও অনেকে ছুটে যাচ্ছে ওদিকে।
বাবার মতো আস্তে ধীরে এগোলেই হয়তো ভালো হত, ভাবল ফ্যারেল, কঠিন চোখে জনতার দিকে তাকিয়ে হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখা যেত ওদের।
কিন্তু ওকে দিয়ে তা সম্ভব নয়। ওর বয়স কম, বাবার আত্মবিশ্বাস আর অভিজ্ঞতা দুটোরই অভাব রয়েছে।
এগোতে শুরু করল জনতা। মিছিলের ওপাশে পড়েছে জেলভবন।
চেঁচিয়ে উঠল ফ্যারেল, পিছিয়ে এসো।
ঘাড় ফিরিয়ে ওর দিকে তাকাল ল্যুক। ছাইয়ের মতো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে চেহারা, ঠোঁটজোড়া ফাঁকা হয়ে আছে, লালা ঝরছে।
রেগানকে জ্যান্ত ফিরিয়ে এনে এই প্রথম কিঞ্চিৎ তৃপ্তি বোধ করল ফ্যারেল। সোনির মতো আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়েছে লোকটা। মরুভূমিতে হত্যা করলে আসলে দয়া দেখানো হত একে। নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করছে সে; আদালতে দাঁড়ানোর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি ঘণ্টা, এই রকম অসহনীয় যন্ত্রণা কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে ওকে। দোষী সাব্যস্ত হবার পরও রেহাই পাবে না, মৃত্যুই তার রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায়।
পিছিয়ে ফ্যারেলের কাছে চলে এল রেগান। চেঁচিয়ে কী যেন বলল, বুঝতে পারল না ক্লিফ।
রেগানের হাতে বাঁধা দড়ির প্রান্ত শক্ত করে ধরে রেখেছে ও। ক্লান্ত হলেও দ্রুত ছুটছে ঘোড়া দুটো। ঢাল বেয়ে উঠছে যদিও, গতি কমছে না।
জঙ্গী জনতা আরও কাছে এসে গেছে। সবার চেহারা আলাদা করে শনাক্ত করতে পারছে ফ্যারেল, পরিষ্কার বুঝতে পারছে ওদের মনোভাব।
ও যাবার পর থেকেই লিঞ্চিংয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে শহরবাসীরা। স্টোনের জন্যে হেলম্যানকে স্পর্শ করতে পারে নি, তাই রেগানকে ছিনিয়ে নেয়ার জন্যে খেপে উঠেছে। ওদের আক্রোশের বেদীতে বলি চড়াবে ওকে।
আর একশো গজ…সত্তর…পঞ্চাশ…জেলহাউসে আর ক্লিফের মাঝে দুর্ভেদ্য এক দেয়াল তৈরি করেছে ক্ষিপ্ত জনতা।
বাঁয়ে, খানিকটা পেছনে রেগানের ঘোড়ার উপস্থিতি অনুভব করছে ক্লিফ। চিষ্কার করে ঘোড়র পেটে স্পর দাবাল ও।
আর বিশ গজ!
দশ গজ!
জনতার দিকে তেড়ে গেল ফ্যারেল। ওকে ঠেকানো যাবে না বুঝতে পেরে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল ওরা। গেল্ডিংয়ের পেটে আবার ম্পারের খোঁচা লাগাল ক্লিফ।
ঘোড়ার কাঁধের সঙ্গে শক্ত কিছু ধাক্কা লাগল, ব্যথায় আর্তর করে উঠল কে যেন। দুতিনজনকে সঙ্গে নিয়ে দড়াম করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল একজন।
লাফিয়ে ঘোড়ার লাগাম ধরার চেষ্টা করল কয়েকজন লোক। দড়ির প্রান্ত দিয়ে সজোরে আঘাত হানল ক্লিফ। পিস্তলছুঁড়ল কেউ একজন। বিশ্রী শব্দ তুলে মাথার ওপর দিয়ে ছুটে গেল বুলেট। তে।
পরক্ষণে জনতাকে পেছনে ফেলে এল, ওরা! ঘুরে দাঁড়াল মিছিলের সরাই।
রাস্তার দিকে ঘুরল ফ্যারেল। রেগানের হাতে বাঁধা দড়ির প্রান্ত হাতছাড়া করে নি। একসঙ্গে সামনে বাড়ল দুটো ঘোড়া।
রেগানের ঘোড়ার সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁচাতে এক পাশে সরে গেল ফ্যারেল। ল্যুকের চোখমুখ হঠাৎ এক অজানা প্রত্যাশায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ঘোড়ার
পেটে সজোরে রের আঘাত করল সে।
লাফিয়ে তেড়ে গেল ওর ঘোড়াটা। স্যাৎ করে ঘোড়া ঘোরাল ক্লিফ, শরীরের সঙ্গে পেঁচিয়ে ফেলল হাতের রশি। মনে মনে প্রস্তুত হলো একটা হ্যাচকা টানের জন্যে, বেহালার তারের মতো টান টান হয়ে গেল দড়ি, স্যাডল থেকে পিছলে পড়ল ক্লিফ, হিচড়ে কয়েক ফুট টেনে নিয়ে গেল ওকে রেগান, তারপর ঢিল পড়ল রশিতে।
আচমকা শূন্যে উঠে গেল ল্যুক রেগান। হাত পা ছড়িয়ে বাতাসে ভেসে রইল এক মুহূর্ত, কান্নার মতো শব্দ বেরুল গলা চিরৈ, সশব্দে মাটিতে পড়ল তার ভারি শরীর।
ঘাড় ফিরিয়ে জনতার দিকে তাকাল ফ্যারেল। এগিয়ে আসছে আবার। চারদিকে ধুলো উড়ছে। হঠাৎ ক্লিফের মুখে হাসি দেখা দিল।
জেলখানার দরজা খুলে গেছে। দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে শেরিফ স্টোন, হাতে একটা ডাবল ব্যারেল্ড শটগান।
অচেতন রেগানকে কোলে তুলে নিল ফ্যারেল, ঢুকে পড়ল জেলহাউসে। ওকে কাভার দিল স্টোন। ক্লিফ ঢুকলে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে হুড়কোটা যথাস্থানে বসিয়ে দিল। হঠাৎ রাজ্যের ক্লান্তি ভর করল ক্লিফের দেহে, ধপাস করে শেরিফের চেয়ারে বসে পড়ল, শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল দরজার দিকে।
০৬. একই ভঙ্গিতে বসে রইল ফ্যারেল
অনেকক্ষণ একই ভঙ্গিতে বসে রইল ফ্যারেল। বাইরে চিৎকার করছে জনতা, পাথর ছুঁড়ছে দরজার ওপর, ভোতা শব্দ হচ্ছে। লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ায় ক্রমেই খেপে উঠছে।
টেনে হিচড়ে রেগানকে একটা সেলে ঢোকাল শেরিফ। দরজায় তালা লাগ্লানোর আওয়াজ শুনল ফ্যারেল। একটু পরে অফিস রুমে ফিরল স্টোন। ডাক্তারকে খবর দেয়া দরকার, বলল সে, যেভাবে আছাড় খেয়েছে হাড়গোড় ভেঙেছে কিনা কে জানে!
ফ্যারেলের রক্তাক্ত পায়ের দিকে তাকাল শেরিফ। কী হয়েছে শোনাও তো!
একরকম অনায়াসেই ওর ট্রেইল খুঁজে পেয়েছি, বলল ক্লিফ। কিন্তু আমার চেয়ে অনেক দূর এগিয়ে ছিল সে। তাই শর্টকাট রাস্তায় ব্যাটাকে অতিক্রম করে গেলাম। এখান থেকে প্রায় আশি মাইল দূরে, দক্ষিণে ব্লফটার কাছে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম, যতক্ষণ ছিলাম, মরুভূমির ওপর থেকে একরারও চোখ ফেরাই নি। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর ব্যাটার দেখা পাওয়া গেল, সঙ্গে সঙ্গে ধাওয়া করলাম।
নিষ্পলক চোখে ক্লিফের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল জেস স্টোন। এমনভাবে বলছ যেন মামুলী ব্যাপার! পায়ের কী হয়েছে?
গুলি করেছে হারামজাদা। স্টোনের মুখের ভাব বদলে যাচ্ছে দেখে আত্মপক্ষ সমর্থনের ভঙ্গিতে ক্লিফ আবার বলল, হ্যাঁ, ইচ্ছে করলে ওকে মেরে ফেলতে পারতাম, সবাই খুশি হত, কিন্তু করি নি। প্রথম কথা ও-ই অপরাধী কি না জানি না; তাছাড়া যদি দোষী হয়েও থাকে, মেরে ফেললে তাকে দয়া দেখানো হত, সেজন্যেই ফিরিয়ে এনেছি।
মাথা দোলাল, জেস স্টোন, সম্মতিসূচক না নেতিবাচক, বোঝা গেল না। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ফ্যারেল জানতে চাইল, সোনির কোনও খবর? কেমন আছে ও?
জানি না। তুমি যাবার পর কারও সঙ্গে দেখা করে নি ও। এক মুহূর্তের জন্যেও বাড়ির বাইরে আসে নি। সেজন্যে ওকে দোষও দেয়া যায় না।
ডাক্তারের সঙ্গে দেখা হয় নি?
হ্যাঁ। ডাক্তার বলেছে, যেমন থাকার কথা তেমনই আছে সোনি। এর মানে আমি বুঝি নি।
আড়ষ্ট ভঙ্গিতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ফ্যারেল। উত্তেজনাকর কয়েকটা দিন কাটানোর পর অবসাদে ভেঙ্গে পড়তে চাইছে শরীর। একটানা সপ্তাহ খানেক ঘুমোতে পারলে হত। দরজার সামনে এসে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ও, মাথা হেলিয়ে বলল, চেঁচামেচি, হৈচৈ ছাড়া আর কিছু করবে না তো ওরা?
কাঁধ ঝাঁকাল স্টোন। কী জানি, জনতার কথা কিছু বলা যায়?
আসামী দুজন হওয়ায় ভালোই হয়েছে, কী বলে?
মনে হয় না। একটু আগে যাকে নিয়ে ফিরলে, দেখে হাড় বজ্জাত বলে মনে হচ্ছে, ওর কাছে হেলম্যান ফেরেশতা।
জনতার বক্তব্য শোনার চেষ্টা করল ক্লিফ ফ্যারেল।
খামোকা ওদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, বলল স্টোন। সোনি চমৎকারর মেয়ে, সবাই ওকে ভালোবাসে, সেজন্যেই তোমার ওপর খেপে গেছে। ব্যাটাকে মেরে স্যাডলে লাশ ফেলে নিয়ে এলেই ভালো করতে, তোমার বাবা হলেও তাই করত; কিন্তু তুমি যেটা করেছ, সোনি নিজেই মেনে নেবে কিনা সন্দেহ।
অগ্নিদৃষ্টিতে স্টোনের দিকে তাকাল ফ্যারেল। তুমি? তুমিও চেয়েছিলে লাশ নিয়ে ফিরে আসি? কিন্তু আমি যাবার সময় তোমার সুর অন্যরকম ছিল।
কয়েক মুহূর্ত পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল ওরা। দ্বিধা ফুটে উঠল স্টোনের চোখে। দৃষ্টি সরিয়ে অন্য দিকে তাকাল সে। জানি না, সত্যি জানি না, বলল, কিন্তু আমার মন বলছে, সেটা করলেই বোধ হয় সবদিক রক্ষা পেত।
কিন্তু লোকটা নির্দোষও হতে পারে?
গ্রেপ্তারে বাধা দেয় নি ল্যুক? এটা মারাত্মক অপরাধ নয়?
দায়িত্ব এড়াতে চাইছে স্টোন, ভাবল ফ্যারেল। এখানে থাকতে চাইলে আমাকে আমার দায়িত্ব পালন করতে হবে, শীতল কণ্ঠে বলল ও, বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকতে না পারলে তা কীভাবে সম্ভব? আমি স্রষ্টা নই, অন্তর্যামী হয়ে সবাইকে বিচার করার ক্ষমতা নেই আমার। আর বাবার মতো সারা জীবন জ্বলেপুড়ে শেষ হতে চাই না আমি।
জানতাম একথা বলবে।
অন্যায় কিছু বলেছি?
না। থাক, এবার যাও, ডাক্তারকে খবর দাও, না আমিই যাব?
বাইরে যেতে ভয় পাই ভেবেছ?
কয়েক মুহূর্ত ওর দিকে তাকিয়ে রইল স্টোন, তারপর মাথা নাড়ল। না, তা নয়, কিন্ত তুমি আহত, ক্লান্ত, বিশ্রামের দরকার। আমিই বরং ডাক্তারের কাছে যাই।
মাথা নাড়ল ফ্যারেল। একটানে দরজা খুলে পা বাড়াল বাইরে। সশব্দে কবাট আটকে দিল জেস স্টোন।
হঠাৎ একটা ঢিল এসে লাগল ক্লিফের বুকে, সম্ভবত দরজার দিকে ছুঁড়েছিল কেউ, লেগে গেছে। তবু প্রচণ্ড রাগে মাথায় রক্ত চড়ে গেল ওর, জনতার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাল।
এক এক করে সবার, চেহারা, জরিপ করল। নিজের চেহারা কেমন লাগছে ভাবল। তিন চারদিন দাড়ি কামানো হয় নি, খসখস করছে গাল, রোদ আর অনিদ্রায় লাল হয়ে গেছে চোখ দুটো। নিঃসন্দেহে অসভ্য বর্বরের মতো লাগছে।
ওর সঙ্গে চোখাচোখি হূতেই দৃষ্টি সরিয়ে নিল সবাই। অশ্রাব্য গালিগালাজ করছে পেছনের সারির লোকজন।
রাস্তায় নেমে দ্রুত হাঁটতে শুরু করল ক্লিফ ফ্যারেল। কনুইয়ের ধাক্কায় পথ করে নিল, কারও প্রতিবাদ গ্রাহ্য করল না, আহত পায়ে যদূর সম্ভব স্বাভাবিকভাবে পা ফেলার চেষ্টা করছে ও।
পেছন থেকে চিৎকার করে উঠল কে যেন। সোনি তোমার ওপর কী যে খুশি হবে, বলার নয়!
আরেকজন বলল, হারামজাদাকে কী করবে, ছেড়ে দেবে?
জবাব দেয়ার প্রবৃত্তি হলো না ফ্যারেলের। মাঝ রাস্তায়, জনতার মাঝে এভাবে সোনির নাম উচ্চারিত হচ্ছে বলে খারাপ লাগছে। সোনিয়ার লাঞ্ছনার কথা কারও অজানা নেই। এরপর কেমন করে এখানে সংসার করবে ওরা?
ভীড় ছেড়ে দূরে এসে পড়েছে ফ্যারেল, কিন্তু চিৎকারের শব্দ কানে, আসছে এখনও। হাঁটার গতি বাড়াল ও, ডাক্তার বাড়ির সামনে মুহূর্তের জন্যে থামল, তারপর সোনিয়াদের বাড়ির দিকে এগোল।
ডাক্তারের কাছে পরে। গেলেও চলবে। মাঝপথে নিকোলাসের সঙ্গে দেখা হলো, একজোড়া ঘোড়া নিয়ে আসছে। বিড়বিড় করে কী বলে কঠিন দৃষ্টিতে ক্লিফের দিকে তাকাল সে। কিছু বলল না ক্লিফ। যথেষ্ট বাজে কথা শোনা গেছে আজ, আর দরকার নেই। নিকোলাসের ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ বোঝে, কিন্তু কী করার আছে? ফেরারীর মতোই ঝড়ের বেগে ছুটতে হয় অফিসারকে, নইলে আসামীকে ধরা যাবে কীভাবে?
মাথার ওপর অকৃপণ হাতে আগুন ঢালছে সূর্য, স্থির হয়ে আছে বাতাস। জৈহাউসে সামনের কোলাহলের শব্দ ক্ষীণ হয়ে এসেছে। শহরের সীমানায় গ্রে বাট পাহাড়ের বিশাল কাঠামো, কিছুক্ষণ পর ওটার আড়ালে চলে যাবে সূর্য, দীর্ঘ ছায়ায় ঢাকা পড়বে শহর, স্বস্তি ফিরে আসবে।
সোনিয়াদের বাড়িতে পৌঁছুল ফ্যারেল, গেট খুলে এগিয়ে গেল। দরজায় দাঁড়িয়ে বেল টিপে অপেক্ষা করল। কয়েক মুহূর্ত পর দরজা খুলে মুখোমুখি হলো সোনিয়ার মা। সমবেদনার দৃষ্টিতে ক্লিফের দিকে তাকাল। ওর ধূলিমলিন পোশক আর রক্তাক্ত পা লক্ষ্য করল। এসো, ক্লিফ, বলল অবশেষে। খোদাকে ধন্যবাদ তোমার কোনও বিপদ হয় নি। আর খুশি হয়েছি ওই পিশাচটাকে…এভাবে বলা ঠিক নয়…তবু বলছি…খুব খুশি হয়েছি।
ভেতরে ঢুকে পার্লারের দরজায় বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল ক্লিফ। সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে চড়া গলায় সোনিকে ডাকল মহিলা। একটু পর সিঁড়িতে পদশব্দ শোনা গেল।
এ-বাড়িতে এলে কেন যেন অস্বস্তি বোধ করে ফ্যারেল, সবগুলো কামরা এত সুবিন্যস্ত আর পরিষ্কার, অন্য কোনও জগতে এসে পড়েছে বলে মনে হয়। সোনি যদি ওদের ঘরও এভাবে গুছিয়ে রাখে, মুশকিল হবে, ভাবল ক্লিফ। এ রকম পরিষ্কার চেয়ার-টেবিলে বসতেই ভয় লাগে, ময়লা হয়ে যায় যদি!
একটা অজুহাত দেখিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল সোনিয়ার মা। কামরায় এল সোনি, মায়ের মতোই সহানুভূতির চোখে ওকে দেখল। সোনিয়ার চোখে মুখে অবসাদের ছাপ। নিপ্রাণ কণ্ঠে জানতে চাইল মেয়েটা। পেয়েছ?
মাথা দোলাল ফ্যারেল।
সামনে ঝুঁকে এল সোনি। মরেছে?
মুহূর্তের জন্যে নির্বাক পাথরে পরিণত হলো ক্লিফ। অপরাধী মনে হলো নিজেকে, মারাত্মক পাপ করে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেছে যেন। মাথা নাড়ল ও। না। জেলে আটকে রেখেছি।
পরিপূর্ণ অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল সোনিয়া। আমি…আমি বলেছিলাম…
শান্ত কণ্ঠে ফ্যারেল বলল, ও-ই অপরাধী কীভাবে বুঝব, বলো? সেদিন দুজন অচেনা লোক ছিল এখানে। সোনিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে ক্লিফ, হঠাৎ মনে হলো, হাজার যোজন দূরে সরে গেছে যেন মেয়েটা। ওর মুখের ক্ষত এখন ভালোর দিকে, ফোলা কমেছে, কিন্তু গালের কালো দাগ এখনও আছে, দৃষ্টির স্বচ্ছতা ফেরে নি। কেমন আছ, সোনি? জিজ্ঞেস করল ক্লিফ।
ওর কথা সোনিয়া শুনেছে কিনা বুঝল না। বিড়বিড় করে কথা বলে উঠল মেয়েটা। তাহলে আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে!
হ্যাঁ।
যদি না শহরবাসীরা… প্রাণহীন দৃষ্টিতে ফ্যারেলের দিকে তাকাল সোনিয়া। তুমি যাবার পর থেকেই বলাবলি করছে সবাই, শুনেছ তো।
লিঞ্চিংয়ের কথা বলছ? হ্যাঁ, শুনেছি। নিকোলাসের আস্তাবলে যে লোকটাকে ধরলাম, তাকেও তো ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিল ওরা। এখন, আবার একে চাইছে। কে দোষী জানতে না পারলে হয়তো দুজনকেই ফাঁসিতে ঝোলাবে। ঝমেলা চুকে যাবে- নিজের কণ্ঠস্বরের তিক্ততা বুঝতে পেরে থেমে গেল ফ্যারেল।
প্রাণপণে সংযত রাখল নিজেকে, মনটা শান্ত রাখতে কষ্ট হচ্ছে, একটু বিরতি দিয়ে মৃদু কণ্ঠে আবার বলল, তোমাকে অপমান করেছে যে লোক, উপযুক্ত শাস্তি সে পাবেই, চিন্তা কোরো না। মনটা শক্ত রাখো। দেখবে কিছুই বদলায় নি। শিগগির ভালো হয়ে উঠবে তুমি, এসব কথা ভুলে যাবে, শান্তিতে সংসার করব আমরা।
সেটা বোধ হয় সম্ভব হবে না… ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থেমে গেল সোনিয়া।
এগিয়ে গেল ক্লিফ, কাছে টানল সোনিয়াকে। এভাবে বলল না। আমি তো খুনী নই, একজন খুনী তোমাকে বিয়ে করুক এটা নিশ্চয়ই চাইবে না?
হঠাৎ কাঁপতে শুরু করল সোনিয়া। চিবুক ধরে ওর মুখ উঁচু করে ধরল ফ্যারেল। এক বিন্দু অশ্রু নেই দুচোখে। চড়া গলায় সোনিয়া বলল, কাঠগড়ায় সবার সামনে এ-লজ্জার কথা বলতে হবে…ওহ, আমি পারব না, ক্লিফ।
হয়তো দরকারই হবে না।
পেছনে কারও উপস্থিতি টের পেয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ফ্যারেল। হলরুমে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে সোনিয়ার মা।
দুচোখে আগুন জ্বলছে; কঠিন চেহারা, রাগে রক্তশূন্য হয়ে গেছে। ভুল শুনলাম না তো, ফ্যারেল? লোকটা এখনও মরে নি?
মাথা নাড়ল ফারেল, ছেড়ে দিল সোনিয়াকে।
এগিয়ে এল মিসেস ম্যাকনেয়ার, একটা হাত নড়ে উঠল, প্রচণ্ড চড় কষাল ফ্যারেলকে। কাঁপা গলায় চিৎকার করে উঠল, বেরোও! এখুনি বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থকে। আর কখনও এখানে আসবে না! কাপুরুষ কোথাকার!
জবাব দেয়ার জন্যে মুখ খুলেও চুপ করে গেল ফ্যারেল। সোর্নিয়ার দিকে তাকাল। সোনি, পরে দেখা হবে–
চেঁচিয়ে উঠল ম্যাকনেয়ার। আর কোনওদিন নয়, আমি বেঁচে থাকতে না?
অস্পষ্টভাবে ওর উদ্দেশে মাথা দোলাল সোনিয়া। ক্রোধান্ধ সোনির মাকে এড়িয়ে দ্রুত দরজার দিকে এগোল ফ্যারেল। এখন এখানে থাকলে আপত্তিকর মন্তব্য করতে বাধ্য হবে ও, তার চেয়ে চলে যাওয়া ভালো।
বাইরে এল ফ্যারেল। ভেতরে থেকে সোনির মায়ের উচ্চকণ্ঠের চিৎকার ভেসে আসছে। গেট খুলে রাস্তায় নেমে চিন্তিত চেহারায় ডাক্তার বোনারের বাড়ির দিকে এগোল। এ-শহর অপমানের চূড়ান্ত করে ছেড়েছে ওকে।
ডাক্তার বাড়ি পৌঁছুল ক্লিফ। বাকবোর্ডে চেপে কোথায় যাচ্ছিল ডাক্তার, তার পাশে উঠে বসল। আমাকে জেল পর্যন্ত পৌঁছে দাও, ডাক্তার, বলল ও। সম্ভব হলে আসামীকে একটু দেখে যাবে।
খুব খারাপ অবস্থা নাকি?
তা নয়। শহরবাসীরা ওকে যা করতে চায়, তার চেয়ে ঢের ভালো।
হাসল ডাক্তার। ঘোড়া ছোটাল জেলহাউসের দিকে। আবার শোরগোল শোনা যাচ্ছে। কী জানো, বলল ডাক্তার, যা ন্যায়সঙ্গত মানুষের তা-ই করা উচিত, নইলে সে কীসের মানুষ?
জেলহাউসের সামনে বাকবোর্ড থামিয়ে নামল ডাক্তার বোনার। ধাক্কা মেরে পোমরয় আর অন্য একজনকে সরিয়ে এগিয়ে গেল ফ্যারেল, সজোরে ধাক্কা দিল দরজায়। স্টোন দরজা খুললে আগে ডাক্তারকে ঢোকার সুযোগ করে দিল, তারপর নিজে ঢুকল। দরজা আটকাতে যেতেই ফাঁক দিয়ে সবুট পা সেঁধিয়ে দিল কে যেন। গোড়ালি দিয়ে সজোরে আঘাত হানল ফ্যারেল, সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য হলো জুতোর ডগা। ক্রুর হাসি ফুটে উঠল ক্লিফের ঠোষ্টে। দড়াম করে দরজা আটকে হুডকো বসিয়ে দিল।
সময় অপচয় না করে ব্যাগ হাতে সেলের দিকে এগোল ডাক্তার, স্টোনও তার সঙ্গে গেল। খানিক পর এক টুকরো কাজ হাতে ফিরে এল সে, ক্লিফকে দিয়ে বলল, এই টেলিগ্রামটা পাঠাতে চাইছে রেগান। আমার মনে হয় অনুমতি দেয়া যায়। টেলিগ্রাফ অফিসে যেতে পারবে? ফেরার পথে সাপার সেরে এসো? রাতে আমাদের দুজনকেই এখানে থাকতে হবে।
টেলিগ্রামটা নিয়ে পড়ল ফ্যারেল। ম্যাথু রেগানের নামে পশ্চিমে শদেড়েক মাইল দূরের একটা শহরের ঠিাকানায় পাঠাতে হবে। ল্যুক লিখেছে, এখানে জেলে আটকা পড়েছি, তোমাদের সাহায্য দরকার।
কাগজটা পকেটে ঢুকিয়ে জেল থেকে বেরিয়ে এল ফ্যারেল। ভিড় ঠেলে এগোল টেলিগ্রাফ অফিসের দিকে।
কাউন্টারে কাগজটা ঠেলে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল ও। উইল অ্যাংগারম্যান বার্তা পাঠানো শেষ করলে আবার ফিরতি পথ ধরল। রাস্তার উল্টোদিক দিয়ে জেলহাউসের অতিক্রম করে এল।
হোটেলে এসে ক্লান্ত পায়ে দোতলায় নিজের কামরায় উঠে এল। দাড়ি কামিয়ে হাত মুখ ধুয়ে পরিষ্কার জামা কাপড় পরল। তারপর নীচে ডাইনিং রুমে এসে এক পাশে খালি টেবিল বেছে নিয়ে বসে পড়ল। ডাইনিং রুমে ওর উপস্থিতি অন্যান্য খদ্দেরের সহ্য হচ্ছে না, বুঝতে পারছে, কিন্তু তোয়াক্কা করে না। শিগগির ও আরও অসহনীয় হয়ে উঠবে সবার কাছে।
০৭. সবার সম্মিলিত দৃষ্টি উপেক্ষা করে
খাওয়া শেষ করে সবার সম্মিলিত দৃষ্টি উপেক্ষা করে দৃঢ় পদক্ষেপে রাস্তায় বেরিয়ে এল ক্লিফ ফ্যারেল। জেলহাউসের সামনে ভিড় পাতলা হয়ে এসেছে। সব মিলিয়ে দশ বারজন লোক জটলা পাকাচ্ছে. এখন। এরা নিঃসঙ্গ মানুষ, হেঁটেল, শ্যাক কিংবা কোনও স্যালুনের অতিরিক্ত রুমে রাত কাটায়, হাতে কোনও কাজ নেই বোধহয়, জেলের সামনে রয়ে গেছে।
এতক্ষণ, সন্দেহ নেই, সবাই মিলে মদ গিলেছে। কিন্তু হৈচৈ করছে না ওরা। সবাই শান্ত। রাস্তা ধরে সামনে এগোলে ক্লিফ, জেলহাউসে ফিরে এল। নিষ্করুণ চোখে ওকে জরিপ করল জনতা।
জেলের ভেতরে ঢুকে স্টোনের দিকে তাকাল ক্লিফ। লোকজনের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে মহা পাপ করে ফেলেছি!
এ-রকম হবে জানতাম, বলেছি না? বলল স্টোন।
তা বলেছ। ঘুরে কাঁচের, ফোর দিয়ে বাইরে চোখ রাখল ফ্যারেল। পাহাড়ের আড়ালে সূর্য লুকিয়ে পড়েছে, তবে এখনও আঁধার নামে নি। ঘড়ি দেখুল ও, সোয়া ছটা, অন্ধকার হতে এখনও প্রায় দুঘণ্টা দেরি।
ফিরে এসে বিছানায় বসল ও। রেগানের কী অবস্থা?
ভালোই। হাড়গোড় ভাঙে নি।
চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল,ফ্যারেল, টুপিট্রা টেনে চোখ ঢাকল। অবসাদে ভেঙে পড়তে চাইছে শরীর, কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না; ঘুম দরকার ওর। কাল রাতে ঘুমুতে পারে নি; দশ বার হাত দূরে একজন খুনীকে নিয়ে নিশ্চিতে ঘুমানো যায় না।
ঘুম নেমে এল ক্লিফের দুচোখে। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে তড়াক করে উঠে বসল ও। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, চারদিকে অন্ধকার। দরজার গায়ে গাছের গুড়ি দিয়ে ধাক্কা মারছে জনতা।
দ্বিধান্বিত, হতবাক চেহারায় ইতিউতি তাকাল ক্লিফ। গানর্যাকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে জেস স্টোন, কিন্তু ওর হাতে অস্ত্র নেই।
বিছানা থেকে নামল ক্লিফ, র্যাকের সামনে এসে একটা ডাবল ব্যারেল্ড শটগান তুলে নিল। ডেস্কের ড্রয়ার থেকে কার্তুজ নিয়ে দ্রুত তৈরি করে নিল অস্ত্রটা। রাগত চেহারায় স্টোনের দিকে তাকাল। তোমার কী হলো?দেখছ না। জেল ভাঙার চেষ্টা করছে ওরা?।
কাঁধ ঝাঁকাল স্টোন। দেখেছি। কিন্তু কী করব? একটা বদমাশ রেপিস্টকে বাঁচাতে নিরীহ শহরবাসীর ওপর গুলি ছুড়ব?
নিরীহ? বলে কী! নিরীহ হলে এমন করে? কে আসল, রেপিস্ট ওরা. জানে? না দুজনকেই ঝোলাতে চায়? একজন তো দোষী হবেই, তাই না?
রাগে জ্বলে উঠল স্টোন। দেখো, আমার সাথে মেজাজ দেখিয়ো, না! এখানে আমি শেরিফ, তুমি ডেপুটি মাত্র!
মুখ দিয়ে বিরক্তিসূচক শব্দ করল ক্লিফ ফ্যারেল। আমার বাবা একবার লোক চিনতে ভুল করেছিল, ঠিক, কিন্তু আসামীকে কখনও লিঞ্চিং মব-এর হাতে তুলে দেয় নি। আমিও তা করতে দেব না!
চাইলে তোমাকে বরখাস্ত করতে পারি আমি, জানো! কেড়ে নিতে পারি ওই ব্যাজ!
ঝট করে জেস স্টোনের দিকে তাকাল ফ্যারেল। চেষ্টা করেই দেখো!
দরজার দিকে এগোল ও। অপেক্ষা করল কয়েক মুহূর্ত। গাছের গুড়ি আবার কাটে আঘাত করতেই এক টানে দরজা খুলে ফেলল। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল জনতা, নড়তেও ভুলে গেল।
প্রায় ডজনখানেক হারিকেনের আলোয় ঝলমল করছে জেলখানার সামনের রাস্তা। জনাপঞ্চাশেক তোক দেখা যাচ্ছে। কোত্থেকে একটা উপড়ানো টেলিগ্রাফের খুঁটি যোগাড় করে এনেছে, সেটা দিয়েই দশবার জন লোক দরজা ভাঙার চেষ্টা করছিল। এখন প্রস্তর মূর্তিতে পরিণত হয়েছে সবাই।
কাকে ঝোলাতে চাও তোমরা? চেঁচিয়ে জানতে চাইল ফ্যারেল।
যাকে ধরে এনেছো।
ও-ই দোষী কীভাবে জানলে?
জানাজানির আবার কী আছে? ওটা-ই আসল হারামজাদা, দেখলেই বোঝা যায়!
হাসল ক্লিফ। পোমরয়ের গলা না?
