অতীত একটা ভিনদেশ – মোজাফ্ফর হোসেন
অতীত একটা ভিনদেশ / গল্প সংকলন / মোজাফফর হোসেন
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৬
উৎসর্গ : আমার পিতা, পিতামহ এবং প্রপিতাকে
.
পাঠকথন
তরুণ লেখক মোজাফফর হোসেন লিখছেন গল্প, আলোচনা, সমালোচনা অনুবাদেও বেশ স্বচ্ছন্দ। আমি যখন তাঁর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থেও ‘পুনরুত্থান’ গল্পটি পড়ি তখন খুব বিস্মিত হয়েছিলাম। কারণ গল্পে নির্মাণ বলে কিছু নেই। কোনো প্রস্তাবনা, অবতরণিতা বা কোনো ভূমিকা ছাড়াই গল্প শুরু হয়। যেমন, ‘গতকাল মধ্যরাতে কবর থেকে উঠে এসেছে রহমান। এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই তার এই উত্থান। আমি জানতাম ওর যা হতচ্ছাড়া স্বভাব তাতে করে বেশি দিন টিকতে পারবে না ওখানে।’
মৃত ব্যক্তির কবর থেকে উঠে এসে এক কাপ গরম কড়া চা ঘিরে গল্পগুজব করে আবার কবরে ফিরে যাওয়া এবং লেখকও তার সঙ্গে গিয়ে কবর পর্যন্ত পৌঁছে। দেবার মধ্যে যে হেঁয়ালি আছে তার গূঢ় অর্থ কোথাও আছে কি না, তা পাঠকই উদ্ধার করবেন এই আশায় এখনকার নবীন লেখকরা গল্পে-কবিতায় কাজ কওে যাচ্ছেন। আমরা এতদিন জানি, গল্পই হোক আর উপন্যাসই হোক- বিষয়বস্তু বিস্তরে নির্মাণ বলে একটা ব্যাপার আছে। তার একটা… কিন্তু মোজাফফরের গল্পে নির্মাণ বলে কিছু নেই- সমস্ত বিষয়টি ভেঙেচুড়ে দিয়ে যা তিনি সৃষ্টি করে ওঠেন, তা যেন অস্থিহীন এশটি অবয়ব। যেন ‘দেহহীন লাবণ্য বিলাস’। অবয়বটিও যেন বায়বীয়- স্বপ্ন আর ঘন কুয়াশার ভেতর দিয়ে দেখা বাস্তবের প্রায় বিনির্মাণ বাস্তব। যেমন, বর্তমান গ্রন্থেও ‘বাঁশিওয়ালা মজ্জেল’ গল্পটিতে মৃত্যুর পনেরো বছর পর মজ্জেলের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর যা ঘটে তা বাস্তবে ঘটতে পারত কিন্তু মৃত্যুর পনেরো বছর পর কথাটা ধরে রাখলেও কথা বলার তোড়ে ধরতাই ছিঁড়ে যায় এবং গল্পের শেষে লেখকের হঠাৎ একটি ইংগিতময় কথায় বোঝা যায়, মৃত্যুর পর মজ্জেলের সঙ্গে এই দেখা। এই ভীষণ সত্যটাই বাস্তব কিন্তু তা একটা বায়বীয় অস্তিত্বে এখানে লুকিয়ে আছে। ব্যাখ্যায় যাওয়া আমার উদ্দেশ্য নয় মোটেই। পাঠক নিজেই জানুক কী আছে সেথায়! আমি শুধু এইটুকু বলতে পারি, মোজাফ্ফর হোসেনের এই গল্পহীন গল্পগুলোতে আধুনিক পরাবাস্তব ও বিনির্মাণ কৌশল কাজ করছে কি না ভেবে দেখবার বিষয়।
জাহানারা নওশিন
কথাসাহিত্যিক।
.
আমার গল্পভাবনা
ক.
