অপ্রাপণীয়া (উপন্যাস) – কোয়েল তালুকদার
ভূমিকা — অপ্রাপণীয়া
অপ্রাপণীয়া’ উপন্যাসটি লেখা অদ্যই শেষ করলাম। আমার জন্য এই কাজটি ছিল একটি মহাযজ্ঞের মতো।
আমি ছিলাম কবিতার মানুষ। ইউনিভার্সিটিতে পড়বার সময় রাত জেগে কবিতা লিখেছি অনেক। উদ্দেশ্য একটাই, মেয়েদের মন ভোলানো। আর তখন ছিল কবিতার কাল। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, মহাদেব সাহা, শহীদ কাদরীদের তখন জয় জয়কার। তারা একএকজন মস্ত বড়ো কবি। আমিও কবি হবো। তাই আমিও লিখতাম। কিন্তু লিখতে লিখতে কবিতাকে দিলাম ছুটি। প্রকৃত কবিরা কখনও কবিতাকে ছুটি দিতে পারে না। কিন্তু আমি দিতে পেরেছিলাম, কারণ আমি কখনোই প্রকৃত কবি ছিলাম না।
এই ফেসবুকের যুগে এসে নিজের টাইম লাইনে ছোট ছোট কিছু স্টাটাস দিতে শুরু করলাম। আমাদের চলনবিলের কাদাতে লুকিয়ে থাকা মুক্তার মতো কাদা জড়ানো লেখা। দেখলাম, বন্ধুরা বেশ পছন্দই করছে। ছোট ছোট লেখাগুলোই মাঝেমাঝে অনু গল্পের আকার ধারণ করল। পোস্ট দিতে থাকি অণুগল্প। দেখলাম আমার বন্ধুরা অণুগল্প গুলো পছন্দ করছে। কেউ কেউ আবার মন্তব্য করছে — আহা ! আর একটু বড়ো করলে কী হতো! পড়তে না পড়তেই শেষ হয়ে গেল। তাদের এই অতৃপ্তি দেখে আমারও মন খারাপ হলো। কী করব? অনুগল্প গুলো একটু বড়ো করে লিখতে লাগলাম। মানে ছোট গল্প লেখা শুরু করলাম।
এখানেও বিপত্তি। রবি ঠাকুর আগেই হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়ে গিয়েছিল, সে বলেছিল — ছোট গল্প শেষ হয়েও হয় না শেষ। অনেক বন্ধু বলা শুরু করল, তোমার গল্প অতৃপ্তিতে ভরা। উপন্যাস লেখো তুমি। কী করব, পাঠকরা দায় দিল আমাকে। আর, সবচেয়ে বড়ো দায়ে ফেলালো আমার প্রকাশক বন্ধু আফজালুল বাসার। গত এক বছর ধরে আমাকে কেবল বলেই যাচ্ছে — তুমি উপন্যাস লিখো।
জীবনে উপন্যাস পড়েছি অনেক। কিন্তু উপন্যাস কী ভাবে লেখে জানতাম না। লকডাউন কালে আবার নতুন করে কিছু উপন্যাস পড়তে শুরু করলাম । পড়ার সময় খেয়াল করি — কী ভাবে ওরা উপন্যাস লিখেছে। যে উপন্যাসগুলো আবার পড়ি সেগুলো
হচ্ছে — বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালি, অপরাজিত, তারাশঙ্করের কবি, কালিন্দী, বুদ্ধদেব গুহর মাধুকরী, কুর্চিবনের গান, রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা, গোরা, সমরেশম জুমদারের কালবেলা, কালপুরুষ, সুনীলের প্রথম আলো, হুমায়ুন আহমেদের নন্দিত নরকে, নবনী, কবি, আমার আছে জল, জহীর রায়হানের শেষ বিকালের মেয়ে, মাহমুদুল হকের জীবন আমার বোন, সেলিনা হোসেনের হাঙর নদী গ্রেনেড।
এগুলো পড়ে একদিন পরম করুণাময় আল্লাহ তায়লার নাম নিয়ে উপন্যাস লিখতে বসলাম’। কিন্তু শুরুতেই একটা অবাক কান্ড ঘটালাম তাহলো উপন্যাস লেখার আগেই উপন্যাসের নাম দিয়ে ফেললাম — ‘অপ্রাপণীয়া’। আর এই নামেই এগুতে থাকে উপন্যাসের আখ্যান ও কাহিনি।
উপন্যাসের আখ্যান — গ্রাম ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া এক তরুণের জীবন আলেখ্য।
“আর কী কখনও দেখা হবে প্রিয় এই মানুষগুলোর সাথে। জানে না সে কোথায় যাচ্ছে, বিদেশ বিভূঁইয়ে কোথায় কোন ছন্নছাড়া ছিন্ন জীবনে এ জীবন কাটবে। যে জীবনই পাওয়া হোক, তাও একদিন শেষ হয়ে যাবে। কেউ জানবে না সে কেমন আছে, কোথায় আছে।
‘ অনন্ত অজানা দেশ , নিতান্ত যে একা তুমি , পথ কোথা পাবে ! হায় , কোথা যাবে ! কঠিন বিপুল এ জগৎ , খুঁজে নেয় যে যাহার পথ। স্নেহের পুতলি তুমি সহসা অসীমে গিয়ে কার মুখে চাবে । হায় , কোথা যাবে !….
যাবে যদি , যাও যাও , অশ্রু তব মুছে যাও , এইখানে দুঃখ রেখে যাও।’
উপন্যাসের একটু চুম্বকাংশ —
‘… পিচঢালা পথ ধরে রিকশাটি চলতে থাকে সম্মূখপানে। পিছনে পড়ে থাকে — তার দূরন্ত শৈশব, মাটির সোঁদা গন্ধ, মৃত্তিকার নীচে আপন মৃত মানুষের করোটি, বাতাসে রোহিনীর কান্নার ধবনি, মেঘের আড়ালে দীপ্যমান দুঃখিনী মায়ের মুখচ্ছবি। আর যে থাকল সে দুজন হতভাগ্য মানুষের অবিচ্ছেদ্য রক্ত মাংসের তৈরি পিতৃ মাতৃহীন একটি মেয়ে ।
উপেক্ষিতা হয়ে আরও একজন থেকে গেল। সে অপার্থিব। দূরালোকে সে চলে গেছে। কেউ জানে না, রোহিত কুমার সেনের সে কী ছিল ? যাকে পায়নি সে এই জীবন কালে। সে যে জনম জনম প্রবঞ্চিতা, সে যে অপ্রাপণীয়া….. ‘।
কোয়েল তালুকদার
দক্ষিণখান, ঢাকা।
তারিখ — ৪ আগস্ট, ২০২০ ইং
.
অপ্রাপণীয়া
০১.
এই আখ্যানের ঘটনাকাল ইং ১৯৬৭ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত।
আখ্যানের মূল চরিত্র শ্রী রোহিত কুমাার সেন প্রায় তেত্রিশ বছর পর নিজ জন্মভূমি বাংলাদেশে আসছেন। উনি এদেশ ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন অনেক বছর আগে কার্তিকের এক অমানিশা রাত্রির অন্ধকারে । সময়টা ছিল ১৯৬৭ ইং সাল।
সেদিন সন্ধ্যা রাত্রিতে একটি ছোট্ট বালক একটি চিরকুট এনে রোহিতকে দিয়েছিল। কাঁপা কাঁপা মেয়েলি হাতে সেই চিরকূটে লেখা ছিল —
‘ আমি নজরবন্দী হয়ে আছি। বের হতে পারছি না। তুমি আর একটা মূহুর্ত দেরি না করে এই গ্রাম ছেড়ে আজই চলে যাও। তোমার জীবন নাশ হবে।তোমাকে আজ রাতেই মেরে ফেলবে। ওরা সব পরিকল্পনা সম্পন্ন করে রেখেছে। আমি সব শুনেছি।
জানিনা এ জীবনে আর কোনোদিন তোমার সাথে আমার দেখা হবে কিনা। যেখানেই যাও যতদূরে যাও, ভুলবে না আমাকে। এই অভাগীকে তুমি মনে রেখ।’
রোহিত হয়ত সাহস করে, জেদ করে গ্রামে থেকে যেতে পারত। কিন্তু থাকেনি। জলের ভিতর কুমিরের সাথে বসবাস বেশি দিন করা যায় না। বিপদ এক সময় না একসময় চলে আসবেই। সেদিন সেই সন্ধ্যা রাত্রিতে কাউকে কিছু না বলে, এমনকি বৃদ্ধ বাবা মা, বড়ো দা এবং ছোট বোন রোহিনীকে কিছু না জানিয়ে সে গৃহ ত্যাগ করে। এক অনিশ্চিত অজানার উদ্দেশ্যে গ্রাম ছেড়ে সে বেরিয়ে পড়ে।
কার্তিক মাসের অমাবস্যার সেই রাতে রোহিত যখন হরিনা গোপাল গ্রাম থেকে শ্লথ পায়ে হেঁটে হেঁটে চলে আসছিল, তখন আঁধার ভেদ করে সে পিছনে চেয়ে দেখছিল তার শৈশবের পাখি ডাকা, ছায়া ঢাকা গ্রামকে। সে দেখতে পায় দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে পাকুড় , জারুল, দেবদারু ও আমগাছ গুলো। আকাশের দিকে চেয়ে দেখে
দূরে বিষণ্ণ হয়ে অনুজ্জ্বল সব তারা মিটিমিটি করে জ্বলছে।
রোহিত মেঠো পথ ধরে হেঁটে হেঁটে প্রায় সাত মাইল দূরে বয়রা ঘাটে চলে আসে। তার পকেটে ছিল তাদের মনোহারি দোকানের সওদা বিক্রি করা আশি টাকা। আর ছোট্ট টিনের স্যুটকেসের ভিতর ছিল একটি সার্ট, একটি পায়জামা, দুটি লুঙ্গি, একটি গামছা, একটি চিরুনি, ছোট্ট একটি গোল আয়না ও খুটিনাটি কিছু দ্রব্য। আর ছিল কিছু কাগজপত্র, খাতা ও একটি কলম।
বয়রা ঘাটে যখন সে পৌঁছে তখন রাত প্রায় সাড়ে
বারোটা বেজে যায়। পথে হেঁটে আসতে আসতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। খুব খিদাও লেগেছিল তার। ঘাটে একটি ভাঙা টিনের চালার হোটেলে ঢুকে সে আলু ভর্তা আর ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে নেয়।
ওপারে জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে যাওয়ার জন্য রাতে কোনো স্টীমার নেই । পরের দিন সকাল সাতটায় স্টীমার আসবে। সে ঘাটে নোঙর করা ভাসমান প্লাটফর্মের একটি খালি বেঞ্চের উপর যেয়ে বসে পড়ে। উত্তাল নদীর জল বয়ে চলেছে ছলাৎছলাৎ শব্দ করে। নদীর আকাশ জুড়ে অন্ধকার রাত্রি। রোহিত তাকিয়ে ছিল জলের দিকে। তার মনে পড়ছিল কত কথা। মনে পড়ছিল বৃদ্ধ বাবার কথা, অসুস্থ মায়ের কথা, দাদা ভাইয়ের কথা, স্নেহময়ী ছোট বোনটার কথা। আর মনে পড়ছিল আর একজনের কথা, যার কারণে তার এই গৃহ ত্যাগ, যার জন্য তার এই অজ্ঞাত যাত্রা ।
আর কী কখনও দেখা হবে প্রিয় এই মানুষগুলোর সাথে। বিদেশ বিভূঁইয়ে কোথায় কোন ছন্নছাড়া ছিন্ন জীবনে এ জীবন কাটবে, তা সে কিছুই জানে না। যে জীবনই পাওয়া হোক, তাও একদিন শেষ হয়ে যাবে। কেউ জানবে না সে কোথায় আছে, কেমন আছে।
‘ অনন্ত অজানা দেশ , নিতান্ত যে একা তুমি , পথ কোথা পাবে ! হায় , কোথা যাবে ! কঠিন বিপুল এ জগৎ , খুঁজে নেয় যে যাহার পথ। স্নেহের পুতলি তুমি সহসা অসীমে গিয়ে কার মুখে চাবে । হায় , কোথা যাবে !….
যাবে যদি , যাও যাও , অশ্রু তব মুছে যাও , এইখানে দুঃখ রেখে যাও।’
রোহিত বাগবাটি হাই স্কুল থেকে বিজ্ঞানে ম্যাট্রিক পাশ করে টাংগাইলের করটিয়া কলেজ থেকে বিএসসি পাস করে গ্রামে ফিরে এসেছিল । সে কোনো একটি স্কুলে অংকের শিক্ষকের চাকুরি করবে এই তার ইচ্ছা ছিল।
একদিন গুরিগুরি বৃষ্টির দিনে তাদেরই গ্রামের হাসান আলী মাস্টার ছাতা মাথায় দিয়ে স্কুলে যাচ্ছিল। পথে দেখা হয় রোহিতের সাথে। রোহিত আসছিল কুড়াগাছা হাটখোলা থেকে। রোহিত হাসান আলী মাস্টারের ছাত্র ছিল। হাসান আলী জানত রোহিত খুব মেধাবী ছাত্র ছিল। এবং সে ছিল সরল, অমায়িক ও ভদ্র একটি ছেলে।
পথের মধ্যে দাঁড়িয়ে হাসান আলী মাস্টার রোহিতকে বলে — ‘ তুমি কী মাঝে মাঝে বাড়িতে এসে আমাদের রেবেকাকে একটু অংক দেখিয়ে দিয়ে যেতে পারবে? এজন্য তুমি অবশ্য মাহিনা পাবে। তুমি হয়ত জানো — রেবেকা এখন নবম ক্লাসে পড়ে।
রোহিত হাসান আলী মাস্টারের প্রস্তাব ফেলতে পারেনি। সে বলেছিল — আচ্ছা, আসব ওকে পড়াতে।
রোহিত বেশির ভাগ সময় বিকালবেলা রেবেকাকে পড়াতে আসত। বাড়ির খোলা বারান্দায় এক কোণে চেয়ার টেবিল পাতা থাকত। সেই টেবিলে বসে মোটামুটি সবার নজরের সামনে রোহিত প্রতিদিনের অংকগুলো রেবেকাকে দেখিয়ে এবং বুঝিয়ে দিয়ে যেত।
রোহিতের কাছে রেবেকা প্রাইভেট পড়ে ভালোই রেজাল্ট করছিল। আগে ক্লাসে অংক ও এ্যালজাবরা সলভ্ করতে পারত না। এখন পারে। এখন সবার আগে অংক করে ক্লাসে স্যারের কাছে জমা দিতে পারে। হাসান মাস্টারও খুব খুশি। রেবেকাকে পড়ানোর জন্য রোহিত মাসে সাত টাকা করে পায়।
রেবেকা ছিলো চৌদ্দ পনরো বছরের উদ্ভাসিত তন্বী তরুণী। গায়ের রঙ গৌরীয়, এবং কালো কেশী। টানা ডাগর চোখের মণিদুটো ছিল সন্ধ্যাতারার মতো সমুজ্জ্বল। অপরূপা সে। বিশ্ব বিধাতা শিল্পীর মতো করে কত সৌন্দর্য, কত সুধা, কত মমতা দিয়েই না নারীদেহ তৈরি করেন! রেবেকা এমনই একটি তৈরি করা নারী শিল্প কর্ম ছিল ।
মানুষের রূপ, প্রেম, জৈবিক চাহিদা, শরীর সৌন্দর্যের মুগ্ধতা কোনো স্থান কাল মানে না। রেবেকা নেহায়াতই একজন পল্লীবালা, কিন্তু তার চাওয়া পাওয়া ছিল পার্থিব জগতের অন্যান্য রমণীদের মতোই। সেও কিছু চাইতে পারে তার মতো করে। যা অন্যরা চায়। আবার অন্য কারোর চাওয়ার সাথে তার চাওয়ার মিল নাও হতে পারে। একজনের চোখে যা আঁধার। অন্য আর একজনের চোখে তা দ্যুতিময় আলো। কাউকে দেখতে দেখতে ভালোলাগে, কাউকে ভালোলাগতে লাগতে ভালোবাসে। জগতের অনেক ভালোবাসার কাহিনিতে এমনই বর্ণিত আছে ।
সেদিনও বিকালবেলা রোহিত বাড়ির বারান্দায় বসে রেবেকাকে পড়াচ্ছিল। নিম গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে বিকালের সোনালী আলো এসে পড়ছিল রেবেকার মুখের উপর। কী অপরূপ লাগছিল ঐ সময়ের তার মুখের দীপ্তি। আঙিনায় দুচোখ মেলে রেবেকা দেখে — কোথাও কেউ নেই।
এখন যে শুধু কথা বলার সময়।
যে কথাটি রেবেকা আজ কয়েকদিন ধরে রোহিতকে বলতে চায় , সেই কথাটি আজ বলার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে সে। কম্পিত ঠোঁট যেন কেঁপে কেঁপে কিছু বলতে চায় বারবার । মনে হয় যেন বহুদূরের কোন পাহাড়ি ঝর্নার মতো অমিয় ফল্গুধারা তার হৃদয় থেকে ঝরে পড়ছে। অদ্ভুত বিস্মরণের সময়! রেবেকা রোহিতের হাতের উপর তার একটি হাত রেখে দ্বিধাহীন চিত্তে বলে — ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি রোহিত’।
হঠাৎ বিকালের দীপ্ত আলো যেন ধপ্ করে নিভে গেল। সেদিনের সন্ধ্যা দ্রুত আঁধার হয়ে গেল। আম গাছের ডালে থেকে একটি কাক কা-কা করে উড়ে চলে গেল। রোহিতের মুখখানা চকিত বিমর্ষ হয়ে উঠল। এক অমাঙ্গলিক ছায়া পড়ল যেন তার চোখে মুখের উপর ।
সেদিন আর রোহিত রেবেকাকে পড়াল না। সে ওর সাথে কোনো কথা না বলে সোজা বাড়ি চলে আসে। বাড়ির সামনে পুকুরের চালায় একাকী বসে ভাবছিল — ‘এ প্রেম কখনোই পূর্ণ করে পাওয়ার নয়। এ চাওয়া অবাস্তব ও অধর্মের। এ ঘটনা গ্রামে জানাজানি হলে তাদের পরিবারের উপর মহাবিপদ নেমে আসবে।’ হাসান মাস্টারের পরিবার গ্রামে দূর্দান্ত প্রতাপশালী । এরা যে কোনো রূপ ক্ষতি করতে পারে। আসন্ন সব বিপদের দৃশ্যগুলো রোহিতের চোখের সামনে ভয়ঙ্কর ছবির মতো ভেসে উঠতে থাকে। এবং সে ভিষণ বিচলিত হয়ে ওঠে।
সে পরের দিন আবারও রেবেকাকে পড়াতে যায়।
রেবেকার পড়ায় কোনো মন বসে না। রোহিত যা পড়ায় তা কোনো কিছুই বুঝে নেয় না। সে ছিল নির্বিকার। মন ছিল উড়ো উড়ো। রেবেকা আজও আস্তে আস্তে মৃদুস্বরে রোহিতকে বলেছিল — ‘আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না।’
রোহিতের সাথে রেবেকার এই গোপন সম্পর্ক চলতে থাকে বেশ কয়েক মাস। ওরা পড়তে বসে প্রায়ই চুপিচুপি কথা বলত। কখনও একে অপরের হাত ধরে থাকত। অস্ফুট করে অনেক কথাই বলত দুজনে। এমনই করে দিনে দিনে তারা গভীর মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেলে দুজনকে। দুজনেই এক অনিশ্চিত আনন্দে আপ্লূত হয়ে ওঠে। সেদিন বাড়ি আসতে আসতে রোহিত অখ্যাত এক কবির কবিতার এই পংক্তিগুলো আওরাচ্ছিল —
‘একদিন তপ্ত দুপুরবেলায় তুমি আগুন পলাশ বনে এসে দাঁড়াবে। রাঙা পলাশের আবীর মাখবে তোমার গালে। তোমার বুক দুরুদুরু। আমার নামে কাজল দেবে চোখে, আদর মেখে নেবে তোমার ঠোঁটে। জুঁই ফুল দিয়ে তুমি চুলের বিনুনি গাঁথবে, খোঁপায় গুজবে হলুদ গোলাপ।’
প্রতিদিনই দুজন হাতে হাত রেখে ফিসফিস করে নানান কথা বলে। ওদের এই ব্যাপারটা রেবেকার মায়ের নজরে পড়ে। সে শুনবার চেষ্টা করে তাদের ভিতর কী কথা হয়। কিন্তু এত আস্তে কথা বলত যে, সে শুনতে পেত না। কিন্তু সন্দেহ রয়েই যায়। ওদের গতিবিধির উপর আড়াল থেকে সে নজরদারি করতে থাকে।
একদিন রেবেকাকে পড়াতে এসেছিল রোহিত। রেবেকার মা ঘরের ভিতর থেকে জানালার ফাঁক দিয়ে ওদের উপর নজর রাখছিল, সে দেখতে পায়, রেবেকা রোহিতের দুই হাতের ভিতর মুখ লুকিয়ে ঝরঝর করে কাঁদছে। কেঁদে কেঁদে বলছে- ‘তুমি আমাকে দূরে কোথাও নিয়ে যাও। আমাকে নিয়ে পালিয়ে যাও। আমাক বিয়ে করো, তোমার সাথে ঘর সংসার বাঁধব।’ রোহিত নিরব ছিল। এই কথার কোনো জবাব তখন সে দেয়নি।
রোহিত আজও বাড়িতে এসে বিছানায় শুয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে ভাবছিল অনেক কথা। রেবেকাকে সে কী ভাবে বলবে যে — ‘আমার উপর থেকে তোমার এই ভালোলাগা উঠিয়ে নাও। যদি আমাকে ভালোবেসে থাকো, সে ভালোবাসাও ফিরিয়ে নাও। ধর্ম বিরুদ্ধ এই ভালোবাসা তোমার ধর্মের মানুষেরা কখনোই মেনে নেবে না।’
রোহিত ও রেবেকার আরও কিছু ঘনিষ্ঠ হওয়ার দৃশ্য রেবেকার মা কয়েকদিন দেখেছে। প্রায় সময়ই দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে। হাত ধরে থেকেই পড়াশোনা করে। আর একদিন তো চুম্বনের দৃশ্যই দেখে ফেলে। ব্যাপারটি তার কাছে ভালো লাগে নাই। সে এই ঘটনাগুলো নিজের ভিতর গোপন রাখতে আর সাহস পায়নি।
একদিন রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে সব কথা বলে দেয় তার স্বামী হাসান আলী মাস্টারের কাছে। পরের দিন যখন রোহিত রেবেকাকে পড়াতে আসে তখন হাসান আলী মাস্টার রোহিতকে ডেকে বলে দেয় — ‘ তোমাকে আর আজ থেকে পড়াতে আসতে হবে না। তুমি আর কোনাদিন আমার বাড়িতে ঢুকবে না। এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে। এই গ্রামের ত্রিসীমানায় থাকবে না।’
হাসান মাস্টার আরও শাসায় — ‘যদি কখনও আমার মেয়ের দিকে হাত বাড়াও, নজর দাও, তাহলে তোমার পরিণতি হবে ভয়াবহ। বুঝতে পেরেছ কী করব তোমাকে? এবার তুমি চলে যেতে পারো।
রোহিত নিরবে চলে আসছিল — পিছনে থেকে হাসান মাস্টার আবারও রোহিতকে ডাক দিয়ে বলে– ‘এই ঘটনা তোমার বাবা মা ভাই বোন বা অন্য কেউ কী জানে?
— জ্বী, না, কেউ জানে না।
— জানলে আমার মেয়ের বদনামি হবে। তুমি তোমার গীতার কসম খেয়ে বলো — কাউকে বলবে না এই কথা। কোনো কাক পক্ষীও যেন না জানে। বুঝলে? যদি জানে, তবে এর পরিণতিও হবে ভয়াবহ।
— জ্বী, আমি গীতার কসম খেয়ে বলছি —
কেউ জানবে না এ কথা। আমার আপনজন, বন্ধু বান্ধব কেউ না। আমি অঙ্গীকার করে গেলাম। আমার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হবে না।
হাসান আলী মাস্টার তার মেয়ে রেবেকাকে ডেকে বলে — আজ থেকে তোমার লেখাপড়া বন্ধ। তুমি আর স্কুলে যেতে পারবে না। ঘরে থাকবে। বুঝতে পেরেছ?
— জ্বী।
— ঐ ছেলের সাথে ভবিষ্যতে কোনোরূপ যদি যোগাযোগ করো তাহলে ওকে আমরা জবাই করে হাড়গোর টুকরো টুকরো করে বস্তায় ভরে যমুনায় ভাসিয়ে দিব। বুঝলে?
— জ্বী।
কয়েকদিন পর একদিন রেবেকা ওর ছোট ভাই রাসেলের মারফতে রোহিতের কাছে একটি পত্র লিখে পাঠায়। পত্রে লেখা ছিল —
কল্যাণীয়েষু,
বাবা মা আমাকে ঘর থেকে বের হতে দিচ্ছে না। স্কুলে যাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে। লেখাপড়া সব বন্ধ। রোহিত, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আমি সারাক্ষণ তোমার জন্য অশ্রুপাত করি।
তুমি কখনই আমার ভালোবাসাকে অমর্যদা করো না। যে কোনো ভাবে হোক, তুমি আমার জন্য ত্যাগ স্বীকার করিও। তোমাকে যেন এ জীবনে কখনোই না হারাই, সেই ব্যবস্থা করবে।
যাই করো, খুব তাড়াতাড়ি করিও। বাবা মা আমাকে অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার জন্য তোড়জোর করছে। পারলে আগামীকাল মধ্যরাতে তুমি আমার সাথে দেখা করবে। আমি সবার অলক্ষ্যে চুপিচুপি ঘর থেকে বের হবো। তুমি আমাদের পুকুরপাড়ে লিচু গাছ তলায় দাঁড়িয়ে থাকবে। আর যদি না যেতে পারি, তবে মনে করবে ঘর থেকে বের হওয়া আমার সম্ভব হয় নাই।
ইতি — রেবেকা।
চিঠিটি পড়ে রোহিত কী মনে করে, নাকি কোনো আবেগের বশবর্তী হয়ে ঐদিনই সিরাজগঞ্জ শহরে যেয়ে গোপনে ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসে হিন্দু ধর্ম পরিত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। দেখা হলে রেবেকাকে সে যেন বলতে পারে — ” আমি এখন মুসলমান। আমার নাম সোলায়মান কবির। তুমি তোমার বাবাকে বলো — রোহিত মুসলমান হয়েছে। সে এখন সোলায়মান কবির। ওর সাথে তোমরা আমাকে বিয়ে দিয়ে দাও।”
রোহিতের কাছে মনে হয়েছে এ জগতে ধর্মের চেয়ে মানুষ বড়ো। আর প্রেম হচ্ছে ধর্মের চেয়েও মহোত্তম। সে বার বার ভাবছিল — এই বালিকাটি অবুঝ! তাকে কাঁদানো ঠিক হবে না। তার সরল প্রাণের চাওয়াকে মর্যাদা দেওয়া দরকার। ধর্মে কী এসে যায়? কেউ জানুক না জানুক, আমি জানি — রেবেকার প্রেমকে মর্যাদা দিতে গিয়ে একটি ননজুডিশিয়াল স্টাম্পের মধ্যে ধর্মকে সীমাবদ্ধ রেখে না হয় স্বাক্ষ্য দিলাম — আমি মুসলমান। তবুও আমি রেবেকাকে পেতে চাই। তবু্ও এই মেয়েটির চাওয়া পূর্ণ হোক।
রোহিত তার ধর্মান্তরিত হয়ে যাবার ঘটনাটি আগেই কাউকে বলল না।
একদিন রেবেকা ওর বাবা মাকে এমনই বলেছিল-”রোহিত যদি মুসলিম হয়ে যায়, তাহলে কী ওর সাথে আমাকে তোমরা বিয়ে দিতে রাজি হবে?’ এ কথা শুনে হাসান মাস্টার আরও রেগে গিয়ে বলেছিল — কোনোক্রমেই না। ঐ মালাউনের সাথে আমি কখনোই বিয়ে হতে দেব না।’
সেদিন ছিল কার্তিকের কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি। ক্রমেই রাত গভীর হতে থাকে। বাইরে নির্জনতা খাঁ-খা করছে। ঝিঁঝি পোকার গুঞ্জন ধ্বনি স্পষ্টতর হচ্ছে। রেবেকা জেগেই ছিল। চিঠিতে লেখা পূর্ব কথা মতো তাকে বের হতে হবে। সে বিছানা থেকে উঠে বসে। পাশের রুমে ওর বাবা নাকে শব্দ করে ঘুমাচ্ছে। আর কেউ যে জেগে নেই, এটাও বোঝা গেল। ওর পরনে ছিল সালোয়ার কামিজ। হাতে চুড়ি ছিল না। গলায় নেই মালা। দুই কানে ছোট্ট দুটো কান ফুল পরা ছিল শুধু। সে খালি পায়ে আস্তে আস্তে হেঁটে গিয়ে দরজার খিল খোলে। বাইরে থেকে পাল্লা ভেজায়ে দিয়ে সে উঠোনে চলে আসে। বাইরে তাকিয়ে দেখে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কোথাও কোনো মনুষ্যজনের সাড়াশব্দ নেই। হেঁটে হেঁটে সে পুকুর পাড়ের দিকে চলে যায়। সেখানে দেখতে পায়, লিচুগাছ তলায় রোহিত দাঁড়িয়ে আছে।
রেবেকা রোহিতকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা ঠেকিয়ে বলে– ‘তুমি আমাকে নিয়ে যাও। বাবা মা তোমার সাথে বিয়েতে রাজি নয়। তুমি যদি মুসলমানও হয়ে যাও, তারপরেও বিয়ে দেবে না। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। তুমি এখান থেকে আজ রাতেই আমাকে বের করে নিয়ে যাও। ‘
রোহিত বলে — তুমি ছোট মানুষ। বুঝবার চেষ্টা করো। এই মুহূর্তে তোমাকে নিয়ে আমি কোথায় যাব? আর গেলে আমাদের পরিবারের উপর বিপদ নেমে আসবে। তুমি একটু ধৈর্য ধরো। অপেক্ষা করো।
— আমার বিয়ে ঠিক করে রেখেছে। আমাকে খুব শীঘ্রই বিয়ে দিয়ে দেবে।
— তুমি আমাকে কটা দিন সময় দাও। দেখা যাক, কী করা যায়।
— আচ্ছা দেখ কী হয়। আমার খুব ভয় হয়। আমি মনে হয় তোমাকে হারিয়ে ফেলব।
রোহিত ওর মুসলমান হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা রেবেকাকে সেক্ষণে আর বলার প্রয়োজন মনে করল না।
এরপর দুজন হাত ধরে হেঁটে হেঁটে পুকুর পাড়ে কাঞ্চনফুল গাছটার দিকে চলে যায়। সেখানে হাস্না হেনা ঝোপের আড়ালে ঘাসের উপর যেয়ে বসে। রেবেকা ওখানেও রোহিতকে বুকে জড়িয়ে অশ্রুপাত করতে থাকে। এবং রুদ্ধবাকে বলতে থাকে — আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না।’
সেদিন সেই কৃষ্ণপক্ষের রাতে ঘাসের উপরে
দুটো প্রাণ কতক্ষণ একে অপরকে জড়িয়ে থেকেছিল, এবং কী রূপ ভালোবাসা প্রকাশিত করেছিল — তা শুধু জানে শিশির সিক্ত ঘাস আর রাতের আঁধার ! কারণ, আঁধারই যে সেই রাতে নিবিড় করে ওদেরকে ঢেকে রেখেছিল।
রেবেকা রোহিতের সাথে দেখা করে বাড়ি ফিরে এসে দেখে — ওর বাবা ও মা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হাসান মাস্টার রুদ্র মূর্তিতে রেবেকাকে চরম রাগান্বিত স্বরে বলে — কোথায় গিয়েছিলেে?
