অঙ্গে আমার বহুবর্ণের দাগ – ত্রিদিব দস্তিদার
উৎসর্গ
মেরী এ্যান রড্রিগসকে
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮
প্রকাশক : সৈয়দ রহমত উল্লাহ রাজন, র্যামন পাবলিশার্স, ঢাকা
আমার চোখ
প্রথমে পায়ের নখের নক্সী-কিউট
না প্রীত-চিবুক ধরে করি সম্বোধন
সব স্থানেই তো লোমশ আবেগ
ওদের বিস্তার সর্বগ্রাসী পশুর ঔরস
এভাবে আমার চোখ মানবীর রূপকে হারায়।
প্রথমে ভোরের শিশির ছুঁয়ে
না সূর্যাস্তের রশ্মি মেখে বুকে
সর্ব-প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের ডাক নামে
আমাকেও উজাড় করে যে দুর্যোগ
ওদের বিস্তার সর্বগ্রাসী প্রলয়ের তাড়া
এভাবে আমার চোখ প্রকৃতির সৌন্দর্য হারায়।
প্রথমে প্রাপ্ত-জীবিকার পরমায়ু দেখে
না আয়ুর নিষ্ক্রান্তি রটিয়ে স্বপ্ন
জাগতিক কবিতার ঘরে দেয় বাস্তবের খুঁটি
ওদের বিস্তার তাই জীবন-যুদ্ধের রূপাঘাত
এভাবে আমার চোখ কবিতার উৎকর্ষ হারায়।
চোখ
তোমার চোখ-জোড়া পাঠ-অভ্যাসের মতো
পড়ে আছে আমার পড়ার টেবিলে
আমি তোমার চোখের মুখবন্ধ খুলি
খুঁজি কাজল পক্তি
ভূমিকার একাগ্র শিকড় প্ৰণয়।
তোমার চোখ-জোড়া সমুদ্র-এ্যাকুরিয়াম
যেন দূর কৃষ্ণ বিন্দুর মাছ
ফেনায়িত শাদা ক্যানভাসের মুখ
পড়ে আছে আমার ঋজুতার ইজেলে
আমি তোমার চোখের রঙ মুখস্থ করি।
তোমার চোখ-জোড়া পাহাড়ের ঢালু পথ
সমতলে গড়ে ওঠা কুঁড়ে ঘর ছাতা
ঝর্নার ঠোঁটে বসে থাকা
শুভ্র পাথর প্রেমিক
আমি তোমার চোখের মুগ্ধতা মুখস্থ করি।
তোমার চোখ-জোড়া লুক্কায়িত ঝিনুক-শঙ্খ
বুকে তার কান্নার গভীর সমুদ্র
আমি তোমার চোখের শব্দ মুখস্থ করি।
তোমার চোখ-জোড়া ভোরের স্নিগ্ধ নীরবতা
নারকেল পাতার ভ্রূ-ভঙ্গিমায়
বিন্দু বিন্দু শিশিরের স্বেদ
আমি তোমার চোখের মগ্নতা মুখস্থ করি।
তোমার চোখ-জোড়া দু’পারের দু’টি রঙধনু সেতু
এপারে অপেক্ষমাণ মানুষের নিঃশব্দ হাঁক
ওপারে বিশ্বাস চুমু খায়
আমি তোমার চোখের সীমানা মুখস্থ করি।
বৈশাখে উত্তরবঙ্গীয় বাস
বৈশাখের বাসে উঠেও তুমি চৈত্রকে—
বিদায় দিতে পারলে না, পারলে না নাড়াতে
উষ্ণতার বিপক্ষে কোনো চৈত্রের বিদায়ী হাতপাখা
যদিও বিদায় কখনো উষ্ণতার হয় না,
তবুও তোমার উষ্ণতা নিবারণ বড় প্রয়োজন ছিল
