অপুর পাঁচালি – সত্যজিৎ রায়
প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ১৯৯৫
ভূমিকা
আমার স্বামী ইংরেজিতে লেখা ‘My Years With Apu’ শেষ করে, ওঁর নতুন ছবি ‘উত্তরণ’-এর Screenplay লিখতে শুরু করেছিলেন। যে কোনও লেখা, ইংরেজি অথবা বাংলা, শেষ করে সর্বপ্রথম আমাকে পড়তে দিতেন। তাড়াতাড়ি লিখতেন বলে মাঝে-মাঝে ২/১টা ভুল ত্রুটি থাকলেও থাকতে পারে এবং সেটা যে আমার নজর এড়াবে না এটা তিনি জানতেন, বলতেন, “কোনও ভুল চোখে পড়লে মার্জিনে ‘টিক’ দিয়ে দিয়ো।” আমিও ওঁর কথা মেনে চলতাম।
ওঁর লেখার তিনটে draft হত, 1st draft, 2nd draft এবং সর্বশেষ final draft. ‘অপু’ লেখা শেষ হলে আমি একদিন জিজ্ঞেস করলাম, “কই, আমাকে পড়তে দিলে না তো!” বললেন, “ ‘উত্তরণ’-এর screenplayটা শেষ করে আর একবার অপুটা brush up করে তারপর তোমাকে দেব। But I must say I am very happy with it.”
‘উত্তরণ’-এর লেখাটা শেষ করার সঙ্গে-সঙ্গে ওঁকে Nursing Home-এ থেকে যেতে হল। উনি যে আর ফিরবেন না তখন কি আর জানতাম! তিনমাস দিন রাত প্রায় Nursing Home-এ কাটিয়েছি।
উনি চলে যাবার ১০/১২ দিন পর আমার ছেলে এবং বউমা ওঁর ঘর গোছাতে গেলেন। বউমা জানতেন কোথায় অপুর final draftটা রাখা ছিল—ওঁর চেয়ারের সামনে টেবিলের উপর। কিন্তু সেটা ওখানে না পেয়ে খোঁজা শুরু হয়ে গেল। তিনদিন তিনরাত তন্ন-তন্ন করে খুঁজেও ওটা পাওয়া গেল না। ওটা যে চুরি হয়ে গেছে সে-বিষয়ে আর কারুর সন্দেহ রইল না। আমার মনের অবস্থা বুঝে তিন মাস ওরা আমাকে কিছু বলেনি। আমার ছেলে 1st draftটা খুঁজে পেয়েছিল। সেইটা আমার কাছে এনে বলল, “মা, তুমি ছাড়া এটাকে আর কেউ উদ্ধার করতে পারবে না।” আমি খাতা খুলে একবার তাকিয়ে শিউরে উঠলাম। এ-লেখা আমার স্বামী ছাড়া পড়েন কার সাধ্য। কাটাকুটিতে বোঝাই, কোথাও কোথাও বাক্য শেষ করেননি, ১০ পাতা লিখে তিন পাতায় ফিরে আসতে হচ্ছে, এক কথায় দুর্বোধ্য। হতাশায় মন ভরে উঠল। আর একবার খাতা খুললাম, তারপর আরও একবার, তখন দেখলাম একটু-একটু পড়তে পারছি, কী লিখতে চেয়েছেন বুঝতে পারছি, ওঁর কাজের সঙ্গে নিবিড় ভাবে যুক্ত থাকার দরুন ঘটনাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে। এখন জিদ চেপে গেল। হার মানব? কক্ষনো না। এক বছর আট মাস ধরে অক্লান্ত চেষ্টা করে বইটাকে দাঁড় করালাম। মনে একটা নিবিড় আপসোস থেকে গেল যে final draft-এ উনি নিশ্চয় অনেক সংশোধন করেছেন, অজানা তথ্য যোগ দিয়েছেন, ঘষে-মেজে ভাষাটারও উন্নতি করেছেন, কারণ বাংলা এবং ইংরেজি দুটোর উপরেই ওঁর সমান দক্ষতা ছিল। কিন্তু পাঠকদের কাছে যে বইটা দাঁড় করাতে পেরেছি তার জন্য এত দুঃখের মধ্যেও কিছুটা সান্ত্বনা লাভ করতে পারছি।
নীরেনবাবুর কাছে আমি একান্ত কৃতজ্ঞ। রীতিমত কঠিন কাজ ছিল এটা অনুবাদ করা। কিন্তু উনি অত্যন্ত সফলভাবে এই কাজে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এত ভাল অনুবাদ, একমাত্র আমার স্বামী ছাড়া আর কেউ করতে পারতেন বলে আমার মনে হয় না।
বিজয়া রায়
প্রকাশকের নিবেদন
‘অপুর পাঁচালি’ সত্যজিৎ রায়ের ইংরেজিতে লেখা স্মৃতিকথা ‘মাই ইয়ার্স উইথ অপু’র বাংলা অনুবাদ। ইংরেজি বইখানি প্রকাশের আগেই বাংলায় দুই কিস্তিতে ‘দেশ’ পত্রিকার শারদীয় ১৪০০ ও ১৪০১ সংখ্যায় এটি প্রকাশিত হয়। গ্রন্থাকারে ‘বর্তমান মুদ্রণ তারই কিঞ্চিৎ পরিমার্জিত রূপ।
‘পথের পাঁচালি’, ‘অপরাজিত’ ও ‘অপুর সংসার’—এই ত্রয়ী-চলচ্চিত্র ছাড়া সত্যজিৎ যদি আর কোনও ছবি না-ও তৈরি করতেন তবু সিনেমার ইতিহাসে তাঁর নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকত। কেমন করে, কতখানি বাধা-বিপত্তি ও বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্যে তিনি সৃষ্টির এই সার্থকতায় পৌঁছেছিলেন তার নেপথ্য-কাহিনী ‘অপুর পাঁচালি’। ভবিষ্যৎ চিত্র-নির্মাতা, চিত্র-দর্শক ও সাধারণ পাঠক এ-কাহিনী সমানভাবে উপভোগ করবেন।
লেখক হিসেবে সত্যজিৎ ধীরে-ধীরে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। কিন্তু সে শুধু সর্বজনভোগ্য রোমাঞ্চকর কাহিনীর স্রষ্টা হিসেবেই নয়, সেই সঙ্গে সমালোচক ও মননশীল প্রবন্ধকার হিসেবেও তাঁকে সার্থক হতে দেখেছেন বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষার পাঠক।
‘মাই ইয়ার্স উইথ অপু’ তথা ‘অপুর পাঁচালি’ নিজের ও নিজের কাজ সম্পর্কে তাঁর সর্বশেষ রচনা—যেমন আপন শৈশব ও কৈশোর নিয়ে এর আগে বাংলায় লিখেছিলেন অসামান্য বই ‘যখন ছোট ছিলাম’। নিজের সম্পর্কে এর বেশি আর কিছুই তিনি লেখেননি।
১৯৯৫-এ চলচ্চিত্রের শতবর্ষ পৃথিবী জুড়ে উদ্যাপিত হচ্ছে। বিশ্ব-চলচ্চিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিভা সত্যজিৎ রায়ের এই বইখানি এ-বছরের শুরুতেই প্রকাশ করতে পেরে আমরা স্বভাবতই বিশেষ আনন্দিত।
শ্রীনীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও শ্ৰীনির্মাল্য আচার্যের সতর্ক দৃষ্টি ও যত্ন ব্যতিরেকে এই গ্রন্থের প্রকাশ সম্ভব হত না। তাঁদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
২৫ জানুয়ারি ১৯৯৫
Leave a Reply