অনির্বাণ অমিতাভ (গৌতম বুদ্ধের জীবনী) – বিশ্বরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
ANIRBAN AMITAVA – History based Bengali Non-Fiction
প্রথম প্রকাশ : বইমেলা ২০১৯
প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ : রোচিষ্ণু সান্যাল
সুষমবার্তা
এ বিষয়ে অবগত হয়ে আমি অত্যন্ত প্রীত হয়েছি যে, দর্শনশাস্ত্রের সুপণ্ডিত, ভূতপূর্ব সরকারি বিএড কলেজের অধ্যক্ষ, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ শ্রীযুক্ত বিশ্বরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়, গৌতম বুদ্ধের জীবন এবং কর্ম নিয়ে জনসাধারণের জন্য সহজ ভাষায় একটি বই ‘অনির্বাণ অমিতাভ’ রচনা করেছেন। পৃথিবীর সাম্প্রতিক অস্থিরতা, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এবং হিংসাকে কেবলমাত্র অহিংসা ও শান্তির বাণী মানবকুলের অন্তঃকরণে প্রবেশ করিয়ে স্তিমিত করা যাবে বলে আমার দৃঢ় এবং স্থির বিশ্বাস। পৃথিবীর যত বেশি সংখ্যক মানুষ শান্তির পথের অনুসারী হবেন, ততই তা পৃথিবীর পক্ষে মঙ্গলদায়ী হবে। লেখকের এই মহান সুকৃতির জন্য ওঁকে আমার আন্তরিক ও সশ্রদ্ধ অভিনন্দন।
ডঃ বুদ্ধপ্রিয় মহাথের
কর্ণধার
সিদ্ধার্থ ইউনাইটেড স্যোসাল ওয়েলফেয়ার মিশন
কলকাতা, চিনার পার্ক (১৬.০১.২০১৯)
কথামুখ
ছোট এই গ্রন্থটি রচনায়, প্রেরণা ও উৎসাহ দিয়েছেন—আমার বড় ছেলে ডাঃ পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়। লিখন, খাতা বাঁধাই এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য কাজে সহায়তা করেছেন—আমার মেয়ে শ্রীমতী লিপি মুখোপাধ্যায় এবং আমার জামাতা শ্রী প্রবীর মুখোপাধ্যায়। এই কথামুখে বুদ্ধের অনুপ্রাণিত কিছু উদ্ধৃতি এবং স্বরচিত কবিতা রাখলাম।
বিশ্বরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
চিনার পার্ক, কলকাতা
দশাবতার স্তোত্র
নিন্দাসি যজ্ঞ—বিধেয় অহহাশ্রুতি জাতম
সদয়—হৃদয় দর্শিত পশুঘাতম
কেশব ধৃত বুদ্ধ শরীর জয় জগদীশ হরে।
দশাবতার স্তোত্র
—জয়দেব
সমস্ত মানুষের দুঃখ দূর করব
”একদিন বুদ্ধ বললেন, ‘আমি সমস্ত মানুষের দুঃখ দূর করব।’ দুঃখ তিনি সত্যই দূর করতে পেরেছিলেন কিনা সেটি বড়ো কথা নয়, বড়ো কথা হচ্ছে, তিনি এটি ইচ্ছা করেছিলেন, সমস্ত জীবের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ভারতবর্ষ ধনী হোক, প্রবল হোক, এ তাঁর তপস্যা ছিল না; সমস্ত মানুষের জন্য তিনি সাধনা করেছিলেন।”
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বিশ্বভারতী’ রবীন্দ্র রচনাবলী
‘বুদ্ধ পূর্ণিমার’ অংশ
”মৈত্রী করুণার মন্ত্র দিতে দান
জাগহে মহীয়ান, মরতে মহিমায়,
সৃজিছে অভিচার নিঠুর অবিচার
রোদন হাহাকার গগন মহীছায়।”
‘বুদ্ধ পূর্ণিমা’ (বেলা শেষের গান: কাব্যগ্রন্থ)
—সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
Buddha has a special appeal
‘‘The life of Buddha has a special appeal. All my life I have been very fond of Buddha…I have more Veneration for that character than any other—that boldness, that fearlessness and that tremendous love! He was born for the good of men. Others may seek God, others may seek truth for themselves; He did not even care to know much for himself. He sought truth because people were in misery. How to help them, that was his concern. Throughout his life, he never had a thought for himdelf. How can we, ignorant, selfish, narrow minded human beings ever understand the greatness of this man?”
