অনন্ত অম্বরে – হুমায়ূন আহমেদ
প্রথম প্রকাশ – ১লা জানুয়ারি, ১৯৯২
উৎসর্গ – জন্ম ভবঘুরে অধ্যাপক আলতাফ হোসেন অপ্রিয়বরেষু
.
আমার আপন আঁধার
তীব্র যন্ত্রণায় ঘুম ভাঙল। মনে হল সারা গায়ে কাঁটা ফুটে গেছে। নির্ঘাত কোন দুঃস্বপ্ন। ইদানীং ভয়ংকর সব দুঃস্বপ্ন দেখছি। আমি চোখ মেলে দেখি–দুঃস্বপ্ন নয়, আসলেই কাঁটা ফুটেছে। বিছানাময় গোলাপ ফুল। পাশ ফিরতেই গায়ে গোলাপের কাটা বিঁধল। ব্যাপার বুঝতে বেশি সময় লাগল না। আজ আমার জন্মদিন। আমার কন্যারা তাদের উদ্ভাবনী শক্তি প্রয়োগ করে বিছানাময় কাটাসুদ্ধ গোলাপ বিছিয়ে রেখেছে। ফুলের কাঁটাই বিধেছে। ফুলশয্যা সবসময় আনন্দময় নয়।
আমি আবার চোখ বন্ধ করে ফেললাম। এখন জেগে উঠা যাবে না। আমার কন্যারা নিশ্চয় জাগাবার জন্যেও কোন বিশেষ ব্যবস্থা করে রেখেছে। ওদের বঞ্চিত করা ঠিক হবে না। কাটার ঘা শরীরে নিয়ে গভীর ঘুমের ভান করলাম।
বিকট শব্দে রেকর্ড প্লেয়ার বেজে উঠলো। এই হচ্ছে আমাকে জাগাবার কৌশল। কয়েকদিন ধরে যে গানটি বাজাচ্ছি কন্যারা সেই গানটি ফুল ভল্যুমে দিয়ে দিয়েছে। কানের পর্দা ফেটে যাবার অবস্থা। সুচিত্রা মিত্র আকাশ ফাটিয়ে গাইছেন,
পাখি
আমার নীড়ের পাখি
অধীর হল কেন জানি
আকাশ কোণে যায় শোনা কি
ভোরের আলোর কানাকানি।।
আমি বিছানায় উঠে বসলাম। তিন কন্যা একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলো–হেপি বার্থ ডে! বড় কন্যার হাতে একটা ট্রে। সেই ট্রেতে একটা কাপ। কানায় কানায় ভর্তি চা। চায়ে দুধের সর ভাসছে। মনে হচ্ছে কন্যারা তাদের সমস্ত প্রতিভা ব্যয় করে চা বানিয়েছে।
আমি বিছানায় গোলাপ দেখে বিস্মিত হবার ভান করলাম, আমার প্রিয় গানটি বাজছে দেখে মহা আনন্দিত হবার ভান করলাম। ওদের বানানো হিমশীতল সরবত সদৃশ চা মুখে দিয়ে তৃপ্তির ভান করলাম। ছোট মেয়ে বলল,
আব্বু, তোমার কি খুব আনন্দ হচ্ছে?
আমি বললাম, হচ্ছে। এত আনন্দ হচ্ছে মনে হয় চোখে পানি এসে যাবে।
আমাদেরো খুব আনন্দ হচ্ছে। কারণ আজ আমরা কেউ স্কুলে যাচ্ছি না। সারাদিন ঘরে থাকব।
খুব ভাল কথা।
আজ আমরাই তোমার জন্য রান্না করব।
তোমরা কি রান্না জান?
না, জানি না–মা দেখিয়ে দেবে।
খুব ভাল।
আমাদের চা কেমন লাগল বাবা?
অসাধারণ লাগল। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সেরা চা খাচ্ছি।
আরেক কাপ বানিয়ে নিয়ে আসব?