আমার কাছে আমার সাহিত্যভাবনা আর গল্পভাবনা আলাদা কিছু না। আমার গল্পে আমার সামগ্রিক সাহিত্যভাবনারই প্রতিফলন ঘটে। আমাকে আমার গল্পভাবনার কথা বলতে হলে, সেটি সাহিত্যভাবনা দিয়েই শুরু করতে হবে। আমি হয়ত খুব চিহ্নিত করে কিছু বলতে পারব না। তবে আমি আমার শিকড়ের কাছে ফিরে গিয়ে, আমার সাহিত্য-ঐতিহ্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কিছু একটা ইঙ্গিতপূর্ণ করে তুলতে পারব- এইটুকু বিশ্বাস রেখে শুরু করছি।
আমি লিখতে শুরু করেছি লেখক হওয়ার মোহ থেকে নয়। সে সুযোগ আমার ছিল না। কারণ লেখালেখি সংস্কৃতির একেবারে বাইরের মানুষ আমি। এমন একটা গ্রামীণ পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছি, যেখানে সাহিত্য সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা ছিল না। যতটুকু ছিল তাও নেতিবাচক। স্কুলে বাংলার শিক্ষকরা গদ্য-পদ্য পড়াতেন, যেমন করে অঙ্ক করাতেন অংকের মাস্টার। অংকটি কে লিখল বা কীভাবে এলো তা নিয়ে যেমন আমাদের জিজ্ঞাসা ছিল না, তেমনি গদ্যখানা বা পদ্যখানা কে লিখলেন বা কিভাবে লেখা হল তাও ছিল আমাদের আগ্রহের বাইরে। হ্যাঁ, একটা নাম থাকত বটে; কিন্তু সেটি আমরা পৃষ্ঠার নম্বর পড়ার মতো করে দেখে যেতাম। তবে এশবার কয়েক দিনের জন্য এই নামগুলো আলাদা করে আলোড়ন তুলেছিল। আমাদের নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত মৌলানা জুম্মার খুতবায় বললেন, মুসলমান দেশে হেঁদুদের লেখা পড়ানো হয়! সব ভারতের দালালদের চক্রান্ত। আমাদের ওই লেখাগুলো গুরুত্বহীনভাবে পড়তে বললেন। আর পড়ার সময় ঘন ঘন ‘নাউজুবিল্লাহ’ উচ্চারণ করার পরামর্শ দিলেন। আমি বা আমরা সেদিন বাসায় ফিরে বইয়ে লাল কালি দিয়ে হিন্দু লেখকদের আলাদা করেছিলাম; আর বিড় বিড় করে বলেছিলাম, তোমরা হলে কি-যে লাল পিঁপড়েদের জাত! এখানে বলে রাখি, কালো পিঁপড়ে আমাদের কামড় দিত না বলে, তাদের আমরা মুসলমান পিঁপড়ে বলে মনে করতাম। এবং আমাদের বিশ্বাস ছিল ভারতে কালো পিঁপড়েরা কামড়ায়, তবে লাল পিঁপড়েরা সেখানে স্বজাতিদের কামড়ায় না।
আমরা ছিলাম বারো ভাই-বোন। আমি এগারতম। অর্থনৈতিকভাবে আমাদের পরিবার বেশ সচ্ছল ছিল, যে কারণে আমাদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বেড়ে ওঠাতে কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু সমস্যা ছিল অন্যখানে। সেই সমস্যাটা একান্তই আমার। কারণে-অকারণে সব কিছু নিয়ে ভাবতাম আমি। পরিবারে আমার মাকে দেখতাম পোশ প্রাণীর মতো কাজ করে যেতে। ঘরের আসবাব থেকে শুরু করে পশুপাখি, গাছপালা সব কিছুর প্রতি মায়ের ছিল ভীষণ সৌহার্দ্যপূর্ণ মানবিক সম্পর্ক। কিন্তু বাড়ির কুকুরটি ছাড়া মায়ের প্রতি বাড়ির আর কারো কোনো অনুভূতি কিংবা দায়িত্ববোধ ছিল বলে মনে হয়নি। (মা মারা যাওয়ার কয়েক দিন পর কুকুরটি মারা গেল! আমি প্রশ্ন করেছি- কেন? উত্তর পাইনি। মা প্রায়ই ঘরের কপাট আটকে বসে থাকতেন। বিড়াল-কান্না কেঁদে কুরআন শরিফ পড়তেন, অনেক রাত অবধি। কেন এভাবে কাঁদতেন, কেন এভাবে দরজা আটকে বসে থাকতেন, তার কোনো উত্তর আমি পাইনি। মা যেদিন মারা গেলেন, তার কয়েক দিন আগে আমাদের ছোট দু’ভায়ের হাত ধরে বলেছিলেন, তোদের বাবা আবার বিয়ে করতে চাইবেন। বাধা দিসনি। মা চলে গেলেন। আমরা কথা দিয়েছিলাম, বাধা দিইনি। কিন্তু প্রশ্ন করেছি, কেন? উত্তর পাইনি।