বৈশাখের সেই লাল বাসে।
আমি তাই একখণ্ড শীতল বাতাসের নির্ভরতার খোঁজে
তন্ন তন্ন করি বাসস্ট্যান্ড
হালকা পাতলা কোনো চটুল সাপ্তাহিকে,
পুরানো দৈনিকের অবিকৃত পাতায়,
বিজ্ঞাপনের ছেঁড়া কার্টুনে-সৃষ্ট বাতাসের প্রত্যাশা পূর্ণ করে
তোমার হাতে পৌঁছে দিতে এক পাখার বিকল্প গন্তব্য
ক্লান্তিহীন তোমার বাতাস-যাত্রায়, ছায়াপথে।
কিন্তু তোমার এ দীর্ঘ পথযাত্রা এবং ক্লান্তিময় উত্তাপ
আমার হৃদয়ে সম্পূর্ণ চৈত্রের হাওয়াহীন
তাপ-হলকা ছিটিয়ে সড়ক-পলকের গতি নিয়ে
ছুটে গেলো বৈশাখের সেই উত্তরবঙ্গীয় বাস,
আমার দৃষ্টির পলকহীন অপেক্ষার বাইরে।
নারী অমৃতস্য
ঈশ্বর গড়েছে লীলায়
নারীতে কাঠামোর ভিত
বাড়ন্ত মাটির অর্ঘ্যে
প্রকৃত স্বদেশপ্রেমী।
নারীই প্রকৃত স্বদেশ যেন
আবর্তিত শস্যের মাঠ
বীজের বাহুল্য রাখে
মোহনার ইলিশ সাঁতার।
নারীতে নিমগ্ন প্রেম
মাতৃসুধা দেশজ বিন্যাস
আঁচল বিছিয়ে তোলে
অমৃতস্য পুত্রের আখ্যান।
ভালোবাসার বস্তুগত ব্যবহার বিধি
আজও সিঁড়ি ধরে নেমে যায় ক্রোধ
সবুজ ছায়ারা আসে ছাদের নিচের ঘরে
হলুদ হওয়ার আগে
নেমে যায় পথে।
অভিমান অভিমানে ক্রোধ হ’লে
ক্রোধের হলুদ আসার আগে
ঝরে যায় যদি পরিপক্কের রূপ,
না-তুমি ঝরাও!
ফলের আসল পরিচয় তবে
কে দেবে আমাকে
বীজহীন রেখে তার
মাটির জীবন?
সবুজ রূপেতে স্বাদ নতুনের ঘরে
এনে দেবে সাময়িক,
চোখের চকচক দেবে যথেচ্ছ বাড়িয়ে।
কেন তুমি প্রিয় অবহেলা ভরে
হলুদ পাতাকে দেবে
পুনশ্চের ক্রোধ-অভিমান?
ক্রোধে আর অভিমানে রেখে একদিন
সবুজকে আবারো হলুদের আগে
যদি তুমি দিয়ে যাও শেষবার,
ভালোবাসার বস্তুগত ব্যবহার বিধি
তবে মেয়ে, বিনা মেঘে বজ্ৰপাত
হবে না আমার।
দুধ-আদর
কী সবুজ আদর পাওয়ার
জন্যে তুমি
কী এমন বেড়াল সাজে
লুটিয়ে পড়ো
চরণ ছুঁয়ে ভালোবাসার
হন্যে তুমি
উজাড় করে দাও যে তোমার
শতেক আয়ু!
কী অবুঝ আদর খোঁজার
দুস্থ বেড়াল
কী এমন সাঁঝের বেলায়
সঙ্গোপনে
জীবনের হাতড়ে ফেরা
সব উপভোগ
পেতে চাও দুধ-আদরে
পূৰ্ণ বাসন!
শালবনে হারিয়ে যাওয়া
শালবনে হারিয়ে যাওয়ার মতো
তোমাকে খুঁজি, পাখির মুগ্ধ কলতানে
জ্যোৎস্নার প্লাবিত সংসারে।
অথচ তুমি কোথায় ছিলে না বলো?