— রোহিতের সাথে দেখা করতে।
— এর পরিণতি কী ভয়াবহ হবে, তা তুমি জানো?
রেবেকা ত্রস্ত হয়ে মাথা নিচু করে থাকে।
এক দিন পরেই রেবেকাদের বাড়িতে ব্রম্মগাছা থেকে ওর এক মামা আসে। তাকে জরুরি ভাবে খবর দিয়ে আনা হয়। রেবেকার মামাটি ষন্ডা প্রকৃতির। গোপনে সে সর্বহারা পার্টি টার্টি করে। মানুষ গুম ও হত্যা করাই তার কাজ। রেবেকার বাবা বিকালবেলা সেই ষন্ডার কাছে রেবেকার ঘটনাটি খুলে বলে। ষন্ডা বলে — আজ রাতেই ঐ মালুর বাচ্চাকে খতম করে দেই, ওকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেই দুলাভাই।
হাসান মাস্টার বলে — আমি তো এই জন্যই তোমাকে খবর দিয়ে এনেছি। তুমি একা এই কাজ করতে পারবে?
ষন্ডা বলছিল — পাশের গ্রামেই আমার দুজন অনুসারী আছে। প্রয়োজনে ওদের খবর দিব। ওরা চলে আসবে।
— ঠিক আছে তাই করো। ঐ মালুর বাচ্চারে আজ রাতেই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দাও। ওকে টুকরো টুকরো করে বস্তায় ভরে যমুনার জলে ভাসিয়ে দিয়ে আসবে।
— আচ্ছা। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে দুলাভাই। আজই সব খতম। কোনো চিন্তা করবেন না।
রেবেকা পাশের রুম থেকে তাদের সব শলাপরামর্শ শুনে ফেলে। আর সেই ক্ষণেই সে একটি চিরকুট লিখে ওর ছোট ভাইয়ের মারফতে রোহিতের কাছে পাঠয়ে দেয়।
রেবেকার চিরকুট পেয়ে ইতোমধ্যে এই রাতেই — রোহিত হরিনা গোপাল গ্রাম ছেড়ে অজানা অনিশ্চিত গন্তব্যের উদ্দেশে ঘর হতে বেরিয়ে পড়েছে।
০২.
তেতত্রিশ বছর পর রোহিত সেন ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে লন্ডন থেকে ঢাকা বিমান বন্দরে এসে নামেন । সে দেশ ত্যাগ করেছিল ১৯৭০ ইং সালে। আর ফিরছে ২০০২ ইং সালে। রোহিত সেই যে গ্রাম ছেড়েছিল পঁয়ত্রিশ বছর আগে, এর মাঝে সে কারোর কোনো খোঁজ খবর রাখেনি। রোহিত কোথায় থাকত, কোথায় ছিল , সে বেঁচে আছ না মরে গেছে তা কেউই জানত না।
রোহিত তার জীবনের এতগুলো বছর পৃথিবীর পথে পথে ঘুরেছে। একদেশ থেকে অন্য আর এক দেশে গিয়েছে। কোথাও সে স্থায়ী ভাবে থিতু হতে পারেনি। তার জীবন ছিল যাযাবরের মতো। ভলগা থেকে দানিয়ুব, আটলান্টিকের বালুকাবেলা থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের নির্জন পাড়ে, মস্কো থেকে মাদ্রিদ, সান্টিয়াগো থেকে টরেন্টো, আল্পস পর্বতমালা থেকে নায়াগ্রা জলপ্রপাত — কত শহর, কত বন্দর সে গিয়েছ। কখনও মেট্রোতে, কখনও ট্রেনে, জাহাজের ডেকে, স্টেশনে স্টেশনে, মসজিদ-মন্দির- গীর্জায় ও বিভিন্ন ধর্মশালায় সে রাত কাটিয়েছে। কত যে স্থানে সে ঘুরেছে ফিরেছে থেকেছে। তার ইয়ত্তা নেই। সারা পৃথিবীই যেন ছিল তার নিজের ঘর।
আজ এত বছর পর এদেশের মাটিতে পা দিয়ে মনে হলো রোহিতের — এই দেশ এই মাটি যে তারই। কত যে আপন লাগছে। এই যে মাথার উপর নীল আকাশ, এই রোদ্দুর, মেঘের শীতল ছায়া, বাতাসের গন্ধ, সবই আগের মতোই তার চিত্তকে দোলা দিচ্ছে। রোহিত প্রাণ ভরে উপভোগ করছে — ‘আমারও দেশেরও মাটির গন্ধে ভরে আছে সারা মন।’
এয়ারপোর্টের কনকোর্স হল দিয়ে হেঁটে রাজপথের উপর এসে দাঁড়ায় সে। হঠাৎ ধূসর লাগছিল এই শহর। তার মনে পড়ছিল — আজ থেকে তেতত্রিশ বছর আগের তেজগাঁও বিমানবন্দরের কথা। সেদিন একটি পিআইএর বিমানে করে লন্ডন যাত্রা করেছিল সে। কেউ আসেনি সেদিন এয়ারপোর্টে। কোনো আপন মানুষ বিমান বন্দরে তাকে বিদায়ী অভিবাদন জানায়নি। কাঁদতে কাঁদতে সেদিন এই দেশ ছেড়ে সে চলে গিয়েছিল।
কোথায় যাবে সে প্রথম? কোথাও কেউ তো তার জন্য অপেক্ষায় নেই। আবার ভাবছিল — হয়ত কেউ তার জন্য অপেক্ষায় থাকতে পারে। জীবনের পয়ত্রিশটা বছর খুব কী বেশি সময়? যাদের জীবন আনন্দের, তাদের জন্য এটি খুব বেশি সময় নয়। আবার নিঃসঙ্গ একাকী মানুষের জন্য এটি দীর্ঘ সময়।
রোহিত একটি রেন্ট- এ ট্যাক্সি ডাকে। ট্যাক্সির চালককে বলে — ভাই, সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে আমাকে নিয়ে চলো। চালক বলে — ওঠেন।
ট্যাক্সি আশুলিয়ার পথ ধরে চলতে থাকে। সে ভাবছিল — আমি অধম। আমি মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারিনি। একাত্তরে আমি টগবগে যুবক ছিলাম। ইচ্ছা করলেই এই মাটিতে ফিরে আসতে পারতাম। কিন্তু আসিনি। কী এক অভিমান ছিল অন্তর জুড়ে। কারোর টানেই এ দেশে ফিরে আসা হয়নি। না মা, না দেশ, না আদরের ছোট বোন , না অন্য কারোর টানে।
মানুষের হৃদয় পাথরের মতো এত কঠিন হয় ! কী যে অনাহুতের মতো সজ্জনহীন ভাবে পরবাসে পড়ে রইলাম এতকাল? কত পথ চলেছি, কত রমণীর সাথে দেখা হয়েছে, কত রূপময়ী মেয়ের সাথে পরিচয় হয়েছে। কত বর্ণের, কত ধর্মের — কিন্তু কাউকেই ভালো লাগল না। কাউকেই পথে থেকে তুলে নিয়ে পথের সাথী করা হয়নি। সারাটা জীবন ঘরহীন ঘরে পড়ে রইলাম। এই সবই এক অন্তহীন গ্লানি।
একবার লাসভেগাসে ভ্রমণ করতে যেয়ে পকেটে কোনো ডলার ছিল না। কপর্দকহীন যাকে বলে। কী করব? একটি মেট্রোরেল স্টেশনের প্লাটফর্মের উপর দাঁড়িয়ে আমার প্রকাশিত নৃবিজ্ঞানের উপর সারা জাগানো বই ‘পিউরিটি এ্যান্ড ড্যান্জার’ কয়েকটি কপি বিক্রি করছিলাম। এক পঞ্চাশোর্ধ্ব মার্কিন মহিলা আমার ব্যাগে থাকা বইটির সবগুলো কপি সে কিনে নেয়। মহিলা তার বাসায় ডিনারের নিমন্ত্রণ করেছিল। আমি গিয়েছিলাম তার বাসায়। বাসায় ঢুকে আমি অবাক হয়েছিলাম। দেখি — তার ড্রয়িং রুমের দেয়াল জুড়ে জয়নুল আবেদীনের বিখ্যাত দূর্ভিক্ষের ছবিটির কপিফটো টানানো। মহিলার নাম ছিল — ডোর্বা আলিসন। সে ভালো পিয়ানো বাজাতে পারত। আপ্যায়নের পর সেই রাতে ডোর্বা আমাকে পিয়ানো বাজিয়ে শোনায়েছিল। আমি শুধু তার বাজানো মেলোডি সুরটিই শুনেছিলাম। গানের কথা কী ছিল তা বুঝতে পারিনি। তবে এটা যে একটা দুঃখের গানের সুর ছিল, তা বুঝতে পেরেছিলাম। আরও সিয়র হয়েছিলাম, – যখন দেখি পিয়ানো বাজানো শেষে ডোর্বার চোখে জল।
এই ধনাঢ্য বিনয়ী মহিলাটিও আমার জীবনের অনেক কিছুই হতে পারত।
ট্যাক্সিটি একসময় নবীনগর স্মৃতিসৌধের সামনে গিয়ে থামে। রোহিত গাড়ি থেকে নেমে ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে সৌধের কাছে চলে যায়। এতদিন ধরে এই সৌধটি ছবিতে আর ভিডিওতে দেখেছে সে। আজ চাক্ষুষ এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। লক্ষ শহীদের রক্তে গড়া এই সৌধ। রোহিত তার নিজের গ্লানি যেন মোচন করছিল বিনম্র ভঙ্গিতে মাথা নত করে। দূরে প্রবাসে বসে কত শুনেছে সে এই গানটি — ‘ সব কটা জানালা খুলে দাওনা, ওরা আসবে চুপিচুপি / যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ…। ‘
রোহিত ট্যাক্সীর কাছে চলে আসে। চালক ছেলেটি বলছিল — স্যার এখন কোথায় যাবেন?
— হোটেল অবকাশ, মহাখালী।
হোটেলে চেক ইন করে নেয় রোহিত। তারপর রুমে যেয়ে গোসল করে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
কখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে বুঝতেই পারেনি।
রোহিত উঠে বিছানায় চুপচাপ বসে থাকে। এই শহরে কেউ নেই তার। সেই কবে প্রথম এসেছিল সে এই শহরে । সব মনে পড়ছে তার। মনে পড়ছে শরীফুল ইসলামের কথা। শরীফ নামের সেই ছেলেটা তাকে এই ঢাকা শহর চিনিয়েছিল, আশ্রয় দিয়েছিল তাকে এই আত্মজনহীন শহরে ।
শরীফের সাথে রোহিতের পরিচয় হয়েছিল ট্রেনে। সে যেদিন গ্রাম থেকে চলে আসছিল সেদিন। স্টিমার থেকে নেমে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট থেকে সে ঢাকাগামী একটি ট্রেনে উঠে। তৃতীয় শ্রেণির কামড়ায় সে বসেছিল । তার পাশেই বসেছিল ওর সমবয়সী একটি ছেলে। চলতে চলতে ট্রেনে ছেলেটির সাথে কথা হয় ও পরিচয় হয়। প্রথম কথা বলেছিল শরীফ আগে। বলেছিল — কোথায় যাবে তুমি ? রোহিত বলেছিল — উদ্দেশ্যহীন গন্তব্য। তবে ঢাকা পর্যন্ত আপাতত যাব।
— ঢাকায় কোথায় যাবে?
— জানি না।
— এর আগে কখনও ঢাকা যাওনি?
— না।
এরপর সারা রাস্তা দুজনের সাথে আরও অনেক কথা হয়। এবং ট্রেনের ভিতর ক্ষণকালের ভ্রমণের সময়টুকুতে একে অপরের মাঝে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। কমলাপুর স্টেশনে যখন দুজন নামে তখন শরীফ বলছিল — বন্ধু, তুমি আমার মেসে কিছুদিনের জন্য উঠতে পারো। আমি যেমন থাকি তুমিও তেমন থাকবে, আমি যা খাই, তুমিও তাই খাবে। একই চোকিতে দুজন একসাথে না হয় কিছুদিন কষ্ট করে ঘুমাব।
আর শোনো, আমি কিন্তু তোমাকে কোনো করুণা বা দানের কথা বলছি না। ঢাকা শহরে এসেছ যখন, তখন কিছু একটা করে তো খাবেই। এই যেমন আমি একটি এ্যালুমিনিয়াম কারখানায় কাজ করে খাই। তুমিও এমন কিছু করে খেতে পারবে। তখন না হয় শোধ করে দিও।
রোহিত শরীফের দুহাত চেপে ধরে বলে — তুমি সত্যি মহৎ ওগো বন্ধু আমার। চলো, তোমার কাছেই আমি থাকব।
বকশি বাজারে একটি সরু গলির ভিতর একটি মেসে শরীফ থাকে। ঐ মেসেই রোহিত বর্ডার হয়ে যায়। অল্প কিছুদিনের মধ্যে সে দু-তিনটে টিউশনি পেয়ে যায়। মেসের জীবন ভালোই চলতে থাকে তার ।
জীবনের সুখ দুঃখের ক্রান্তিকালের দুই আড়াই বছর এই শরীফ রোহিতের জীবনে জড়িয়ে ছিল। খুব হাসি খুশিপূর্ণ ছেলে ছিল। হাজারও দুঃখের মাঝে নিজেকে হাসি খুশি রাখত। একদিন ওর কারখানা বন্ধ ছিল। বিকালে সে বিছানায় চুপচাপ শুয়ে ছিল । রোহিত জিজ্ঞাসা করে — ‘বন্ধু, তোমার কী হয়েছে? কোনো অতীত সুখ স্মৃতি মনে পড়ছে তোমার? কিংবা কোনো দুঃখের কথা?’
শরীফ বলে, না আমার তেমন কিছু নেই। আমি কী অতই সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছি যে — একটি গোলাপ ফুল হাতে দিয়ে কোনো মায়াময়ী মেয়ে এসে বলবে —আমি তোমাকে ভালোবাসি। তবে আমার কৈশোরের বেদনা জাগানিয়া একটি স্মৃতি আছে, যা এখনও মাঝে মাঝে মনে পড়ে।
— ঐটিই শোনাও, বলো শুনি।
— ‘ মনটা কখনো কখনো ভবঘুরে মন হয়ে ওঠে। কোনো কিছু ভালো লাগে না। কারোর মায়াও কাছে টানে না। কিন্ত পথ আমাকে টেনে নিয়ে যায়। উদাস হয়ে ঘুরতে মন চায় পথে পথে, খেয়া ঘাটে। নদীতে নদীতে, নৌকায় নৌকায় । মন চায় কোনো সার্কাস দলের কিংবা কোনো যাত্রা দলের গায়েন হই। বর্ষার রাত্রি নিশীথে মঞ্চের পালায় গান গেয়ে গেয়ে ঘুরে বেড়াই !
অনেক বছর আগে এক শ্রাবণ বর্ষা মৌসুমে আমাদের গ্রামে হাটের পাশে সার্কাস পার্টি এসেছিল। নাম ‘ নিউ স্টার সার্কাস অপেরা ‘। প্রায় একমাস ছিল তারা আমাদের গ্রামে। তখন ছিল আমার তারুণ্যের প্রথম প্রহরের সময়। প্রায় প্রতিদিন যেতাম, ঐ সার্কাস দেখতে। কি প্রবল আকর্ষণে টেনে নিয়ে যেত আমাকে। সার্কাস দেখানোর পাশাপাশি সেখানে গান হতো, নাচ হতো, কৌতুক হতো, হাতির খেলা হতো ।
ঐ সার্কাস দলে তেরো চৌদ্দ বছরের একটি বালিকা এসেছিল। নাম স্বপ্না। পিঙ্গল মণিকান্ত চোখ। শরীর নদীর বাঁকে বাঁকে তখনও ঢেই তরঙ্গায়িত হয়নি । সে ঘাগরা পড়ে নাচত। গানও গাইত। আবার সার্কাসের বিভিন্ন শারীরিক কসরৎ দেখাত সে। ওর এই চৌকস ব্যাপারগুলো আমাকে ভীষণরকম মুগ্ধ করেছিল। ঐ মেয়ের অদ্ভুত সব গুণ দেখে সেদিনের এক গ্রাম্য সরল বালক ঐ বালিকার ভক্ত হয়ে উঠেছিল।
তখন বর্ষার দিনে নৌকায় করে স্কুলে যেতাম। ছলাৎছলাৎ বৈঠার শব্দ হতো জলে। কাঠের পাটাতনের উপর চুপচাপ বসে থাকতাম। জলের নুপুরে ঐ সার্কাস বালিকার ঘুঙুরের শব্দ শুনতে পেতাম। মরা গাঙে তখন বর্ষার জলে ভরে যেত। সন্তোষ মাঝি জাল পেতে রাখত মাছ ধরার জন্য। পাটের জাঁকের উপর বসে থাকত ধবল বক। মাথার উপরে উড়ত গাংচিল। ওদের চ্রিহি চ্রিহি ডাকের মধ্যে আমি শুনতে পেতাম সার্কাসের ঐ বালিকার গানের সুর আর যন্ত্রী দলের খুঞ্জরীর শব্দ।
মন প্রফুল্ল হতো কিনা বুঝতে পারতাম না। পুকুর পাড়ের কদম গাছ থেকে কদম ফুল ছিঁড়ে পুকুরের জলে ভাসিয়ে দিতাম। উজান থেকে আসা নৌকাগুলো বাদাম তুলে চলে যেত দক্ষিণের গঞ্জে। মাঝি মল্লারও গান গাইত ভাটিয়ালি সুরে । কিন্তু সব গান আর সব সুর থেমে যেত সার্কাস দলের ঐ বালিকার ঘুঙুরের তালে। জলে কদম ফুল ভাসানোর সময় মনে হতো, এর একটি ফুল যদি আমার থেকে নিত ঐ দিগবালিকা।
কাউকে কিছুই বলা হয়নি আর। ভাবতাম, লেখাপড়া করে কি লাভ হবে? তারচেয়ে আমি যদি গায়েন হতে পারতাম। যদি যোগ দিতে পারতাম ঐ সার্কাস দলে। জীবনটা কত সুন্দরই না হতো। বালিকা শুনত আমার গান ! দ্বৈত কণ্ঠে গাইতাম যাত্রার পালায়। জীবনের স্বপ্নগুলো পূর্ণ হতো আনন্দময় সঙ্গীতে।
সেইদিন শ্রাবণ আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছিল। আমাদের বাড়ির রাখাল সমির আলি ছোট নৌকায় করে আমাকে নিয়ে যায় সার্কাস প্যান্ডেলে। হ্যাজাকের আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে প্যান্ডেলের ভিতরে । যন্ত্রী দলের কেউ একজন ৰাঁশিতে সুর তুলে, তবলায় তাল দিচ্ছিল তবলচি। হারমোনিয়াম বেজে উঠে। সেদিনও বালিকা গান গেয়েছিল। নুপুরের ঝুমঝুম শব্দ তুলে নেচেছিল । আমার প্রাণের তন্ত্রী কেঁপে উঠেছিল।
প্যান্ডেলের বাইরে ছিল পূর্ণিমার চাঁদ। নৌকায় আসার সময় বাইরে দেখে এসেছিলাম জ্যোৎস্নায় ভাসছে জলে ভাসা মাঠ ঘাট। আমি জানতাম না, সেই রাত ছিল বালিকার শেষ গানের রাত। জানতাম না সেইটি হবে আমার বালিকার কাছ থেকে শেষ গান শোনা।
পরের দিন দুপুরের পর সার্কাস দলটি বড়ো একটি পানসি নৌকা করে চলে যায় দূরে অন্য আরেক ঘাটে। বিকেলে যখন প্যান্ডেলটি দেখতে যাই,
দেখি — সেখানে কোনো সামিয়ানা টানানো নেই। দুই একটি বাঁশের খুঁটি এলমেল পড়ে আছে। স্তব্ধ বাতাসে কান পেতে থেকেছিলাম অনেকক্ষণ।সেদিন আর বালিকার কোনো ঘুঙুরের শব্দ শুনতে পেলাম না।
টিউশনী করার পাশাপাশি রোহিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞানে মাস্টার্স প্রিলিমিনারীতে ভর্তি হয়। ক্লাসে পড়া শোনায় সে খুব ভালো করে এবং শিক্ষকদের নজরে আসে। দুবছর পর সে মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়। রেজাল্টের পরপর বৃটিশ সরকারের স্কলার্শিপ নিয়ে নৃবিজ্ঞানের উপর উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার জন্য সে লন্ডনেে চলে যায়।
সেদিন সেই ট্টেনে যদি শরীফের সাথে রোহিতের পরিচয় না হতো, যদি ঢাকা শহরে তাকে আশ্রয় না দিত, তাহলে সে আজকের এই রোহিত সেন হতে পারত না।
এত বছর পর ঢাকায় এসে তার সেই অকৃত্রিম নিঃস্বার্থ বন্ধুটির কথা খুব মনে পড়ছে । পুরোনো ঢাকার একটি এ্যালুমিয়াম ফ্যাক্টরীর শরীফ একজন কেরানী ছিল।
রোহিত সন্ধ্যায় একটি বেবীট্যাক্সি নিয়ে জেলখানার নিকট বেগম বাজার মোড়ে চলে যায়। ওখান থেকে হেঁটে হেঁটে বেচারাম দেউরীর একটি গলির মধ্যে ঢোকে। রোহিতের এ্যালুমিনিয়াম ফ্যাক্টরীটি খুঁজতে থাকে। সে দেখতে পায় — যে বাড়িতে ফ্যাক্টরিটি ছিল সেখানে সেটি নেই। লোকজনদের জিজ্ঞাসা করে শরীফুল ইসলামের কথা। কিন্তু তারা কেউই তাকে চিনতে পারে না। সে কোথায় চলে গেছে তাও জানে না।
রোহিত একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেগম বাজারের জনারণ্যময় গলির উপর দিয়ে হাঁটতে থাকে। বিমর্ষ হয়ে ভাবছিল — যাকে একদিন খুঁজে পেয়েছিলাম একটি যাত্রী ট্রেনে, সে আজ হারিয়ে গেল কোন্ অজ্ঞাতে, কোন্ জনারণ্যে। এ জীবনে তাকে কী আর খুঁজে পাব? যেখানেই থাকো শরীফ, তুমি ভালো থেক বন্ধু।
সে ভগ্ন মন নিয়ে ফিরে আসে হোটেলে। ট্যাক্সিতে আসতে আসতে মনে পড়ছিল শরীফের সাথে মেস জীবনের সুখ দুঃখের স্মৃতির কথা।
একদিনের কথা। ক্লাস শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেসে ফিরছিলাম। পথে জয়কালী মন্দিরের কাছে আমাদের গাঁয়ের মজিদ মন্ডলের সাথে দেখা হয়। ও এসেছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ওর এক আত্মীয়ের চিকিৎসা করাতে। রাস্তার পাশে ফুটপাতের উপর দাঁড়িয়ে মজিদের সাথে কথা বলছিলাম । কথায় কথায় জানতে পারলাম রেবেকার বিয়ে হয়ে যাওয়ার কথা। মনটা মুহূর্তে বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। মজিদের সাথে কথা বলতে পারছিলাম না। কণ্ঠ রোধ হয়ে আসছিল। নিশ্চুপ হয়ে ভাবছিলাম — যাও-বা গ্রামে ফিরে যাওয়ার ক্ষীণ ইচ্ছা ছিল, তাও রুদ্ধ হয়ে গেল।
মজিদের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে আমি আর মেসে গেলাম না। কোথায় গেলে মন ভালো লাগবে সেই পথ খুঁজছিলাম। ভাবলাম, বুড়িগঙ্গার তীরে যেয়ে বসে থাকি গিয়ে। ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে চানখার পুল পার হয়ে জেলখামার পাশে দিয়ে ইসলামপুর রোডের উপর যেয়ে উঠি।
আমি যখন নবাব বাড়ির গেটের পাশে দিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ের দিকে যাচ্ছিলাম, তখন মনে হলো — নবাববাড়ির ভিতরে অন্দরমহল থেকে ঘুঙুরের আওয়াজ কানে আসছে। কে যেন পায়েল পরে নাচছে। উঁকি দিয়ে একবার দেখতে মন চাইল — কোন্ সে নর্তকী?
পিয়ারি বেগম।
জিন্দাবাহার লেনের একটি বাড়িতে হরিমতি বাঈজীর কাছে রক্ষিতা হয়ে থাকত পিয়ারি। প্রতিদিনের অভ্যাস মতো সকালে ভৈরবি রাগে গান গাইত ‘রসিয়া তোরি আখিয়ারে, জিয়া লাল চায়’ ঠুংরী ঠাটের গানের এ কলিতে জিন্দা বাহার গলি কানায় কানায় ভরে উঠত। আরও একটি গান পায়েলের ঝুমুর শব্দের সাথে শোনা যেত —
‘প্রভু মোর অবগুন চিতনা ধর
সমদরশি হ্যায় নাম তোমার
এক লহো পুজামে রহত হ্যায়
এক রহো ঘর ব্যাধক পরো
পরলোক মন দ্বিধা নাহি হ্যায়
দুই কাঞ্চন করো।’
খুব ইচ্ছা হচ্ছিল, যদি কোনো অস্তরাগের বিকালে কাউকে নিয়ে বসতে পারতাম ওয়াইজঘাটের অদুরে সেই শান বাঁধানো ঘাটে। যে ঘাটে অনেক বছর আগে কত হেমন্ত বিকালে কমলা রঙের রোদ মেখে নবাব বাড়ি থেকে এসে বসত পিয়ারি বেগম। পিয়ারির মুখটি ছিল অবিকল ছবির মতো, থুতুনিটি ঈষৎ তীক্ষ, ঠোঁট দুটি যেন কোয়ারিতে রাখা করবী। তার নাকের প্রতিটি নিঃশ্বাস বুড়িগঙ্গার মলয় বাতাসে মিলিয়ে যেত। ওর শরীরটি যেন মুর্শিদাবাদী রেশম দিয়ে মোড়ান। এমনই মসৃন তার ত্বক। পাকা পাতি লেবুর গায়ে হাল্কা গোলাপী রঙের পোচে যে রঙের মিশ্রন হয় ঠিক তেমনই ছিল তার গায়ের রঙ। তার নীল কালো চোখ দুটি যেন স্তম্ভিত মেঘ মুখের অর্ধেকটাই জুড়ে থাকত।
তুমি কী আমার সেই রূপ ঝলসিত একজন পিয়ারি বেগম?
