ফিরে এসো চাকা – বিনয় মজুমদার
.
৮ মার্চ ১৯৬০
একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে
দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে
পুনরায় ডুবে গেলো– এই স্মিত দৃশ্য দেখে নিয়ে
বেদনার গাঢ় রসে অপক্ক রক্তিম হ’লো ফল
বিপন্ন মরাল ওড়ে, অবিরাম পলায়ন করে,
যেহেতু সকলে জানে তার শাদা পালকের নিচে
রয়েছে উদগ্র উষ্ণ মাংস আর মেদ;
স্বল্পায়ু বিশ্রাম নেয় পরিশ্রান্ত পাহাড়ে-পাহাড়ে;
সমস্ত জলীয় গান বাষ্পীভূত হয়ে যায়, তবু
এমন সময়ে তুমি, হে সমুদ্রমৎস্য, তুমি… তুমি…
কিংবা, দ্যাখো, ইতস্তত অসুস্থ বৃক্ষেরা
পৃথিবীর পল-বিত ব্যাপ্ত বনস্থলী
দীর্ঘ-দীর্ঘ ক্লান্তশ্বাসে আলোড়িত করে;
তবু সব বৃক্ষ আর পুষ্পকুঞ্জ যে যার ভূমিতে দূরে-দূরে
চিরকাল থেকে ভাবে মিলনের শ্বাসরোধী কথা।
২৬ অগাস্ট ১৯৬০
মুকুরে প্রতিফলিত সূর্যালোক স্বল্পকাল হাসে ।
শিক্ষায়তনের কাছে হে নিশ্চল, স্নিগ্ধ দেবদারু
জিহ্বার উপরে দ্রব লবণের মতো কণা কণা
কী ছড়ায়, কে ছড়ায়; শোনো, কী অস্ফুট স্বর, শোনো-
‘কোথায়, কোথায় তুমি, কোথায় তোমার ডানা, শ্বেত পক্ষীমাতা,
এই যে এখানে জন্ম, একি সেই জনশ্রুত নীড় না মৃত্তিকা?
নীড় না মৃত্তিকা পূর্ণ এ-অস্বচ্ছ মৃত্যুময় হিমে…’
তুমি বৃক্ষ, জ্ঞানহীন, মরণের ক্লিষ্ট সমাচার
জানো না, এখন তবে স্বর শোনো, অবহিত হও ।
সুস্থ মৃত্তিকার চেয়ে সমুদ্রেরা কতো বেশি বিপদসঙ্কুল
তারো বেশি বিপদের নীলিমায় প্রক্ষালিত বিভিন্ন আকাশ,
এ-সত্য জেনেও তবু আমরা তো সাগরে আকাশে
সঞ্চারিত হ’তে চাই, চিরকাল হ’তে অভিলাষী,
সকল প্রকার জ্বরে মাথা ধোয়া আমাদের ভালো লাগে ব’লে ।
তবুও কেন যে আজো, হায় হাসি, হায় দেবদারু ।
মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়!
২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৬০
শিশুকালে শুনেছি যে কতিপয় পতঙ্গশিকারী ফুল আছে।
অথচ তাদের আমি এত অনুসন্ধানেও এখনো দেখিনি।
তাঁবুর ভিতরে শুয়ে অন্ধকার আকাশের বিস্তার দেখেছি,
জেনেছি নিকটবর্তী এবং উজ্জ্বলতম তারাগুলি প্রকৃত প্রস্তাবে
সব গ্রহ, তারা নয়, তাপহীন আলোহীন গ্রহ।
আমিও হতাশবোধে, অবক্ষয়ে, ক্ষোভে ক্লান্ত হয়ে
মাটিতে শুয়েছি একা-কীটদষ্ট নষ্ট খোশা, শাঁস।
হে ধিক্কার, আত্মঘৃণা, দ্যাখো, কী মলিনবর্ণ ফল।
কিছুকাল আগে প্রাণে, ধাতুখন্ডে সুনির্মল জ্যোৎস্না পড়েছিলো।
আলোকসম্পাতহেতু বিদ্যুৎসঞ্চার হয়, বিশেষ ধাতুতে হ’য়ে থাকে।
অথচ পায়রা ছাড়া অন্য কোনো ওড়ার ক্ষমতাবতী পাখি
বর্তমান যুগে আর মানুষের নিকটে আসে না।
সপ্রতিভভাবে এসে দানা খেয়ে ফের উড়ে যায়,
তবুও সফল জ্যোৎস্না চিরকাল মানুষের প্রেরণাস্বরূপ ।
বিশেষ অবস্থামতো বিভিন্ন বায়ুর মধ্য দিয়ে
আমরা সতত চলি; বিষাক্ত, সুগন্ধি কিংবা হিম
বায়ু তবু শুধুমাত্র আবহমণ্ডল হ’য়ে থাকে।
জীবনধারণ করা সমীরবিলাসী হওয়া নয়।
অতএব, হে ধিক্কার, বৈদ্যুতিক আক্ষেপ ভোলো তো,
অতি অল্প পুস্তকেই ক্রোড়পত্র দেওয়া হ’য়ে থাকে।
১১ অক্টোবর ১৯৬০
আকাশআশ্রয়ী জল বিস্তৃত মুক্তির স্বাদ পায়, পেয়েছিলো।
এখন তা মৃত্তিকায়, ঘাসের জীবনে, আহা, কেমন নীরব।
মহৎ উল্লাস, উগ্র উত্তেজনা এইভাবে শেষ হতে পারে?
ইপ্সিত গৃহের দ্বারে পৌঁছোনোর আগেই যে ডিম ভেঙে যায়-
এই সিক্ত বেদনায় দূরে চ’লে গেলে তুমি, পলাতকা হত,
বেদনার দানা নিয়ে একা-একা খেলা করো, সুকুমার খেলা।
ঘন অরণ্যের মধ্যে সুর্যের আলোর তীব্র অনটন বুঝে
তরুণ সেগুন গাছ ঋজু আর শাখাহীন, অতি দীর্ঘ হয়;
এত দীর্ঘ যাতে তার উচ্চ শীর্ষে উপবিষ্ট নিরাপদ কোনো
বিকল পাখির চিন্তা, অনুচ্চ গানের সুর মাটিতে আসে না।
১২ অক্টোবর ১৯৬০
স্রোতপৃষ্ঠে চূর্ণ-চূর্ণ লোহিত সূর্যাস্ত ভেসে আছে;
নিশ্চল, যদিও নিম্নে সংলগ্ন অস্থির স্রোত বয়।
এখন আহত মাছ কোথায় যে চ’লে গেছে দূরে,
তুমিও হতাশ হয়ে রয়েছো পিছন ফিরে, পাখি।
এখনো রয়েছে ওই বর্ণময়, সুস্থ পুষ্পোদ্যান;
তবুও বিশিষ্ট শোকে পার্শ্ববর্তী উদাত্ত সেগুন।
নিহত, অপসারিত, আর নেই শ্যামল নিস্বন।
কেন ব্যথা পাও বলো, পৃথিবীর বিয়োগেবিয়োগে?
বৃক্ষ ও প্রাণীরা মিলে বায়ুমণ্ডলকে সুস্থ, স্বাস্থ্যকর রাখে।
এই সত্য জানি, তবু হে সমুদ্র, এ-অরণ্যেকান পেতে শোনো-
ঝিঁঝিঁ পোকাদের রব—যদিও এখানে মন সকল সময়
এ-বিষয়ে সচেতন থাকে না, তবুও এই কান্না চিরদিন
এইভাবে র’য়ে যায়, তরুমর্মরের মধ্যে অথবা আড়ালে।
১৪ অক্টোবর
কাগজকলম নিয়ে চুপচাপ ব’সে থাকা প্রয়োজন আজ;
প্রতিটি ব্যর্থতা, ক্লান্তি কী অস্পষ্ট আত্মচিন্তা সঙ্গে নিয়ে আসে।
সতত বিশ্বাস হয়, প্রায় সব আয়োজনই হয়ে গেছে, তবু
কেবল নির্ভুলভাবে সম্পর্কস্থাপন করা যায় না এখনো।
সকল ফুলের কাছে এতো মোহময় মনে যাবার পরেও
মানুষেরা কিন্তু মাংসরন্ধনকালীন ঘ্রাণ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।
বর্ণাবলেপনগুলি কাছে গেলে অর্থহীন, অতি স্থূল ব’লে মনে হয়।
অথচ আলেখ্যশ্রেণী কিছুটা দূরত্ব হেতু মনোলোভা হয়ে ফুটে ওঠে।
হে আলেখ্য, অপচয় চিরকাল পৃথিবীতে আছে;
এই যে অমেয় জল – মেঘে মেঘে তনুভূত জল –
এর কতোটুকু আর ফসলের দেহে আসে বলো?
