অন্তর্জলী যাত্রা – কমলকুমার মজুমদার
.
উপন্যাস সমগ্র – কমলকুমার মজুমদার
ভূমিকা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
জীবনানন্দ দাশের অন্তত বারো কিংবা চোদ্দোটি উপন্যাসের (দু’টিকে বড়গল্প বলা যায়) সন্ধান পাওয়া গেছে এ পর্যন্ত এবং সম্ভবত আরও চারখানি উপন্যাস লুক্কায়িত আছে তাঁর পাণ্ডুলিপির জীর্ণ ভূপে। সেগুলি পুনরুদ্ধার কাজে ব্যাপৃত রয়েছেন ভূমেন্দ্র গুহ। এবং ছোটগল্প লিখেছেন প্রায় একশো কুড়িটি। তাঁর জীবদ্দশায় এগুলির একটিও প্রকাশিত হয়নি। রবীন্দ্রনাথেরও উপন্যাসের সংখ্যা বারোটি এবং ছোটগল্পও একশো’র কমই হবে। সবই তিনি দেখে গেছেন মুদ্রিত অবস্থায়। রবীন্দ্রনাথ একই সঙ্গে কবি ও কথাসাহিত্যিক। কিন্তু জীবনানন্দের এই দ্বিতীয় পরিচয়টি গুপ্ত ছিল বহুদিন। কেউ শখ করে একটি-দুটি উপন্যাস রচনা করতে পারেন, মুদ্রণের সম্ভাবনা থাক বা না থাক। কিন্তু এতগুলি উপন্যাস ও গল্প রচনা, যা বেশ পরিশ্রমসাধ্য কাজও বটে, কোনো রকম পাঠক-প্রত্যাশা না করেও একজন মানুষ, বিশেষত। একজন কবি, কেন করেছিলেন তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।
কমলকুমার মজুমদার উপন্যাস লিখেছেন আটটি এবং কিছু গল্প। উপন্যাসগুলি এবং প্রায় সব গল্পই প্রকাশিত হয়েছে এক্ষণ, কৃত্তিবাসের মতন পত্রিকায়, কোনো বহুল প্রচারিত, অভিজাত বা সওদাগরি পত্রিকায় সে সব রচনার স্থান হয়নি। ব্যতিক্রম শুধু দুটি ছোট গল্প, ‘মতিলাল পাদরি’ ও ‘তাহাদের কথা’ মুদ্রিত হয়েছিল সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায়। কমলকুমার জীবনানন্দের মতন নিঃসঙ্গতা বিলাসী ছিলেন না। জীবনানন্দ যেন ইচ্ছে করেই তাঁর উপন্যাস-গল্পগুলি রেখেছিলেন পাঠকদের চোখের আড়ালে, কেন না, যে-সব পত্র-পত্রিকায় তিনি কবিতা লিখতেন, তার কোনোটিতে একটু চেষ্টা করলে তাঁর উপন্যাস-গল্প ছাপা হতো না, এটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। বাংলার অনেক কবিই কিছু কিছু গদ্যকাহিনী লিখেছেন, যেমন মাইকেল মধুসূদন, নজরুল ইসলাম, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী প্রমুখ, সবই মুদ্রিত, শুধু জীবনানন্দ তাঁর একটিও গদ্য কাহিনী কেন প্রকাশ করতে চাননি, সে রহস্য আর বোধহয় উদঘাটিত হবার সম্ভাবনা নেই।
কমলকুমার অল্প সংখ্যক পাঠক পেয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন, সেই জন্যই তিনি একটার পর একটা উপন্যাস লিখে গেছেন ছোট পত্রিকায়। হয়তো তিনি সচেতন ছিলেন, তাঁর রচনারীতি বৃহত্তর পাঠক সমাজের জন্য নয়। রচনাগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশের ব্যাপারেও তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল না, যতদূর জানি, তাঁর একটি মাত্র উপন্যাস ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ এবং একটি গল্প সংকলন ‘নিম অন্নপূর্ণা’ প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর জীবিতৎকালে। আর একটি উপন্যাস ‘পিঞ্জরে বসিয়া শুক’ প্রকাশের প্রস্তুতি চলছিল, মুদ্রণ সম্পূর্ণ হবার আগেই তাঁর অকালমৃত্যু ঘটে।