না, তুমি পিয়ারি বেগম নও। তুমি রেবেকা বেগম।
যাকে আমি পেয়েছিলাম পূর্ব জীবন থেকে এই পর জীবনে। স্বপ্নের কোন্ ইন্দ্রলোক থেকে তুমি এসেছিলে। তোমার চোখের আলোয় যে দ্যুতি ছড়িয়েছিল, তা আমাকে পথ দেখিয়েছিল নতুন জীবনের।
এই সবই আমার পরাবাস্তব ভাবনা ছিল, যা ছিল একেবারেই মূল্যহীন।
বুড়িগঙ্গার ঘাট থেকে ফেরার সময় ইসলামপুরের মোড়ে গঙ্গাজলির মক্ষিকালয়ের প্রবেশ মুখে দেখতে পাই — রঙবেরঙের চোলি পরিহিতা রূপবাহারি অনেকগুলো মেয়ে দাঁড়িয়ে হাসাহাসি করছে, গান গাইছে, বিচিত্র সব অঙ্গ ভঙ্গি করছে। ইশারায় শীশ দিচ্ছে ভিতরে যাওয়ার জন্য।
ওখানে কী আনন্দ হয় অনেক? ওটা নাকি বিরহী আর প্রবঞ্চিতদের আনন্দলোক। ওখানে রূপের হাটে শরীরের ভালোবাসা বেচাকেনা হয়।
“অ্যায় হুসন, জী খোলকর আজ সাতাঁলে মুঝকো। কাল, মেরা ইস্ককা আন্দাজ বদল যায়ে গা। ”
মানে, “ওহে সুন্দরী! আজ প্রাণ খুলে আমাকে দুঃখ দিয়ে নাও, আমায় নিয়ে খেলা করো, আমার সঙ্গে আজ তোমার প্রাণের খেলার সময়। আহা! তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা। কারণ কাল, আগামিকাল, আমার প্রেমের পাত্রী অন্য কেউও হয়ে যেতে পারে।”
সেদিন রাতে পথে ঘুরে ঘুরে মেসে ফিরে এসে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। শরীফ কতবার বলেছিল, কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে। কিন্তু ওর সকল অনুরোধ উপেক্ষা করেছিলাম। ও বলেছিল, কেন তোমার মন খারাপ? আমাকে বলো না !’
— কী বলব ওকে? মনে রয়ে গেল মনেরই কথা,
শুধু চোখে জল।’
০৩.
প্রায় পয়ত্রিশ বছর পর রোহিত তার গ্রামের বাড়ি হরিনা গোপালে আজ ফিরে যাচ্ছে। যেদিন সে গ্রাম ছেড়ে ঢাকা এসেছিল — সেদিন রাতে বয়রা ঘাটে ভাসমান প্লাটফর্মের রেলিংয়ের কাছে দাঁড়িয়ে জলের ধ্বনি শুনেছিল। ভেবেছিল সে — ‘জীবনের কী এক অমূল্য সম্পদই না পিছনে রেখে এলাম। যে সম্পদ কোনো দামেই কোথাও থেকে কিনতে পারব না।’ জীবনের প্রতি সে ঘৃণাও করছিল– এ কেমন কাপুরুষের মতো সব ফেলে চলে যাচ্ছে সে কোন্ অচেনা ভূবনে।
সেদিন তার একবার মনে হয়েছিল সে আবার ফিরে যাবে হরিনা গোপাল গ্রামে , কিন্তু পরক্ষণেই ছেলেমানুষের মতো কী এক চির অভিমান হয় তার নিজের প্রতি। চরম ঘৃণাও হয় ধর্মের প্রতি, এবং সমাজের নিয়মনীতির প্রতি। চিত্ত তার অস্থির হয়ে উঠছিল।
যমুনা বক্ষে সেদিনের সেই হেমন্তের রাত্রিটি ছিল কোনো এক ব্যর্থ প্রেয়সীর চোখের নীচে মলিন দাগের মতো বিষণ্নতার। দূরে কোনো বন নিবিড়ে ত্রস্ত কোনো হরিণ চোখ তুলে যেন ঘাতক শিকারীকে বলছে — এই জীবন তুমি কেড়ে নিও না। আমি বাঁচতে চাই। আমি রয়ে যেতে চাই অপূর্ব সুন্দর এই সবুজ অরণ্যে।
ভোরে শের আফগান জাহাজটি বয়রা ঘাট থেকে ছেড়ে এসেছিল। যমুনার জল ভেঙে ভেঙে জাহাজটি ভেঁপু বাজিয়ে একসময় জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে গিয়ে ভেড়ে। রোহিত আস্তে আস্তে জাহাজের সোপান বেয়ে নীচে নেমে আসে। সে দেখতে পেয়েছিল ঢাকা যাওয়ার একটি ট্রেন স্টেশনে অপেক্ষা করছে।
রোহিত বাসের ভিতর বহু বছর আগের তার গৃহ ত্যাগের কথা ভাবছিল। হঠাৎ সম্বিত ফিরে আসে তার। সে দেখতে পায় — সে এখন সিরাজগঞ্জগামী একটি এক্সপ্রেস বাসের ভিতরে বসে আছে। বাসটি মির্জাপুর অতিক্রম করছিল।
পাশে এমন কেউ নেই যে তার সাথে দুদন্ড কথা বলে সময় পার করবে। কেমন যেন ঘুম ঘুম লাগছিল চোখে। সে সামনের সিটে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করে। কিন্তু ঘুমও আসছিল না। তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে কী সব ভাবছিল। সেই সূদুর অতীতের সব কথা — ‘কোথায় সেই ভাঁটফুল, ভেরেন্ডার পাপড়ি, আকন্দের ঝোপঝাড়। কোথায় হিজলের বন, মহুয়া মাতাল নদীর কূল। যে নারীকে নদী মনে করত, সেই একদিন ধর্ম অন্ধতার কবলে পড়ে হারিয়ে গেল।
সে যেন দিনের অস্তবেলায় আবার ফিরে যাচ্ছে নক্সী কাঁথার পথ ধরে সেইখানে, যেখানে অসংখ্য দূর্বাঘাসের উপর অপরাহ্ণের রোদ্দুর পড়ে আছে। সব ঘাস পায়ে মারিয়ে হেঁটে হেঁটে সে চলে যাবে নদীর কাছে। সেখানে যেয়ে বলবে — ‘ আজ তোমার কাছে থেকে কিছুই নেব না, আজ সব ফিরিয়ে দিতে এসেছি।’
যখন চাঁদ উঠবে, যখন রাতের আঁধার ফুঁড়ে জ্বলে উঠবে থোকা থোকা তারা, তখন ফিরে আসবে সে জীবনের উপত্যকায়। জ্যোৎস্নায় নেশাচ্ছন্ন নগ্ন পায়ে নেমে পড়বে মৃত্যু নদীর জলে। আর উঠবে না। তখন কেউই একাকী কূলে দাঁড়িয়ে খুঁজবে না তাকে শীর্ণা নদীর জলে।’
বাসের জানালার গ্লাস উঠিয়ে রোহিত দেখেছিল গ্রাম। কত সুন্দর সুন্দর সুন্দর মানুষ, কত রূপ অপরূপ মুখ। এখনও মনে রেখেছে সে এখন হেমন্ত কাল। মাঠে মাঠে পাকা ধান। বাতাসে কাঁচা পাকা ধানের গন্ধ ভাসছে। রোহিত সেই গন্ধ নিচ্ছিল প্রাণ ভরে।
বাসটি একসময় যমুনার খুব কাছাকাছি চলে আসে। ধূঁধূ বালির প্রান্তর আর কাশবন দেখলেই মনে হয় কাছেই নদী আছে। কত বছর ধরে যমুনার জল দেখা হয় না। তার শুধু মনে
পড়ছিল — ঢাকায় যাবার বেলায় সেই রাতের কথা। স্টিমারের ডেকের বেঞ্চের উপর সে যখন বসেছিল, কী এক অন্তর বেদনায় হিম হয়ে আসছিল সারা শরীর। অনেক দূর থেকে গুমরে গুমরে কার যেন কান্নার ধ্বনি শুনতে পাচ্ছিল। চোখের ভিতর জল ছপ ছপ করছিল। সে জল সেদিন যেন করুণ ধারায় বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়েছিল।
বাসটি একসময় যমুনা সেতু অতিক্রম করছিল। সে জানালা দিয়ে দেখছিল দুইপাশের নদীর রূপ। হায়! এই সেই উত্তাল ভরা যমুনা? বিশাল বিশাল চর জেগে উঠেছে নদীর মধ্যখানে। কাশবন দেখতে ভালো লাগলেও ভরা যমুনা দেখার জন্য এতদিন সে অপেক্ষা করেছিল। তা আর দেখা হলো না। এই নদী দেখে তার প্রাণ কাঁদতে থাকে।
তারপর, একসময় বাসটি তার শৈশবের নিজ
শহর সিরাজগঞ্জ প্রবেশ করে। বুকের ভিতর কেমন শিহরণ জেগে উঠল। বিদেশ বিভূঁইয়ে থাকতে কত মনে পড়েছে এই শহরকে। কত উন্মন মন আকুল হয়েছে এই শহরটিকে দেখবার জন্য। লক্ষী সিনেমা হলে সে প্রথম সিনেমা দেখেছিল ফতেহ লোহানীর ‘আসিয়া’ ছবিটি। কী অমিত বিস্ময়ে দেখেছিল ছবিটি। শহরের ইলিয়ট ব্রীজের কাছে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে দেখত সে থাম্বা বিহীন ব্রিজ। সবই এখন স্মৃতি, সবই নস্টালজিক।
রেল স্টেশনের কাছেই বাস স্ট্যান্ড। ওখানেই সে বাস থেকে নেমে পড়ে। ছোট বেলার চেনা শহর তার কাছে আজ অচেনা লাগছে। কত মানুষ হাঁটছে পথের উপর দিয়ে, একজনও চেনা মানুষ কোথাও দেখতে পেল না । স্টেশনের কাছে একটি হোটেলে সে ভাত খেয়ে নেয়। তারপর পায়ে প্যাডেল টানা একটি রিকশায় করে হরিনা গোপাল গ্রামের দিকে রওনা হয়।
০৪.
রিকশায় উঠে রোহিত আবেগ আপ্লূত হয়ে ভাবছিল — সে আবার তার শৈশবের স্বপ্নলোক হরিনা গোপাল গ্রামে ফিরে যেতে পারছে। তার এই গ্রামকে সে মুছে ফেলতে পারেনি জীবন স্মৃতি থেকে। সেখানকার পথের উপর ফেলে রাখা তার পায়ের চিহ্নগুলো এত বছরে হয়ত মিলিয়ে গিয়েছে। কিন্তু ছায়াময় মায়াময় তার সেই গ্রামটি এখনও স্পষ্ট সুখ স্মৃতি হয়ে তার জীবন জুড়ে আছে।
কার্তিক মাসের শেষ। পথের দু ধারে মাঠের ভিতর হলুদ সরিষা ফুলের অপার সৌন্দর্য থই থই করছে। কাসুন্দা, ধুতুরা, কুচকাঁটা, বিকাশ লতা, ঝুমকো লতার দল জঙ্গলের মতো হয়ে একে অপরের সাথে নিবিড় হয়ে জড়িয়ে আছে। বিকালের হেমন্ত রৌদ্রের সাথে আকন্দ ফুলের গন্ধ যেন মিশে আছে চরাচরে— সেই সব কমনীয় রূপ আগেও ছিল, এখনও আছে। সে এই অপরূপ রূপের মধ্যে দিয়ে চলেছে বাড়ির দিকে।
যে রাস্তা দিয়ে সে রিকশা করে আসছিল সেই রাস্তাটি ছিল একসময় ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে। আঁকাবাঁকা ধূলির পথ ছিল। মানুষ হেঁটে চলত আর চলত গরুর গাড়িতে। এখন এই রাস্তাটি পিচঢালা হয়েছে। চলতে চলতে পথে সে খুঁজছিল ইছামতী নদী। খুঁজছিল শৈলাভিটা খেয়াঘাট। যে ঘাটে প্রতিদিন শত শত মানুষ খেয়া নৌকায় পারাপার হতো।
খেয়াঘাটের এই নদীতে একসময় অনেক জল থাকত। প্রায়ই ঘ গানের আসর বসত নদীর কুলে। গান শুনতে শুনতে কত খেয়া যে মিস করত পারাপার হওয়া মানুষ। এখন এখানে খেয়া ঘাট নেই। এখানে এখন কংক্রীটের বিশাল ব্রীজ।
নীচে ধূঁ-ধূ বালুচর। নদীতে এই সময় জল থাকে না। বোষ্টমীদের গানও আর শোনা যায় না।
ছেলেবেলায় একবার বাবার সাথে শহরে আসছিলাম। খেয়া ঘাটে নৌকা আসতে তখনো দেরি। এপাড়ে নদীর কূলে তখন বৌষ্টমীদের গান হচ্ছিল। বৌষ্টমের হাতে ছিল খঞ্জরী, আর বৌষ্টমী গেয়ে যাচ্ছিল গান। দু’জনেরই পরনে ছিল গেরুয়া রঙ্গের ধূতি। বাবার হাত ধরে আমি নিমগ্ন হয়ে গান শুনছিলাম। ভীড়ের ওপাশে চেয়ে দেখি — আমাদের গাঁয়ের লীলাবতী গান শুনছে ওর বাবার হাত ধরে। ওর পরনে ছিল ঝালরওয়ালা লাল নীল ফ্রক।
বৌস্টুমী যে গানটা গাচ্ছিল —
‘ও তোরা মন দিয়ে শোন্-
সে যে ছিল আমার মনেরই মতোন……..।’
গান শুনতে না শুনতেই খেয়া নৌকা এসে যায় ঘাটে। আমি বাবার হাত ধরে যেয়ে নৌকায় উঠি। বৌষ্টমী তখনো গেয়ে যাচ্ছিল গান। লীলাবতী ওর বাবার হাত ধরে শুনছিল সেই গান। নৌকায় বসে ওকে দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাাম। কিন্তু লীলাবতী আমার দিকে একবারও ফিরে তাকায়নি।
ক্রমেই বেলা পড়ে আসছিল। রিকশাটা এক সময় ঘোড়াচরা গ্রাম পার হয়ে হরিপুর গ্রামের ভিতর দিয়ে চলতে থাকে। এখানেও রাস্তার দুপাশে ফসলের মাঠ। দূরে ধনিদহ বিল। ঐ বিলের আরেক নাম পদ্মবিল। শত শত লাল আর গোলাপি রঙের পদ্মফুল ফুটে থাকত জলের উপর। এই রকম অপূর্ব শোভামন্ডিত জলাভূমি, স্বপ্নমাখা ফসলের মাঠ — পৃথিবীর কোনো প্রান্তেই সে দেখতে পায়নি। অতসীর ঝাড়, আমলকীর বন, আম গাছের কচি পাতার মিহি গন্ধ, অপূর্ব সুন্দর ঘোর লাগা সন্ধ্যা-পূর্ব বিকাল রোহিতের মনকে উদ্ভাসিত করে তুলছিল।
এরপরই আর একটি মাঠ পেরিয়ে রিকশাটি ধলডোব গ্রামের ঠাকুর পুকুর পাড়ের কাছে যেয়ে থামে। এটি ছিল ধলডোব গ্রামের শেষ সীমানা। তারপর কিছুদুর আলপথ দিয়ে হেঁটে গেলেই হরিনা গোপাল গ্রাম। রোহিত এই ঠাকুর পুকুর পাড়েই রিকশা থেকে নেমে পড়ে। সন্ধ্যার ছায়াতল দিয়ে, মাঠের ভিতর দিয়ে, মেঠো পথের বাঁক পেরিয়ে হেঁটে হেঁটে সে হরিনা গোপাল গ্রামে ওদের বাড়ির দিকে যেতে থাকে।
সে সময় সাঁজের পাখিরা পুকুরের ওপারের ঝোপের মাথায় কিচ কিচ করে ডাকছিল, পথের দুপাশে গুচ্ছ গুচ্ছ দূর্বাদল সারাদিনের রোদ্র তাপে মুড়ে পড়েছে। ডোবার ধারে ঘেঁটু ফুলের সাদা পাঁপড়ি থেকে বুঁনো গন্ধ আসছিল। সন্ধ্যার আলোছায়ায় কেউ কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছিল। ওরা হয়ত ভাবছিল — এ কোন্ অপরিচিত আগন্তুক কোথা থেকে এই গ্রামে এল। কিন্তু কেউই এগিয়ে এসে অচেনা এই মানুষটির সাথে কোনো কথাই বলল না।
মানুষ যখন সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালায় নিজ ঘরে। ঠিক সেই সময় রোহিত ওদের বাড়ির আঙিনায় এসে পা ফেলে। বাড়িটি দেখে বুকের ভিতর তার হুহু করে উঠে। মনের ভিতর এই রকম প্রতীতী জাগল –‘যখন জমবে ধুলা তানপুরাটার তারগুলায়, কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়, আহা, ফুলের বাগান ঘন ঘাসের পরবে সজ্জা বনবাসের, শ্যাওলা এসে ঘিরবে দিঘির ধারগুলায়– ‘
এই বাড়ির কেউ কী মনে রেখেছে তাকে? চিনতে পারবে কী এক সময়ের একুশ বাইশ বছরের উচ্ছল সেই তরুণকে। যে এখন পঞ্চান্ন ছাপ্পান্ন বছরের এই প্রবীন। ন্যুব্জ হয়ে গেছে যৌবন। যে ছেলেটা অপরিপক্ক ও অবাঞ্চিত এক অভিমান নিয়ে কোনো এক আঁধার রাত্রিতে গৃহ ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল।
বিদেশে থাকাকালীন সময়েই জেনেছিল সে তার সব হারানোর কথা। ১৯৭১ সালে বাগবাটী-ধলডোব-হরিনা গোপাল গ্রামে ম্যাসাখার করেছিল পাক সেনারা। ২৭ শে মে ভোরে, একটি যৌথ অভিযানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও আলবদর রাজাকাররা উল্লেখিত গ্রামগুলি ঘিরে ফেলে। তারা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শত শত লোককে হত্যা করে, এর ভিতর বেশিরভাগ ছিল হিন্দু। তারা অসংখ্য আবাসস্থল লুট করে আগুন লাগিয়ে দেয়।পাক আর্মিরা মেয়েদের ধর্ষণ করে। গণহত্যার পরের দিন, বেঁচে থাকা ব্যক্তিরা বাগবাটি ও ধলডোবের পূর্ববর্তী জমিদারদের নির্জন বাড়ির কূপে মৃতদেহ গুলি ফেলে দিয়ে মাটি চাপা দিয়েছিল।
এই নির্মম গণহত্যায় প্রাণ গিয়েছিল রোহিতদের পরিবারের সব সদস্যদের। সেদিন সে হারিয়েছিল তার বৃদ্ধ বাবাকে, অসুস্থ মাকে, বড় ভাইকে। ধর্ষিত হয়েছিল বৌদিদি ও ছোট বোন রোহিনী। ধর্ষণের পর পাকসেনারা তাদের দুজনকেও হত্যা করে ফেলে রেখে গিয়েছিল ।
সেই নির্জন ঘোর সন্ধ্যাবেলায় রোহিত মৃদু পায়ে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করে। দেখে — ভিতরের আঙিনায় কেউ নাই। ইঁদারা পাড় ঘন ঘাসে জঙ্গল হয়ে আছে। মনে হলো কতকাল ধরে এই ইঁদারা থেকে কেউ জল তোলে না। রান্না ঘরের কোণায় একটি বড়ো পিয়ারা গাছ ছিল, সেই গাছটিও নেই। রান্না ঘরের চালের মাটির টালিগুলো ভেঙেচুরে গেছে। বোঝা গেল, এই রান্না ঘরে দীর্ঘদিন ধরে কেউ রান্না করে না।
রোহিত তাদের পশ্চিম দুয়ারি বড়ো ঘরটির দিকে এগিয়ে যায়। দেখে ঘরের দরজা খোলা। ভিতরে একটি অল্প পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে। মনে হলো সন্ধ্যা আলোটা কেউ এখনই জ্বালিয়ে রেখেছে ৷ প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সী একজন মহিলা ধীর পায়ে দরজার কাছে চলে আসে। একজন অপরিচিত লোককে ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে চমকে ওঠে। আগন্তুক লোকটিকে সে জিজ্ঞাসা করে — ‘আপনি কে গো, কাকে চাচ্ছেন?’
রোহিত বলে — আমি রোহিত কুমার সেন। বাবা স্বর্গীয় অসিত কুমার সেন। আমি এই বাড়িরই লোক।
মহিলা বিস্ময়ে রোহিতের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর স্মিত হাস্যে বলে — ‘ও মা! তুমি রোহিত দা! এত বছর পর তুমি এলে! আমাকে তুমি চিনতে পারছ না? আমি ছায়া রাণী। তোমার খুরততো বোন’।
— হ্যাঁ, তোকে আমি চিনতে পারছি। তুই তো একেবারে বুড়ী হয়ে গেছিস। তোকে চিনব কী করে? আয় তো এই দিকে– তোর কপালখানি দেখি। মনে আছে তোর? আমগাছে ইটের টুকরো দিয়ে আম পাড়ার জন্য ঢিল দিয়েছিলাম, সেই ঢিলটি এসে পড়েছিল তোর কপালে। তোর কপাল জখম হয়ে রক্ত ঝরে পড়েছিল।
ছায়া রাণীর কপালে সেই দাগটি রোহিত আজও দেখতে পেল। কী এক অপার বিস্ময়েে তাকিয়ে দেখছিল দুজন দুজনকে। সেই কতকাল পরে রক্তের সম্পর্কের একজন মানুষকে তৃষা মিটিয়ে পরম স্নেহ দৃষ্টি দিয়ে রোহিত দেখতে থাকে। রোহিতের হাত থেকে ব্যাগটি নিয়ে ছায়া রাণী বলে, দাদা, তুমি ঘরে চলো, বসো, বিশ্রাম নাও ।
রোহিত ছায়া রাণীকে বলে — জামাই বাবু কই?
— বাজারে গেছে , দোকানে । একটু পরই চলে আসবে।
— তোর ছেলে মেয়ে কী?
— একটা মেয়ে ও একটি ছেলে। মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছি দাদা। গারোদহ গ্রামে শশুর বাড়িতে থাকে। আর ছেলেটা কলেজে পড়ে, আই এ সেকেন্ড ইয়ারে।
রোহিত যে খাটের উপর বসে কথা বলছিল, সেই খাটটিতে ওর বাবা মা শুইত। সিয়রের কাঠের উপর ময়ুরপঙ্খী ডিজাইন করা। ওয়াল ঘেষে একটি পুরানো কাঠের আলমারি। সেটিও ওর বাবা সখ করে মিস্ত্রি বাড়িতে এনে বানিয়েছিল। এখনও আলমারিটা সেই রূপই আছে। ঘরের এক কোণে ঠাকুরের ছোট্ট মূর্তি রাখার জায়গাটা শুচি পবিত্র করে রেখেছে ছায়া রাণী। ধূপধূনো ও প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছিল সন্ধ্যায়। সে ধূপ দীপ এখনও জ্বলছে।
ঘরের দেয়ালের পলেস্তারা গুলো খসে পড়ে গেছে। ছাদের পলেস্তারাও খুলে পড়েছে। ইটগুলো পোড়া মাটির মতো লাল হয়ে গেছে। বাইরের দিকে পরগাছা উঠেছে জায়গায় জায়গায়। রোহিত তাদের এই থাকার মেইন ঘরটি চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল, আর দীর্ঘশ্বাস ফেলছিল।
কী উৎসবমুখর ছিল এই বাড়িটা। মা বাবা বড়ো দা ও রোহিনীর কথা খুব মনে পড়ছিল রোহিতের। আজ কেউ নেই তারা। ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। রোহিত ছায়া রাণীকে বলে — যেদিন মিলিটারীরা এল, তোরা কোথায় ছিলি?
— আমি বাড়ির পিছনে জঙ্গলের ভিতর লুকিয়ে ছিলাম। ওরা মাকে কিছু বলে নাই। কিন্তু বাবাকে গুলি করে মেরে রেখে গেছে। দাদাকেও। আমাদের বাড়ি ও তোমাদের বাড়ি পাকসেনা ও রাজাকারেরা প্রথম আক্রমণ করে। কেউ পলানোর সুযোগ পায় নাই। তাই ম্যাসাখারটা তোমাদের বাড়ি ও আমাদের বাড়িতে বেশি হয়েছে।
— বাবা মা বড়োদা ভাই, বৌদিদি ও রোহিনীর লাশ কী দাহ করা হয়েছিল?
— না। দাহ করা হয় নাই। বেশির ভাগ লাশ জমিদার বাড়ির পরিত্যক্ত কূপের ভিতর ফেলে দিয়েছিল। জেঠামশায়, জেঠিমা সহ সবার লাশও কূপের ভিতর ফেলে দিয়েছে। ওখানেই অন্ধকার মৃত্তিকা তলে সবাই মিশে গেছে।
ইতোমধ্যে বাজার থেকে জামাইবাবু চলে আসে। ছায়া রাণী রোহিতকে ওনার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ছায়ারাণী রোহিতকে বলে — ‘দাদা, তুমি এই ঘরে এই খাটের উপর ঘুমাও। আমরা পাশের ঘরে ঘুমাব।’ এই বলে ওরা দুজন চলে যায় পাশের ঘরে।
০৫.
রাতে খাটের উপর রোহিত শুয়ে আছে। ঘুম আসছিল না চোখে। মনে পড়ছিল তার পূর্ব পুরুষদের কথা। ঘুমহীন চোখের সামনে তারা বিচরণ করছিল। পিতামহীর মুখে সে শুনেছিল — ‘নববধূরূপে প্রথম যেদিন সে এই বাড়িতে এসেছিল– দুধে-আলতায় পা রেখে দাঁড়িয়েছিল এ বাড়ির প্রাঙ্গণে।’ ‘আজ এই প্রাঙ্গনে তারা কেউ নেই। স্বর্গের বাড়িতে তারা চলে গেছে। হয়ত সেখানে তারা এখন ভালো আছে।
ঠিক পিতামহীর মতো মাও একদিন এই বাড়িতে এসে প্রাঙ্গনে দূধে আলতায় পা রেখে দাঁড়িয়েছিল। মা আজ নেই। সেও বাবাকে সাথে করে স্বর্গলোকে চলে গেছে। আমার জন্য কেউ আজ এই বাড়ির প্রাঙ্গনে এসে দাঁড়াল না। কেউ বলল না, খোকা তুই ফিরে এসেছিস! তোর জন্য কাঁদতে কাঁদতে আমার দুই চোখে ঘা হয়ে গেছে।’
গভীর রাত্রে স্বপ্নের ঘোরে পূর্বপুরুষদের অনুযোগ করে রোহিত বলছিল — ‘ কেন তোমরা আমাকে ছেড়ে চলে গেলে? কী করেছিলাম আমি? আমিও ঠিক একদিন চলে আসব তোমাদের কাছে।’
পাশের ঘরে জামাইবাবু ছায়াকে বলছিল — দাদা এতদিন পর কী উদ্দেশ্যে যে বাড়িতে আসল? নিশ্চয়ই কোনো মতলব নিয়ে এসেছে। বাড়ি ঘর, জমি জিরাত, বাজারের দোকানপাট সব মনে হয় বিক্রি করে দিয়ে টাকা পয়সা নিয়ে একেবারে পাততারি গুটিয়ে চলে যাবে। ‘
ছায়া রাণী বলছিল — তুমি এইসব আজেবাজে কথা বলো না। দাদা কত বছর পরে এল। নিশ্চয়ই তিনি মাটির টানে, পূর্ব পুরুষদের পুন্য আত্মার আহবানে নিজের জন্মস্থান দেখার জন্য এসেছে। দাদাকে আমি খুব শ্রদ্ধা করি। আর তিনি যদি সব বিক্রি করে দিয়ে চলেও যায়, যাবে। তার জিনিস তিনি যা করবেন, করবে। তুমি এসবের উপর দৃষ্টি দিও না।
ভোরবেলা রোহিতের আচমকা ঘুম ভেঙে যায়। তার কাছে মনে হয়েছিল — ঠিক যেন মায়ের মতো বিছানার পাশে এসে কেউ একজন বলছে —
‘ বাবা, তুমি ওঠো। তুমি সেই এলে ! তোমার জন্য আমি কত অপেক্ষা করেছি পথের দিকে চেয়ে। মনে হতো — এই বুঝি তুমি চলে এলে। কিন্তু আসোনি। আমি তোমার জন্য কেঁদে কেঁদে চোখ অন্ধ করে ফেলেছি। সেই তুমি এলে বাবা। যখন আমি জীবন নদীর এপারে চলে এসেছি তখন।’
শুয়ে থেকেই বালিশে মুখ গুজে রোহিত বিড়বিড় করে বলছিল — ‘মা, তুমি যখন ছিলে এই বাড়ি মুখর হয়ে থাকত , তুমি আজ নেই। কেমন নিরব চারদিকে। তুমি থাকলে মুখর সব , না থাকলে মন খারাপ লাগে। তুমি আসবে না মা? তোমার পায়ের শব্দে আনন্দ ভৈরবী বেজে ওঠে পথে পথে। মনে হয় তুমি আসছ।
‘মা, তুমি আর কখনোই আসবে না জেনেও, দৌড়ে চলে যাব ঘরের বাইরে । যেয়ে দেখব — পথের উপর নির্জনতা’রা ক্রন্দন করছে।’
রোহিত বিছানা হতে উঠে মেঝেতে পা রেখে খাটের উপর বসে। কোথা থেকে আসা বেলী ফুলের গন্ধ পাচ্ছিল সে। হঠাৎ তার মনে হলো — বহু বছর আগে পুকুরের চালায় মা বেলী ফুলের গাছ লাগিয়েছিলেন। যে বছর সে বাড়ি ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল সেই বছর।
রোহিত দরজা খুলে বাহির আঙিনা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের পাড়ে চলে যায়। এক জায়গায় দেখতে পায়, অনেকগুলো বেলী ফুলের গাছে জঙ্গল হয়ে আছে। মা ঠিক এই জায়গাতেই কয়েকটি বেলীফুলের চারা লাগিয়েছিল। সেই চারা কটি-ই জঙ্গল হয়ে গেছে অনাদরে আর অপরিচর্যায়। আর এই জঙ্গল থেকেই বেলী ফুলের বুঁনো গন্ধ ভেসে গিয়েছিল ঘরে। এই বেলী ফুল সেই কতকাল পূর্বের কোনো এক বিস্মৃত অতীতের কথা তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল। মায়ের শরীরের গন্ধের ন্যায় আজিকার এই ফুলের গন্ধ সৌরভ ছড়াচ্ছে এই বাড়ির সারা আঙিনাতে।
কেমন যেন উদাস উদাস লাগছিল তার। সে পুকুরের ঘাটের দিকে এগিয়ে যায়। ঘাটের পাকা সোপানগুলো জায়গায় জায়গায় ফেটে গেছে। আগাছা উঠেছে ফাঁক ফোকর গুলো থেকে। শ্যাওলা আর কচুরিপানায় পুকুর ভরে গেছে। বহুবছর ধরে কচুরিপানা যে পরিস্কার করা হয় না। এটা বোঝা গেল।
পুকুরের একপাশে ছিল একটি বকুল গাছ। হঠাৎ মনে পড়ল তার সেই বকুল ফুলের গাছটির কথা। একবার রোহিনী বকুল ফুলের মালা গেথে এক রাখী বন্ধনের দিনে তার হাতে পরিয়ে দিয়ে বলেছিল — দাদা, তোমার জন্য এটা আমার রাখী। তুমি এরকম করে আমায় বেঁধে রেখ তোমার স্নেহে আর মায়ায় ।’ রোহিত সেই গাছটি খুঁজে পেল না। শুধু মরা শুকনো গুড়িটি মাটির উপর এখনো লেগে আছে।
রোহিত মন খারাপ করে বসেছিল ঘাটের ভাঙা সোপানের উপর। দুঃংখ জাগানিয়া কত স্মৃতিকথা মনে হচ্ছিল তার। যখন সে ভাবছিল সেইসব স্মৃতি কথা, তখনই ছায়া রাণী এসে তাকে ডাক দেয়– ‘দাদা, বাড়ির ভিতর চলো। নাস্তা খাবে। তোমার জামাই বাবু অপেক্ষা করছে।’
নাস্তা খেতে বসে রোহিত ছায়া রাণীকে বলছিল — আমি কয়েকদিনের জন্য এখানে এসেছি। তারপর, চলে যাব।
— দাদা, রাতে তোমাকে বলা হয়নি। আমাদের বৌদিদিকে তুমি যে আনলে না। এবং ভাইজি ভাইপুতদেরও।
— হা হা হা, আমি তো এখনও বিয়েই করিনি রে! আনব আর কাকে?