ফসলের ঋতুতেও অধিকাংশ শুষে নেয় মাটি।
তবু কী আশ্চর্য, দ্যাখো, উপবিষ্ট মশা উড়ে গেলে
তার এই উড়ে যাওয়া ঈষৎ সংগীতময় হয়।
১৫ অক্টোবর ১৯৬০
বিনিদ্র রাত্রির পরে মাথায় জড়তা আসে, চোখ জ্ব’লে যায়,
হাতবোমা ভ’রে থাকে কী ভীষণ অতিক্রান্ত চাপে।
এ-রকম অবস্থায় হৃদয়ে কিসের আশা নিয়ে
কবিতার বই, খাতা চারিপাশে খুলে ব’সে আছি?
সকল সমুদ্র আর উদ্ভিদজগৎ আর মরুভূমি দিয়ে
প্রবাহিত হওয়া ভিন্ন বাতাসের অন্য কোনো গতিবিধি নেই ।
ফলে বহুকাল ধ’রে অভিজ্ঞ হবার পরে পাখিরা জেনেছে
নীড় নির্মাণের জন্য উপযুক্ত উপাদান ঘাস আর খড়।
প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাগুলি ক্রমে জ্ঞান হয়ে ওঠে।
এ-সকল সংখ্যাতীত উদ্ভিদ বা তৃণ, গুল্ম ইত্যাদির মূল
অন্তরালে মিশে গিয়ে অত্যন্ত জটিলভাবে থাকা স্বাভাবিক।
কোনো পরিচিত নাম বলার সময় হলে মাঝে মাঝে দেখি
মনে নেই, ভুলে গেছি; হে কবিতারাশি, ভাবি ঈষৎ আয়াসে
ঠিক মনে এসে যাবে, অথচ…অথচ…হায়, সে এক বিস্মিত,
অসহ্য সন্ধান, তাই কেউ যদি সে-সময়ে ব’লে দেয় তবে
তপ্ত লৌহদণ্ড জলে প্রবিষ্ট হবার শান্তি আচম্বিতে নামে।
১৩ জুন ১৯৬১
কেন যেন স’রে যাও, রৌদ্র থেকে তাপ থেকে দূরে ।
ভেঙে যেতে ভয় পাও ; জাগতিক সফলতা নয়,
শয়নভঙ্গির মতো অনাড়ষ্ট স্বকীয় বিকাশ
সকল মানুষ চায়- এই সাধনায় লিপ্ত হ’তে
অভ্যন্তরে ঘ্রাণ নাও, অযুত শতাব্দীব্যাপী চেয়ে
মস্তিষ্কে সামান্যতম সাধ নিয়ে ক্লিষ্ট প্রজাপতি
পাখাময় রেখাচিত্র যে-নিয়মে ফুটিয়ে তুলেছে
সে-নিয়ম মনে রাখো ; ঢেউয়ের মতন খুঁজে ফেরো ।
অথবা বিম্বের মতো ডুবে থাকো সম্মুখীন মদে ।
এমনকি নিজে-নিজে খুলে যাও ঝিনুকের মতো,
ব্যর্থ হও, তবু বালি, ভিতরে প্রবিষ্ট বালিটুকু
ক্রমে-ক্রমে মুক্তা হ’য়ে গতির সার্থক কীর্তি হবে।
শয়নভঙ্গির মতো স্বাভাবিক, সহজ জীবন
পেতে হ’লে ঘ্রাণ নাও, হৃদয়ের অন্তর্গত ঘ্রাণ ।
১৬ জুন ১৯৬১
মাংসল চিত্রের কাছে এসে সব ভোলা গিয়েছিলো ।
মদিরার মতো তুমি অজস্র যুদ্ধের ক্ষত ধুয়ে
স্নিগ্ধ ক’রে দিয়েছিলে । প্রত্যাশার শেষে ছিপ রেখে
জাল ফেলে দেখার মতন এই উদ্যম এসেছে ।
বিদেশী চিত্রের মতো আগত, অপরিচিত হ’লে,
কিংবা নক্ষত্রের মতো অতিপরিচিত হ’লে তবে
আলাপে আগ্রহ আসে ; অথচ পত্রের মতো ভুলে
অন্য এক দুয়ারের কাছে উপনীত হ’য়ে যাই ।
ডানা না-নেড়েই ঊর্ধ্বে যে-চিল সন্ধান ক’রে ফেরে
তার মতো ক্লান্তি আসে ; কোনো যুগে কোনো আততায়ী
শক্ত ছিলো ব’লে আজো কাঁটায় পরিবেষ্টিত হ’য়ে
গোলাপ যেমন থাকে, তেমনি রয়েছো তুমি ; আমি
পত্রের মতন তুলে অন্য এক দুয়ারের কাছে।
২৬ জুন ১৯৬১
বলেছি, এভাবে নয়, দৃশ্যের নিকটে এনে দিয়ে
সকলে বিদায় নাও; পিপাসার্ত তুলি আছে হাতে,
চিত্ৰণ সফল হ’লে শুনে নিও যুগল ঘোষণা।
অথবা কেবল তুমি লিপ্ত হ’লে সমাধান হয়।
মেলার মতন ভিড়ে তবে তুমি—আমরা এখনো
ক্রমাগত বাধা পাই প্রাত্যহিক হৃদয়যাপনে ।
সৃষ্টির পূর্বাহ্নে, দ্যাখো, নিজেকেই সৃষ্টি করা প্রয়োজন হয়।
পরিচিত সূর্য আরো বেশি আকর্ষণশীল হ’লে
হয়তো সমুদ্রবক্ষে এমন জোয়ার এসে যেতো
যাতে সব বালিয়াড়ি, প্রবালপ্রাচীর পার হ’য়ে
জলরাশি হৃদয়ের কাছে এসে উপস্থিত হ’তো ।
অর্থাৎ কেবল তুমি লিপ্ত হ’লে সমাধান হয়।
২৬ জুন ১৯৬১
নাকি স্পষ্ট অবহেলা, কোরকে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে, আজো
যে-আকাশ দেখা যায় তারো দূরে ওপারে আকাশে
চ’লে গেলে ; কাল আছে, শারীরিক বৃদ্ধি, ক্ষয় আছে
দেখেছি গাংচিলগুলি জাহাজের সঙ্গে-সঙ্গে চলে,
অথবা ফড়িঙ সেও নৌকার উপরে ভেসে থাকে
ডানা না-নেড়েই, এতো স্বাভাবিক, সহজ, স্বাধীন
গ্রীষ্মের বিকেলবেলা অকস্মাৎ শীতল বাতাস
যেমন ঝড়ের ডাক, বৃষ্টির প্রস্তাব এনে দেয়,
আয়াসহীনভাবে যেমন নিশ্বাস নিতে হয়
অলক্ষ্যে ঘুমেরো মধ্যে, সে-প্রকার প্রয়োজন আছে,
তোমারো রয়েছে, তাই সমুদ্রমৎস্যের মতো নানা
বাতাসের ভার বও, সে-কথা বোঝে না, প্রিয়তমা ?
২৭ জুন ১৯৬১
সময়ের সঙ্গে এক বাজি ধ’রে পরাস্ত হয়েছি।
ব্যর্থ আকাঙ্খায়, স্বপ্নে বৃষ্টি হ’য়ে মাটিতে যেখানে
একদিন জল জমে, আকাশ বিম্বিত হ’য়ে আসে।
সেখানে সত্বর দেখি, মশা জন্মে ; অমল প্রত্যূষে
ঘুম ভেঙে দেখা যায়, আমাদের মুখের ভিতরে
স্বাদ ছিলো, তৃপ্তি ছিলো যে-সব আহার্য তারা প’চে
ইতিহাস সৃষ্টি করে ; সুখ ক্রমে ব্যথা হ’য়ে ওঠে।
অঙ্গুরীয়লগ্ন নীল পাথরের বিচ্ছুরিত আলো।
অনুষ্ণ ও অনির্বাণ,জ’লে যায় পিপাসার বেগে ।
ভয় হয়, একদিন পালকের মতো ঝ’রে যাবো ।
২৭ জুন ১৯৬১
আমাদের অভিজ্ঞতা সিক্ত গিরিখাতের মতন
সংকীর্ণ, সীমিত ; এই কদিন যা কুয়াশায়,
মেঘে সব ঢেকে আছে—উপত্যকা, অরণ্য, পাহাড় ।
পৃথিবীতে বহুবিধ আহার্য রয়েছে, তবু বলো,
বিড়ালের ব্যর্থতর জিহ্বা তার কতো স্বাদ পায়?