যে দৃশ্যে তাকাই না কেন সে দৃশ্যে তুমি ছিলে
রূপে, গন্ধে, বর্ণে কেবল সমাহার।
তোমার অস্তিত্ব এখন শুধুই ধু-ধু শালবন
ধু-ধু হারিয়ে যাওয়া
ধু-ধু নীলিমায় ঝরা পালকের ঢেউ।
একদিন বিস্তীর্ণ স্বপ্নের মাঠ পার হতে দেখেছিলাম
এক দিব্য জ্যোতির্ময় যৌবনবতীকে
সে যতই অগ্রসর হচ্ছে তার পশ্চাৎভাগ
ততই অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছিল একান্ত নিয়মে
আর সামনে তার প্রজ্জ্বলিত আলোর শিখা
পেছনে আমি যেন এক অন্ধকার পিণ্ড
আমিময় অন্ধকার পিণ্ডটিকে নিয়ে যতই এগিয়ে যাই
মাঝখানে তোমার পশ্চাৎছায়ার কৃষ্ণ-দেয়াল
ততই দৃঢ় এবং ঋজু ভঙ্গিতে
আলোকময় রশ্মিগুলোকে ঘিরে থাকে।
এবারও আমিময় আলোর দিকে
মুখ করে ছুটতে চাইলাম—
তবুও তুমি এক রহস্যময় আঁধারের বন্ধন,
ছিন্ন হতে দিলে না,
রেখে দিলে শুধু গতিষ্মান সময়ের সন্ধিস্থলে।
আমি এখনো তোমাকে খুঁজি
পৃথিবীর আদিম মন্ত্রে, নক্ষত্ররাজির উদ্বেলিত উদ্যানে
অবলুপ্ত কোনো প্রাচীন পুরাণে।
কিন্তু তোমার অর্ধেক অন্ধকার আর অর্ধেক আলোর শরীর
কখনো আর একত্র হবে না জেনেও
এই শালবনহীন প্রান্তরে
আজ আমি শালবনে হারিয়ে যাওয়ার মতো
তোমাকে পাওয়া, তোমাকে খোঁজা, তোমাকে হারানো
পূর্ণিমার কাছে, জ্যোৎস্নার একান্ত সাহচর্যে
পাখির উচ্ছল কলতানে
মর্মরিত পাতার আনন্দে
তোমার একাংশ অন্ধকারকে নিবিড় প্রজ্ঞায়
আজো জানতে চাই,
বার বার হারিয়ে যাই,
তোমার নির্মিত এই গভীর শালবনে।
ফুলের গৌরব নেই
ফুল ফেরায় না তার কোনোই ভ্রমর
ফুলের গৌরব কিছু নেই, কি পবিত্রতার?
ফুল এ পবিত্র নাম দেবতার অর্ঘ্যে
ফুল এ পবিত্র নাম প্রেমিকার সৌন্দর্যে
ফুল এ পবিত্র নাম ভালোবাসা নিবেদনে
তাকে তুমি ফুলেশ্বরী বলো!
সে তোমার ঈশ্বর নয়, পরজায়া।
ঈশ্বর সে তো ভোগী, একনায়কের ছায়া
ফুলের সৌরভ শুষে নেয়া
আর বলে বলে যাওয়া
ছুঁয়ে দিলাম, পবিত্র হও পবিত্র হও ছুঁয়ে দিলাম
পাঠালাম তোমাদের নামে পবিত্র এনাম।
তোমার জন্মদিনে
It’s too late my love, it’s too late
It’s too late my creation, in your birth
বড় দেরি হয়ে গেলো তোমাকে জানার জন্মদিন
নিজেকে জানার জন্মে তোমাকে খোঁজার চিরদিন
It’s too late my beauty, it’s too late
It’s too late my thirst, It’s too late
বড় দেরি হয়ে গেলো এ দেখার মানবী জমিন
শত দেখার মাঝেও অদেখার কাঁকন বাজে রিনিঝিন
It’s too late my poetry, It’s too late
It’s too late my conversation, in your heart
বড় দেরি হয়ে গেলো তোমার শব্দে হৃদয় ছোঁয়ার
অপরূপ ছাঁচে আমার স্বপ্নের কবিতা বোনার