জনতার মাঝে হাসির রোল, পড়ল। হাসি থামতেই তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল ক্লিফ। এখানে গোলমাল না করে বাড়ি ফিরে যাও। জেস হয়তো তোমাদের পথ ছেড়ে দিত, কিন্তু আমি ছাড়ব না। সারা রাত দরজার দিকে শটগান ধরে বসে থাকব, ফের যদি দরজায়, বাড়ি পড়ে সঙ্গে সঙ্গে ট্রিগার টিপব, মনে রেখো এটায় বাকশট ঢোকানোযার গায়ে লাগবে, সোজা জাহান্নামে চলে যাবে।
হঠাৎ নীরবতা নামল রাস্তায়। কঠিন চোখে আরও একবার জনতার দিকে তাকাল ফ্যারেল, তারপর ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দিল। পা দিয়ে একটা চেয়ার টেনে ঠিক দরজার মুখে বসে পড়ল।
হঠাৎ চোখ তুলে দেখল কাঁচের ফোকর দিয়ে ওকে দেখছে কে যেন, চোখাচোখি হতেই অদৃশ্য হলো মুখটা।
ক্লিফ জানে, এবার আলোচনার ঝড় উঠবে জনতার মাঝে, মদ গিলে মাতাল হবে ওরা, হুমকি দেবে ওকে। কিন্তু জেল ভাঙার আর চেষ্টা করবে না। আর জেল না ভেঙে আসামীকে ছিনিয়ে নেয়ার কোনও উপায় নেই। শটগানের একটা ট্রিগারে হাত রেখে সতর্ক পাহারায় রইল ক্লিফ। যাবার আগে ওকে বাজিয়ে দেখবে জনতা, জানে, ওদের নিরাশ করবে না।
পাঁচ মিনিটের মতো কেটে গেল নীরবে। বিছানায় শুয়ে পড়ল স্টোন। সেলের ভেতর কথা বলছে দুই কয়েদী, কিন্তু কী বলছে বোঝা যাচ্ছে না।
অকস্মাৎ, এল হামলা। হামলা আসবে জানা থাকা সত্ত্বেও চমকে উঠল ফ্যারেল। প্রচণ্ড বাড়ি পড়ল দরজায়। গাছের গুঁড়ি নয়, বড়সড় পাথর ছুঁড়ে দিয়েছে কেউ।
দরজার মাত্র ছইঞ্চি দূর থেকে শটগানের ট্রিগার টিপল ক্লিফ।
বদ্ধ ঘরে বিস্ফোরণের প্রচণ্ড, শব্দ হলো, কানে তালা লেগে গেল। শটগানের মাযলে ধোঁয়া উড়ল। ধোয়া কেটে যাবার পর দেখা গেল, দরজার গায়ে প্রায় দুইঞ্চি প্রস্থচ্ছেদের একটা ফোকর তৈরি হয়েছে; কিন্তু বাইরে থেকে কারও আর্তনাদ শোনা গেল না।
দ্রুত শটগান লোড করে নিল ক্লিফ, হ্যামার কক করল।
অস্ত্রটা কোলের ওপর রেখে পকেট থেকে কাগজ তামাক বের করে সিগারেট বানিয়ে ধরাল। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল শেরিফের দিকে।
আজ রাতে আর উৎপাত করবে না কেউ। দরজার ফোকর দিয়ে ওকে গুলি করে মারতে চাইলে অবশ্য ভিন্ন কথা। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ওরা চরম সিদ্ধান্ত নেবে বলে মনে হয় না।
ধীরে ধীরে স্তিমিত হলো বাইরের কোলাহল। হারিকেনগুলো অদৃশ্য হলো। দরজার বিকট ফোকরটার দিকে বিষণ্ণ চেহারায় তাকিয়ে বসে রইল ফ্যারেল।
শটগানের গোলায় দরজায় ফোকর তৈরি হয়েছে, কিন্তু বিপদ কাটে নি। কেন যেন অস্বস্তি বোধ করছে ফ্যারেল, আশঙ্কায় কেঁপে উঠছে বুক; সামনে আরও গোলযোগ, রক্তপাত আর মৃত্যু অপেক্ষা করছে বলে মনে হচ্ছে।
ল্যুক রেগানকে হত্যা না করে ভুল করল না তো?
০৮. নিঃশব্দে চেয়ার ছেড়ে
ভোর।
নিঃশব্দে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ক্লিফ ফ্যারেল, দরজা খুলে বাইরে এল। সকালের ঠাণ্ডা হাওয়া শান্তির পরশ বুলিয়ে দিল গায়ে। নির্জন নিস্তব্ধ পথ-ঘাট। নিঃসঙ্গ একটা কুকুর ঘুরঘুর করছিল, হঠাৎ বসে গা চুলকাল, তারপর লেজ নেড়ে এগিয়ে এল ক্লিফের দিকে। সামনে ঝুঁকে ওটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল ফ্যারেল। লেজ নেড়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল কুকুরটা, পরমুহূর্তে এক দৌড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
গত কয়েকদিনের ঘটনাগুলো একে একে ভাবল ক্লিফ। সোনির মানহানি, হেলম্যানের গ্রেপ্তার, রেগানের পিছু ধাওয়া করে তাকে আটক করা, আসামীকে ছিনিয়ে নেয়ার জন্যে শহরবাসীদের প্রচেষ্টা-ছবির মতো ভেসে উঠল চোখের সামনে। কিন্তু নির্জন রাস্তাঘাট দেখে বিশ্বাস হতে চায় না এত কিছু ঘটে গেছে। যেন একটা দুঃস্বপ্ন, একটু পরে ঘুম ভাঙবে শহরের, সব শঙ্কা কেটে যাবে।
কিন্তু আসলে তা নয়; এসবই রূঢ় বাস্তব। ভোরের শান্তু সমাহিত পরিবেশ আর মৃদুমন্দ হাওয়া বিভ্রান্ত করতে চাইছে ওকে। এই নীরবতা বিপদের পূর্বাভাসই ঘোষণা করছে।
জেলহাউসে ফিরে দরজা আটকে হুড়কোটা জায়গামতো বসাল ক্লিফ। এখনও বিকট শব্দে নাক ডাকছে শেরিফ, তার দিকে চাইল।
কাল রাতে লোকটার অস্বাভাবিক আচরণ বিস্মিত করেছে ওকে। স্টোনের স্বভাবের সঙ্গে ঠিক মানায় না, লোকটাকে কখনও ভীতু বলে মনে হয় নি. ওর; ভীতু না হওয়ারই কথা। শেরিফমাত্রই একজন রেপিস্টকে বাঁচাতে শহরবাসীর ওপর গুলি চালানোর আগে দুবার চিন্তা করবে, হোক না সে বিচারাধীন আসামী।
মৃদু কাঁধ ঝাঁকিয়ে ঘুরে দাঁড়াল ফ্যারেল। স্টোন কাপুরুষ হলে শিগগিরই জানা যাবে সেটা।
জানালার সামনে এসে বাইরে চোখ ফেরাল ও। নিজেই অন্যায় করছে কিনা কে বলবে? রেগানকে জ্যান্ত ধরে আনা হয়তো মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু বাবার অনুতপ্ত, বিধ্বস্ত চেহারা হাজারবার দেখেছে ও, তিলেতিলে দগ্ধ হতে দেখেছে তাকে, এসবের গভীর প্রভাব পড়েছে মনের ওপর, যেজন্যে রেগানকে হত্যা করতে পারে নি।
অধৈর্যের সঙ্গে মাথা নাড়ল ফ্যারেল। সেলব্লক থেকে বিছানা ককিয়ে ওঠার শব্দ এল, পরমুহূর্তে শোনা গেল রেগানের কণ্ঠস্বর। অ্যাই, শেরিফ, গেলে কোথায়?
সেলের দিকে পা বাড়াল ক্লিফ। দরজা পেরোলেই করিডর, দালানের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত চলে গেছে, দুপাশে সারিবদ্ধ সেল। ডানপাশের প্রথম সেলে ল্যুক রেগানকে আটক রাখা হয়েছে; ডানে হেলম্যান, ঘুমোচ্ছে সে।
উদ্ভ্রান্ত চেহারায় গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে আছে ল্যুক রেগান, অনিদ্রার ছাপ চেহারায়।ক্লিফকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল, অ্যাই, ডেপুটি, খাবার দিচ্ছ কখন?
ছটায়, রুক্ষ কণ্ঠে জবাব দিল ফ্যারেল, এখন মোটে, সাড়ে চারটে। আরও ঘণ্টা দেড়েক ঘুমিয়ে নিতে পারো।
কাগজ তামাক হবে?
তামাকের প্যাকেট আর কাগজ বের করে দিল ক্লিফ। সিগারেট বানিয়ে প্যাকেটটা নিজের কাছে রেখে দিল রেগান।
ম্যাচ?
বিরক্তির সঙ্গে কয়েকটা দেশলাইয়ের কাঠি ল্যুকের হাতে দিল ফ্যারেল।
টেলিগ্রামটা পাঠিয়েছ? জানতে চাইল রেগান।
মাথা দুলিয়ে সায় দিল ক্লিফ।
ঠিক তো?
নিজে দাঁড়িয়ে থেকে পাঠিয়েছি।
রেগানের চেহারায় সূক্ষ্ম পরিবর্তন লক্ষ্য করল ক্লিফ। ভাই-টাইয়ের ওপর বেশি ভরসা কোরো না, বলল ও, খোদ শয়তানও এখন তোমাকে রক্ষা করতে পারবে না!
সদন্ত হাসল রেগান; সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ক্লিফের মুখ বরাবর ভুশ করে ধোঁয়া ছাড়ল।
বিদ্যুৎচমকের মতো গরাদের ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে রেগানের শার্টের কলার জাপটে ধরল ফ্যারেল, পরক্ষণে হ্যাচকা টানে সামনে নিয়ে এল তাকে। লোহার শিকের সাথে ঠোক্কর খেলো রেগান, নাকটা থেতলে গেল, গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এল। সজোরে তাকে পেছনে ঠেলে দিল ফ্যারেল, বেমক্কা ধাক্কায় তাল হারাল ল্যুক। এলোমেলো পায়ে পেছনের দেয়ালে গিয়ে বাড়ি খেলো, আছড়ে পড়ল মেঝেয়, কোনওমতে উঠে দাঁড়াল আবার, দৃষ্টিতে আগুনঝরিয়ে ক্লিফের দিকে চাইল!
আর কক্ষনো আমার সঙ্গে ইয়ার্কি, মারবে না! হিসহিস করে বলল ফ্যারেল। আর, মনে রেখো, এদেশে মৃত্যুদণ্ডই রেপের একমাত্র শাস্তি, বাপ এলেও বাঁচাতে পারবে না তোমাকে!
হাতের পিঠে নাকের রক্ত মুছল ল্যুক লেগান, হিংস্র অথচ চাপা কণ্ঠে বলে উঠল, হারামজাদা! তোমাকে খুন করে তারপর এখানে থেকে যাব আমি!
ঠিক আছে, দেখা যাবে কে কাকে খুন করে!
সক্রোধে দড়াম করে দরজা আটকে সেল-ব্লক থেকে অফিসরুমে ফিরে এল ফ্যারেল। প্রচণ্ড শব্দে ধড়মড় করে জেগে উঠল স্টোন, নগ্ন পায়ে বিছানা থেকে মেঝেয় নেমে রুক্ষ কণ্ঠে জানতে চাইল, কী-কী হয়েছে?
কিছু না চিন্তার কিছু নেই, জবাব দিল ফ্যারেল। একটু বিরতির পর জিজ্ঞেস করল, নাশতা করতে চাও?
করতে পারলে ভালো হত, ভাল খিদে পেয়েছে।
ঠিক আছে, নিয়ে আসছি, বলল ক্লিফ। মাংস আর ডিম, চলবে?
চলবে।
মাথায় টুপি চাপিয়ে বাইরে এল ফ্যারেল। হুড়কো আটকে দিল শেরিফ। হোটেলের দিকে পা বাড়াল ক্লিফ। এক লোক হোটেলের বারান্দা আর সামনের ফুটপাথ ঝাড় দিচ্ছে। একে ক্লিফ চেনে না, ভবঘুরে জাতীয় কেউ হবে, থাকা খাওয়া বিনিময়ে কাজ করে দিচ্ছে। কোনওদিকে না তাকিয়ে। সোজা ভেতরে ঢুকে পড়ল ও।
খাঁ খাঁ করছে ডাইনিং রুম, এত ভোরে কেউ আসে নি। রান্নাঘরে থালাবাসনের ঝনঝন শব্দ হচ্ছে। সেদিকে এগোল ক্লিফ, ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল।
ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল বাবুর্চি জন ক্যাশ।
কফি হবে? জানতে চাইল, ফ্যারেল।
মাথা দোলাল জন। ভেতরে ঢুকল ক্লিফ। মগ ভর্তি ধূমায়িত কফি বাড়িয়ে দিল ক্যাশ। কফিতে চুমুক দিয়ে ফ্যারেল বলল, আমাদের দুজনের জন্যে মাংস আর ডিম ভেজে দাও। পরে আসামীদের জন্যে দুই প্লেট নাশতা পাঠিয়ে দিয়ো, ঠিক আছে?
মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাল ক্যাশ, চুলোর দিকে এগিয়ে গেল, নাশতা তৈরির কাজে হাত দিল।
জন ক্যাশের দিকে তাকাল ফ্যারেল। রেগানের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে কিছুই বলে নি লোকটা। তার অবশ্য দরকারও নেই, ও ঢুকতেই যেভাবে তাকিয়েছে, যথেষ্ট; অপরিচিত কাউকে দেখেছে যেন। এর আগে যখনই দেখা হয়েছে নানারকম রসিকতা করেছে ক্যাশ, কিন্তু আজ পুরোপুরি ভিন্ন চেহারা।
শহরবাসীরা নিজেদের ক্লিফের জায়গায় কল্পনা করে বর্তমান পরিস্থিতি বিচার করতে চাইছে, একই সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা ভাবছে ওরা। সমস্যা সেখানেই, একটা কথা ভুলে যাচ্ছে সবাই, দায়িত্ব পালনের সময় কোনও অফিসারের ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা ভাবা উচিত নয়, তার নিরপেক্ষ থাকা বাঞ্ছনীয়। নিজের কাছে পরিষ্কার থাকার জন্যে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শুরুতেই দোষী ধরে নিতে পারে না সে।
কাঁধ ঝাঁকিয়ে সব ভাবনা দূর করে দিতে চাইল ফ্যারেল। জাহান্নামে যাক! লোকে পছন্দ করুক না করুক, দায়িত্ব পালন করতে হবে ওকে। শহরবাসীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার ইচ্ছে থাকলে গ্রেপ্তারে বাধা দেয়ার অজুহাতে অনেক আগেই হত্যা করতে পারত আসামীকে।
কফি শেষ করে চুলোয় চাপানো কেতলি থেকে আবার কফি ঢেলে নিল ফ্যারেল। জনশূন্য ডাইনিং রুমে এসে একটা টেবিলে বসল। পকেট হাতড়ে কাগজ তামাক খুঁজল ও, নেই; রেগান রেখে দিয়েছে ওগুলো। উঠে লবিতে চলে এল ফ্যারেল, ডেস্কের দিকে পা বাড়াল, কেউ নেই ওখানে। ডেস্কের উল্টোদিক থেকে তামাক আর কাগজের প্যাকেট বের করে ডেস্কের ওপর দাম রেখে আবার ডাইনিং রুমে ফিরে এল। চেয়ারে বসে সিগারেট বানিয়ে ঠোঁটে ঝোলাল। কিছুক্ষণ পর দুই ট্রে নাশতা হাঁতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল জন কাশ।
নাশতা নিয়ে হোটেল থেকে রাস্তায় নামল ক্লিফ ফ্যারেল। ফিরতি পথ ধরে জেলহাউসে ফিরল। লাথি হাঁকাল জেলের দরজায়। একটু পর দরজা খুলে দিল জেস স্টোন। ক্লিফ ভেতরে ঢুকতেই আবার দরজা আটকে দিল সে। নিঃশব্দে খাওয়ার পাট চুকাল ওরা। আবার সিগারেট বানাল ক্লিফ, তামাক ভরে পাইপ ধরাল স্টোন।
জাজ কেনেডির কবে আসার কথা, জানো? জিজ্ঞেস করল ফ্যারেল।
দুসপ্তাহ পর।
ইশ, এই মুহূর্তে জাজকে যদি পাওয়া যেত, ভাবল ক্লিফ, ঝটপট রেগানের বিচারের ব্যবস্থা করে ফেলত ও। কিন্তু সেটা যখন সম্ভব নয়, জাজ দুদিন কি দুসপ্তাহ পরে আসুক, ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। জাজ আসার আগে দুটো ব্যাপার ঘটতে পারে: শহরের উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে আসবে; অথবা আরও অবনতি ঘটবে পরিস্থিতির। আগামী আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্য কিছু একটা পরিণতি হয়ে যাবে।
বাইরে কোনও কাজ আছে তোমার? স্টোনকে জিজ্ঞেস করল ফ্যারেল।
মাথা নাড়ল স্টোন। না, কেন?
সোনিকে দেখে আসব ভাবছিলাম।
বিস্মিত দৃষ্টিতে ক্লিফের দিকে তাকাল স্টোন, পরমুহূর্তে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। বেশ তো, যাও।
আবার রাস্তায় নামল ফ্যারেল। দুতিনজন লোককে দেখা যাচ্ছে, বিতৃষ্ণ নয়নে তাকাল তারা ওর দিকে। হনহন করে সোনিয়াদের বাড়ির দিকে এগোল
আজ মারাত্মক কিছু ঘটার আশঙ্কা নেই, তবু জেলখানার আশপাশে থাকবে স্থির করল ফ্যারেল। শহরবাসীরা কালরাতের মতো উত্তেজিত হয়ে পড়লে একা সামলাতে পারবে না স্টোন, হার স্বীকার করে বসবে।
আজ সারাদিন জটলা বেঁধে ক্লিফকে গালমন্দ করবে ওরা। কিন্তু রাতের কথা ভিন্ন, রাতে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে যাবে ওরাতারপর
সোনিয়াদের গেটের সামনে মুহূর্তের জন্যেই ইতস্তত করল ফ্যারেল। সোনিকে আবার দেখতে চায় ও, কাছে পেতে চায়, দেখতে চায় ওর দুচোখের ভয় আর শঙ্কা মুছেছে কিনাঅথচ ভেতরে ঢুকতে সংকোচ হচ্ছে। অপমানিত হওয়ার আশঙ্কায় সোনির মা বাবার সামনে যাবার সাহস পাচ্ছে না। সোনি নিজেই দুর্ব্যবহার করবে কি না কে জানে?
অবশেষে ভেতরে ঢুকল ও, হাঁটতে হাঁটতে দরজার সামনে দাঁড়াল। কড়া নাড়ার জন্যে হাত তুলল, সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল দরজাটা।
সোনির মায়ের মুখোমুখি হলো ক্লিফ। বিবর্ণ, ফ্যাকাসে চেহারা মহিলার, ঠোঁটজোড়া পরস্পর চেপে রেখেছে, ঘৃণা ঝরছে দুচোখে। প্রায় চাপা কণ্ঠে হিসহিস করে কথা বলে উঠল সে। দূর হও! আর কক্ষনো এসো না এদিকে! সোনির সঙ্গে তোমার দেখা হবে না! উফু, তোমার চেহারা দেখতে ইচ্ছে করছে না।
তুমি চাও না আমি ওর সঙ্গে দেখা করি? জানতে চাইল ক্লিফ ফারেল।
যে লোক আপনজনকে আগলে রাখতে পারে না তার সঙ্গে কিসের সম্পর্ক! তোমার মতো কাপুরুষের সঙ্গে সোনির সম্পর্ক থাকতে পারে না চাবুক হাতে তাড়া করার আগেই দয়া করে বিদেয় হও!
কাঁধ ঝাঁকাল ফ্যারেল। জোর করে ভেতরে ঢোকা সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে সোনিয়ার মাকে আক্রমণ করতে হবে। ঘুরে আবার গেটের দিকে এগোল ও, রাস্তায় ওঠার আগে থেমে ঘাড় ফিরিয়ে দোতলায় সোনির ঘরের দিকে
তাকাল। একটু দুলে উঠল না, পর্দাটা? না চোখের ভুল?
মায়ের মতো সোনিও কি ঘৃণা করে ওকে? অসম্ভব নয়। ও তো রেগানকে হত্যা করতে বলেছিল, ওর মনের অবস্থা এখনও আগের মতোই আছে হয়তো, অদূর ভবিষ্যতে বদলানোর সম্ভাবনা ক্ষীণ।
হাঁটতে হাঁটতে আবার জেলে ফিরল ফ্যারেল। হতাশায় ঝুলে পড়েছে কাঁধ, নিস্তেজ মনে হচ্ছে। বিবেকের কাছে নির্দোষ থাকার আদৌ প্রয়োজন আছে? এতই কি গুরুত্বপূর্ণ সেটা? বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলেও বুকে হাত দিয়ে কেউ বলতে পারবে, রেগানই অপরাধী? মাথা নাড়ল ক্লিফ। গ্রে বাট-এর কোনও অবস্থায় নিরপেক্ষ বিচার আশা করতে পারে না রেগান…কেন না ঘটনার সঙ্গে সোনি জড়িত।
দোষী বা নির্দোষ যাই হোক, ফাঁসিতেই মরতে হবে রেগানকে, তাকে ফিরিয়ে এনে কী লাভ হলো তাহলে? মরতে ওকে হবেই, ফাঁসিতে ঝোলার চেয়ে গুলি খেয়ে মরা ভালো নয়?
হঠাৎ ঘুরে জ্যাকব ফ্যারেলের বাড়ির পথ ধরল ফ্যারেল, মোড়ে একবার থামল, তারপর আবার এগোল। এখনও তেমন বেলা হয় নি, কিন্তু বাবাকে জাগা অবস্থায় পাওয়া যাবে, জানে, ও।
নিজের ওপর বিরক্ত ক্লিফ, সমস্যায় পড়লে আগেও বাবার কাছে গেছে, কিন্তু এরকম হয় নি। বাবার পরামর্শ সর সময় কাজে লাগে, তা নয়; প্রায়শ তাকে সমস্যাটা বোঝানোই কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। তবু ও বাবার কাছে যায়, আশা থাকে, হয়তো বাবা সমস্যার গুরুত্ব বুঝতে পারবে।
কারও কাছে পরামর্শ চেয়ে কখনও সন্তুষ্ট হওয়া যায় না। পছন্দসই জবাব বড়ই দুর্লভ। মলিন হাসি ফুটে উঠল ক্লিফের ঠোঁটে। আজ বাবার কাছে পরামর্শের জন্যে যাচ্ছে না ও, কী করবে স্থির করে ফেলেছে, বাবার অনুমোদন প্রয়োজন।
জ্যাকব ফ্যারেলের জীর্ণ শ্যাকের চিমনি থেকে ক্ষীণ রেখায় ধোঁয়া উঠছে। আগাছা আর বুনো ঝোঁপের মাঝ দিয়ে এগোল ক্লিফ। দরজা খোলা ছিল। বাবা? ডাকল ও।
এসো।
ঘরে ঢুকল ক্লিফ। যথারীতি অগোছাল অবস্থা রান্নাঘরের, অবাক হলো না ও। কাবার্ড থেকে কাপ বের করে চুলোয় চাপানো কেতলি থেকে কফি ঢালল।
টেবিলে নাশতা সারছিল জ্যাকব ফ্যারেল, তার সামনে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। সোনিয়ার মা আজ দরজা থেকে আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে, বলল ও।
কিছু বলল না প্রাক্তন শেরিফ।
চোখ তুলে বাবার দিকে তাকাল ক্লিফ, আমি কি ভুল করেছি, বাবা? জিজ্ঞেস করল।
খাবার প্লেট থেকে চোখ সরাল না জ্যাকব ফ্যারেল। কিন্তু ক্লিফ লক্ষ্য করল, মৃদু কাঁপছে তার দুহাত। বাবা? আবার ডাকল ও 1।
মুখ তুলে তাকাল জ্যাকব ফ্যারেল, বোঝা যাচ্ছে, মনের সঙ্গে লড়াই করছে। অবশেষে মুখ খুলল সে। যে যাই বলুক, আমার মতে ঠিক পথেই আছ তুমি। তবে, সাবধান, সামনে বিপদ অপেক্ষা করছে তোমার জন্যে।
জানি।
স্টোনের ওপর ভরসা করো না। বেগতিক দেখলে কেটে পড়বে সে।
সামনে ঝুঁকে পড়ল ক্লিফ।
মানে?
কাঁধ ঝাঁকাল জ্যাকব ফ্যারেল। ওকে ভালো করে চিনি আমি। সাবধানী লোক। দেখেছ তো, প্যসি ছাড়া কখনও কোথাও যায় না, পরিস্থিতি যাতে আয়ত্তের বাইরে না যায় সেদিকে কড়া নজর রাখে। কিন্তু এবার ওর হিশেবে ভুল হতে যাচ্ছে। যত চেষ্টাই করুক সে, পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে, লক্ষণ ভালো নয়।
কত খারাপ, বাবা? ওরা জেল ভাঙার চেষ্টা করবে?
মাথা ঝাঁকাল জ্যাকব। অবশ্যই।
দীর্ঘ সময় নীরব রইল ক্লিফ ফ্যারেল। তারপর চোখ ছোট করে বাবার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, রেগানের মতো একটা বেজন্মাকে বাঁচাতে তুমি মানুষ হত্যা করতে, বাবা?
এবার নীরব থাকার পালা জ্যাকবের। অনেকক্ষণ পর নরম কণ্ঠে জবাব দিল সে। আগে হলে হয়তো করতাম। এখনকার কথা জানি না। কী করা উচিত সেটা জানতে চাও তুমি, তাই না? কী করবে তোমাকেই স্থির করতে হবে, তবে একটা কথা মনে রেখো, আসামীকে লিঞ্চ মবের হাতে তুলে দিলে কি নিজের পায়ে কুড়াল মারলে! এর চেয়ে মারাত্মক ভুল আর হতে পারে না। সব, উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে আসার পর, পরিণামে তোমাকেই দুষবে সবাই, নিজেদের দোষ স্বীকার করবে না।
মাথা কঁকাল ক্লিফ, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তোমার কথায় সাহস পেলাম, বাবা।
একটু যেন আড়ষ্ট হয়ে গেল জ্যাকব ফ্যারেল। উজ্জ্বল হয়ে উঠল দুচোখের দৃষ্টি। উঠে দাঁড়াতে গিয়েও বসে পড়ল, ফিসফিস করে বলল, দরকার হলে ডেকো।
আচ্ছা। বাবা ওকে সরাসরি সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, অপ্রত্যাশিত ঘটনা। তবে এই আশ্বাসের ওপর নির্ভর করে লাভ নেই। এখন প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে একটু পরেই হয়তো বেমালুম ভুলে যাবে। তবে যে কথা শুনতে বাবার কাছে আসা, শুনেছ; এবার নির্দ্বিধায়, নিঃসংকোচে এগোনো যায়।
০৯. জেলে ফিরল ক্লিফ ফ্যারেল
জেলে ফিরল ক্লিফ ফ্যারেল। সময় গড়িয়ে চলল মন্থর গতিতে। দুপুর হলো। বিশ্রাম নিতে বেরিয়ে গেল শেরিফ জেস স্টোন। বাইরে কড়া রোদ, জেলের ভেতর একাকী ঘামছে ফ্যারেল।
ডেস্কে পা তুলে দিয়ে শেরিফের চেয়ারে বসে রয়েছে ও, ভারি হয়ে আসছে চোখের পাতা। কীভাবে যেন একটা মাছি ঢুকে পড়েছে ঘরে, খুব জ্বালাতন করছে, তন্দ্রা টুটে যাচ্ছে বারবার।
কিছুক্ষণ পর পর চেঁচিয়ে এটা ওটা চাইছে ক রেগান। না শোনার ভান করছে ক্লিফ।
গ্ৰে বাট এখন শান্তি, কিন্তু ফ্যারেল জানে, এই শান্তি বিপদের পূর্বাভাস মাত্র। চেয়ার ছেড়ে জানালার দিকে এগিয়ে গেল ও, বাইরে তাকাল। স্যালুন দুটোর সামনে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি লোকের আনাগোনা, এছাড়া পথঘাট মোটামুটি অন্যান্য দিনের মতো। তবু মনে হচ্ছে কোথাও একটা অস্বাভাবিকতা রয়েছেজেলের সামনে দিয়ে যাবার সময় বাঁকা চোখে এদিকে চাইছে সবাই,ক্রমশ খেপে উঠেছে ওরা…দিনের আলোয় অবশ্য অঘটন ঘটার আশঙ্কা নেই, রাতের অপেক্ষায় থাকবে জনতাআঁধারে পরিচয় গোপন করা সহজ।
ঘুরে গানরাকের সামনে এসে দাঁড়াল ক্লিফ। একটা ডাবল ব্যারেল্ড শটগান বের করল, কাল রাতে এটা দিয়েই দরজা ফুটো করেছে। আজও প্রয়োজন হতে পারে।
শটগান ভয় পায় না এমন লোক বিরল। স্বল্প দূরত্বে এটার ক্ষমতা ভয়ঙ্কর, সবচেয়ে বড় কথা শটগানের গুলি সাধারণত ফস্কায় না।
কিন্তু আসামীর প্রাণ রক্ষা করার জন্যে ও কি পারবে শহরবাসীর ওপর গুলি চালাতে?-সময়েই এ-প্রশ্নের জবাব মিলবে। কিন্তু সঠিক সময় চিনে নিতে আবার ভুল হয়ে যাবে না তো?
গ্রে বাট-এর পেছনে পশ্চিমে ডুব দিল সূর্য। অন্ধকারের সাথে ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা নেমে এল শহরের বুকে। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে ফিরে এল স্টোন। দরজা খুলে দিল ক্লিফ ভেতরে ঢুকে ঠেলে কপালের ওপর থেকে টুপি পেছনে সরিয়ে শার্টের হাতায় মুখের ঘাম মুছে শেরিফ বলল, তুমি খেয়ে এসে গে, যাও।
আচ্ছা। শিগগিরই ফিরে আসব।
তাড়াহুড়োর কিছু নেই। বিপদের কোনও আশঙ্কা নেই এই মুহূর্তে।
তীক্ষ্ণ চোখে শেরিফকে জরিফ করল ক্লিফ। স্বাভাবিক চেহারা, উত্তেজনার লেশমাত্র নেই। জেল থেকে বাইরে এসে দরজা ভিড়িয়ে দিল ফ্যারেল। ভেতর থেকে হুড়কো লাগানোর আওয়াজ পাওয়া গেল না।
একটু ইতস্তত করল ক্লিফ, তারপর পা বাড়াল সামনে। চিন্তা নেই, হুড়কো লাগাতে স্টোনের ভুল হবে না।
এতক্ষণ জেলের ভেতর গুমোট পরিবেশে থাকার পর বাইরে আসায় বেশ ভালো লাগছে। শীতল হাওয়ার ছোঁয়া লাগছে গায়ে, হাঁটতে হাঁটতে হোটেলের দিকে এগোল ফ্যারেল।
হোটেলে পৌঁছে জন ক্যাশকে সাপারের ফরমাশ দিয়ে জানালার কাছে একটা টেবিল বেছে নিয়ে বসল ও, তাকাল বাইরে। চারদিক থমথমে। এই মুহূর্তে দুই স্যালুনের সামনে মহা হট্টগোল হওয়ার কথা, বেহেড মাতাল হয়ে জেলের সামনে লোকে ভিড় করলেই স্বাভাবিক দেখাত।
অস্বস্তিকর একটা অনুভুতি ঘেঁকে ধরল ক্লিফকে।
ট্রে-তে করে খাবার নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল জুলি ক্যাশ। ক্লিফের ভাবনায় ছেদ পড়ল। বাঁকা চোখে ওর দিকে তাকাল জুলি, ভাবটা: এ-শহরে মেয়েরা বোধহয় আর নিরাপদে থাকতে পারবে না। খাবার রেখে চলে গেল। জুলি। করুণ হাসি হাসল ফ্যারেল। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবলে একথা বুঝতে কারও কষ্ট হবার কথা নয়, গ্রেপ্তারের পর বিচারে দোষী সাব্যস্ত আসামীকে ফাঁসি দেয়াই ন্যায়সঙ্গত, তাকে লিঞ্চিং মবের হাতে তুলে দেয়া নয়। কিন্তু বর্তমান মুহূর্তে এই সহজ সত্যটা স্বীকার করবে না কেউ।
জানালা দিয়ে আবার বাইরে তাকাল ফ্যারেল। ক্রমশ গাঢ় হয়ে আসছে অন্ধকার।
খাবার শেষ করে কফির কাপ তুলে নিল ও। দ্রুত কফি শেষ করে ঝট করে উঠে দাঁড়াল, টেবিলের ওপর একটা মুদ্রা রেখে তুরিৎ পদক্ষেপে হোটেল থেকে বেরিয়ে এল। প্রয়োজনে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বাবাজ্যাকব ফ্যারেল শহরবাসীদের আদর্শ; আপোসহীন নিষ্ঠুর আইনের প্রতীক।
গত কয়েক বছর ধরে হতাশার সীমাহীন সাগরে ডুবে থাকলেও, এখনও সবার মনে আছে স্পষ্ট, জেল ডাঙার বিরুদ্ধে অতীতে এই লোক প্রচণ্ড প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।
কেন যেন ক্লিফের মনে হচ্ছে, স্টোনের একার পক্ষে এখন আর পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হবে না। তা ছাড়া ওর চালচলনও সুবিধের ঠেকছে না, অচিরেই হয়তো রণেভঙ্গ দেবে সে। কিন্তু তিনজন একাট্টা হতে পারলে বাবা সাহায্য করলে হয়তো জেলখানার ওপর হামলা এলে ঠেকাতে পারবে ওরা।
হনহন করে প্রাক্তন শেরিফের বাড়ির দিকে এগোল ক্লিফ। কী ভেবে পেছনে তাকাল কয়েকবার। কেউ নেই কোথাও। খামোকা উত্তেজিত হচ্ছে, ভাবল ও!