অথচ তীক্ষ্নতা আছে, অভিজ্ঞতাগুলি সূচিমুখ,
ফুলের কাঁটার মতো কিংবা অতি দূর নক্ষত্রের
পরিধির মতো তীক্ষ্ণ, নাগালের অনেক বাহিরে ।
যা-ই হোক, তা সত্ত্বেও বিশালা আকাশময় বায়ু,
বিশাল বাহাস বয়, বিরুদ্ধ বাতাসে বেধে যায় ।
সর্বদা কোনো না কোনো স্থানে, দেশে ঝড় হ’তে থাকে ।
এ-সকল অনিশ্চিত অস্থিরতা, দ্বন্দ্ব ভেদ ক’রে
তবুও পাইন গাছ, ঋজু হ’য়ে ক্রমে বেড়ে ওঠে,
প্রকৃত লিপ্সার মতো, আকাশের বিদ্যুতের দিকে ।
১ জুলাই ১৯৬১
কী উৎফুল্ল আশা নিয়ে সকালে জেগেছি সবিনয়ে।
কৌটোর মাংসের মতো সুরক্ষিত তোমার প্রতিভা
উদ্ভাসিত করেছিলো ভবিষ্যৎ, দিকচক্রবাল ।
সভয়ে ভেবেছিলাম সম্মিলিত চায়ের ভাবনা,
বায়ুসেবনের কথা, চিরন্তন শিখরের বায়ু ।
দৃষ্টিবিভ্রমের মতো কাল্পনিক ব’লে মনে হয়
তোমাকে অস্তিত্বহীনা, অথবা হয়তো লুপ্ত, মৃত ।
অথবা করেছো ত্যাগ, অবৈধ পুত্রের মতো, পথে ।
জীবনের কথা ভাবি, ক্ষত সেরে গেলে পরে ত্বকে
পুনরায় কেশোদ্গম হবে না ; বিমর্ষ ভাবনায়
রাত্রির মাছির মতো শান্ত হ’য়ে রয়েছে বেদনা-
হাসপাতালের থেকে ফেরার সময়কার মনে ।
মাঝে-মাঝে অগোচরে বালকের ঘুমের ভিতরে
প্রস্রাব করার মতো অস্থানে বেদনা ঝ’রে যাবে।
২ জুলাই ১৯৬১
গুনে-গুনে ছেড়ে দিই, নিজেও সুস্থির পায়ে নামি,
জাহাজডুবির পরে ; শীতল আঁধারে মিশে থাকি।
বরং ছিলাম দীর্ঘ-দীর্ঘকাল, হাসি ভুলে হেসে,
করুণ ফলের মতো ; কেউ চায় আত্মবলিদান।
ভ্রূণের বিকট দৃশ্যে ব্যথা পেয়ে—এমনই পৃথিবী—
গবেষক হ’য়ে ফের কারণ নির্ণয়, ক্ষয়-ক্ষতি
দেয়ালি রাত্রির নষ্ট কীটের মতন জ’মে গেছে।
ফুল নয়, চাঁদ নয়, মহিলার দেহস্থিত মন
অতি অল্পকালে যদি বিকশিত হয় তবে হয়,
না-হ’লে কাঁটার মতো বিধে ফের কিছু ভেঙে থাকে।
অবশ্য তোমার কাছে যাবার সময়ে আলো লেগে
নীলাভ হয়েছে দেখি অনেক আকাশ ; দীর্ঘকাল
শীতল আঁধারে থেকে গবেষণা শেষ হ’য়ে আসে।
১৪ জুলাই ১৯৬১
পর্দার আড়ালে থেকে কেন বৃথা তর্ক ক’রে গেলে—
আমি ভগ্ন বৃদ্ধ নই, বিড়ম্বিত সম্পৃক্ত তরুণ।
এই যে ছেড়েছি দেশ, সব দৃশ্য, পাহাড়, সাগর—
এতে কি বিশ্বাস হবে ; কোনোদিন মদ্যপান ক’রে
মাতালের আর্ত নেশা হয়তো হৃদয়ঙ্গম হবে—
লুপ্ত সভ্যতার কথা স্বীকারের মতো সার্থকতা।
বিকলাঙ্গ সন্তানের মতো স্নেহে বিনষ্ট অতীত
বুকের নিভৃতে নিয়ে ভাবি একা, ভাবি গ্রীষ্মকালে
শুষ্কপ্রায় জলাশয়ে সন্ত্রস্ত ভেকের মতো মনে।
বেশ, তবে চ’লে যাও, তবে যদি কোনোদিন কোনো
লৌকিক সাহায্যে লাগি, ডেকে নিও ; যাকে ভালোবাসে
সেই পুষ্পকুঞ্জটিকে যত্নভরে, তৃপ্ত সুখে রাখা
মানুষের প্রিয় কীর্তি ; কিসের ব্যাঘাতে মুঠো ক’রে
চন্দ্রালোক ধ’রে নিতে বারংবার ব্যর্থ হ’তে হয় ;
সেই কোন ভোরবেলা ইটের মতন চূর্ণ হ’য়ে
প’ড়ে আছি নানা স্থানে ; কদাচিৎ যথেষ্ট ক্ষমতা,
তুমি এসে ছিন্ন ছিন্ন চিঠির মতন তুলে নিয়ে
কৌতূহলে এক ক’রে একবার প’ড়ে চ’লে যাও,
যেন কোন নিরুদ্দেশে, ইটের মতন ফেলে রেখে।
১৫ জুলাই ১৯৬১
কী যে হবে, কী যে হয়, এখনো অনেক রীতি বাকি।
দুরারোহ, নভোলীন পর্বতশিখরে আরোহণ
ক’রে ফের অবিলম্বে নেমে আসি, নেমে যেতে হয়।
কাচের শার্শিতে ধৃত, সুদূরের আকর্ষণে স্মিত,
প্রজাপতিদের মতো ঘরে কিংবা নক্ষত্রে বা চাঁদে
গমনেচ্ছুদের মতো পৃথিবীতে প’ড়ে আছি শুধু
বাধা ও ব্যাঘাত পেয়ে ; আমাদের পরিণাম এই।
তবু ভালো, ইঁদুরের দংশনে আহত হ’য়ে তবু
ঘুম ভেঙে যাওয়া ভালো, সাপ ভেবে, উত্তেজিত হ’য়ে।
যদিও অগ্নির মতো জ্বললেই, প্রিয় অন্ধকার,
বহু দূরে স’রে গেছো ; অবশেষে দেখি, প্রেম নয়,
প’ড়ে আছে পৃথিবীর অবক্ষয়ী সহনশীলতা।
নিষ্পেষণে ক্রমে-ক্রমে অঙ্গারের মতন সংযমে
হীরকের জন্ম হয়, দ্যুতিময়, আত্মসমাহিত।
১৯ জুলাই ১৯৬১
বেশ কিছুকাল হ’লো চ’লে গেছো, প্লাবনের মতো
একবার এসে ফের ; চতুর্দিকে সরস পাতার
মাঝে থাকা শিরীষের বিশুষ্ক ফলের মতো আমি
জীবনযাপন করি; কদাচিৎ কখনো পুরোনো
দেয়ালে তাকালে বহু বিশৃঙ্খল রেখা থেকে কোনো
মানুষীর আকৃতির মতো তুমি দেখা দিয়েছিলে ।
পালিত পায়রাদের হাঁটা, ওড়া, কূজনের মতো
তোমাকে বেসেছি ভালো ; তুমি পুনরায় চ’লে গেছো।
১৯ জুলাই ১৯৬১
নেই কোনো দৃশ্য নেই, আকাশের সুদূরতা ছাড়া ।
সূর্যপরিক্রমারত জ্যোতিষ্কগুলির মধ্যে শুধু
ধূমকেতু প্রকৃতই অগ্নিময়ী ; তোমার প্রতিভা
স্বাভাবিকতায় নীল, নর্তকীর অঙ্গসঞ্চালন
ক্লান্তিকর নয় ব’লে নৃত্য হয় যেমন তেমনি।
সুমহান আকর্ষণে যেভাবে বৃষ্টির জল জ’মে
বিন্দু হয়, সেইভাবে আমিও একাগ্র হ’য়ে আছি।
তবু কোনো দৃশ্য নেই আকাশের সুদূরতা ছাড়া।
২০ জুলাই ১৯৬১
আর যদি না-ই আসো, ফুটন্ত জলের নভোচারী
বাষ্পের সহিত যদি বাতাসের মতো না-ই মেশো,
সেও এক অভিজ্ঞতা ; অগণন কুসুমের দেশে
নীল বা নীলাভবর্ণ গোলাপের অভাবের মতো
তোমার অভাব বুঝি ; কে জানে হয়তো অবশেষে
বিগলিত হ’তে পারো ; আশ্চর্য দর্শন বহু আছে-
নিজের চুলের মৃদু ঘ্রাণের মতন তোমাকেও
