অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – দেবারতি মুখোপাধ্যায় (রুদ্র-প্রিয়ম সিরিজ ৩)
প্রথম প্রকাশ : নভেম্বর ২০১৮
অঘোরে ঘুমিয়ে শিব কোনো ইতিহাস নয়, একটি কাল্পনিক উপন্যাস। এই কাহিনি কোনো ব্যক্তি, সম্প্রদায়, ধর্ম, প্রতিষ্ঠান অথবা সংগঠনের অনুভূতিতে আঘাত বা কুৎসা করার উদ্দেশ্যে রচিত হয়নি। কোনো রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ বা প্রচারের উদ্দেশ্য এই উপন্যাসের লেখকের বা প্রকাশকের নেই। ঘোরে ঘুমিয়ে শিব উপন্যাসের সমস্ত চরিত্র কাল্পনিক। জীবিত অথবা মৃত কোনো ব্যক্তির বা তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে এই কাহিনির কোনো মিল পাওয়া গেলে তা নিতান্তই কাকতালীয়। এই উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র, ঘটনাবলি এবং পটভূমির কিয়দংশ লেখকের কল্পনাপ্রসূত। উপন্যাসে উল্লিখিত বিভিন্ন তত্ত্বের ব্যাখ্যা এবং সেগুলোর সত্যতার দায় কোনোভাবেই লেখক বা প্রকাশকের নয়। বিভিন্ন তত্ত্বের সূত্র এবং সংশ্লিষ্ট গ্রন্থপঞ্জি বইয়ের শেষে উল্লেখ করা হয়েছে।
.
যাঁর কলমের মায়াবী গতিপথে দিক হারিয়েছি
বার বার, ওপার বাংলার সেই অবিসংবাদী স্রষ্টা
হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতির উদ্দেশে
.
লেখকের কথায়
‘বেশ তো লিখছিলেন রহস্যরোমাঞ্চ, ইতিহাস, বিজ্ঞান মিলিয়ে মিশিয়ে। প্রেম, সামাজিক লেখাও সমান্তরালে এগোচ্ছিল। পত্রপত্রিকা, পুজোসংখ্যায় গল্প-উপন্যাসও দেখতে পাচ্ছি নিয়মিত। কিন্তু হঠাৎ এইসব? আগুনে হাত কি না দিলেই চলছিল না?’
‘এত কিছু থাকতে হঠাৎ এমন বিতর্কিত বিষয় কেন? একেই সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা চারদিকে উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে, ধর্মকে শিখণ্ডী করে মানুষ রাজনীতি থেকে নিজের আখের গোছানো, সবেতেই ফায়দা লুটছে, সেখানে জেনেশুনে ঘৃতাহুতি দেওয়ার কী আছে বাপু!’
ওপরের উক্তি দুটি সমুদ্রে নিমজ্জিত হিমশৈলের চূড়ামাত্র। উপন্যাস প্রকাশের মাসছয়েক আগে উপন্যাসটির পটভূমিকা হিসেবে একটি ভিডিয়ো ট্রেলার আন্তর্জালে প্রকাশ করা হয়েছিল। তারপর থেকে এমন শয়ে শয়ে বার্তা গত কয়েক মাসে আমার কাছে এসেছে। বলা বাহুল্য, সেই সব বার্তাই যে নিখাদ প্রশ্নসূচক বা বিস্ময়সূচক ছিল তা নয়, অনেকগুলিই তার মধ্যে ছিল বেশ ভীতিপ্রদর্শনকারী।