বাবার বাড়ি থেকে আধ ব্লক দুরে পৌঁছুতেই আচমকা রাস্তার দুপাশ থেকে তিনজন লোক সামনে এসে দাঁড়াল। বুকটা ধক করে উঠল ফ্যারেলের ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকাল ধীর কদমে এগিয়ে আসছে আরও চারজন।
হঠাৎ বুঝতে পারল ক্লিফ, ওর আশঙ্কা অমূলক ছিল না। জেলের বাইরে পা রাখার পর থেকেই ওর ওপর নজর রাখা হয়েছে। এদিকে না এলে হোটেল আর জেলহাউসের মাঝামাঝি কোথাও আক্রমণের মুখে পড়তে হত।
ওর জন্যেই শহরবাসীরা এখন ল্যুক রেগানকে ছিনিয়ে নিতে পারে নি। সুতরাং ওকে অক্ষম করে দেয়া গেলে রেগানকে জেল থেকে বের করে নেয়া পানির মতো সহজ হয়ে যাবে।
ঘাড় ফিরিয়ে আবার পেছনে দেখল, ফ্যারেল। ইচ্ছে করলে দৌড়ে পালাতে পারে ও জেল পর্যন্ত সবগুলো গলিপথ, সন্দেহ নেই, পাহারা দেয়ার ব্যবস্থা করেছে ওরা; তবু ঝেড়ে দৌড় লাগালে পৌঁছুনো কঠিন হবে না।
কিন্তু পালাবে না ও। পালালে, এখনও যা আছে, সেই কর্তটুকুও হারাতে হবে।
চট করে ফুটপাথ-এ উঠে পড়ল ক্লিফ, দৃঢ় পদক্ষেপে সামনে এগোল। ওর দেখাদেখি সামনের তিনজনও ফুটপাথ-এ উঠল।
ঝড়ের গতিতে চিন্তা চলছে ক্লিফের মাথায়। এ মুহূর্তে বাবার সাহায্য আশা করা বৃথা, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেও বাবা শুনবে না। পিস্তল বের করে ফাঁকা গুলি করা যেতে পারে, সেটাকেও মাতাল কাউহ্যান্ডের কাণ্ড বলে উড়িয়ে দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে পুরোপুরি।
স্টোনের কাছ থেকেও সাহায্য মিলবে না। জেলে পাহারা দিচ্ছে সে, শত কোলাহলেও বেরোবে না। তাহলে সঙ্গে সঙ্গে রেগানকে হারাতে হবে।
কোমরে পিস্তল আছে, খাপমুক্ত করে এদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করা যায়। কিন্তু গুলি ছোঁড়া ওর পক্ষে সম্ভব হবে না; এবং এরা সেটা ভালো করেই জানে। আত্মরক্ষার তাগিদ ছাড়া মানুষ খুন করতে পারবে না ও।
এখন গজ পঞ্চাশেক দূরে আছে সামনের তিনজন। পেছনের চারজনও এগিয়ে আসছে দ্রুত।
থামল না ক্লিফ ফ্যারেল। দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে চলল। এখন থামলে দুর্বলতা প্রকাশ পাবে, মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যাবে তাহলে। দিগুণ উৎসাহে ছুটে আসবে ওরা। সুতরাং এমন কিছু করা যাবে না যাতে মনে হয় ও ভয় পেয়েছে।
আরও কমে এল মাঝের দূরত্ব।
তিরিশ ফুট…
পঁচিশ ফুট…
এগিয়ে চলল ক্লিফ, স্থির দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে।
সামনের একজন হঠাৎ নড়ে উঠল, পথ ছেড়ে দিচ্ছে বলে মনে হলো। কিন্তু সরল না ওরা।
পেছনে সমবেত ছুটন্ত পায়ের শব্দ, আসছে ওরা…
শালাকে মার! চিৎকার করে উঠল কে যেন, শুইয়ে দাও। তারপর বদমাশটাকে জেল থেকে বের করে ঝোলাও!
আর পাঁচ ফুট…পাঁচশো গজ হলেই কী! প্রাচীরের মতো পথ আগলে রেখেছে সামনের তিনজন।
সোজা গিয়ে ওদের ওপর পড়ল ক্লিফ ফ্যারেল। সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে ধাক্কা মারল একজন।
তাল হারিয়ে হুড়মুড় করে মাটিতে পড়ল ক্লিফ, পড়তে পড়তে পিস্তল বের করে আনল হোলস্টার থেকে। ফুটপাথএ শায়িত অবস্থাতে আক্রমণকারীর মাথায় পিস্তল তাক করল।
ঘাবড়ে গিয়ে ওকে ছেড়ে দিল লোকটা। কিন্তু ওঠার সুযোগ পেল না ক্লিফ। বৃষ্টির মতো কিল, চড় আর লাথি পড়তে শুরু করেছে। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেল। বুটের প্রচণ্ড আঘাতে মট করে পাঁজরের হাড় ভাঙার শব্দ হলো।
সবচেয়ে কাছের লোকটার পা আঁকড়ে ধরল ক্লিফ, শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে হ্যাচকা টান মারল। কাটা কলাগাছের মতো মুখ থুবড়ে পড়ল লোকটা। প্রাণপণ চেষ্টায় এই সুযোগে হাঁটু গেড়ে বসল ক্লিফ।
ডান হাতের কজিতে রিভলবারের ব্যারেলের বাড়ি লাগাল কেউ একজন। মুহূর্তে অসাড় হয়ে গেল হাতটা। খসে পড়ল হাতের পিস্তল। লাথি মেরে ওটা দূরে সরিয়ে দিল আরেকজন
নিরস্ত্র ক্লিফ ফ্যারেল, অসহায়। সাতজনের বিরুদ্ধে একা। তবু হার মানবে ও, প্রাণ গেলেও না।
আচমকা সামনে ঝাঁপ দিল ও সংঘর্ষ হলো প্রতিপক্ষের একজনের সঙ্গে। একসঙ্গে আছাড় খেলো ওরা। পরক্ষণে আরও একজনকে ধরাশায়ী করল, কনুইয়ের আঘাত হানল তার কণ্ঠনালীতে। হাঁ হয়ে গেল লোকটার মুখ, বাতাসের জন্যে হাঁসফাস শুরু করে দিল।
একলাফে ফাঁকায় বেরিয়ে এল ফ্যারেল, পড়তে পড়তে কোনওমতে সামলে নিল নিজেকে; তারপরই চরকির মতো ঘুরে মুখোমুখি হলো জনতার।
এখনও কেটে পড়া যায়। আর হয়তো বাধা দেবে না। প্রতিপক্ষের একজন জ্ঞান হারিয়েছে; জবাই করা মুরগীর মতো তড়পাচ্ছে আরেকজন, দুহাতে গলা চেপে ধরেছে, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে প্রতিক্ষণে। খানিক দূরে সরে দাঁড়িয়েছে অন্য একজন, চেহারা বলছে চোট পেয়েছে সে।
হাঁপাচ্ছে ক্লিফ, হাপরের মতো অনবরত ওঠানামা করছে বুক। না, পালাবে না ও, শেষ দেখে ছাড়বে।
চারদিক থেকে ক্লিফের দিকে এগোতে শুরু করল অবশিষ্ট চারজন, সতর্ক ভঙ্গি। পিছোতে লাগল ফ্যারেল। বারবার পেছনে তাকাচ্ছে। দেখছে কোনও দেয়াল আছে কিনা…
এগোচ্ছে চারজন, পিছিয়ে আসছে ক্লিফ। ওকে দিশেহারা করে দিতে চায় ওরা। ক্ষোভ হচ্ছে ক্লিফের। এরা ওর চেনা মানুষ, এই শহরেরই লোকঅথচ শত্রুর মতো আচরণ করছে।
শোনো! চাপা কণ্ঠে ফুসে উঠল ফ্যারেল, আমি বলছি সবাই ফিরে যাও! রেগানকে ঝোলাতে চাইছ, কিন্তু জানো তারপর তোমাদের অবস্থা কী হবে? দু-তিনদিন পর যখন রাগ কমে যাবে তখন বিবেককে বোঝাবে কী করে?
দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ল লোকগুলো সুযোগটা হাতছাড়া করল না ক্লিফ, ছুটে গিয়ে একটা দালানের দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল।
তুমি একটা হারামজাদা, ফ্যারেল! ক্রুদ্ধ কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল একজন। সোনি আমার বউ হলে!
ঘৃণায় কেঁপে উঠল ক্লিফের শরীর। বুঝতে পারছে যুক্তি-জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে এরা। এখন এদের বোঝানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। আর দেরি কেন? পাল্টা জবাব দিল ও, এসো যা করার করো!
অদ্ভুত এক উন্মাদনা জেগেছে জনতার মাঝেচেনা মানুষগুলো একেবারে বদলে গেছে। বিশ্বাস হতে চায় না। গলা পর্যন্ত মদ গিলে বেসামাল হয়ে গেছে, কিন্তু ওদের উন্মত্ততার কারণ মদ নয়, অন্ধ আক্রোশে জ্বলছে ওরা, খুনের নেশায় মেতেছে, তার ছাপই পড়েছে চেহারায়।
ধীর অথচ অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে আসছে চারজন। আর কয়েক ফুট। হঠাৎ ছুটে এসে ডান হাতে ক্লিফের দিকে ঘুসি ছুঁড়ল একজন, তারপর হাঁটু চালাল তলপেট লক্ষ্য করে। সাথে সাথে তার চোয়াল বরাবর সজোরে পাল্টা ঘুসি ঝাড়ল ক্লিফ। থপ করে শব্দ হলো। পরক্ষণে পেটে ঘুসি খেয়ে উবু হয়ে গেল লোকটা, লুটিয়ে পড়ল।
এবার অন্য তিনজন ঝাঁপিয়ে পড়ল ক্লিফের ওপর। ওদের পায়ের নীচে পড়ে চিড়ে চ্যাপটা হলো ধরাশায়ী লোকটা।
যা ভেবেছিল ক্লিফ, সংক্ষেপেই চুকে গেল ব্যাপারটা। ওর প্রতিটি ঘুসি লক্ষ্য ভেদ করলেও সামান্যতম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিতে ব্যর্থ হলো; কিন্তু প্রতিপক্ষ আঘাতে আঘাতে চেহারা পাল্টে দিল ওর। অসহনীয় যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেল ও নির্দয় প্রহারে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
এভাবে মার খেলে আর উঠতে হবে না, ভাবল ফ্যারেল।
বারান্দার পাটাতন থেকে এক টুকরো কাঠ ভেঙে নিল একজন। এলোপাতাড়ি মারতে শুরু করল ওকে।
জীবনে এই প্রথম অদম্য ক্রোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল ক্লিফের। বুকে হেঁটে সরে যেতে চাইল ও, ওঠার চেষ্টা করল। মরার আগেই মরবে না, পাল্টা আঘাত হানবে।
কিন্তু কঠিন আর বেপরোয়া হলেও এক সময় সহ্যের শেষ সীমা ছাড়িয়ে গেল ফ্যারেলের। চোখের সামনে নিকষ কালো পর্দা নেমে এলো। ধূলিধূসর রাস্তায় পড়ে রইল এর জ্ঞানহীন দেহ।
অবশেষে মার থামাল লোকগুলো ঘোলাটে চোখে পরস্পরের দিকে তাকাল, তারপর ঘুরে ক্লান্ত দেহে হাঁটতে শুরু করল। উদ্দেশ্য সফল হয়েছে, এখন আর ওদের বাধা দিতে পারবে না। ফ্যারেল-ধীরে সুস্থে রেগানকে লটকে দেয়া যাবে।
নিসঙ্গ অচেতন ফ্যারেল পড়ে রইল।
অন্ধকার আরও গাঢ় হলো।
.
প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে জ্ঞান ফিরল ক্লিফের। যেন জাগানোর চেষ্টা করছে ওকে। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করছে। লোকটাকে চেনার চেষ্টা করল ও। কে? অবশেষে চিনতে পারল।
জ্যাকব ফ্যারেল, ওর বাবা! প্রয়োজনের মুহূর্তে ঠিক এগিয়ে এসেছে। চারদিকে রাতের অন্ধকার, তবু বাবাকে চিনতে পারছে ও।
শুয়োরের বাচ্চারা! ক্ষোভের সঙ্গে বলল প্রাক্তন শেরিফ, সব কটাকে ধরে ফাঁসি দেওয়া উচিত! দেখি, ক্লিফ আমার ওপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াও। ঘরে চলো, হাত মুখ ধোও; তারপর একসঙ্গে জেলে ফিরব আমরা, শহরের লোকেরা কী করতে পারে দেখব!
বাবার সাহায্যে উঠে দাঁড়াল ফ্যারেল। সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা, হাঁপাচ্ছে, জ্যাকব ফ্যারেলের কাঁধে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোল। গজ পঞ্চাশেক এগিয়ে থমকে দাড়াল। আমার পিস্তল ফেলে এসেছি।
ঠিক আছে, নিয়ে আসছি। পিস্তল আনতে ফিরে গেল জ্যাকব ফারেল কোনওমতে, দাঁড়িয়ে রইল ক্লিফ একটু পরেই ফিরল জ্যাকব। মন্থর গতিতে আবার এগোল ওরা।
ঘরে ঢুকেই একটা চেয়ারে এলিয়ে পড়ল ক্লিফ আলমারি থেকে হুইস্কির বোতল বের করে এগিয়ে দিল বুড়ো ফ্যারেল। খানিকটা গলায় ঢালোলা, ভালো লাগবে!
বিনা আপত্তিতে নির্দেশ পালন করল ক্লিফ। জ্বলতে জ্বলতে গলা বেয়ে নীচে নেমে গেল তরল আগুন। মুহূর্তে,চাঙা বোধ করল ও। বোতলের হুইস্কি দিয়ে এক টুকরো কাপড় ভিজিয়ে ক্লিফের মুখ মুছে দিল জ্যাকব।
ক্ষতস্থানে হুইস্কি লাগতেই জ্বলে উঠল, তবে কিছুটা কমল যন্ত্রণা।
মুখ মোছা শেষ করে জ্যাকব ফারেল জানতে চাইল, হাড়টাড় ভাঙেনি তো?
পাঁজরের একটা হাড় বোধহয় ভেঙেছে! যাকগে, ও নিয়ে পরে ভাবা যাবে। এখন জলদি চলো জেলে ফিরি সময় বায়ে যাচ্ছে!
উঠে দাঁড়াল ক্লিফ। দুলে উঠল পৃথিবী। তারপর ধীরে ধীরে দৃষ্টি স্বচ্ছ হয়ে এল। অসংলগ্ন পা ফেলে দরজার দিকে এগোল ও, ওকে অনুসরণ করল জ্যাকব।এখনও যদি রেগানকে কেড়ে না নিয়ে থাকে, বলল সে, আর পারবে না!
১০. প্রতি পদক্ষেপে প্রাণ বেরিয়ে যেতে চাইছে
প্রতি পদক্ষেপে প্রাণ বেরিয়ে যেতে চাইছে ক্লিফের, দেহের প্রতি ইঞ্চিতে চোট পেয়েছে, অসাড় হয়ে গেছে পেশীগুলো, তারপরও ব্যথা লাগছে। নিঃশ্বাস ফেলার সময় পাঁজরে ভাঙা হাড়ের খোঁচা লাগছে।
জ্যাকব ফ্যারেলের রাস্তা বরাবর এগোল ওরা। আক্রান্ত হওয়ার জায়গাটা পেরোনোর সময় রাগে কেঁপে উঠল ক্লিফ। বাবার উদ্দেশে বলল, আচ্ছা বাবা, শহরের লোকজন হঠাৎ এমন শুরু করল কেন?
কাঁধে শয়তান চেপেছে, বলল জ্যাকব ফ্যারেল।
জনতার এমন জঙ্গী চেহারা আগে দেখেছ?
হ্যাঁ।
কোথায়, এখানে?
না, মেক্সিকোয়।
কী ঘটেছিল?
যা হয়, তিক্ত শোনাল জ্যাকব ফ্যারেলের কণ্ঠস্বর, একটা মেয়েকে হত্যার অভিযোগে শহরের লোকজন মিলে এক লোককে ফ্লাগ পোলের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। কাঁধ ঝাঁকাল জ্যাকর ফ্যারেল। লোকটা সত্যিই অপরাধী কিনা তা আর জানা যায় নি। জানার চেষ্টাও করে নি কেউ, আমি নির্দোষ! আমি নির্দোষ! বলতে বলতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিল লোকটা।
ওকে যারা ফাঁসি দিয়েছিল তাদের কিছু হয় নি?
শাস্তি পেয়েছে কিনা? না, কারোই সাজা হয় নি, কিন্তু অনুশোচনায় জ্বলে মরেছে সবাই। পর পর তিনদিন খুঁটির সঙ্গে ঝুলেছিল বেচারার লাশ, কারো নামানোর সাহস হয় নি।
জেলহাউসের দিক থেকে চিৎকার ভেসে এল, অস্পষ্ট।
জলদি চলো! উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল ক্লিফ। একটানে হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করল ও, ধুলো ঝাড়ল, ফু দিয়ে ব্যারেল পরিষ্কার করল।
ভেবেছে, আবার বলল ক্লিফ, আমাকে পথ থেকে সরানো গেছে! ওরা ভালো করে জানে, ওদের ঠেকানোর মুরোদ স্টোনের নেই।
তীব্র ব্যথা উপেক্ষা করে দ্রুত এগোল ক্লিফ, তাল মিলিয়ে চলার গতি বাড়াল জ্যাকব ফ্যারেল।
দেরি হয়ে গেল কিনা কে জানে! বলল ক্লিফ।
প্রয়োজনে ওদের ওপর গুলি চালাতে পারবে? জানতে চাইল বুড়ো ফ্যারেল।
ক্লিফ বুঝতে পারছে, বাবা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। একশো বার! তিক্ত কণ্ঠে জবাব দিল ও। এক ঘণ্টা আগে হয়তো পারতাম না, কিন্তু এখন পারব।
মার খেয়েছ বলে?
মাথা নাড়ল ক্লিফ। চিন্তিত কণ্ঠে বলল, সে জন্যে নয়। আমাকে মারার সময় ওদের চেহারা দেখেছি, সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হয়েছে তাই।
মোড় ঘুরে রাস্তায় উঠল জন। জনতাকে দেখা যাচ্ছে এখন জেলহাউসের সামনে এক থোকা জমাট অন্ধকার, মৃত জানোয়ারের লাশের ওপর জেঁকে বসেছে যেন সহস্র কীট। কয়েকজনের হাতে হারিকেন আছে। দূরত্ব কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে ভীতিকর হয়ে উঠছে জনতার চিৎকার। অ্যাই, স্টোন। দরজা খোলো, হারামজাদা! ডেপুটি ব্যাটাকে তক্তা বানিয়ে দিয়েছি! একা কী করবে তুমি! ভেঙে চুরমার করার আগে জলদি দরজা খোলো!
সাড়া নেই স্টোনের। জেলের ভেতর অন্ধকার। কল্পনার চোখে দেখছে ক্লিফ, অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দরজা খুলবে কিনা ভেবে দ্বিধায় ভুগছে স্টোন। সেলে আটক আসামী দুজনের চেহারাও আন্দাজ করতে পারছে, ওদের চার চোখে এখন মৃত্যুর ছায়া।
বিষণ্ণ হাসি দেখা দিল ক্লিফের ঠোঁটে। রেগানের চেহারায় ভয়ের ছাপ, ভাবতেই আনন্দ বোধ করছে। কিন্তু জনতার হাতে তার মৃত্যু চায় না ও। ফিরিয়ে না এনে মরুভূমিতে হত্যা করলে রেগানের মৃত্যু কত আরামের হত আবার সেটা উপ্পলব্ধি করল ক্লিফ। এখানে, এখন নরক যন্ত্রণায় ভুগছে শয়তানটা, যেমন সোনিকে ভুগিয়েছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এরকম মানসিক উদ্বেগের মধ্যে কাটাতে হবে তাকে প্রতিটি মুহূর্ত।
জেলহাউস আর আধ ব্লক দূরে। যথাসম্ভব দ্রুত হাঁটছে ক্লিফ, ব্যথায় মনে হচ্ছে মরে যাবে।
এতক্ষণে বাবার অস্ত্রটার দিকে চোখ গেল ওর। পুরোনো একটা ডাবল ব্যারেল্ড শটগান। জ্যাকব ফ্যারেলের মুখের দিকে তাকাল ও। হারিকেনের ফ্যাকাসে আলোয় দেখল, হতাশার ছাপ মুছে গেছে ওর চেহারা থেকে, চোখ ছোট করে তাকিয়ে আছে সামনে, নিষ্পলক দৃষ্টি। ক্রুদ্ধ দেখাচ্ছে।
গুলি আছে? জানতে চাইল ক্লিফ।
হ্যাঁ।
তা হলে এক্ষুনি ওদের মাথার ওপর একটা ব্যারেল খালি করো!
শটগানের মাল উঁচু করল জ্যাকব, টিপ দিল ট্রিগারে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা গেল নলের মুখে, পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে গেল গোলা, জেলখানার দোতালার দেয়ালে লাগল, প্রতিধ্বনি উঠল চারদিকে। ঝনঝনাৎ শব্দে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল সবগুলো জানালার কাচ। চিৎকার ছাড়ল ক্লিফ, সরে এসো সবাই!
একসঙ্গে ঘুরে ফ্যারেলদের মুখোমুখি হলো জনতা, ওর কথায় আমল দিল না।
আবার চেঁচাল ক্লিফ, কই, এসো!
তবুও অবিচল জনতা, নির্মম। পাল্টা চিষ্কার করে উঠল কে যেন, ওকে পাত্তা দিয়ো না। ব্যাটাকে অ্যায়সা ধোলাই দিয়েছি, এখন কি করতে পারবে না…আর জ্যাকভ তো একটা অপদার্থ!
ওদের মাথার ওপর দিয়ে ওপাশের দালানটার দিকে আবার গুলি করো, বাবা। সঙ্গে সঙ্গে আবার রিলোড় করে নিয়ে বহুকটা।
ঘাড় ফিরিয়ে চাইল জ্যাকব ফ্যারেল, তারপর কাঁধের ওপর তুলল শটগান, গুলি করল। ফের ধোঁয়া দেখা দিল মালে। রাস্তার উল্টো দিকের দালানের দেয়ালে লাগল গোলাটা। আবার কাঁচ ভাঙার ঝনঝন শব্দে পিলে চমকে উঠল সবার।
এক মুহূর্ত অপচয় না করে শটগান রিলোড করল জ্যাকব ফ্যারেল। আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল প্রতিধ্বনির শব্দ।
আরও একবার হুঙ্কার ছাড়ল ক্লিফ। আবারও বলছি, জেলের সামনে থেকে সরে এসো! এরপর ঠিক ভিড়ের মাঝ বরাবর গুলি করব। যারা পেছনে রয়েছ, তাদের কিছু না হলেও সামনের, সবাই হাওয়ায় মিশে যাবে!
জটলা আর ফ্যারেলদের মাঝে এখন দশ ফুট ব্যবধান। সবচেয়ে কাছের লোকটার উদ্দেশে চেঁচিয়ে উঠল ক্লিফ। অ্যাই, তুমি!…হ্যাঁ, তোমাকে বলছি! এখন শটগানের একটা গোলা খেলে তোমাদের কি হবে জানো!
জনতার সামনে আলোড়ন দেখা দিল, সরতে শুরু করল ওঁরা। পেছনের লোকেরা পুতুলের মত অনুসরণ করল তাদের।
মুহূর্তে ফাঁকা হয়ে গেল জেলের সামনের ফুটপাত। বিনা বাধায় জেলের সামনে এসে দাঁড়াল জ্যাকব ফ্যারেল আর ক্লিফ। সজোরে দরজায় লাথি হাঁকাল ক্লিফ। হাট করে খুলে গেল কবাটটা। আঁতকে উঠল ও। ঠেলে আগে জ্যাকবকে ঢুকিয়ে চট করে নিজেও ঢুকে পড়ল।
দরজা বন্ধ করে বলল, বাতি জ্বালো, স্টোন।
সাড়া নেই। পিস্তল হোলস্টারে রেখে দেশলাই বের করে দেয়ালে ঘষে জ্বালাল ক্লিফ। স্টোনকে দেখা গেল না কোথাও। ডেস্কের কাছে এসে হারিকেন জালাল ও। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, আসামীদের সঙ্গে সেলে আছে বোধ হয়।
স্টোনকে ঠিক বিশ্বাস করে না ও। কিন্তু সে আসামীদের সঙ্গে থাকলে, বুঝতে হবে ওদের বাঁচানোই তার উদ্দেশ্য; জনতার হাতে ছেড়ে দিতে চাইলে এখানেই বসে থাকত। এগিয়ে গিয়ে সেলরকের দরজা খুলল ক্লিফ। দেশলাই জ্বেলে জ্বলন্ত কাঠি উঁচু করে ধরল। দুপাশের দুটো সেলে রেগান আর হেলম্যান বসে, দুজনই আতঙ্কে শাদা হয়ে গেছে। কিন্তু স্টোন নেই।
অফিস রুমে ফিরে এল ক্লিফ। সেলরকের দরজা বন্ধ করল অস্বস্তি বোধ করছে ও। পরাজয় মেনে নেয়ার জন্যে তৈরি হয়েই ছিল জেস স্টোন। ক্লিফ আর জ্যাকবের আগমনে জনতার মনোযোগ অন্য দিকে সরার সুযোগে সটকে পড়েছে। কোথায় গেছে কে জানে!
স্টোন ভেগেছে, জ্যাকব ফ্যারেলের উদ্দেশে বলল ও।
দরজা খোলা দেখেই বুঝে নিয়েছি।
আরও দুটো হারিকেন জ্বালল ক্লিফ। ব্ল্যাক থেকে শটগান নামিয়ে গুলি ভরে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। বাইরে বেরিয়েই চট করে একপাশে সরে দাঁড়াল, যাতে ভেতরের আলোয় রাস্তা দেখা যায়।
জেল ভাঙার কথা ভুলে যাও! বজ্রকণ্ঠে হঙ্কার ছাড়ল ও। কেউ জেলে ঢোকার চেষ্টা করলে, লাশ ফেলে দেব! রেগানের জন্যে প্রাণ দিতে রাজি থাকলে এসো, যে কোনও সময়, আমার আপত্তি নেই!
আবার জেলের ভেতরে ঢুকল ক্লিফ, সশব্দে দরজা আটকে হুড়কো বসিয়ে দিল।
দরজার সঙ্গে শটগানটা ঠেস দিয়ে রাখল ও বাইরে নিরাপদ দূরত্ব থেকে চেঁচামেচি করছে জনতা।
এগিয়ে এসে খাটে বসল ক্লিফ। মলিন হাসি ফুটল ঠোঁটে, জ্যাকব ফ্যারেলের দিকে তাকাল। মেজাজটা একদম তেতে গেছে। এখনও কঠিন একটা রাত পড়ে আছে।
আর বোধ হয় ঝামেলা হবে না। এবার সবাই ঘরে ফিরে যাবে।
কাঁধ ঝাঁকাল ক্লিফ। গেলেই ভালো। এমনিই হয়রান হয়ে গেছি, তার ওপর রাত জাগতে হলে স্রেফ মারা পড়ব!
ক্লিফ জানে, মাত্র একটা কারণে জনতা হতোদ্যম হয়েছে জেক সরাসরি গুলি করবে শুনে অবিশ্বাস করে নি ওরা। সবাই জানে জেকের পক্ষে তা সম্ভব। জেলে ঢোকার চেষ্টা করলে মরতে হবে, এ কথাও বিশ্বাস করেছে জনতা।
চোখ বুজে ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করল ক্লিফ। ঘণ্টাখানেক ঘুমাতে পারলে হত। কিছুটা উপশম হত যন্ত্রণার, ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তাভাবনা করা যেত।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল জানে না ক্লিফ। হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে বসল।
নাহ্, সব ঠিক আছে। বাতিগুলো জ্বলছে, দরজা আটকানো। ডেস্কে বসে রয়েছে জ্যাকব ফ্যারেল।
ক্লিফ জেগেছে দেখে উঠে দাঁড়াল প্রাক্তন শেরিফ। ককিয়ে উঠল চেয়ারটা। হঠাৎ বুঝতে পারল ক্লিফ, নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে বাইরে।
চলে গেছে ওরা? বাবাকে জিজ্ঞেস করল ও।
হ্যাঁ। ঘণ্টাখানেক হলো আওয়াজ নেই।
ঘুমিয়ে পড়েছি কতক্ষণ?
ঘড়ি দেখল জ্যাকব ফ্যারেল। এই ধরো, আড়াই ঘণ্টা?
স্টোনের কী খবর?
কোনও খবর নেই।
কফির গন্ধ পাচ্ছি যেন?
হ্যাঁ। বসো দিচ্ছি।
ঘরের কোণে পেট মোটা চুলোর দিকে এগোল জ্যাকব। কেতলি থেকে কাপে কফি ঢালল। পকেট হাতড়ে কাগজ আর তামাক বের করে সিগারেট রোল করতে শুরু করল ক্লিফ। মারামারির সময় কাগজ কুঁকড়ে গেছে, সমান করে নিতে হচ্ছে আঙুল দিয়ে। দরদর করে ঘামছে ও।
কফির পেয়ালা ক্লিফের হাতে দিল জেক। চুমুক দিল ও। হঠাৎ ঘোড়ার খুরের শব্দ ভেসে এল বাইরে থেকে। জেলহাউসে সামনে থামল ঘোড়াটা।
জ্যাকবের দিকে এক নজর চেয়ে ঘাড় ফিরিয়ে দরজার দিকে তাকাল। ক্লিফ। কে যেন ধাক্কা দিল বাটে!
উঠে দাঁড়াল ক্লিফ, দরজায় ঠেস দিয়ে রাখা শটগানটা তুলে নিল। দরজা খুলল প্রাক্তন শেরিফ। এক অচেনা লোক দাঁড়িয়ে বাইরে, বিশালদেহী, শশ্রুমণ্ডিত চেহারা। অনুমতির তোয়াক্কা না করে ভেতরে ঢুকে পড়ল সে। চট করে তার পেছনে এসে দরজা আটকে দিল জ্যাকব ফ্যারেল।
চুপচাপ দাঁড়াও, বলল ক্লিফ বাবা, কোমর থেকে ওর পিস্তলটা খুলে নাও।
আলগোছে আগন্তুকের পিস্তল বের করে নিল বুড়ো ফ্যারেল।
কে তুমি? জিজ্ঞেস করল ক্লিফ, কী চাও?
ম্যাট রেগান, ভারি এবং কর্কশ কণ্ঠস্বর। তোমরা আমার ভাইকে আটকে রেখেছ। ওর সঙ্গে দেখা করতে চাই। শার্টের পকেট থেকে একটা দোমড়ানো কাগজ বের করে ক্লিফকে দিল সে। ল্যুকের পাঠানো টেলিগ্রামটা।
মৃদু কাঁধ ঝাঁকাল ক্লিফ। অ বলল ও।
ক্লিফকে জরিপ করল ম্যাট রেগান। তোমার এই দশা কে করল?
ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ক্লিফ, শীতল দৃষ্টি। তোমার ভাইয়ের অপকর্মে এ শহরের লোকজন খেপে গেছে, ওকে কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে ওরা, আমি বাধা দিয়েছি।
বিচার হয়ে গেছে নাকি?
হয় নি, তবে হবে।
নাও হতে পারে।
সেল ব্লকের দরজা খুলে দিল ক্লিফ। যাও। একটা হারিকেন রেগানকে দিল। তারপর আটকে দিল দরজাটা।
কাউচে এসে বসল ও রেগানের সেল থেকে গলার আওয়াজ ভেসে আসছে।
আমার মতে, বলল জ্যাকব ফ্যারেল, নিরাপত্তার খাতিরে একেও আটকে রাখা উচিত। শহরবাসীরা পরিচয় জানতে পারলে
জবাব দিল না ক্লিফ, অপেক্ষা করতে লাগল। মিনিট দশেক পর বেরিয়ে এল ম্যাট রেগান, ডেস্কের ওপর হারিকেন রেখে জ্যাকবের দিকে তাকাল। আমার পিস্তল?
পিস্তলটা ছুঁড়ে দিল জ্যাকব, নিপুণ হাতে লুফে নিল ম্যাট। হোলস্টারে রেখে বলল, ক বলছে ও নির্দোষ।
এছাড়া আর কী বলবে? ব্যঙ্গঝরল ক্লিফের কণ্ঠে।
দোষ করলে আমার কাছে নিশ্চয়ই মিথ্যে বলত না?
কর্কশ কণ্ঠে হেসে উঠল ক্লিফ। তা বটে!
ও-ই দোষী প্রমাণ করতে পারবে?
সেটা আদালতেই দেখা যাবে।
দরজার দিকে পা বাড়াল ম্যাট রেগান, দোরগোড়ায় থেমে ঘাড় ফিরিয়ে ক্লিফের দিকে তাকাল। একটা কথা শোনন, ডেপুটি, ওকে ছেড়ে দাও, সকালের আগেই আমরা হাওয়া হয়ে যাব। আর না ছাড়লে…
শীতল দৃষ্টিতে ম্যাটের দিকে তাকাল ক্লিফ, মৃদু কণ্ঠে বলল, আমার হবু স্ত্রীকে লাঞ্ছিত করেছে ল্যুক। এত সহজে ওকে ছেড়ে দেব ভেবেছ? আমাকে হুমকি দিতে এসো না, স্রেফ আটকে রেখে দেব, বুঝেছ?
হুড়কো সরিয়ে দরজা খুলল ম্যাট রেগান, আবার থামল। আমাদের পরিবারটা বেশ বড় ডেপুটি, বলল সে। আমি ছাড়াও ল্যুকের আরও চারটে ভাই আছে। ওরাও আসবে। শিগগিরই।
ভয় দেখাচ্ছ? বলল ক্লিফ।
ভয়েরই কথা, ডেপুটি, ভয় পাওয়া উচিত। বেরিয়ে গেল রেগান।
দরজা আটকে হুড়কো বসাল ক্লিফ। ঘুরে বাবার মুখোমুখি হলো।
মেরুদণ্ডের কাছটায় শিরশির করছে।
১১. ফিরে এসে ধপ করে বিছানায়
ফিরে এসে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল ক্লিফ। সেল থেকে তীক্ষ্ণ স্বরে চিৎকার করছে ল্যুক রেগান। পাত্তা দিল না। ভুরুজোড়া কুঁচকে আছে ওর। সন্ধ্যায় খাওয়া মারগুলো হজম করার চেষ্টা করছে। জীবনে কখনও এত ক্লান্ত বোধ করে নি। সাধারণ ব্যাপারগুলোও এখন ঘোলাটে লাগছে, মনে হচ্ছে স্মৃতি হারিয়েছে। শহরবাসী আর রেগানের পাঁচ ভাইয়ের চাপের মুখে অবিচল থেকে ল্যুককে আটকে রেখে আদালতে হাজির করা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারছে না।
ডেস্কে পা তুলে আয়েশ করে বসে চোখ বুজল জ্যাকব, ফ্যারেল।
আজই টেলিগ্রাম করলে এখানে আসতে জাজের কতক্ষণ লাগবে? জিজ্ঞেস করল ক্লিফ।
করেই দেখো।
ঠিক আছে যাচ্ছি। তুমি দরজা আটকে হুড়কো বসিয়ে দাও। ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে উঠে দাঁড়াল ক্লিফের বাবা!