—Swami Vivekananda
Worlds parliament of Religions on 26th Seprember 1893.
বুদ্ধের মুখটি একবারে জীবন্ত
করণীয় মৈত্রী সূত্রে বুদ্ধ বলেছেন—
না পারো পরং নিকুবেবথ
নাতি মঞ্চেথ ক ঋচি নং কঞ্চি
ব্যারোসনা পর্টিঘসঞা
নাঞমঞসম দু কখা মিচ্ছেষ
এর অর্থ:
কাউকে করো না অবজ্ঞা বঞ্চনা
কাউকে কখনো করো না গো লাঞ্ছনা
হয়ে আক্রোশ ঘৃণার পরবশ
করো না কাউকে দুঃখে ক্লেশে বিবশ।
P.D. Ouspensky একবার শ্রীলঙ্কায়, ল্যাভিনিয়া পর্বতের কাছে একটি বৌদ্ধ মঠে গিয়েছিলেন। সেখানে একটি বুদ্ধ প্রতিমূর্তি দেখেছিলেন। এই মূর্তি দেখে তিনি তাঁর প্রতিক্রিয়ার কথা লিখেছেন:
‘বুদ্ধের মুখটি একবারে জীবন্ত। তিনি সোজা আমাকে দেখছিলেন এমন নয়। কিন্তু আমার মনে হল সম্ভবত তিনি আমাকেই দেখছিলেন। প্রথম প্রথম আমার মনে কোনো অনুভূতি জাগেনি। শুধু একটু অবাক হয়ে পড়েছিলাম এই মাত্র। এমন কোনো অভিজ্ঞতা হতে পারে এমনটা আমি ভাবিনি, প্রত্যাশাও করিনি। কিন্তু শীঘ্রই আমার বিস্ময় ভাব চলে গেলো। পরিবর্তে এলো নতুন এক ধরনের চেতনা। বুদ্ধ আমাকে দেখছেন। আমার ভিতরটা যেন তিনি স্পষ্ট বুঝে নিচ্ছেন। আমার অন্তরটা এভাবে আমি নিজেও কোনদিন অনুভব করতে পারেনি। বুদ্ধের দৃষ্টি দেখে তখন আমিও আমার ভিতরের মন ও আত্মাকে যেন সুস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার মনের যা কিছু জ্বালা, যন্ত্রণা, অস্বস্তি সবই যেন বুদ্ধের চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। বুদ্ধের মুখমণ্ডল গম্ভীর এবং প্রশান্ত। কিন্তু এ মুখ ভাবহীন নয়। তিনি যেন আমার সব কিছু স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন। একটা গভীর চিন্তার ভাব তাঁর মুখে ফুটে উঠেছিল। সেই ভাবের মধ্যে মেশানো ছিল সমবেদনা ও সহানুভূতি। তিনি আপন আসনে শান্ত ভাবে অবস্থান করেছিলেন। আমি কি তাঁর শান্তি ভঙ্গ করলাম? একটা অপরাধবোধ যেন আমার মনে জেগে উঠলো। দরজা খুলে আমি সোজা গিয়ে দাঁড়ালাম তাঁর মূর্তির সামনে। তিনি কি আমাকে বিচার করছেন? কি ভাবছেন তিনি আমার সম্পর্কে? কিন্তু তাঁর দৃষ্টির মধ্যে নিন্দা বা ভর্ৎসনার কোন ভাব ছিল না। তবে তেমন সদয় সহানুভূতির ভাবও দেখতে পেলাম না সেই মুখে। আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল সেই মুখ নির্লিপ্ত বা উদাসীনও ছিল না। কি ছিল তবে? কি ভাবছেন তিনি। আমাকে বিচার করছেন কি? আমার মনের যা কিছু কলুষিত তা সবই কি তিনি বুঝতে পারছিলেন? তাঁর মুখ অবশ্যই মানুষেরই মুখ? আবার ঠিক মানুষের মুখও যেন নয়। আমি এ মুখের বর্ণনা করি এমন যথার্থ ভাষাও খুঁজে পাইনি। তবে এটুকু বুঝতে পারছিলাম—এ মুখের মধ্যে আছে অপূর্ব বুদ্ধি, মেধা এবং অবশ্যই অপার সহানুভূতি ও করুণা।