না, আর আনতে হবে না।
জন্মদিনে তোমার জন্য আমরা উপহার কিনেছি। শার্ট কিনেছি।
বাহ বাহ–কোথায়?
তিন কন্যার কিনে আনা উপহার গায়ে দিলাম। পৃথিবীর সমস্ত মেয়েরাই মনে করে তাদের বাবা বিশালকায় একজন মানুষ। আমার মেয়েরাও যে তার ব্যতিক্রম না তাদের কেনা শার্ট গায়ে দিয়ে পরিষ্কার বোঝা গেল। শার্ট পাঞ্জাবীর চেয়েও লম্বা। কাঁধের ঝুল নেমে এসেছে কনুই-এ।
মেজো মেয়ে শংকিত গলায় বলল, শার্টটা কি তোমার একটু বড় বড় লাগছে?
না তো। গায়ে খুব ভাল ফিট করেছে। আজকাল লম্বা শার্ট পরাই ফ্যাশন।
হাজী সাহেবের লম্বা কুর্তার মত শার্ট গায়ে দিয়ে বারান্দায় এসে দেখি মেঝেময় ভাঙা কাঁচের টুকরা। ফুলদানিতে ফুল রাখতে গিয়ে কন্যারা দুটো ফুলদানি ভেঙেছে। কাজের মেয়েকে ভাঙা কাঁচ সরাতে দেয়া হচ্ছে না কারণ এই বিশেষ দিনে আমার তিন কন্যাই না-কি ঘরের সব কাজ করবে।
বারান্দায় এসে বসলাম। রবীন্দ্র সংগীত বন্ধ হয়েছে বলে খানিকটা স্বস্তি পাচ্ছি। দিনের শুরুতে রবীন্দ্র সংগীত শুনতে আমার ভাল লাগে না। এক কাপ চা খেতে ইচ্ছা হচ্ছে। বলার সাহস পাচ্ছি না। বলামাত্রই তিনজন ছুটে যাবে রান্নাঘরে। আগুন-টাগুন ধরিয়ে একটা কাণ্ড করবে।
মেজো মেয়ে বলল, বাবা, তোমার কেমন লাগছে?
খুব ভাল লাগছে মা।
আনন্দ হচ্ছে?
অসম্ভব আনন্দ হচ্ছে।
তোমাকে দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে না।
আমি আনন্দিত হবার অভিনয় করলাম, অভিনয় খুব ভাল হল না।
বড় মেয়ে বলল, বাবা গান দেব?
গান থাক মা।
তোমার সব প্রিয় গান ক্যাসেট করে রেখেছি।
তাহলে দাও।
প্রথম গানটি কি কাকতালীয় ভাবেই মিলে গেল–অরুন্ধতী হোম গাইছেন,
সখী বহে গেল বেলা, শুধু হাসি খেলা।
একি
আর ভাল লাগে?
আচ্ছা, আজ আমার হয়েছেটা কি? এত চেনা গান অচেনা লাগছে কেন? কত অসংখ্যবার এই গান শুনেছি, কই কখনো তো এত বিপ্ন বোধ করি নি? আজ কেন প্রথমবারের মতো মনে হচ্ছে–বেলা তো চলেই গেল। হাসি-খেলায় বেলা পার করে দিলাম। আর তো ভালো লাগছে না।
কেউ যেন কানের কাছে গুনগুন করে বলছে–না চাইতেই তুমি অনেক পেয়েছ। এই জীবনে তুমি দেখেছ ৫১৬টি ভরা পূর্ণিমা। তুমি পার করেছ ৪৩টি বর্ষা। এত সৌভাগ্য কজনের হয়?
বাবা-মার যে ভালোবাসায় আমার জন্ম, তাতে মনে হয় কোনো খাদ ছিল। দীর্ঘ ৪৩ বছরে একদিনের জন্যেও আমার মনে হয়নি বৃথাই এই পৃথিবীতে জন্মেছি। প্রচণ্ড দুঃসময়েও বেঁচে থাকার আনন্দ অনুভব করেছি। বৈশাখ মাসে যখন আকাশ অন্ধকার করে কালবোশেখী আসে, তখন মনে হয়, কি ক্ষতি ছিল পৃথিবীটা যদি আরেকটু কম সুন্দর হত। এত সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে যাব কি করে?