মাথায় টুপি চাপিয়ে বাইরে, এল ক্লিফ! দরজায় হুড়কো বসানোর শব্দ শুনল। পকেট হাতড়ে তামাক আর কাগজ বের করল। এক টুকরো কাগজ সমান করে সিগারেট বানিয়ে ঠোঁটে ঝোলাল ও, দেশলাই জ্বেলে ধরিয়ে টান দিল। দ্রুতপায়ে এগোল টেলিগ্রাফ অফিসের দিকে।
বাবার আজকের ভূমিকায় ও সন্তুষ্ট। আত্মবিনাশের পিচ্ছিল পথ থেকে তাকে সরিয়ে আনার জন্যে এরকম কিছুর প্রয়োজন ছিল, ভাবল ক্লিফ। হয়তো সাময়িক, তবু বাবার আত্মবিশ্বাসী চেহারা দেখে ভালো লাগছে।
টেলিগ্রাফ অফিসে এখনও আলো জ্বলছে। টেলিগ্রাফারের মাথার ওপর দেয়াল ঘড়ি সাড়ে এগারটা বাজার ঘোষণা দিচ্ছে। মাঝরাতের আগে জাজের কাছে টেলিগ্রাম করার বুদ্ধি মাথায় আসায় শোকর করল ক্লিফ।
কাউন্টারে দাঁড়াতেই টেলিগ্রাফার উইল অ্যাংগারম্যান, মাথা তুলে তাকাল, সোনালি রিমের চশমা আর সবুজ আই-শেড পরেছে, হাতে কালো স্লিভ প্রোটেক্টর, ইলাস্টিকের সাহায্যে বাহুর সঙ্গে আটকানো। টেবিলের ওপর বোবা টেলিগ্রাফ যন্ত্রটা পড়ে আছে। কাগজ আর পেন্সিল তুলে নিল ক্লিফ। জাজের নাম ঠিকানা লিখে তারপর। আসল খবর বসাল: ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তি আটক। পরিস্থিতি বিস্ফোরোখি। তাড়াতাড়ি আসা দরকার। সম্ভব? বার্তার নীচে স্বাক্ষর করল।
অ্যাংগারম্যানকে চিরকুটটা দিল ও। এখুনি পাঠাও। জবাবের অপেক্ষা করছি আমি।
জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে অকাল ক্লিফ। বার্তা পাঠাতে শুরু করেছে উইল, টেলিগ্রাফ কী টেপার কটকট শব্দ হচ্ছে। হঠাৎ নীরব হলো যন্ত্রটা, ক্লিক করে অপর প্রান্তের প্রাপ্তি সংবাদ জানাল। জেলহাউসের দিকে চোখ রেখে আবার একটা সিগারেট তৈরি করল ক্লিফ। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে। জাজ কেনেডি বার্তা পাবে, উত্তর তৈরি করার পর আবার টেলিগ্রাফের সাহায্যে পাঠানো হবে-সময় লাগা স্বাভাবিক, একঘণ্টার কম নয়।
ডাক্তার ঘুমিয়ে পড়ার আগে কাজটা শেষ করতে পারলে ভালো হত। নিঃশ্বাস নিতে গেলেই সুচের মতো বিধছে পাঁজরের ভাঙা হাড়, ব্যথায় জ্বর এসে যাচ্ছে। দ্রুত খারাপের দিকে যাচ্ছে ওর অবস্থা।
এখনই ডাক্তারের কাছে গেলেজাজের জবাব আসার আগেই বোধ হয় ফিরে আসা যেত
আধ ঘণ্টা পর আসছি আমি, অ্যাংগারম্যানকে বলল ও, জবাব আসতে দেরি হলে একটু খবর নিয়ো।
আচ্ছা। আইশেড ঠেলে ওপরে তুলে বলল অ্যাংগারম্যান। কিছুক্ষণ আগে বেশ হৈ-চৈ হয়ে গেল, তাই না?
হ্যাঁ।
তাড়ালে কীভাবে?
কাঁধ ঝাঁকাল ক্লিফ ফ্যারেল। আর কীভাবে, বললাম, জেলে ঢোকার চেষ্টা করলে কপালে খারাবী আছে, চলে গেল!
কাজটা সত্যিই রেগানের?
তার হবার সম্ভাবনাই বেশি। আবার হেলম্যানও হতে পারে।
টেলিগ্রাফ অফিস থেকে বেরিয়ে ডাক্তার বাড়ির দিকে এগোল ক্লিফ। বাট স্যালুন পেরোনোর সময় কে যেন অকথ্য ভাষায় গালাগালি করল ওকে। শুনেও শোনার ভান করল ও। মোড়ে পৌঁছে সামনে তাকাল, ডাক্তারের ঘরে আলো জ্বলছে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ও। দরজায় এসে কড়া নাড়ল। একটু পর দরজা খুলল ডাক্তার বোনার, রাতের পোশাক পরনে, শোবার আয়োজন করছিল বোধ হয়।
এসো, ক্লিফ, বলল ডাক্তার। একটু বসো তৈরি হয়ে আসি।
আমিই আজ রোগী, ডাক্তার। পাঁজরের একটা হাড় বোধহয় ভেঙে গেছে, একটু যদি দেখে দিতে…
ঝট করে তাকাল ডাক্তার। সে কী! ওরা তোমাকে মেরেছে! এসো, ভেতরে এসো! শাটটা খোলো দেখি!
শার্ট খুলে ফেলল ক্লিফ। ওর বুকে পিঠে লাল-নীল অসংখ্য ক্ষত, বীভৎস দেখাচ্ছে। আঙুলের ডগার চাপ দিয়ে পাঁজর পরীক্ষা করল ডাক্তার। একটা হাড় ভেঙেছে, সন্দেহ নেই, বলল সে। করেছে কী, লাথি মেরেছে?
হ্যাঁ।
বাঁচলে কীভাবে?
পালিয়েছি কিনা? না, পালাই নি, জ্ঞান হারিয়েছিলাম।
আপন মনে বিড়বিড় করতে করতে ওর কাঁধ, পিঠ ভাল করে পরীক্ষা করল ডাক্তার, তারপর বলল, তোমার কপাল ভালো, একটা হাড়ই ভেঙেছে, দাঁড়াও ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি।
কেবিনেট খুলে গ বের করল ডাক্তার। টাইট করে ক্লিফের বুকে ব্যান্ডেজ বাঁধতে শুরু করল। চওড়া ব্যান্ডেজের নীচে ঢাকা পড়ল বুক। ক্লিফ অনুভব করল, এখন আর আগের মতো কষ্ট হচ্ছে না, স্বাভাবিকভাবে নিশ্বাস নিতে পারছে।
এবার শার্টটা বাড়িয়ে দিল ডাক্তার। দৌড়াদৌড়ি না করে কদিন একটু বিশ্রাম নিয়ো…আর কাল একবার এসে দেখিয়ে যেয়ো।
আচ্ছা। অসংখ্য ধন্যবাদ, ডাক্তার।
মাথা ঝাঁকাল ডাক্তার। আডিয়োস, ক্লিফ।
দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল ক্লিফ। সকালে সোনির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, পারি নি, অসহায় কণ্ঠে বলল। কেমন আছে ও?
শারীরিকভাবে সুস্থ, কিন্তু মানসিক ধাক্কা সামলে উঠতে পারে নি। রেগানের বিচার না হলে হয়তো পারবেও না। সেক্ষেত্রেও অনেক সময় লাগবে। শহরবাসীরা যা করছে, চাইলেও এখন ব্যাপারটা ভুলতে পারবে না ও। সবচেয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করছে ওর মা।
দেখা হলে ওকে…বলবে…নাহ্, থাক, কিছু বলতে হবে না!
বলব, যথাসাধ্য করছ তুমি।
ক্লিফ মাথা দোলাল। আরও বলবে, কিছুই পাল্টায় নি।
আচ্ছা, ক্লিফ।
বাইরে এসে দরজা আবজে দিল ফ্যারেল। বাট স্ট্রীট ধরে টেলিগ্রাম অফিসে পৌঁছুল।
জবাব এসেছে? অ্যাংগারম্যানকে জিজ্ঞেস করল ও।
হ্যাঁ, এইমাত্র এল। একটা চিরকুট এগিয়ে দিল অ্যাংগারম্যান।
জাজ লিখেছে: শিগগির আসছি। পরশু সকাল দশটায় বিচার হবে। নীচে স্বাক্ষর করেছে কেনেডি।
বার্তাটা পকেটে রেখে দিল ক্লিফ। ধন্যবাদ, উইল। টেলিগ্রাফ অফিস থেকে বেরিয়ে এল ও। অপেক্ষা করল অ্যাংগারম্যানের। আইশেড খুলে বাতি নেভাল, উইল, বাইরে এসে সাবধানে তালা লাগাল দরজায়, টেনেটুনে ঠিকমতো লেগেছে কিনা দেখল।
ক্লিফের সঙ্গে আধ ব্লক এল সে। তারপর মোড় নিয়ে বাড়ির পথ ধরল। একাকী হয়ে পড়ল ক্লিফ।
জেলহাউসের সামনে থামল ও। বাইরে রাতের শীতল হাওয়া বেশ লাগছে। আবার গুমোট পরিবেশে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। তামাক কাগজ বের করে সিগারেট রোল করে ঠোঁটে ঝুলিয়ে বাইরে দাঁড়িয়েই অলস ভঙ্গিতে টানতে লাগল।
ল্যুক রেগান কঠিন লোক, ভাবল ক্লিফ, তার ভাই আরও খারাপ। লোক চিনতে ওর ভুল হয় না। আরও চারজন নাকি আসছে।
কিন্তু মাত্র পাঁচজন কীভাবে শরহবাসীদের সিদ্ধান্ত পাল্টাতে সক্ষম হবে, ভেবে পেল না ক্লিফ। আর ও যতক্ষণ পাহারায় আছে, জেল দখল করার তো প্রশ্নই ওঠে না।
কিন্তু দৃঢ় আত্মবিশ্বাস সত্ত্বেও রেগানের ভাইদের কথা ভেবে অস্বস্তি বোধ করছে ক্লিফ।
পথঘাট এখন একেবারে নীরব। শহরবাসীদের অধিকাংশ ঘরে ফিরে গেছে। কেবল স্যালুন দুটো থেকে চাপা কোলাহলের শব্দ আসছে।
কঠিন রাস্তায় ঘোড়ার খুরের শব্দ উঠল। মুখ তুলে তাকাল ক্লিফ।
প্রথমে কিছুই চোখে পড়ল না। খুরের শব্দ ক্রমশ এগিয়ে আসছে, একাধিক ঘোড়া এদিকেই আসছে।
ঈষৎ কুচকে উঠল ক্লিফের ভুরু। বাফেলো স্যালুনের খোলা দরজা আর জানালা গলে বেরোনো আলোয় রাস্তা আলোকিত হয়েছে, সেই আলোয় তিনজন অশ্বারোহীকে দেখতে পেল ও। বাট স্যালুন পেছনে ফেলে এল ওরা।
আরেকটু কাছে আসতেই একজনকে চিনতে পারল ক্লিফ। ম্যাট রেগান, বাকি দুজন তার ভাই বলে ধরে দিল। ওদের আসার কথা বলেছিল ম্যাট।
অস্বস্তিকর অনুভূতিটা আবার ছেকে ধরল ওকে। খেপে উঠল ক্লিফ। রেগানের ভাইদের ভয়ের কী আছে? হতে পারে ওরা দুর্ধর্ষ, কঠিন, কিন্তু গ্রে বাট-এর নাগরিকরা কম কীসে? তা ছাড়া পরশু সকাল দশটাতেই তো বিচার হয়ে যাচ্ছে।
জেলহাউসের সামনে ঘোড়া থামাল তিন অশ্বারোহী। অন্ধকারে, ম্যাট রেগানের কর্কশ কণ্ঠস্বর শোনা গেল। ডেপুটি নাকি?
হ্যাঁ।
এসো, আমার দুভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। মার্ক আর জনি।
স্যাডল থেকে নামতে গেল একজন। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ধমক দিল ক্লিফ, খবরদার, নামবে না?
বিনাবাক্যব্যয়ে আগের ভঙ্গিতে বসে পড়ল নোকটা। আবার কথা বলল ম্যাট রেগান। রেগে আছ যেন, ডেপুটি?
হয়তো।
রাগারই কথা। ল্যুকের ফাঁসি ঠেকাতে এসেছি আমরা।
চেষ্টা করে দেখ পারো কি না।
স্রেফ চেষ্টা করে থেমে থাকব না।
ক্লিফের দিকে কয়েক কদম এগিয়ে এল একটা ঘোড়া, মাথা নিচু করে ওর দিকে তাকাল ম্যাট রেগান। জেলখানার জানালা দিয়ে বাইরে আসা ফ্যাকাসে আলোয় ওর চেহারা দেখতে পাচ্ছে ক্লিফ।
শেষ সুযোগ দিচ্ছি তোমাকে, ডেপুটি, মৃদু কণ্ঠে বলল ম্যাট ল্যুকের সেল খুলে দাও, বের করে আনো ওকে। ওকে নিয়ে চলে যাব আমরা, আর কখনও এদিকে আসব না।
হাত দুটো মুঠি পাকিয়ে ফেলল ক্লিফ। দৃঢ় হয়ে চেপে বসল চোয়াল। শহরবাসী, সোনির মা, ল্যুক আর ম্যাট অনেক অপমান করেছে ওকে। ক্রমশ সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
তুমি চলে যাও, রেগান, বলল ও, সময় হাত পালাও। আর কখনও আমায় হুমকি দিতে এসো না।
হুমকি দিলাম কোথায়? তোমাকে একটা সুযোগ দিতে চাইলাম। কঠিন শোনাল ম্যাটের কণ্ঠস্বর। সুযোগটা না নিলে কী হবে, শোনো, বিচারে ল্যুকের বিরুদ্ধে রায় দেয়া হলে বা ওকে জনতার হাতে তুলে দিলে তোমার জীবন বিষিয়ে তুলব আমরা। পৃথিবীতে না এলেই ভালো ছিল-এই রকম মনে হবে তোমার। স্রেফ মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেব হতচ্ছাড়া শহরটাকে লণ্ডভণ্ড করে ছেড়ে দেব–
নিজেকে আর সংযত রাখতে পারল না ক্লিফ। রক্ত চড়ে গেল মাথায়, বিদ্যুৎ বেগে সামনে বাড়ল ও, ম্যাটের ঘোড়ার একপাশে ধাক্কা দিয়েই হাত বাড়িয়ে ওকে ধরল, হ্যাচকা একটা টান দিয়ে ছেড়ে দিল। স্যাডল থেকে পিছলে ধপাস করে মাটিতে পড়ল ম্যাট। দ্রুত এগিয়ে গেল ক্লিফ। তাড়াহুড়ো
করে পিস্তল বের করতে গিয়েছিল প্রতিপক্ষ, ঝেড়ে লাথি কষাল তার হাতে। শূন্যে ভাসতে ভাসতে দূরে গিয়ে পড়ল অস্ত্রটা।
হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করে নিমেষে কক করল ক্লিফ। দৃঢ় স্পষ্ট কণ্ঠে নির্দেশ দিল। কেউ এক চুল নড়েছে কি, কুকুরের মতো গুলি করে মারব!
ম্যাটের দুই সহোদর জমাট বরফে রূপান্তরিত হলো।
এক এক করে সবাই পিস্তল ফেলো! আবার বলল ক্লিফ। ফ্যারেল। টুপ করে মাটিতে পড়ল একটা পিস্তলতারপর আরেকটা আরেকটা।
ঘোড়ায় চাপো, ম্যাট, বলল ক্লিফ। রাতে যদি আবার রাস্তায় দেখি বেঁধে রেখে দেব!।
বিড়বিড় করে কী যেন বলল ম্যাট রেগান, বোঝা গেল না। আচমকা পিস্তলের মাযল ম্যাটের পেটে ঠেসে ধরল ক্লিফ। গুঙিয়ে উঠল লোকটা।
কী বললে?
কিছু না।
যাও, ভাগো! সকালে এসে পিস্তল নিয়ে যেয়ো।
স্যাডলে চাপল ম্যাট রেগান। কী যেন বলতে চাইল, কিন্তু ধমকে তাকে চুপ করিয়ে দিল ফ্যারেল। চোওপ! কোন কথা নয়! দূর হয়ে যাও!
রওনা হলো ম্যাটের, ঘোড়া! অন্য দুভাই অনুসরণ করল। অন্ধকারে মিলিয়ে গেল তিন ছায়ামূর্তি। আত্মতৃপ্তির হাসি হাসল ক্লিফ। কিছুটা হলেও শিক্ষা দেয়া গেছে বদমাশগুলোকে। এতে অবশ্য লাভ হবে না। কালই ফিরে আসবে ওরা। আরও নাকি দুটি ভাই আছে, তারাও অচিরেই আসবে। ভাইকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে ওরা…কিন্তু কীভাবে?
বিনা বিচারে ল্যুককে শহরবাসীর হাতে তুলে দিতে চায় না ক্লিফ, তেমনি চায় না ভাইয়েরা ওকে ছিনিয়ে নিক। বিচারে ল্যুক দোষী সাব্যস্ত হলে ফাঁসিতে ঝুলতেই হবে তাকে। নিজ হাতে তার গলায় দড়ি পরাবে ও।
জেলে ঢোকার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল ক্লিফ। চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ঋয়েছে জ্যাকব ফ্যায়েল। আমি যাচ্ছি, বলল সে। আপাতত আমার এখানে প্রয়োজন নেই, তাছাড়া ভয়ের কারণ নেই দেখলে স্টোন ফিরে আসবে।
মাথা দোলাল ক্লিফ। ঠিক আছে, বাবা, তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
মাথা দুলিয়ে ঘরের পথ ধরল বুড়ো ফ্যারেল।
মাটি থেকে পিস্তল তিনটে তুলে নিয়ে জেলে ফিরে এল ক্লিফ।
১২. পশ্চিমে গ্রীষ্মকালীন রাতগুলো স্বল্পায়ু
পশ্চিমে গ্রীষ্মকালীন রাতগুলো স্বল্পায়ু, তাড়াতাড়ি দিনের আলো ফুটে ওঠে। রাতের কালো মখমল আকাশে হালকা আলোর ছোয়া লাগে প্রথমে, ধীরে ধীরে ধূসর থেকে ক্রমশ ফ্যাকাসে হয়। সূর্য ওঠে পুর দিগন্তে, তার ছোঁয়ায় গোলাপি আভা লাগে ভাসমান মেঘের গায়ে। তারপর আবার বদলে যায় রঙ, কমলা আর সোনালির খেলা চলে দূর আকাশে। সবার আগে প্রথম আলোর পরশ পায় গ্রে-বাট-এর সুউচ্চ চূড়া। এরপর ভোরের নরম আলোয় আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে নীচের ঘুমন্ত বসতি।
সকালে সূর্যের আলো গ্রে বাট-এর সর্বোচ্চ বিন্দু ছুঁতেই দুই ভাইকে নিয়ে শহর থেকে বেরিয়ে এল ম্যাট রেগান। স্যাডল থেকে নামল ওরা, ক্যাম্প করল রাস্তার পাশে। অপেক্ষা করতে লাগল। সিগারেট আর হুইস্কি খাওয়ার, ফাঁকে ফাঁকে রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে পালা করে।
আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি নেই ম্যাটের, তবু এই মুহূর্তে কিঞ্চিৎ ক্ষুব্ধ এবং বিরক্ত সে। বোতলে মুখ লাগিয়ে এক ঢোক হুইস্কি খেয়ে ওর দিকে বোতল বাড়িয়ে ধরল জনি। না দেখার ভান করল ম্যাট।
কাজটা ল্যুকের, ম্যাট? জিজ্ঞেস করল জনি। অবশ্যই। এটাই তো প্রথম নয়।
এক শ্যাইয়্যান মেয়ের কথা আজও মনে আছে ম্যাটের, বেঁচে থাকার সৌভাগ্য বেচারির হয় নি; ল্যুককে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছিল, তাতেই খেপে ওঠে সে, মারা যায় হতভাগিনী।
আরও কয়েকজন মেয়ের দুর্ভাগ্যের কথা জানে ম্যাট, অজানা আরও ঘটনাও আছে নিশ্চয়ই! ল্যুক আপন ভাই না হলে…
কিন্তু সে ওরই সহোদর ভাই, যেভাবে হোক তাকে ফাঁসির দড়ি থেকে রক্ষা করতেই হবে।
হোক না ভাই; তবু অস্বীকার করার জো নেই, ল্যুক একটা পাগলা কুকুর। উঠে দাঁড়াল ম্যাট, বিরক্তির সঙ্গে একটা পাথরে লাথি হাঁকাল, বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল সামনের দিকে! দূরে ধুলোর মেঘ দেখা গেল না? নিশ্চিত হতে পারল না ও। আরও কিছু মুহূর্ত একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেদিকে।
আচমকা পাই করে ঘুরল ম্যাট, ভারি চেহারায় একবার গ্রে বাট শহর আর একবার আকাশ ছোঁয়া বিশাল পাহাড়ের দিকে তাকাল। একটা বুদ্ধি বের করা দরকার। আবার শহরে ফেরার আগেই পরিকল্পনা খাড়া করতে হবে। দুর্ধর্ষ নির্মম, কঠিন হলেও মাত্র পাঁচজনের একটা দলের পক্ষে গোটা শহরের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। গ্রে বাট-এর মতো একটা জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরিতে তো প্রশ্নই ওঠে না
কিন্তু শহরবাসীর সঙ্গে লড়তে এখানে আসে নি ওরা, এসেছে, ল্যুককে জেল থেকে বের করে নিয়ে যেতে।
অথচ মাথায় কিছু খেলছে না। কী করা যায়? গ্রে বাট পাহাড়ের দিকে তাকাল সে আবার। এরকম বিশাল পাহাড়ের নীচে কেন শহর গড়ে তুলতে গেল এরা? শীতের শেষে বরফ গলার সময় নিশ্চয়ই পাথর-ধস নামে… সেটাই স্বাভাবিক সোজা শহরের রাস্তায় গিয়ে পড়ার কথা ধসের…
চট করে বুদ্ধিটা পেয়ে গেল ম্যাট। ক্রুর হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে, দৃষ্টিতে হিংস্রতা। হতচ্ছাড়া পাহাড়টার চূড়ায় ওঠা যায় না?
গ্রে বাট-এর দিকে তাকাল মার্ক আর জনি। তিন ভাইয়ের মধ্যে মার্ক সবার ছোট। ঘোড়ায় চেপে ওই ঢালটার শেষ মাথায় যেতে পারলে আর অসুবিধে হবে না। দেখে তো মনে হচ্ছে গা বেয়ে ওঠা সম্ভব। কেন?
এমনি। চূড়ায় ওঠার দরকার কী?-ভাবছে ম্যাট-পাহাড়ের খানিকটা উঁচুতে উঠলেই তো চলে। ঘোড়ার পিঠে ঢাল বেয়ে ক্লিফের গোড়ায় যেতে পারলে শহরবাসীরা ওদের মতলব টের পাবার আগেই কাজ হাসিল করা যাবে।
পাহাড়ের দিকে পলকহীন চোখে চেয়ে রইল ম্যাট। আনুমানিক দুই তৃতীয়াংশ উচ্চতায় একটা তাক মতো দেখা যাচ্ছে, খাড়া পাহাড়ী দেয়ালের গোড়ায় খাজ-টাজ পেলে ওখানে ওঠা কঠিন হবে না।
ওই চাতালেই উঠতে হবে, স্থির করল ম্যাট। অন্ধকারে উঠলে শহরের লোকেরা দেখতে পাবে না, অবশ্য দিনেই বা কে খেয়াল করতে যাচ্ছে? কয়েক বাক্স ডিনামাইট নিয়ে দুজন ওই তাকে উঠে বসলে…
আপনমনে হাসল ম্যাট,. ঘুরে আবার রাস্তার দিকে তাকাল। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এখন ধুলোর মেঘ, ঠিক সামনে দুজন অশ্বারোহীকেও দেখতে পেল সে।
এতদূর থেকে চেনার কথা নয়, কিন্তু ম্যাট জানে ওদের পরিচয়। ওরই, দুভাই জেস আর লিন্স আসছে।
দশ মিনিট পেরিয়ে গেল।
ঠিক আছে, হঠাৎ বলে উঠল ম্যাট।ঘোড়ায় চাপ তোমরা?
সবার আগে স্যাডলে উঠে বসল সে। হুইস্কিটুকু এক নিঃশ্বাসে শেষ করে বোতলটা ছুঁড়ে ফেলল জনি। পাথরে বাড়ি খেয়ে ভেঙে চুরচুর হয়ে গেল ওটা।
জেস আর লিন্স এসে যোগ দিল ওদের সঙ্গে। পাঁচ অশ্বারোহী একসঙ্গে ধীর গতিতে শহরের পথ ধরল। দীর্ঘদেহী, একহারা গড়নের জেস, খোঁচা খোঁচা দাড়িতে ভর্তি গাল চুলকে পথের পাশে একটা ছুটন্ত গিরগিটির গায়ে তামাকের পিক ফেলল, ভাইদের মধ্যে সে-ই সবার বড়। ল্যুক আবার কী করল? জানতে চাইল নরম গলায়।
এখানকার একটা মেয়েকে রেপ করেছে।
সশব্দে অসন্তোষ প্রকাশ করল জেস; অবশ্য তাকে অবাক হতে দেখা গেল। তা ওকে বের করবে কী করে?
এখন সোজা জেনারেল স্টোরে যাচ্ছি আমরা, ডিনামাইটের কয়েকটা বাক্স নিতে হবে। স্বভাবতই বিক্রি করতে চাইবে না ওরা, সুতরাং কেড়ে নেব। ডিনামাইটের বাক্সসহ গ্রে-বাট পাহাড়ে উঠে যাবে আমাদের দুজন, ঘোড়া নিয়ে নীচে অপেক্ষা করবে আরেকজন, দুজন থাকবে শহরে। তারপর শহরবাসীদের বলব আমাদের দাবী মেনে নিতে, নইলে পুরো পাহাড়টা ধসিয়ে দেব ওদের মাথার ওপর।
চমৎকার, সায় দিল জেস। কসম খোদার, ম্যাট, তোমার বুদ্ধির তুলনা নেই।
ডেলহ্যান্টিস মারকেন্টাইলের সামনে ঘোড়া থামিয়ে স্যাডল থেকে নামল ম্যাট রেগান। জেস আর লিন্স থাকো এখানে। জনি, তুমি আর মার্ক এসো আমার সঙ্গে।
সিঁড়ি বেয়ে সংকীর্ণ বারান্দায় উঠে এল ওরা, তারপর দোকানে ঢুকল।
দোকান খুলেছে বেশিক্ষণ হয় নি। খদ্দের দেখে বুড়ো দোকানি ডেলহ্যান্টি বিশাল বপু নিয়ে এগিয়ে এল।
আমাদের কিছু ডিনামাইট চাই বলল ম্যাট। এই ধরো, পাঁচ বাক্স ফিউজ আর ক্যাপও দিয়ো।
সন্দেহভরা চোখে ম্যাটের দিকে তাকাল, ডেলহ্যান্টি। তোমরা এখানে নতুন?
হ্যাঁ।
ডিনামাইট দিয়ে কী করবে?
হোলস্টার থেকে চট করে পিস্তল বের করল ম্যাট রেগান; প্রেছনে নিয়ে এল হ্যামার। ফিউজ আর ক্যাপসহ পাঁচ বাক্স ডিনামাইট চাই, কত দিতে
ডিনামইট কিনতে হলে শেরিফের অনুমতি লাগবে।
তা হলে, জোর করেই নিতে হচ্ছে। রেখেছ কোথায়?
জবাব দিল না, ডেলহ্যান্টি, একগুয়ে ভাব ফুটে উঠল তার চেহারায়।
গায়ে হাত তুলতে, আমাকে বাধ্য করো না, মিস্টার, নরম গলায় বলল ম্যাট রেগান।
ম্যাটের বিরক্ত চেহারার দিকে তাকাল ডেলহ্যান্টি, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলুল; বেশ, দৈাকানের পেছনে চলো।
মার্ক, তুমি এখানে থাক, বলল ম্যাট।
আচ্ছা।
আবার ডেহ্যান্টির দিকে তাকাল ম্যাট চাবি নাও,…চলো।
মালপত্রে ভর্তি একটা কামরায় ঢুকল ওরা, গোটা ছয়েক চটের খালি বস্তা তুলে নিল ম্যাট, ডেলহ্যান্টির পিছু পিছু আরেকটা ছোট কামরার সামনে এসে দাঁড়াল।
বস্তাগুলো জনির হাতে দিল ম্যাট, চকিতে একবার ওর দিকে তাকাল ডেলহান্টি, তারপর তালা খুলে দিল দরজার।
বাক্স বের করে আনো, আদেশ করল ম্যাট।
নীরবে নির্দেশ পালন করল দোকানি।
ফিউজ আর ক্যাপ কোথায়, দোকানে? জানতে চাইল ম্যাট।
হ্যাঁ।
আচ্ছা। বাক্সগুলো ভেঙে ফেলো দেখি?
আবার ঘরে ঢুকল, ডেলহ্যান্টি, কয়েক সেকেন্ড পর একটা পিঞ্চ বার হাতে ফিরে এল। ওটার সাহায্যে একে একে খুলে ফেলল বাক্সগুলো। ম্যাটও হাত লাগাল। বক্স খোলার পর ডিনামাইটগুলো সঙ্গে আনা চটের বস্তায় ভরে ফেলল। লাথি মেরে, দূরে সরিয়ে দিল খালি বাক্স। দরজায় তালা মারল ডেলহ্যান্টি।
তুমি দুটো বস্তা নাও, স্টোরকীপার, বলল ম্যাট। জনি, তুমি দুটো নাও। বাকি দুটো আমি নিচ্ছি।
ডেলহ্যান্টি আর জনি চারটে ডিনামাইটের বস্তা কাঁধে তুলে নিল। ডানহাতে পিস্তল উঁচিয়ে রেখে বাঁহাতে দুটো বস্তা নিল ম্যাট। আবার দোকানের মূল অংশে ফিরে এল ওরা। মার্ক অপেক্ষা করছিল, ম্যাট তাকে বলল, মার্ক, তুমি আর জনি এগুলো বাইরে নিয়ে যাও। আমি ফিউজ আর ক্যাপ নিয়ে একটু পর আসছি।
বস্তাসই বেরিয়ে গেল দুভাই। ডেলহ্যান্টির দিকে চোখ ফেরাল ম্যাট। এবার ফিউজ আর ক্যাপ, জলদি!
জবাব না দিয়ে পথ দেখিয়ে ম্যাটকে দোকানের পেছন দিকে নিয়ে এল ডেলহ্যান্টি দেয়ালের সঙ্গে লাগানো বুক সমান উঁচু একটা বাক্সের তালা খুলে ম্যাটকে,বড় আকারের একটা ফিউজের কয়েল আর ক্যাপের খুদে বাক্স বের করে দিল! তালা লাগানোর জন্যে, ঘুরে দাড়াল সে। এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল ম্যাট, পিস্তলটা উল্টো করে ধরে সজোরে দোকানির মাথায় নামিয়ে আনল বাঁটটা।
জ্ঞান হারিয়ে নিঃশব্দে ম্যাটের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ল ডেলহ্যান্টি। নিমেষে পিস্তল হোলস্টারে রেখে ঘুরে দাঁড়াল ম্যাট, দোকান ছেড়ে বেরিয়ে এল। চল; যাওয়া যাক, ভাইদের বলল।
স্যাডলে চেপে বসল ম্যাট। বাট স্ট্রীট ধরে এগোল পাঁচ ঘোড়সওয়ার। রাস্তাটা যেখানে দুভাগ হয়েছে, ওখান থেকে আঁকাবাঁকা সংকীর্ণ একটা ট্রেইল পাহাড়ের খাড়া ঢালের দিকে গেছে। সরলরেখার ট্রেইল ধরে এগিয়ে চলল ওরা।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পাহাড়ী দেয়ালের পাদদেশে পৌঁছে গেল পাঁচজন। ঘোড়ার পিঠ থেকে নামল।
রাইফেলটা বের করো, লিন্স, বলল ম্যাট। আমি যতক্ষণ না আসছি, শহরের দিকে কড়া নজর রাখবে।
ফিউজের কয়েল একটা বস্তায় ঢোকাল ম্যাট, দড়ির গোছা খুলে নিল স্যাডল থেকে। তারপর একটা পাহাড়ী খাঁজ বেয়ে উঠতে শুরু করল।
কোথাও এক ফুট কোথাও তিনফুট প্রশস্ত খাজটা, জায়গায় জায়গায় মসৃণ পাথর মানুষের আনাগোনার প্রমাণ দিচ্ছে। শহরের ছোট ছেলেমেয়েরা সম্ভবত খেলতে আসে এখানে, ভাবল ম্যাট।
অল্প আয়াসে খুঁজ বেয়ে উঠে চলল সে, মিনিট দশেক বাদে সে-ই চাতালে পৌঁছুল। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল, তারপর কাঁধ থেকে দড়ি নামিয়ে ওটার প্রান্ত ছেড়ে দিল নীচে, পঁয়ত্রিশ ফুট দীর্ঘ দড়ি সরসর করে নেমে গেল। ডিনামাইটের বস্তা বেঁধে দিতে পারবে ওরা সহজেই।
একটা বস্তা ওপরে তুলল ম্যাট, তারপর আরেকটা, সাত আট মিনিট লাগল সবগুলো বস্তা, পাহাড়ী চাতালে তুলতে।
চিৎকার করে জনির উদ্দেশে ম্যাট। বলল, তুমি আর মার্ক উঠে এসো, জনি! তোমরা, এখানে থাকবে। পরে তোমাদের খাবার আর পানি দিয়ে যাব!