হঠাৎ বুদ্ধের এই করুণাঘন উপস্থিতি আমার মনের মধ্যে একটা অপূর্ব প্রতিক্রিয়া ঘটিয়ে দিচ্ছিল। আমার মনের সব দুঃখ, কষ্ট, গ্লানি বেদনা যেন ক্রমশ বিলীন হয়ে যাচ্ছিল।
বুদ্ধের শান্ত মুখমণ্ডলের প্রশান্ত ভাব আমার মনেও ছড়িয়ে পড়ছিলো। বড় আশ্চর্য এই অনুভূতি যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আমার মনে হচ্ছিল এতদিন ধরে যে সব ভাবনা চিন্তা আমাকে অহরহ পীড়িত ও ক্লিষ্ট করে চলেছিল সে গুলি যেন আদৌ ততখানি গুরুত্বপূর্ণ নয় যা আমি ভাবছিলাম। বরং সেগুলি খুবই অকিঞ্চিৎকর বিষয়।
আমার মনে হতে লাগল দারিদ্র্য পীড়া দুঃখ কষ্ট জর্জরিত যে মানুষই এখানে এসে এই মূর্তির সামনে দাঁড়াক না কেন তার সব অশান্তি দূরে চলে যাবে। সে শান্তি এবং আনন্দ খুঁজে পাবে।’
(সংগৃহীত)
প্রার্থনা
মাৎসর্য ও হিংসাদীর্ণ এই পৃথিবীটা আজ,
তুমি ফিরে এসে সমাপ্ত করো তোমার আরব্ধ কাজ।
মানুষের মনে এনে দাও প্রেম, ভরসা, প্রীতি ও স্নেহ,
বিশ্বাস দাও, ভালবাসা দাও—দূর করো সন্দেহ।।
আকুল চিত্তে ডাকে যে সবাই—ফিরে এস দয়াময়,
বিদূরিত করো এ বিশ্ব হতে যত সন্ত্রাস ভয়।
জানি তথাগত এই পৃথিবীতে তুমিই আপনজন,
তাই তো বিনতি জানাই হে প্রভু কর শোক নিবারণ।।
সামান্য আমি—নিয়েছি তোমার জীবনী লেখার ভার,
তোমার আশিস পেলেই কাজটা সফল হবে আমার।
জানি অমিতাভ এই ভবে তুমি আর্তের বান্ধব,
তোমার মমতা পেয়েছে যে জন সে জন পেয়েছে সব।।
(স্বরচিত)
বুদ্ধের বাণী
”যেমন গো যান
হয় চলমান
গোরুর টানের বলে।
তেমনি তোমার
এই দেহ ভারও
মনের আদেশে চলে।।
কিন্তু তোমার
মন ও আচার
কলুষিত যদি হয়।
তখনই জানবে
জীবনে নামবে
দারুণ বিপর্যয়।।”
(অনূদিত)
বুদ্ধ
বৌদ্ধ শ্রমণ অনিরুদ্ধর দুটি চোখই ছিল অন্ধ,
ভিক্ষা অন্নে—প্রাণ বাঁচাতেন, আর সব পথই বন্ধ।
একদিন তাঁর পরনের বাস কি ভাবে হল যে ছিন্ন,
একটি বসনই ছিল শুধু তাঁর, ছিল না বসন ভিন্ন।।
নিকটেই ছিল সূচ ও সূত্র, যদিও তিনি দরিদ্র—
অন্ধতা বশে খুঁজে পেলেন না কোথায় সূচের ছিদ্র।
কি ভাবে পরাহে পথে বেরোবেন কিভাবে জুটবে অন্ন?