It’s too late my love, It’s too late
It’s too late my creation, in your birth
বড় দেরি হয়ে গেলো তোমাকে জানার জন্মদিন
নিজেকে জানার জন্মে তোমাকে খোঁজার চিরদিন।
আঁচড়
আমন চালের ভিড়ে
তুমি এক কঠিন কাঁকর
প্রেমের শোভন দাঁতে–কেটেছো,
কেটেছো শুধুই
কোমল আঁচড়।
তোমাকে পাবার আগে
তোমাকে পাবার আগেই হারিয়ে ফেলি
তারপর আবারো খুঁজি দিব্যদৃষ্টির আলোয়
কখনো শব্দরূপে, কখনো অলীক আসনে
তোমাকে খোঁজার ব্যঞ্জনা
আমাকে আরো দূর এগিয়ে নেয়
সূর্যাস্তের আরো আগে
অথবা সূর্যোদয়ের আরো কাছে
তোমার হারিয়ে যাওয়া,
প্রীত হয়েছে কি না? কোনো স্থলে
কিংবা জলে
তোমার হারানোর সীমা,
লিপিবদ্ধ হয়েছে কি না? এই সব
রঙধনু রঙ দিব্যদৃষ্টির পথে
সেতু হয়ে আমাকে পারাপার করে।
তোমাকে পাবার আগে আমি হারিয়ে
তারপর আবারো খুঁজি দিব্যদৃষ্টির
দাঁড়ানোর সহজ ভঙ্গিমা
কোথায় এসে থামবে বলো হে আমার স্রোতস্বিনী
জমে যাওয়া পাহাড়-দুঃখ ছুঁয়ে ছুঁয়ে
তুমি কি দাঁড়াবে এখন?
ভরা আবেগের স্রোতে গড়ানো পাথর
তুমি কোথায় এসে থামবে বলো?
নদী তীরে না নদীর গভীরতম বুকে
দাঁড়াতে দাঁড়াতে তুমি কি ফের পাহাড় হবে?
পাহাড় কখনো প্রেমের উৎকৃষ্ট উপমা নয়
প্রেম অনড় পাহাড়কেও ডিঙিয়ে যায়
অনেক কাঠ-খড়, চড়াই-উৎরাই
এভাবে প্রেম এসে তার অভিজ্ঞ শিশু
হাঁটি হাঁটি পা পা, এক সাথে দুই পা
সঠিক উচ্ছ্বাসে একদিন দাঁড়িয়ে যায়
পাহাড়ের মুখোমুখি, যদিও পাহাড় তার
ইচ্ছার উচ্চতার চেয়ে অনেক খাটো, তবুও
পাহাড়ের পাশ দিয়ে নদী বয়ে যায়।
তাই পাহাড় আর পাথরকে সামনে রেখে
নদী তার মানুষের প্রেম, চলা এবং দাঁড়ানোর
সহজ ভঙ্গিমা শিখিয়ে দেয়।
সুঁই-সুতো প্ৰাণ
তোমার জন্যে এফোঁড়-ওফোঁড় কাঁথায় সুতোমুখী
তোমার জন্যে হৃদয়-কাঁথায় নক্সী ব্যথা আঁকি
তোমার প্রেম যে উঁকি-ঝুঁকি কাঁথার ফোঁড়ে চলে
উঁকি-ঝুঁকির মাঝেও কেমন বুনন কথা বলে
প্রেম যে আমার বুনন প্রথায় বাবুই-এ বিশ্বাসী
দীর্ঘ ফোঁড়ের কাঁথার ঢেউ-এ হয় যে সুঁই নদী।
সুঁই-নদীরই বাঁকে আমার রয়েছে হৃদয়নগর
নক্সা আঁকা দুঃখ আমার সুতোতে বন্দিনী
সুতো বন্দী, সুতো সন্ধি সুতোই পরম কাঁথা
সুঁই-দরদে হৃদয় ফোঁড়ে সাজায় চরণ গাঁথা
আমরা দু’জন সুঁই-সুতো প্রাণ বুনি রঙিন ব্যথা।
কবিতা অঙ্গরাজ্য গড়ে
এখনো আমাকে নিয়ে কবিতা হলো না
এই খোলাখুলি দম্ভ প্রদর্শনে
যদি তুমি সিদ্ধ হও,
তবে তোমাকেই শব্দের সাহসী প্রতীক
এবং বিষয়ের প্রকৃত ছন্দকলা
বলা যেতে পারে।
কবিতা বিষয় চায়,
বিষয় কি শুধুই মুক্ত চোখের সাদৃশ্য?