হয়তো পাই না আমি, পূর্ণিমার তিথিতেও দেখি
অস্ফুট লজ্জায় ম্লান ক্ষীণ চন্দ্রকলা উঠে থাকে,
গ্রহণ হবার ফলে, এরূপ দর্শন বহু আছে।
২০ জুলাই ১৯৬১
অভিজ্ঞতা থেকে ক্রমে আকাশের বর্ণহীনতার
সংবাদের মতো আমি জেনেছি তোমাকে ; বাতাসের
নীলাভতাহেতু দিনে আকাশকে নীল মনে হয়।
বালুময় বেলাভূমি চিত্রিত করার পরেকার
তরঙ্গের মতো লুপ্ত, অবলুপ্ত তুমি, মনোলীনা।
এতকাল মনে হ’তো, তুমিও এসেছো অভিসার
চাঁদের উপর দিয়ে স্বচ্ছ মেঘ ভেসে ভেসে গেলে
যেমন প্রতীতি হয়, মেঘ নয়, চাঁদ চলমান।
এখন জেনেছি সব, তবুও প্রয়াস প’ড়ে আছে।
শিশুদের আহার্যের মতন সরল হও তুমি,
সরল, তরল হও ; বিকাশের রীতিনীতি এই।
বৃক্ষের প্রত্যঙ্গ নড়ে-এই দৃশ্য দেখেই কখনো
সে নিজে দোলনক্ষম-এই কথা পাখিদের মতো
ভুল ক’রে ভেবেছো কি, তোমার বাতাসে সে তো দোলে।
২০ জুলাই ১৯৬১
নিকটে অমূল্য মণি, রত্ন নিয়ে চলার মতন
কী এক উৎকণ্ঠা যেন সর্বদা পীড়িত ক’রে রাখে।
শুনি, নানা ফুল আছে ; অথচ ক্ষতবিশিষ্ট কারো
সমুদ্রস্নানের মতো-লোনা জলে স্নানের মতন
ভীতি ছেয়ে আসে মনে ; এখন কোথায় তুমি ভাবি।
পৃথিবীর বুক থেকে সহসা বাতাস লোপ পেলে
সকল জীবন, ফুল, সব কীর্তি, খ্যাত কীর্তিগুলি
ধ্বংস হ’য়ে যেতে পারে—যে-সব চিত্রের পক্ষে কোনো
সামাজিক মেলামেশা অসম্ভব তাদের মতন
ত্যক্ত হ’য়ে যেতে পারো ; কিংবা বকুলের মতো শেষে
শুকিয়ে খয়েরি হ’য়ে, দীর্ঘস্থায়ী হ’য়ে মালিকার
কোনোদিন আসবে কি, নিষিদ্ধ সমুদ্রস্নান আজ ।
নিকটে অমূল্য মণি, রত্ন নিয়ে চলার মতন
কী এক উৎকণ্ঠা যেন সর্বদা পীড়িত ক’রে রাখে।
২০ জুলাই ১৯৬১
যেন প্রজাপতি ধরা—প্রত্যক্ষ হাতের অতর্কিত
আক্রমণ ক’রে ব্যর্থ ; পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের
অবকাশে ফুটে ওঠা পিপাসার্ত তারাদের মতো
অন্যান্য সকলে আছো ; অথচ আমি তো নিরুপায়।
ক্ষুধিত বাঘের পক্ষে শূন্যে দিক-পরিবর্তনের
মতন অসাধ্য কোনো প্রচেষ্টার সারবত্তা নেই ।
তোমাদেরই নীতি নেই ; সে এখনো আসতেও পারে।
কিছুটা সময় দিলে তবে দুধে সর ভেসে ওঠে।
২২ জুলাই ১৯৬১
সুগভীর মুকুরের প্রতি ভালোবাসার মতন
শান্ত দিনগুলি যায়, হায় সখী, নবজাতকের
শৈশবে হৃদয় দিয়ে পালন করায় অপারগ
শাশ্বত মাছের মতো বিস্মরণশীলা যেন তুমি ।
যদিও সংবাদ পাবে, পেয়েছো বেতারে প্রতিদিন,
জেনেছো অন্তরলোক, দূরে থেকে, তবু ভুলে যাবে।
গর্ভস্থ ভ্রূণের প্রতি গূঢ় ভালোবাসার মতন
প্রকাশের কোনোরূপ উপায়বিহীন যন্ত্রণায়
গীতিপরায়ণ আমি ; মানুষের মরণের আগে
পিপাসা পাওয়ার মতো অতিরিক্ত অথচ করুণ
আমার অপেক্ষা, আশা – আজ এ-রকম মনে হয়।
সুগভীর মুকুরের প্রতি ভালোবাসার মতন
শান্ত দিনগুলি যায় ; হায় সখী, বিস্মরণশীলা।
২৩ জুলাই ১৯৬১
বিদেশী ভাষায় কথা বলার মতন সাবধানে
তোমার প্রসঙ্গে আসি ; অতীতের কীর্তি বাধা দেয়।
হে আশ্চর্য দীপ্তিময়ী, কীটদষ্ট কবিকুল জানে,
যারা চিত্রকর নয়, তাদের শৌখিন শিল্পায়নে
আলেখ্যের মুখে চুল, ওষ্ঠ – সব কিছু আঁকা হয়
কিন্তু তবু সে-মুখের অধিকারিণীর স্নিগ্ধ রূপ
আলেখ্যে আসে না ; ফলে সাধনা ও ডুবুরি রয়েছে।
তোমার কী মনে হয়? এও কি অপরিণত ফল?
অথবা যৌগিক কথা যে-প্রাণীর রোম দৃঢ়মূল
পরিধেয় বস্ত্রাদিতে তার ত্বক ব্যবহৃত হবে?
২৩ জুলাই ১৯৬১
তিন পা পিছনে হেঁটে পদাহত হ’য়ে ফিরে আসি ।
আবার তোমার কথা মনে আসে ; ধূমকেতুর মতো
দীর্ঘকাল মনে রবে তোমাকে ; পূর্ণাঙ্গ জীবনের
জটিলতা, প্রতিঘাত বালকের মতন সাগ্রহে
ভালোবাসি ; হৃদয়ের গুরুভার জলে নিমজ্জিত
অবস্থায় লঘু ক’রে নেবার পিচ্ছিল সাধ ক’রে
পদাহত হ’য়ে ফিরি ; অজ্ঞাত পূর্ণাঙ্গ জীবনের
জটিলতা, প্রতিঘাত বালকের মতো ভালোবাসি।
২৭ জানুয়ারি ১৯৬২
মুক্ত ব’লে মনে হয় ; হে অদৃশ্য তারকা, দেখেছো
কারাগারে দীর্ঘকাল কী-ভাবে অতিবাহিত হ’লো ।
অথচ বাতাস ছিলো ; আবদ্ধ বৃক্ষের পাতাগুলি
ভাষাহীন শব্দে, ছন্দে এতকাল আন্দোলিত ছিলো।
অদৃশ্য তারকা, আজ মুক্ত ব’লে মনে হয় ; ভাবি,
বালিশে সুন্দর কিছু ফুল তোলা নিয়ে এত ক্লেশ।
ইতিমধ্যে কতিপয় অতি অল্প পরিচিত, নীল –
নীল নয়, মনে হয়, নীলাভ কচুরি ফুল মৃত।
অদর্শনে ম’রে গেছে ; অন্ধকার, ক্ষুব্ধ অন্ধকার।
জীবনে ব্যর্থতা থাকে ; অশ্রুপূর্ণ মেঘমালা থাকে ;
বেদনার্ত মোরগের নিদ্রাহীন জীবন ফুরালো ।
মশাগুলি কী নিঃসঙ্গ, তবুও বিষন্ন আশা নিয়ে
আর কোনো ফুল নয়, রৌদ্রতৃপ্ত সূর্যমুখী নয়,
তপ্ত সমাহিত মাংস, রক্তের সন্ধানে ঘুরে ফেরে।
১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২
অত্যন্ত নিপুণভাবে আমাকে আহত ক’রে রেখে
একটি মোটরকার পরিচ্ছন্নভাবে চ’লে গেলো।
থেমে ফিরে তাকালেই দেখে যেতো, অবাক আঘাতে
কী আশ্চর্য সূর্যোদয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে কুয়াশা,
কী বিস্মিত বেদনায় একা-একা কেঁদে ফেরে শিশু।
অজীর্ণ, তোমাকে নিয়ে আর কতো গান গাওয়া হবে?