গ্রামে একঘর হিন্দু ছিল- কামার। ওরা একদিন অকারণেই উঠে গেল। আমরা যারা হিন্দু দেখব বলে ওদের বাড়ির পাশে ভিড় করতাম, তারা একদিন সকালে ওদের ভিটেমাটি খালি খাঁ খাঁ করতে দেখে মন খারাপ করে চলে এলাম। ওরা চলে গেল কেন? কেন আমরা ওদের দেখতে যেতাম? এর কোনো উত্তর আমি পাইনি।
আমাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করা হল। বাবা বললেন, অন্তত একটা ছেলে হাফেজ হোক। আমি মাদ্রাসায় যেতাম আর প্রশ্ন করতাম, কেন? কিন্তু উত্তর পাইনি। মাদ্রাসাটি একদিন অর্থাভাবে এবং ছাত্রাভাবে বন্ধ হয়ে গেল। আমাকে আবার সাধারণ স্কুলে ফেরত আনা হল। বাবার স্বপ্ন এবার, আমি ডাক্তার হব। আমি প্রশ্ন করলাম, কেন? কোনো জবাব পেলাম না। এরকম শত শত কেনর উত্তর খুঁজতে খুঁজতে একদিন হাতে পেলাম ‘গল্পগুচ্ছ’। ক্লাস সেভেন কি এইটে পড়ি তখন। সেই প্রথম ক্লাসের বাইরের কোনো বই হাতে নিলাম। পড়লাম। রাতদিন নষ্ট করে। কিছু বুঝলাম, অনেকটাই বুঝলাম না। কিন্তু শব্দগুলোর প্রেমে পড়ে গেলাম। কাউকে বলতে পারছিলাম না সে কথা। সবাইকে তখন অন্যগ্রহের মানুষ বলে মনে হচ্ছিল। আমি কাউকে ঠিক ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। একবার কিছু লিখব বলে ঠিক করলাম। কিন্তু যখন মনে হল, আমার পরিবারে কোনো দিন কেউ কলম ধরেনি- আমার পিতামহ-প্রপিতারা অক্ষরহীন ছিলেন। তখন আর সাহসে কুলালো না। তবে পড়ার ব্যাপ্তিটা বেড়ে গেল। লাইব্রেরি থেকে চুরি করে কিংবা টাকা জমিয়ে কিনে দেশি-বিদেশি আরো কয়েকজনের লেখা পড়লাম। এরই মধ্যে একদিন আবিষ্কার করলাম- আমি চলতে-ফিরতে, নামাজে দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলি! একতরফা না, সেও বলে। আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর দেয়, আবার আমাকেও প্রশ্ন করে বিচলিত করে তোলে। তাকে একবার মনে হল, বাড়ির পেছনের বুড়ো আমগাছটি সে। একবার মনে হল, কোনো আদিম ছায়া। একবার তাকে আমি সত্যি সত্যি দেখলাম। আমাদের শান বাঁধানো পুকুরপাড়ের ওপর একটা পাকুরগাছ ছিল; গাছটার নিচে বসে। কাঁধে ছেঁড়া থলে, পরনে কাদামাটি মাখা কয়েক শ বছর পুরনো পোশাক। মাকে বলে ওকে আমাদের বৈঠকখানায় বসালাম। মা কচুঘণ্ট দিয়ে মাছ-ভাত দিল। মাছটা খেল না। আমি পানি দিলাম গ্লাসে। ও ইশারা করল থালে ঢেলে দিতে। থালে পানি নিয়ে কুকুরের মতো চেটে চেটে খেল। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে একবার মনে হল লজ্জা পেল; মনে হল এভাবে সামনাসামনি দেখা হওয়াতে ও বিব্রত। ওর আদিম স্বভাব দেখে আমিও একটু বিব্রত হলাম। সন্ধ্যায় গ্রামে রটে গেল, ভারত থেকে স্পাই এসেছে। ভারত তখন আমাদের কাছে হিন্দু রাষ্ট্র। সবাই ওকে নানা কূটনৈতিক প্রশ্ন করল। ও কোনো উত্তর না করায় কিংবা ওদেও কথা বুঝছে না এমন ভাব করায়, সকলে তাদেও ধারণা ঠিক বলে ধরে নিল। সিদ্ধান্ত নিল ওর পোশাক খুলে দেখবে, কোনো গোপন নথি আছে কি না। আমি কিছু করতে না পেরে মায়ের দ্বারস্থ হলাম। মায়ের কড়া আদেশ, সকাল পর্যন্ত ওর গায়ে কেউ হাত দেবে না। সকালে পাশের গায়ে ক্যাম্পের পুলিশ ডেকে তাদের হাতে তুলে দেয়া হবে। সবাই সকালের তামাশা দেখার আশায় ফিরে গেল।
ভোরে উঠে আমরা দেখলাম, ও নেই। বৈঠোকখানা ফাঁকা পড়ে। গ্রামের লোকজন তল্লাসিতে বের হল। আশপাশের গায়ে খোঁজ পাঠাল। পেল না। তুমি ওভাবে চলে গেলে যে? আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। ও মুচকি হেসে বলেছিল, মায়ের আদেশ ফেলতে পারলাম না যে! তখনই ওর নাম পড়ালাম, প্রপিতা। প্রপিতা শব্দটা সদ্য শিখেছিলাম। এরপর প্রপিতার অনুরোধে লিখতে শুরু করলাম। আমাদের দু’জনের ভাবনাই আমি গুরুত্ব দিয়ে লিখলাম। সে-সব মাথামুণ্ডহীন চিন্তাভাবনা। কখনো কখনো গালগল্প। তবে খুব সামান্যই লিখলাম। বেশির ভাগ গল্পই আমরা সুন্দও করে বানিয়ে বাতাসে ভাসিয়ে দিতাম। এভাবেই আমার গল্প লেখার কিংবা গল্পভাবনার শুরু।
পরবর্তী সময়ে যখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনার পাশাপাশি লেখালেখিটা কিছুটা বুঝে ভেবেচিন্তে লেখার চেষ্টা করছি, তত দিনে সেই প্রপিতা আমার সঙ্গে মেলামেশা কমিয়ে দিয়েছেন। শহর তার ভালো লাগে না। প্রকৃতি ছাড়া সে থাকতেও পারে না। আমি লিখতে থাকলাম আমার সেই ছেলেবেলার ‘কেন’গুলোকে জড়ো করে নিয়ে আপন মনে।
.
খ.
আমি যখন লিখতে শুরু করি, দেখা যায় অধিকাংশ গল্পই লিখতে লিখতে বাঁকবদল করে ভিন্ন একটা গল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ যে গল্পটা লিখব বলে শুরু করেছি, শেষ পর্যন্ত আর সেই গল্পটা লেখা হয়ে ওঠেনি। অনেকগুলো পথের মাঝখানে এসে আমি অন্য পথে চলে গেছি। এভাবেই না লিখতে পারা গল্পটার অতৃপ্তি আমাকে নতুন গল্পপথে চালনা করেছে।
সব সময় আমি গল্পটা জানি বলে লিখি না; অনেক ক্ষেত্রে গল্পটা জানতে চাই বলে লিখতে শুরু করি। পাঠক যেভাবে গল্পটা পড়তে পড়তে জানেন, আমি তেমন লিখতে লিখতে জানি। ন্যারেটিভের এই পদ্ধতিটা আমি আমার কৈশোরের সেই প্রপিতার কাছে পেয়েছি। আমরা দুজনেই জানি না এমন অনেক গল্প নাড়াচাড়া করতে করতে শেষ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ একটা গল্প ফেঁদে ফেলতাম। অনেক সময় গল্পের শেষটা জানতাম; তখন গল্পের মুড়ো ধরার জন্য উল্টো পথে হাঁটা দিতাম। আবার কখনো মাঝটা জানতাম, তখন উভয় দিকেই আমাদের হাঁটতে হতো। ফলে গল্পের যে কোনো পয়েন্ট থেকে আমরা শুরু করতে পারতাম।
আমার গল্পভাবনার একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, আমি খুব কাছ থেকে জীবনকে অনুকরণ করতে চাই না। জীবনটা বুঝে নিয়ে দূর থেকে দেখাতে চাই। হারুকি মুরাকামির মতো আমিও বিশ্বাস করি, আমরা সবসময় একটা বানোয়াট বা আরোপিত (Given) পরিস্থিতির মধ্যে বাস করছি, তাই আমার গল্পে সেই বানোয়াট জগতের কথাই নানাভাবে উঠে এসেছে। আমি সব সময় একটি ঘটনা যা বাস্তবে ঘটেছে সেটি না বলে কী কী ঘটতে পারত সেই গল্পটা বলতে চেয়েছি। তাই গল্পগুলো সরাসরি বাস্তবতানির্ভর না থেকে সম্ভাবনানির্ভর হয়ে উঠেছে।