জনি আর মার্ক চাতালে উঠে এল। যদূর সম্ভব সতর্কতার সঙ্গে ডিনামাইট বসানো শুরু করল ম্যাট। চটের বস্তার সাহায্যে প্রথমে খাজের ভেতর বিস্ফোরক বসানোর জায়গা তৈরি করল, সযত্নে তার ওপর সবগুলো ডিনামাইট রাখল। একটা ক্যাপ-এ ফিউজের প্রান্ত ঢুকিয়ে দাঁতে চেপে শক্ত করে আটকে দিল, নরম ডিনামাইটের একটা শলায় ঢোকাল ক্যাপটা.. স্তূপীকৃত ডিনামাইটের সঙ্গে পাথরচাপা দিয়ে ফিউজযুক্ত ডিনামাইটটা রাখল। চাতালের ওপর তার ছড়িয়ে দশ মিনিট আন্দাজ সময় স্থির করল। ভেবেচিন্তে সময় নির্ধারণ করেছে সে। ফিউজে আগুন জ্বালানোর পর বিস্ফোরণের আগেই কেটে পড়তে পারবে মার্ক আর জনি, কিন্তু ওরা নামার পর আগুন নেভানোর সুযোগ পাবে না কেউ।
পিছিয়ে এসে ফিউজের তার যেখানে খাজ থেকে বেরিয়ে এসেছে, সেখানে তারের ওপর পাথর চাপা দিল, ম্যাট-অপ্রত্যাশিতভাবে খুলে আসবে না ওটা। জনির দিকে তাকাল সে এবার। ম্যাচ আছে? জিজ্ঞেস করল।
মাথা দোলাল জনি।
পরপর তিনবার গুলি ছুঁড়ে একটু থেমে আবার দুবার গুলি করব আমি, বলল ম্যাট, তাহলেই বুঝবে ফিউজে আগুন দিতে বলছি। আগুন জ্বেলেই নেমে যাবে তোরা। সোজা স্যান্তা রোসায় চলে যাবে, অপেক্ষা করবে, আমাদের জন্যে।
ঘোড়া?
তিনটে ঘোড়া নিয়ে লিন্স থাকবে নীচে।
ওঁ, হ্যাঁ।
খাঁজ বেয়ে নামতে শুরু করল রেগান। সঙ্কেত দেয়ার দরকার নাও হতে পারে। তবু বলা যায় না, হাতের কাছে দেশলাই তৈরি, রেখো।
আচ্ছা।
নীচে নেমে এল ম্যাট। লিন্স, তুমি ঘোড়া নিয়ে এখানে অপেক্ষা কর। যদি দেখ শহর থেকে কেউ পালাতে যাচ্ছে, তার পায়ের সামনে কয়েকটা গুলি ছুঁড়বি, সাবধান করার জন্যে, তাতে না থামলে দেবে খতম করে।
মাথা দুলিয়ে সায় দিল লিন্স।
খাবার আর মদের বোতলের ব্যবস্থা করছি আমি।
তোফা, ম্যাট।
জেসের উদ্দেশে মাথা দোলাল ম্যাট। চলো, জেস। এবার আরেকবার দেখা করতে হয় ভদ্রলোকের সঙ্গে।
ঘোড়ায় চাপল দুভাই। সর্পিল ট্রেইল ধরে নীচে নেমে এল, দুলকি চালে এগোল জেলহাউসের দিকে। শেরিফের অফিসের সামনে ঘোড়া থামাল ম্যাট, চিৎকার করে ডাকল, শেরিফ! ডেপুটি! কই, বাইরে এসো! কথা আছে!
জেল থেকে বেরিয়ে সতর্ক ভঙ্গিতে রাস্তায় নেমে এল স্টোন আর ক্লিফ ফ্যারেল।
গ্রে বাট পাহাড়ের দিকে ইঙ্গিত করল ম্যাট। ওদিকে দেখো। পাঁচ বাক্স ডিনামাইট আগলে আমার দুভাই বসে আছে, নীচে অপেক্ষা করছে লিন্স।
ছাইয়ের মতো ফ্যাকাসে হয়ে গেল স্টোনের চেহারা, প্রায় কেঁদে ফেলল সে। ইয়া খোদা! তোমরা কী…।
পিশাচের মতো হেসে উঠল ম্যাট। এক সাথে পাঁচ বাক্স ডিনামাইট ফাটলে কী হবে জানো। পুরো পাহাড়টা সরসর করে নেমে আসবে। ঠিক বলেছি কিনা, শেরিফ? ঠিক শহরের ওপর পড়বে আস্ত পাহাড়!
তোমরা…
পারব না বলছ?ম্যাটের চোখে ঠাণ্ডা দৃষ্টি। ভালো করেই জানো তুমি, পারব।
।দাঁতে দাঁত চাপল ক্লিফ ফ্যারেল। চাও কী তোমরা?
বলে দিতে হবে? ল্যুকের মুক্তি। চাই চব্বিশ ঘণ্টা বিনা বাধায় এগোনোর সুযোগ।
আমরা কী করে, তার নিশ্চয়তা দেব? শহরের লোকজন…
আবার কর্কশ স্বরে হেসে উঠল ম্যাট রেগান। মাথার ওপর এতগুলো ডিনামাইট নিয়ে কেউ আমাদের ধাওয়া করতে যারে বলে মনে হয় না। হঠাৎ নতুন একটা ধারণা খেলে গেল তার মাথায়, ল্যুককে বরং আদালতেই সোপর্দ করো, বলল সে, এই অবস্থায় বেকুসর খালাস পেয়ে যাবে। তা জাজ। আসছে কখন?
আজ রাতে কিংবা কাল ভোরে। কাল সকাল দশটায় কোর্ট কাজ শুরু করবে।
তাহলে আমাদের কথাটা সবাইকে জানিয়ে দিয়ো। শহরবাসী বাস্তব অবস্থা জানুক। কয়েকজনের নায়ক হবার খায়েশ বা বোকামির কারণে ডিনামাইট ফাটাতে হলে দুঃখের আর শেষ থাকবে না।
ম্যাট রেগানের দিকে তাকাল ক্লিফ, নরম গলায় বলল, এভাবে পার পাবে, না, রেগান! জানি না কীভাবে, কিন্তু তোমাকে আমি রুখবই।
চেষ্টা করতে থাকো, ডেপুটি, সেই সঙ্গে মাথার ওপর ওই পাহাড়টার কথাও মনে রেখো। চলি, আবার দেখা হবে।
১৩. চলে গেল ম্যাট আর জেস
চলে গেল ম্যাট আর জেস, ওদের গমনপথের দিকে চেয়ে রইল ক্লিফ ফ্যারেল। চোখ দুটো ছোট হয়ে গেছে, রাগে ফেটে পড়তে চাইছে ও, সেই সঙ্গে অসহায় বোধ করছে।
গ্যাড়াকলেই পড়া গেছে, বলল জেস স্টোন। এত সহজে হাল ছাড়ছি না, বলল ক্লিফ। প্রয়োজনে ব্যাটাকে নিজহাতে খুন করব!
সে সুযোগ, তুমি একবার পেয়েছিলে।
জানি, চোখ রাঙিয়ে শেরিফের দিকে তাকাল ক্লিফ। দ্রুত চিন্তা চলছে মাথায়, কিন্তু সমস্যার সমাধান পাচ্ছে না। কী করার আছে? পাহাড়চূড়ায় একসঙ্গে পাঁচ বাক্স ডিনামাইট ফাটলে গ্রে বাট শহরের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে, মাটির সঙ্গে মিশে যাবে বসতবাড়ি, প্রাণ হারাবে অসংখ্য মানুষ।
খবরটা সবাইকে জানিয়ে আসি, বলল স্টোন।
দুড়দাড় করে পালাতে শুরু করবে লোকে।
যদি কাউকে শহরের বাইরে যাবার সুযোগ দেয়া হয়। গ্রে বাট পাহাড়ের দিকে তাকাল জেস স্টোন। তারপর ঘুরে মন্থর পদক্ষেপে হাঁটতে শুরু করল। হোটেলের দিকে তাকাল ক্লিফ। বারান্দার খুঁটিতে এক টুকরো কাগজ সঁটছে ম্যাট, রেগান সরতেই চারপাশে ভিড় জমে উঠল। কাগজটা পড়া শেষ হলে একসঙ্গে সন্ত্রস্ত চেহারায় পাহাড়ের দিকে তাকাল সবাই। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে পাহাড়ী চাতালে বসা ম্যাটের দুভাইকে।
শেরিফকে দেখে শোরগোল তুলে ছুটে এল ওরা। জনতাকে শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা চালাল স্টোন। জেলহাউসে ফিরে এল ক্লিফ, সজোরে লাথি হাঁকিয়ে দরজা আটকাল।
খাঁচায় বন্দী বাঘের মতো দশ পনের মিনিট অবিরাম কামরার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে পায়চারি করে বেড়াল। অসম্ভব একেকটা বুদ্ধি আসছে মাথায়, সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করে দিচ্ছে, গোলক ধাঁধায় পড়ে খাবি খাচ্ছে ও, চোখে অন্ধকার দেখছে। ম্যাটের পরিকল্পনায় ফাঁক নেই, ঠেকাবে কীভাবে?
আচমকা দড়াম করে দরজা খুলে গেল, এলোমেলো পায়ে ভেতরে ঢুকল ডেলহ্যান্টি, মুখের একপাশে রক্তের দাগ, মাথার চুল শুকনো রক্তে জট পাকিয়ে গেছে। চেহারায় যন্ত্রণার ছাপ, দৃষ্টিতে ক্রোধ। ক্লিফ, ওরা..:পাঁচ বাক্স ডিনামাইট কেড়ে নিয়ে গেছে…অজ্ঞান করে ফেলে গিয়েছিল আমায়…জ্ঞান ফিরতেই খবরটা জানাতে ছুটে এসেছি…
আগেই জানতে পেরেছি…
তাহলে শয়তানগুলোকে ধরছ না কেন? তুমি না অফিসার?
একটু এদিকে এসো, ডেলহ্যান্টি… এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলল ক্লিফ, নেমে এল রাস্তায়। সন্দিগ্ধ চেহারায় অনুসরণ করল বুড়ো দোকানি। গ্রে বাট-এর দিকে ইঙ্গিত করল ডেপুটি, ওইযে, পাহাড়ে উঠে বসেছে ওদের দুজন। ডিনামাইটগুলো ওখানে ঘোড়া নিয়ে একজন অপেক্ষা করছে নীচে।
আতঙ্কে বিস্ফারিত হলো ডেলহ্যান্টির চোখজোড়া। কেন? কী চায় ওরা?
মাথা নেড়ে জেলহাউসের দিকে ইশারা করল ফ্যারেল। ল্যুকের ভাই। ওরা, ওকে ছাড়িয়ে নিতে এসেছে।
কী করবে বলে, ভাবছ?
জানি না। কিছু ঠিক করি নি!
পাহাড়ের দিকে সম্মোহিতের মতো চেয়ে রয়েছে ডেলহ্যান্টি, চোখজোড়া কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। পাঁচ বাক্স ডিনামাইট! ইয়া আল্লাহ!
কী রকম ক্ষতি হতে পারে?
প্রায় পুরো পাহাড়টাই নেমে আসবে। মোট কথা কবর হয়ে যাবে আমাদের!
প্রথম আঘাতটা কোথায় লাগবে?
বাট স্ট্রীটের মাথায়।
আমিও তাই ভেবেছি। ওখানেই সোনিয়াদের বাড়ি।
ঘাড় ফিরিয়ে ক্লিফের দিকে তাকাল ডেলহ্যান্টি, তারপর ঘোরলাগা লোকের মতো বিড়বিড় করতে করতে এলোমেলো পা ফেলে সামনে এগোল। পাগল! বদ্ধ উন্মাদ! আমি গেলাম..এখানে আর থাকা যাবে না।
চোখ কুঁচকে ডেলহ্যান্টির গমনপথের দিকে চেয়ে রইল ক্লিফ। কয়েক হাজার টন পাথরাইয়ের ধস সরাসরি সোনিয়াদের বাড়ির ওপর পড়বে ভাবতেই দুহাত মুষ্টিবদ্ধ হলো ওর। শিগগির ওদের সরিয়ে আনতে হবে, ও বাড়িতে থাকা নিরাপদ নয়।
অবশ্য, আপনমনে বলল ক্লিফ, এই মুহূর্তে বিপদের আশঙ্কা নেই, তাড়াহুড়ো করে ডিনামাইট ফাটাতে যাবে না ম্যাট। শহরবাসীরাও এমন কিছু করবে না যাতে অজুহাত পায়।
সুযোগ যখন পেয়েছিল তখনই ল্যুককে হত্যা করা উচিত ছিল, ভাবল ক্লিফ এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। ল্যুককে আটক রাখতে গেলে শহর ধ্বংসের ঝুঁকি নিতে হবে।
এদিকে আবার উধাও হয়েছে স্টোন। উত্তেজিত ভীত জনতা পথে নেমে পড়েছে। ডেল পোমরয় হাহট আর হোটেল ক্লার্ক হিউগে স্মিদারসসহ দশ বারজনের…একটা দল দৌড়ে এল ক্লিফের দিকে। ফুট দশেক দূরে থাকতেই রুদ্ধশ্বাসে চেঁচিয়ে উঠল পোমরয়। ওকে ছেড়ে দাও, ক্লিফ! নইলে সবাইকে মরতে হবে!
উঁহু, মাথা নাড়ল ফ্যারেল। ওকে আমি ছাড়ব না। আদালতে দাঁড়াতেই হবে বদমাশটাকে।
কিন্তু ওরা…
কিচ্ছু করবে না। ল্যুক যতক্ষণ জেলে আছে, বিপদের আশঙ্কা নেই। এরা স্রেফ ল্যুকের ফাঁসি ঠেকাতে চাইছে-আর কিছু না।
ওকে বরং ছেড়েই দাও! আমরা কি ছাই জানতাম যে…!
ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে জনতার দিকে তাকাল ক্লিফ। কালই না ওকে ঝোলানোর জন্যে খেপে উঠলে তোমরা? ওকে ছিনিয়ে নিয়ে ফাঁসি দেয়ার জন্যে মেরে বেহুশ করে দিলে আমায়! আজ আবার উল্টে গেলে কেন? ল্যুক ফেরেশতা হয়ে গেল? না ভয়ে নীতি পাল্টালৈ?
পোমরয়সহ কয়েকজনের চেহারা লাল হলো। মুখ তুলে ক্লিফের দিকে তাকাল পোমরয়। যা খুশি ভাবতে পারো, কিন্তু এক লোককে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করতে গিয়ে পুরো শহরকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়ার কোনও মানে হয় না।
সামনে রাস্তার দিকে তাকাল ক্লিফ। সোনিদের বাড়ির কাছাকাছিই পোমরয়ের বাড়ি, পাহাড় ধসের পথে পড়বে রেগানের বিচার হবেই, গোয়ারের মতো বলল ও। অপরাধী সে, শাস্তি তাকে পেতেই হবে।
রক্ত সরে শাদা হয়ে গেল পোমরয়ের চেহারা। পালা করে একবার রাস্তা আর একবার ক্লিফের দিকে তাকাল। বউ বাচ্চা নিয়ে এখুনি চলে যাচ্ছি আমি এখান থেকে! কাঁপা গলায় বলে উঠল সে।
ঘুরে দাঁড়াল পোমরয়, সঙ্গীদের ঠেলে এগোল, দৌড় দিল বাড়ির দিকে। ক্লিফের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ চেহারার দিকে তাকাল অন্যরা, তারপর পোমরয়ের মতো যার যার বাড়ির পথ ধরল। আরও অনেকে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটোছুটি করছে রাস্তায়।
স্টোন কোথায় গেছে, কে জানে! লোকটা থাকলে ভালো হত, ভাবল ফ্যারেল, বিপদ সম্পর্কে সোনিদের সতর্ক করা দরকার, কিন্তু আসামীদের একা ফেলে কোথাও যাবার সাহস হচ্ছে না।
হঠাৎ ঘোড়ার খুরের শব্দে চমকে তাকাল ক্লিফ। ধুলো উড়িয়ে দ্রুত ছুটে এল একটা বাকবোর্ড, ক্লিফকে পেরিয়ে গেল, অপ্রতিহত গতিতে ছুটল শহর সীমান্তের দিকে। গ্রে বাট-এর চূড়ার দিকে তাকাল ক্লিফ, রাইফেলের নলে রোদের প্রতিফলন দেখল, পরমুহূর্তে ধোয়ার কুণ্ডলী দেখা দিল ওখানে। চট করে বাকবোর্ডের দিকে চোখ ফেরাল ও ঠিক তখনই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ঘোড়াটা। একদিকে কাত হয়ে গেল বাকবোর্ড, কাঁকড়ার মতো পিছলে এগিয়ে গেল বেশ খানিকটা। দুজন যাত্রী ছিটকে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। মেয়েটা ছুটে এল নিঃসাড় লোকটার কাছে।
মুহূর্তের জন্যে ইতস্তত করল ফ্যারেল। ভালো একটা রাইফেল থাকলে পাহাড়ের নীচের লোকটা মাত্র শতিনেক গজ দূরে কিন্তু তাকে মেরে ওপরের দুজনকে ঘায়েল করার আগেই বদমাশগুলো তারে আগুন ধরিয়ে দেবে। তা ছাড়া এখান থেকে ওদের গুলি লাগানো যাবে, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।
ঘুরে উল্টানো বাকবোর্ডের দিকে দৌড়ে গেল ফ্যারেল। চরকির মতো এখনও ঘুরছে একটা চাকা। জবাই করা মুরগীর মতো দাপাদাপি করছে আহত ঘোড়াট, উঠতে পারছে না।
মেয়েটিকে চিনতে পারল ক্লিফ, ডেলা ব্রনসন। অচেতন লোকটি তার স্বামী, এড ব্রনসন। ব্রনসনের পাশে হাঁটু গেড়ে বসেছে ডেলা, ধুলো রক্তের আস্তরণ ওর মুখে, এখানে ওখানে ছিড়ে গেছে পোশাক।
ডেলার মুখোমুখি হয়ে ব্রনসনের অন্যপাশে বসে পড়ল ক্লিফ। স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে এডের। তীক্ষ্ণ চোখে ওর মাথা পরীক্ষা করল ক্লিফ কানের কাছে একটু চামড়া কেটে গেছে, আর কিছু না।
চিন্তার কিছু নেই, ম্যাম, বলল ও, হঠাৎ চোট লাগায় জ্ঞান হারিয়েছে। দাঁড়াও ওকে বাতি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করছি, অপ্রয়োজনে আর বাইরে এসো না , ঠিক আছে?
ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে হাত গুটিয়ে বসে আছ কেন?
লোকজন যতক্ষণ শহরে থাকছে, ওরা চুপচাপ থাকবে। ল্যুককে বের করে নিয়ে যেতে চাইছে তার ভাইয়েরা।
ছেড়ে দাও!
কাল রাতে এডসহ আরও কয়েকজন রেগানকে ছিনিয়ে নেয়ার জন্যে আমাকে প্রায় খুন করে ফেলছিল, বলল ক্লিফ, আর তুমি বলছ তাকে ছেড়ে দিতে?
দ্বিধার ছাপ পড়ল ডেলার চেহারায়। সোজা হয়ে দাঁড়াল ক্লিফ। ইতিমধ্যে ভিড় জমতে শুরু করেছে, ব্রনসনকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার জন্যে অনুরোধ করল জনতাকে। তারপর আহত ঘোড়ার সামনে এসে দাঁড়াল ও, কপাল লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ল পিস্তল থেকে, স্থির হয়ে গেল অবোধ জানোয়ারটা।
তুফান বেগে ঘোড়া হাঁকিয়ে ছুটে এল এক লোক। চেঁচিয়ে তাকে থামতে, অনুরোধ করল ফ্যারেল। কিন্তু কে শোনে কার কথা, ঝড়ের মতো ওকে পাশ কাটিয়ে গেল সে। পাহাড়চূড়ায় আবার রাইফেল গর্জাল প্রচণ্ড শব্দে। ধুলো ছিটকে উঠল ছুটন্ত ঘোড়র পায়ের কাছে। সঙ্গে সঙ্গে লাগাম টেনে ঘোড়া থামাল সওয়ারী, সাঁই করে ঘুরল, আবার ক্লিফদের দিকে ফিরে এল, চলে গেল যে-পথে আসছিল সে-পথে। ক্লিফ শুনল লোকটা বিড়বিড় করছে, রাত হোক, অন্ধকারে লুকিয়ে ঠিক পালাব!
অফিসে চলে এল ফ্যারেল। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে পুরো জনপদে, দ্বিধায় ভুগছে সবাই। পালাতে গেলে গুলি খেতে হবে, বুঝিয়ে দিয়েছে দুবৃত্তরা। আবার শহরে থাকাও নিরাপদ নয় মোটেই। ভয়ের কথা, নতি স্বীকার করবে না সাফ সাফ বলে দিয়েছে ক্লিফ।
জেলহাউসের পেছন থেকে বেরিয়ে এল জেস স্টোন। আতঙ্কে বিহ্বল জনতার দিকে একনজর তাকিয়ে ধূর্ত দৃষ্টি ফেরাল ক্লিফের দিকে।
কোথায় ছিলে? জিজ্ঞেস করল ফ্যারেল।
বাসায়। ভেবেছিলাম ছেলেমেয়েসহ ওকে বাইরে পাঠিয়ে দেব, কিন্তু…
এখানে একটু থাকতে পারবে? মুহূর্তের জন্যে ভয়ের ছাপ পড়ল শেরিফের চোখে।
না, পালাব না, ওকে আশ্বস্ত করল ক্লিফ। একটু সোনিদের বাড়িতে যাব। ওদের সরিয়ে আনা জরুরি, ডিনামাইট ফাটলে সবার আগে ওরাই বিপদে পড়বে।
ঠিক আছে, যাও। স্টোনের কণ্ঠে স্পষ্ট স্বস্তির ছাপ।
হাঁটতে হাঁটতে সোনিয়াদের বাড়ির দিকে এগোল ফ্যারেল। মাঝে মাঝে গ্রে বাট পাহাড়ের দিকে চাইছে। ইচ্ছে করছে ছসাতজন লোক নিয়ে গা ঢাকা দিয়ে এগিয়ে যায়, শেষ করে দিয়ে আসে ওদের। কিন্তু ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে কাজটা। চেষ্টা করলে শদুয়েক গজ কাছাকাছি যাওয়া যাবে হয়তো, তারপরই ওদের চোখে ধরা পড়তে হবে। আত্মরক্ষার জন্যে স্রেফ চাতালের ওপর শুয়ে পড়বে ওরা, তারপর আগুন লগিয়ে দেবে ডিনামাইটের, ফিউজে। সর্বনাশ হয়ে যাবে।
কিন্তু রাতেভাবল ক্লিফটেইল বেয়ে উঠে আচমকা হামলা চালিয়ে ঘোডাঅলাকে বন্দী করে…হ্যাঁ, সম্ভব তারপর-চাতালে উঠে বাকি দুজনকেও পাকড়াও করা যাঝে…কিন্তু ব্যর্থতার সমূহ আশঙ্কাঅন্য কোনও উপায় দেখতে হবে।
একটা চটের বস্তা আর দুটো ক্যান্টিন নিয়ে ম্যাট রেগান ট্রেইল ধরে এগিয়ে যাচ্ছে, দেখ ক্লিফ। চাতালের নীচে ঢালের মাথায় ঘোড়া থামিয়ে স্যাডল থেকে নামল ম্যাট। ওপর থেকে রশি নেমে এল, খানিক পরেই বস্তা আর ক্যান্টিনসহ উঠে গেল, আবার।
আবার ঘোড়ায় উঠে বসল ম্যাট রেগান। ফিরতি পথ ধরল। সোনিদের বাড়ির ঠিক সামনে মুখোমুখি হলো ওরা।
কী ঠিক করলে, ডেপুটি? জিজ্ঞেস করল ম্যাট।
কিছু না, আমি জানি, ল্যুক যতক্ষণ জেলে আছে, ডিনামাইট ফাটানোর ঝুঁকি তোমরা নেবে না। তাহলে তাকেও মরতে হবে।
এতটুকু ম্লান হলো না ম্যাটের হাসি, তবে দুচোখের দৃষ্টিতে কাঠিন্য ফুটল। তোমার ঘাড়ের রগ কী করে সোজা করতে হবে আমি জানি।
তা হলে আর কী, চেষ্টা করো!
জবাব দিল না ম্যাট, ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে একবার ওর দিকে তাকাল, তারপর আবার নিজের পথ ধরল।
সোনিয়াদের দরজায় টোকা দিল ক্লিফ। দরজা খুলল সোনির মা। ক্রুদ্ধ চেহারা। কিন্তু সে মুখ খোলার আগেই বাধা দিল ক্লিফ। চুপ থাকুন! আপনার বকবকানি শুনতে আসি ন; এসেছি, জরুরি একটা কথা বলতে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে পড়ুন এখান থেকে আপনাদের মাথার ওপর পাঁচ বাক্স ডিনামাইট আগলে দুই বদমাশ বসে আছে পাহাড়ে। ল্যুক রেগানকে না ছাড়লে পুরো গ্রে বাট ধসিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছে ওরা।
ফ্যাকাসে হয়ে গেল মিসেস ম্যাকনেয়ারের চেলা, চট করে ঘুরে দাঁড়াল। জুলস! সেনি! চিৎকার জুড়ে দিল সে, শিগগির এসো! তাড়াতাড়ি! শোনো ক্লিফ কী বলছে!
সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামল সোনিয়া আর জুলস ম্যাকনেয়ার। একই কথার পুনরাবৃত্তি করল ক্লিফ। ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকাল সোনিয়ার দিকে। ওর দুচোখের তারায় এখন সেই শূন্যতা নেই। কিন্তু ক্লিফের দিকে সরাসরি তাকাল না সোনি।
এক্ষুনি বেরিয়ে যাব আমরা, বলল সোনির বাবা। আপাতত টেইলরদের ওখানেই উঠব।
ঈষৎ মাথা দোলাল ফ্যারেল। যত চাপই আসুক, নিশ্চিত থাকুন, ল্যুক রেগানকে ছাড়ছি না, বলল ও।
১৪. গেটের সামনে দাঁড়িয়ে
গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল ক্লিফ, ভাবল এখুনি ছুটে আসবে সোনি, একা দুটি কথা বলবে ওর সঙ্গে। কিন্তু ওকে নিরাশ করে বাবা মায়ের সঙ্গে বেরিয়ে এল সোনিয়া। একসঙ্গে দক্ষিণে টেইলরদের বাড়ির পথ ধরল, সবার হাতে একটা করে ব্যাগ।
অনিচ্ছার সঙ্গে আবার অফিসের দিকে পা বাড়াল ক্লিফ, মাঝপথে একবার থেমে গ্রে-বাট পাহাড়ের দিকে তাকাল।
চাতালের দেয়ালে ঠেস দিয়ে অলস ভঙ্গিতে বসে আছে ল্যুকের দুভাই, অবিরাম সিগারেট ফুকছে। সকালের রোদ সরাসরি ওদের চোখে পড়ছে, তাই টুপি নামিয়ে চোখ আড়াল করে রেখেছে।
অপর ভাইটি নীচে রাইফেলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে এদিকে।
শহরের পথঘাট বিস্ময়কররকম নির্জন। ব্রনসন নাজেহাল হওয়ায় পালানোর উৎসাহে ভাটা পড়েছে। জেলহাউসের কাছে এখনও একই ভঙ্গিতে পড়ে রয়েছে বাকবোর্ড আর নিহত ঘোড়াটা।
অফিসে পৌঁছল ক্লিফ, ভবনের সামনে বেঞ্চে বসে পাইপ টানছে স্টোন। তার পাশে বসে পড়ল ও, পকেট থেকে কাগজ-তামাক বের করে সিগারেট বানিয়ে ধরাল। কাউকে দেখছি না, সবাই গেল কোথায়? জিজ্ঞেস করল।
হোটেল লবিতে, মিটিং করছে।
কী ব্যাপারে?
আমাদের রাজি করানোর উপায় বের করতে…
…যাতে স্যুকদের ছেড়ে দিই? বলল ক্লিফ, আমরা রাজি না হলে?
রাত নামলেই এখান থেকে পালানোর চেষ্টা করবে সবাই।
ম্যাট বাধা দেবে।
কীভাবে?
একটা বুদ্ধি ঠিক বের করবে শয়তানটা, বলল ক্লিফ, একটু থামল ও। মিটিংয়ে আমাদের কারও থাকা উচিত ছিল না?
তা ঠিক, যেতে চাও?
উঠে দাঁড়াল ক্লিফ। নানা জনের অনুযোগ অভিযোগের মুখোমুখি হতে হবে বলে যেতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু ন গিয়ে উপায় নেই। হোটেলে পৌঁছে। সোজা লবিতে ঢুকে পড়ল ও।
সত্তর-পঁচাত্তর জন লোক জমায়েত হয়েছে লবিতে, অধিকাংশই পুরুষ। মাথায় পট্টি বাঁধা ডেলহ্যান্টি, ডাক্তার বোনার, ডেল পোমরয়, লেক্স মেসি, ফ্র্যাংক হাইট, সস্ত্রীক আহত এড ব্রনসন-সবাই উপস্থিত। ক্লিফকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠল পোময়। কথা না বাড়িয়ে এবার একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছুনো দরকার! ক্লিফের দিকে ইঙ্গিত করল সে। ওই তো ডেপুটি এসে গেছে! কী করবে ঠিক করলে, ক্লিফ? রেগানকে ছেড়ে দিচ্ছ?
মাথা নাড়ল ক্লিফ।
ওকে জিজ্ঞেস করছ কেন? গলা ছেড়ে চিৎকার করল একজন। স্টোন এখানকার শেরিফ, ফ্যারেল স্রেফ তার ডেপুটি। স্টোন যা বলবে তাই তাকে মানতে হবে।
বক্তার দিকে ঘাড় ফেরাল ক্লিফ, জ্যাক কোল, কালরাতের সাত হামলাকারীর একজন।
আজই কোনও একসময় জাজ কেনেডি আসছে, গলা চড়িয়ে বলল ও। কাল সকাল দশটায় আদালত বসছে, ওখানেই সিদ্ধান্ত হরে।
তার আগেই স্টোন যদি ল্যুককে ছেড়ে দেয়?
ছাড়বে না। দৃষ্টিতে কাঠিন্য ফুটে উঠল ফ্যারেলের। আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি ওকে ছাড়ার সাধ্য নেই কারও।
সময়টা সংক্ষিপ্ত হতে পারে।
ভিড় ঠেলে কোলের দিকে ছুটে গেল ক্লিফ, উল্টোহাতে বিদ্যুৎগতিতে থাবড়া লাগাল তার গালে। ভয় দেখাচ্ছ? ইচ্ছে করলে তোমাকেও আমি জেলে ভরে রাখতে পারি, জানো?
ক্লিফের কাঁধে হাত রেখে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করল পোমরয়। থামো, ক্লিফ। ঝগড়া করে কী লাভ?
সরোষে ঘাড় ফিরিয়ে পোমরয়ের দিকে তাকাল ফ্যারেল। আচ্ছা? তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল ও। রেগানকে জ্যান্ত ফিরিয়ে আনার পর সবাই মিলে আমাকে গালাগালি করলে, ওকে দুবার ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলে, অথচ এখন বলছ ছেড়ে দিতেকের সঙ্গে তোমাদের তফাৎ কোথায়? কিন্তু মনে রেখো, কেউ চাক না চাক রেগানকে আমি আদালতে চালান দেবই। ল্যুক দোষী না নির্দোষ আদালতই স্থির করবে। কিন্তু তোমাদের হাতে যেমন তুলে দিই নি তেমনি বিনাবিচারে ছেড়ে দেয়ারও প্রশ্ন ওঠে না।
আমাদের তাহলে শহর ছেড়ে পালানো ছাড়া উপায় থাকছে না, গম্ভীর কণ্ঠে বলল, কোল, আজই আমরা চলে যাব। রেগানের বিচার করতে জুরী খুঁজে পাবে না তুমি।
বিরক্তিভরে সমবেত জনতার দিকে তাকাল ক্লিফ। এমনিতেও আশা কম। এ শহরে কারও জুরী হবার মতো সাহস আছে বলে আমার মনে হয় না। কথাটা শেষ করেই ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল ক্লিফ, বেরিয়ে এল বাইরে। বারান্দায় আড়ি পেতে ওদের কথা শুনছিল-ম্যাট আর জেস রেগান। ফ্যারেলের দিকে তাকিয়ে বিজয়ীর হাসি হাসল ওরা। বারান্দার খুঁটিতে একটা নোটিস সেঁটে দিয়েছে, মাথা দুলিয়ে সেদিকে ইঙ্গিত করল ম্যাট। নোটিসটা পড়ল ক্লিফ।
নোটিস
রাতে অথবা দিনে শহর ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করলেই
ডিনামাইট ফাটানোর নির্দেশ দেব।
ম্যাট রেগান।
এখনও সময় আছে হার স্বীকার কর, ডেপুটি, বলল ম্যাট। ছেড়ে দাও ওকে। আদতে ও হয়তো নির্দোষ, কাজটা হেলম্যানেরও হতে পারে।
হেলম্যান নয়, ল্যুকই পালিয়ে গিয়েছিল।
আর দোষী হলেই বা কি? মেয়েটাকে তো আর মেরে ফেলে নি?