তোমাকেই দেখে যার
নির্মাণ কাঙ্ক্ষা হয়, কবিতা অঙ্গরাজ্য গড়ে
পাহাড়স্পর্শী সানুদেশ থেকে নদীর
নোনা নাভির স্রোত
নিতম্বের বাঁক ছুঁয়ে গোড়ালিতে নেমে আসা
উদাস চুলের পান্সি
উন্মুক্ত বক্ষের বেদীতে বসা
কালো তিলের চুম্বন-শিলা
এক জোড়া অপেক্ষার কাছাকাছি
দু’টো সবুজ ঠোঁটের আল
কোমর কলসীর কাঁখে তৃষ্ণা-ভরা
সাবলীল বিছা
এইসব বিস্তৃত কারুকাজ, ধারণ-উন্মুখ
বহির্দৃশ্য তোমার
আমার কবিতার উপাদেয় কি-না
কি করে তা বলি—
তোমাকেই নিয়ে আজ আমার কবিতা হবে?
মচকে দিলে
মচকে দিলে ভালোবাসা
ভাঙতে দিলে না
সেই ব্যথাতে আজও আছি
টলতে জানি না।
টলটলে এক তরল গ্লাসে
আকার তোমার রেখে
তার বহনে আমায় নিলে
টলতে না হয় দেখে।
মচকে দিলে ভালোবাসা
ভাঙতে গেলে না
সেই ব্যথাতে আজও আছি
টলতে দিলে না।
টলতে গেলে তরল পাত্র
গরল রূপ যে ব্যেপে
সে অভয়ে আজও বাঁচি
তোমার আদেশ মেপে।
ভালোবাসা ভাতঘর
ভেঙে পড়ে ভাতঘর
আমাদের পিঠে
মুখে তাই কি দেবো
শস্যের চিটে!
আমাদের পাতে বসা
নিমকের দেখা নেই
সময়ের খড়
ভালোবাসা পর।
ভালোবাসা ভাতঘর
টেকা বড় দায়
প্রয়োজনে ধরে রাখি
খুঁটি-বীম চাই?
রঙধনু-ওড়না
আকাশের প্রশস্ত বুক নিয়ে, স্কার্ট-নীলে
তুমি পরে আছো এক রঙধনু ওড়না
যেন রঙের কারুকাজ দেখে
শান্ত এ বিকেলে শিল্পী যুবক কোনো
কাছে আসে,
ছুঁতে চায় তোমার রঙের একান্ত নির্জন!
মেঘ আর বৃষ্টিকাটা তুমি রঙধনু
মৃদু-মধুর রোদ্দুরে উপস্থিতি তোমার
মেঘ অনুতাপে
বৃষ্টি অনুতাপে
যেন মাটি ছুঁয়ে আছো দূর—দূরে
অপরূপ দৃশ্য হয়ে মায়াবী প্রকৃতির বেশে।
চ্যওমিন
অনুপ্রেরণার জন্যে চাই যে আহার
তুমি কি দেবে না প্রিয় প্রাকৃত আহার?