অয়োময়ের জন্যে গান লিখতে গিয়ে লিখেছিলাম, আমার মরণ চাঁদনি পহর রাইতে যেন হয়। আজ মনে হচ্ছে ভুল গান লেখা হয়েছে, ভুল প্রার্থনা। চাঁদনি পহর রাতে আমি মরতে পারব না। নতুন গান লিখতে হবে। প্রার্থনা জানাতে হবে যেন ভরা জ্যোৎস্নায় সেই বিশেষ পাল্কি আমার দুয়ারে এসে না থামে।
একবার নর্থ ডাকোটা থেকে গাড়িতে করে সিয়াটল যাচ্ছি, পথে মন্টানায় রাত্রিযাপনের জন্য থামলাম। চারদিকে পাহাড়ঘেরা সমতলভূমি। বাচ্চাদের হোটেলে শুইয়ে বাইরে এসে দাঁড়াতেই প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম। রূপার থালার মত প্রকাণ্ড চাঁদ উঠেছে। অপূর্ব জ্যোৎস্না। জ্যোৎস্না ভেঙে আলো-আঁধারের অপূর্ব নকশা তৈরি হয়েছে পাহাড়ের গায়ে। আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। মহান সৌন্দর্যের মুখোমুখি হলে এক ধরনের তীব্র হাহাকার মনের ভেতরে আপনা আপনি জন্মায়–সুন্দরের উৎস সন্ধানে ব্যাকুলতা জাগে।
সৌন্দর্য দেখে দেখে জীবন কাটিয়ে দিলাম, এই সুন্দরের জন্ম কোথায়, কোন দিন তার খোঁজ করলাম না। এই জীবনে সম্ভব হল না–হায়! অন্য কোন জীবনও তো নেই, থাকলে চেষ্টা করা যেত।
ছোটবেলায় আমাদের মীরাবাজারের বাসায় একজন হিন্দু ব্রাহ্মণ বেড়াতে আসতেন। আমার বাবা-মা দুজনই ছিলেন তাঁর ভক্ত। এই চিরকুমার মানুষটি না-কি মহাপুরুষ পর্যায়ের। ঘুরে বেড়াতেন খালি পায়ে, অতি তুচ্ছ বিষয়ে হা-হা করে হাসতেন। তখন আমার ধারণা হল–মহাপুরুষদের খালি পায়ে থাকতে হয়, অকারণে হাসতে হয়। এক সন্ধ্যার কথা তিনি বেড়াতে এসেছেন। মা বললেন, আপনি খুব ভালো দিনে এসেছেন, আমার কাজলের জন্যে একটু প্রার্থনা করুন। আজ কাজলের জন্মদিন।
তিনি আমাকে টেনে কোলে তুলে বললেন–গা দিয়ে ঘামের গন্ধ বেরুচ্ছে, কি রে ব্যাটা, গায়ে ঘামের গন্ধ কেন? এই বলেই চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করলেন, পরম করুণাময়, এই ছেলের অন্তর থেকে তুমি অন্ধকার দূর কর।
তাঁর প্রার্থনা ঈশ্বর গ্রহণ করেন নি। আমার অন্তরে এমন সব অন্ধকার আছে যা দেখে আমি নিজেও মাঝে মাঝে ভয়ে চমকে উঠি। কাউকে সেই অন্ধকার দেখতে দেই না। আলোকিত অংশটাই দেখতে দেই, কারণ এই আঁধার আমার আপন আঁধার। আমার নিজস্ব অনন্ত অমর।
হুমায়ূন
আহমেদ
১৩ই নভেম্বর ১৯৯১
Leave a Reply