ক্লিফের অ্যাকশন পুরোপুরি পিলে চমকানো। চোখের পলকে ম্যাটের পেটে একটা ঘুসি বসিয়ে দিল ও। দুর্ভাঁজ হয়ে গেল রেগান, সঙ্গে সঙ্গে ওর নাক বরাবর উঠে এল ক্লিফের হাঁটু। মুখ থুবড়ে পড়ল ম্যাট, গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসছে নাক থেকে।
ম্যাট ধরাশায়ী হওয়ার আগেই পিস্তল বের করে ফেলল ক্লিফ। অস্ত্র উঁচিয়ে হুঙ্কার ছাড়ল, সাবধান! পিস্তলের বাঁট আঁকড়ে ধরে জমাট বেঁধে গেল জেস। ম্যাটকে পেটানোর সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল, ভাবল ক্লিফ, টগবগে ক্রোধ প্রশমিত করার রাস্তা বন্ধ হলো। এখন আর পিস্তল খাপে ভরা যাবে না, প্রথম সুযোগে ওকে খুন করবে জেস। আর অস্ত্র হাতে ম্যাটের সঙ্গে মারপিট সম্ভব নয়।
কোনওমতে উঠে বসল ম্যাট, প্রবল বেগে মাথা নাড়ছে, অঝোর ধারায় রক্ত ঝরছে নাক থেকে। সভা ভেঙে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল সবাই, ভিড় জমাল চারপাশে। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল ডেল পোমরয়। আরে, ওটা কী! খুঁটির সঙ্গে সঁটা নোটিসটা সবাইকে শুনিয়ে পড়ল সে।
ভিড় ঠেলে তার দিকে এগিয়ে গেল ম্যাট রেগান। ল্যুক জেলে না থাকলে এখুনি বোমা ফাটানোর নির্দেশ দিতাম আমি! কর্কশ কণ্ঠে বলল সে। প্রাণ ভরে দেখতাম শহরটার মরণ!
ঠেলাঠেলি করে ক্লিফের কাছে এল পোমরয়। কাজটা ভাল হয় নি, বলল সে। এই পরিস্থিতিতে একটু সামলে চলতে হয়, ওরা খেপে গেলে কী অবস্থা হবে, বলো তো?
জবাব না দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল ক্লিফ, দুপদাপ করে রাস্তায় নামল, পা বাড়াল অফিসের দিকে। পেছনে চিৎকার জুড়ে দিল জনতা। আশ্চর্য মানুষগুলোপ্রতি মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে। এই এক কথা বলছে…পরমুহূর্তে সম্পূর্ণ ভিন্ন সুর বাজছে তাদের কণ্ঠে।
আচ্ছা কী করলে সবদিক রক্ষা হয়? হ্যাঁ, একটা কাজ করা যায়
সম্ভাবনাটা খতিয়ে বিচার করল ফ্যারেল। সোনিকে নিয়ে শহর ছেড়ে ও নিজেই চলে যেতে পারে। তারপর শহরবাসীরাই সিদ্ধান্ত নেবে করণীয় সম্পর্কে…কিন্তু তার অর্থ তো হার মেনে নেয়ামুক্তি দেয়া রেগানকে।
শেষ পর্যন্ত তো খালাস পাবে লোকটা; ম্যাটরা যতক্ষণ ডিনামাইটসহ পাহাড়ে থাকছে, জুরীদের সাহস হবে না ওর বিরুদ্ধে রায় দেয়ারযদি জুরী খুঁজে পাওয়া যায়।
জেলহাউসের সামনের বেঞ্চে এখনও বসে আছে স্টোন। দরজা খোলা, ভেতর থেকে চিৎকার করে কী যেন চাইছে ল্যুক রেগান, কান ঝালাপালা হবার যোগাড়। একটানে দরজাটা আটকে দিল ক্লিফ, চাপা পড়ে গেল আসামীর চিৎকার।
গলা খাঁকারি দিল স্টোন। কাল রাতে আমায় জেলে না পেয়ে কি ভেবেছিলে, পালিয়েছি?
পালাও নি?
হয়তো। অভিযোগ অস্বীকার করতে চাইছে যেন স্টোন। জনতা তোমাদের পরাস্ত করবে ধরে নিয়েছিলাম আমি।
সাহায্য করতে এলে না কেন? কৈফিয়ত তলবের সুরে বলল ক্লিফ।
রেগে গেল স্টোন। তোমাকে তার কৈফিয়ত দিতে হবে! ভুলে যেয়ো না, তুমি আমার ডেপুটি, চাইলে যে কোনও সময় তোমাকে বরখাস্ত করতে পারি!
বেশ তো, করো! শীতল কণ্ঠে বলল ক্লিফ।
দেখো, আমায় খেপিয়ো না! তাহলে সত্যিই বরখাস্ত করতে বাধ্য হব। কালই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি রেগানকে আটক রাখার জন্যে কাউকে হত্যা করা যাবে না। নিজের প্রাণ খোয়ানোর তো প্রশ্নই ওঠে না। আর এটাই যুক্তিসঙ্গত কথা।
রেগানকে দেখলেই বোঝা যায়, লোকটা জন্মপাপী, ওকে ছেড়ে দিলে মহা সর্বনাশ হয়ে যাবে।
ওকে ছেড়ে দিয়ে তারপর প্যসি নিয়ে একসঙ্গে সবগুলোর পিছু নিলেই তো হয়…
তা হয়, বলল ক্লিফ। কিন্তু প্যসিকে ফাঁকি দেয়ার জন্যে ওরা ছয়জন ছুদিকে চলে যাবে, বুঝলে! তখন? বুঝলাম দুএকজনকে ধরলে, তারপর? এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না?
রাস্তার দিকে তাকাল, ফ্যারেল। হোটেলের দিক থেকে একদল লোক আসছে। হঠাৎ আরেকটা জিনিস নজরে এল ওর, ঝট করে উঠে দাঁড়াল। হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে আসছে সোনিয়া।
দ্রুত এগোল ফ্যারেল। ওকে থামানোর চেষ্টা করল জনতা। সবার বাধা উপেক্ষা করে এগিয়ে চলল ও। স্টোনের কাছে যাও, বলল, সে-ই তো শেরিফ।
হাঁটার গতি বাড়াল ক্লিফ, প্রায় ছুটছে, আকুলতা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সোনিয়ার দিকে।
সোনিয়ার সামনে পৌঁছে থমকে দাঁড়াল ও। দুজন মুখোমুখি, নিশ্চপ।
দুঃখ ভারাক্রান্ত সোনিয়ার চেহারা; নিশ্চয়ই প্রচুর কান্নাকাটি করেছে, ফুলে আছে চোখজোড়া। বিবর্ণ ঠোঁট দুটো মৃদু কাঁপছে।
সোনিয়ার কাঁধে হাত রাখল ক্লিফ। ঘুরে হাঁটতে শুরু কলল দুজন, একসঙ্গে সব কোলাহল পেছনে ফেলে শহরের বাইরে চলে এল।
কেমন আছ, সোনি? জিজ্ঞেস করল ক্লিফ।
হাসতে গিয়ে ব্যর্থ হলো মেয়েটা। আরও সামনে এগোল ওরা, একটা কটনউডের ছায়ায় পৌঁছুল। বসো, সোনি। তোমাকে দেখতে যাবার অনেক চেষ্টা করেছি আমি, কিন্তু তোমার মা…
আমি জানি, ক্লিফ।
হয়তো আমার ভুল হয়েছে, কিন্তু যা করেছি ভালো ভেবেই করেছি।
তাও জানি। সেকথা বলব বলেই তো এলাম। লোকটাকে মেরে ফেলার কথা আমি মন থেকে বলি নি।
সব এখনও আগের মতোই আছে, সোনি, বলল ক্লিফ। একদম ভেবো। ঝামেলাটা মিটে যাক, বিয়েটা সেরে চলে যাব আমরা এখান থেকে।
যদি না মেটে?
কেন, কালই রেগানের বিচার হচ্ছে।
কিন্তু সে তো খালাস পেয়ে যাবে। এই অবস্থায় কেউ ওর বিরুদ্ধে আঙুলটিও নাড়বে না।
সেক্ষেত্রে আমি নিজে… থেমে গেল ক্লিফ। পরিস্থিতির জটিল রূপ উপলব্ধি করতে পারছে ও। ফিউজে আগুন জ্বালানোর আগে রেগান ভাইদের পরাস্ত করা অসম্ভব। মনকে চোখ ঠেরে লাভ কী?
সোনিয়ার দিকে তাকাল ও। মেয়েটার সেই চঞ্চল দৃষ্টির কথা মনে পড়ল। রেগান সোনির অসম্মান করেছে, তাকে কী করে ক্ষমা করবে ও? কাল আদালতে কী সিদ্ধান্ত হবে কে জানে। রেগানের নিরপেক্ষ বিচার করার মতো জুরী কি মিলরে? জুরীরা হয়তো বেকসুর খালাস দিয়ে দেবে ল্যুককে…
তাহলে…দাঁতে দাঁত চাপল ক্লিফ, একাই ছভাইয়ের পিছু নেবে ও, খুন করে আসবে ল্যুককে। পারবে? ল্যুক রেগানকে হত্যা করার পর কোন্ দৃষ্টিতে নিজের বিচার করবে ও? কাজটা বেআইনি হয়ে যাবে না? বিচারে খালাস পাওয়ার পর তাকে হত্যা করার যুক্তি কোথায়? আইনের সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলেই আইন ভাঙবে, এই ঠুনকো ওর নীতিবোধ?
এবার যেতে হয়, বলল সোনিয়া, মা চিন্তা করবে।
আচ্ছা, হাত ধরে সোনিয়াকে দাঁড় করাল ক্লিফ। সহসা, ওর বাহু আঁকড়ে ধরল মেয়েটা, কান্নায় ভেঙে পড়ল। নীরবে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করল ক্লিফ।
আবার শহরের দিকে পা বাড়াল ওরা। কিছুতেই পাহাড়ের দিকে, না তাকিয়ে থাকতে পারছে না ক্লিফ।
সত্যিই ওরা ডিনামাইট ফাটাবে? জিজ্ঞেস করল সোনিয়া।
আশঙ্কা আছে।
বিচারের জন্যে লোকটাকে সান্তা রোসায় নিয়ে গেলে কেমন হয়?
মাথা দোলাল ফ্যারেল। কথাটা আগেই ভেবেছে। একা একা ওকে নিয়ে অতদূর যাওয়া যাবে না। কেউ যাতে আমাদের সঙ্গে না যায় ম্যাট তার ব্যবস্থা করবে।
ওরা আজীবন বসে থাকতে পারবে ওখানে?
তা পারবে না। আসলে কি জানো, ডিনামাইট ফাটানোর ওদের ইচ্ছে নেই। কেননা ওরা জানে, শহরের কিছু হলে ওদের মরতে হবে। তবু বলা যায় না, ল্যুকের জন্যে সে ঝুঁকি নিতেও পারে।
শহরে ফিরে এল ওরা।
আমি একাই যেতে পারব, ক্লিফ, বলল সোনিয়া। মায়ের খিটখিটে স্বভাবের কথা তো জানোই।
হাসল ক্লিফ, হ্যাঁ। আবার কবে দেখা হবে?
কাল আদালতে, আমাকে তো সাক্ষী দিতে যেতে হবে, তাই না?
মাথা দোলাল ফ্যারেল। পারবে?
জানি না, চেষ্টা করব।
সোনিয়ার হাতে মৃদু চাপ দিল ক্লিফ। টেইলরদের বাড়ির দিকে রওনা হলো মেয়েটা, ওর গমনপথের দিকে চেয়ে রইল ও সোনি ঘরে ঢোকা পর্যন্ত অপেক্ষা করল, তারপর অফিসের পথ ধরল।
১৫. জেলের ভেতরেই অপেক্ষা করছে জনতা
এখনও জেলের ভেতরেই অপেক্ষা করছে জনতা। জঙ্গী ভাব উধাও হয়েছে ওদের চেহারা থেকে, প্রাণ ভয়ে এতটুকু হয়ে গেছে, নিরাপত্তার আশ্বাস পেতে ছুটে এসেছে এখানে।
দরজা খোলাই ছিল, ভেতরে ঢুকল ক্লিফ ফ্যারেল। কী ব্যাপার?
কী যেন বলছিল ডেল পোমরয়, সে-ই জবাব দিল। একটা সমাধান পথ খুঁজছি আমরা।
সমাধান না ছাই, বাঁকা সুরে বলল ক্লিফ, রেগানকে ছেড়ে দেয়ার ফিকির!
তাতে দোষ কী? বাইবেল অশুদ্ধ হয়ে গেছে? বোমা ফাটলে কেউ যদি না-ও মরে, কত টাকার সম্পদ বিনষ্ট হবে, জানো?
বোমা ফাটবে না, বলেছি তো, বলল ক্লিফ।
এহ্, একেবারে সবজান্তা! তুমি বলার কে? যা বলার শেরিফ বলবে, তুমি, তাঁর ডেপুটি, কথা বলার অধিকার তোমার নেই। বলতে বলতে ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে এল রুফাস মুর, শহরের কামার।
দীর্ঘ বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী রুফাস, পরনে ওভারঅল থাকায় আরও বিশাল লাগছে। ওভারঅলের ভোলা বুকের ফাঁকে চেনো বুকের লোমশ ছাতি উঁকি দিচ্ছে। স্টোনের দিকে ঘাড় ফেরাল সে। জেস চাইলে যে কোন সময় তোমার চাকরি খেতে পারে, তাই না?
পারি কিন্তু খাব না, বলল স্টোন। নিজে রেগানকে ধরে এনেছে ক্লিফ, ওর কাজে অসন্তুষ্ট হওয়ার মতো কিছু ঘটে নি, কোন দোষে চাকরি খেতে যাব? আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করছে ও-সেটাই ওর চাকরি। তাছাড়া একটা কথা তোমরা ভুলে যাচ্ছ কেন? সোনির সঙ্গে ওর বিয়ের কথা পাকাঁপাকি হয়ে আছে, দুর্ঘটনাটা ওর মনেও গভীর ক্ষত জন্ম দিয়েছে।
আচ্ছা! ঠোঁট বাঁকাল রুফাস। ব্যাপারটা আদৌ দুর্ঘটনা কিনা কীভাবে বুঝব? সোনিই লোকটাকে উস্কানি দেয় নি, তার কী প্রমাণ আছে?
প্রথমে কথাটার মানে বুঝতে পারল না ক্লিফ, মুহূর্তের জন্যে হতবাক হয়ে গেল, পাগলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল মুরের ওপর। হিংস্র হয়ে গেল চেহারা, জ্বলে উঠল চোখজোড়া।
ক্লিফের ঘুসিতে নাক থেঁতলে গেল মুরের, হঠাৎ ধাক্কায় আছড়ে পড়ল জনতার ওপর। কয়েকজনকে নিয়ে ধরাশায়ী হলো সে। বাকি সবাই পড়িমরি করে ছুটে গেল দরজার দিকে।
ক্লিফ! চেঁচিয়ে উঠল জেস স্টোন।
শুনল না ক্লিফ। শরীরের সব শক্তি এক করে ঘুসি বসাল রুফাসের ভূঁড়িতে। কক করে উঠল কামার। সময় নষ্ট করল না ফ্যারেল, বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে গেল বা হাত, আরেকটা ঘুসি পড়ল রুফাসের মুখে, থেঁতলে গেল তার ঠোঁটজোড়া।
বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে উঠল রুফাস মুর। ছোট ছোট দু-চোখে ক্রোধের আগুন জ্বলল। দুহাত ছড়িয়ে কুস্তিগীরের মতো সামনে ঝুঁকে পড়ল সে।
রুফাসের মতলব টের পেল ক্লিফওকে জাপটে ধরতে চায় লোকটা, পিষে মারবে।
অফিস কামরা ফাঁকা হয়ে গেছে, স্টোন ছাড়া কেউ নেই। সামনে বাড়ল ক্লিফ, কাঁধের ধাক্কা দিল প্রতিপক্ষকে। কোনও প্রতিক্রিয়াই হলো না, যেন দেয়ালে বাড়ি খেয়েছে ও। কাঁধের হাড় ভেঙে গেছে বলে মনে হলো!
একই কায়দায় আবার রুফাসকে ধাক্কা দিল ক্লিফ। টলতে টলতে গানরাকের ওপর আছড়ে পড়ল লোকটা। সশব্দে মেঝেয় পড়ল সবগুলো আগ্নেয়াস্ত্র। উঠেই ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো তেড়ে এল মুর। শেষ মুহূর্তে বাউলি কেটে সরে গেল ক্লিফ। সোজা ডেস্কের সঙ্গে টক্কর খেলো রুফাস, পিছলে পেছনে চলে গেল টেবিলটা। স্টোনসহ উঠে পড়ল সুইভেল চেয়ার। ঘুরে দাঁড়াল মুর; ঘোলাটে চোখে তাকাল ক্লিফের দিকে।
জীবনে আর কখনও এত খেপে নি ক্লিফ। গলা টিপে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে রুফাসকে। সেরাতেও এমনি খুনের নেশা চেপেছিল। রেগানের মতোই আজ সনিকে অসম্মান করেছে রুফাস। সোনির প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছে ওর কথায়। এর চেয়ে মারাত্মক আর কী হতে পারে?
কিন্তু রুফাস নিশ্চয়ই মন থেকে বলে নি কথাটা! আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে লোকটা, ম্যাটরা সত্যি সত্যি ডিনামাইট ফাটালে ভয়াবহ পাথর-কস নামবে, ঘর বাড়ি মিশে যাবে মাটির সঙ্গে।
ফের এগিয়ে গেল ক্লিফ, চোখ দুটো ছোট হয়ে গেছে, ফাঁক হয়ে থাকা ঠোঁটের ফাঁকে শাদা দুপাটি দাঁত দেখা যাচ্ছে। আচমকা হাঁটু আর কনুই দিয়ে একসঙ্গে রুফাসের গলায় আঘাত হানল ও। বাতাসের জন্যে আঁইটাই শুরু করে দিল লোকটা। কিন্তু এই অবস্থাতেই হঠাৎ ক্লিফকে জাপটে ধরল সে, সাঁড়াশির মতো চেপে বসল তার দুই হাত।
আবার নির্দয়ভাবে হাঁটু চালাল ফ্যারেল। সামান্য কমল কঠিন হাতের চাপ, মুরের হাঁটুর নীচের হাড়ে অবিরাম লাথি মেরে চলল ও।
ইস্পাতের মতো কঠিন দুটো হাতক্রমশ চেপে বসছে বুকের ওপর। রীতিমতো হাঁপাচ্ছে এখন ক্লিফ। ডাক্তার ব্যান্ডেজ করে দেয়ার পর ভাঙা পাঁজরের কথা ভুলে গিয়েছিল ও, এখন আবার সেই ভয়াবহ যন্ত্রণা শুরু হয়েছে, মাথা ঘুরছে।
ডেস্কের দিকে ঘুরল রুফাস মুর। ডেস্কের ধারাল প্রান্তে ক্লিফের পিঠ ঠেকিয়ে চাপ দিতে শুরু করল।
যন্ত্রণায় অচেতন হবার দশা হলো ক্লিফের, ধনুষ্টংকার রোগীর মতো বাঁকা হয়ে গেল শরীর। রুফাসের কবল থেকে রেহাই পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাল। নিষ্ফল। হাত দুটো চাপা পড়ে গেছে বিশাল হাতের নীচে, দুটো পা মুক্ত থাকলেও লাথিতে জোর পাওয়া যাচ্ছে না। মুর ওর মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে চায়, বুঝতে পারছে ক্লিফ, অথর্ব করে দিতে চায় ওকে।
হঠাৎ পিস্তলের বাঁট আঁকড়ে ধরল ক্লিফ, একটানে খাপমুক্ত করল। হ্যামার। পেছনে এনে টিপ দিল ট্রিগারে।
একটু যেন কমল সাঁড়াশি চাপ! দুই পা একসঙ্গে ভঁজ করল ক্লিফ, পরক্ষণে ঝাঁকি খেলো ওর শরীর, ছুটে গেল মুরের লৌহকঠিন বাঁধন, পিছলে ডেস্কের ওপর দিয়ে স্টোনের উল্টানো চেয়ারে গিয়ে পড়ল ও।
ওঠার চেষ্টা করে প্রথমে ব্যর্থ হলে ক্লিফ, অবশেষে চেয়ারে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। মুরের উরুতে লেগেছে গুলি, ক্ষতস্থান থেকে রক্ত বেরোচ্ছে গলগল করে, ভিজে যাচ্ছে প্যান্ট। অবিশ্বাস-ভরা দৃষ্টিতে পায়ের দিকে চেয়ে রয়েছে। রুফাস। ক্লিফের দিকে মুখ তুলে তাকাল সে। তারপরই মাটিতে পড়া অস্ত্রের দিকে ঝাঁপ দিল। একটা ডাবলব্যারেল্ড শটগান তুলে ঘুরে দাঁড়াল।
সাধারণত গুলিভরা অবস্থাতেই গানর্যাকে রাখা হয় অস্ত্রগুলো, তবে এটাতে গুলি নাও থাকতে পারে। কিন্তু ঝুঁকি নেয়ার উপায় নেই। সুইভেল চেয়ারে শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে পিস্তলের হ্যামার পিছিয়ে আনল ক্লিফ।
অস্ত্র ফেলে দাও, মুর! ফাসফেঁসে কণ্ঠে বলল ও, নইলে গুলি করতে বাধ্য হব।
ইতস্তত করল রুফাস মুর, একটু ওপরে উঠল শটগানটা, বেপরোয়া দৃষ্টি ফুটে উঠল চোখে। গুলি করতে যাচ্ছে লোকটা, ভাবল ক্লিফ।
অপ্রত্যাশিতভাবে সহসা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল স্টোন। নীরবতার দেয়ালে কুঠারাঘাত করল শেরিফের কণ্ঠস্বর। ওর কথা তুমি শুনেছ, মুর। শটগান ফেলে দাও। নইলে গুলি করব!
রুফাস মুরের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরল, হাত থেকে খসে পড়ল শটগান।
বেরিয়ে যাও! বলল ক্লিফ, মেঝে নোংরা করে ফেলছ!
ভেজা চুপচুপে প্যান্টের দিকে তাকাল মুর, তারপর পা টেনে টেনে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দোরগোড়ায় থেমে ঘাড় ফিরিয়ে বিষ-মেশানো দৃষ্টিতে ক্লিফের দিকে তাকাল, কী যেন বলতে চাইল, কিন্তু কর্কশ কন্ঠে বাধা দিল ক্লিফ। বাজে কথার খেসারত একবার দিয়েছ, ফের গোলমাল করতে যেয়ো না!
বেরিয়ে গেল রুফাস মুর। পিস্তল হোলস্টারে রাখল ফ্যারেল। ক্লান্ত দেহে সুইভেল চেয়ারটা সোজা করে বসে পড়ল।
অস্ত্রগুলো আবার তুলে রাখল স্টোন।
ধীরে ধীরে শান্ত হলো ক্লিফের উত্তেজিত স্নায়ু। সাহায্যের জন্যে ধন্যবাদ, জেসকে বলল ও।
এবার কী করবে? ঘুরে দাঁড়িয়ে জানতে চাইল স্টোন।
আমাদের সামনে মাত্র দুটো পথ খোলা আছে, বলল ক্লিফ, রেগানকে ছেড়ে দিতে হবে, নয়তো আটকে রেখে আদালতে হাজির করতে হবে।
এই পরিস্থিতিতে আদালতে নিয়ে কী লাভ?
পরিস্থিতি পাল্টাতেও পারে।
কীভাবে? কায়দা মতোই আমাদের পেয়েছে ব্যাটারা।
জানি না, বিরক্তির সঙ্গে বলল ক্লিফ। শুধু জানি, এ অবস্থা চলতে পারে না। হাল ছেড়ে দেয়ার মতো এখনও কিছু ঘটে নি।
আচ্ছা, ল্যুককে না হয় আদালতে দাঁড় করালে, তারপর? সারা শহর চষে বেড়াও তো ওর বিরুদ্ধে রায় দেয়ার মতো বারজন লোক মিলবে না।
এখানে না মিললে স্যান্তা রোসায় যাব!
ব্যঙ্গাত্মক হাসি হাসল স্টোন। কে যাবে? জলজ্যান্ত পাঁচ গুণ্ডার সামনে দিয়ে আমি অন্তত যাব না!
তাহলে আমি একাই যাব। ল্যুককে ওরা কেড়ে নেবার চেষ্টা করলে, স্রেফ ওর মাথায় একটা সীসে ভরে দেব।
খুন হয়ে যাবে।
কাঁধ ঝাঁকাল ক্লিফ। পরোয়া করি না। এমনিতেও ওরা আমাকে খুন করার হুমকি দিয়েছে।
আগে জানলে ল্যুকের টেলিগ্রামটা পাঠাতে দিতাম না।
তার যে আবার পাঁচটি পেয়ারের ভাই থাকতে পারে কে জানত!
যা হোক, শহরবাসী লিঞ্চিংয়ের চিন্তাটা অন্তত বাদ দিয়েছে।
হ্যাঁ। বড় ক্লান্ত বোধ করছে ক্লিফ। প্রচণ্ড চাপের মাঝে কাটাতে হচ্ছে প্রতিটি মুহূর্ত। তার ওপর জনতার রুদ্ররোষের মুখে পড়তে হয়েছে, দু দুবার।
এভাবে আর কদিন চলবে? কী করলে অবসান ঘটবে এই বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির? হঠাৎ সেরাতে সোনির দৌড়ে আসার দৃশ্যটা ফুটে উঠল ওর চোখের সামনে।
মুহূর্তে ফুসে উঠল ক্লিফ ফ্যারেল। রেগানকে উপযুক্ত শাস্তি পেতেই হবে…নতুন করে শপথ নিল ও।
ডিনামাইটের হুমকি না থাকলে দূর করা যায় না?
ম্যাট আর জেসকে জিম্মি করার কথা ভাবল ক্লিফ, ওদের আটক করে দুভাইকে পাহাড় থেকে নেমে আসার নির্দেশ দেয়া যায়
ডেলহ্যান্টির দোকানে ডাকাতির অভিযোগে ম্যাট আর জেসকে গ্রেপ্তার করলে কেমন হয়? ওদের বন্দী করে দুভাইকে বলতে পারি ভাইদের বাঁচাতে চাইলে নেমে আসতে…
শেরিফ মুখ খোলার আগেই জবাবটা জানা হয়ে গেল ওর। ম্যাট আর জেসকে গ্রেপ্তারে ঝুঁকি আছে। ডিনামাইট ফাটানোর জন্যে কীভাবে সঙ্কেত দেবে, ম্যাট, জানা নেই। ধরা পড়ার আগেই নির্দেশ দিয়ে বসতে পারে সে। তাহলে ওর উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। শহরবাসীর জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার ওর নেই। পাহাড় ধসে কমপক্ষে পঞ্চাশজন লোক প্রাণ হারাবে…
তাছাড়া ম্যাট আর জেসকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হলেও, পাহাড়ের ওই দুজন নির্দেশ অমান্য করলে ঠাণ্ডা মাথায় ওদের হত্যা করতে পারবে না ক্লিফরা। কথাটা বুঝতে কষ্ট হবে না কারও।
তাহলে ম্যাটের হুমকির বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ কী হতে পারে? কীভাবে ল্যুকের বিচারের ব্যবস্থা করবে ও?
পাহাড়চূড়ার দুভাইয়ের ওপর চব্বিশ ঘণ্টা নজর রাখার ব্যবস্থা করা যায়, ওরা নামার চেষ্টা করলে…
বিস্ফোরণের নাগালের বাইরে যেতে কমপক্ষে দশপনের মিনিট সময় লাগবে ওদের, এই সময়ের ভেতরই চেষ্টা করলে সরে পড়তে সক্ষম হবে। শহরবাসীরা…
আবার মাথা নাড়ল ক্লিফ। শহরবাসীদের আগেই পালিয়ে যাবে রেগানরা, এখানকার কিছু লোক পিছিয়ে পড়তে বাধ্য…এবং ওরা…
আপনমনে বিড়বিড় করে গাল বকল ও। উভয়সঙ্কট বোধহয় একেই বলে! এই সঙ্কট থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় ল্যুককে ছেড়ে দেয়া। কিন্তু এত সহজে তাকে ছাড়ছে না, এর শেষ দেখে ছাড়বে ও!
১৬. সন্ধ্যার আগেই নগ্ন আতঙ্ক
সন্ধ্যার আগেই নগ্ন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল গ্রে বাট শহরে। বিরান হয়ে গেল পথ ঘাট। দুএকজন রাস্তায় নামছে নেহাত প্রয়োজনবশত, মাটির দিকে চেয়ে হাঁটছে, মাঝে মাঝে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে মূর্তিমান বিভীষিকা আকাশছোঁয়া পাহাড়টার দিকে।
সন্ধ্যা নামল। পাহাড়ের ওপর জ্বলে উঠল অগ্নিকুণ্ড, জানিয়ে দিল রেগানের ভাইয়েরা এখানেও আছে, বহাল রয়েছে তাদের হুমকি। রাত আটটায় পৌঁছুল স্টেজ কোচ, হোটেলের সামনেই থামল। একমাত্র যাত্রীটি নেমে ক্লিফের মুখোমুখি হল।
নবাগতের সঙ্গে করমর্দন করল ক্লিফ ফ্যারেল! হ্যালো, জাজ! তুমি আসায় খুবই খুশি হলাম।
দীর্ঘ একহারা গড়ন জাজ কেনেডির, সত্তরের কাছাকাছি বয়স, চিবুকে কাঁচা-পাকা দাড়ি আর ক্যাভালরি ধাঁচের গোঁফ চেহারায় আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য এনে দিয়েছে। শাদা শার্ট, কালো কোট আর টাই পরেছে ভদ্রলোক, চমকার মানিয়েছে। ড্রাইভারের কাছ থেকে কার্পেট ব্যাগ নিয়ে হোটেলের দিকে পা বাড়াল সে।
হোটেলের জানালা গলে বেরোনো ম্লান আলোয় ক্লিফকে জরিপ করল। জাজ কেনেডি। মারাত্মক কোনও গোলমাল হয়ে গেছে নাকি?
করুণ হাসি হাসল ফ্যারেল। তুলকালাম কাণ্ড বলতে পার, জাজ।
ওপরে এসো, সব খুলে বলো আমাকে। অবশ্যই, কেনেডির সঙ্গে হোটেল ডেস্কে এল ক্লিফ। রেজিস্টার খাতায় নাম লিখিয়ে চাবি গ্রহণ করল জাজ। তারপর দোতালার নির্দিষ্ট কামরায় উঠে এল দুজন আলো জ্বেলে দরজা বন্ধ করল ক্লিফ।
এবার বলল, বলল জাজ।
বলছি, তোমাকে টেলিগ্রাম করার কিছুক্ষণ আগে শহরবাসীরা আসামীকে ছিনিয়ে নিয়ে ফাঁসি দেয়ার চেষ্টা চালিয়েছিল।
কিন্তু এখন দেখছি চারদিক একেবারে শান্ত, তারপর কী ঘটল?
আমাদের প্রতিরোধের মুখে শহরবাসীরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। হয়তো শেষ রক্ষা হত না, কিন্তু হঠাৎ আসামীর পাঁচ ভাই এসে হাজির হলো। ডেলহ্যান্টির দোকান থেকে পাঁচ বাক্স ডিনামাইট ছিনিয়ে নিয়েছে ওরা, তারপর গ্রে বাট-এর চাতালে উঠে বসেছে, হুমকি দিয়েছে ক রেগান, মানে আসামীকে না ছাড়লে পুরো পাহাড় ধসিয়ে দেবে। শহরের লোকজন ভয়ে। সিঁটিয়ে গেছে। আসামীকে ছেড়ে দেয়ার জন্যে চাপ দিচ্ছে এখন।
কিন্তু তুমি ছাড়ো নি?
না।
কেন?
কেন ছাড়ব? ডিনামাইট ফাটানোর হুমকি কিছুতেই বাস্তবায়ন করতে চাইবে না ওরা। অবশ্য এটা ঠিক, কের বিরুদ্ধে রায় দেবার মতো লোক এখন পাওয়া যাবে না এখানে।
মেয়েটা কে?
সোনিয়া।
সোনিয়া ম্যাকনেয়ার? হায় খোদা! তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ক্লিফের দিকে তাকাল কেনেডি। তোমাদের দুজনের না বিয়ের কথা ছিল?
হ্যাঁ, এখনও আছে। ঝামেলাটা চুকে গেলেই…
ল্যুকের বিরুদ্ধে কী কী প্রমাণ আছে?
ঘটনার রাতে মাত্র দুজন আগন্তুক ছিল এখানে-সোনিও বলেছে অপরিচিত লোক আক্রমণ করেছে ওকে-এদের একজন পালানোর চেষ্টা চালায়, অপরজন লিভারি বার্ন-এ ছিল। পলাতক লোকটার পিছু নেই আমি, গ্রেফতার করার সময় সে বাধা দেয়।
মামলা চালানোর জন্যে খুবই দুর্বল প্রমাণ।
তা ঠিক, কিন্তু ল্যকের চোখেমুখে আঁচড়ের দাগ ছিল, আমার ধারণা সোনি ওকে শনাক্ত করতে পারবে।
কীভাবে, তখন অন্ধকার ছিল না?
হ্যাঁ, স্যাটারলিদের পুরোনো বাড়িটায় ঘটেছে ব্যাপারটা।
তাহলে ও শনাক্ত করবে?
আমার মনে হয় পারবে।
আর কোনও প্রমাণ নেই?
ক্লিফ উপলব্ধি করল, ল্যুকের বিরুদ্ধে ওর অভিযোগ কত দুর্বল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে। না, আর কোন প্রমাণ নেই, বলল ও।
তাহলে লোকটাকে ছেড়ে দাও, বলল কেনেডি, এ নিয়ে ওর বিরুদ্ধে কিছু করা যাবে না। কোনও জুরী…
আমাকে একটু সময় দাও, জাজ, হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল ক্লিফ। কাল সকাল দশটার আগেই প্রমাণ যোগাড় করছি…
যাই করো, বুঝেশুনে করো।
আচ্ছা।
তাহলে কাল সকালে দেখা হবে, কেমন?