আহার মানে শব্দ-ব্যঞ্জন
আহার মানে তোমার সৌন্দর্যকে
ধারণ করার ক্ষমতা, পাকস্থলীর পরিপাক
কবির পাকস্থলী মানে হৃদয়।
কবির আহার হলো শব্দের চ্যওমিন
চেতনার দু’টি কাঠি দিয়ে পঙ্ক্তির মতো
তুলে নেয়া চাওমিন
কবির আহার হ’লো পঞ্চ-ব্যঞ্জন
স্বাদের আহ্লাদ মুখে আঘাটায় ধুয়ে আসা হাত।
প্রেম ও মৃত্যুদণ্ডের কবিতা
রাজদণ্ডে লড়ছে নায়ক
লড়ছে ভীষণ লড়ছে
প্রেমিক রণে হন্যে এ-প্ৰেম
শুধুই আশা গড়ছে।
মৃত্যুর আর দণ্ড কিসের
প্রেমের দণ্ডে প্রাণ
এক দরিয়ায় হলো না তার
তৃষ্ণা অবসান।
প্রেমিক নেবে দণ্ড মাথায়
ভিলেন নেবে ক্রোধ
মৃত্যু এসে ত্যাগের খাতায়
লিখবে অবরোধ।
একটি বাড়ির দুঃখ
আসতে তোমার বিঘ্ন হলে
পায়ের সাথে পায়ের পাতা
লেগে থাকার দীর্ঘ এ পথ
একটি বাড়ি দুঃখ পাবে,
কষ্ট পাবে
সোফা সেটের কোমল শরীর
সেগুন কাঠের রয়্যাল টেবিল
চাদরখানার রেইনবো কালার
দুয়ারেতে অপেক্ষমাণ পাপোসখানি
কষ্ট পাবে
ফ্রিজের সবুজ সব্জী বাগান
খাসির সীনা কষ্ট পাবে
ঠাণ্ডা জলের বোতলগুলোর গায়ে লাগা
শীতল ঘামের কোলাকুলি
কষ্ট পাবে
তোমার আসার বিঘ্ন হলে, ক্লান্ত
একটি বাড়ি দুঃখ পাবে
পায়ের পাতা একটি বাড়ি কষ্ট পাবে!
পঙক্তিভোজ
প্রথমে মুখমণ্ডলের দিকে না তাকিয়ে
চরণের দিকে দৃষ্টি রাখার কু-অভ্যাস
বড়ই কুশ্রী, বড়ই বিকৃত রুচি
ধরা যাক নিবিড় নষ্টামি
ভণ্ডামি প্রেমের নামে, নিমগ্নগামিতার সিঁড়ি।
তবুও এ দৃষ্টিপাত মজ্জাগত শিরার সৌন্দর্য
নারীর বৈশিষ্ট্য খোঁজার দৃষ্টি প্রক্ষেপণ
চরণে কমল পাপড়ি ছোঁয়ার আবেশ
কবিতার পরম পঙ্ক্তিভোজের রেশ
টুকটুকে লাল আলতার চুম্বন, পদচ্ছাপ—
বুকে নেয়ার আকুতি
অনুভূতির শতদল সৃষ্টির একান্ত গুলজার
আমারই, শুধু আমার।
মর্মে আমার
মর্মে আমার মন মরেছে
মন-ময়ূরী জানছো নাকি
পিযূষ পাড়ায়
ঘুরছে ফিরে নির্জনতা
ভবঘুরে বলছে লোকে
মিথ্যে লোকে পাগল সাজায়
এ ভোর ঘুরে সন্ধ্যা নামে
হঠাৎ যেন কাহার খোঁজে
বলছে দেখো রাতের আঁধার
খনির আঁধার
মাপছে দেখো বিশালতা
নিজের খোঁজে চাঁদটা দেখো
বাড়বে আবার প্রেমিক ছায়ায়
মর্মে আমার মন মরেছে, প্রেমের ধারায়।
‘আমি-তুমি’ আশ্রয় কেন্দ্ৰ
তোমাকে কেন্দ্র করে এই ‘আমি’ও
শুধু তুমি তে রূপান্তর হই কবিতায়।
তোমার পথে পথে
মোহে ও বন্ধনে
আমিও বিলীন, অন্তহীন
গড়ে তুলি একঘেঁয়েমির দীর্ণ কবিতা,
হয়ে উঠি অস্তিত্বের প্রৌঢ় মিলন
যাই সকলের পথে, একাকার, অনিল
অপরিহার্য ‘আমি’ শব্দের টানে
এভাবে ‘আমি-তুমি’র
ক্রমবর্ধিত রূপে,
অভ্যাসের সহস্র শব্দের ডানায়
আবার খুঁজতে চাই কাকাতুয়াহীন
শব্দের আকাশ
নতুন পথ-পরিক্রমার ভাষা
শরীর-সৌন্দর্যের আক্ষরিক বিভা।
কার আশ্রয়ে যাও ‘আমি-তুমি’
আশ্রয় নার্সিসাসে,
রঞ্জন সকালে
ভাবো বুঝি পৃথিবীর প্রত্যয় দেবে এই তান
কবিতা কি ‘তুমি’ আশ্রয়কেন্দ্রের মান,
অনাথ শব্দের আশ্রিত ‘আমি-প্রত্যয় প্রাণ’?