এর পর কমলকুমারের উপন্যাসগুলি পত্রিকার পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধার করেন তাঁর স্ত্রী দয়াময়ী মজুমদার। তিনি স্বয়ং বিদুষী এবং সুলেখিকা। কিন্তু কোনো বিচিত্র কারণে সধবা অবস্থায় তাঁর এই সব পরিচয় কিছুই জানা যায়নি, তিনি ছিলেন অন্তরালবুর্তিনী। এমনকী কমলকুমার তাঁর প্রথম উপন্যাস গ্রন্থটি পত্নীকে উৎসর্গ করলেও সেখানে সহধর্মিণীর নাম উল্লেখ করেননি, শুধু লিখেছিলেন স্ত্রীকে।
খ্যাতির আকাঙ্ক্ষায় লেখেননি কমলকুমার, অর্থের জন্য তো নয়ই। এক্ষণ পত্রিকায় সম্মান দক্ষিণা দেবার রেওয়াজ ছিল না, কমলকুমার কিছু পেয়েছিলেন কি না জানি না। কৃত্তিবাস পত্রিকা থেকে তিনি একবারই চেয়ে নিয়েছিলেন মাত্র তিরিশ টাকা। (প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, যে গুটিকয়েক ছাত্রকে তিনি ফরাসি ভাষা শিক্ষা দিতেন, তাদের কাছ থেকে গুরুদক্ষিণা নিতেন মাসিক একটাকা।)
তবে কমলকুমারের সাহিত্য রচনার প্রেরণা কী ছিল? তিনি ছিলেন উত্তম পড়ুয়া, তাঁর সময়ে, একশো বছরের বাংলা গদ্য সাহিত্য ছিল তাঁর নখদর্পণে, বিশেষ অনুরাগী ছিলেন বঙ্কিম এবং রাজশেখর বসুর, এই ভাষার ঐশ্বর্য নিয়ে তাঁর গর্ব ছিল, তবু কিছু একটা অভাববোধও ছিল। ধনী ভাষাগুলির সাহিত্য ঠিক একমুখী হয় না। অনেকগুলি ধারা থাকে, বাংলা গদ্য সাহিত্যে ঘটনা পরম্পরার ধারাটিই অতি প্রবল, অন্য আর কোনো ধারাই নেই বলতে গেলে। বাস্তব কখনো উত্তীর্ণ হয়নি পরা বাস্তবতায়। লোককথা, রূপকথা, প্রবাদ, ছড়া, হেঁয়ালি ইত্যাদির মধ্যেও থাকে যে সব লুক্কায়িত কাহিনী, সেগুলিও যে আধুনিক সাহিত্যের অন্তর্গত হতে পারে, তা নিয়ে পরীক্ষা হয়নি বিশেষ।
সেইজন্যই কমলকুমার শুধু সাহিত্য রচনায় প্রবৃত্ত হননি, তিনি নতুন ধারার প্রবর্তনে উদ্যত হয়েছিলেন, তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ বাংলা সাহিত্যে এসে পড়েছে আচম্বিতে, এর কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না, এই গদ্যরীতি ও কাহিনী বিন্যাস সম্পূর্ণ অভিনব। এরকম রচনার আস্বাদের জন্য বাংলার পাঠকরা দীক্ষিত নয়, সেইজন্যই কমলকুমার হয়তো আশা করেছিলেন, ছোট সাহিত্য পত্রিকার যে একটি নির্বাচিত পাঠকগোষ্ঠী থাকে, যাদের অধিকাংশই সাহিত্য রচনায় প্রয়াসী তারা অন্তত অনুধাবন করার চেষ্টা করবে। আমার মনে আছে, ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ প্রকাশিত হয়েছিল একটি অল্প পরিচিত পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায়, কমলকুমার সেই পত্রিকাটি থেকে নিজের উপন্যাস-অংশ ছিঁড়ে নিয়ে, বেশ কিছু কপি আলাদা ভাবে সেলাই করে কিছু নবীন লেখককে উপহার দিয়েছিলেন এবং আমাকে দশ-বারোটি কপি দিয়ে বলেছিলেন, অন্য লেখকদের মধ্যে বিলি করে দিও, তারা পড়লেই আমি খুশি।