এতকাল চ’লে গেলো, তবু মাঝে-মাঝে বাতায়ন
খুলে দেখি, মহাশূন্যে গোয়েন্দার মতো জোনাকিরা
জ্বলে নেভে, জ্বলে নেভে ; তৃষ্ণা নিয়ে এরূপ খেলায়
কতোকাল চ’লে গেলো ; মরণের মতো ক্লান্তি আসে।
এসো ক্লান্তি, এসো এসো, বহু পরীক্ষায় ব্যর্থ হাঁস
পুনরায় বলে, তার ওড়ার ক্ষমতাবলি নেই,
নির্মিত নীড়ের কথা মনে আনে, বিস্মিত স্মৃতিতে।
অজীর্ণ, তোমাকে নিয়ে আর কতো গান গেয়ে যাবো?
১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২
রক্তে-রক্তে মিশে আছে কৌতূহল, লিপ্ত কৌতূহল ;
বীজের ভিতরে আছে গুহার লালসাময় রস।
নতুন ঘরের আলো, পার্বত্য ফুলের চিত্রগুলি
মনকে নিয়েছে টেনে চারিদিকে, ছিন্নভিন্ন বেশে।
এ-ই স্বাভাবিক, এই বিনিদ্রতা লালনেপালনে
বৃদ্ধি পেয়ে প্রীতি হয়, হয়তো ঘাসের ফলকেও
শস্য ব’লে ধান ব’লে বোঝার আদিম উদ্ভাবনা
কখনো সম্ভব হয় ; অথচ নিষিদ্ধ মেলামেশা।
যদি যাই প্রথমেই মাংসল মালার আমন্ত্রণ,
মন নিয়ে কিছুকাল তাপ পেতে ব্যয় করেছি কি
শোনা যাবে, হীরকের মতো আমি কঠিন, নিস্ক্রিয় ।
ফলে সবই ব্যর্থ হয় ; কৌতূহল নিয়ে খেলা করি ।
কবেকার নিমজ্জিত জাহাজের প্রেমে ভুলে থাকি,
ভুলে থাকি বর্তমান রসোত্তীর্ণ মালা ও মদিরা।
২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২
আর অন্ধকার নয়, আর নয় অবাঞ্ছিত ছায়া ।
উন্মুক্ত স্বস্থানে স্থিত, বৃক্ষাবলি অধিক সংখ্যায়
ফুল, ফল পেয়ে থাকে, ফসলের উপচার পায় ।
এবার উন্মাদ হবো, অবশেষে উন্মত্ত নখরে
খুলে নেবো পলাতকা পরিটির ঠিকানা, দরজা ।
ইলোরার চিত্রাবলি, হরিণের মাংসের মতন
বিলম্বিত ব্যবহার পাবো আমি জিহ্বায়, জগতে
এরূপ বিরহী ভয় যথার্থই হয়েছে আমার ।
তবে তুমি গুহাচিত্র, নিঃসন্দেহে দীর্ঘায়ু, সফল ।
আর অন্ধকার নয়, আর নয় অবাঞ্ছিত ছায়া ।
২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২
প্রত্যাখ্যাত প্রেম আজ অসহ ধিক্কারে আত্মলীন ।
অগ্নি উদ্বমন ক’রে এ-গহ্বর ধীরে-ধীরে তার
চারিপাশে বর্তমান পর্বতের প্রাচীর তুলেছে ।
এত উচ্চে সমাসীন আজ তার আপন সততা,
যাতে সমতলবর্তী প্রজাপতি, পাখিদের রঙ
তার কাছে নিরর্থক ; এমন সমস্যাকীর্ণ আমি ।
দূরে যাও মেঘমালা, তোমাদের দৌত্যে, আলিঙ্গনে
আমি আর ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সাগরের ক্রোড়ে তো যাবো না ।
আমি যাবো দেশান্তরে যেখানে ফুলের মুক্তি আছে ।
বৃষ্টি, ঢেউ ত্যাগ ক’রে রসে পুষ্ট শিল্প পেতে পারি
বর্তমানে, চারিপাশে পর্বতের প্রাচীর আসীন ।
আমি আর ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সাগরের ক্রোড়ে তো যাবো না ।
২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২
কেন এই অবিশ্বাস, কেন আলোকিত অভিনয়?
কী আছে এমন বর্ণ, গন্ধময় ; জীবনের পথে,
গ্রন্থের ভিতরে আমি বহুকাল গবেষক হ’য়ে
লিপ্ত আছি, আমাদের অভিজ্ঞতা কীটের মতন ।
জানি, সমাধান নেই ; অথচ পালঙ্করাশি আছে,
রাজকুমারীরা আছে-সুনিপুণ প্রস্তরে নির্মিত
যারা বিবাহের পরে বারংবার জলে ভিজে-ভিজে
শৈবালে আবিষ্ট হ’য়ে সরল শ্যামল হতে পারে ।
এখন তাদের রূপ কী আশ্চর্য ধবল লোহিত ।
অকারণে খুঁজে ফেরা ; আমি জানি, নীল হাসি নেই ।
জঠরের ক্ষুধা-তৃষ্ণা, অট্টালিকা সচ্ছলতা আছে
সফল মালার জন্য ; হৃদয় পাহাড়ে ফেলে রাখো ।
২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২
রোমাঞ্চ কি র’য়ে গেছে ; গ্রামে অন্ধকারে ঘুম ভেঙে
দেহের উপর দিয়ে শীতল সাপের চলা বুঝে
যে-রোমাঞ্চ নেমে এলো, রুদ্ধশ্বাস স্বেদে ভিজে-ভিজে ।
সর্পিনী, বোঝোনি তুমি, দেহ কিনা, কার দেহ, প্রাণ ।
সহসা উদিত হয় সাগরহংসীর শুভ্র গান ।
স্বর-সুর এক-হ’য়ে কাঁপে বায়ু, যেন তুষ্ট শীতে,
কেঁদে ওঠে, জ্যোৎস্নার কোমল উত্তাপ পেতে চায় ।
রোমাঞ্চ তো র’য়ে গেছে শীতল সাপের স্পর্শে মিশে ।
১ মার্চ ১৯৬২
সবই অতিশয় শান্ত ; নির্বাক ডিমের ভাঙা খোশা,
শালপাতা, হাহাকার, বকুল বৃক্ষের দীর্ঘশ্বাস।
সব যেন কবেকার বনভোজনের পরিশেষে
কোনো নীল অনামিকা নদীর মতন দীর্ঘ হ’য়ে
চ’লে গেছে নিরুদ্দেশে ; দূর থেকে ভেসে-ভেসে আসে
কাঠ চেরাইয়ের শব্দ ; আমাদের দেহের ফসল,
খড় যেন ঝ’রে গেছে, অবশেষে স্বপ্নের ভিতরে ।
এত স্বাভাবিকভাবে সবই ব্যর্থ-ব্যর্থ, শান্ত, ধীর।
যে গেছে সে চ’লে গেছে ; দেশলাইয়ে বিস্ফোরণ হয়ে
বারুদ ফুরায় যেন ; অবশেষে কাঠটুকু জ্বলে
আপন অন্তরলোকে ; মাঝে-মাঝে সহসা সাক্ষাৎ
তারই অনুজার সঙ্গে ; বকুল বৃক্ষের দিকে চাই,
অত্যন্ত নিবিড়ভাবে চেয়ে দেখি, যে-শাখায় কলি
একবার এসেছিলো, সে-শাখায় ফুটবে কি দ্বিতীয় কুসুম?