কবিতা চিত্রাঙ্গদা
শব্দের কাঁচুলি পরা পুরুষের বুকে
আমাদের কবিতারা কবিতাকে ডাকে
টগবগে ভরপুর তাড়ির আবেগে
কবিতা এগিয়ে যায় অজন্মা বেহাগে
নয় নারী নয় পুরুষ এমন আকৃতি
কবিতা প্রতীক যেমন ফলন দুর্গতি
পঙ্ক্তির কাঁচুলি কেন পুরুষ শরীরে
অঙ্গ-রস রঙ্গে মাখে বিপন্ন বিহারে
এ-কোন প্রার্থিত রাজ রাজরানী বেশে
রাজ্য শাসে হুঙ্কারে কাঁচুলি আবেশে
প্রজনন থেমে যায় প্রজারা চিন্তন
মৃত্যু আসে অমেয় জন্ম সনাতন
প্রজারা দিলেন ঢেঁড়া চায় সেই নারী
কবিতা চিত্রাঙ্গদা – শৌর্য বীর্যধারী
কিছুতে নেই, কিচ্ছুতে নেই
আমি এখন কিছুতে নেই, কিচ্ছুতে নেই
কিচিরমিচির কিছু ব্যথা বুকের ভেতর বাঁধছে বাসা
বাইরে এখন ওলট-পালট, ড্রাই-জিনেরই বাতাস বাড়ে
ভেতরটা যে আস্ত দখল, জবর দখল কে ওঠাবে?
চতুর্দিকে শূন্যতাবোধ গিলে খাচ্ছে
সব কিছুতে কিচ্ছুটি নেই, মনের ভেতর মনটিও নেই
রূপের ভেতর রূপটি
নাকি আমার ব্যতিক্রমী চোখ দু’টোতে
দৃষ্টি রেখে পালিয়ে বেড়ায় রূপের নগর
সামনে আমার উঁচু-নিচু ক’টি পাহাড়
হেঁটে যাচ্ছে আমার ছায়া, পাখির পালক
বায়ুর খোঁপায় রঙিন রিবন
হরহামেশা জ্বালায় ভীষণ একটি তিতির
মন্দিরা রায় তুমি এখন তানপুরাতে সাধছো গলা
এ অবেলায় একটি বালক চষছে শহর
কাঠফাটা-প্রেম মাথায় চেপে
শূন্যে এখন এপিটাফের তীব্র নিনাদ
গ্রেভইয়ার্ডে ঝুলছে কেন মৃত কপোত, তোমার আঁচল?
আমি এখন কিছুতে নেই, কিচ্ছুতে নেই
হায়রে আমার মন-ময়ূরী তুমিও বলো
আমি এখন কিছুতে নেই, কিচ্ছুতে নেই।
অঙ্গে আমার বহুবর্ণের দাগ
ভালোবাসার অঙ্গে আমার
বহুবর্ণের দাগ
অন্ধকারে চমকে ওঠে
আলোতে অনুরাগ!
একই অঙ্গে বহুবর্ণ-
হোঁচট খেয়ে পড়ে
ভালোবাসার দিবা-রাত্রি
টাট্টু ঘোড়ায় চড়ে।
ঘোড়া তো নয় পরীর জিন
লাগামহীন ছোটে
ভালোবাসার অঙ্গরাজ্যে
গোবরে পদ্ম ফোটে।
গোবর মুখে হরি-কীৰ্ত্তন
গাইলো ভক্তকুল
ভালোবাসার কৃষ্ণচূড়ায়
রাধার সত্য মূল।
ভালোবাসার অঙ্গে আমার
বহুবর্ণের দাগ
অন্ধকারে চমকে ওঠে
আলোতে অনুরাগ!
Leave a Reply