— কেন তুমি এখনও বিয়ে থা করোনি?
— ‘ সে অনেক আফসোসের কথা। পৃথিবীর কত দেশ ঘুরলাম, কতজন কে দেখলাম — কাউকেই মনের মত করে পছন্দ করতে পারলাম না। একটা না একটা খুত থেকেই যায়। এইভাবে খুঁজতে খুঁড়তে কখন যে এতগুলো বছর চলে গেছে, বুঝতেই পারিনি। আর এখন তো বুড়োই হয়ে গেছি। এখন বিয়ে করলে মানুষ হাসবে। তাই বাদ দিয়েছি এই সাবজেক্ট। পরজনম বিশ্বাস করি না। তারপরও যদি থাকে — সেই জনমে না হয় কাউকে খুঁজে নিব।’
রোহিত জামাই বাবুকে বলছিল — তুমি কেমন আছো? তোমার ব্যাবসা কেমন চলছে?
— ঠাকুরের দোয়ায় ভালোই আছি। পুঁজিপাটা তেমন নেই। আপনার দোকান ঘরটাতেই কোনোভাবে দোকানদারী করে যাচ্ছি।
— ওহ! আচ্ছা।
রোহিত ছায়াকে বলছিল– আমাদের গ্রামে যে হাসান আলী মাস্টার ছিলেন, ওনার খবর কী? উনি কী বেচে আছেন?
— না দাদা উনি মারা গেছেন অনেক আগেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরের বছর। ওনার স্ত্রী তারও আগে মারা যান। ওনাদের যে মেয়েটা ছিল নাম রেবেকা। সেও মারা গেছে তুমি চলে যাওয়ার বছর খানেকের মধ্যে ।
তুমি চলে যাওয়ার কয়েকদিন পরই ওর বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পরপরই অন্তঃসত্ত্বা হয়। দূর্ভাগ্য, প্রসবকালীন সময় সে মারা যায়। বাচ্চাটা এখনও আছে। মেয়ে হয়েছিল । নাম — মণিকা। অনেক বড়ো হয়ে গেছে। বিয়েও হয়েছে। ওর ঘরে একটা মেয়েও হয়েছে। বয়স পাঁচ ছয় বছর হবে । স্বামী একজন উকিল। নাম নাসির উদ্দীন। সিরাজগঞ্জ শহরে আমলা পাড়াতে থাকে।
রোহিত ভিতরে ভিতরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সেই দীর্ঘশ্বাসের তপ্ত বাতাস কারোরই গায়ে লাগল না। তার অন্তরমহল কেঁপে উঠল, সে কাঁপনও কেউ অনুভব করতে পারল না । চোখের ভিতর জল ছপছপ করছিল, সে জলও গড়িয়ে পড়েনি ললাটে বেয়ে।
রোহিত ছায়াকে বলে — হাসান মাস্টারের যে একটি ছেলে ছিল নাম রাসেল, ওর খবর কী?
—ওতো বেঁচে নেই। মুক্তিযুূদ্ধের সময় ওর টায়ৈয়েড হয়েছিল। বিনা চিকিৎসায় সে মারা গেছে। পাক সেনাদের ভয়ে ওকে শহরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করতে পারে নাই।
— আর রেবেকার স্বামী? সে কোথায়?
— সেও নেই। পাঁচ বছর আগে সে পরপারে চলে গেছে। উনি আর বিয়ে করে নাই। মেয়েকে উনিই লালন পালন করেছে। বড়ো করেছে। লেখাপড়া করিয়েছে। এবং বিয়েও দিয়ে গেছে। মনে হয়েছে মেয়ের জন্যই সে বেঁচে থেকেছিল।
রোহিত ছায়াকে বলে — আমার বাল্যবন্ধু শহীদুল এখন কোথায় আছে? জানিস? বাগবাটী স্কুলে আমরা দুজন একই সাথে পড়েছি।
— শহীদুল ভাই গ্রামের বাড়িতেই থাকে দাদা। সে বাগবাটী স্কুলেই শিক্ষকতা করে।
— আচ্ছা।
সবার নাস্তা খাওয়া শেষ হয়। রোহিত উঠে দাঁড়ায়। এবং ছায়াকে বলে — ‘আমি একটু ঘুরে আসি।
— কোথায় যাবে দাদা?
— শহীদুলদের বাড়ি।
০৬.
বহু বছর পর রোহিত যাচ্ছে শহীদুলদের বাড়িতে। কৈশোরে আর তারুণ্যে কত সময় ওরা দুজন একসাথে কাটিয়েছে। প্রায়ই শহীদুল চলে যেত রোহিতদের বাড়িতে, না হয় রোহিত আসত শহীদুলদের বাড়িতে। চিরকালের সেই চেনা পথ দিয়েই রোহিত আজ চলে আসে শহীদুলদের বাড়িতে। বাড়ির বড়ো উঠোনেই ওর সাথে দেখা হয়ে যায়। পয়ত্রিশ বছর পর দেখা। কিন্তু চিনতে একটুও অসুবিধা হয়নি। কোনো দ্বিধা না করেই শহীদুলকে রোহিত বলে — ‘তুই কেমন আছিস শহীদুল?’ শহীদুলও রোহিতকে চিনে ফেলে এবং জড়িয়ে ধরে বলে — ‘রোহিত, তুই? এত বছর পর তোর দেখা পেলাম।’
দুই বন্ধু আপ্লূত হয়ে কিছু সময় একে অপরকে জড়িয়ে ধরে থাকে। খুশির আনন্দ অশ্রুতে ভিজে যায় দুজনেরই নয়ন।
শহীদুল রোহিতকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় বাড়ির ভিতরে। বিছানায় বসিয়ে ওর স্ত্রী শেফালী কে ডেকে নিয়ে আসে। রোহিতকে দেখিয়ে পরিচয় করে দিয়ে বলে, এই হচ্ছে রোহিত। আমার প্রাণের বন্ধু। যার কথা তোমাকে কত হাজার বার যে বলেছি। তার ইয়ত্তা নেই।
অনেক বছর পর দুই বন্ধু দুজনকে কাছে পেয়ে নানা স্মৃতিচারণ করতে থাকে। রোহিত শহীদুলকে বলে — তোর কথা কিছু বল, নিশ্চয়ই অনেক ঘটনা ঘটে গেছে এই পয়ত্রিশ বছরে ! সেই সব বল, শুনি।
শহীদুল বলছিল — ‘জীবনে কত প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি অপূর্ণতা রয়ে গেল। কতকিছু পেয়েছি যেমন, আবার হারিয়েছিও অনেক। আল্লাহর কী অসীম মহিমা এখনও বেঁচে আছি। তার করুণার দানেই এই জীবন পার করে দিলাম। কত ঘাত, কত আনন্দ বেদনা, কত সুখ, কত অপূর্ব জ্যোৎস্না-রাত্রি এসেছে জীবনে। এই গ্রামে ঝোপে ঝাড়ে কত নতুন নতুন ফুল ফুটেছে। কত সন্ধ্যা তারা নিভে গেছে, কত কোমল হৃদয় ভেঙে গেছে। কান্না জড়ানো কত মধুর স্মৃতি, কত দিন রাত্রির কাব্য গাঁথা রচিত হয়েছে ।’
‘মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে চুপিচুপি গান শুনি। এরকম করে গান শোনাও খারাপ। তবুও শুনি। কিছু গান থাকে সৃষ্টির অমৃত সুধাকে পান করায় এমনই রাত্রির মধ্য প্রহরে। কিছু সুর থাকে স্নায়ু বিকল হয়ে যায় , হাড় হীম হয়ে আসে। শুনি সেই গান রাতের নিবিড়ে গোপনে। ‘ যতবার আলো জ্বালাতে চাই নিভে যায় বারেবারে।’
একটি চাওয়া সবসময় চিত্তকে আকুল করে। হাসিমুখ রাখতে চাই। হাসির ওপিঠে দুঃখ কেউ যেন না দেখতে পায়। হাসিটুকু রেখে যেতে চাই।
তারপর ক্রমশ গানের কথার মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। সুরের সঙ্গে ভেসে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না আমার।
“যেটুকু প্রহর বাকী সুপটু হাতের ফাঁকি
কিছুটা সময় আঁকি
জামার গায়।
সে জামা হলুদ ভোরে তোমারি কপোল জুড়ে
ঠোঁটের অনতিদূরে
রোদ পোহায়।”
— তোর অনিতা দেব বর্মনের খবর কী? ভাবীকে দেখলাম, সে তো অনিতা নয়।
— আমি মুক্তি যুদ্ধে চলে গিয়েছিলাম। ভারতের আসামের ধুবড়িতে ট্রেনিং নিয়ে সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের আন্ডারে ২ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধে অংশ নেই। খালেদ মোশাররফ, যিনি পরবর্তীকালে কে ফোর্সেরও অধিনায়ক ছিলেন। আমরা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় ঢুকে পড়ে সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছিলাম। যুদ্ধ শেষে যখন গ্রামে ফিরে আসি, দেখি — আমাদের এই জনপদ পাকিস্তানি আর্মিরা এ দেশের বাজাকার আলবদরদের সাথে নিয়ে এখানে হত্যা যজ্ঞ চালিয়েছে। আমাদের এই হরিনাগোপাল গ্রামেই দুইশত মানুষকে তারা হত্যা করে। আমার বাবাকেও মেরে ফেলে। আমাদের বাড়ি ঘর আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়।
— তারপর?
অনিতাকে পাক সেনারা ধর্ষণ করে গুলি করে মেরে ফেলে রেখে যায়। অনিতার দুই ভাই এবং ওর বাবাকেও পাক সেনারা গুলি করে মেরে ফেলে। জানিস রোহিত — যেদিন যুদ্ধে যাই তার আগের দিন সন্ধ্যা রাতে অনিতা আর আমি মন্দিরে গিয়েছিলাম। ও পূজো দেয়ার জন্য মন্দিরে ঢোকে। আমি বাইরে বেল গাছ তলায় দাঁড়িয়ে থাকি। পুজা শেষে অনিতা মন্দির থেকে বের হয়ে এসে সন্ধ্যা রাত্রির অন্ধকারে আমাকে প্রণাম করে বলেছিল — দেশ যখন স্বাধীন হবে, তুমি তখন লাল সবুজের ঝান্ডা উড়িয়ে গান গাইতে গাইতে চলে আসবে এই গ্রামে । আমিও হারমনিকা বাজাব বাড়ির উঠোনে নেচে নেচে। তারপর একদিন তুমি —-
‘স্বপনদুয়ার খুলে এসো অরুণ-আলোকে
মুগ্ধ এ চোখে।
ক্ষণকালের আভাস হতে চিরকালের তরে এসে আমার ঘরে।’
— সরি, শহীদুল, তোকে আমি অনিতার কথা মনে করিয়ে দিয়ে দুঃখ দিলাম।
— অনিতাকে একটুও ভুলতে পারিনা রে! আমার শত কর্মের মাঝে ও চুপিচুপি চলে আসে।
শত বছর পরে কোনো এক শ্রাবণে বৃষ্টি সন্ধ্যা রাত্রিতে হয়ত মাটির ফোড়া কাটা ঝোপে ঝাড়ে লুকিয়ে ঝিঁঝি পোকা ডাকবে। বাঁশঝাড়ের আড়ালে আঁধার করা বনমৌরির গন্ধে যখন রাতের জোনাকিরা আকুল হবে — সেই রাতের গোপনে হয়ত সে আবার ফিরে আসবে এই হরিনা গোপাল গ্রামে। আমিও মরে যাব একদিন। আমিও হয়ত ফিরে আসব। চেনার মতো আজিকার কোনো মানুষ হয়ত তখন থাকবে না। এই পৃথিবী নামে গ্রহে তখন অন্য রূপে আসব। তুচ্ছ কোনো কিছু হয়ে। হয়ত ঝিঁঝি পোকা কিংবা সন্ধ্যা নিশীথের নীল নীল জোনাকি হয়ে।
শহীদুলের চোখের কোণ্ জলে ভিজে চিকচিক করছিল। রোহিত ওকে বলে — তোকে আমি অহেতুক কাঁদালাম।
— ধলডোবের দোলা মিত্রের কথা শুনেছিস না ! তুই যখন গ্রাম ছেড়ে চলে গেলি, তখন ও বালিকা ছিল। মুক্তি যুদ্ধের সময় ও ক্লাস নাইনে পড়ত। আমি তখন স্কুলে নবীন শিক্ষক। দোলা আমার সরাসরি ছাত্রী ছিল। মেয়েটি ভালো গান গাইত। পাক সৈন্যদের কালো হাতের থাবা থেকে সেদিন দোলাও রক্ষা পায়নি। সেও ধর্ষিত হয়েছিল। লজ্জ্বায় আর গ্লানিতে দোলাদের পরিবার স্মরণার্থী হয়ে সেই যে ভারতে চলে গিয়েছিল, তারপর আর ওরা ফিরে আসে নাই এই দেশে। শুনেছি ওরা নাকি ভারতের শিলিগুড়িতে থাকে।
শহীদুল রোহিতকে বলে — মুক্তিযুদ্ধের সময় তুই কোথায় ছিলি?
— আমি তখন লন্ডনে পিএইচডি করছিলাম। এপ্রিল মাসের কোনো একসময় ট্রাফালগার স্কোয়ারে অনেক প্রবাসী বাঙালি পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে গমহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে সমাবেশ করেছিল। সমাবেশ শেষে প্রবাসী বাঙালিরা ডাউনিং স্ট্রীটস্থ বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর অফিসের দিকে মিছিল নিয়ে যায়। সেখানে তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে স্মারকলিপি প্রদান করে। সেদিনকার সেই মিছিলে ফরিদ আহমেদ, লুলু বিলকিস বানু , ফেরদৌস রহমান, সুলতা শরীফ, বদরুল হোসেন তালুকদার প্রমুখদের সাথে আমিও উপস্থিত ছিলাম।
তাছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে লন্ডনে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সভা, সমিতি, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে অংশ গ্রহণ করেছিলাম।
— আয়, আমরা দুজন এই গানটি কবিতার মতো করে একসাথে আবৃত্তি করি । খুব শ্রদ্ধা জানাতে ইচ্ছে করছে শহীদদের প্রতি ও বীরাঙ্গনাদের প্রতি।
‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হল বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে/ কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা, বন্দীশালার ওই শিকল ভাঙ্গা, তাঁরা কি ফিরিবে আজ সু-প্রভাতে,
যত তরুণ অরুণ গেছে অস্তাচলে।’
শহীদুল রোহিতকে বলে, তুই কি সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিস?
— না। তবে বেশি খাই না। মন খারাপ হলে খাই। মাঝে মাঝে মনে হয়, এই সিগারেটই প্রকৃত বন্ধু। ঐই দুদণ্ড শান্তি দেয় আমাকে। ও কোনো ফাঁকি দেয় না। এই মনে কর্, এখন খুব খেতে ইচ্ছে করছে।
— তোর কি মন খারাপ লাগছে?
— হুম।
— চল বাইরে পুকুর পাড়ে ছাতিম তলায় যাই। ওখানে যেয়ে খাই।
— চল্।
রোহিতই শহীদুলকে সিগারেট ওফার করে। দুই বন্ধু ছাতিম তলায় চেয়ার পেতে বসে সিগারেট খেতে থাকে।
শহীদুল রোহিতকে বলে — তুই একটা প্রশ্নের উত্তর দিবি আমাকে?
— বল। সম্ভব হলে উত্তর দিব।
— তুই গৃহ ত্যাগ করেছিলিি কেন? কী হয়েছিল তোর?
— না, এই প্রশ্নের উত্তর তোকে আমি দিব না। আমার জীবনের এই গোপন কথাটি আজ পয়ত্রিশ বছর ধরে গোপন রেখেছি। কাউকে বলিনি। বলবও না কখনও। কারণ, আমি যে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলাম ও আছি। বললে গীতাকে অপবিত্র করা হবে।
— তোর এই গোপন কথাটি আর কেউ কি জানে?
— যারা জানত তারা কেউ আজ আর বেঁচে নেই। সবাই পরপারে চলে গেছে।
— তোর কী মনে হয় না, তুই ভুল করেছিলি চিরদিনের জন্য গৃহ ত্যাগ করে।
— চিরদিনের জন্য আর হলো কই? এই তো কয়দিনের জন্য এলাম তো ফিরে। তবে হ্যাঁ, আমি ভুল করেছিলাম।
— তা, বিয়ে করিস নাই কেন?
— পৃথিবীর পথে পথে কত খুঁজেছি একজন মনের মানুষকে, কিন্তু মনের মতো মনের মানুষ কোথাও খুঁজে পাইনি। একবার অস্ট্রিয়ার একটি অজো গ্রামে গিয়েছিলাম। ওখানে ঐ জনপদে ভিন্ন প্রকৃতির, ভিন্ন জাতি সত্বার মানুষ বসবাস করে। তাদের নৃতাত্ত্বিক বিবর্তনের উপর কিছু উপাত্ত সংগ্রহ করাই আমার কাজ ছিল।
নদীর নাম মোরাভা।
ঠিক আমাদের ইছামতী নদীর মতো ছোট্ট একটি নদী বয়ে এসেছে কোথা থেকে, জানতাম না । পরে জেনেছি — নদীটির উৎপত্তি স্থল ছিল দানিয়ুব নদী। স্লোভাকিয়ার বুক চিরে ভেসে ভেসে এসেছে সে অস্ট্রিয়ার এই নির্জন সমতটে। স্লোভাক আর রোমার এই দুটি জাতি স্বত্বার সংমিশ্রণে বিবর্তিত নৃগোষ্ঠির মানুষেরা এখানে এসে বসতি স্থাপন করেছিল।
একটি গ্রাম্য বধু স্নান করে উঠে আসছিল ঘাট থেকে। দেখতে একদম বাঙালি রমণীর মতো লাগছিল । মেয়েটিকে দেখে মনে হয়েছিল — তাকে আমি এর আগে কোথায় যেন অনেক দেখেছি। আমি ওর কাছে যেয়ে কথা বলবার চেষ্টা করি। বলেছিলামও কথা ওর সাথে – ‘মেয়ে, তোমাকে আমি জন্মজন্মান্তর ধরে চিনি।’ কিন্তু ও আমার কথা কিছুই বোঝেনি।
ডরমেটরীতে ফিরে আসার পর মন কিছুতেই ভালো লাগছিল না। বারবার মনে পড়ছিল ঐ মেয়েটির কথা। পরের দিন আবার গেলাম ওকে খুঁজতে। কিন্তু ওর কোনো দেখা পেলাম না। তারপরের দিন আবার যাই। সেদিনও দেখা পেলাম না। যেদিন ভিয়েনা ছেড়ে চলে আসব, তার আগের দিন আবার যাই ঐ জনপদে ছোট্ট ঐ স্বচ্ছতোয়া নদীটির তীরে। কত খুঁজেছি তাকে। একে ওকে কতজনকে জিজ্ঞাসা করেছি কেউ ওর খোঁজ দিতে পারেনি।
প্রায়ই ঐ মেয়েটির কথা মনে পড়ে। ওগো লক্ষ্মী মেয়ে! তুমি কী এখনও আছ সেখানে ? সুদীর্ঘ কত বছর চলে গেছে। আজও তুমি কি সেই নির্জন নদীর কূলে ভাঙা ঘাটে স্নান করতে আসো? তোমাকে খুব মনে পড়ে…তোমাকে আবার দেখতে বড়োই ইচ্ছে করে….. অনেক দূরের কোনো বনপাতার ঘরে তুমি কী প্রদীপ জ্বালাও মৌন সন্ধ্যায়? আবার যদি যাই, দেখা কী পাব
তোমার?
— খুব তো সুন্দর গল্প কথা শোনালি। তা এটি কী সত্য কথা ! নাকি আসল কথাটা আড়াল করে গেলি।
— সত্যটাও সত্য, মিথ্যাটাও সত্য।
— তোর কী এই দেশের জন্য প্রাণ কাঁদত না?
— এই দেশের মাটি, জলবায়ু, আকাশ, বৃক্ষরাজি ও নদীর জন্য প্রায়ই মন তৃষিত হয়ে ঘাকত। যখনই কোনও অস্তমিত সন্ধ্যাবেলায় টেমস কিংবা স্যাভরন নদীর পাড়ে গিয়েছি, তখনই মনে হতো ইছামতী ও যমুনা নদীর কথা। বিস্মৃতপ্রায় ঝাপসা ছবির মতো মনে ভেসে উঠত — নিভৃত পল্লিগ্রামের জীর্ণ শানবাঁধানো পুকুর ঘাটের কথা। পুকুরের জলে ভেজা লক্ষ্মীর চরণচিহ্নের মতো মায়ের জলসিক্ত পা দু খানির রেখা আঁকা পদচিহ্নর কথা…আঁধার সন্ধ্যায় আম কাঁঠালের বনের মাথার ওপরের আকাশে দু-একটা নক্ষত্র জ্বলে ওঠার কথা । শান্ত আঙিনায় তুলসী মঞ্চমূলে মঙ্গল প্রার্থিনী সে কোন্ পূজারত মাতৃমূর্তি, করুণামাখা অশ্রু ছল ছল তার চোখের কথা … ।
শহীদুলের স্ত্রী শেফালী দুই বন্ধুর জন্য প্লেটে করে পিয়ারা কেটে দিয়ে যায়। এবং রোহিতকে বলে যায় — দাদা, আজ দুপুরে আমাদের এখানেই ডাল ভাত খাবেন।
শহীদুল বলছিল — একটা সুখের কোনো ঘটনা বল্, যা শুনে মনটা যেন একটু ভালো হয়। আর একটা সিগারেট দে খাই।
— লন্ডনে যে ইউনিভার্সিটি থেকে এমফিল করছিলাম — ওখান থেকেই একবার ব্রাজিল গিয়েছিলাম। রিও ডি জেনেরিওর একটি ইউনিভার্সিটির সাথে আমাদের ইউনিভার্সিটর এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম ছিল। উদ্দেশ্য ছিল আমাজনের আদিবাসীদের জীবন যাত্রার উপর এ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করা ।
আমার সাথে আরও তিনজন তরুণ গবেষক ছিল। এর ভিতর দুজন ছিল মেয়ে । রিও ডি জেনেরিও থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে আমাজন অরণ্য অবস্থিত । সেই অরণ্যে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠির আদিবাসীদের বাস। তার একটি হলো — ‘আয়োরো’। এই আয়ারো আদি গোষ্ঠীকে নিয়েই আমাদের এ্যাসাইমেন্ট ছিল।
আয়োরো আদিবাসীদের বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন আদিবাসী গোষ্ঠী।
এরা মূলত পশুপালন করে । এক একটি পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকে কমপক্ষে শতাধিক শূকর। এই গোষ্ঠীর সমাজে যখন কেউ
প্রাপ্তবয়স্ক হয় তখন তাকে নিজ চেষ্টায় ঘর তৈরি করতে হয়। ঘর তৈরি করার সক্ষমতা অর্জন করলেই বর্ষায় তাকে বিয়ে দেয়া হয়। আর বর্ষার শুরুর আগে প্রথম যেদিন পাখি ডাকে সেদিন শুরু হয় আয়োরো আদিবাসী গোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় উৎসব ‘আছোঞ্জা’। পুরো একমাস ব্যাপী এই উৎসব চলে।
রিও থেকে আমরা প্রথম চলে গিয়েছিলাম আমাজন নিকটবর্তী একটি ছোট্ট শহরে। তারপর আমাজনের সেফ জোনে যেয়ে আমরা তাবু পেতেছিলাম। একমাস সেই তাবুতে ছিলাম। কী আনন্দময় জীবন ছিল , যাকে বলে ‘দ্যাট ওয়াজ রিয়াল ন্যাচারাল লাইফ টুগেদার। যে একমাস ছিলাম জীবনের সব দুঃখ বেদনা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম আমাজনের গভীর জঙ্গলেে। আমাদের মূল শ্লোগান ছিল — Life is ours, we live it our way.
আমাদের সাথে যে দুজন মেয়ে ছিল তার একজনের নাম ছিল সান্ডি আরিস্তা। ও এসেছিল স্পেনের বার্সিলোনা থেকে। তেইশ চব্বিশ বছরের স্প্যানিশ উচ্ছ্বল তরুণী। ও আমার রিসার্চ
মেট ছিল। আমরা দুজন প্রায়ই হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম গভীর অরণ্যে। ও ছিল সাংঘাতিক ভিতু প্রকৃতির। এক জায়গায় এক নীল জলের শীর্ণা নদীর কূলে বসে দুজন গল্প করছিলাম। জলের ছোট ছোট ঢেউ দেখছিলাম চেয়ে চেয়ে। কারোরই কোনো চাওয়া নেই। সান্ডি আরিস্তা শুধু আমাকে বাহু বন্ধনে বেঁধে রেখেছিল। নির্জন সেই বন-ক্রোরে নীল আকাশের নীচে কী আর কথা থাকে?
অরণ্য ঘেরা নদীর কূলে আরক্ত চাঁপাফুলের কি যে মৌ মৌ গন্ধ, সিক্ত হলো ঘাস — স্বর্গীয় আশীর্বাদে ঋদ্ধ হলো দুজন। এক গভীর নিবিড় আলিঙ্গনে একাত্ম হয়ে গেলাম। শুধু ‘তোমারি আনন্দ আমার দুঃখে সুখে ভরে / আমার করে নিয়ে তবে নাও যে তোমার করে। / আমার বলে যা পেয়েছি শুভক্ষণে যবে,/ তোমার করে দেব তখন তারা আমার হবে– সব দিতে হবে।’
শুনলি তো, আমার আনন্দময় একটি ঘটনার কথা। একটা কথা তোকে বলি — জীবনের আনন্দময় ক্ষণ খুবই ক্ষণকালের হয়। সান্ডি আরিস্তার চোখের জল মিশেছিল আমাজনের শীর্ণা নদীটির নীল জলে, আর আমার দীর্ঘশ্বাস মিশেছিল সেখানকার হিমেল বাতাসে।
০৭.