ঠিক আছে, জাজ।
হোটেল থেকে বেরিয়ে এল ক্লিফ ফ্যারেল। রেগানের বিরুদ্ধে প্রমাণ যোগাড়ের একটা পথই খোলা আছে: ওর স্বীকারোক্তি আদায়।
স্বাভাবিক অবস্থায় কোনওমতেই দোষ স্বীকার করত না রেগান, জানে ও, কিন্তু এটাকে স্বাভাবিক অবস্থা বলা যায় না। রেগান জানে, ডিনামাইটসহ পাহাড়ে অবস্থান নিয়েছে তার ভাইয়েরা; ওকে ছেড়ে দেবার জন্যে শেরিফ আর ডেপুটির ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে শহরবাসী; প্রমাণ মিলুক না মিলুক বেকসুর খালাস পেতে যাচ্ছে সে। সুতরাং, এই সময় রেগানের আত্মবিশ্বাস হবে প্রবল, রূপ হবে উদ্ধত। কোনওভাবে যদি তাকে খেপিয়ে তোলা যায়।
রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করল ক্লিফ। কাল আদালতে রেগান দোষী প্রমাণিত হলেও ডিনামাইটের ভয়ে তাকে খালাস দেবে জুরীরা, প্রয়োজনে জাজ কেনেডির আদেশও তারা অমান্য করবে।
এসব কথা আর ভাবতে চায় না ফ্যারেল। যেভাবে হোক ল্যুক রেগানের বিরুদ্ধে নিরেট প্রমাণ যোগাড় করতে হবে। স্টোনকে বলেছিল ও, পরিস্থিতি বদলাবে, বদলানো প্রয়োজন।
হাঁটার গতি বাড়াল ক্লিফ, বাঁক নিয়ে জ্যাকব ফ্যারেলের বাড়ির পথ ধরল। ওখানে পৌঁছে বাবাকে ওর উদ্দেশ্য জানাল। রেগানের স্বীকারোক্তি আদায় সম্ভব হলে তার জন্যে সাক্ষী লাগবে। বাবা রাজি হলে হেলম্যানসহ চারজন দাঁড়াবে সাক্ষীর সংখ্যা-যথেষ্ট।
রাজি হলো জ্যাকব ফ্যারেল। একসঙ্গে আবার পথে নামল বাপ-বেটা। হাঁপাতে হাঁপাতে ক্লিফের পাশাপাশি এগিয়ে চলল বুড়ো ফ্যারেল।
রেগানরা পাহাড়ে উঠতেই সবার কথার ঢঙ পাল্টে গেছে, না?
হ্যাঁ। ভুরু কুঁচকে ভাবছে ক্লিফ, অপরাধ স্বীকার করাতে কীভাবে খেপানো যায় রেগানকে?
জেলহাউসে পৌঁছে ভেতরে ঢুকল ওরা।
জাজ কেনেডি এসে গেছে, স্টোমকে বলল ক্লিফ।
কাঁধ ঝাঁকাল স্টোন, ডেস্কের ওপর পা তুলে বসে রয়েছে সে।
রেগানের সঙ্গে একটু কথা বলব, বলল ক্লিফ।
যাও!
একটা হারিকেন, তুলে নিয়ে সেলকের দিকে এগিয়ে গেল ক্লিফ, দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে একটু ফাঁক করে রাখল দরজাটা।
বাংকের এক ধারে দুহাতে মাথা রেখে বসে আছে হেলম্যান। নিজের বাংকে শুয়েছিল রেগান, উঠল না, বিদ্রূপ মেশানো দৃষ্টিতে ক্লিফের দিকে তাকাল। আমি তো এখন মুক্ত মানুষ।
এখনও ছাড়া পাও নি।
সত্যি কথাটা মেনে নিচ্ছে না কেন? হেরে গেছ তুমি। আমার ভাইদের বোমা ফাটাতে নিশ্চয়ই বাধ্য করবে না?
তার আগে ওদের জেলে ভরব আমি।
কোন অপরাধে?
সশস্ত্র ডাকাতি, মানহানি, হত্যার অপচেষ্টা-আরও লাগবে?
কী আবোলতাবোল বকছ?
পয়সা দিয়ে ডিনামাইট কেনে, নি তোমার গুণধর ভাইয়েরা, অস্ত্রের মুখে কেড়ে নিয়েছে, আহত করেছে দোকানিকে, সস্ত্রীক এড ব্রনসনকে খুন করতে চেয়েছে!
বিরস হাসি হাসল ল্যুক। ম্যাট বড় ভয়ঙ্কর লোক, কী বলো?
সাহসী-ঐ কথা বলা যায়, তোমার মতো কাপুরুষ নয়। তোমাকে আটকে ভুল হলো কিনা তাই ভাবছি এখন। মনে হচ্ছে হেলম্যানই অপরাধী, তুমি নও।
হঠাৎ একথা মনে হওয়ার কারণ?
কারণ সে তোমার চেয়ে সাহসী। তুমি একটা ভীতুর ডিম, আপাদমস্তক কাপুরুষ, মেয়েমানুষের গায়ে হাত দেয়ার সাহস রাখো কিনা সন্দেহ।
অদৃশ্য হলো রেগানের হাসি। আগে বেরোই, তারপর দেখো সাহস কাকে বলে!
নিতান্ত অবহেলার সঙ্গে ঠোঁট বাঁকাল ক্লিফ।
হঠাৎ ক্রোধে জ্বলে উঠল রেগান, জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ক্রুর হাসি হাসল। ভাবছি তোমাকে খুন না করে যাবার সময় তোমার হবু বউটাকে সঙ্গে নিয়ে যাব, বুঝলে, ডেপুটি?
তবে রে, হারামখোর…! দুহাতে গরাদ ধরল ক্লিফ, রক্ত সরে শাদা হয়ে গেল আঙুলগুলো। পাকস্থলীর ভেতরটা গুলিয়ে উঠল, আর শুনতে পারছে না, কিন্তু সরল না ও, চোখ রাঙিয়ে রেগানের দিকে তাকাল।
হাসল ল্যুক রেগান। হ্যাঁ, সেটাই ভালো হবে, সঙ্গে নিয়ে যাব ওকেএরপর হয়তো স্বেচ্ছায়ই… হঠাৎ থেমে গেল সে।
ক্লিফের অগ্নিদৃষ্টির সামনে ভড়কে গেল, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার ছাড়ল, তোমাকে ভয় পাই ভেবেছ? আমি কাপুরুষ, না? আরে, আমি যদি এইখানে দাঁড়িয়ে বলি, হ্যাঁ, তোমার হবু বউকে বেইজ্জত করেছি, কী করার আছে তোমার? আমাকে স্পর্শ করতে পারবে। তোমার সে সাহস নেই। আমার কিছু হলে এই শহর ধুলোয় মিশে যাবে না!
গরাদের শিক ছাড়ল না ক্লিফ, এখন হাত মুক্ত করলেই পিস্তলের দিকে এগিয়ে যাবে, খুন হয়ে যাবে ল্যুক রেগান। পেছনের মৃদু নড়াচড়ার শব্দে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ও। জ্যাকব ফ্যারেল এসেছে। চট করে ওর হোলস্টার থেকে পিস্তলটা বের করে নিল জ্যাকব। এবার হাত আলগা করতে পারো, বলল সে। নিজের মুখে স্বীকার গেছে রেগান, স্টোন আর আমি শুনেছি, ওই হেলম্যানও শুনেছে-তাই না?
হ্যাঁ, বলল হেলম্যান।
চেঁচিয়ে উঠল ল্যুক। শুনেছে তো হয়েছে কী? কিস্যু করতে পারবে না। কালই ভাইদের সাথে এখান থেকে চলে যাচ্ছি।
কাল পরপারে যাচ্ছ তুমি, একা, বলল ক্লিফ।
ল্যুক রেগান দোষ স্বীকার করেছে কেন, বুঝতে পারছে ও। বিদ্রূপ আর তাচ্ছিল্যে ওর ওপর খেপে গেছে লোকটা, চরমে পৌঁছেছে ক্লিফের প্রতি তার ঘৃণা, ওকে মানসিক আঘাত দিয়ে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে, ফলে মুখ ফস্কে সত্যি কথা বেরিয়ে এসেছে।
হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল ক্লিফ, ছুটে বেরিয়ে এল অন্ধকার রাস্তায়। রেগান দোষী, নিঃসন্দেহ ছিল ও, কিন্তু তার সদম্ভ স্বীকারোক্তি শোনা…
শহরের শেষ প্রান্তে আসার পর হুঁশ হলো ক্লিফের। দাঁড়িয়ে পড়ল, বুক ভরে ঠাণ্ডা বাতাস টেনে নিল। কাঁপা হাতে কাগজ তামাক বের করে সিগারেট বানিয়ে ধরাল, কয়েক টানেই শেষ হয়ে গেল ওটা। সিগারেটের অবশিষ্টাংশ মাটিতে ফেলে গোড়ালি দিয়ে পিষে ভোল।
হঠাৎ একটা জিনিস উপলব্ধি করল ও, এরপর রেগানকে কোনওমতেই রেহাই দেয়া যাবে না। চাপের মুখে যদি ছাড়তে হয়, তাতেই শেষ হবে না ঘটনার, হতে পারে না…পিছু নিয়ে রেগানকে হত্যা করে আসবে…সেজন্যে যদি সারাজীবন লাগে, পরোয়া করে না।
।আঘাতে আঘাতে ওকে জর্জড়িত করেছে রেগান, তবে সেই সঙ্গে নিজেরও সর্বনাশ ডেকে এনেছে।
.
সকাল। সূর্যের প্রথম আলো গ্রে-বাট-এর চূড়া স্পর্শ করল, হামাগুড়ি দিয়ে নেমে এল নীচের ঘুমন্ত শহরের বুকে।
গ্রে বাট-এর চাতাল। একটা খুদে অগ্নিকুণ্ড থেকে ধোয়ার ক্ষীণ রেখা উঠে যাচ্ছে আকাশে। নাশতা তৈরি করছে ল্যুকের দুভাই। ঘুম থেকে জেগে উঠছে নীচের জনপদ, ভীত সন্ত্রস্ত লোকদের রাস্তায় দেখা যাচ্ছে, নগ্ন আতঙ্কভরা চোখে বারবার এদিকে তাকাচ্ছে তারা।
শহরে নির্দিষ্ট আদালত ভবন নেই, তাই ডেলহ্যান্টির দোকানের দোতালার একটা কামরায় বিচারের কাজ হয়ে থাকে। মাসিক দশ ডলারে কামরাটা ডেলহ্যান্টির কাছ থেকে ভাড়া করেছে কাউন্টি কমিটি।
হোটেলে বসে এক কাপ কফি খেয়ে ডেলহ্যান্টির দোকানে এল ক্লিফ, বাইরের সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় উঠে কোর্টরুমের তালা খুলল। গত এক বছরে এইখানে কারও বিচার হয় নি, পুরু ধুলোর আস্তরণ পড়েছে প্রতিটি কোণে।
ঘরটা ভালো করে আঁট দিল ক্লিফ। তারপর একপাশে ঈষৎ উঁচু প্ল্যাটফর্মের সামনে ফোল্ডিং চেয়ার পাতল লাইন করে। একটু আগে ছটা বেজেছে, বিচারের এখনও চার ঘণ্টার মতো দেরি।
ঘর সাফ করে চেয়ার বসাতে ঘণ্টাখানেক লাগল। রাস্তার দিকে জানালাগুলো খুলে দিল ক্লিফ, আলোয় ভেসে গেল পুরো কামরা।
এবার কিছুটা অনিচ্ছার সঙ্গেই নীচে নেমে এল ও, হোটেল থেকে দুই ট্রে নাশতা নিয়ে জেলে ফিরল।
এখন আর কোনওরকম দ্বিধা নেই ওর, কী করতে হবে জানে। ঠিক দশটায় রেগানকে আদালতে হাজির করবে, অভিযোগ দাখিল করবে তার বিরুদ্ধে, যেমন আর দশজন কয়েদীর বেলায় করত। তারপর শহরের নাগরিকরা স্থির করবে রেগান সাজা পাবে না খালাস।
তবে তাকে যদি মুক্তি দেয়া হয়বিবেকের কাছে আর আটকা পড়ে থাকবে না ক্লিফ। মোনিকে অপমান করার কথা স্বীকার গেছে ল্যুক, সে অপরাধী, মরতে তাকে হবেই..ফাঁসিতে কিংবা গুলি খেয়ে। না জেনে নিজের সর্বনাশ ডেকে এনেছে ল্যুক, পাঁচ কেন পঞ্চাশটা ভাই এলেও এখন তাকে বাঁচাতে পারবে না।
ঘুম থেকে উঠেছে জেস স্টোন। দেয়ালে টাঙানো ভাঙা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গালে সাবান লাগাচ্ছে, শেভ করবে। ক্লিফ ঢুকতেই ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। এসেছ? সযত্নে এক গালের দাড়ি কামাল সে, তারপর বলল, এবার হেলম্যানকে ছেড়ে দেয়া যায়, বেচারার যখন কোনও দোষ নেই।
বিচার শেষ হলেই ছেড়ে দেব, সে-ও তো সাক্ষীদের একজন, পালিয়ে গেলে অসুবিধে হবে।
তা ঠিক। দাড়ি কামিয়ে ভোয়ালে টেনে নিয়ে গাল মুছল স্টোন। সাবানগোলা পানি পেছনের উঠোনে ফেলে এল। ডেস্কে বসল নাশতা করতে।
খিদে নেই, তবু জোর করে খেলো ক্লিফ। সেলে গর্বের হাসি হাসছে ল্যুক, মনে পড়লেই পেট উল্টে বমি, আসতে চাইছে।
নাশতা শেষ করার একটু আগে দরজা খুলে ভেতরে এল ম্যাট আর জেস রেগান।
বিজয়ীর ছাপ ম্যাটের চেহারায়। লককে ছেড়ে দিচ্ছ, নাকি বিচার শেষ, হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে আমাদের?
বিচার তো হোক, তারপর দেখা যাবে, বলল স্টোন।
হাসল ম্যাট। সে-ই ভালো। বেকসুর খালাস পেলেই বরং সুবিধে।
কিছু বলল না ক্লিফ। হাসি মুখে ওর দিকে তাকাল ম্যাট। তোমাকে বেশ ঠাণ্ডা মনে হচ্ছে, ডেপুটি? শেষমেশ হার মানলে?
না, এখনও নয়। যাও, ভাগো।
ল্যুককে দেখতে এসেছি, আমাদের সে অধিকার আছে…
উঠে দাঁড়াল ফ্যারেল, মেজাজ তেতে উঠছে। তোমাদের আমি যেতে বলেছি! ল্যুকের সঙ্গে দেখা হবে না। তোমাদের কোনও অধিকার, আমি স্বীকার করি না, এখানে বেআইনি কাজ করেছ তোমরা।
আমাদের আবার গ্রেপ্তার করবে না তো, ডেপুটি?
চলে যাও, নইলে তোমাদের ডিনামাইট ফাটাতে হতে পারে, যেটা আমরা কেউই চাই না!
ভুরু কোঁচকাল ম্যাট রেগান। চলো, জেস, বলল সে, তারপর বেরিয়ে গেল জেল থেকে। নীরবে তাকে অনুসরণ করল জেস রেগান।
১৭. আদালতে ভিড় জমে উঠতে শুরু করল
নটার আগেই আদালতে ভিড় জমে উঠতে শুরু করল লোকজনে গিজগিজ করছে স্যালুন দুটো। রাস্তায় মানুষের ঢল। ডেলহ্যান্টির দোকানের সামনে জটলা করছে একদল লোক, মাঝে মাঝে পালা করে গ্রে বাট আর জেলের দিকে তাকাচ্ছে।
অফিসে অবিরাম পায়চারি করে বেড়াচ্ছে ক্লিফ। সবুট পা জোড়া ডেস্কে তুলে বসে আছে শেরিফ স্টোন, পাইপ ফুকছে। স্টোনের চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই, সে কী ভাবছে। নির্লিপ্ত দেখাচ্ছে তাকে। এভাবেই এতদিন শেরিফের পদ অধিকার করে আছে সে-গুরুতর সঙ্কট মোকাবিলায় অক্ষম, কাউকে বুঝতে দেয় নি।
এই লোক শেষ পর্যন্ত উল্টে যাবেই, ভাবল ক্লিফ, কিন্তু কখন? হয়তো আজই, কোনও এক সঙ্কটজনক মুহূর্তে। একবার যখন পালিয়েছে, আবার না পালানোর কারণ নেই।
সাড়ে নটা।
একজোড়া হাতকড়া নিয়ে সেলরকে ঢুকল ক্লিফ। প্রথমে হেলম্যানের সেলে গেল, ওর বাড়ানো হাতে পরিয়ে দিল একটা। অফিস রুমে চলে যাও, বলল তাকে।
সেল থেকে বেরিয়ে অফিসের দিকে গেল হেলম্যান। সুইভেল চেয়ার ককিয়ে ওঠার শব্দ পেল ক্লিফ, উঠে দাঁড়িয়েছে স্টোন।
রেগানের সেলের তালা খুলল ক্লিফ। এদিকে এসো।
আদেশ পালন করল ল্যুক রেগান।
ঘুরে দাঁড়াও, তারপর হাতদুটো পেছনে নিয়ে এসো।
কিছু একটা বলতে চাইল রেগান, কিন্তু ক্লিফের মুখের দিকে তাকিয়ে দমে গেল। সুবোধ বালকের মতো ঘুরে দাঁড়াল, হাত-দুটো নিয়ে এল পেছনে। হাতকড়া পরিয়ে দিল ক্লিফ। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলে রেখেছে ও। এবার সামনে বাড়ো।
ক্লিফের সঙ্গে অফিস কামরায় এল ল্যুক রেগান। শটগান আর কিছু গুলি ক্লিফকে দিল শেরিফ স্টোন। গুলি ভরে ওটা তৈরি করে নিল ক্লিফ, বাড়তি গুলিগুলো পকেটে রাখা।
হঠাৎ কি ভেবে গানর্যাকের দিকে এগিয়ে গেল ও, একটা রাইফেল নিয়ে গুলি ভরা আছে কিনা দেখল। ডেস্কে এসে ড্রয়ার থেকে গুলি বের করে পকেটে ঢোকাল, শটগানটা ফিরিয়ে দিল স্টোনকে।
মার্কদের কায়দা করার কথা ভেবে থাকলে ভুলে যাও, তুমি—
চোপরাও! ধমকে উঠল ফ্যারেল। রাইফেলের ব্যারেল দুলিয়ে দরজার দিকে ইঙ্গিত করল। বৈরিয়ে এল ল্যুক, তাকে অনুসরণ করল হেলম্যান। ক্লিফও বেরোল। রেগান পালাবে সে আশঙ্কা নেই, তবু সতর্ক থাকা ভালো।
ডেলহ্যান্টির দোকানে পৌঁছুল ওরা।
দোতালায়, ল্যুককে নির্দেশ দিল ফ্যারেল।
লোকজন সরে গিয়ে পথ করে দিল। সিঁড়িতে যারা ছিল, দুড়দাড় করে সরে পড়ল, যেন রেগানের ছোঁয়া লাগলেই ফোস্কা পড়ে যাবে।
দর্শকরা আসন গ্রহণ করতে শুরু করেছে আদালত কামরায়। জাজ কেনেডি এখনও পৌঁছুও নি।
আসামীদের সামনের সারিতে নিয়ে গেল ক্লিফ, ওরা বসলে ঠিক পেছনে বসল ও। দরজায় গিয়ে দাঁড়াল স্টোন, জাজের অপেক্ষায় রইল।
কামরার ভেতর গুঞ্জন, চাপা কণ্ঠে কথা বলছে সবাই। গমগম করছে সারা ঘর।
ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে আপন গতিতে।
হঠাৎ বুঝতে পারল ক্লিফ, হাত দুটো ঘামছে। প্যান্টের পায়ায় হাত মুছল। জড়োসড়ো হয়ে বসেছে হেলম্যান, সামনে তাকিয়ে আছে। শিরদাঁড়া সোজা করে বসেছে ল্যুক, ম্যাট রেগানের, অপেক্ষা করছে।
নটা পঞ্চাশে হাজির হলো ম্যাট আর জেস, সরাসরি ল্যুকের কাছে এগিয়ে এল। মুহূর্তের জন্যে ক্লিফের দিকে তাকাল ম্যাট, তারপর ল্যুকের দিকে চোখ ফেরাল। ভেবো না, ল্যুক, সন্ধ্যার আগেই এখান থেকে চলে যাব আমরা।
ম্যাটের পিছু নিয়ে স্টোনও এসেছে। সামনে চলে যাও, মৃদু কণ্ঠে আদেশ করল সে।
ঘাড় ফিরিয়ে শেরিফের দিকে তাকাল ম্যাট। চলো, জেস, ভাইয়ের উদ্দেশে বলল। সন্তুষ্ট চেহারায় সামনে বাড়ল দুভাই, শেষে দুটো চেয়ারে বসে পড়
এই সময় কামরায় পা রাখল জাজ কেনেডি।
সবাই উঠে দাঁড়াও! বলল স্টোন।
উঠে দাঁড়াল দর্শকরা। ডেস্কের দিকে এগিয়ে গেল কেনেডি, আসন গ্রহণ করল। সঙ্গে আনা কাঠের হাতুড়ির আঘাত করল ডেস্কে।
নীরবতা নামল কামরায়। স্টোনের দিকে ঘাড় ফেরাল কেনেডি। প্রথমে জুরী নির্বাচন পর্ব, পনেরজন লোকের নাম বলো।
একে একে নাম ডাকতে শুরু করল স্টোন। মোট পনেরজন লোক উঠে বিচারকের আসনের বাঁ দিকে সাজানো দুসারি চেয়ারে গিয়ে বসল।
সবার চেহারা জরিপ করল ক্লিফ। ওদের চোখে মুখে অনীহার ছাপ সুস্পষ্ট।
ডেস্কে হাতুড়ি ঠুকল কেনেডি, ফিসফিস গুঞ্জন শুরু হয়েছিল, আবার নীরবতা নামল কামরায়।
নাম বলো, শেরিফ, বলল জাজ, সম্ভাব্য জুরীদলের দিকে তাকাল। নাম ডাকার পর দাঁড়িয়ে আমার প্রশ্নের জবাব দেবে।
পোমরয়, ডাকল শেরিফ।
কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল পোমরয়, অস্বস্তির সঙ্গে, ল্যুক আর ম্যাটের দিকে তাকাল। ক্লিফকে এড়িয়ে গেল তার দৃষ্টি।
তুমি কাউন্টির যোগ্য ভোটার? জিজ্ঞেস করল কেনেডি।
জি।
এই মামলার জুরী হতে তোমার আপত্তি আছে?
মেঝের দিকে চোখ নামাল পোমরয়। আছে, জাজ।
কেন?
আমার রায় নিরপেক্ষ হবে না।
দীর্ঘ সময় পোমরয়ের দিকে চেয়ে রইল জাজ। তার তীব্র দৃষ্টির সামনে মিইয়ে গেল পোমরয়। ঠিক আছে, অবশেষে বলল কেনেডি, পরের জনকে ডাকো, শেরিফ।
ফ্রাঙ্ক হাইট।
দাঁড়াল হাইট। ক্লিফ জানে সে কী বলবে। পোমরয় পথ দেখিয়ে দিয়েছে। এটা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট, এখানে বসে যতই খোঁজাখুঁজি করুক, বারজন কেন, ছজন লোকও জুরী হতে রাজি হবে না।
আর, এই পরিস্থিতিতে জুরী মিললেও নির্দ্বিধায় ল্যুকের পক্ষে রায় দেবে তারা। ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে শয়তানটা।
হুবহু পোমরয়ের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করল ফ্র্যাঙ্ক হাইট।
একের পর এক নাম ডেকে গেল স্টোন, একই জবাব পাওয়া গেল।
গম্ভীর হয়ে উঠল জাজ কেনেডির চেহারা। পনের জনই জুরী হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। দর্শকদের দিকে তাকাল জাজ, অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর বলল, জীবনে বহু জায়গায় বিচার করতে গেছি, কিন্তু ভীতু লোকে ঠাসা এমন শহর আর চোখে পড়ে নি। গুরুতর একটা অপরাধ সংগঠিত হয়েছে এখানে, তোমরা ভালোবাস যাকে, সেই মেয়েটাকে লাঞ্ছিত করেছে এক নরপশু, অথচ তারই বিচারে জুরী হওয়ার মতো একটা লোক পাওয়া যাচ্ছে না, আশ্চর্য!
নীরব দর্শকদের দিকে তাকিয়ে আছে জাজ কেনেডি, সরাসরি তার দিকে তাকানোর সাহস করছে না কেউ।
অপরাধের কাছে নতি স্বীকার করে নিয়েছ তোমরা, আবার বলল জাজ, তোমরাও কি অপরাধী নও? ভারি দীর্ঘশ্বাস ফেলল কেনেডি। এ-ই সব নয়। আসামীর পাঁচ ভাই শহরে আসার আগে তোমরা কয়েকবার জেল ভেঙে নিজ হাতে আইন তুলে নেয়ার চেষ্টা চালিয়েছ, অফিসারদের বাধা দিয়েছ দায়িত্ব পালনে। অপরাধীদের সহায়তা করার অপরাধে তোমাদের সবাইকে অভিযুক্ত করতে পারলে খুশি হতাম, দুর্ভাগ্যবশত তা সম্ভব নয়, একসঙ্গে এত লোকের বিচার করা যায় না। কিন্তু মনে রেখো, তোমরা মানুষ নামের অযোগ্য। আমি সতর্ক করে দিয়ে বলছি, কেউ যদি বিকৃত মনকে তৃপ্ত করতে অসহায় মেয়েটার প্রতি কোনও বাজে মন্তব্য করে মানহানিকর একটা শব্দ উচ্চারণ করে, তাকে যাতে জবাবদিহি করতে হয়, তার ব্যবস্থা আমি করব। ক্রুদ্ধ চেহারায় দর্শকদের দিকে তাকাল সে; তারপর আবার খেই ধরল, সেই সঙ্গে শেরিফ আর ডেপুটিকে আসামীকে স্যান্তা রোসায় নিয়ে যাবার নির্দেশ দিচ্ছি। কাল সকাল ঠিক দশটায় বিচার শুরু হবে। ওখানে আসামীর বিচার করার সাহস রাখে এমন বারজন লোক পাওয়া যাবে আশা করি। আদালত আপাতত মুলতবী ঘোষণা করা হলো।
খট! খট!-হাতুড়ির বাড়ি পড়ল ডেস্কে।
উঠে দাঁড়াল জাজ কেনেডি।
স্টোনও উঠল। সবাই উঠে দাঁড়াও! বলল সে।
একসঙ্গে উঠে দাঁড়াল কামরার প্রতিটি লোক। দরজার দিকে পা বাড়াল জাজ, বেরিয়ে গেল।
ল্যুক রেগানের পিঠে রাইফেলের নল ঠেসে ধরল ক্লিফ ফ্যারেল। ম্যাটের দিকে তাকাল। তুমি শুনে রাখো, আমাকে বাধা দিতে এলেই ট্রিগার টিপে দেব। হয়তো খুন হয়ে যাব কিন্তু ল্যুকও রেহাই পাবে না। আমরা এখান থেকে না বেরোনো পর্যন্ত এক পাও নড়বে না।
সমবেত দর্শকের দিকে তাকাল স্টোন। আসামীকে বাইরে না নেয়া পর্যন্ত যার যার জায়গায় বসে থাকো।
রেগানের পিঠে রাইফেলের খোঁচা দিল ফ্যারেল। ককিয়ে উঠল ল্যুক, উঠে দরজার দিকে এগোল।
আস্তে, বলল ক্লিফ, এমন কিছু করো না যাতে মনে হয় পালানোর তাল করছ।
ঘাড় ফিরিয়ে ক্লিফের দিকে তাকাল ল্যক। খুব ধীরে, সতর্কতার সঙ্গে দরজার দিকে এগিয়ে চলল। ল্যান্ডিংয়ে পৌঁছে নামতে শুরু করল সিঁড়ি বেয়ে।
ল্যুকের পিঠে রাইফেলের মাযল ঠেকিয়ে এক কদম পেছনে রইল ক্লিফ।
রাস্তায় নামল দুজন। একটু দাঁড়াও, বলল ক্লিফ।
থামল রেগান। চট করে একবার চারপাশে নজর ..বোলাল ক্লিফ। ল্যান্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে আদালত কামরার দিকে শটগান বাগিয়ে ধরে রেখেছে স্টোন, পাশে হেলম্যান, আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ল্যুকের দিকে চোখ ফেরাল ও। অবস্থাটা বুঝতে পারছ?
আশপাশে তাকাল ল্যুক, হতাশার ছাপ পড়ল তার চেহারায়। নীরবে ক্লিফের সঙ্গে জেলহাউসে ফিরে এল সে।
হাতকড়া খুলে আবার ওকে সেলে ঢোকাল ক্লিফ। রেগানের চোখে নৈরাশ্যের ছায়া দেখল ও, কাঁদো কাঁদো চেহারা হয়েছে তার।
আমার তামাক দেশলাই ফুরিয়ে গেছে, বলল সে। ইশ, মনে হচ্ছে।
পরে, বলল ক্লিফ। অফিসে ফিরে এল ও। একটু পরে হেলম্যানকে নিয়ে স্টোন পৌঁছুল। হেলম্যানের হাতকড়া খুলে দিল শেরিফ। চাইলে তুমি এখন। যেতে পারো, বলল, তবে আমরা যতক্ষণ স্যান্তা রোসায় না যাচ্ছি, আশপাশে থেকো।
আমি একা চলে গেলে হয় না?
মাথা নাড়ল স্টোন।
তা হলে জেলে থাকাই ভালো, বলল হেলম্যান। আমার কাছে একটা ফুটো পয়সাও নেই।
তোমার ইচ্ছে।
হেলম্যানকে সেলে রেখে এল স্টোন।
কখন রওনা দেবে? জিজ্ঞেস করল ক্লিফ, এখনই গেলে ভালো হত না? নইলে পৌঁছুতে পৌঁছুতে রাত হয়ে যাবে।
পাগল নাকি? বলল স্টোন। রেগানকে নিয়ে স্যান্তা রোসায় যাওয়া অসম্ভব।
তবু চেষ্টা করা উচিত।
আমি যাই ঘোড়ার ব্যবস্থা করি।
জবাব দিল না স্টোন। বাইরে বেরিয়ে এল ফ্যারেল, এগোল লিভারি বার্ন-এর দিকে।
আস্তাবলে পৌঁছে চড়া গলায় নিকোলাসকে ডাকল। একটা স্টল থেকে উঁকি দিল হোলস্টার।
চারটে ঘোড়া, নিকোলাস, তাড়াতাড়ি! বলল ক্লিফ।
ওকে স্যান্তা রোসায় নিয়ে যাচ্ছ?
মাথা দোলাল ক্লিফ।
তোমরা দুজন?
উপায় কী? শহরের লোকেরা জুরী হতেই রাজি হলো না, তারা কি আর সাহায্য করবে?
কিন্তু দুজনে পারবে?
প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল ফ্যারেল। জলদি ঘোড়ার ব্যবস্থা করো, তাড়া দিল
পরপর চারটে ঘোড়া বের করে ওগুলোর পিঠে জিন চাপাতে শুরু করল নিকোলাস। অপেক্ষা করল ক্লিফ। নিকোলাস সত্যি কথা বলেছে। মাত্র দুজনের পক্ষে রেগানকে স্যান্তা রোসায় নিয়ে যাওয়া এক কথায় অসম্ভব।
কিন্তু রেগানকে কোনওমতেই মুক্তি দেয়া যাবে না। এখন দুটো পথ আছে, ল্যুকের সামনে: স্যান্তা রোসায় গিয়ে আদালতে দাঁড়াতে হবে; অথবা মরতে হবে ক্লিফের হাতে।
চারটে ঘোড়া তৈরি করে লাগামগুলো ফ্যারেলের হাতে তুলে দিল নিকোলাস। একটা ঘোড়ার পিঠে উঠে বসল ক্লিফ, অপর তিনটে ঘোড়াসহ
এগোল রাস্তা ধরে। হোটেলের সামনে কিছু লোক জটলা করছে। আবার বারান্দার খুঁটিতে নোটিস সেঁটেছে ম্যাট, পড়ছে সেটা। জেলহাউস পেছনে ফেলে হোটেলের দিকে এগিয়ে গেল ক্লিফ। ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে পড়ল নোটিসটা।
আমার ভাইয়েরা পাহাড়ের ওপর থাকবে, শেরিফ আর ডেপুটি ছাড়া অন্য কেউ ল্যুকের সঙ্গে গেলে ডিনামাইট ফাটিয়ে দেবে।
ম্যাট রেগান।
পাশে দাঁড়িয়েছিল ম্যাট, বিদ্রূপভরা দৃষ্টিতে ক্লিফের দিকে তাকাল। ক্লিফ তাকাল তার দিকে। ওদের পাঁচ-সাত মাইল এগিয়ে যাবার সুযোগ দেবে লোকটা, ভাবল, তারপর নেমে আসতে বলবে দুভাইকে, পাঁচজন একসঙ্গে ছুটে যাবে ল্যুককে উদ্ধার করতে; পাঁচজনের মোকাবেলা করা ওদের সাধ্যে কুলোবে না।
অন্যমনস্কভাবে কাঁধ ঝাঁকাল ক্লিফ, ঘুরে জেলহাউসের পথ ধরল। জেলের সামনে পৌঁছে লাফিয়ে নামল স্যাডল থেকে। ঘোড়াগুলোকে হিচরেইলে বেঁধে ভেতরে ঢুকল।
অফিস কামরায় পা রেখেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো থমকে দাঁড়াল। মুক্ত অবস্থায় কামরার মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে ল্যুক রেগান! সেলের দিকে যাচ্ছে স্টোন।
ক্লিফকে দেখেই গানরাকের দিকে তেড়ে গেল ল্যুক। এক টানে পিস্তল বের করে আনল ফ্যারেল, পিছিয়ে আনল হ্যামার, কঠিন কণ্ঠে নির্দেশ দিল, থামো!
জমে গেল রেগান। স্টোন? একই সুরে আবার বলল ক্লিফ। করেছ কী? জলদি ওর হাতে হাতকড়া পরাও!
ঘুরে দাঁড়াল স্টোন। উদ্যত পিস্তল তার হাতে। ওকে যেতে দাও, ক্লিফ, বলল সে।
না! অবিশ্বাসের সঙ্গে স্টোনের দিকে তাকাল ফ্যারেল। আশ্চর্য! এই খানিক আগে আদালতে এবং এর আগে মুরের সঙ্গে মারপিটের সময় পাশে এসে দাঁড়াল, অথচ এখন একেবারে উল্টো কথা বলছে!