১ মার্চ ১৯৬২
যদি পারো তবে আনো, আনো আরো জয়ের সম্ভার।
যদি মহীরুহ পেয়ে কাছে আসে কতিপয় লতা
তবে তো ক্ষমতা আছে, তার কাছে আত্মনিবেদনে
যেতে পারা সবিনয়ে ; হয়তো সে দ্রবীভূত হবে।
এখনো সন্দেহ আছে, নতুন পাতার শ্যামলতা
তার কাছ থেকে কোনো জ্যোৎস্না ভিক্ষা ক’রে পাবে কিনা।
সে কী ফল ভালোবাসে, কে জানে সবুজ কিংবা লাল,
কিছুই জানো না তুমি ; তবু দীর্ঘ আলোড়ন আছে,
অনাদি বেদনা আছে, অক্ষত চর্মের অন্তরালে
আহত মাংসের মতো গোপন বা গোপনীয় হ’য়ে।
৩ মার্চ ১৯৬২
ধূসর জীবনানন্দ, তোমার প্রথম বিস্ফোরণে
কতিপয় চিল শুধু বলেছিলো, ‘এই জন্মদিন’।
এবং গণনাতীত পারাবত মেঘের স্বরূপ
দর্শনে বিফল ব’লে, ভেবেছিলো, অক্ষমের গান।
সংশয়ে-সন্দেহে দুলে একই রূপ বিভিন্ন আলোকে
দেখে দেখে জিজ্ঞাসায় জীর্ণ হ’য়ে তুমি অবশেষে
একদিন সচেতন হরীতকী ফলের মতন
ঝ’রে গেলে অকস্মাৎ, রক্তাপ্লুত ট্রাম থেমে গেলো।
এখন সকলে বোঝে, মেঘমালা ভিতরে জটিল
পুঞ্জীভূত বাষ্পময়, তবুও দৃশ্যত শান্ত, শ্বেত,
বৃষ্টির নিমিত্ত ছিলো, এখনো রয়েছে, চিরকাল
র’য়ে যাবে ; সংগোপন লিপ্সাময়ী, কম্পিত প্রেমিকা-
তোমার কবিতা, কাব্য, সংশয়ে-সন্দেহে দুলে-দুলে
তুমি নিজে ঝ’রে গেছো, হরীতকী ফলের মতন।
৬ মার্চ ১৯৬২
আমিই তো চিকিৎসক, ভ্রান্তিপূর্ণ চিকিৎসায় তার
মৃত্যু হ’লে কী প্রকার ব্যাহত আড়ষ্ট হ’য়ে আছি।
আবর্তনকালে সেই শবের সহিত দেখা হয় ;
তখন হৃদয়ে এক চিরন্তন রৌদ্র জ্ব’লে ওঠে।
অথচ শবের সঙ্গে কথা বলা স্বাভাবিক কিনা
ভেবে-ভেবে দিন যায় ; চোখাচোখি হ’লে লজ্জা-ভয়ে
দ্রুত অন্য দিকে যাই ; কুক্কুপিন্ট ফুলের ভিতরে
জ্বরাক্রান্ত মানুষের মতো তাপ ; সেই ফুল খুঁজি।
১১ মার্চ ১৯৬২
স্বপ্নের আধার, তুমি ভেবে দ্যাখো, অধিকৃত দু-জন যমজ
যদিও হুবহু এক, তবু বহুকাল ধ’রে সান্নিধ্যে থাকায়
তাদের পৃথকভাবে চেনা যায়, মানুষেরা চেনায় সক্ষম।
এই আবিষ্কারবোধ পৃথিবীতে আছে ব’লে আজ এ-সময়ে
তোমার নিকটে আসি, সমাদর নেই তবু সবিস্ময়ে আসি।
পত্রবাহকে মতো কাষ্ঠময় দরজায় করাঘাত ক’রে।
তোমাকে ঘুমের থেকে অবিন্যস্ত অবস্থায় বাহিরে এনেছি।
আমরা যে জ্যোৎস্নাকে এত ভালোবাসি-এই গাঢ়ই রূপকথা
চাঁদ নিজে জানে না তো ; না জানুক শুভ্র ক্লেশ, তবু অসময়ে
তোমার নিকটে আসি, সমাদর নেই তবু আসি।
১২ মার্চ ১৯৬২
আরো কিছু দৃশ্যাবলি দেখেছি জীবিতকালে যারা
চিত্রায়িত হ’তে পারে ; ব্যথাতুর অসুবিধা এই,
কিছুই গোপন নেই ; মনে হয়, নির্বাক শিশুর
হাসি দেখে বুঝে নেয়, যার-যার অভিরুচি মতো।
ফলত নিষ্ক্রিয় থাকি, কুসুমের প্রদর্শনী দেখি।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে যাই ; বাতাসে বিধৌত দেহমন
কার জন্য সুরক্ষিত, হায় কাল, জলের মতন
পাত্রের আকার পাওয়া এ-বয়সে সম্ভব হবে কি?
১২ মার্চ ১৯৬২
মনের নিভৃত ভাগ লোভাতুর, সতত সুগ্রাহী।
চেয়ে দেখি, শুধু শূন্য, বিভিন্ন উষ্ণতা নিয়ে এসে
ঊর্ধ্বাকাশে ভিন্ন-ভিন্ন বায়ু মিলে তরঙ্গআকারে
মেঘের সূচনা করে, ভেবে এত লোভ, ভালোবেসে।
সুদূর সমুদ্রবায়ু, কোথায় উষ্ণতা নিয়ে যাও?
আমি যেই কেঁদে উঠি অনির্বাণ আঘাতে আহত
তখনি সকলে ভাবে, শিশুদের মতোই আমার
ক্ষুধার উদ্রেক হ’লো, বেদনার কথা বোঝে না তো।
১৫ মার্চ ১৯৬২
সুরায় উন্মত্ত হ’য়ে পদাঘাতে পুষ্পধারটিকে
বিচূর্ণ করেছি ; কোনো পরিতাপ রাখিনি হৃদয়ে।
এখন টেবিল রবে অন্তর্গত কাগজে আবৃত।
দিনগুলি চ’লে যাবে রহস্যের সমাধানে, যাবে
উপচীয়মান কিছু বৎসর ; বয়স বাড়ুক।
মাটি খুঁড়ে যেতে হবে ; মাটির গভীরে ইতস্তত
সভ্যতার অবশেষ খুঁজে পাই, পেয়েছি অনেক
পোড়া ইট, পুতুলের অবয়ব ভগ্নপ্রায় বুক।
মানুষেরা আজ যেন নিরুপম সম্রাটশিকারে
ব্যস্ত আছে ; নানারূপ ছলা-কলা মিথ্যার আশ্রয়ে
কোনোভাবে কিছু কাল বিনষ্ট করে আস্থাবান।
জান্তব আগ্রহে দ্যাখে অশ্বের ভয়ার্ত গতিবেগ-
কখন সে শ্রান্ত হবে, ধরা দেবে, এই প্রতীক্ষায়।
সম্রাট বলে না কথা, রহস্যের সমাধানে থাকে।
১৫ মার্চ ১৯৬২
আমার সৃষ্টিরা আজ কাগজের ভগ্নাংশে নিহিত
কিছু ছন্দে, ভীরু মিলে আলোড়িত কাব্যের কণিকা
এখন বিক্ষিপ্ত নানা বায়ুপথে, ঝড়ের সম্মুখে।
আমাকে ডাকে না কেউ নিরলস প্রেমের বিস্তারে।
পুনরায় প্রতারিত ; কাগজের কুসুমকলিকে
ফোটাতে পারিনি আমি, অথবা সে মৃতদেহ নাকি !
এই বেদনায় ফের শিশির, বাতাস সঙ্গে নিয়ে
খুঁজেছি সংগত হ্রদ, দেশে দেশে, হায় অনাহত।
১৭ মার্চ ১৯৬২
রসাত্মক বাক্য লেখা কবে যে আয়ত্ত হবে, ভাবি
কবোষ্ণ প্রভাতবেলা উজ্জ্বল শব্দের দিকে চেয়ে
অনুশোচনায় ভরে হৃদয় ; কখনো অধিকার
পাবো না হে বাষ্পপুঞ্জ, বক্ষের অমল ক্ষতরাশি ।
ওরা উড়ে যাবে দূরে, গানের সহিত যুক্ত হ’য়ে
পাখির পশ্চাতে কিংবা নোঙরের গম্ভীর রজ্জুতে,
নিজের নিয়মমতো ; আমার এ-লেখনীর মুখে
আসবে না, মিশে যাবে পিপীলিকাশ্রেণীতে, জগতে।
১৭ মার্চ ১৯৬২
কিছুটা সময় তবু আমাকেও ক’রে নিতে হবে।
শরীরের তমোরস অবিরাম সেই কথা বলে।
হৃদয় ক্ষতের মতো অবিরাম জ্ব’লে যেতে থাকে।
এখন সম্মুখে যাবো, অসুস্থতাগুলি মনে-মনে
গোপন রেখেই যাবো ; ফুলের সহিত আলোচনা
করা তো সম্ভব নয় যেতে হবে পিতার সকাশে।
যদি বা মালিকা পাই, ভয় হয়, অসুস্থতাহেতু
শাশ্বত পানীয়-জল হয়তো বিস্বাদ মনে হবে।
১৮ মার্চ ১৯৬২
শূন্যকে লেহন করো, দেবদারু, ঊর্ধ্বগ শাখায়
পত্ররিক্ত নগ্নরূপে ; উদ্যত নতুন কোনো মুখ-
কিংবা বিম্ব নেই আজ ; কারো প্রতি অবলোকনের
প্রয়োজন ফুরিয়েছে ; অনেকেই বহুকাল আগে
ফিরে গেছে ; একদিন সূর্যের দীপ্তিতে অন্ধ হ’য়ে
তারা সবে সবিস্ময়ে সূর্যের পূজারী হয়েছিলো।
দেবদারু, আমি স্পষ্ট পেচকের মতো গহ্বরের
স্বস্তি অভিলাষী, তবু ফিরে আসি পূর্ববর্তী ফুলে
ক্বচিৎ কখনো কোনো ফোঁড়া হ’লে নিষিদ্ধ হ’লেও
যে-কারণে তার কাছে অগোচরে হাত চ’লে যায়।
১৮ মার্চ ১৯৬২
যে-পথ রয়েছে তাকে একমাত্র পায়ে-পায়ে হেঁটে
পার হ’য়ে যেতে হবে, আর কোনো সুরম্য শকট
পাবো না নিষ্ফলা পথে, এমনকি অশ্বগুলি কবে
হারিয়ে গিয়েছে সেই আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের
বিধ্বস্ত সময়ে, তবে মানুষের পদদ্বয় আছে।
কোনো বন্ধু নেই আর, সহায়তা পাই না কখনো।
নিজের নিরস্ত্র শোভা, উলঙ্গ অবস্থা নিয়ে আর
কোথায়, কাদের দ্বারে উপস্থিত হবো, হে সময়?