শহীদুলের ওখান থেকে বাড়িতে এসে রোহিত বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। ভেবেছিল একটু ঘুমাবে। কিন্তু ঘুৃম আসে নাই চোখে। ছায়া রাণী চা বানিয়ে এনে বলে — ‘দাদা, ওঠো খেয়ে নাও।’ রোহিত চা খেতে খেতে ছায়াকে বলে — ‘পুরনো জমিদার বাড়ির পরিত্যক্ত কূপ দেখতে যাব, যেখানে মা, বাবা, বড়ো দা, বৌদিদি ও রোহিনীর লাশ ফেলে দিয়েছিল। তুইও চল্ আমার সাথে।’
— আচ্ছা, যাব তোমার সাথে।
রোহিত ও ছায়া রাণী বিকালের গোধূলি লাল আভার ছায়া পড়া সবুজ মাঠের পাশে দিয়ে হেঁটে হেঁটে জমিদার বাড়ির কূপটির কাছে চলে যায়। রোহিত দেখতে পায় স্থানীয় মুুুুক্তিযোদ্ধা সংসদ কূপটিির পাশে একটি স্মৃতিসৌধ তৈরি করেছে। বেদিতে সব শহীদদের নাম লেখা আছে। সেখানে ওর বাবা মা ভাই বোনদের নামও লেখা আছে। রোহিত ও ছায়া রাণী সৌধের পাদমূলে দাঁড়িয়ে নিরবে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে এবং তাদের আত্মার শান্তি কামনা করে ।
তারপর দুজন হেঁটে যেয়ে কূপের পাশে দাঁড়ায়। মাথা নত করে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখে কূপের নীচ তলায়। কেমন আঁধার সেখানে। কবরের মতো অনন্ত অন্ধকার যেন। কূপের ভিতর থেকে রোহিত শুনতে পাচ্ছিল মায়ের কান্নার শব্দ আর রোহিনীর করুণ আর্তনাদ। রোহিত ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করতে থাকে। কূপের তলা থেকে সে শুনতে পাচ্ছিল, কে যেন ওকে বলছে, অনেকটা ওর বাবার কণ্ঠস্বরের মতো করে — ‘ ওরে ভয় নাই, নাই স্নেহমোহবন্ধন, ওরে আশা নাই, আশা শুধু মিছে ছলনা। ওরে ভাষা নাই, নাই বৃথা বসে ক্রন্দন, ওরে গৃহ নাই, নাই ফুলশেজরচনা।’
রোহিত পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু চোখে ছিল তার জলের ধারা।
ছায়া ওর দাদাকে বলছিল — চলো দাদা, ঘরে ফিরে যাই ।
সন্ধ্যা পূর্বেই রোহিত ও ছায়া বাড়ি চল আসে। রোহিত ঘরের ভিতর না ঢুকে ছায়াকে বলে — আমকে উঠোনে জাম্বুরা গাছ তলায় একটি চেয়ার বের করে দে। ওখানেই কতক্ষণ একা একা বসে থাকব।
ছায়া ঘর থেকে পুরানো হাতলওয়ালা একটি চেয়ার বের করে দেয়। রোহিত চেয়ারটা দেখে চিনতে পারে। এ রকম চেয়ার আরও একটি ছিল। প্রায়ই চাঁদনী রাতে ওর বাবা মা উঠোনে চেয়ারে বসে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করত । কত কথা বলত ফিসফিস করে। চাঁদ ডুবে গেলে তারপর ঘরে যেয়ে শুয়ে পড়ত।’ আজ মনে হচ্ছে — সবই ছিল তাদের মহব্বত, সবই ছিল প্রেম।
রোহিত অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকে উঠানে। আজ আকাশে কোনো চাঁদ উঠল না। তারা’রা বিচ্ছিন্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে জ্বলে আছে আকাশে। আজ — যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে, / সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া, / যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে, / যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া, / মহা আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে।’
পরের দিন সকালে রোহিত নাস্তা করতে বসে ছায়াকে বলে — আমাদের জমিজমা, বাড়ি, পুকুর, বাজারের দোকান, দুটো আমবাগান এগুলো কী ভাবে রেকর্ড হয়েছে? তুই জানিস?
— পিপুল বাড়িয়ার ইয়াকুব চেয়ারম্যান নিজে তদারকি করে তোমাদের সব জায়গা জমি তোমার নামে রেকর্ড করে দিয়েছেন। জমির সব পর্চা ও কাগজপত্র আমার কাছে আছে। তুমি সেগুলো দেখতে পারো। জানো দাদা, ইয়াকুব চেয়ারম্যান মুক্তি যোদ্ধা ছিলেন। উনি খুব ভালো মানুষ ছিল। এই ভালো মানুষটিকে সর্বহারা পার্টির লোকেরা দিনের বেলায় ইউনিয়ন বোর্ডের অফিসের ভিতর কুপিয়ে হত্যা করে।
— কাগজপত্র যা আছে তোর কাছে আপাতত থাক। আমি পরে দেখব সব। আমার কিছু কাজ আছে। পরে তোর কাছ থেকে নিয়ে নেব। আর মরহুম ইয়াকুব আলী চেয়ারম্যানের আত্মার শান্তি কামনা করছি। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ওপারে যেন ভালো থাকেন।
নাস্তা খাওয়া যখন শেষের দিকে তখনই শহীদুল চলে আসে। ছায়া শহীদুলকে বলছিল — দাদা আপনাকেও নাস্তা দেই।
— আমি নাস্তা করে এসেছি।
— তাহলে আপনাদের চা করে দেই।
— না। চা দিতে হবে না। আমি আর রোহিত পিপুল বাড়িয়া বাজারে যেয়ে চা খেয়ে নেব।
যেতে যেতে পথে শহীদুল রোহিতকে বলছিল — ‘আবার কোন্ জনমে তুই আসবি, চল্ — আমাদের স্কুলটা একটু দেখে যা।’
ওরা দুজন হেঁটে হেঁটে স্কুল আঙিনায় চলে আসে। রোহিত স্কুল আঙিনা দেখে হতবাক! কোথাও নেই আগের সেই শান্ত সৌম্য নিরিবিলি পরিবেশ। কোথায় হারিয়ে গেছে আঙিনা বেষ্টিত সবুজ বৃক্ষরাজি। তখনকার সেই আমগাছ, ঝাউ গাছ, দেবদারুর ঝাড়, সুপারি গাছের সারি, ছাতিম গাছ, এসবের চিহ্ন কোথাও নেই। আগে স্কুল ঘরটা ছিল বিশাল লম্বালম্বি, এবং সামান্য এল্ প্যাটার্নের। এখন তার পাশে অপরিকল্পিত ভাবে বিল্ডিং উঠানো হয়েছে। স্কুল আঙিনার অন্য এক পাশে কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। উঠানো হয়েছে এলমেল ভাবে স্টাফ কোয়ার্টার আর হোস্টেল। এই গিঞ্জি পরিবেশ দেখে রোহিতের মনটা খুবই খারাপ হয়ে যায়।
ছুটির দিন ছিল ঐদিন। ছাত্র ছাত্রীদের মুখর করা কোলাহল ছিল না। রোহিত শহীদুলকে বলছিল — দেখ্ — মাঠের ঐ কোণে একটি আম গাছ দেখতে পাচ্ছি। ওখানে আগেও একটি এমন আম গাছ ছিল। কিন্তু এই গাছটি দেখে নতুন মনে হচ্ছে।
— আগের সেই গাছটি মরে গেছে। এই গাছটি নতুন করে ঠিক একই জায়গায় পরে লাগানো হয়েছে।
— চল্, ঐ গাছটার নীচে ঘাসের উপর দুজন কিছুক্ষণ বসে থাকি।
— আচ্ছা, চল।
ওরা দুজন আমগাছের নীচে যেয়ে বসে। রোহিত বলছিল — ‘ তেমন কাউকে তো কোথাও দেখছি না। একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। খাওয়া যাবে?
শহীদুল এদিক ওদিক তাকিয়ে বলছিল — কেউ তো নেই। কেই দেখতে পাবে না। সিগারেট ধরাতে পারিস।
সিগারেট টানতে টানতে রোহিত শহীদুলকে বলছিল — তোর মনে আছে? টিফিনের সময় স্কুল ঘরের পিছনে লুকিয়ে লুকিয়ে আমি তুই ও দত্তবাড়ি গ্রামের রতন — আমরা তিনজন টেন্ডু পাতার বিড়ি খেতাম। রতন হরিপুর গ্রাম থেকে আসা সেতারা নামে একটি মেয়েকে খুব পছন্দ করত, ভালোও বাসত একতরফা। ও শুধু দূর থেকেই মেয়েটিকে ভালো বেসে গিয়েছিল। কোনো দিন তা মেয়েটিকে বলে নাই। যেন শুধুই —
‘মনে রয়ে গেল মনের কথা– শুধু চোখের জল, প্রাণের ব্যথা। মনে করি দুটি কথা বলে যাই, কেন মুখের পানে চেয়ে চলে যাই।’
সেই রতন এখন কোথায় আছে, কেমন আছে? দূর দেশে কত মনখারাপিয়া মুহূর্তে ওর কথা খুব মনে পড়ত। ওর সেই সারল্য মুখ, নিষ্কলুষ চাহনি, সব সময় চোখের সামনে দেখতে পেতাম। কী ভালো ছেলে ছিল। খেপালে একটুও রাগ হতো না কখনও। মুখে একটি স্মিত হাসি লেগেই থাকত সবসময় ।
— রতন মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার জন্য ভারতের বালুঘাট গিয়েছিল। আরও কয়েকজন যুবকের সাথে ট্রেনিং নেওয়ার জন্য ও সেখানে যায় । তখন ছিল শ্রাবণ মাস। ওরা প্রথম উঠেছিল পুণর্ভবা নদীর তীরে স্থাপিত একটি স্মরণার্থী শিবিরে। ক্যাম্পের অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে ওর ডায়রিয়া হয়েছিল। অনেকটা বিনা চিকিৎসায় রতন সেখানে মৃত্যু বরণ করে।
— এই দেশের স্বাধীনতার জন্য শহীদ হওয়া হতভাগ্য রতনের নাম নিশ্চয়ই তালিকায় নেই। এই রকম কত শহীদের নাম অলিখিত রয়ে গেছে। কত তরুণ অকাতরে বিলিয়ে গিয়েছে তাদের প্রাণ! তারা বাংলাদেশের আকাশে তারা হয়ে মিটিমিটি করে জ্বলে থাকবে।
কেউ চলে গেছে, কেউ ফিরে এসেছে, কেউ হয়ে গেছে নিখোঁজ, কেউ আছে মিনারে অভিজ্ঞান হয়ে চিরন্তন, তারা রবে —
‘অনন্ত আকাশে অনন্তকাল,
কখনো নদীর স্রোতে মৃত গাধা
ভেসে যেতে দেখেছি সন্ধ্যায়,
দেখেছি একদা যারা হৈচৈ করে যুদ্ধে
গেছে তাদের ক’জন
মহৎ স্বপ্নের শব কাঁধে নিয়ে হেঁটে-হেঁটে
ক্লান্ত হয়ে ফের
স্বগৃহে এসেছে ফিরে।’
শামসুর রাহমানের কবিতা।
— চল্, পিপুলবাড়িয়া বাজারে যাই। ওখানে চা’র দোকানে বসে বসে চা আর সিগারেট খাই গে। তোর মন ভালো লাগবে।
— সিগারেট একটু বেশি খাওয়া হচ্ছে না?
— এই তো এই কটা দিনই একটু বেশি খাব। যে কয়দিন তোর সাথে আছি।
০৮.
পিপুলবাড়িয়া বাজারে চা খেয়ে দুপুরের মধ্যেই রোহিত ও শহীদুল বাড়ি চলে আসে। শহীদুল চলে যায় ওর বাড়িতে। রোহিত শহীদুলকে বলে দেয় — তুই বিকালে একটু চলে আসিস। তোকে নিয়ে এক জায়গায় যাব।
— কোথায় যাবি?
— তুই বিকালে আয়।, তোকে কোথায় নিয়ে যাই। তখনই জানতে পারবি।
বাড়ির ভিতর রোহিত যখন ঢুকে তখন ঘরের ভিতর ছায়া রাণী ও জামাই বাবু কী নিয়ে যেন কথা-কাটাকাটি করছিল। রোহিত শুধু জামাই বাবুর এই কথাটি শুনতে পেল — ‘বেচে টেচে যখন সব টাকা পয়সা নিয়ে চলে যাবে, তখন তুমি বুঝতে পারবে।’
রোহিত ছায়া রাণীকে ডাকে — ছায়া…।
ছায়া রোহিতের কাছে এসে বলে — জ্বী দাদা।
— নে, বাজারের ব্যাগটা ধর্। পিপুলবাড়িয়া বাজারে যমুনার আইর মাছ পেলাম তাই কিনে নিয়ে এলাম। কতকাল ধরে যমুনার মাছ খাইনা। তুই ঠিক আমার মায়ের মতো করে রান্না করবি। আমার খুব ইচ্ছা হচ্ছে, আজ আমার মায়ের হাতের রান্না খাব।
বিকালে যথাসময়ে শহীদুল চলে আসে। শহীদুল রোহিতকে বলে এখনই বের হবি?
— হুম। এখনই বের হবো, চল।
দুই বন্ধু বের হয়ে পড়ে।
রোহিত শহীদুলকে সাথে নিয়ে যে বাড়িটাতে যাচ্ছে, সে বাড়ির পথ তার চির চেনা। কিছু পথ আছে, হাজার বছর পরেও চলতে যেয়ে অচেনা মনে হয় না। কিছু নদী আছে যে নদীর আঁখি কোণের জল ফুড়ায় না, কিছু আকাশ আছে, যে চির নীলাম্বরী শাড়ি পড়ে থাকে চিরকাল। যেন ‘বিশদ জোছনা, কুসুম কোমল—
সকলই আমার মতো।’
অপরাহ্ণের পাখিগুলো সুপারি বাগানের ঝাড়ে বসে ডাকছিল। পাখিদের ভিতরও সব পাখির ডাক একই রকম হয় না। কারোর ডাকের ভিতর আনন্দ উৎসব করার নিমন্ত্রণ থাকে, কারোর ডাকে শোনা যায় বেদনা নিঃসৃত কান্নার ধ্বনি। ওদের ভিতরও আছে সুখ দুঃখের অনুভূতি। কারোর ভিতর যদি মন খারাপ থাকে, সেদিন তার সুরের মাধুর্য প্রাণের মধ্যে কোনো সাড়া দেয় না। সুরের স্তরে স্তরে মন কেমন উদাস হয়ে ওঠে। মনে হয় জীবনটা কেবল কতকগুলো বিষাদের গানের সুরের সমষ্টি।
পরন্ত বিকালে মানুষ তার জীবনের ক্লান্তির ছায়া নামতে দেখে। আত্মার স্পন্দন ক্ষীণ ভাবে অনুভব করে। যা কিছু ভালোলাগা তা ঐ পশ্চিম আকাশের লাল আভাটুকু। রোহিত হাঁটছিল আর ভাবছিল — ‘কী এক অসীম ক্ষরণ হৃদয়ে, রক্তান্ত আত্মার সামনে দাঁড়িয়ে অপ্রাপ্তির এই চাওয়াটুকু চাইতে ইচ্ছে করে, ‘পর জনমে শুক্লা যামিনীতে যদি তুমি আস, দেখতে পাই যেন তোমাকে ঠিক চির কল্যাণময়ী রূপে।’
দূরে কোথায় যেন হাস্নাহেনা ফুটে আছে। অনাঘ্রাত সুবাস মিশে আছে আজকের এই অপরাহ্ণের ঝলমলে রোদ্র ছায়ায়। পথ আর চলতে পারিনা যে! ‘ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো।’
রোহিত ও শহীদুল একসময় চলে আসে সেই বাড়িটিতে। সুন্দর ছোট্ট একটি পুকুর। পিছনে পশ্চিম পাশে বাঁশবন, আমগাছ গুলো বহু আগের। ফলের গাছগুলো যেন প্রাচীন অরণ্যে পরিণত হয়েছে। খুব নির্জন বাড়ি। এই বাড়িতে এখন কে থাকে?
শহীদুল বিস্ময়ে রোহিতকে জিজ্ঞাসা করে। -তুই এই বাড়িতে আমাকে নিয়ে আসলি? এটা তো হাসান মাস্টারের বাড়ি। এই বাড়িতে ওনার কেউ থাকে না। একজন পুরানো ভৃত্য বাড়িটি দেখাশোনা করে।’
রোহিত শহীদুলকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে। বাড়ির আগের ঘরগুলো এখনো রয়ে গেছে। সেই বারান্দার কোণ্ এখনো আছে। শুধু চেয়ার টেবিলগুলো ওখানে নেই, যে কোণে বসে রোহিত রেবেকাকে পড়াত। স্মৃতির অমল কাঁটায় ক্ষরণ হচ্ছিল তার হৃদয়ে —
তেতত্রিশ বছর আগের! কী আশ্চর্য মধুময় স্মৃতি চোখে দেখতে পাচ্ছিল রোহিত। টেবিলে বসে আছে সে। বিস্ময়ে দেখছিল রেবেকাকে। একটি ডোরাকাটা কামিজ পরে আছে। ওড়না পিছনের ঘার থেকে দুই দিক দিয়ে ঘুরিয়ে সামনে এনে রেখেছে। ওর একটি হাত খাতার উপর, আর একটি হাত রোহিতের হাত ধরে রেখেছে। রোহিত দ্বিধা করছিল ছাড়িয়ে দেবার। কিন্তু পারছিল না, বারবার চেষ্টা করেছে, তাও পারে নাই। রেবেকার অতি প্রত্যয়ের মুখ দেখে মনে হয়েছিল — ‘ন্যায় অন্যায় জানিনে শুধু তোমাকে জানি।’ শুধু তোমাকে চাই প্রথমত। তোমাকে চাই জীবনের শেষ পর্যন্ত।
ভৃত্য মতি কাছে এগিয়ে আসে। রোহিত মতিকে চিনতে পারে। মতি তখন ছোট ছিল। একদম বালক। এই বাড়ির ফয়ফরমাস করত। রোহিত মতিকে বলে — ‘তুমি কেমন আছো মতি?’ মতি রোহিতের মুখের দিকে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকে। চিনতে পারেনা।
— আমাকে চিনতে পারছো না মতি? আমি তোমার রোহিত দা।
মতি রোহিতের হাত চেপে ধরে বলে — ‘ এত বছর পর আপনি এলেন রোহিত দা? মনে করেছিলাম — আপনি আর কোনোদিন ফির আসবেন না।’ চলেন ঘরের ভিতর যেয়ে বসেন।’
— না, আমরা বসব না। চলে যাব এখনই। আচ্ছা মতি, তোমার রেবেকা বুবুকে কোথায় কবর দিয়েছে, জানো?’
— আপনি আসেন আমার সাথে। দেখাচ্ছি।
বাড়ির পূর্বপার্শ্বে একটি পারিবারিক কবরস্থান। ওখানে বেশ কয়টি কবর আছে। তাদের ভিতরই রেবেকার কবর। কবরটি বাঁধানো। শ্বেত পাথরের একটি প্লেটে লেখা আছে —
মোছাঃ রেবেকা বেগম।
মৃত্যু — ২৭ আষাঢ়, ১৩৭৪ বাংলা।
সৌম্য নিস্তব্ধ সমাধি স্থল। প্রত্যহ রাত্রির আকাশ থেকে চন্দ্র কিরণ ঝরে পড়ে দূর্বা ঘাসের উপর। অজস্র তারার আলোর নীচে দূর্বাদলের উপর সুঘ্রাণ ছড়ায় বন্যমালতী। শ্রাবণ মেঘ থেকে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে ভিজে থাকে মাটি। সন্ধ্যায় সোনালি আভায় হাস্নাহেনার গন্ধে আকুল হয়ে ওঠে প্রাঙ্গন। রোহিত মৃত্তিকার নীচ থেকে রেবেকার হৃদয়ের স্পন্দন ধ্বনি শুনতে পায় । ক্ষণতরে ক্ষরিত হয় বহু আগের প্রণয়সুধাসার।
রোহিত শহীদুলকে বলে — ‘তুই রেবেকার কবরটা জিয়ারত করে ওর আত্মার শান্তি কামনা করে একটু মোনাজাত কর্।’
শহীদুল কবরটি জিয়ারত শেষে মোনাজাত করে। সেই মোনাজাতে রোহিতও হাত উঠায়ে প্রার্থনায় রত ছিল।
বাড়ির ভিতর এসে মতি রোহিতকে বলে — এই বংশে রেবেকা বুবুর একটি মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই। ওনার মেয়েটি স্বামীর সাথে শহরে থাকে। নাম মণিকা। শহরের আমলা পাড়াতে থাকে। ওর স্বামীর নাম — নাসির উদ্দীন উকিল।
মতি আরো বলছিল — জানেন রোহিত দা, আমার মনে আছে, যেদিন রেবেকা বুবুর বিয়ে হয়, সেদিন সে খুব কেঁদেছিল। বিয়ের পর থেকেই রেবেকা বুবু কেমন অসুখে পড়ে যায়। খেতে পারত না কোনো কিছু। দিনে দিনে একদম রোগা হয়ে যায়। এর মাঝেই তার গর্ভে সন্তান আসে। প্রসবের সময় সে মারা যায়। সন্তানটি বেঁচে থাকে। আর সেই সন্তানই হচ্ছে মণিকা।
রোহিত মতিকে বলে — ঠিক আছে মতি। তুমি থাকো। আমরা যাই। পারলে একবার আমাদের বাড়িতে এস। আমি দুই তিনদিন আছি।
মতি বলে — একটা জিনিস আছে। আপনি একটু দাঁড়ান, আমি ভিতর থেকে নিয়ে আসছি।
মতি ঘরের ভিতর চলে যায়। একটু পর পুরনো খবরের কাগজে মোড়ানো একটি বই এনে রোহিতের হাতে দিয়ে বলে — রেবেকা বুবু মৃত্যুর কয়দিন আগে এই বইটি আমাকে দিয়ে বলেছিল — ‘যদি কোনোদিন তোর রোহিত দাদা ফিরে আসে তখন এই বইটি তাকে দিয়ে দিবি। অন্য কাউকে বলবি না এই বইটির কথা। ‘
রোহিত মোড়ানো কাগজ খুলে দেখে, এটি নবম শ্রেণির একটি অংকের বই। বইটি সে সিরাজগঞ্জ থেকে কিনে এনে রেবেকাকে দিয়েছিল। রেবেকা বইটির দাম দিতে চেয়েছিল কিন্তু রোহিত তার কাছ থেকে মুলা গ্রহণ করেনি।
বইটি জীর্ণ পুরনো হয়ে হলুদ রঙ হয়ে গেছে। সে বইটির পাতা উল্টায়ে দেখতে পায় , প্রথম সাদা পাতায় রেবেকার নিজ হাতে এই চরণগুলি লেখা —
জীবন যখন শুকায়ে যায়
করুণাধারায় এসো।
সকল মাধুরী লুকায়ে যায়,
গীতসুধারসে এসো।
কর্ম যখন প্রবল-আকার
গরজি উঠিয়া ঢাকে চারি ধার,
হৃদয়প্রান্তে হে জীবননাথ,
শান্তচরণে এসো।
আর কিছু লেখা নেই। নাম তারিখ বা অন্য কোনো কথা।
এক মনখারাপের অসীম বেদনা নিয়ে রোহিত বাড়ি চলে আসে। আসতে আসতে পথে যেন এক বিরহিণীর অযত্ন বিন্যস্ত মেঘবরণ চুল এলিয়ে দেওয়ার মতো সন্ধ্যা নামতে থাকে। প্রিয়াহীন প্রাণের নিবিড় দূর বনে ডাকছিল কাকাতুয়া। চোখ অশ্রু সজল হয়ে উঠে। তার নিসৃত অশ্রুধারা পথসঙ্গী শহীদুল দেখতে পেল না।
‘দীর্ঘদিন আমি এমন প্রবাসী হয়ে আছি।
বড়ো দীর্ঘদিন, দীর্ঘবেলা।
জলের ভিতরে ক্রমে জমে-ওঠা শ্যাওলার সবুজ,
হাওয়া ভারী হয়ে আসে, স্রোত
থেমে যায়, ক্রমে
কুসুমের বুক থেকে ঝরে পড়ে নিহিত কুসুম।
দীর্ঘদিন বিজনে একেলা।’
কবিতা — প্রণব মুখোপাধ্যায়।
রোহিত যখন ফিরে আসছিল — তখন কার্তিক হাওয়ায় রাস্তার দুপাশের বৃক্ষরাজী থেকে শুকনো পাতা ঝরে পড়ছিল। বট, অশোক, কৃষ্ণচূড়া,র পাতা বাতাসে ঝিলমিল করে উড়ছে। একজন পাগলিনী এলমেল ভূষণে ছুটে চলে যাচ্ছিল কোথাও । সেই পাগলিনী একবারও কারোর দিকে না তাকিয়ে বলে যাছিল —
‘সুখ নেইকো মনে, সুখ নেই। নাকফুলটি হারিয়ে গেছে বেতসীর বনে।’
০৯.
বাড়িতে আসার পর শহীদুল রোহিতকে বলছিল — আমি কী এখন চলে যাব?
— না যাসনে, চল পুকুর পাড়ে ঘাসের উপর কিছুক্ষণ বসে থাকি। বিশ্বাস কর শহীদুল, তোকে না পেলে আমি মনে হয় একদিনও এখানে থাকতে পারতাম না। কেমন দম বন্ধ হয়ে যাবার মতো শূন্যতা চারদিকে। সেই শূন্যতার মাঝে তুই আমার ছায়াসঙ্গী।
ওরা দুজন পুকুর পাড়ে খালি জায়গায় ঘাসের উপর যেয়ে বসে। রোহিত শহীদুলকে বলছিল — একটা সিগারেট দে। ধরাই।
রোহিত আনমনা দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে স্বগোতক্তির মতো বিড়বিড় করে বলছিল — একটি গ্রাম্য অর্বাচীন ছেলে। যে তার বুকের ভিতর রিমঝিম বৃষ্টি লুকিয়ে রাখত। প্রদীপের আলোর বাইরে যে অনির্বচনীয় জোৎস্না থাকে, তাও সে মুঠোর ভিতর পরম যত্নে ভরে রাখতে চেয়েছিল। সে বুঝতে পারত এ আলোর নীচে কোনও আঁধার নেই। খুব কাছে তারায় তারায় ভরা আকাশ। কত অফুরন্ত আলোর রোসনাই ঐ আকাশের গায় । ঐ আকাশ, ঐ আলো, এই পার্থিব জগত কেবলই মায়ার। এই মায়া থেকে কেউ নিজেকে আলাদা করতে পারে না। কেউ ছাড়তেও পারে না। এই মায়াগুলোই হচ্ছে ভালোবাসা ।
শহীদুল রোহিতের ঘারের উপর একটি হাত রেখে বলে–‘ তুই কী যেন আমার কাছে লুকাচ্ছিস, কী এক গোপন দুঃখ ব্যথা। যা তোর অন্তরের মধ্যে নিষ্ঠুর ভাবে বিঁধে আছে। আমি একসময় তোর জীবন জুড়ে ছিলাম। আজ মনে হচ্ছে — সেই থাকার মধ্যে অনেক ফাঁক ছিল। তুই কোথায় কোন্ গোপন কুঠিরে তোর বেদনার কথা লুকিয়ে রেখেছিলি। তা না হলে, কাউকে কিছু না বলে এইভাবে শিকড় ছেড়ে চলে যাস্? আজ এই সন্ধ্যার বিষণ্নতা বলে দিচ্ছে — কী এক অমূল্য জিনিস হারিয়ে ফেলে , চির অভিমান করে তুই সব মায়া ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলি।
শহীদুল আরও বলছিল —
আমার কথা বাদ দে। তুই জানিস, মাসি মা তোর জন্য কত কেঁদেছে। সন্ধ্যায় পূজার ঘরে আলো জ্বালাতে গিয়ে আলো জ্বালাননি তিনি । ঠাকুরের পায়ে কপাল ঠেকিয়ে অন্ধকারে অশ্রুপাত করেছে। রোহিনী সারাক্ষণ মন খারাপ করে থাকত। পরিপাটি করে মাথার বেনী বাঁধতে না। ও ভুলে গিয়েছিল পায়ে নুপুর পরে উঠোনে হাঁটতে । স্কুলেও যেতে চাইত না ঠিকমতো।
— কী বলব তোকে। শূন্য এই ভরা বুকের মাঝে কেউ আর নেই। তুইও তো আমার অন্তরতলা থেকে বেদনা জাগিয়ে দিয়ে কাঁদাচ্ছিস —
‘আমার দিন ফুরালো ব্যাকুল বাদল সাঁঝে
আমার দিন ফুরালো
গহন মেঘের নিবিড় ধারার মাঝে
আমার দিন ফুরালো…’
চোখের ভিতর অনেক জল ছপ ছৃপ করছে। কিন্তু সব জল স্থির করে রেখেছি। ঝরতে দেই না। কারোর জীবন দীপ নিভে গেছে, এমন কোনো আঁধার হওয়ার করুণ-সুধা রসের কথা তোকে আজ বলতে চাই না।
রাতভোর যদি বৃষ্টি হতো। দরজা জানালা খুলে বৃষ্টির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। বৃষ্টির ছাটে ভিজে শীতল করতাম দেহখানি। কী যে ইচ্ছে করে বৃষ্টি ভেজা মাটির গন্ধ নিতে। যদি তুমুল ঝড় উঠত।
জানিস শহীদুল, কতকাল সাদা টগর ফুল স্পর্শ করিনি। উন্মুখ হয়ে থাকি রাধাচূড়ার তলে যেয়ে একটু হাঁটতে। মৌ মৌ গন্ধ ভাসত বাতাসে। কতদিন চলে গেছে — ঐ হলুদ ফুলটার পাপড়ি ছুঁয়ে দেখিনি আমি। কেমন চঞ্চল হয়ে ওঠে মন।
‘…কেউ দেখুক বা না দেখুক
আমি ঠিক টের পাই
অভিমান আমার ওষ্ঠে এনে দেয় স্মিত হাস্য
আমি এমনভাবে পা ফেলি যেন মাটির বুকেও
আঘাত না লাগে
আমার তো কারুকে দুঃখ দেবার কথা নয়।’
— সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
— দোহাই লাগে, তুই তোর এইসব কথা বন্ধ কর!