ওকে যেতে দাও, ভারি গলায় বলল স্টোন। নইলে গুলি করব।
করো গুলি, বলল ফ্যারেল। মরার আগে রেগানকে মেরে যাব আমি!।
ক্লিফ…! কাঁদো কাঁদো গলায় উচ্চারণ করল স্টোন, আর কোনও উপায় নেই, বুঝছ না কেন?
পিস্তল রেখে হাতকড়া এনে দাও, বলল ক্লিফ।
ফিরে এল স্টোন, ক্লিফের পায়ের কাছে ছুঁড়ে দিল হাতকড়া। হাত বাড়িয়ে বুকে সাঁটা ব্যাজটা খুলে ফেলল একটানে, ছুঁড়ে দিল একদিকে। জাহান্নামে যাক, আমি আর নেই! এটার জন্যে প্রাণ খোয়ানোর ইচ্ছে নেই আমার।
আবার ক্লিফের দিকে তাকাল সে, তারপর নীরবে বেরিয়ে গেল, হাঁটতে হাঁটতে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল একসময়।
১৮. স্টোনের গমনপথের দিকে
স্টোনের গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইল ক্লিফ, অসন্তোষ চেপে রাখল অনেক কষ্টে। কয়েক মুহূর্ত পর ঘাড় ফিরিয়ে রেগানের দিকে তাকাল ও।
আমি এখন একা, রেগান, বলল, বুঝতে পারছ, মেজাজ খারাপ, উল্টাপাল্টা কিছু করলে একেবারে শেষ হয়ে যাবে! এবার ঘুরে দাঁড়াও!
আদেশ পালন করল ল্যুক রেগান।
হাত পেছনে আনো।
এবারও আপত্তি করল না সে।
সামনে ঝুঁকে মেঝে থেকে হাতকড়া তুলে নিয়ে রেগানের হাতে পরিয়ে দিল ক্লিফ। তারপর বলল, যাও, সেলে ঢোকো।
রেগান সেলে ঢুকলে দরজায় তালা লাগাল ও। ফিরে এল অফিস রুমে। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকাল। বিষণ্ণ চেহারা। কী করবে, বুঝতে পারছে না। একা ওর পক্ষে রোগানকে নিয়ে স্যান্তা রোসায় যাওয়া সম্ভব নয়, আবার কারও সাহায্যও পাওয়া যাবে না। কী করা যায়?
চিন্তাভাবনা করার জন্যে সময় দরকার। কিন্তু ভাবলেই কি পরিস্থিতি পাল্টে যাবে? আবার কোনও উপায় না থেকে পারে? থাকতেই হবে!
ফিরে এসে শেরিফের চেয়ারে বসল ক্লিফ। কাঁপা হাতে সিগারেট বানিয়ে ধরাল। প্রথম থেকে পুরো ব্যাপারটা আবার পর্যালোচনা করে দেখল।
কেন যেন মনে হচ্ছে রেগানকে বাঁচিয়ে রেখে ভুল করেছে ও। এই লোকটাই যত নষ্টের মূল। কিন্তু মেরে ফেললে তার স্বীকারোক্তি পাওয়া যেত না, বিবেকের দংশনে জ্বলতে হত সারা জীবন
কিন্তু রেগানের স্বীকারোক্তি পাওয়ার পরও নীতির প্রশ্নে অবিচল থাকতে গিয়ে প্রাণের ঝুঁকি নিয়েছে ও। স্টোনের মতো দায়িত্ব এড়ানোর কথা মুহূর্তের জন্যেও ঠাই পায় নি ওর মনে। ভেতরে ভেতরে ভীত হয়ে পড়েছে ওজমাট বেঁধে গেছে পাকস্থলীর ভেতরটা। এত তাড়াতাড়ি মরতে চায় না ক্লিফ, ফাঁসির আসামীর মতো ভাবতে চায় না মৃত্যুর কথা।
কাঁধ ঝাঁকাল ফ্যারেল, প্রাণ বাঁচানোর কোনও পথ খোলা নেই। তবে প্রতি মুহূর্তে যদি সতর্ক থাকতে পারে, মরার আগে অন্তত রেগানকে মেরে যেতে পারবে ও।
ক্লান্ত দেহে উঠে দাঁড়াল ক্লিফ। ইতস্তত করে সময় নষ্ট করার মানে হয়। না। একটা দায়িত্ব চেপেছে কাঁধে, পালন করতে হবে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
বাবার কাছে সাহায্য চাওয়ার কথা ভাবল ও, পরক্ষণে নাকচ করে দিল। চিন্তাটা। বাবাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার অধিকার ওর নেই, বহু আগেই চাকরি থেকে অবসর নিয়েছে মানুষটা; এবং এটা তার দায়িত্ব নয়।
দুপুর হয়ে এল প্রায়, এখুনি রওনা না হলে স্যান্তা রোসায় পৌঁছুতে সন্ধ্যা লেগে যাবে। কুঁচকে উঠল ক্লিফের চোখমুখ। দেরি হলেই বা কি? ওদের তো স্যান্তা রোসায় পৌঁছুতে দেয়া হবে না। তবু, যদিও ক্ষীণ, একটা সম্ভাবনা তো আছে!
সেলব্লকে এসে হেলম্যানের সেলের তালা খুলল ক্লিফ। আমি চাই না তোমার বিপদ হোক, বলল ও, তাই ছেড়ে দিচ্ছি। স্যান্তা রোসায় গিয়ে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করো, ঠিক আছে?
হেলম্যানের চেহারায় স্বস্তির ছাপ পড়ল, মাথা দুলিয়ে জবাব দিল সে। ঠিক আছে, মিস্টার ফ্যারেল।
পকেট থেকে দশ ডলারের নোট বের করে হেলম্যানকে দিল ক্লিফ। হোটেলের ভাড়া আর খাওয়ার খরচ, খবরদার, হুইস্কি ছোঁবে না, বুঝেছ?
অবশ্যই, মিস্টার ফ্যারেল।
বাইরে চারটে ঘোড়া আছে, বলল ক্লিফ। একটা নিয়ে যাও। রেগানরা, পাহাড় থেকে নামলে তারপর রওনা দিয়ো, নইলে ব্যাটারা গুলি করে বসতে পারে।
আচ্ছা।
জেল থেকে বেরিয়ে এসে কিছুক্ষণ ফুটপাথ-এ দাঁড়িয়ে থাকল হেলম্যান, হঠাৎ আলোয় চোখ কুঁচকে গেছে। আলো সয়ে আসলে হিচরেইল থেকে একটা ঘোড়া খুলে নিয়ে চেপে বসল স্যাডলে। এগোতে শুরু করল ঘোড়াটা।
মন্থর পায়ে আবার সেলব্লকে এল ক্লিফ। বেরিয়ে যাবার আগে সোনির সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু উপায় নেই। ল্যুক রেগানকে একা রেখে যাওয়ায় ঝুঁকি আছে। এমন কেউ নেই, যাকে রেখে যাওয়া যায়।
পেছনে দরজা খোলার শব্দে ঘুরে দাঁড়াল ক্লিফ। সোনিয়া, ভীত দৃষ্টিতে দেখছে ওকে।
সেলের দরজা সশব্দে আটকে দিয়ে সোনিয়ার দিকে এগিয়ে এল ক্লিফ। চারদিকে চোখ বোলাল সোনি। স্টোন কই? জানতে চাইল।
একটা কাজে বাইরে গেছে, মিথ্যে বলল ক্লিফ, অনর্থক মেয়েটাকে ভাবনায় ফেলে কাজ নেই। স্টোন বিদায় নিয়েছে শুনলে ঘাবড়ে যাবে ও।
রেগানকে সান্তা রোসায় নিচ্ছ?
হ্যাঁ। সোনিয়ার কাঁধে হাত রাখল ক্লিফ। সোনিকে এমন কিছু বলা যাবে যাতে পরিস্থিতির ভয়াবহতা প্রকাশ পায়।
সকালে বাবা মায়ের সঙ্গে যাচ্ছি আমি, বলল সোনিয়া, দশটা নাগাদ পৌঁছে যাব।
সোনিয়ার দিকে তাকিয়ে মাথা দোলাল ক্লিফ। বেশ স্বাভাবিক হয়ে। এসেছে ওর চেহারা। কথা বলার জন্যে মুখ খুলল; কিন্তু বাধা দিল, সোনি।
আর একটা কথা, ক্লিফ, আমার মতে এখন পর্যন্ত কোথাও ভুল করো নি তুমি।
হাসল ক্লিফ। জানতাম, তুমি একথাই বলবে।
এবার যাই, কাল দেখা হবে।
আচ্ছা।
চলে গেল সোনিয়া। জানালার সামনে দাঁড়াল ক্লিফ। হাঁটতে হাঁটতে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল মেয়েটা। হাঁটার ভঙ্গিতে আগের সেই চঞ্চলতা খানিকটা ফিরে এসেছে, ভাবল ও।
স্বস্তির ছাপ পড়ল ক্লিফের চেহারায়। আবার সেলকে ঢুকল ও, তালা খুলল রেগানের সেলের। বেরোও, এখুনি রওনা দেব আমরা। তোমাকে এই প্রথম ও শেষবারের মতো সাবধান করে দিচ্ছি, পালানোর চেষ্টা বা সন্দেহজনক আচরণ করলে সোজা খুন হয়ে যাবে। আমার সান্তা রোসায় পৌঁছুবার আশা, কম, তবে তোমার অবস্থাও বিশেষ সুবিধের নয়। ম্যাটরা হামলা করলে তোমাকে মেরে মরব আমি।
ক্লিফের সতর্কবাণীতে ম্লান হয়ে গেল ল্যুক রেগান, তাচ্ছিল্যের ছাপ উধাও হলো চেহারা থেকে। ম্যাটের সঙ্গে একটা আপোসরফায় পৌঁছুনোর চেষ্টা করো না? অনুনয় করল সে। তুমি মারা যাও, আমরা কেউই চাই না।
হাসল ক্লিফ।
মাথা নাড়ল রেগান, দুচোখে তার স্পষ্ট ভয়।
অফিস কামরায় এনে রেগানকে দাঁড় করাল ক্লিফ। র্যাক থেকে স্টোনের, ডাবল ব্যারেল্ড শটগানটা তুলে নিয়ে লোড করা কিনা দেখল। রিলোড, করার সুযোগ ওকে দেয়া হবে না জেনেও ড্রয়ার থেকে গোটাকতক শেল নিয়ে পকেটে রাখল। দুটো ব্যারেলই লোড় করা, রেগানের উদ্দেশে বলল ও, ফস্কানোর তিলমাত্র সম্ভাবনা নেই, একটা গুলি খেলেই দুটুকরো হয়ে যাবে, মনে রেখো!।
সম্মোহিতের মতো শটগানের দিকে চেয়ে রইল রেগান। জিভ বের করে শুকনো ঠোঁট ভেজাল সে, ঢোক গিলে বলল, তোমাকে মেরে আমাকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবে ওরা, ডেপুটি!
জানি। কিন্তু আমার হাতে না মরলেও শেষ পর্যন্ত ফাঁসিতে তো তোমাকে ঝুলতেই হবে, ভয় কী? দুটোই সমান।
রেগানের ভীত চেহারা দেখে পুলক অনুভব করল ক্লিফ। চলল, ঘোড়ায় চাপো।
এলোমেলো পায়ে জেল থেকে বেরিয়ে এল ল্যুক রেগান, একটা ঘোড়ার পাশে দাঁড়াল। সামনে এসে আবার ওকে হাতকড়া পরাল ক্লিফ। লক স্যাডলে চাপলৈ লাগাম তুলে দিল তার হাতে। তারপর নিজে একটা ঘোড়ায় চেপে বসল, রাস্তার দিকে তাকাল ও।
শহরবাসীরা রাস্তার দুপাশে সার বেঁধে অপেক্ষা করছে, সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ দেখতে এসেছে যেন! থমথমে ভাব চারদিকে। জনতার দৃষ্টি ওঁদের দুজনের ওপর নিবদ্ধ।
সামনে বাড়ো, বলল ক্লিফ ফ্যারেল।
ঘোড়ার পেটে গোড়ালির খোঁচা দিল রেগান।
ক্লিফের কনুইয়ের ভাঁজে ভাবল ব্যারেল শটগানটা দেখে মনে হবে নিতান্ত অবহেলার সঙ্গে ধরে রেখেছে; আদৌ তা নয়, রেগানের পিঠ বরাবর তাক করা রয়েছে ওটা। ওকে ঠেকাতে সরাসরি মাথায় গুলি করতে হবে প্রতিপক্ষকে, সেটা সম্ভব নয়।
ঘাড় ফিরিয়ে গ্রে বাট-এর দিকে তাকাল রেগান। এখনও নামে নি ওরা, বলল।
আমরা বেরোলেই নেমে আসবে।
ওরা দুজনই আছে, লিন্সকে নীচে দেখছি না।
ঝট করে তাকাল ক্লিফ ফ্যারেল। পাহাড়ের নীচে মাত্র দুটো ঘোড়া দেখা যাচ্ছে, লিন্স নেই। ম্যাট জেস আর লিঙ্গের খোঁজে রাস্তায় চোখ বোলাল ও, কেউ নেই। আবার সামনে তাকাল ক্লিফ, প্রতিটি ভবনের ছাদ লক্ষ্য করল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নেই।
শহর ছাড়ার আগেই হামলা চালাবে না তো?-ভাবল ক্লিফ। তাহলে তো ল্যুক মারা গেলে প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে ডিনামাইট ফাটিয়ে দেবে
শয়তানগুলো। উৎকণ্ঠায় ভুগে লাভ নেই, আপনমনে বলল ক্লিফ, যা হবার হবে, উদ্বিগ্ন, হলেই তো পরিস্থিতি বদলাবে না!
জেল ছেড়ে আধ ব্লক দূরে এসে পড়েছে ওরা। হঠাৎ ক্লিফের খেয়াল হলো, উত্তেজনায় দম আটকে রেখেছে, ফোঁস করে এক মুখ বাতাস ছাড়ল।
মস্থর গতিতে গড়িয়ে যাচ্ছে অপেক্ষার মুহূর্তগুলো।
আরও বাড়ল জেলের সঙ্গে দূরত্ব। একটা হ্যামারে চেপে বসেছে ক্লিফের আঙুল।
গুড়ম!
অচিমকা গুলির শব্দে কুঁকড়ে গেল ক্লিফ, নিমেষে পিছিয়ে আনল শটগানের হ্যামার।
রাশ টেনে ঘোড়া থামাল ল্যুক। ক্লিফও থামল, অবাক হয়ে আবিষ্কার করল ওর গায়ে লাগে নি গুলিটা। কে গুলি করল?
পাহাড়ের গায়ে বাড়ি খেয়ে কঁপা প্রতিধ্বনি ফিরে এল। পাহাড় থেকে আসে নি গুলিটা, শহরের ভেতরেই রয়েছে অস্ত্রধারী।
কিন্তু অস্ত্রধারী রেগানদের কেউ নয়, তাহলে ও অক্ষত থাকত না।
কে?
ল্যুকের ওপর নজর রাখার জন্যে দুগজের মতো সামনে এগোল ক্লিফ। হঠাৎ গ্রে বাট-এর দিকে তাকাতেই দেখল লুটিয়ে পড়ছে ঝুঁকের এক ভাই, মার্ক। প্রলম্বিত আর্তনাদ আঘাত করল কানের পর্দায়।
নড়তেও ভুলে গেল চমকিত ক্লিফ। অসহায় চেহারায় লক্ষ্য করল, ডিনামাইটের সলতেয় আগুন ধরাতে সামনে ঝুঁকে পড়েছে জনি রেগান।
আবার গর্জাল অদৃশ্য রাইফেল, আবার কয়েক মুহূর্ত পর প্রতিধ্বনি ভেসে এল।
স্প্রীয়ের মতো সোজা হয়ে গেল জনি, বাঁকাচোরা ভঙ্গিতে পিছিয়ে গিয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল পাথুরে দেয়ালে। আবারও গর্জাল রাইফেলটা। কেউ যেন পেরেক দিয়ে পাহাড়ের সঙ্গে গেঁথে দিল জনিকে। কয়েক মুহূর্তে লেগে রইল সে, তারপর হুড়মুড় করে আছড়ে পড়ল, একদিকে হেলে পড়ল মাথাটা, নড়ল না আর।
বিস্ময়ে থ হয়ে গেছে ফ্যারেল। পাহাড়ের ওই হুমকিতে এত অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল, এখন আর তার অস্তিত্ব নেই বিশ্বাস করতে পারছে না।
হঠাৎ খেয়াল হলো জেল থেকে অনেক দূরে এসে পড়েছে ওরা, এবং লকের আরও তিনটি ভাই এখনও বেঁচে, কাছেপিঠেই আছে তারা!
যেদিকে এগোবে, বিপদ সমান। ল্যুকের দিকে একবার তাকিয়ে রাস্তার এমাথা ওমাথায় চোখ বোলাল ফ্যারেল। কানের কাছে কে যেন বলে উঠল, ছোট! জলদি!
ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছে জনতা, এদিকে ওদিকে ছোটাছুটি করছে সবাই। ধরে নিয়েছে, ডিনামাইটের ফিউজে আগুন লেগেছে, বিস্ফোরণের আগেই পালাতে হবে।
গুলি খাওয়ার আগেই হয়তো ফিউজে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে জনি, হয়তো ধরায় নি, যাই হোক, শহরবাসীর সাহায্য পেতে কিছু সময় লাগবে…ঘণ্টাখানেক পালানো ছাড়া অন্য কিছু ভাববে না কেউ; পরে ডিনামাইট নাঃ ফাটলে যার যার ঘরে ফিরতেও দেখি করবে না।
জেলহাউসকে, এখন হাজার মাইল দূরে বলে মনে হচ্ছে। শটগান উঁচিয়ে ধরল ক্লিফ ফ্যারেল। ফের জেলে চলো, রেগান, বলল ও, প্রার্থনা করো, যেন পথে কোনও বাধা না আসে।
১৯. দিশেহারা চেহারায়
দিশেহারা চেহারায় ঘাড় ফিরিয়ে ক্লিফের দিকে তাকাল ল্যুক। নিজের চোখে আপন দুভাইকে প্রাণ হারাতে দেখে বিমূঢ় হয়ে গেছে।
কই, এগোও! জলদি! ধমকে উঠল ক্লিফ।
হতচকিত রেগান খোঁচা দিল ঘোড়র পেটে। মন্থর গতিতে জেলহাউসের দিকে এগোল দুই অশ্বারোহী।
একচুলও নড়ে নি ক্লিফের শটগান, যেমন ছিল, ল্যুকের পিঠ বরাবর তাক করা এখনও। এদিকে হুলস্থুল পড়ে গেছে রাস্তায়, দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটছে লোকজন, চিৎকার করছে পাল্লা দিয়ে।
কে গুলি ছুঁড়ল?-আবার ভাবল ক্লিফ-বাবা কী? তাই হবে। এরকম ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার দুঃসাহস বাবা ছাড়া কারও হবে না, বেপরোয়া কাজ একমাত্র জ্যাকব ফ্যারেলের পক্ষেই সম্ভব।
জনি রেগান মারা গেছে কতক্ষণ? মনে হচ্ছে, একটি ঘন্টা কেটে গেছে, কিন্তু ক্লিফ জানে, আসলে এক মিনিটও পেরোয় নি।
আরও আধ ব্লক পথ বাকি, বারবার ডানে বামে তাকাচ্ছে রেগান, প্রতিটি দালানের ছাদ আর দোতালার জানালা জরিপ করছে ওর চোখ; ছাইয়ের মতো শাদা হয়ে গেছে চেহারা।
ক্লিফ পরিষ্কার বুঝতে পারছে, ল্যুকের অন্য তিনভাই এখন পথ রোধ করে দাঁড়ালে জেলহাউসে আর পৌঁছুতে হবে না, একা চারশত্রুর মোকাবিলা করা অসম্ভব।
বাবা সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে, সেই আশায় বসে থেকে লাভ নেই। সে কোথায় আছে কে জানে, পাহাড়চূড়ায় দুবৃত্তদের নাগালে পেতে নিশ্চয়ই অনেকটা এগিয়ে যেতে হয়েছে ওকে।
বাট স্যালুন অতিক্রম করল ল্যুক, পেছনে রইল ক্লিফ। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ও। রাস্তায় বেরিয়ে এল ম্যাট, পেছনে জেস আর লিন্স। থামল না ক্লিফ, তাহলে শটগানের আওতার বাইরে চলে যাবে ল্যুক। পেছন থেকে কর্কশ কণ্ঠে খেঁকিয়ে উঠল ম্যাট। আর এক পা-ও এগোবে না বলছি, ডেপুটি!
দাঁড়াও, ল্যুক, বলল ক্লিফ।
দাঁড়িয়ে পড়ল ল্যুকের ঘোড়া। সামনে তাকিয়ে অনড় বসে রইল ক্লিফ, শটগানের ট্রিগারে চেপে বসল তর্জনী। বেকায়দায় পড়ে গেছে ও, এই মুহূর্তে ম্যাট ওর মাথা নিশানা করেছে কিনা কে জানে!
পিস্তল ফেলে দাও, ম্যাট, কণ্ঠ স্বাভাবিক রেখে বলল ক্লিফ, জেস, লিন্স, তোমরাও। আমার শটগান ল্যকের হৃৎপিণ্ডের দিকে চেয়ে আছে, আঙুল ট্রিগারের ওপর, মাথায় গুলি করলেও ল্যুককে বাঁচাতে পারবে না, ঝুঁকি নিতে চাও?
ঝুঁকি? জেলে গেলে এমনিতেও মরতে হবে ওকে!
ঘাড় ফিরিয়ে তাকানোর ইচ্ছেটা অনেক কষ্টে দমন করল ক্লিফ।
আচমকা গুলির শব্দ ভেসে এল পেছন থেকে। সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়ার পেটে গুতে লাগাল ব্যুক, ঝটিতি সরে গেল এক পাশে।
শব্দ শুনেই কুঁকড়ে গিয়েছিল ক্লিফ, গুলি লাগে নি, এখনও অক্ষত আছে বুঝতে পেরে বিমূঢ় হয়ে গেল, কিন্তু দ্রুত সামলে নিয়ে গুলি করল ও।
স্পিনটার লাগল ল্যুক আর তার ঘোড়ার গায়ে, কেঁপে উঠল লোকটা, ঝুঁকে পড়ল সামনের দিকে। প্রাণপণে ছুটতে শুরু করল আহত-ঘোড়াটা।
ফাঁকা গুলি করেছে ম্যাট, বুঝল ফ্যারেল। ঘটনার দ্রুত নিষ্পত্তি চাইছে প্রতিপক্ষ। চট করে ঘোড়ার আড়াল নিয়ে স্যাডল থেকে নেমে পড়ল ও। পরক্ষণে, প্রায় একই সঙ্গে গর্জে উঠল দুটো বন্দুক, ওর ঘোড়ার গায়ে লাগল, একটা বুলেট। সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়া নিয়েই দৌড় দিল ক্লিফ। বেশি দূর এগোতে পারল না জানোয়ারটা, পা ভাজ হয়ে গেল ওটার, লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। পাই করে ঘুরল ফ্যারেল, শটগানের অন্য হ্যামার পেছনে নিয়ে এল।
আবার গুলির শব্দ হলো। লিন্স গুলি করেছে। তারপরই গুলি ছুঁড়ল ম্যাট আর জেস। হঠাৎ কুড়োলের কোপ পড়ল যেন ক্লিফের উরুতে, হাঁটু ভাজ হয়ে গেল। ট্রিগার টিপল ও, প্রচণ্ড গর্জনে চাপা পড়ে গেল চারপাশের কোলাহল।
মাত্র বিশফুট দূরে স্যালুনের দরজার কাছে ছিল লিন্স, সোজা তার বুকে গিয়ে লাগল বাকশট, ঝাঁঝরা হয়ে গেল লোকটা; নিমেষে টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করল পরনের শার্ট, বিকৃত হয়ে গেল চেহারা। গুলির ধাক্কায় এক কদম পিছিয়ে গেল লিন্স, আছড়ে পড়ল স্যালুনের জানালার ওপর, ঝনঝন শব্দে কাঁচ ভাঙল, মাটিতে লুটিয়ে পড়ল একটা নিপ্রাণ দেহ। গুলিশূন্য এখুন ক্লিফের শটগান, শত্রুর মুখোমুখি অসহায়।
ওর শটগানে গুলি নেই প্রতিপক্ষ লক্ষ্য করেছে কিনা কে জানে! মনে মনে গুলি খাওয়ার জন্যে তৈরি হয়ে গেল ও। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ দৌড়তে শুরু করল ম্যাট আর জেস।
স্যাঁৎ করে স্যালুনে ঢুকে পড়ল জেস। দরজা থেকে খানিকটা দূরে ছিল ম্যাট, রাস্তা ধরেই দৌড় দিল সে, স্যালুন আর একটা দালানের মাঝের এক চিলতে ফাঁকা জায়গায় ঢুকে পড়ল।
পরিষ্কার কিছু ভাবতে পারছে না ক্লিফ, সহজাত প্রবৃত্তির বশে কাজ করে যাচ্ছে। শটগানটা আবার লোড করে স্যালুনের দিকে দৌড়ে গেল, ও। এক ধাক্কায় দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল, চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে পড়তে গিয়েও সামলে নিল। উরুর ক্ষত থেকে রক্ত বেরিয়ে প্যান্ট ভিজে গেছে, টের পাচ্ছে, ভেজা প্যান্ট লেপ্টে গেছে চামড়ার সঙ্গে।
বারের কাছে পৌঁছে গেছে জেস, শটগান তাক করল ক্লিফ; কিন্তু গুলি করার আগেই ঝুপ করে বসে পড়ল লোকটা। স্যালুনের সবাই পাগলের মতো ছুটল দরজার দিকে। বারের শেষ প্রান্তের দিকে এগিয়ে গেল ক্লিফ। পা দুটো আর চলছে না। ও বারের কিনারে পৌঁছুতেই ঝট করে উঠে দাঁড়াল জেস, ট্রিগার টিপল পিস্তলের।
এবার আর ভুল হলো না ক্লিফের, ডান হ্যামার পিছিয়ে আনল, টিপ দিল ট্রিগারে। ফলাফল ভয়াবহ, বারের পেছনে লাগানো আয়না, তাকে সাজানো বোতল, উধাও হলো এক লহমায়, যেন ঝড় বয়ে গেছে। আক্ষরিক অর্থে দুটুকরো হয়ে গেল জেস। ভয়ঙ্কর একটা গর্ত সৃষ্টি হয়েছে তার পেটে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে। নিঃসাড় জেসের দেই, কাঁচের ভাঙা টুকরো ঝরে পড়ছে। তার ওপর।
ঘুরে দাঁড়াল ক্লিফ, পা টেনে দরজার দিকে এগোল, বেরিয়ে এল রাস্তায়। ক্রোধে জ্বলছে দুচোখ। মাথার টুপিটা কখন পড়ে গেছে জানে না। ম্যাটের খোঁজে ডানে বামে তাকাল ও।
স্যালুনের পাশের গলিটার দিকে ইঙ্গিত করল এক লোক। চট করে সেদিকে ছুটে গেল ক্লিফ। আহত পায়ে আর কতক্ষণ সোজা থাকতে পারবে? মাথাটা এখনও ঠিকমতো কাজ করছে না। তবে এটুকু বুঝতে পারছে, অজ্ঞান হবার আগেই শেষ করতে হবে ম্যাটকে।
খাঁ খাঁ করছে গলিপথ। খুঁড়িয়ে এগিয়ে চলল ফ্যারেল, অন্য দিকে খোলা জায়গায় বেরিয়ে এল। আচমকা হোঁচট খেলো আবর্জনার স্তূপে, হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
একই সময়ে ডান দিক থেকে ভেসে এল বন্দুকের কানফাটা গর্জন। ক্লিফের পেছনে, স্যালুনের দেয়ালে খাবলা বসাল বুলেট। আবার গুলির শব্দ হলো। গড়ান দিয়ে সরে যেতে শুরু করল ক্লিফ। আর একটা গুলি অবশিষ্ট আছে, ভাবল। কোমরে ঝোলানো গুলি ভরা পিস্তলের কথা মনে পড়ল হঠাৎ, উত্তেজনায় ভুলে গিয়েছিল, হাত বাড়াল ও-নেই, স্যালুনের সামনে ঘোড়া থেকে নামার সময় পড়ে গেছে হয়তো।
গড়ান দেয়ার সময় ম্যাটকে দেখেছে ও, একটা ভাঙা দেয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে, মাথা আর বুকের উর্ধ্বাংশ নজরে আসছে কেবল। ক্লিফের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, তার হাতের পিস্তল। শোয়া অবস্থাতেই শটগান তুলে ধরল ক্লিফ, ওর দৃষ্টি ম্যাটের পিস্তলের মাযুল দেখছে, পেছনে ম্যাটের হিংস্র চেহারা।
এখুনি গুলি করবে ম্যাট…মনে মনে মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হলো ক্লিফ।
আচমকা কেঁপে উঠল ম্যাট, পাঁই করে ঘুরল, এক পাক, নেমে গেল পিস্তলের নলটা, খেঁকিয়ে উঠল। পরক্ষণে কানের পর্দায় আঘাত করল অদৃশ্য সেই রাইফেলের প্রচণ্ড গর্জন।
ম্যাটকে দেখা যাচ্ছে না আর, শুধু দেয়ালটা দেখা যাচ্ছে। গুলির শব্দ অনুসরণ করে তাকাল ক্লিফ। কাছের একটা দালানের ছাদে রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে আছে জ্যাকব ফ্যারেল।
চট করে উঠে দাঁড়াল ও, দেয়ালের দিকে এগিয়ে গেল। উঁকি দিতেই ম্যাটের নিথর দেহ চোখে পড়ল।
শটগানের হ্যামার আগের জায়গায় ফিরিয়ে/আনল ক্লিফ, তারপর ধীরে ধীরে বড় রাস্তার দিকে এগোল, একটা কাজ বাকি রয়ে গেছে
বড় রাস্তায় পৌঁছে পিস্তলটা খুঁজে পেল, হোলস্টারে রাখল ওটা। খুঁড়িয়ে জেলহাউসের সামনে এল ও। একটা ঘোড়া এখনও আছে। রেইল থেকে লাগাম খুলে স্যাডলে চেপে বসল। এখন শুধু ল্যুক বেঁচে আছে, ওকেই দরকার।
কোথায় যেতে পারে সে? পাঁচ পাঁচটি ভাইয়ের মৃত্যুতে দিশেহারা ফেরারী ল্যুক কোন দিকে যাবে? সোজা সেই মরুভুমিতে?-নাহ। গ্রে বাট-এর দিকে দৃষ্টি গেল ফ্যারেলের। ঢাল বেয়ে উঠে যাচ্ছে ল্যুক। তার মানে ডিনামাইটের ফিউজে আগুন ধরাতে যাচ্ছে। ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নেবে!
জ্যাকব ফারেলের খোঁজে সেই দালানটা ছাদের দিকে তাকাল ক্লিফ। রেগানের দিকে নিবদ্ধ বাবার দৃষ্টি, কিন্তু তাকে রাইফেল তাক করতে দেখা গেল না। ল্যুককে ঠেকানো না গেলে বাবা গুলি করবে নিঃসন্দেহে, ডিনামাইটের সলতেয় আগুন দেবার আগেই। কিন্তু ল্যুককে যে ওর জ্যান্ত প্রয়োজন, গ্রে বাট-এ তার বিচার হবে, তারপর সে ফাঁসিতে ঝুলবে।
ঘোড়ার পেটে সজোরে খোঁচা দিল ক্লিফ! ঝড়ের গতি পেল ওটা। ঢালের শেষ মাথায় পৌঁছে গেছে ল্যুক রেগান, এই সময় পাহাড়ের ঘোড়ায় এসে থামল ও।
ল্যুক! চিৎকার করে ডাকল, রেগান! শোনো! আমার বাবার রাইফেল তোমার দিকে চেয়ে আছে, চাতালে ওঠার চেষ্টা করলে মারা পড়বে!
ফিরেও তাকাল না ল্যুক। এদিকে ভার হয়ে আসছে ক্লিফের মাথা, দুর্বলতা গ্রাস করে নিচ্ছে ওকে প্রতি মুহূর্তে…সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত…কিছু একটা করা দরকার!
হঠাৎ মনে পড়ল কথাটাসাধারণ ব্যাপারটা এতক্ষণ মনে ছিল না!
ল্যুক! আবার চিৎকার করল ক্লিফ। ফিউজে আগুন জ্বালাবে কীভাবে? দেশলাই কোথায়? একটু আগে কোর্ট থেকে জেলে ফিরে আমার কাছে তামাক ম্যাচ চেয়েছিলে, মনে নেই?
কড়া লাগানো হাতে উদ্ভ্রান্তের মতো পকেট হাতড়াল ল্যুক। অবশেষে হতাশায় ঝুলে পড়ল ওর কাধ, ঘোড়া ঘুরিয়ে নেমে আসতে শুরু করল। অপেক্ষা করল ক্লিফ। ল্যুক কাছে এলে এক পাশে সরে ওকে পথ করে দিল। এক সঙ্গে জেলে ফি ওঁরা। স্যাডল থেকে নেমে ল্যুককে নিয়ে ভেতরে ঢুকল ক্লিফ। ওকে সেলে রেখে তালা দিল দরজায়।
অবশেষে সমাধান হলো সব সঙ্কটের, ভাবল ও জেলে আটক রয়েছে ত্মক রেগান, ওর ভাইয়েরা মারা যাওয়ায় অবসান হয়েছে অবরোধের, শহরের নিরাপত্তা ফিরে এসেছে। এবার নির্বিঘ্নে বিচার হবে আসামীর, আগেই স্বীকারোক্তি দিয়েছে সে, আদালতের রায় তার বিরুদ্ধে যাবে.নিঃসন্দেহে।
অফিস কামরায় ফিরে শেরিফের সুইভেল চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল ক্লিফ। অবসাদে চোখ বুজল।
Leave a Reply