এই দুর্দিনে সহায়তা দিতে কে আসবে তাঁর জন্য?
হঠাৎই কি হলো, কোথা হতে এলো—অজানা ফুলের সুবাস,
প্রাণটা জাগলো, শরীরে লাগলো স্নিগ্ধ বায়ুর আভাস।
কে এলো নিকটে, তাঁর হতে হতে নিলো সে বস্ত্রখানি—
‘কে এসেছো তুমি ও গো দয়াময় নামটা তো আগে জানি।’
নিশ্চুপ তিনি, নবাগত যিনি—সীবনের কাছে ব্যস্ত,
কি হবে এ ভেবে অনিরুদ্ধর মনও তখন ত্রস্ত।
কিছুটা সময় পার হয়—সেই নিপুণ জীবন—সাধন কর্মে,
ফিরে এল যেন নতুন বস্ত্র, শান্তি জাগিয়ে মর্মে।
‘কে তুমি বল না, কি বা পরিচয়, কি নামে ডাকি তোমাকে?’
‘গৌতম আমি আমাকে অনেকে বুদ্ধ নামেও ডাকে।’
অনিরুদ্ধের চোখে এল জল, ‘জেনেছি প্রভু এ তুমি,
এসো দয়াময় নিকটে আমার তোমার পা দুটি চুমি।।’
(স্বরচিত)
বুদ্ধের আত্মপরিচয় দান
ত্রিতাপ ভুলে, বসে তরু-মূলে ভগবান তথাগত,
এক ব্রাহ্মণ, পেয়ে দর্শন হলেন সমীপাগত।
ব্রাহ্মণ কন, ‘ও গো গুণীজন কি তোমার পরিচয়?
জন গণ নেতা, তুমি কি দেবতা? বলো প্রভু দয়াময়।’
তথাগত কন, ‘শোনো ব্রাহ্মণ,আমি তো দেবতা নই,
জীব কল্যানে বিশ্ব ভূবনে সদা তৎপর রই।’
ব্রাহ্মন ফের প্রশ্ন করেন, ‘গন্ধর্ব কি তুমি?’
‘না না আমি নই স্বর্গ-গায়ক বিশ্ব আমার ভূমি।’
‘তবে কেগো তুমি, বলো দেখি শুনি অবশ্য তুমি যক্ষ।’
‘না না ব্রাহ্মণ, শোনো দিয়ে মন আমি আর্তের পক্ষ।’
‘তবে দয়াময়, তুমি নিশ্চয় মানব অতি সাধারণ?’