রোহিত শহীদুলকে বলে — আরও একটা সিগারেট দে। এমন চুপ হয়ে আছিস কেন?
— একটু মন ভালো করে দে। তোর নির্বাসিত প্রবাস জীবনের কোনো সুখ স্মৃতি যদি থাকে, সেই স্মৃতির কথা শোনা আমাকে।
— ১৯৭০ সালে স্কলারশিপ নিয়ে প্রথম আমি বিলাতে যাই। থাকতাম উইনিভার্সিটির একটি হোস্টেলে। ওখানে যাওয়ার পরপরই শীতকাল শুরু হয়। জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি কোনো এক সময় হবে। প্রচুর শীত পড়েছে। আমি তো শীতের তেমন কোনো কাপড় নিয়ে যাইনি। কাছে বাড়তি কোনো টাকাও ছিল না যে, তাই দিয়ে ভারী শীতের কাপড় কিনব।
একদিন সকাল বেলা জানালা খুলে দেখি — বাইরে প্রচুর সাদা সাদা বরফ পড়ছে। আমি এতদিন শুধু তুষারপাতের কথা শুনেছি। কিন্তু তা স্বচক্ষে কোনোদিন দেখিনি । ঐ দিনই প্রথম তুষারপাত দেখি। মনটা ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে উঠল। কয়দিন ধরে মনটা এমনই খারাপ লাগছিল। হোম কান্ট্রি সিক যাকে বলে। কিন্তু তুষারপাত দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল। মন খুব টানছিল সারা শরীরে তুষার মাখাতে। আমি বোকার মতো একটা হালকা
টি-সার্ট ও প্যান্ট পরে তুষারে ভিজতে বাইরে বের হয়ে পড়ি।
পথে নেমে পা পা করে হাঁটতে থাকি। শিমুল তুলার মতো বরফ উড়ে উড়ে এসে আমার টি-সার্টের উপর পড়ছিল। প্রথম প্রথম নিজেকে খুব দুঃসাহসিক অভিযাত্রী মনে হলো । যেন — ‘আহা! কী আনন্দ আকাশে বাতাসে।’ কিন্তু পরক্ষণেই দেখি, হাত পা শরীর বরফে জমেি আসছে। কিন্তু দমে গেলাম না। আমি থাকতাম পশ্চিম লন্ডনের একটি এরিয়ায়। ওখান থেকে ক্যাস্টল বার পার্ক রেল স্টেশন বেশি দূরে নয়। আমি প্রায়ই ঐ রেলস্টেশনে যেয়ে বসে থাকতাম। খুব চমৎকার নিরিবিলি একটা স্টেশন। তুষারে ভিজতে ভিজতে আমি ঐ স্টেশনে চলে যাই। ততক্ষণে সারা শরীর হিম শীতল হয়ে গেছে । আমার মাথার চুল, ভ্রু, কান, কাপড়চোপড় বরফে ঢেকে যায়।
স্টেশনটা তখন ফাঁকা ছিল। মনুষ্য সমাগম তেমন ছিল না। একটা বেঞ্চে জড়োসড়ো হয়ে বসে কাঁপছিলাম খুব । পাশে দিয়ে যাচ্ছিল মধ্য বয়সী একজন আইরিশ মহিলা। সে মনে করেছিল আমি একটা আধা পাগল ছেলে। নইলে এমন করে তুষারে ভিজে কেউ? দয়াপরবশ হয়ে সেই মহিলা তার সুটকেস থেকে একটি বিগ সাইজের লেডিস কোট আমাকে বের করে দেয়, এবং বলে — ‘তুমি এটা পরো।’ আমি কোটটি পরে নেই।
সে আরও বলে — তোমার কাছে কোনো টাকা পয়সা নেই?’
আমি বললাম — না।
সে আমাকে কুড়ি পাউন্ড দিয়ে বলে — তুমি ট্যাক্সি ডেকে বাড়ি চলে যাও।’ সে বিড়বিড় করে এও বলছিল, — এমনও পাগল ছেলে হয় ? ‘
স্মৃতিকথা থামিয়ে দিয়ে রোহিত শহীদুলকে বলছিল — কী মন ভালো করতে পেরেছি তোকে?
— তুই তোর আসল কথা বলছিস না। এ সমস্ত গল্পকথা আমাকে বলে তোর জনম জনমের আসল দুঃখকে ঢেকে রাখতে পারবি না।
— যে মানুষের জীবনে দুঃখ নেই, সে তো জীবনের স্বাদই পায় নাই। জীবনকে চিনতে হলে দুঃখের নদী সাঁতরাতে হয়। তবেই বোঝা যায়, জীবন কী? ব্যর্থতা, গ্লানি, খেদ, অপূর্ণতা, আফসোস, অশ্রুত কান্না, দীর্ঘশ্বাস, বিরহ, বিষাদ, উপেক্ষা, অবহেলা — এই সবই জীবনের বোধ। আর এই বোধগুলোকে যে না চিনেছে, সে তো আর একজন ব্যর্থ মানুষ। সত্যি অর্থে সে জীবনই দেখেনি।
কথায় কথায় সন্ধ্যা পেড়িয়ে রাত হয়ে যায় অনেক।বেলীফুলের ঝাড় থেকে গন্ধে ভরে ওঠে সারা পুকুর পার। ঝিঁঝি ডাকছে। জোনাকিরা মিটি মিটি করে সবুজ আলো জ্বালিয়েছে ছিটকির বনে। রোহিত শহীদুলকে বলে — ‘আর একটা সিগারেট দে। খেয়ে ঘরে চলে যাই।’
যেদিন শেষ বারের মতো চলে যাব, সেদিন পথ
ডেকে বলবে , দাঁড়াও তুমি– ধূলি মেখে যাও পায়ে।
শূন্য নীল আকাশ বলবে, এস তোমাকে নীলাদ্রি করে দেই। রাতের তারা মন্ডল বলবে — কোথায় আর যাবে? তারা হয়ে জ্বলে থাকো আমাদের পাশে।
দখিনা সজল বাতাস দোলা দিয়ে বলবে — তোমার আতর মাখা শরীরের গন্ধ ছুঁয়ে দাও।
ফুল বলবে, আজ তোমার জন্য ফুঁটেছিলাম, সুবাস নিয়ে যাও। পাখি বলবে — যাবেই যখন আমার একটি পালক পরে নাও।
নদী বলবে, এস আর একবার, অবগাহন করো, পুণ্য হয়ে যাও।
নারী বলবে, প্রেম দিব তবু তুমি যেওনা।
খরতাপে চোখ পুড়ে তপ্ত মাঠ পেরিয়ে চলে যাব।
ধুনো ধূপের গন্ধ পাব আকুল করা আশ্বিন সন্ধ্যায়। হাঁটব যতক্ষণ না তারা ফুটে উঠবে আকাশে। চলব যতক্ষণ না আলো নিভে মেঠো পথে। অন্ধকারে যতক্ষণ না দেখতে পাব জোনাকিরা উঠছে, পড়ছে, জ্বলছে, নিভছে।
১০.
রোহিত খেতে বসে ছায়া রাণীকে বলে, ‘তোর ছেলেকে ডাক্। ওকে নিয়ে বসে আজ একসাথে ভাত খাব। আসার পর ওর সাথে তেমন কোনো কথাই হলো না।’
রঞ্জিত খেতে চলে আসে। খাবার টেবিলে রঞ্জিতকে রোহিত বলে — তুমি কী নিয়ে পড়াশোনা করছ?
— মানবিক নিয়ে পড়ছি।
— আচ্ছা, খুব ভালো।
— তা উচ্চতরে যেয়ে কোন্ বিষয় নিয়ে পড়তে চাও?
— জানি না। ভাবিনি এখনও। আপনি বলেন, কী নিয়ে আমি পড়ব।
— তুমি সমাজবিজ্ঞান নিয়ে পড়তে পারো। ভালো রেজাল্ট করতে পারলে বাইরে স্কলারশিপ নিয়ে পড়ার সুযোগ বেশি পাবে।
— আচ্ছা মামা। দোয়া করবেন আপনি।
— আর একটি কাজ করবে। যদি পারো, নিজের প্রতি যদি দায় হয় — তুমি মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষিতা মেয়েদের নিয়ে গবেষণামূলক কিছু কাজ করবে। কাজটি অনেক বড়ো ও কঠিন । তবুও করবে। তুমি শুরু করবে আমাদের এই হরিনা গোপাল গ্রাম থেকে। এই ধরো, তোমার রোহিনী মাসির কথা। তার নাম কিন্তু কোথাও লেখা নেই। এই রকম অনেক ধর্ষিতা মেয়ে আছে, গ্রামে গঞ্জে ও বিভিন্ন জনপদে। জীবিত ও মৃত কিংবা শহীদ হয়েছেন। তাদেরকে তুমি খুঁজে খুঁজে বের করবে। তুমি তরুণ প্রাণ। হাতে অনেক সময়। তুমিই পারবে এই বিশাল কাজটি করতে। আমি এই ব্যাপারে একটি দিকনির্দেশনা দেব পরে একদিন।
খাওয়া শেষ হলে রোহিত ছায়া রাণীকে বলে — তুই রাতেই আমার সব জমি জমার কাগজগুলো বের করে রাখবি। আমি ওগুলো দেখব, এবং একজন উকিলকে দেখাব। কোনো ভুল ভ্রান্তি থাকলে তা ঠিক করে নেব। তারপর রোহিত বিছানায় চলে যায় ঘুমুতে।
রোহিত চলে যাবার পর জামাই বাবু ছায়া রাণীকে বলছিল, শুনলে তো তোমার দাদার কথাবার্তা। তুমি শুধু শুধু পর মানুষের সম্পত্তি কষ্ট করে দেখে শুনে রাখলে। কী লাভ হলো তোমার? শুধু পাহারাদারনী হয়েই থাকলে। অপেক্ষা করো ক’টা দিন। দেখো কী করে তোমার দাদা? সব বেচে থুইয়ে টাকা নিয়ে পারি জমাবে দূরদেশে । আর আসবে না।
ছায়া রাণী বলে — ‘দাদা যা করার করবে। তোমাকে এই নিয়ে ভাবতে হবে না। ওনার সম্পত্তি উনি যা করার করবে। এ নিয়ে তোমার এত মাথা ব্যথা কেন?
রোহিত সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে নেয়। সে আজ শহরে যাবে। একবার ভেবেছিল — শহীদুলকে সাথে করে নেবে। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল, সে একাই যাবে।
রোহিত জমিজমার কাগজগুলো বের করে দেখল।সে একটি হিসাব করে, কতটুকু জায়গাজমি তার আছে। সে দেখতে পায় — বাড়ি এবং পুকুরসহ চার বিঘা, আমবাগান কাঁঠালবাগান, সুপারিবাগান ও অন্যান্য ভিটা মিলে ৫ বিঘা, ফসলি জমি ১৫ বিঘা, আর বাজারে দোকানের জায়গা ১ বিঘা। আর অস্থাবর সম্পদ হচ্ছে — পাকা দালান একটি, ছোট বড়ো টিনের ঘর তিনটি, বাজারে আধা পাকা দোকান চারটি। সব মিলে যার বর্তমান মূল্য দেড় কোটি টাকার উপর হবে।
রোহিত ছায়া রাণীকে বলে — আমি আজ একটু শহরে যাচ্ছি। আজ যদি না আসতে পারি, কাল চলে আসব।
রোহিত শহরে এসেই প্রথম ভালো একজন উকিলোর সাথে দেখা করে। তাকে তার সমস্ত সম্পত্তির কাগজপত্র দেখায়। এবং তার সাথে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আইনগত ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করে। এবং বলে আপনি একটি খসড়া দলিল তৈরি করেন। আগামীকাল এটি সম্পাদন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। আমি কাল আবার আসব।
রোহিত উকিলের চেম্বার থেকে বের হয়ে রাস্তায় নেমে হাঁটতে থাকে। তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। একটি রিকশা ডাকে, এবং রিকশাওয়ালাকে বলে – ‘তুমি আমলা পাড়া যাবে?’ ‘
— যাব, ওঠেন আপনি।’
রিকশা একসময় আমলা পাড়ার গলিতে ঢোকে। রিকশাওয়ালা বলে — এটাই আমলা পাড়া। তা, কোন্ বাড়িতে যাবেন? ‘
— যে বাড়িতে যাব, সে বাড়ি আমি চিনিনা।
— বাড়ির মালিকের নাম কী?
—নাসির উদ্দীন উকিল।
রিকশাওয়ালা দুই একজনকে জিজ্ঞাসা করে বাড়িটি চিনে নেয়। তারপর রোহিতকে সেই বাড়িটির সামনে নামিয়ে দেয়। রিকশাওয়ালা রোহিতকে বাড়িটি দেখিয়ে দিয়ে বলে — ‘এইটি নাসির উকিলের বাড়ি।’ রিকশাওলাকে ভাড়া পরিশোধ করে রোহিত বাসার গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। এবং গেট নক করে। ভিতর থেকে একজন তিরিশোর্ধ্ব মেয়ে এসে গেট খুলে দেয়।
মেয়েটিকে দেখে তার শরীরের সমস্ত রক্ত মুহূর্তে হিম শীতল হয়ে ওঠে । আত্মার স্পন্দন ধ্বনি থেমে যায়। কী আশ্চর্য ! সেই আনত মুখ, সেই মায়াভরা চোখ, সেই গ্রীবা, সেই নাক, সেই শরীর গড়ন, মুখ জুড়ে সেই লুকানো হাসি। একদম রেবেকার মতো। আরও আশ্চর্য হয় — সে এমন কিছু মিল খুঁজে পায় মেয়েটির ভিতর, তা আরও বিস্ময়ের।
মেয়েটি বলে — আপনি কে? কাকে চান? আপনাকে তো চিনতে পারছি না।
— আমি রোহিত সেন। এখানে মণিকার সাথে দেখা করতে এসেছি। তুমি কী মণিকা ?
— জ্বী, আমি মণিকা। কিন্তু রোহিত সেন নামে কাউকে আমি চিনিনা। তা, আপনি কোথায় থেকে এসেছেন?
— আমি আপাতত হরিনা গোপাল গ্রাম থেকে এসেছি। কিছু মনে করোনা। তুমি কী আমাকে একটু বসতে দেবে?
— ও দুঃখিত। আপনাকে বসতেই বলিনি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছি। আসুন, ভিতরে চলুন।
মণিকা রোহিতকে ভিতরে নিয়ে বসতে দেয়। একটি পাঁচ ছয় বছরের বাচ্চা মেয়ে ছুটে কাছে চলে আসে। এবং রোহিতের কোলের উপর এসে বসে পড়ে। বাচ্চাটি রোহিতকে বলে — ‘তুমি আমার কী হও?’ রোহিত বলে — ‘আমি তোমার দাদু হই।’
— এতদিন কোথায় ছিলেন?
— চাঁদের দেশে।
— তুমি আমাকে একটা গল্প শোনাও।
— চাঁদের দেশে এক চাঁদের বুড়ীর সাথে আমার খুব ভাব ছিল। সে আমাকে একদিন একটা সাদা বিড়ালছানা উপহার দেয়। সেই বিড়াল ছানাটির নাক, মুখ, চোখ, গাল একদম তোমার মতো দেখতে খুব সুন্দর। আর শরীরটা ছিল তুলতুলে। আমি সেই নরম বিড়াল ছানাটির গাল আমার গালে লাগিয়ে আদর করতে থাকি। দেখি — কী সুন্দর শান্ত হয়ে আছে।
— তারপর?
— তারপর আর কী? দেখি সে ঘুমিয়ে গেছে।
— তুমি আমাকে ঐরকম একটা বিড়াল ছানা এনে দিবে?
— অবশ্যই দেব। আমি আবার যখন চাঁদের দেশে যাব, তখন চাঁদবুড়ীকে বলে তোমার জন্য একটি সুন্দর তুলতুলে বিড়াল ছানা নিয়ে আসব। আচ্ছা, তোমার নাম কী?
— ঐশ্বর্যময়ী।
মণিকা ওর ঐশ্বর্যময়ীকে বলে — ‘তুমি তোমার দাদুর সাথে পরে কথা বলবে। এখন চলো।’
মণিকা মেয়েকে অন্য রুমের ভিতর রেখে আসে। এবং অনেকটা বিস্মিত হয়ে রোহিতকে বলে –‘আজ প্রথম দেখলাম, আমার মেয়েটি কোনো একজন অপরিচিত মানুষের কোলে গিয়ে বসেছে। এবং তাকে আপন করে নিয়েছে।’
রোহিত মনে মনে বলছিল — ‘আমি অপরিচিত মানুষ?’ পরক্ষণেই বলে — ও আমাকে খুব আপন মনে করেছে। তাই এসে কোলে উঠেছে। আচ্ছা, তুমি আমার নাম আগে কারোর কাছে থেকে কখনো শোনোনি?
— জ্বী , এখন মনে পড়ছে। মতি চাচাসহ গ্রামের অনেকের কাছে থেকে আপনার কথা আমি শুনেছি। আপনি তো নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন সেই কবে। তা এতবছর কোথায় ছিলেন?
— সে অনেক কথা। এত কথা শোনার তোমার সময় হবে না। বিরক্ত হবে তুমি। আমার জীবন হচ্ছে যাযাবরীয়। কত দেশ ঘুরেছি, কত বিচিত্র মানুষের সাক্ষাৎ পেয়েছি, কত সরোবরে পদ্মফুল জলে ভাসতে দেখেছ। কত নদীর কূলে একাকী বসে থেকেছি, কত সাগরবেলায় হেঁটে হেঁটে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থেকে জলের সাথে অন্তরের বেদনার কথা প্রকাশ করতে চেয়েছি।
পরিব্রাজকের মতো ঘুরতে ঘুরতে জীবনের এই প্রান্ত বেলায় এসে মনে হলো — আর কত অভিমান প্রলম্বিত করব? কার সাথেই অভিমান আমার ! নিজের কাছে থেকে নিজে কখনও জানতে
চাইনি — ‘কোথায় আমার কে আছে?’ কখনও খুঁজতেও চাইনি — ‘আপন কেউ কী আছে , যে আমার জন্য সান্ধ্য ধূপগন্ধ প্রদীপ জ্বেলে অপেক্ষা করবে।
— আপনি বিয়ে করেন নি। ফ
— না।
রোহিত মণিকাকে বলছিল — মা, একটা কথা বলব?
— বলেন।
— আমার খুব খিদে লেগেছে। একটু খেতে দেবে? আমি দুপুরে এখনও খাইনি।
মণিকা একটু অবাক হয়! স্বগোতক্তি করে বলছিল, লোকটিকে ভালো করে চেনাই হলো না। সে কি না, খেতে চাচ্ছে। আবার ভাবছিল, উনি আমাকে আপন মনে করেই হয়ত খাবার চাইছে। যেমন করে সন্তান খেতে চায় মায়ের কাছে, যেমন করে বাবা খেতে চায় কন্যার কাছে। উনি হয়ত আমার ভিতর একজন কন্যার ছায়া দেখতে পেয়েছে ।
খাবার টেবিলে খেতে বসে রোহিত মণিকাকে বলছিল — জামাই বাবু কখন আসবে?
— ও চলে আসবে। ওর চলে আসার সময় হয়েছে।
— আমি জামাইবাবুকে রেখেই খেতে বসলাম।
— কোনো অসুবিধা নেই। আপনি বিব্রত হবেন না।
রোহিত খেতে খেতে মণিকাকে বলছিল — তোমার মা আমার ছাত্রী ছিল। তাকে আমি খুব স্নেহ করতাম। সে আমার মঙ্গল কামনা করত সবসময়। একবার রেবেকা আমার জীবনও বাঁচায়েছিল। কেউ যদি কারোর জীবন বাঁচায়, তখন সে তার কাছে একজন দ্বিতীয় ঈশ্বর বা দেবী হয়ে থাকে চিরকাল। আমি তোমার মায়ের কাছে চিরঋণী হয়ে আছি।
রোহিত আরও বলছিল — আমি একটা উদ্দেশ্য নিয়ে তোমার কাছে এসেছি মা। তুমি তিনদিন পর জামাইবাবুকে নিয়ে হরিনা গোপাল গ্রামে চলে আসো, তোমাদের কিছু কাজ দিয়ে যাব। কিছু দায়িত্ব। তুমি আসো, তখন তোমাকে বিস্তারিত সব বলব।
রোহিতের খাওয়া শেষ হয়ে যায়। তখন পর্যন্ত জামাইবাবু আসে নাই। রোহিত বলছিল — আমি আজ চলে যাই। যদিও কাল আরও একবার আসব শহরে। একটা জরুরি কাজ করা বাকি আছে। কাল এসে সেটা সম্পাদন করব।
— তাহলে কাল আবার আসবেন।
— দেখি, যদি সময় পাই আসব। আর না আসতে পারলে তোমরা কিন্তু অবশ্য অবশ্যই গ্রামে যাবে। কোনো কিছুতেই যেন মিস না হয়। জামাইবাবুকে আমার হয়ে সব বলবে।
— যাব আঙ্কেল।
— তোমার মেয়ে কই? ডাকো।
মণিকা মেয়েকে নিয়ে আসে। এবারও সে কোলে এসে বসে বলে — তুমি চলে যেওনা। তুমি চলে গেলে আমাকে গল্প শোনাবে কে?
— আমি আবার আসব। এসে মেঘের দেশের এক অপূর্ব সুন্দর পরীর গল্প শোনায়ে যাব।
রোহিত ঐশ্বর্যময়ীর হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বলে — তুমি তোমার আব্বু আম্মুকে সাথে করে নিয়ে এই শহর থেকে সবচেয়ে সুন্দর সুন্দর কটি জামা ও খেলনা কিনবে।
ঐশ্বর্যময়ী রোহিতের পাজরের কাছে মাথা রেখে বলে, আচ্ছা।
১১.
বাড়িতে ফিরে আসতে আসতে রিকশায় বসে রোহিত ভাবছিল — যতক্ষণমণিকার ওখানে ছিলাম, আর যতবার আমি ওকে তাকিয়ে দেখেছি, ততবার মনে হয়েছে, ও আমারই চির জনমের আপন কোনো জন। কোথায় থেকে একটি স্বর্গীয় আলো ওর মুুখের উপর এসে পড়েছিল। দৈব কণ্ঠে কে যেন বলছিল — ‘তুই ভালো করে চেয়ে দেখ এই মেয়েটিকে। ওর মুখের উপর যে অপার্থিব আলো আমি ফেলেছি, তা শুুুধু ওকে ভালো করে চিনে নেবার জন্য ফেলেছি। ‘
”নদীর জলে থাকি রে কান পেতে, কাঁপে যে প্রাণ পাতার মর্মরেতে।
মনে হয় যে পাব খুঁজি, ফুলের ভাষা যদি বুঝি,
যে পথ গেছে সন্ধ্যাতারার পারে……”
— রবীন্দ্রনাথের গানের কথা।
আসতে আসতে পথে ইছামতী নদীর তীরে সন্ধ্যা নেমে আসে। রোহিত দূরে নদীর কূলে দুচোখ মেলে তাকিয়ে থাকে কাশবনের দিকে। বালির উপরে ঘন কাশবন। থরে থরে সাদা ফুল ফুটে আছে। ধবল শুভ্র সেই কাশফুল দুহাত দিয়ে সরিয়ে সরিয়ে একটি কিশোরী বালিকা দৌড়ে দৌড়ে তার দিকে ছুটে আসছে । রোহিত চিনতে পারে এই কিশোরীকে। সে যে অনেক আগের কিশোরী মণিকা। ওকে দেখতে দেখতে চোখে ঘোর লেগে আসে। ঘোর ছাড়ার জন্য সে চোখ বন্ধ করে। আবার যখন চোখ খুলে তাকায় দূরে কাশবনের দিকে। তখন কাশবন সন্ধ্যার অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। সেখানে কোনো কিশোরীকে সে আর দেখতে পায় না ।
রোহিতের বাড়িতে পৌঁছতে পৌছতে রাত্রি হয়ে যায়। ছায়া রাণী অপেক্ষা করছিল তার জন্য। কখন তার দাদা চলে আসবে।
রোহিত সকালে ঘুম থেকে জেগেই দেখতে পায় শহীদুল বারান্দায় একটি চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছে। রোহিত ওকে দেখেই বলে — সুপ্রভাত। শহীদুলও বলে — সুপ্রভাত।
— কখন এসেছিস?
— একটু আগে। তা কাল তুই কোথায় গিয়েছিলি?
— মণিকাকে দেখতে গিয়েছিলাম। খুব দেখতে ইচ্ছা হয়েছিল মেয়েটাকে।
— তা দেখেছিস?
— দেখেছি ‘প্রাণ ভরিয়ে, তৃষা হরিয়ে’। কী যে ভালো লেগেছে মেয়েটিকে দেখে । আমার অন্তর গহীনে ওর মায়াময় মুখ, চোখ, চাহনি, হাসি– সব ছুঁয়ে আছে। যা আমি বয়ে নিয়ে যাব অনেক দূরে। এই মুখ আমার মনে গেঁথে থাকবে।
আর মাত্র দুই একদিন আছি। তারপর চলে যাব। এবার যেয়ে কোথাও গিয়ে নিরিবিলি কিছুদিন কাটাব। আমি জানি মনটা খুব ভঙ্গুর ও বিধ্বস্ত থাকবে। ফিনল্যান্ডে যাওয়ার ইচ্ছে আছে। ওখানে নরওয়ের সীমান্তের কাছাকাছি রয়েছে হাল্টি পর্বত মালা। নির্জন অনেক গুহা আছে সেখানে। সারাদিনে একটুও সূর্যের আলো পড়ে না। আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয় দিনের বেলায়। তা না হলে অন্ধকার! কোনো একটি গুহায় ডেরা পাতব। মাসখানেক থাকব। ওখানে যারা যায় তারা বেশির ভাগই পর্বত প্রস্তুরে কিংবা গুহা গাত্রে বিভিন্ন চিত্র এঁকে রেখে আসে। আমি চিত্রকর নই। তবুও ছবি আঁকব। রং তুলি নিয়ে যাব। আমি আঁকব একটি মেয়ের মুখের ছবি। একটিই মুখ থাকবে , কিন্তু সেই মুখে দুজন প্রকাশিত হবে। মা ও মেয়ে । ছবিটির নাম দেব — বিশ্ব ভরা প্রাণ।
হয়ত উৎফুল্লতেই কাটবে গুহাবাসের দিনগুলো । দূরে বাল্টিক সাগরের তীর থেকে ভেসে আসবে হিম মাখা শীতল বাতাস। চোখ ও দৃষ্টি ওখান থেকে অনেক দূরের বাংলাদেশের উপর এসে পড়বে। গুহা প্রান্তে দাঁড়িয়ে মন কী উদাস হবে কারোর জন্য? পর্বতেও অস্তমিত হয় সূর্য, ওখানেও চাঁদ ওঠে, জ্যোৎস্নার প্লাবন বয়, তারা জ্বলে। আমি জেগে থাকব, চোখ মেলে কান পেতে শুনব —
‘যে বাঁশিতে বাতাস কাঁদে সেই বাঁশিটির সুরে সুরে।যে পথ সকল দেশ পারায়ে উদাস হয়ে যায় হারায়ে। সে পথ বেয়ে কাঙাল পরান যেতে চায় কোন্ অচিনপুরে।’
— রবি ঠাকুরের গান।
ছায়া রাণী এসে ওদের দুজনকেই বলে — দাদা ভাইরা আসুন, নাস্তা করে নিন। নাস্তা খেতে খেতে রোহিত ওদের দুজনকেই বলে — আমি আজও একটু শহরে যাব। কিছু কাজ বাকী আছে। ওগুলো সেরে বিকালের মধ্যেই চলে আসব। শহীদুলকে বলে — তুই বাড়িতেই থাকিস। সন্ধ্যায় তোকে নিয়ে একটু ঘুরতে বের হবো।
রোহিত শহরে চলে যায়। এবং সমস্ত কাজ সম্পাদন করে ফেলে। সে কাজ সেরে মণিকার সাথে দেখা করে। আজকে জামাইবাবু নাসির উদ্দীনের সাথেও দেখা হয়। নাসির খুব অমায়িক ছেলে। রোহিত ছেলেটির সাথে কথা বলে খুব ভরসা পেল। ওদের দুজনকেই রোহিত বলে দেয়, ‘তোমরা কাল বিকালেই চলে যেও। একটা ছোট্ট পারিবারিক মিলনীর ব্যবস্থা করেছি। সবাই একত্রিত হয়ে আনন্দ করব। গান করব। তাছাড়া আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে, যা তোমাদের সবাইকে আমি বলব।
আজও ঐশ্বর্যময়ী রোহিতকে দেখে দৌড়ে কোলের উপর বসে পড়ে। এবং বলে — ‘দাদু,, তুমি আমাকে একটা গল্প শোনাও।’
আচ্ছা শোনাই — তখন আমি তোমার মতো ছোট। মা আমাকে একদিন পরীর গল্প শোনায়ে ঘুম পারিয়ে দিল। তো আমি ঘুমিয়ে গেছি। দেখি — একটা সুন্দর রঙবেরঙের পাখাওয়ালা পরী আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে আছে । পাখা দেখতে একদম ময়ুরের মতো। আমাকে সে বলছে — এই ছেলে তুমি ওঠো। আমি তোমাকে নিতে এসেছি। আমি বললাম — তোমার নাম কী? পরী বলল — আমার মাম মেঘবতী।
— তুমি কোথায় থাকো?