প্রথমেই স্পষ্ট করে দিই, রুদ্র-প্রিয়ম সিরিজের তৃতীয় উপন্যাস হিসেবে অঘোরে ঘুমিয়ে শিব-এ এমন বিতর্কিত বিষয় বেছে নেওয়ার পেছনে রাজনৈতিক, ধার্মিক, বা ব্যাবসায়িক কোনো উদ্দেশ্যই আমার কাছে বড়ো হয়ে ওঠেনি। তাজমহল ভারতবর্ষের অহংকার, মধ্যযুগীয় স্থাপত্যের এক অনন্যসুন্দর নিদর্শন। পঞ্চম মুঘল সম্রাট শাজাহান তাঁর প্রিয়তমা মহিষী মুমতাজ মহলের অকালপ্রয়াণে কাতর হয়ে তাজমহল নির্মাণ করেন। শুভ্রধবল মার্বেল পাথরের এই অসামান্য স্মৃতিসৌধ দেখতে সারা পৃথিবী থেকে আগ্রা শহরে পর্যটকরা ভিড় জমান। আমিও ছোটো থেকে একাধিকবার আগ্রা গিয়েছি।
কিন্তু বছরসাতেক আগে আমার হাতে হঠাৎই একটা বই এসে পড়ে, যার লেখক পুরুষোত্তম নাগেশ ওক নামের এক প্রাক্তন সেনা অফিসার। ভদ্রলোক ব্রিটিশ আর্মির হয়ে সিঙ্গাপুরে যুদ্ধে লড়তে গিয়েছিলেন, কিন্তু নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কিছুদিন পরেই তিনি যোগ দেন আজাদ হিন্দু ফৌজ-এ।
স্বাধীনতার পর তিনি ভারতের ইতিহাস পুনর্লিখনের কাজে আগ্রহী হয়ে পড়েন, এই উদ্দেশ্যে একটি প্রতিষ্ঠানও স্থাপন করেন এবং বিভিন্ন প্রামাণ্য নথি দিয়ে ইতিহাসকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতে শুরু করেন। তাঁর সমস্ত গবেষণার মধ্যে সবচেয়ে আলোড়ন ফেলা ও কৌতূহলউদ্রেককারী বক্তব্য ছিল, তাজমহল আদপেই শাজাহানের কীর্তি নয়, এটি আসলে প্রায় আটশো বছর আগের এক শিবমন্দির ও প্রাসাদ, যা কালের নিয়মে হস্তান্তর হতে হতে হিন্দু রাজা মানসিংহের দখলে এসে পড়ে, শাজাহান মানসিংহের পৌত্র জয়সিংহের থেকে এটি অধিগ্রহণ করে মুসলিম স্মৃতিসৌধে রূপান্তরিত করেন।
বিশ্বের ইতিহাসে চটজলদি জনপ্রিয়তা পাওয়ার লোভে আজগুবি তাক লাগানো বক্তব্য পেশকারী লোকের সংখ্যা কিছু কম নেই। ওকমহাশয় ঠিক না ভুল, তাঁর গবেষণা আদৌ ইতিহাসের প্রমাণনির্ভর না একপেশে অনুমাননির্ভর, তাই নিয়েও বিতর্ক হয়েছে প্রচুর। তাঁর বইয়ে লেখা যুক্তিগুলো একের পর এক নস্যাৎ করেছেন কেউ কেউ, আবার তাঁর থিয়োরিতে আবিষ্ট হয়েছেন এমন মানুষও আছেন।
ক্রমশ ওক-এর এই বক্তব্য সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে থাকে, অনেক ইতিহাসবিদ তাঁক সমর্থন করে আরও নতুন তথ্য সংযোজন করতে থাকেন, আবার অনেকে তাঁর মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। ইতিহাসের প্রকৃত সত্য অনুসন্ধান এবং ধর্মের গায়ে কুঠারঘাত এই দুটোর মধ্যে পার্থক্য বোঝার মতো ধীশক্তি অধিকাংশ নাগরিকেরই নেই, সরকারও এই বিষয়ে ততোধিক সতর্ক। ফলে সময় এগোয়, আর সমান্তরালে তাজমহল সম্পর্কে এই দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটিও যুগ যুগ ধরে জনশ্রুতিতে স্থায়ী হতে থাকে।