‘শোনো ওগো দ্বিজ, আমি না মনুজ জানে তা সর্বজন।
বলি ব্রাহ্মণ, আমার এখন সব পরিচয়ই লুপ্ত,
এই পৃথিবীর, সব মায়াবীর পাশ হতে আমি মুক্ত,
আমি তো এখন অবয়ব হীন নিত্য এবং শুদ্ধ,
সকলে আমাকে এ কারণে ডাকে মোক্ষ-প্রাপ্ত বুদ্ধ।’
(স্বরচিত)
প্রাককথন
খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দী।
এই সময়টা ছিল প্রাচীন ভারতের উজ্জ্বল সময়কাল। আর্যদের বসতি ক্রমে বিস্তারিত হচ্ছে। এই বিস্তৃতি ঘটছে পূর্ব দিকে। আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে একই সঙ্গে। রাজনৈতিক ভাবে কয়েকটি রাজ্য যেমন গড়ে উঠেছে, আবার উপজাতি শাসন ব্যবস্থাও চালু আছে। একদিকে যেমন আছে পার্থিব জড়বাদ অপরদিকে তেমনই আছে আধ্যাত্মবাদ এবং পারলৌকিক চিন্তাভাবনা।
পরবর্তী বৈদিক যুগ। এ সময় লোহার যন্ত্রপাতি ব্যবহার শুরু হয়েছে। লোহার যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ব্যবহারের কারণে জঞ্জাল পরিষ্কার হচ্ছে আর পরিষ্কৃত স্থানে গড়ে উঠছে কৃষিক্ষেত্র ও আবাদভূমি। এর ফলে বসতি গড়ে উঠেছে—স্থায়ী বসতি। অতিরিক্ত খাদ্য ও ফল উৎপন্ন হচ্ছে। রাজারা এই অতিরিক্ত উৎপাদন ব্যবহার করে তাঁদের সেনাবাহিনীকে উন্নততর করে তুলছেন। তাঁদের শাসন আরও মজবুত হয়ে উঠছে। নগরবাসীরা এই উৎপাদন তাঁদের কৃষিনির্মাণ এবং শিল্প সামগ্রী প্রস্তুতির কাজে ব্যবহার করছেন। ফলত যা দাঁড়াচ্ছে এতে রাজত্ব সীমা যেমন ক্রমশ বেড়ে চলছে তেমনি প্রতিবেশী অঞ্চলগুলির সঙ্গে একটা বিরোধ গড়ে উঠছে। শুরু হয়েছে যুদ্ধ বিগ্রহ। এই যুদ্ধে প্রতিপক্ষরা হলেন একদিকে আর্য রাজা অন্যদিকে অপর আর্য নৃপতি কিংবা অন্য উপজাতি গোষ্ঠী ভুক্ত শাসক দল। এই সব সংগ্রামের ফলে ছোট ছোট রাজ্যগুলি পরাজিত হওয়ার কারণে বৃহত্তর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাচ্ছে। উৎপন্ন হচ্ছে শক্তিশালী রাজা ও রাজত্বের। বৃহত্তর এই সব রাজ্যগুলির নাম ‘জনপদ’। কতকগুলি জনপদ আবার একত্রিত হয়ে গড়ে উঠছে আরও শত্তিশালী রজ্যের। এই সব শক্তিশালী বৃহৎ রাজ্যগুলির নাম হয়েছে ‘মহাজনপদ’।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠশতাব্দীতে আমরা দেখা পেয়েছি মহাচিন্তা নায়ক কয়েকজনের। একজন পারস্যের জরথুস্ট্র, আর একজন চীনের কনফুসিয়াস। ভারতবর্ষের মহাবীর এবং গৌতমবুদ্ধ হলেন সমকালীন উদাহরণ ব্যক্তিত্ব। গোঁড়া একগুঁয়ে ধর্মচিন্তার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করেছিলেন জৈন এবং বৌদ্ধ ধর্মবিশ্বাসীরাই।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী—