— আমি মেঘের দেশে থাকি। তুমি আমার একটি ডানা ধরো। আমরা দুজন উড়ে উড়ে চলে যাব মেঘ রাজ্যে।’ আমি পরীর একটি ডানা ধরলাম। পরী উড়তে লাগল। দুজনই উড়ে উড়ে যেয়ে দেখি, সত্যিই সে এক অপূর্ব মেঘের দেশ।’
এই টুকু বলে রোহিত একটু থামল।
— তারপর, থামলে কেন? বলো।
— বাকিটুকু কাল বলব। তুমি তোমার বাবা মার সাথে কাল দাদু বাড়িতে চলে এস। ওখানে তোমাকে বাকীটুকু শোনাব।
— আচ্ছা।
রোহিত বিকালেই চলে আসে হরিনা গোপাল গ্রামে। বাড়িতে এসে দেখে — শহীদুল ওর জন্য অপেক্ষা করছে।
১২.
ঘরে বসেই রোহিত ও শহীদুল গল্প গুজব করছিল। রোহিত শহীদুলকে বলে — আমি আগামী পরশু দিনই চলে যাচ্ছি। তুই এই একদেড়দিন আমার সাথে সাথেই থাকবি। কাল মণিকাদের আসতে বলেছি। ওরাও চলে আসবে। কাল সন্ধ্যায় তুইও চলে আসবি শেফালী ভাবীকে সাথে করে। রাতে তোদের আমার নিমন্ত্রণ। আমরা সবাই মিলে খাব, গান গাইব, আনন্দ করব।
— এত তাড়াতাড়ি চলে যাবি? খুব মন খারাপ লাগছে। এত বছর হারিয়ে থেকেছিলি সেও একরূপ ছিল। তোকে ভুলেই গিয়েছিলাম। কেনই এলি। এসে হৃদয়টাকে উসকে দিলি। তোকে কত বছর পর পেলাম। পেয়েও আবার হারাব। কেন জানি মনে হচ্ছে , বাকি যে স্বল্প জীবনটুকু আছে সেই জীবনে তোর আর দেখা পাব না।
‘একটা সিগারেট দে, খাই।’
সিগারেট ধরিয়ে খেতে খেতে শহীদুল বলতে থাকে, তোকে দেখার পর থেকে তোর উপর আমার কী যে মায়া পড়ে গেছে। এত একাকী তুই ! মন বলছে, তুই অনেক বড়ো কোনো বেদনা বয়ে বেড়াচ্ছিস।
আচ্ছা রোহিত, তুই বলত — এই যে তুই ঢাকায় ছিলি দুই আড়াই বছর, তারপর বিদেশে কত দেশে দেশে গেলি, এবং থাকলি । তোকে পাবার জন্য কোনো মেয়েই কি ব্যাকুল হয়নি? দুহাত বাড়িয়ে দিয়ে কেউ কি বলেনি — ‘এস আলিঙ্গণে জড়িয়ে ধরো, সারা জীবন কালের জন্য তুমি আমাকে চিরসঙ্গী করে নাও।’
রোহিত শহীদুলের মুখপানে চেয়ে মনে মনে বলছিল — ‘ কেউ তো একজন এসেছিল, কেউ তো একজন এক নিশীথে পরম ভালোবাসায় বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল — ‘আমাকে তুমি এখান থেকে লইয়া যাও। আমি তোমার ঘরে যাইব। জনম জনম ধরিয়া তোমার কাছে থাকিব।’
তাকে আর ঘরে আনা হয়নি । আর আমি হয়ে গেলাম চিরকালের জন্য ঘরহীন। শুধুই আক্ষেপ, কেবলই দীর্ঘশ্বাস এখন। অন্তর কেঁদে কেদে বলি –
‘দুঃখসুখের দোলে এসো, প্রাণের হিল্লোলে এসো।ছিলে আশার অরূপ বাণী ফাগুনবাতাসে বনের আকুল নিশ্বাসে– এবার ফুলের প্রফুল্ল রূপ এসো বুকের ‘পরে।’
কিন্তু সে আর ঘরে এল না। বেদনায় শোকে দুঃখে এবং অভিমানে সে এখন দূর আকাশের তারা হয়ে গেছে।
রোহিত বলছিল — শহীদুল চল, আমরা দুজন একটি রিক্সা নিয়ে ইছামতী নদীর তীরে যাই। পুরো সন্ধ্যা ওখানে নদীর কূলে সবুজ ঘাসের উপর বসে কাটিয়ে দেই। হেমন্তের ঝিরিঝিরি বাতাসে দোল খেয়ে রাত্রি নামবে। রাত্রির নিরবতায় তোকে আমি একটি ছোট্ট গল্প শোনাব।
দুই বন্ধু নদীর কূলে একটি পাকুড় গাছের তলে যেয়ে বসে । অদূরে ইছামতী বয়ে চলেছে। যদিও এই হেমন্তে নদীর জলের ধারা তীব্র নয়। অনেকটাই শান্ত, এবং শীর্ণ এই নদী।
জীবনে কিছু কঠিন গোপন কথা থাকে, তা কাউকে না কাউকে স্বাক্ষী করে বলে যেতে হয়। কারোর কাছে প্রতিশ্রুতি দেওয়া থাকলেও ভঙ্গ করে হলেও তা বলতে হয়। রোহিত শহীদুলকে এখানে এই নদীর কূলে এনে রেবেকার সাথে তার সম্পর্কের কিছু কথা বলতে চেয়েছিল। কতটুকু সম্পর্ক ছিল তার সাথে । কী ঘটেছিল তাদের জীবনে, সব কথা। কিন্তু কী এক দ্বিধায় তা বলতে পারল না। একজন মৃত মানুষের সব কথা বলা কী ঠিক?
আর এইভাবে মুখোমুখি অনেক সত্য কথা তার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল — রেবেকা আর তার ভিতরকার না বলা কিছু কথা শহীদুলকে কাগজে লিখে যাবার বেলায় বলে দিয়ে যাবে।
রোহিত সত্যি সত্যি তার মত পরিবর্তন করে ফেলল। সে শহীদুলকে নদীর কূলে সেই সন্ধ্যা রাতে শোনাল অন্য গল্প কথা —
‘তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র। আমার সহপাঠিনী ছিল দীপান্বিতা। ও প্রেম করে বিয়ে করেছিল তাদেরই পাড়ার নীলেশকে। নীলেশদের সোয়ারি ঘাটে পাইকারি মাছের আড়ত ছিল। পড়াশোনা করেছিল সে অস্টম ক্লাস পর্যন্ত। কাড়ি কাড়ি টাকা ছিল নীলেশদের। কিন্তু টাকা থাকলে কি হবে, নীলেশরা ছিল একটু গোয়ার গোবিন্দ ও গারোল টাইপের।
একদিন দেখি, দীপান্বিতা ক্লাশে আসেনি। পরের দিনও সে এল না। তারপরের দিনও না। এবং তারপরে কোনদিন আর দীপান্বিতা ক্লাসে আসেনি।
নীলেশ শরীর চিনত দীপান্বিতার। এক রাত্রে দীপান্বিতার ভিতর জৈবিক ভালোবাসার চাহিদা নাকি আদৌ ছিল না। কিন্তু নীলেশের ছিল গোয়ার্তুমি। নীলেশ তাকে বলাৎকার করেছিল।
ফলে দীপান্বিতার পেটে সন্তান আসে নেহাতই জৈবিক নিয়মে। কি নিষ্করুণ সৃষ্টির এই রুঢ় নিয়ম। যা আসতে দিতে চায়নি তাই আসে জীবনে।
দীপান্বিতার জন্য মন খারাপ লাগত। ক্লাসে এত গুলো মুখের মাঝে দীপান্বিতার মুখটি আর দেখতে পেতাম না। কিছু ভালোলাগা, কিছু অন্তর নিসৃত টান আমাকে বিষণ্ণ করে রাখত। দীপান্বিতা আমার কেউ ছিল না। কিন্ত ওর জন্য আমার প্রাণ
কাঁদত।
আমি পুরানো ঢাকার বাকরখানি খেতে খুব পছন্দ করতাম। দীপান্বিতা প্রতিদিন আমার জন্য বাকরখানি নিয়ে আসত ওর ব্যাগে করে । এইগুলি খেয়েই প্রায়ই কাটিয়ে দিতাম বিকাল পর্যন্ত। যদি কোনো দিন বেশি খিদে লাগত, তাহলে শহীদুল্লাহ হলের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে যেয়ে , চাঁনখারপুল পার হয়ে হাজির দোকান থেকে পাতায় মোড়ান বিরিয়ানি কিনে এনে দুজন খেতাম।
যেদিন আমার পকেটে টাকা থাকত না সেদিন আগেই আমার মুখ দেখে বুঝতে পারত দীপান্বিতা। ক্লাস শেষে সন্ধ্যায় ও যখন বাড়ি চলে যেত, তখন ভ্যানেইটি ব্যাগ থেকে টাকা বের করে আমার বুক পকেটে দিয়ে বলত, চাকুরি পেলে — পরে এ টাকা আমায় শোধ করে দেবে। এখন শুধু হিসাবটা ডাইরিতে লিখে রাখবে।
প্রায়ই দীপান্বিতা মন খারাপ করে ক্লাসে আসত। সবাইকে হাসি খুশি মুখ দেখাবার চেষ্টা করত। কিন্তু আমি বুঝতে পারতাম, ওর অন্তরের গভীর বেদনার কথা। আমি জানতে চাইতাম, কিন্তু কোনো কথা বলত না দীপান্বিতা। কান্না এবং দীর্ঘশ্বাস দুটোই বুকের গভীরে আড়াল করে রাখত সে। মাঝে মাঝে উদাস কোনো রাত্রি বেলা একাকী শুয়ে শুয়ে ভাবতাম, জগতে এত মেয়ে থাকতে কেন এই অন্তর দুঃখী মেয়েটির সাথে আমার পরিচয় হলো।
একদিন এক মেঘলা দিনের অসতর্ক মুহূর্তের কথা। কার্জন হলের সামনে সবুজ ঘাসের উপর দুজন বসেছিলাম। চুপচাপ আছি দুইজনই, কারও মুখে কোনো কথা নেই। হঠাৎ দীপান্বিতা আমার হাত টেনে নিয়ে আঙুল ছুঁয়ে বলেছিল — ‘তুমি তোমার এই অঙুলি দিয়ে আমার সিঁথির সিঁদুর সব মুছিয়ে দাও।’ সেদিন কোনো সিঁদুর মোছা হয়নি। ঝমঝম করে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছিল।
যেদিন ওর সাথে আমার শেষ দেখা হলো, সেদিন বুঝতে পারিনি এইটি হবে ওর সাথে আমার শেষ দেখা। আমরা বসেছিলাম, লাইব্রেরী বারান্দায়। আমাকে দীপান্বিতা বলেছিল — ‘কে যেন আমার চলাফেরা গতিবিধি অনুসরণ করে। এক অজানা আশংকা আমার মধ্যে। যদি আর তোমার সাথে আর কোনো দিন দেখা না হয়। ‘
আমার শিক্ষা বর্ষের বাকি সময়গুলোতে আর কোনো বন্ধু করিনি কাউকে। প্রতিদিন ক্লাশে আসতাম। পিছনের ব্রেঞ্চে চুপচাপ বসে থাকতাম। দুপুরে প্রায় দিনই খাওয়া হতো না আমার । খেতে ইচ্ছাও করত না। ক্লাস শেষে একাকী শহীদ মিনারের সোপানের উপরে বসে থাকতাম। বসন্তদিনে ইউক্যালিপটাসের পাতা ঝরে পড়ত। পথের ধূলো উড়ত বসন্ত বাতাসে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চেনা পথ দিয়ে তারপরেও প্রায় দুই বছর চলেছি। কোথাও কোনো দিন আর দীপান্বিতার দেখা পাইনি। কার্জন হলের সামনে সবুজ লনের ঘাস, বাংলা একাডেমির বৃক্ষছায়া তল, কিংবা খাজা নাজিমউদ্দিনের মাজার প্রাঙ্গণের সোপান, সেখানকার বৃক্ষরাজি কেউই বলতে পারেনি, দীপান্বিতা এখানে আর এসেছিল কি না?
প্রার্থনার দিনগুলোতে প্রায় সন্ধ্যায় চলে যেতাম ঢাকেশ্বরী মন্দিরে। শঙ্খ ধ্বনি বাজত সেখানে । আরতি হতো পূজার। কোনো দিন কোনো পূজার স্থলে দীপান্বিতার দেখা পাইনি। ধূপের গন্ধ বিষাদের ধূয়া হয়ে মন্দিরে মিলিয়ে গেছে। সকল পূজা শেষ হয়ে গেছে। আরতি থেমে গেছে। কিন্তু দেবীর দেখা আর মেলেনি।
শিক্ষা জীবন শেষ হয় একসময়। বৃটিশ সরকারের স্কলার্শিপের চিঠি আমার হাতে আসে । হঠাৎই বঙ্কিমের ‘আনন্দ মঠ’ বইটি নতুন করে আবার পড়বার ইচ্ছা হয় । কিন্তু ‘আনন্দ মঠ ‘ কোথাও খুঁজে না পেয়ে নীলক্ষেতের পুরোনো বইয়ের দোকানে বইটি খুঁজতে যাই । বইটি পেলামও সেখানে।
বইটি কার ছিল জানি না। বইটি কিনে বাসায় এসে আনন্দ মঠের পাতা উল্টায়ে দেখছিলাম। প্রথম সাদা পাতাটি ছিল আংশিক ছেঁড়া। কোনো কিছু লেখা ছিল না তাতে। বইয়ের শেষ সাদা পাতার প্রথম পৃষ্ঠায় আবছা নীল কালিতে লেখা ছিল —
‘ বুড়িগঙ্গার ধারে নির্জন শ্মশান ঘাট থেকে
লাশ পোড়ানোর গন্ধ আসছে,
কার হৃদয় পুড়ছে ওখানে দাউ দাউ করে
বাতাস ভারী হয় কার ক্রন্দনে —
কে চলে গেল কাকে শূন্ঢ় করে দূরের পরপারে। ‘
আনন্দ মঠের শেষ সাদা পাতার অপর পৃষ্ঠায় লেখা ছিল —
‘সময়ের ব্যবধানে হার মেনেছি সময়ের সাথে
আজো বিষণ্ণতা ঘিরে ধরে নিঝুম রাতে
মন খারাপের তো কয়েক হাজার কারণ থাকে
সত্যিই কেন যে দেখা হয়েছিল তোমার সাথে। ‘
———- দীপান্বিতা সেন।
প্রথম চরণগুলো উৎসর্গ করা ছিল স্বর্গীয় শ্রী নীলেশ সেনকে, আর দ্বিতীয় চরণগুলো উৎসর্গ করা ছিলো আমাকে।’
—— ——- —— ——-
শহীদুল বলছিল — নদীর কূলে এই সন্ধ্যায় তুই একটি আনন্দময় স্মৃতির কথা শোনা আমাকে। এত দুঃখের কথা আর সইতে পারি না।
রোহিত বলছিল — তবে শোন্ আনন্দময় এক সন্ধ্যারাত্রির কথা —
আরিজোনা ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার
একবার দক্ষিণ আরিজোনার টুসন শহরে যাত্রা বিরতি করেছিলাম। হোটেল থেকেই জানতে পারি সোনারন নামে একটি মরুভুমিতে নাকি থোকা থোকা কমলা রঙের ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার ফুটে থাকে। আরও আছে বালিয়াড়িতে প্রান্তরের পর প্রান্তরে ক্যাকটাসের ঝাড়। হাতে সময় নেই। পরের দিনই চলে যাব লাসভেগাস। আমার খুব দেখতে সাধ হলো মরুভুমিতে ফুটে থাকা ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার আর ক্যাকটাসের ঝাড় । হোটেলের ইনফরমেশন সেন্টার থেকে সোনারন যাওয়ার সব তথ্য জেনে নিলাম। ওরা আমার সাথে একজন গাইড নিয়ে যাবার পরামর্শ দিল এবং একজন গাইডের ব্যবস্থা করেও দেয় আমাকে।
গাইড মেয়েটির নাম — নিকিতা জুলি। আরিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির একজন ছাত্রী। জুয়োলজীতে পড়াশোনা করে। মেয়েটি ল্যাটিনা। ভেনেজুয়েলা থেকে এসেছে। ভারতীয় মেয়েদের মতো কালোকেশী। অসম্ভব সুন্দরী, নদীর মতো দেহবল্লরী তার। চমৎকার ইংরেজিতে কথা বলে। ইউনিভার্সিটি ভ্যাকেশন সময়ে সে পার্টটাইম জব হিসেবে টুসন শহরে আগত পর্যটকদের গাইড হিসাবে কাজ করে।
সকাল দশটার দিকে একটি পর্যটন মাইক্রোবাসে করে সোনারন মরুভূমির উদ্দেশ্য রওনা হই। আমাদের সাথে ছিল আরও ছয়জন নারী পুরুষ। তারাও যাবে সোনারন দেখতে।
আমি আর নিকিতা সামনের সিটে বসে আছি। চলতে চলতে মাইক্রোবাসটি শহর ছেড়ে একসময় মরুভূমিতে যেয়ে পড়ে। চারিদিকে ধু-ধু বালুকাময় প্রান্তর। কিন্তু এখানকার বালি অনেকটা ঊষর। জায়গায় জায়গায় পাথুরে মাটিও দেখতে পাই। নিকিতা আমাকে বলছিল, এই একমাত্র মরুভূমি তুমি একটু পর দেখতে পাবে ছোট্ট ছোট্ট টিলা। এবং পাহাড়।
মাইক্রোবাসের অন্য সঙ্গীরা যে যার মতো আনন্দ করছে, স্ফূর্তি করছে, হুল্লোড় করছে, বিয়ার খাচ্ছে, গান গাইছে। নিকিতা আমাকে বলছিল –‘ তুমি কী কিছু খাবে?’ বললাম ‘দাও।’
‘কী দিব?’
‘আনারসের জুস’।
নিকিতা একটু বিস্মিত হলো!
কী অপূর্ব দৃশ্য অপেক্ষা করছিল! মরুভূমির বালি ফুঁড়ে সবুজ ঘাস ! অপেক্ষা করছিল আরও বিস্ময় ! রাস্তার দুপাশে ক্যাকটাসের জঙ্গল। জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে কমলা রঙের অজস্র ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার ফুটে আছে। সুন্দর আবহাওয়া, বেশ মোলায়েম । না শীত, না গরম। নিকিতার দিকে চেয়ে দেখি– এখন যে তার গানের সময়। স্প্যানিস ভাষায় সে গুণ গুণ করে গান গাইছে। আমি ওকে বলেছিলাম, তুমি যে গানটি গাইলে তা ইংরেজিতে একটু ট্রানস্লেট করে কথাগুলো বলো না ! ও বলছিল —
‘How it is to be with you
From the first day I saw your face
I knew this love was true…’
প্রান্তরের পর প্রান্তর মাইলের পর মাইল পথ ছাড়িয়ে যাওয়ার পর একটা বাড়ি চোখে পড়ে। আসলে এটি একটি গেস্ট হাউজ। পরে দেখলাম, এই রকম গেস্ট হাউজ একটি নয়, বেশ কয়েকটি আছে। নিকিতা বলছিল — ‘এইটিই সোনারন ডেজার্ট।’ যে সমস্ত পর্যটকরা এখানে এসে রাত্রিযাপন করতে চায়, তারা এই গেস্ট হাউজ গুলোতে ওঠে। এখানে রেস্টুরেন্ট ও বার আছে। আছে মিউজিক ক্যাফে ও স্পোর্টস কাফেও।’ একটি মিউজিয়ামও দেখলাম। আমি আর নিকিতা একটি রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করে নেই। তখন বিকেল হয়ে যায় ।
এখান থেকে অদূরে ছোট বড়ো পাহাড় দেখতে পেলাম। তারও আরো দূরে সানফ্রান্সিসকো পর্বতমালা। এখানে আগত নারী পুরুষ ও ছেলেমেয়েদের প্রধান আনন্দময় জায়গা হচ্ছে এই পাহাড়ের পাদদেশ।
নিকিতা আমাকে বলছিল — ‘ তুমি কী ঐ পাহাড়ের পাদদেশে যাবে?’ আমি বললাম, যাব। হেঁটে হেঁটে দুজন যাচ্ছিলাম পাহাড়ের দিকে ক্যাকটাস আর ওয়াইল্ডফ্লাওয়ারের ঝাড়ের ভিতর দিয়ে। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছিল। ছায়া ছায়া ময় মনোরম পরিবেশ। সবুজ গালিচার মতন ঘাসে পাথর ঢাকা। কত নারী পুরুষ আলিঙ্গনবদ্ধ হয়ে নিজেকে সপে দিচ্ছে পাহাড়কে সাক্ষী রেখে। অনেক ছেলেমেয়ে এখানে এসে প্রপোজ করে ভালোবাসার। ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার হাতে দিয়ে বলে – I love you, I marry to you.
কয়েকজোড়া ছেলেমেয়েকে দেখলাম — প্রপোজ শেষে হাত ধরে জড়িয়ে হেঁটে হেঁটে আরও দূর পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি নিকিতাকে বলি — ওরা কোথায় যাচ্ছে?
নিকিতা বলছিল — ‘ওরা মরুভুমি ভালোবাসে, ওরা পাহাড় ভালোবাসে। আজ রাতটা এখানেই কাটাবে ওরা। খোলা আকাশের নীচে শুয়ে থাকবে। পৃথিবীটাই ওদের বিছানা।’
তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছিল। দেখলাম প্রচন্ড একটি চাঁদ উঠেছে আকাশে। জ্যেৎস্নায় ভাসছে প্রান্তর। ভাবছিলাম, কী নির্জনে মধুযামিনী না হবে ওদের ! চাঁদের নিচে ঘাসের শয্যা।
নিকিতা বলছিল — ‘যাবে না তুমি?’ বলেছিলাম — যেতে ইচ্ছে করছে না যে !
১৩.
পরেরদিন সকালে রোহিত ঘুম থেকে উঠে ছায়া রাণীকে ডেকে বলে — ছায়া, আজ বিকালে শহর থেকে মণিকারা আসবে, এখানে থেকে শহীদুল ওর বউকে নিয়ে আসবে। সন্ধ্যার পর আমরা সবাই মিলে একটু আনন্দ করব।
আর একটি কথা, আমি আগামীকাল সকালেই চলে যাচ্ছি। মন খুব করে চেয়েছিল জন্মভূমি দেখতে, এখানকার মাটির গন্ধ নিতে, শৈশবের ধূলির পথগুলো থেকে ধূলো পায়ে মাখতে। আমার সেই অদম্য তৃষ্ণা কিছুটা হলেও মিটেয়েছি। যদিও এ তৃষ্ণা চিরতরে মিটাবার নয়। আকুতি থেকেই যাবে। যা হোক যতটুকু মিটিয়ে নিলাম, ঐ প্রবাস বিভূঁইয়ে এখন আর মন প্রাণ তেমন উতলা হবে না।
ছায়া রাণী কাঁদছিল। রোহিত বাহুতে ওকে জড়িয়ে ধরে বলে — পাগলি ! তুই কাদছিস কেন? যদি বেঁচে থাকি, আবার হয়ত এমনই হুট করে একদিন চলে আসব।
— দাদা, তুমি আমাকে হঠাৎ করে বলছ, তুমি চলে যাবে। একটুও সময় দিলে না। তোমাকে ওট পিঠা, দইলা পিঠা, মালপোয়া, চদ্রপুলি, দুধের পিঠা কিছুই বানিয়ে খাওয়াতে পারিনি। জেঠী মা এগুলো তোমাকে বানিয়ে খাওয়াতো। তুমি খুব পছন্দ করতে।
— মন খারাপ করিস না। আমি আবার তো আসব, তোকে বললাম। তখন বানিয়ে খাওয়াবি।
— আমার মাথার দিব্বি রইল। তুমি আবার আসবে কিন্তু।
— আচ্ছা। জামাই বাবু ও রঞ্জিতকে বলে রাখবি, ওরা যেন কাল সন্ধ্যায় থাকে। আর, শোন্ — এই টাকাগুলো রাখ, বাজার করবি। সবাইকে দুমুঠো ডাল ভাত খাওয়াতে হবে তো !
আমি একটু শহীদুলের ওখানে যাচ্ছি। দুপুরেই চলে আসব। এসে তোর সাথে বসে একসাথে খাব।
— নাস্তা করে যাও।
— শেফালী ভাবীর কাছে থেকে খেয়ে নেব।
রোহিত শহীদুলের বাড়িতে পৌঁছেই শহীদুলের স্ত্রীকে বলে — ভাবী, সেমাই রান্না করো। মুড়ি দিয়ে সেমাই খাব। সেই কতকাল ধরে মুড়ি দিয়ে সেমাই খাই না।
— রোহিত দা, আপনেরা দুই বন্ধু গল্প করতে থাকেন, আমি ঝটপট সেমাই রান্না করে নিয়ে আসছি।
শহীদুল রোহিতকে বলছিল, তুই কাল কখন যাবি?
— সকাল নয়টার মধ্যে বের হয়ে যাব।
— তোকে একটা কথা বলি রোহিত। এখনও তো জীবন অনেকখানি রয়ে গেছে। এই ধর্ — পাঁচ বছর, দশ বছর, বিশ বছর বাঁচতেে পারিস। এই সময়টুকু সায়াহ্নকাল। অসুখ বিসুখ, শারিরীক কত অক্ষমতা আসে মানুষের । তাছাড়া একাকীত্ব তো আছেই। তুই একটা বিয়ে করে নে।
— নারে, সংসার আসক্তি আমার একদমই নেই। ভালোবাসা মায়া মমতা সবই মুক্ত বিহঙ্গের মতো ব্যপ্ত হয়ে আছে আকাশে। আমার আছে নীল আকাশ। আমার আছে মেঘ। যদি কখনও নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ লাগে, যদি একা এলা আর না চলতে পারি, তবে মেঘকে বলব, তুমি বৃষ্টি ঝরাও, বলব — তুমি কাঁদো। না হয়, ঈশ্বরকে ডাকব, বলব — তুমি আমাকে নিয়ে যাও।
— আমি বুঝিনা তোর এইসব কথা।
— সে বহুকাল আগে স্বপ্নে পাওয়ার মতো ডানা মেলে উড়ার আকাশ পেয়েছিলাম। ছোট্ট একটি ঘরে সংসার গড়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। সেই আকাশটা, সেই ঘরটা আর পাওয়া হয়নি। সবই স্বপ্নেে থেকে পাওয়া ছিল। স্বপ্ন ভেঙে গেছে। সবকিছু হারিয়ে গেছে।
— তুই বিয়ে কর, তুই সবকিছু আবার ফিরে পাবি।
— এই জীবনে আর রাজ্যপাট গড়তে চাই না। কত কিছুই ঘটে পুরো জীবন অব্দি। কতজন কত কিছু পায়, রাজ্য, রাজরাণী, রাজকন্যা — কতকিছু ! এই সব অনেকেই পায়, যারা সৌভাগ্যবান। অনেকে আবার পেয়ে হারায়। আবার কেউ কেউ পায়ই না। প্রবঞ্চিত যারা।
জীবনে কত কিছুই ঘটে গেল। কত দেশ দেখলাম , কত নব নব মুখ, কত তুষার পড়া শীতের রাত্রি।পুষ্প কাননে ফুটে থাকা কত নতুন ফুল, পদ্ম-কুসুম দামের কত হৃদয় কেঁদে কেঁদে দিঘির জলে মিশিয়েছে, কত সে মায়া বিদুর স্মৃতি!…
— আমি কিছু অনুমান করতে পারছি। তোর এই অপ্রাপ্তি, তোর এই হাহাকার ও গ্লানি কিসের জন্য, কার জন্য?
— অনুমানের কথা তোর ভিতরেই থাক্। যে কথা বলা হয়নি এতকাল তা আর এই সায়াহ্ন কালে নাইবা বলা হলো। তা অপ্রকাশিতই থাক। কোনো কথা না বলা মিথ্যা বলা নয়।
শেফালী এসে বলে — চলুন খাবার টেবিলে। মুড়ি সেমাই খেয়ে নিন।
নাস্তা খাওয়ার পর রোহিত শহীদুলকে বলে — আলোকদিয়ার পুরানো জমিদার বাড়ির সামনে একটি দিঘি ছিল না ! ঐ দিঘিতে নেমে স্নান করতে ইচ্ছা করছে। ছোট বেলায় ঐ দিঘিতে নেমে আমরা কত জলখেলা করেছি না ! আহা, কী শীতল ছিল জল। গা ঠান্ডায় জুড়ে যেত। আচ্ছা শহীদুল, জমিদার বাড়ির ঐ দিঘির জল এত ঠান্ডা ছিল কেন?