ওক নিজে প্রকৃত ঐতিহাসিক অনুসন্ধানের দাবিতে সুপ্রিম কোর্ট অবধি গিয়েছিলেন, অনেক ধর্মীয় বা রাজনৈতিক দলও যেকোনো কারণেই হোক, মাঝেমধ্যেই এখনও তাজমহলের এই বিতর্কিত দিক নিয়ে ধুয়ো তোলে।
আমি নিজে শাজাহানের রাজত্বকালে উপস্থিত ছিলাম না, কাজেই ওক ঠিক না ভুল, সেই তর্কে আমার কোনো বক্তব্য নেই, তাজমহল বিতর্কে উপসংহার টানার মতো ধৃষ্টতাও আমি করব না। আমি শুধুমাত্র এই বিতর্কের ওপর নির্ভর করে সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে একটি কল্পনাশ্রয়ী উপন্যাস লিখতে চেয়েছি। আবারও বলছি এটি কোনো ইতিহাস নয়, একটি নির্ভেজাল উপন্যাস। কোনো ঐতিহাসিক গবেষণায় সিদ্ধান্তগ্রহণ করতে এই উপন্যাস রচনা করা হয়নি। তাজমহল বিতর্ক এই উপন্যাসের একমাত্র বিষয়ও নয়, একটি অংশমাত্র।
আমার বার বার আগ্রা যাওয়ার ক্ষেত্রে এবং তথ্যসংগ্রহের কাজে অনেক মানুষ এই উপন্যাস রচনায় ভীষণভাবে সাহায্য করেছেন। তাঁদের সংখ্যা এতই বেশি যে আলাদা করে উল্লেখ করা অসম্ভব। তাঁদের প্রত্যেকের কাছে আমি বিশেষভাবে ঋণী।
যুগ যুগ ধরে চলে আসা একটি বিতর্ককে কেন্দ্র করে কল্পনার তুলিতে সাহিত্য রচনাই এই উপন্যাসের উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য কতটা সফল, তাতে সিলমোহর দেবেন আপনারই। ভালো-মন্দ যা-ই লাগুক, প্রতিক্রিয়া জানালে ভালো লাগবে।
দেবারতি মুখোপাধ্যায়
.
প্রাক্কথন
২৫ ডিসেম্বর, ২০১৭
প্রৌঢ় থরথর করে কাঁপছিলেন।
বড়োদিনের ঠান্ডায় বা কোনো অসুস্থতায় নয়, আতঙ্কে।
আলো ঝলমলে ক্রিসমাসের রাত। সবে বারোটার কাঁটা ছুঁয়েছে ঘড়ি। শতাব্দীপ্রাচীন উত্তরপ্রদেশের প্রাচীন নগরী আগ্রার অলিতেগলিতে সুন্দর আলোকসজ্জায় স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে চারদিক। ইতিহাসের লোদী রাজত্ব থেকে শুরু করে দোর্দণ্ডপ্রতাপ মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস, তাঁদের বিভিন্ন কীর্তি ইতস্তত চারদিকে ছড়ানো থাকলেও এই শহর আয়তনে বেশ ছোটো, আর্মি ক্যান্টনমেন্ট থাকার সুবাদে উত্তর ভারতের অন্যান্য ঘিঞ্জি শহরগুলোর তুলনায় বেশ পরিচ্ছন্নও বটে। যমুনা নদী একছড়া মুক্তোর মালার মতো এঁকেবেঁকে গোটা নগরীকে যেন সাপের মতো বেঁধে রেখেছে।
.