কালচক্রের নিরিখে, ভারতের ইতিহাসে এই সময়টা ছিল খুব খারাপ। এখনকার ধর্মীয় রীতিনীতিগুলি হয়ে পড়েছে সম্পূর্ণ আচার অনুষ্ঠান সর্বস্ব। ছোট বা বড়, যে কোনও ধর্ম অনুষ্ঠান হয়ে পড়েছে অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ। সাধারণ মানুষের পক্ষে এই ব্যয়ভার বহন করা শুধু যে দুঃসাধ্য তাই নয় অসাধ্যও বটে। পুরোহিত সম্প্রদায়ের ব্যক্তি যাঁরা, তাঁরা এই সব অনুষ্ঠান করার জন্য প্রচুর অর্থ দাবি করতেন। সঙ্গতভাবেই এই সব ধর্ম অনুষ্ঠানগুলি বড় বেশি অনুষ্ঠানসর্বস্ব হয়ে পড়েছিল। সাধারণ গরিব মানুষেরা না বুঝত এর অর্থ না বুঝত এ সবের তাৎপর্য। তারা চাইত এই সব ধর্ম অনুষ্ঠানগুলি যেন সহজ সরল হয়, আর ন্যূনতম ব্যয়ের মধ্য দিয়ে যেন তা করা যায়।
ধর্মের মধ্যে তখন নানান দুর্নীতি ঢুকে পড়েছে। ধর্মীয় সব ধরনের অনুষ্ঠানেই দুর্নীতি ক্রমশ তীব্র নিপীড়নের আকার ধারণ করেছে। যজ্ঞ না করতে পারলে ঈশ্বর অসন্তুষ্ট এবং ক্রুদ্ধ হবেন এবং যজমানদের নিদারুণ ক্ষতি করবেন এই ভাবেই পুরোহিতরা সাধারণ মানুষদের বোঝাচ্ছেন আর যে কোনও অজুহাতে প্রচুর অর্থ দাবি করে চলেছেন। অবশ্য ক্ষত্রিয় শাসকেরা এই সব ব্যয়বহুল অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে সরব হচ্ছেন বটে কিন্তু যেহেতু তাঁরা বলশালী, তাই পুরোহিতরা তাঁদের বেশি ঘাঁটাচ্ছেন না। কিন্তু দরিদ্র জনসাধারণেরা পুরোহিত শ্রেণীর এই অনাচার আর সহ্য করতে পারছে না। তারা ক্রমশ অধৈর্য হয়ে পড়েছে। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় জৈন এবং বৌদ্ধ ধর্ম প্রতিষ্ঠাতা দুজনেই ছিলেন ক্ষত্রিয় বংশ জাত। ব্রাহ্মণ প্রভাবিত সমাজের বিরুদ্ধে ক্ষত্রিয় এবং অন্যান্য শ্রেণির ক্ষোভ ও প্রতিবাদই ছিল প্রতিবাদী ধর্ম মতগুলির আবির্ভাবের মূল কারণ।
জাতিভেদ প্রথা অত্যন্ত কঠোর হয়ে পড়ছে। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চারটি জাতি একান্ত ভাবে আপন আপন জাতির মধ্যেই বদ্ধ হয়ে পড়ছে। সামাজিক জাতিদের মধ্যে মেলামেশা এমনকী এক জাতি হতে অন্য জাতির মধ্যে প্রবেশ করা ক্রমশই জটিল হয়ে পড়েছে। একগুঁয়ে এবং জটিল এই জাতিভেদ সমাজকে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে। খাদ্য, পানীয় এবং বিবাহের ক্ষেত্রে এ ধরনের জাতি পৃথকীকরণ সকলের কাছেই ক্রমশ পীড়াদায়ক হয়ে উঠছে। যা সংযোগসাধনের একমাত্র মাধ্যম, তাও যেন ক্রমে পৃথক হয়ে পড়ছে জাতিবর্গের মধ্যে। সংস্কৃত ভাষা হয়ে পড়েছে পবিত্র এক ভাষা; যদিও অধিকাংশ বৈদিক সাহিত্যগুলিই সংস্কৃত ভাষাতেই রচিত। একমাত্র পুরোহিতরাই মন্ত্র উচ্চচারণ করার অধিকারী হয়ে পড়েছেন। ধর্মীয় অনুশাসনগুলিও তাঁরাই দিচ্ছেন। সাধারণ শ্রেণির লোকেরা এই সব মন্ত্রের কোনও অর্থ বুঝতে পারছে না বলে এ সবের তাৎপর্যও বুঝতে পারছে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাধারণ লোকেরা এমন এক ধর্ম অনুষ্ঠানের কথা ভাবছে যা তারা বুঝতে পারবে ও সহজে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানগুলি পালন করতে পারবে। আর একই সঙ্গে উচ্চচারিত মন্ত্রগুলির অর্থও তারা সহজে বুঝতে পারবে।