কমলকুমারের সমস্ত রচনার উপাদান দেশজ এবং মূলত গ্রাম ভিত্তিক। আমাদের সাহিত্যে গ্রাম বাস্তবতা বড় বেশি গ্রাম্য এবং আঞ্চলিক শব্দে কণ্টকিত। কমলকুমার গ্রামের মানুষদের তুলে দিয়েছেন উচ্চ পর্যায়ে, তারা হয়ে গেছে চিরকালীন মানুষ। খেলার প্রতিভা উপন্যাসে একটি মৃত ভিখিরির লাঠিটা নিতেও যাদের বিবেক-দ্বন্দ্ব হয়, তারা অনায়াসেই মহাভারতীয় চরিত্র হয়ে ওঠে।
তাঁর ভাষা শুধু সাধু বাংলা নয়, বাক্য বিন্যাস একেবারে স্বতন্ত্র। তিনি যে সাবলীল, ঝকঝকে চলিত ভাষাও লিখতে পারতেন, তার অনেক নিদর্শন আছে। বড় পত্র-পত্রিকায় শিল্প সমালোচনা এবং নানা বিষয়ে নিবন্ধ লিখতেন চলিত ভাষায়। কমলকুমারের বয়েসী অনেক লেখকই সাধু বাংলা চিরতরে পরিত্যাগ করে চলে এসেছিলেন চলিত অষায়, দৃষ্টান্ত ও প্রেরণা স্বরূপ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু কমলকুমার সাধু ও চলিত এই দুটি বাংলাই পোষণ করেছেন। অর্থাৎ, উপন্যাস-গল্পের ভাষা সম্পর্কে তাঁর বিশেষ চিন্তা ছিল, এ ভাষায় দায় নেই সহজ বোধ্যর, এ শিল্প-নির্মাণের ভাষা, যে-কোনো উচ্চাঙ্গ শিল্পের মতনই এর রস গ্রহণ করার জন্য পাঠকদের দীক্ষিত হতে হবে। যেহেতু কমলকুমারের ভাষার আর কোনো পূর্ব-নজির নেই, অন্য কোনো লেখকের সঙ্গেই তাঁর ভাষার তুলনা চলে না, তাই কমলকুমারের রচনাই বারবার পড়ে এর মর্ম উদ্ধার শিখতে হবে। সেই জন্যই কমলকুমারের যে-কোনো রচনাই বারবার পড়তে হয়।
তিনি নিজে অনেক সময় বলতেন, বাংলা গদ্যের সিনট্যাক্স হুবহু ইংরেজি গদ্যের অনুকরণে, তিনি সেই প্রথা ভেঙে ফেলে ফরাসি গদ্যের প্রকরণ আনতে চান। তাঁর এই উক্তি আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। লিঙ্গ ভেদ কিংবা একবচন-দ্বিবচন বহুবচন অনুযায়ী ক্রিয়াপদ বাংলায় কোনোক্রমেই সম্ভব নয়, এ ব্যাপারে বাংলা সংস্কৃত থেকেও পৃথক। বিশেষণের সংস্থানের অদল বদল, যেমন কালো বেড়ালের বদলে বেড়াল কালো, ফরাসি অনুযায়ী এমন ব্যবহার কোথাও কোথাও আছে মাত্র। অন্য ভাষার অনুসরণে নয়, সম্পূর্ণ অভিনব বাকভঙ্গি নির্মাণেরই দুঃসাহস দেখিয়েছেন কমলকুমার। এ ভাষা অবশ্যই অনবদ্য কিন্তু বাংলা গদ্যের অন্তর্গত হবার মতন নয়। আর দ্বিতীয় কোনো লেখকের পক্ষে এই ভাষা রীতি গ্রহণ করা অসম্ভব। কেউ কেউ কিছুটা চেষ্টা করেও পশ্চাৎ অপসরণে বাধ্য হয়েছেন, এমন দেখেছি। এ এক আশ্চর্য মিনার, যা বাংলা সাহিত্যে চিরকাল স্বতন্ত্র হয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকবে। জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে কমলকুমারের তুলনা একারণেই মনে আসে। গদ্যে নয়, দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ থেকে জীবনানন্দ যে কাব্য ভাষা গ্রহণ করেছিলেন, তা অননুসরণীয় এবং বাংলা কবিতায় তা পূর্বাপর রহিত। জীবনানন্দীয় গোত্রের দ্বিতীয় কোনো কবিকে খোঁজা নিরর্থক।