শোনা যায়, এককালে এই যমুনা নদীর দুই তীরে মুঘল দরবারের আমির-ওমরাহের প্রাসাদোপম বাড়ি, অট্টালিকা মুকুটের রত্নের মতো অবস্থান করত। আর সেই সমস্ত মনোরম স্থাপত্যের মাঝে রাজরানি হয়ে জ্বলজ্বল করত পঞ্চম মুঘল সম্রাট শাজাহানের অমর কীর্তি- তাঁর পরলোকগতা স্ত্রী মুমতাজ বেগমের উদ্দেশে বানানো তাজমহল। আসলত খান, হসদার খান, মহব্বত খান, আজম খানদের মতো উচ্চপদস্থ মন্ত্রী-অমাত্যের প্রাসাদোপম হাভেলিগুলো তাজমহলের দু-পাশে, যমুনা নদীর দুই তীরে থাকায় আগ্রার সৌন্দর্য হাজারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল, প্রচুর বিদেশি শিল্পীদের আঁকায় আজও উজ্জ্বল আছে সেই গৌরবময় স্মৃতি।
কালের নিয়মে সবই বদলায়। আগ্রা শহরও এখন তার কৌলীন্যের খোলস ছেড়ে জনসাধারণের জীবনযাত্রার সঙ্গে নিজেকে অভিযোজিত করে নিয়েছে। যে পথে একসময় দুলকিচালে হেঁটে যেত বাদশাহের হাতি, এখন সেখানে ছোটে অফিসটাইমের ব্যস্ত ভিড়ে ঠাসা বাস। বাদশাহজাদার বিশেষ পছন্দের কোনো নর্তকীর ঘুঙুরের মূর্ছনায় যে বাড়ির প্রতিটা ইট নৃত্যের তালে তালে যোগ্য সঙ্গত করত, এখন সেখানে হয়তো দাঁড়িয়ে আছে সুউচ্চ কোনো শপিং মল।
কমলানগর এই শহরের বেশ অভিজাত জায়গা। তাজমহল থেকে কিছুটা পশ্চিমদিকে যমুনা নদীর পাড়েই প্রায় আয়তাকার এই অঞ্চলে বেশ উচ্চবিত্ত, শিক্ষিত মানুষজনই থাকেন। বড়ো বড়ো একেকটি সুদৃশ্য বাড়ি, মাঝখান দিয়ে চওড়া রাস্তা, কিছুটা জায়গা অন্তর বাচ্চাদের খেলার পার্ক এই কমলানগরের জমির দাম প্রায় আকাশছোঁয়া করে তুলেছে।
আজ বড়োদিনের রীতি মেনেই সুন্দর করে সাজানো রাস্তায় সবাই পরিবারের সঙ্গে বেরিয়েছে। কেউ নদীর পাড় বরাবর হাঁটছে, কেউ আবার হেঁটে চলেছে দূরের খ্রিস্টান কলোনির গির্জার দিকে।
কোনো বাড়ি থেকে ভেসে আসছে গরম কেকের সুগন্ধ।
কিন্তু কমলানগরের একদম শেষে যে রাজস্থানী কাইলা দেবীর মন্দির রয়েছে, তার ঠিক পাশের সবুজ দোতলার বাড়িটার একদম কোণের ঘুপচি ঘরটাতে বসে সেই প্রৌঢ়র আতঙ্ক বেড়েই চলেছিল। নিজেকে শান্ত রাখতে দামি কুর্তার হাতা দিয়ে এই ঠান্ডাতেও তিনি কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছলেন।
দোতলা এই বাড়িটা বেশ সুন্দর, কমলানগরে বাকি বাড়িগুলোর মতোই সামনে গাড়িবারান্দা, গেট পেরিয়েই একপাশে সুন্দর একফালি বাগান।
কিন্তু কোনো কিছুই যেন ঠিক আর আস্ত নেই। এক ঝলক তাকালেই বোঝা যায়, গোটা বাড়িটার ওপর দিয়ে যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে। গাড়ির সামনের কাচ ভেঙে কাচ ছড়ানো রয়েছে এদিক-ওদিক। ফুলের গাছগুলোর কাণ্ড ধরে কেউ বা কারা নির্দয়ভাবে টেনেছে, গাছের পাতাসুদ্ধু ডাঁটিগুলো গড়াগড়ি খাচ্ছে সামনের লনে। গেটটা ঈষৎ খোলা। তার ওপরের অংশে লেগে থাকা ছেঁড়া একটা জামার টুকরো হাওয়ায় উড়ছে পতপত করে।
প্রৌঢ় যে ছোট্ট খুপরির মতো ঘরটায় বসে কাঁপছিলেন, তার পেছনেই দোতলায় ওঠার সিঁড়ি, তাতে আলো জ্বলছে টিমটিম করে। সেখান দিয়ে দ্রুতগতিতে শোনা যাচ্ছে কিছু পায়ের আওয়াজ।