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম ভাগে মগধের শাসক ছিলেন বিম্বিসার এবং পরে অজাতশত্রু। এই দুইজন শাসকই ছিলেন উদারপন্থী এবং পরমতসহিষ্ণু। এঁরা ব্রাহ্মণ তথা পুরোহিত সম্প্রদায়কে সেরকম মান্য করতেন না। তাঁরা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে প্রজাসাধারণকে স্বাধীনতা দেওয়ার কথাই বলতেন। ব্রাহ্মণদের অতিরিক্ত অত্যাচার আর অর্থগৃধ্নতাকে তাঁরা মান্যতা দিতে চাইতেন না। সুযোগ—সুবিধা পেলে তাঁরা ব্রাহ্মণ, ধর্মবিরোধী জৈন এবং বৌদ্ধ ধর্মমতকেই প্রাধান্য দিতে চাইতেন।
যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠানের সময় পশু বলিদানের ব্যবস্থা কৃষকেরা পছন্দ করত না। কৃষিকাজে তারা পশুদের লাঙল ইত্যাদি টানার কাজে ব্যবহার করত। আর এই ভাবে চাষবাসের ক্ষেত্রে তারা ক্রমে পশুদের ওপর নির্ভরশীলও হয়ে পড়েছে। তাই তারা এমন এক ধর্ম অনুষ্ঠানের কথা ভাবছে যেখানে অন্তত পশুদের রক্ষা করার ব্যবস্থা থাকবে এবং পশুবলিদান প্রথা থাকবে না। বৌদ্ধ এবং জৈন উভয় ধর্মমতেই পশু হিংসা ও রক্তপাত নিষিদ্ধ থাকায় এ দুটি ধর্মমতের প্রতি সাধারণ মানুষ ক্রমেই আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে।
এই সব কারণগুলির জন্য সে সময়ে জৈন এবং বৌদ্ধ ধর্মমত ক্রম প্রাধান্য লাভ করে চলছিল।
উত্তর বৈদিক যুগের শেষ দিকে পরিব্রাজক কিছু সন্ন্যাসী অভ্রান্ত বেদ নির্ভর সমাজ ব্যবস্থা এবং ধর্মীয় আচারসর্বস্বতাকে অস্বীকার করেন। তাঁরা গুরুত্ব দেন বিশুদ্ধ ভক্তি এবং সৎ আচারণের উপর এই ভাবে উদ্ভব বেদ বিরোধী প্রতিবাদী ধর্মের। এই সব সন্ন্যাসীরা কর্মফল ও জন্মান্তরবাদের ওপর আস্থা রাখলেও তাঁরা বর্ণভেদ, ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য এবং দেবদেবীর অস্তিত্বকে স্বীকার করতেন না। দুটি মাত্র উচ্চবর্ণের মানুষ ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় সর্বাধিক সমাজিক মর্যাদা ও সুবিধা ভোগ করতে এটাও অনেকেই বিশেষ করে নিম্ন দুই বর্ণের মানুষের সহ্য করতে পারত না। ব্যবসা—বাণিজ্যের উন্নতির কারণে বৈশ্য বর্ণ ধনী হয়ে উঠছিল কিন্তু সামাজিক মর্যাদা তাঁরাও পেত না। নতুন শক্তিশালী বৈশ্য শ্রেণির উত্থানের ফলে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের মর্যাদা ক্রমেই হ্রাস হয়ে পড়ছিল। প্রতিবাদী ধর্মমতগুলি তাদের আশা—আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দিত। তাই এ কথা বলা চলে বৈশ্যদের এই ক্রমোন্নতির কারণে বৌদ্ধ, জৈন প্রমুখ প্রতিবাদী ধর্মমতগুলির ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। গৌতম বুদ্ধের ধর্মোপদেশ সমসাময়িক ভারতবর্ষের বর্ণভেদ জর্জরিত সমাজ পরিবেশকে ভেঙে ফেলে মানুষের অধিকার ও মর্যাদাকে ভিত্তি করে নতুন এক সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখছিলো।
Leave a Reply