এখন হেঁটেই চলি ; জলে ডুব দেবার আগেই
ডুবুরির মতো কিছু সুগভীর শ্বাস টেনে নিই।
২২ মার্চ ১৯৬২
কোনোদিন একবার উদ্যানে বেড়াতে গেলে পরে
পরিচিতা বাঘিনীর শব পেয়ে অজ্ঞ, চমৎকৃত
একটি মশক বেশ সুনিবিড় প্রেমে পড়েছিলো।
অধ্যবসায়ের ফল ব্যথিত ব্যর্থতাময়, কালো।
পচা শবে মৃত্তিকায় পুষ্পকুঞ্জ জন্ম পেলো নাকি?
বেশ কিছুকাল হ’লো লীলাময়ী রসার্ত বয়স
কাদের গৃহস্থবধূ হয়েছে ; কী-ভাবে জানি না তা।
লতারা কী-ভাবে বোঝে কাছে কোনো মহীরুহ আছে,
তার পরে আরোহণ ক’রে তবে জীবনযাপন
করার সফল কীর্তি কী-ভাবে যে করে, তা জানি না।
তবু বৃক্ষ সনাতন বৃক্ষই, লতাও শুধু লতা,
মৌমাছি ও কুসুমের অভীপ্সার রোমাঞ্চ জানে কি?
৫ এপ্রিল ১৯৬২
শুধু গান ভালোবাসো ; বিপদার্ত মিলনচিৎকারে
এমন আগ্রহহীনা, চ’লে গেছো পার্কের আশ্রয়ে।
উৎপাটিত, রুগ্ন বৃক্ষ আর কোনো গান গায় না যে।
শিকড়ের থেকে তবু নতুন অঙ্কুর অভ্যুদিত–
চেয়ে দ্যাখে, মুখগুলি নিরুৎসাহ, গুপ্ত সাম্রাজ্যের
পতনের কাল থেকে রয়েছে এমনিভাবে, যেন
কাঠখোদাইয়ের শিল্প ; রক্তাপ্লুত শতাব্দীগুলির
উচ্ছ্বাস বিষাদরাশি নীরস আবহে পরিণত।
আমি বৃক্ষ, রোগশয্যা পরিত্যক্ত টিপয়ের মতো
জীর্ণ, ধূলিময়, ম্লান। সলিলসমৃদ্ধ সিন্ধু নয়,
কারো অতি স্বাভাবিক অমোঘ শীতল হাতও নেই,
যে-হাত কপালে পেলে অতীত ও বর্তমানও মোছে।
অসুখ গভীর তবু, হায় কবি, সংক্রামক নয়
কখনো ফুলের দেহে সংক্রামিত হয়নি, হবে না।
৬ এপ্রিল ১৯৬২
একটি বৎসর শুধু লাস্যময়ী অগ্নির সকাশে
ব’সে-ব’সে সদালাপে কাটিয়েছি অবকাশকাল।
বহু তাপ পেয়ে শেষে, হায় অগ্নি, জ্বরাক্রান্ত হ’য়ে
নীলিম কোরকে বিদ্ধ; কিছুকাল পরে অন্য পটে
থেকেছি উদ্দাম বোধে বরফের ঘরের ভিতরে
মথিত ঐশ্বর্য নিয়ে ; তবে পুনরায় অসুস্থতা।
আমাকে ঘিরেছে, দ্যাখো, উদঘাটিত করেছে নিঃস্বতা ;
রোগের সময়ে কোনো শুশ্রূষা পাবার বিত্ত নেই।
অসুস্থতাকালে এত বিচিত্র লালসাময়ী স্বাদ
মনে পড়ে, জেগে কয় ঝালমত্ত আহার্যের ঘ্রাণ্,
মাংসের ঝোলের সিক্ত আবাহন বুভুক্ষু শরীরে।
তারকারা ঋতুচক্রে স’রে গেছে, এ-সব বোঝেনি।
৮ এপ্রিল ১৯৬২
সন্তপ্ত কুসুম ফুটে পুনরায় ক্ষোভে ঝ’রে যায়।
দেখে কবিকুল এত ক্লেশ পায়, অথচ হে তরু,
তুমি নিজে নির্বিকার, এই প্রিয় বেদনা বোঝো না।
কে কোথায় নিভে গেছে তার গুপ্ত কাহিনী জানি না।
নিজের অন্তর দেখি, কবিতার কোনো পঙক্তি আর
মনে নেই গোধূলিতে ; ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই।
অথবা গৃহের থেকে ভুলে বহির্গত কোনো শিশু
হারিয়ে গিয়েছে পথে, জানে না সে নিজের ঠিকানা।
১১ এপ্রিল ১৯৬২
কোনো স্থির কেন্দ্র নেই, ক্ষণিক চিত্রের মোহে দুলি।
ভিন্ন-ভিন্ন সুশীতল স্বাস্থ্যনিবাসের স্বপ্নরূপ
ইতস্তত আকর্ষণে ভ’রে রাখে শূন্য মন, সাধ।
এরূপ পিঙ্গল তৃষ্ণা, অবসর এসেছে এবার।
অপূর্ণের ক্লেশ এই, যে-শাখাগ্রে ফাল্গুনে আমের
বোল মুকুলিত হয়, সে-শাখায় নতুন পাতার
উদ্গমের পথ নেই ; কোথায় সে মুকুলিত প্রেম?
অথচ হৃদয় ছিন্ন, উৎপাটিত কেশমালা যেন,
ছড়িয়ে গিয়েছে বহু ভবনে, উদ্যানে, নানা ক্ষণে।
এত জন্ম, হায় প্রেম, নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন আজ।
১১ এপ্রিল ১৯৬২
কোনো সফলতা নয় ; আকাশের কৃপাপ্রার্থী তরু,
সুপ্ত সরোবরে স্নান করায় অক্ষম ব’লে ; এত-
এত অসহায় আমি, মানবিক শক্তিহীন, তবু
নিমন্ত্রণপত্র পাই, প্রেরিকার ঠিকানাবিহীন।
এত নিরুপায় আমি ; বিষন্ন বাতাস দিয়ে ঢাকি
অন্যের অপ্রেম, ক্ষুধা, দস্যুবৃত্তি, পরিচিত কাঁটা।
অব্যর্থ পাখির কাছে যতোই কালাতিপাত করি
আমাকে চেনে না তবু, পরিচয় সূচিত হ’লো না।
কোনোদিন পাবো না তো, সেতুর উপর দিয়ে দ্রুত
ট্রেনের ধ্বনির মতো সুগম্ভীর জীবন পাবো না।
১২ এপ্রিল ১৯৬২
ব্যর্থতার সীমা আছে ; নিরাশ্রয় রক্তাপ্লুত হাতে
বলো, আর কতকাল পাথরে আঘাত ক’রে যাবো?