যারা বীরবিক্রমে ওপরে উঠছে তারা একতলাটা প্রায় শ্মশান বানিয়ে দিয়েছে এর মধ্যে। একতলার পুরোটাই তাঁর লাইব্রেরি, গবেষণার জায়গা। প্রৌঢ়ের গলার কাছটা কষ্টে দলা পাকিয়ে উঠছিল, কোনো বই-ই বোধ হয় আর আস্ত নেই এই নরাধমদের আক্রমণে।
এই বিপদের মধ্যেও তাঁর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।
প্রৌঢ়র এই ঘরটা অনেকটা পুরোনো দিনের জমিদারবাড়ির চোরাকুঠুরির মতো, দোতলার একটা ঘরের বিশাল এক আলমারির পেছন দিয়ে কপিকল টেনে ঢুকতে হয়। কেউ আগে থেকে না জানলে এই ঘরের হদিশ পাওয়া বেশ কঠিন। অনেক ভেবেচিন্তেই এই ঘরটা তিনি বানিয়েছিলেন। গোটা খুপরিটাতেই পুরোনো বইয়ের গন্ধ, ছোটো ছোটো দেরাজে রয়েছে দুর্মূল্য বই, অমূল্য পুথি।
দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠেই ওরা আবার বাধা পেল। সামনে আরও একটা দরজা, সেটা ভেতর থেকে বন্ধ। দোতলার মাটিতে পা দিতে গেলে এই দরজা খুলতেই হবে।
প্রৌঢ় শুনতে পেলেন, মুহুর্মুহু কর্কশ ধাক্কা পড়ছে সেই দরজায়, সঙ্গে চাপা গলায় শাসানি, ‘দরজা না খুললে কিন্তু ভেঙে ঢুকব। আমরা ঠিক এক থেকে পাঁচ গুনব, তার মধ্যে যদি না খুলিস…!’
প্রৌঢ় শুনতে পাচ্ছেন সব, ভয়ে তাঁর স্নায়ুর দৌরাত্ম্য এতই বেড়ে গেছে যে মনে হচ্ছে বুকে হাতুড়ি পেটার মতো হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনিও ওরা শুনতে পাবে। কাঁপতে কাঁপতে তিনি শুনতে পেলেন, ‘এক… দুই!’
রোগা মানুষটা কোনোমতে হাতের মুঠোয় ধরা জিনিসটা শক্ত করে ধরলেন, ঘামে ইতিমধ্যেই জবজবে হয়ে উঠেছে সেটা। অন্য হাতে পুরোনো আদ্যিকালের ঢাউস মোবাইলে কয়েকটা নম্বর হাতড়ে হাতড়ে টিপে কানে দিলেন।
রিং হচ্ছে, তার সঙ্গেই তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন দেওয়ালের ওপাশের হুংকার, ‘তিন… চার!’
ওপাশে কেউ ফোন রিসিভ করতেই প্রৌঢ় ঢোঁক গিলে ফিসফিস করে বলতে লাগলেন, ‘ওরা আ-আবার এসেছে। লাঠিসোঁটা নিয়ে। একতলায় পাগলের মতো খুঁজেছে, পায়নি। এইবার ওপরে আসছে।’
ওপাশ থেকে কে কী বলছে, প্রৌঢ় কিচ্ছু শুনতে পেলেন না। বললেন, ‘চিন্তা নেই, আমাকে মেরে ফেললেও জিনিসটা ওরা পাবে না। এমন বুঁদ হয়েছিলাম যে কখন যে ওরা ঢুকে পড়েছে বুঝতে পারিনি। একটা ব্যাপার আসলে কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না। রাজার দশ রানি, কিন্তু ন-টা ঘর। কিন্তু ন-টা ঘরের মধ্যেই দশ রানিকে থাকতে হবে। এটার মানে কী? চান্দেলা রাজাদের এমন দৈন্যদশা কবে হল!’ প্রৌঢ় কাতরস্বরে বলতে লাগলেন, ‘যাইহোক তুমি কাউকে পাঠাও, বাড়ির কাছে এসে ফোন করতে বলবে, আমি আসতে বললে তখন যেন আসে।’
ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ শোনার আগেই প্রৌঢ়ের মনে হল, তাঁর কানে যেন তালা লেগে গেল।
হিংস্রভাবে ‘পাঁচ’ উচ্চারণের পরেই ক্রমাগত আঘাতে মড়মড় শব্দে ভেঙে পড়ল দোতলার সিঁড়ির মুখের দরজাটা। ধুপধাপ শব্দে কারা ওপরে উঠে আসতে লাগল।
Leave a Reply