— তা জানি না। চল্ জলকে চল্। তপ্ত দেহখানি শীতল করে নিবি। ‘
দুপুরে রোহিত বাড়িতে এসে ছায়া রাণীকে নিয়ে একসাথে বসে ভাত খেয়ে নেয়। খেতে খেতে রোহিত ছায়া রাণীকে বলছিল — তুই এই বাড়িটিকে আনন্দে ভরে রেখেছিস। তুই না থাকলে এই বাড়িতে একটি মূহুর্ত আমি থাকতে পারতাম না। আমার মায়ের শূন্যস্থাম তুই পূরণ করেছিস , রোহিনীর ও বৌদিদির অভাবও দূর করে দিয়েছিস। মনেই হয়নি আমি সব হারিয়ে বসে আছি।
আর, একটা জিনিস আমার খুব ভালো লেগেছে তা হলো — এই আঁধার হয়ে যাওয়া বাড়িটিতে কেউ না কেউ প্রতি সন্ধ্যায় সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালায়ে রাখে। ধান ধূপ দিয়ে ঠাকুরের ঘরে পূজা দেয়। স্বর্গীয় পূর্ব পুরুষদের আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করে। তুই তাই করছিস। আমি তোর কাছে ঋণী হয়ে রইলাম ছায়া।
ছায়া রাণী অঝোর ধারায় কাঁদছিল।
১৪.
বিকালে মতি মিয়া এসে রোহিতকে খবর দিয়ে যায়, শহর থেকে মণিকা’রা চলে এসেছে সন্ধায় এখানে চলে আসবে।
সন্ধ্যার পর সবাই চলে আসে। মণিকা, জামাইবাবু, ঐশ্বর্শময়ী ও মতি মিয়া । শহীদুলদের বাড়ি থেকে আসে শহীদুল ও তার স্ত্রী শেফালী। আর বাড়ির মানুষের ভিতর ছায়া রাণী, ছায়া রাণীর স্বামী ও রঞ্জিত।
উঠোনে লিচু তলায় চেয়ার সাজিয়ে রাখা আছে। সবাই গোল হয়ে বসে একে অপরের সাথে গাল গল্প, স্মৃতিচারণ, সুখ দুঃখের নানান কথা আদান প্রদান করতে থাকে।
কাকতালীয় ভাবে সেদিন ছিল হেমন্তের পূর্ণিমার রাত। সন্ধ্যা রাত থেকেই বাড়ির সারা উঠোন জুড়ে চাঁদের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠে। রোহিত মণিকাকে বলে — তুমি একটা গান গেয়ে শোনাও। মণিকা আজ পরেছে সোহাগপুরের নীল রঙের তাঁতের শাড়ি। গলায় পরেছে শিউলি ফুলের মালা। খোঁপায় এক গুচ্ছ সাদা অতসী ফুল। খুব সুন্দর লাগছিল ওকে। মণিকা খালি গলায় গাইতে থাকে রবি ঠাকুরের গান —
‘আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে ॥
যাব না গো যাব না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে–এই নিরালায় রব আপন কোণে।
যাব না এই মাতাল সমীরণে ॥
রোহিত রঞ্জিতকে বলছিল, তুমি একটি কবিতা আবৃত্তি করে শোনাও। রঞ্জিত শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটি আবৃত্তি করে —
‘ স্বাধীনতা তুমি
রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান। স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল…।’
ছায়া রাণী গেয়ে শোনায় রজনীকান্ত সেনের একটি গান —
‘ তুমি, নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে।তব, পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক্,
মোর মোহ-কালিমা ঘুচায়ে…. ।’
এবার রোহিত সবাইকে উদ্দেশ্যেে বলে — খুব ভালো লাগল এতক্ষণ সবার গান ও কবিতা শুনে। মনে হলো, ‘এত সুর আর এত গান ওগো যদি কোনোদিন থেমে যায়।’ পরক্ষণেই রোহিত বলে — না, থামবে না।
আমি আমার সবচেয়ে প্রিয় কিছু মানুষকে নিয়ে আজ এখানে এই নির্মল জোছনা রাতে সমবেত হয়েছি। আমি সব হারানো একজন নিঃসঙ্গ মানুষ। যায়াবরের মতো পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে বেড়াই। কতকাল পরে কী এক অসীম মায়ার টানে এখানে এই মাটির ক্রোরে কয়েকদিনের জন্য ফিরে এসেছিলাম। এসে দেখি, এখনও কয়েকজন মানুষ আছে, যারা জন্ম জন্মান্তরের আপন। যাদের ভিতর আমার আত্মার স্পন্দন অনুভব করেছি। যদি ফিরে না আসতাম তাহলে এই প্রিয় মানুষ গুলোকে না দেখেই আমার অতৃপ্ত চোখ চিরতরে বন্ধ হয়ে যেত।
কেন যে আমি পৃথিবীর এই ছোট্ট কোণের অপূর্ব সুন্দর এই হরিনা গোপাল গ্রামটি থেকে এক আঁধার রাতে চলে গিয়েছিলাাাম। সে কথা চিরদিনের জন্য না বলা হয়েই থাকল। শুধু এইটকু বলব, সেটি নিতান্তই তারুণ্যের আবেগ ছিল। সেটি ছেলেমানুষী এক ভুল অভিমান ছিল। আজ এত বছর পর উপলব্ধি করছি, এর জন্য আমাকে কতই না মূল্য দিতে হয়েছে। কত বিনিদ্র রাত কেটেছে নিরব অশ্রুপাতে।
মাঝে মাঝে খুব করে মনে হতো — আমার অমঙ্গলে, অসুখ বিসুখে, আমার রোগ মুক্তির জন্য কোনো আপন মানুষ কী প্রার্থনা করে? কত সময়ে তপ্ত জ্বরে শরীর পুড়ে যেত, প্রবাসে সেই অজ্ঞাতে কেউ কাপড়ে জল ভিজে জলপট্টি দেয়নি কপালে।
মানুষের যখন বয়স বাড়ে, তখন তার বোধের অনেক কিছু দূর্বল হয়ে যায়, এই ধরো — আমার তারুণ্যে যে অভিমান ছিল, সে অভিমান এখন আর নেই, তা অবদমিত। সবাই আহাম্মক হয় না, কেউ কেউ হয়। আমি ছিলাম সেই আহম্মকের দলে। কত কুসুমাস্তীর্ণ জীবনই না হতে পারত এই জীবন। তার কোনো সুবাসিত ফুলই ফোটাতে পারিনি। তবু জীবন আছে। কেন যে এখনও এই পৃথিবীর মধ্যখানে প্রবল ভাবে বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে। বিধাতা একমাত্র এই পৃথিবীকেই বহু অমূল্য রূপ সৌন্দর্য দিয়ে তৈরি করেছেন।
একটা জিনিস জীবনেরএই ক্রান্তিলগ্নে এসে উপলব্ধি করছি — কারোর প্রতি চির অভিমান করতে নেই। কাপুরুষের মতো সবাইকে ছেড়েছুঁড়ে জনমের তরে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে নেই। তোমরা হয়ত বলতে পারো — ‘জীবনটা আবাার সংশোধন করে নিন।’ কিন্তু কী লাভ আর সংশোধন করে ? জীবনই তো শেষ ! ভাঙা এই প্রবঞ্চিত জীবনে কেউই তো আর নেই।
এই দীর্ঘকালে কত প্রিয় মানুষকে হারিয়েছি। পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার সময় তারা দেখতে পায়নি আমার মুখ, আমিও দেখতে পাইনি শেষ বিদায়ের ক্ষণের তাদের অশ্রু সজল মুখখানি। শুনতে পইনি তাদের রক্তাক্ত আর্তনাদ। এদেশের স্বাধীনতার জন্য তারা চরম মূল্য দিয়ে গেছেন। বাবা মা ভাই ছোট বোনকে হারিয়েছি। তাদের মতো এই গ্রামের অনেক মানুষ শহীদ হয়েছেন। রোহিনীর মতো অনেক মা বোন তাদের অমূল্য সম্ভ্রমকে এদেশের স্বাধীনতার জন্য বিলিয়ে দিয়ে গেছে।
আমি আগামীকাল সকালে চলে যাব। আবার কবে আসব, কিংবা আর আসা হবে কী না জানি না। হয়ত আসব, হয়ত আসব না। আমার মন এবং আত্মা বারবার আমাকে বলছিল — ‘তোমার কিছু দায় আছে, তোমার কিছু ঋণ আছে, তা তুমি শোধ করে যাও।’
এই যে আজ এখানে উপস্থিত আছে আমার পরম বাল্যবন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম, এখানে উপস্থিত আছে তরুণ দুটি প্রাণ মণিকা ও রঞ্জিত। ওদের দুজনের ভিতর আমি প্রত্যয় দেখেছি। ওদের দুজনকে আমি কিছু দায়িত্ব দিয়ে যাব। ওদেরকে উপদেষ্টা হিসাবে সহায়তা করবে আমার বন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম। ওদের দুজনের পাশে আরও থাকবে, ছায়া রাণী, নাসির উদ্দীন ও ছায়া রাণীর স্বামী সুবোধ দত্ত।
যে কাজটি করতে হবে তাহলো — মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষিত সকল বীরাঙ্গনাদের নাম লিপিবদ্ধ করতে হবে । যে সমস্ত ধর্ষিতারা শহীদ হয়েছেন, মৃত্যুবরণ করেছেন এবং যারা বেঁচে আছেন তাদের নাম । বাংলাদেশের প্রতি গামে গঞ্জে, শহরে, বিভিন্ন জনপদে হেঁটে হেঁটে, ঘুরে ঘুরে, খুঁজে খুঁজে বের করতে হবে তাদেরকে। অনেক বীরাঙ্গনা আছে যারা লজ্জায় তাদের আত্মত্যাগ ও পরিচয় গোপন করে রেখেছে। তাদেরও খুঁজে বের করেতে হবে এবং বলতে হবে তাদের — দেশের জন্য তোমরা যে ত্যাগ স্বীকার করেছ এজন্য মোটেই তোমরা অসম্মানিত নও। ঘৃণিত নও। তোমরা মহান, এবং মহিয়সী। তোমাদের ত্যাগ আমরা কোনদিন ভুলব না।
কাজটি অনেক কঠিন এবং বিশাল। তোমরা একা এই কাজ শেষ করতে পারবে না। কিন্তু তোমরা শুরু করবে। এর আগে কিছু কাজ ডঃ নীলিমা ইব্রাহীম, মালেকা বেগম, বেগম মুশতারী শফি, বাসন্তীগুহ ঠাকুরতা ও ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী’রা করে গেছেন। তারা যেখানে শেষ করেছেন, তোমরা সেখান থেকে শুরু করবে। তোমরা শুরু করবে এই হরিনা গোপাল গ্রাম থেকে। তারপর ইউনিয়ন, থানা ও নিজ জেলায় প্রতিটি গ্রামে এবং লোকালয়ে যাবে । তোমাদের এই কর্মযজ্ঞ ছড়িয়ে দিতে হবে সারা দেশে।
তোমাদের না বলেই আমি একটি ট্রাস্ট করে ফেলেছি। যার নাম দিয়েছি ‘রোহিনী স্মৃতি কল্যাণ ট্রাস্ট’। তোমরা সবাই জানো, আমার এই আদরিনী ছোট বোনটি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক আর্মির দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিল এবং তাকে পরে গুলি করে নৃশংস ভাবে হত্যা করেছিল।
রোহিত তার ব্যাগ থেকে একটি ছোট্ট কাঁচের বক্স বের করে। বক্সের ভিতর রয়েছে পুরানো জীর্ণ একটি বকুল ফুলের মালা । রোহিত বলে — এটি একটি রাখী। এই রাখিটি আজ থেকে তেত্রিশ বছর আগে এক রাখীবন্ধনের দিনে রোহিনী আমার হাতে পরিয়ে দিয়েছিল।
রোহিত কিছুক্ষণ নিরব থাকে। চশমার ফ্রেমের নীচে আঙুল ঢুকিয়ে চোখের জল মুছে নিয়ে উপস্থিত সবাইকে বিশেষ করে মণিকা, রঞ্জিত ও শহীদুলকে বলে — ‘আমি যে কাজের কথা বললাম, তা তোমরা করতে পারবে না? ‘
সবাই আস্থার সাথে সমস্বরে বলে — পারব।
তারপর রোহিত ব্যাগ থেকে একটি দলিল বের করে। দলিলটি সবাই কে দেখিয়ে বলে — আমি আমার সমস্ত সম্পত্তি ‘রোহিনী স্মৃতি কল্যাণ ট্রাস্টে’র নামে দান করে দিয়েছি। যার তত্বাবধায়ক হচ্ছে দুজন — মণিকা ও রঞ্জিত। এদের দুজনকে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।’
দলিলটি ছায়া রাণীর হাতে দিয়ে রোহিত বলে, এটি তোর কাছে পবিত্র আমানত হিসাবে জমা থাকল। তুই এই বাড়ি, জায়গা জমিন সব দেখেশুনে রাখবি। তুই মণিকা ও রঞ্জিতকে মায়ের স্নেহ দিয়ে আগলে রাখবি সারা জীবন।
রোহিত মণিকাকে বলে — মা একটু কাছে আয়। রঞ্জিতকেও কাছে ডাকে। দুজনকে দুই বাহুতে জড়িয়ে নিয়ে বলে — ‘ কী ! তোমরা আমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে না?’ ওরা দুজনেই বলে — জ্বী, পারব।
মণিকা উপস্থিত সবাইকে আবার একটি গান গেয়ে শোনায় —
আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে। এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে।
আমার এই দেহখানি তুলে ধরো, তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো–
নিশিদিন আলোক-শিখা জ্বলুক গানে।
আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব, সারা রাত ফোটাক তারা নব নব।
নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো, যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো–
ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊর্ধ্ব পানে।
গান শেষ হয়ে গেলে রোহিত সবাইকে বলে — ছায়া রাণী চমৎকার সব রান্না করে রেখেছে। তোমরা সবাই খেয়ে যাবে।
জই রোহিতের এ বাড়িতে শেষ রাত্রি। সে তার বাবা মার খাটের উপর শুয়ে আছে। ঘুম আসছে না চোখে। সে উঠে খাটের উপর কিছুক্ষণ বসে থাকে। ঘরের লাইটটা জ্বালিয়ে দেয়। আনমনা হয়ে ঘরের ভিতর পায়চারী করতে থাকে। মায়ের কথা খুব মনে পড়ছিল তার ।
রোহিত ভাবছিল — মার কোনো অভিজ্ঞান বা কোনো স্মৃতি চিহ্ন কী এই ঘরে নেই? সে ঘরের এক কোণে বহু পুরানো একটি কাঠের তোরঙ্গ দেখতে পায়। তোরঙ্গটি অব্যাবহৃত ও অযত্নে পড়ে আছে। কাঠের ঢাকনার উপর ধূলো জমে গেছে। তালা লাগানো নেই। রোহিত বাক্সটা খুলে ফেলে। ভেতর থেকে উৎকট ভ্যাপসা গন্ধ বের হয়। তেলাপোকা দৌড়াদৌড়ি করছে। বাক্সের ভিতর দুটো লেপ, একটি কাঁথা, একটি লোহার সুপারির যাতি ও একটি পিতলের পানের ডাবর দেখতে পায়। লেপের কাপড় ছিঁড়ে ছিটে তুলা সব বের হয়ে গেছে। তেলাপোকা সেখানে বাসা বেঁধেছে। কাঁথাটা পুরনো হয়ে গেলেও মোটামুটি ঠিক আছে। রোহিতের মনে পড়ে — মা কাঁথাটি তার পরনের কাপড় দিয়ে রাঙা সুঁতোর কাজ করে তাকে সেলাই করে দিয়েছিল। রোহিত এই কাথাটি গায়ে দিত। কাঁথাটি তোরঙ্গ থেকে বের করে ঝেরে ভাজ করে তার ব্যাগের ভিতর ঢুকিয়ে নেয়। সে ভাবছিল — মায়ের পরনের কাপড় দিয়ে তৈরি এই কাঁথাটি সে বাকী জীবন গায়ে দিয়ে ঘুমাবে। মনে হবে তার — মা তাকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে রেখেছে।
রোহিত দরজা খুলে বাইরে আসে। সে দেখতে পায়, সন্ধ্যা রাত্রির সেই অপূর্ব চাঁদটি একাকী মধ্য গগনে টুপটুপ করে জ্যোৎস্না ঝরিয়ে দিচ্ছে। ওর কান্না পায়। তার মায়ের কথা মনে পড়ে। অপূর্ব সুন্দর ঐ চাঁদটি যেন মায়ের প্রীতি আনন্দের বারতা দিচ্ছে। আশাময়ী, হাস্যময়ী মা যেন আশীর্ববাদ করছে — “কাঁদে নাা বাপ, তোমার জীবন সুন্দর হোক, তোমার পথচলার পথের ধূলি মধুময় হোক। জগৎ সংসারে তুমি ভালো থেক বাপ।” আকাশটা যেন তার স্নেহে মমতায় জ্যোৎস্না হয়ে ঝরে পড়ছে বিন্দুতে বিন্দুতে। নিজেকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে…ঝিরি ঝিরি.. টুপ…টাপ।
১৫.
রোদ্রকরোজ্জ্বল সুন্দর সকাল আজ। রহিত আজ চলে যাচ্ছে। মণিকা, ছায়া রাণী, শহীদুল, শেফালী, নাসির, রঞ্জিত, ঐশ্বর্যময়ী সহ সবাই উপস্থিত আছে। রাস্তায় উপর একটি রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। সবাই রোহিতকে বিদায় জানানোর জন্য পাকা রাস্তা পর্যন্ত চলে এসেছে।
শহীদুল রোহিতকে বলে — ‘আমরা তোকে শহর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসি না হয়।’
— ‘না। আমি একাই চলে যাব। চারদিকে অপূর্ব রুপোলী রোদ, মাথার উপর নীল আকাশ, রাস্তার দুপাশে বিস্তৃর্ণ ফসলের মাঠ। বনকূচের লাল ফুল, অনন্ত লতা, সোনালের হলদে ফুলের শোভা, বৈচীর ঝোপ, বাঁশঝাড়, গাঙশালিখদের গর্তে লুকিয়ে যাবার দৃশ্য দেখতে দেখতে চলে যাব। ভালোই লাগবে আমার। পথে চলব আর– বনে, বাগানে, পাখিদের এলমেল কলকাকলি শুনব। দক্ষিণ হাওয়ায় ভেসে আসবে বুঁনো ভাট ফুলের রোদ্র-স্নিগ্ধ গন্ধ। উদ্দাম আনন্দ উচ্ছাসে ভরে উঠবে
মন।
একটু উদাস উদাস লাগছিল রোহিতকে। রোহিত শহীদুলকে বলে — চল একটু ওধারে যাই। পুকুর পাড়ে বেলীফুলের ঝাড়ের আড়ালে ।
ওরা দুজন চলে যায় পুকুর পাড়ে।
রোহিত শহীদুলকে বলে — একটা সিগারেট দে। খাই।
শহীদুল নিজেই রোহিতের ঠোঁটে সিগারেট ধরিয়ে দেয়।
রোহিত সিগারেট টানতে থাকে। কিছুক্ষণ মুখে কোনো কথা নেই। চোখ ছলছল করছে। রোহিত করুণ চোখে শহীদুলের মুখের দিকে চেয়ে বলে — এই কাগজটি নে। এখানে আমার কিছু কথা লেখা আছে। আমি চলে যাবার দু’ তিনদিন পরে এই চিঠিটি পড়বি। আমি যখন পৌঁছব তখন। তার আগে নয়। ‘
শহীদুল বলে — ‘আচ্ছা।’
সিগারেট খেয়ে শেষ করে দুজনেই পুণরায় চলে আসে রাস্তার উপর ।
মণিকা বিষণ্ণ মুখে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল এতক্ষণ। ভিতরে ভিতরে বইছিল কান্নার ধারা। সে রোহিতের কাছে চলে আসে। রোহিতের পাঁজরেে কপাল ঠেকিয়ে অঝোর ধারায় ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে। কান্নার ভিতর কিছু কথা অস্পস্ট ভাবে শোনা গেল কেবল — ‘আপনাকে আমার এত আপন লাগছে কেন? কী মায়া রেখে গেলেন ! অন্তর বীণার তার ছিঁড়ে যাচ্ছে যে ! ‘
‘পরানে বাজে বাঁশি, নয়নে বহে ধারা–
দুখের মাধুরীতে করিল দিশাহারা
সকলই নিবে-কেড়ে, দিবে না তবু ছেড়ে–
মন সরে না যেতে, ফেলিলে একি দায়ে।’
সবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে রোহিত রিকশার দিকে এগুতে থাকে। ঠিক তখনই পিছন থেকে ঐশ্বর্যময়ী বলে ওঠে — দাদু, তোমার গল্পটা শেষ করে গেলে না। ‘
রোহিত ফিরে এসে ঐশ্বর্যকে জড়িয়ে ধরে গল্পের শেষ টুকু শোনায়– ‘ ‘তারপর কী হলো শোনো — সেই মেঘের দেশে হঠাৎ ঝমঝম করে বৃষ্টি নামতে শুরু করল । বৃষ্টিতে ভিজে আমি শীতে কাঁপতে থাকি। আমার ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে দেখি — পরীটা নেই। ও চলে গেছে। পড়ে বুঝতে পারলাম, পরীটাকে আমার স্বপ্নের ভিতর পাওয়া ছিল। স্বপ্ন ভেঙে গেছে, পরীও চলে গেছে।
রোহিত যেয়ে রিকশায় উঠে। পিচঢালা পথ ধরে রিকশাটি চলতে থাকে সম্মূখপানে। পিছনে পড়ে থাকে — তার দূরন্ত শৈশব, মাটির সোঁদা গন্ধ, মৃত্তিকার নীচে আপন মৃত মানুষের করোটি, বাতাসে রোহিনীর কান্নার ধবনি, দিগন্তে মেঘের আড়ালে দীপ্যমান দুঃখিনী মায়ের মুখচ্ছবি। আর যে থাকল সে দুজন হতভাগ্য মানব মানবীর অবিচ্ছেদ্য রক্ত মাংসের তৈরি পিতৃ-মাতৃর স্নেহ বঞ্চিত একটি মেয়ে মণিকা।
উপেক্ষিতা হয়ে আরও একজন থেকে গেল। সে অপার্থিব। দূরালোকে সে চলে গেছে। কেউ জানে না, রোহিত কুমার সেনের সে কী ছিল ? যাকে পায়নি সে এই জীবন কালে। সে যে জনম জনম প্রবঞ্চিতা, সে যে এক অপ্রাপণীয়া।
রোহিতের সামনে কিছুই নেই। সংসার নেই। ঘর নেই। কেউ নেই। সেও অপ্রাপণীয়। দূর প্রবাসে কোনো নিঃসঙ্গ শয্যায় প্রিয় মানুষের কোমল হাতের পরশহীন অজ্ঞাত মৃত্যুর জন্য সে অপেক্ষা করবে।
‘আমি তো থাকবই শুধু মাঝে মাঝে পাতা থাকবে সাদা,
এই ইচ্ছামৃত্যু আমি জেনেছি তিথির মতো…
আমি তো থাকবই তোমাদের দুঃখের অতিথি, আমি ছাড়া
দেবতার হাত থেকে কে খুলে পড়বে চিঠি,
কার রক্তের আদেশে মালা হয়ে উঠবে ফুল?
আমি দিয়ে যাব তোমাদের সঙ্গোপন গন্ধর্ব…
এই স্বেচ্ছামৃত্যু আমি নিজেই চেয়েছি।”
সমরেন্দ্র সেনগুপ্তর কবিতা।
কয়েকদিন পরের কথা।
বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে শহীদুল রোহিতের চিঠির কথা ভুলেই গিয়েছিল। আজ হঠাৎ চিঠিটির কথা তার মনে পড়ে। সে প্যান্টের পকেটের ভিতর চিঠিটি রেখেছিল। প্যান্টটি খুঁজতে থাকে। আলনায় প্যান্ট নেই। সে তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করে। তার স্ত্রী বলে, ‘আমি প্যান্টটি ধুয়ে ভাজ করে ওয়ারড্রবের ভিতর রেখে দিয়েছি।’
শহীদুল প্যান্টের পকেট থেকে চিঠিটি বের করে। পানিতে ভিজে চিঠটি এবড়ো খেবড়ো হয়ে গেছে। কাগজ গলে নরম হয়ে জায়গায় জায়গায় উঠে গেছে। ছিঁড়েও গেছে খানিক। পানিতে ধুয়ে লেখা গুলো মুছে অস্পষ্ট হয়ে গেছে।
শহীদুল অনেক কষ্ট করে জোড়াতালি দিয়ে চিঠিটি পড়বার চেষ্টা করে। রোহিত লিখেছে —
সুপ্রিয়য়েষু শহীদুল,
এই পত্রখানি তুই যখন পড়বি তখন আমি তোর থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে থাকব। জীবনের বাঁকে বাঁকে কত বন্ধু আমি পেয়েছি, কিন্তু তোর মতো অকৃত্রিম বন্ধু আর কাউকে পাইনি। সব মানুষের জীবনে এমন কিছু গোপন কথা থাকে …
( অস্পষ্ট ও লেখা পড়া যায় না ).দুই একটি কথা কাউকে না কাউকে বলতে হয় .. আমার কেউ নেই। কাকে বলব? ( অস্পষ্ট.,পড়া যায় না….)
কিছু কথা তেকে বলছি। আল্লাহর দোহাই লাগে, কাউকে বলবি না।
মণিকা আমারই মেয়ে… ( অস্পষ্ট এবং, পড়া যায় না)….
আমি ধর্মান্তরিত ( অস্পষ্ট)…
ঘটনাটি বলছি, সেদিন ছিল কার্তিকের অমাবস্যার পূর্ব রাত্রি। রেবেকা এসেছিল.( অস্পষ্ট)….. অন্ধকারে চোখের জলে .. রুধিরের দাগ.. (অস্পষ্ট, এবং চিঠি ছিন্ন )…….
— — — — — — —- —–
পরিশিষ্ট —
রোহিতের জীবন ধারা থেমে থাকবে না । তার প্রতিদিনের কর্ম অবসরে, বিনিদ্র রাত্রির অন্ধকারে, রোগ শয্যায়, কিংবা অপার্থিব কোনো জ্যোতির্ময় ছায়াপথ থেকে দূর দৃষ্টি মেলে দেখবে — হরিনা গোপাল গ্রামে তাদের বাড়িটাতে সাঁজ অন্ধকার নামছে। ধীর স্নিগ্ধ হাতে ঘরে সন্ধ্যা বাতি জ্বালাচ্ছে ছায়া রাণী। হয়ত সেই আঁধার রাত্রিতে বাড়ির পিছনে ঝিমঝিম করে ঝিঁ-ঝি পোকা গুঞ্জন করে ডাকবে, ডুমুর গাছে কেঁদে উঠবে লক্ষী পেঁচা। নামহীন অনেক পাখিই হয়ত ডেকে ডেকে ফিরে যাবে অন্যত্র, অন্য কোনও বন নিভৃতে ।
সে আরও দেখবে — স্বচ্ছতোয়া পদ্মদিঘি, অরণ্য নিবিড় বাঁশ ঝাড়, ধনিদহ বিলে যেতে বিস্তৃর্ণ মাঠ, দেবী বিশালাক্ষীর পোড়ো মন্দির। এই সবই জলছবির মতো চোখের সামনে ভেসে উঠবে। পোড়ো ঐ মন্দির ঘরের পিছনের বাতাবি লেবুর বন থেকে পাখিদের কলকাকলিও শুনতে পাবে। প্রতি বর্ষায় ইছামতী নদী কানায় কানায় বানের জলে ভরে উঠবে । কস্তুরি ফুলগুলি স্রোতে ভেসে চলে যাবে দূর মোহনায় ।
এক হারানো রাত্রির কথা মনে করে আক্ষেপও করবে রোহিত সেন । যেখানে পুকুরপাড়ের কাঞ্চন-ফুল তলায় ঘাসের উপরে স্বর্গ নেমে এসেছিল বন শেফালীর গন্ধে । বীথিপথে অনাগত দিনে শত হেমন্ত পাখিরা এসে মুখর করে রাখবে হরিনা গোপাল গ্রামের বৃক্ষ শাখায় ।
পৃথিবী ছেড়ে রেবেকা চলে গেছে নক্ষত্রের দেশে।সে হয়ে গিয়েছে আর এক নক্ষত্র। দূর্ভাগা শ্রী রোহিত কুমার সেন মৃত্যুর পর কোনও স্বীকৃত উত্তরসুরী রেখে যেতে পারবে না, যে তাকে স্মরণ করে তার আত্মার শান্তি চেয়ে ঠাকুর ঘরে প্রদীপ জ্বেলে প্রার্থনা করবে। দিন চলে যাবে, ফুরাবে আয়ুষ্কাল, মহাকালে নিবর্তিত হবে দিন মাস বর্ষ। জীবনের সব মর্মর স্বপ্ন, বিষাদ বেদনা, মধু কথা, মাধবী রাত্রিও ফুরাবে একদিন। তবুও চলবে জীবন ধারা, আপন উত্তরসুরী থাক বা না থাক, অন্য কেউ তো থাকবে…..।
আখ্যান শেষ হয় নাই।
হ্যাপি রহমান
অপ্রাপণীয়া উপন্যাসটি কোয়েল তালুকদারের একটি অসাধারণ সৃষ্টি। এটি মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে একটি প্রেমের আখ্যান। এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে কোয়েল তালুকদার বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে থাকবেন। আমি তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করি।
জারা নাওসীন
মুক্তিযুূূূদ্ধের প্রেক্ষাপটে অসম্ভব সুন্দর একটি প্রেমের উপন্যাস। আমি নিশ্চিত এই উপন্যাসটি কালজয়ী হবে।