একটি ছোট অথচ মনোযোগী পাঠকগোষ্ঠী তৈরি করবেন বলেই যেন কমলকুমার তাঁর কাহিনীগুলিতে ভাষার বর্ম দিন দিন আরও সুদৃঢ় করেছেন। তাঁর উপন্যাসগুলির মধ্যে তুলনামূলক ভাবে ‘গোলাপ সুন্দরী’র ভাষা ততটা দুর্বোধ্য নয়, মাঝে মাঝেই ঝলসে ওঠে কবিত্বের মাধুর্য। ‘গোলাপ সুন্দরী’ পড়ার পর ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ ফিরে পাঠ করলে অনেক জট খুলে যায়। ‘অন্তর্জলী যাত্রা’র বিশ্বস্ত ভাবে চলচ্চিত্র রূপ দিয়েছেন গৌতম ঘোষ, সেটি যারা দেখেছেন, তাদের আর কাহিনী অনুসরণে কোনো অসুবিধে হবার কথা নয়। তবু, কাহিনী জানা সত্ত্বেও এর ভাষা সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য এ উপন্যাস বারবার পড়া যায়। সব সাহিত্যেই এরকম দৃষ্টান্ত খুব কমই থাকে।
অনেক লেখকেরই প্রথম জীবনের তুলনায় পরবর্ত্তীকালের ভাষা ক্রমশ সরল হয়ে আসে। কমলকুমারের সব ব্যাপারেই বিপরীত যাত্রা। তৃতীয় ও চতুর্থ উপন্যাসে তাঁর ভাষা আরও জটিল হয়েছে, যেন তিনি খেলা করছেন পাঠকদের সঙ্গে, কিংবা তাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন। কেননা কোনো বাক্যে রেখে দিচ্ছে ব্যাসকুট। পঞ্চম উপন্যাস ‘সুহাসিনীর পমেটম’-এ এই রচনা প্রক্রিয়া আমি নিজেই প্রত্যক্ষ করেছি। লেখাটি সম্পূর্ণ হবার পরেও তিনি আঙ্গিক বদল করছেন বারবার। ছোট ছোট বাক্যগুলি তিনি জুড়ে দিলেন অসমাপিকা ক্রিয়ায়, তারপর বলতে গেলে বাক্যই থাকছে না, পাতার পর পাতা পূর্ণচ্ছেদহীন ঠাসা রচনা। আর সময় নেই বলে আমি যখন তাঁর কাছ থেকে শেষ পাণ্ডুলিপি কেড়ে নিয়েছি কৃত্তিবাস পত্রিকায় প্রকাশের জন্য, তারপরেও তিনি চুপি চুপি প্রেসে গিয়ে প্রচুর পরিবর্তন করেছেন, প্রফের পৃষ্ঠা কণ্টকিত করে তিনি সব সরলকে করেছেন জটিল, পরিবর্তিত প্রত্যেকটি শব্দ আগেরটির চেয়ে কঠিন।
কঠিন বলতে কিন্তু আভিধানিক শব্দ বোঝায় না। ব্যবহারের অনন্যতা। বাঙালি পাঠক তাতে অনভ্যস্ত বলেই হোঁচট খায়। যারা তাতে পেছন ফেরে, তারা কমলকুমারের পাঠক হবার যোগ্যতা তখনো অর্জন করেনি, বুঝতে হবে। যারা কাব্যপাঠে অভ্যস্ত, তারাই এগিয়ে যেতে পারে। এ ঠিক গদ্য নয়, কাব্যের সৌরভ সর্বত্র অথচ চকিতে এক একটি দেশজ শব্দ এসে ঘোর ভেঙে দেয়। “ঐ চন্দ্রালোক, তাহারা নিজেদের বড়ই ঘোলা বুঝিতে আছিল; নদীর ঝিল্লির ইত্যাদির আওয়াজ তাহাদের জানিত সমস্তবিধ শব্দের বাচকতাকে নষ্ট করিয়াছে; বস্তু দর্শনে নাম, নাম শ্রবণে বস্তু মনেতে আসে না; প্রায় প্রত্যেকেই এমন অবস্থা আপন অজ্ঞাতসারেই টের পাইতেছিল।” (খেলার প্রতিভা) এই যে ‘শব্দের বাচকতা’ এটা কমলকুমারের ভাষার সঠিক পরিচয়।
কমলকুমার মজুমদারের উপন্যাসগুলি আসলে আধুনিক চম্পূ, যেরকম চম্পূ ইদানীংকালে অন্য কেউ লেখেন না, আর কেউ লিখতে পারবেন বলেও মনে হয় না।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
Leave a Reply