গল্পের বিষয়বস্তু নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমি দুটো বিষয় মাথায় রাখি। এক, আমার বর্তমানের কাছে দায়বদ্ধতা। যে কারণে আমার গল্পে বর্তমান সময়ের তৃমুখী শক্তি- কর্পোরেট শক্তি, আমলাতন্ত্রের শক্তি এবং মিডিয়াশক্তি- এই তিন শক্তির কাছে একজন ব্যক্তির যে অবস্থান, সেটি নানাভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। দুই. আমার ঐতিহ্যের কাছে দায়বদ্ধতা। যে কারণে আমার গল্পের অনেক চরিত্র ক্ষয়ে যাওয়া অতীতের জন্য হাহাকার করে। নগরজীবনের বিস্তার এবং প্রযুক্তিবিপ্লবের কারণে আমাদের গ্রামীণজীবন বদলে গেছে। অর্থাৎ আমরা যে আদর্শ গ্রাম দেখে এসেছি, সেটি এখন একমাত্র আমাদের স্মৃতিতে আছে। অন্য কোথাও নেই। আমি বাবাকে দেখেছি, গ্রামে দাদার তৈরি পুরনো বাড়িটা খুঁড়িয়ে নিজের হাতে গড়া পাকা বাড়িতে থাকতেন। স্থানচ্যুত তিনি হননি। তারপরও হোমসিকনেসে ভুগেছেন। এই হোমসিকনেসের বিষয়টি আমাকে অন্যভাবে তাড়িত করেছে। মাধ্যমিকে উঠে আমি যখন গ্রাম ছেড়ে জেলা শহর মেহেরপুরে আসলাম, তখন প্রতিটা মুহূর্তে শহরটিকে আমার নিজের করার জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে। এরপর উচ্চমাধ্যমিকে চলে এলাম কুষ্টিয়া শহরে, এই শহরে আমি আগন্তুক হিসেবেই পরিচিতি পেলাম। উচ্চশিক্ষার জন্যে চলে গেলাম রাজশাহী। এখানে (উত্তরবঙ্গে) আমার পরিচয় আমি দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ। তত দিনে মেহেরপুর শহরটি আমার কাছে অপরিচিত হয়ে উঠেছে। গ্রামকে হারিয়েছি আগেই। বাবা-মা গত হয়েছেন সেখানে ক্ষতচিহ্ন হয়ে পড়ে আছে মৃতপ্রায় ভবনটি। এখন কর্মসূত্রে ঢাকায় আছি, আমার সন্তানের জন্ম হয়েছে এখানে। ও যখন আমাকে নীরব চাহুনি দিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারে। আমি বা আমরা কোথাকার, বাবা? আমি একটা নীরব সিদ্ধান্তে আসি- Dhaka will never be the city of our own; and Meherpur is no more…!
আমার গল্পভাবনা শেষ ও চূড়ান্ত বলে তো কিছু নেই। তাই হঠাতই ইতি টানছি। স্মরণ করছি এল পি হার্টলির উপন্যাস ‘দ্য গো-বিটুইন’র সেই বিখ্যাত প্রথম লাইন, যেটি থেকে আমি আমার বর্তমান গ্রন্থটির নামকরণ করেছি–’দ্য পাস্ট ইজ অ্যা ফরেইন কান্ট্রি, দে ডু থিংস ডিফারেন্টলি দেয়ার।
মোজাফফর হোসেন
নূরজাহান রোড, মোহাম্মদপুর। ঢাকা
৪ ডিসেম্বর ২০১৫
.
সূচিপত্র
বাঁশিওয়ালা মজ্জেল
একটা কুকুর অথবা একজন কবির গল্প
ভ্যাদা কবির প্রস্থান কবিতা
লাশটি জীবিত, বাকিরা মৃত
ঘুমপাড়ানো জল
যে কারণে যুদ্ধটা অনিবার্য ছিল
একটি নদীর গল্প
না লিখতে পারা গল্পটা
খোয়াব
জীবনটা গল্পের অথবা মরীচিৎকার
মৎস্যজীবন
একবার যদি কথা হতো
সুখ-অসুখ
ছুঁয়ে দেখা জীবন
Leave a Reply