এখনো ভাঙেনি কেউ ; ফুরিয়েছে পাথেয় সম্বল।
অথবা বিলীয়মান শবকে জাগাতে কোনো শিশু
সেই সন্ধ্যাকাল থেকে সচেষ্ট রয়েছে, তবু যেন
পৃথিবী নিয়মবশে নির্বিকার ধূসরতাধৃত।
উষ্ণ, ক্ষিপ্ত বাতাসেরা, মেদুর মেঘেরা চিরকাল
ঊর্ধ্বমুখী ; অবয়বে অমেয় আকাঙ্ক্ষা তুলে নিয়ে
ঘুরেছি অনেক কাল পর্বতের আশ্রয় সন্ধানে ;
পাইন অরণ্যে, শ্বেত তুষারে-তুষারে লীলায়িত
হ’তে চেয়ে দেখি কারো হৃদয়ে জীবন নেই ; তাই
জলের মতন ব’য়ে চ’লে যাবো ক্রমশ নিচুতে।
১২ এপ্রিল ১৯৬২
শিশুকাল হ’তে যদি মাত্রাসিদ্ধ পরম বীজাণু
মাঝে-মাঝে পাওয়া যেতো, তবে আজ বসন্তে অসুখ
এত ভয়াবহরূপে দেখা তো দিতো না, প্রিয় সখী ।
আন্দোলিত প্রেমে-প্রেমে প্রাথমিক হৃদয় উন্মাদ ।
ঝরে পুঁজ, ঝরে স্মৃতি, রহস্যনিলীনা অপসৃতা
কুমারীত্ব থেকে দূরে, আরো দূরে, অবরুদ্ধ নীড়ে।
আর আমি অর্ধমৃত ; বৃক্ষদের ব্যাপক অসুখে
শুশ্রূষা করার মতো অনাবিল প্রিয়জনও নেই ।
১২ এপ্রিল ১৯৬২
হৃদয়, নিঃশব্দে বাজো ; তারকা, কুসুম, অঙ্গুরীয়—
এদের কখনো আর সরব সংগীত শোনাবো না ।
বধির স্বস্থানে আছে ; অথবা নিজের রূপে ভুলে
প্রেমিকের তৃষ্ণা দ্যাখে, পৃথিবীর বিপণিতে থেকে।
কবিতা লিখেছি কবে, দু-জনে চকিত চেতনায় ।
অবশেষে ফুল ঝ’রে, অশ্রু ঝ’রে আছে শুধু সুর।
কবিতা বা গান..ভাবি, পাখিরা — কোকিল গান গায়
নিজের নিষ্কৃতি পেয়ে, পৃথিবীর কথা সে ভাবে না।
১৫ এপ্রিল ১৯৬২
বড়ো বৃদ্ধ হ’য়ে গেছি, চোখের ক্ষমতা ক’মে গেছে
পরস্পর মিশে থাকা কাচপুঁতি এবং নীলার
পার্থক্য নির্ণয় ক’রা এখন সম্ভব নয় আর।
এমনকি কাগজের নৌকা নির্মাণের পদ্ধতিও
ভুলে গেছি ; কবিতার মিল খুঁজে মন্থর প্রহর
চলে যায় ; সন্ধ্যাকালে শুনেছি শীতের পুরোভাগে
মৃত্তিকাসংলগ্ন মেঘ এখনো কুয়াশারাশি ব’লে
অভিহিত হয় — এই কুৎসাভীত বহু ভালোবাসা।
অভিজ্ঞতা ফুরিয়েছে ; অন্ধকারে আহার্যবিহীন
ক্ষুধায় অতিবাহিত করা ভিন্ন বৃক্ষদের কোনো
গত্যন্তর নেই, হায়, এই ক্লেশে ম্রিয়মাণ আমি।
হেটেছি সুদীর্ঘ পথ; শুধু কাটা, রক্তাক্ত দু-পায়।
তোমার দুয়ারে এসে অনিশ্চিত, নির্বাক, চিন্তিত।
তুমি কি আমাকে বক্ষে স্থান দিতে সক্ষম, মুকুর?
১৫ এপ্রিল ১৯৬২
কোনো যোগাযোগ নেই, সেতু নেই, পরিচয় নেই ;
তবুও গোপন ঘর নীলবর্ণে রঞ্জিত হয়েছে
এই ভেবে যদি খুঁজি, তবে বলো, এ-কল্পনা কালো।
আঁধারে সকলই, সখা, কালো ব’লে প্রতিভাত হয়।
তর্কের সময় নয় ; বিপুল বিপদাপন্ন ক্ষুধা ।
প্রাণে জ্যোৎস্নালেপনের সাধ যদি না-ই হয়, তবে
ছিদ্র দিয়ে ডেকে নিয়ে কেন সে যে খোলে না দরজা।
আহার করার আগে স্নান করা তারই রীতি, প্রেম।
১৭ এপ্রিল ১৯৬২
বাতাস আমার কাছে আবেগের মথিত প্রতীক,
জ্যোৎস্না মানে হৃদয়ের দ্যুতি, প্রেম ; মেঘ – শরীরের
কামনার বাষ্পপুঞ্জ ; মুকুর, আকাশ, সরোবর,
সাগর, কুসুম, তারা, অঙ্গুরীয়—এ-সকল তুমি ।
তোমাকে সর্বত্র দেখি ; প্রাকৃতিক সকল কিছুই
টীকা ও টিপ্পনী মাত্র, পরিচিত গভীর গ্রন্থের ।
অথচ তুমি কি, নারী, বেজে ওঠো কোনো অবকাশে?
এতটা বয়সে ক্ষত – ক্ষত হয়নি কি কোনোকালে?
তৃপ্ত অবস্থা তো নেই, সমুদ্রের আবশ্যক জল
যতো পান করা হয়, তৃষ্ণা ততো বৃদ্ধি পেতে থাকে ।
বৃষ্টির পরেও ফের বাতাস উত্তপ্ত হ’য়ে ওঠে।
প্রেম, রাত্রি পরিপূর্ণ অতৃপ্তির ক্ষণিক ক্ষান্তিতে।
সেহেতু তুমি তো, নারী, বেজে ওঠো শ্বেত অবকাশে ;
এতটা বয়সে ক্ষত – ক্ষত হয়নি কি কোনোকালে?
১৭ এপ্রিল ১৯৬২
আমার বাতাস বয় ; সদ্যোজাত মরুভূমি থেকে
কেবলই বালুকা ওড়ে ; অবাঞ্ছিত পিপাসা বাড়ায়।
তাঁবু নিয়ে ফিরে আসি বন্দরের পরিশ্রান্ত ভিড়ে।
কী আশ্চর্য, খুশি হয় কুকুর, উদ্যান, রাজপথ।
শুনেছি সভার মাঝে একটি কুসুম ঘ্রাণময়ী ;
ব্যথিত আগ্রহে দেখি ; এত ফুল, কোনটি বুঝি না।
যে-কোনো অপাপবিদ্ধ তারকারো জোৎস্না আছে ভেবে
কারো কাছে যেতে চাও, হে চকোর, স্বপ্নচারী, বৃথা।
লাশের অভ্যর্থনাকারীদের মাঝ দিয়ে হেঁটে
বিদেশী ব্যক্তির মতো কে জানে কোথায় যেতে হবে।
১৮ এপ্রিল ১৯৬২
ঈপ্সিত শিক্ষায়তনে যাবার বাসনা হয়েছিলো।
গিয়ে দেখি ত্রস্ত মুখ, উপলক্ষ সমুদ্র উধাও।
ভ্রমর পোষে না কেউ ; নবতর হাসির মাধ্যম
সেখানে সুলভ নয় ; কাঁটাগাছ পূর্বেই প্রস্তুত।
কিছু আলোকিত হ’লো সমাচ্ছন্ন বাঁশ, ভবিষ্যৎ।
এখন সমস্যা এই, কোনো করবীর সঙ্গে আর
খেলার সময় কিংবা বিশ্বস্ত সুযোগ কোনোদিন
ভুলেও দেবে না কেউ ; বাকি আছে শুধু ক্ষুণ্ণ ক্রয়।
২৩ এপ্রিল ১৯৬২
এমন বিপন্ন আমি, ব্যক্তিগত পবিত্রতাহীন।
যেখানে-সেখানে মুগ্ধ মলত্যাগে অথবা অসীমে
প্রস্রাব করার কালে শিশুর গোপন কিছু নেই।
ফলে পিপীলিকাশ্রেণী, কুসুমের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
নিয়ন্ত্রিত, ক্ষুব্ধ আমি ; যে-সুবিধা তোমরা পেয়েছো
তার দুষ্ট ব্যবহার, মুহুর্মুহু কাদা, ইতিহাস –
এ-সবে বিধ্বস্ত আজ ; এত সম্ভাবনাময় দ্যুতি,
সবই ব্যর্থ ; শুধু আশা, কোনোদিন জীর্ণ বৃদ্ধ হবো।
মৃত্তিকায় প’ড়ে রবে বয়োত্তীর্ণ, রসহীন বীজ,
উৎসুক হবে না কেউ ধ্বংসপ্রাপ্ত দেবতার শবে।
২৪ এপ্রিল ১৯৬২
সহাস্য গুলিটি মনে বিদ্ধ হ’য়ে বহুকাল ছিলো
সনাতন মূল কেটে, ভিক্ষা ক’রে সুস্থ হ’তে হয়।
ফলে এই স্পৃহাহীন, ক্ষমায় বিশীর্ণ ঋতু আসে।
অসীম শিল্পীর হাতে বৃক্ষ শেষে হয়েছে টিপয়।
পাখিকে ডাকি না তবু, আহার্য ছড়িয়ে কাছে পেতে।
নতুন মদের পাত্র নির্বাচন এখন স্থগিত।
জরায়ু ত্যাগের পরে বিস্তীর্ণ আলোকে এসে শিশু
সৃষ্টির সদর্থ বোঝে, নিজস্ব পিপাসা, ক্ষুধা পায়।
অন্ধকার সীমা ছেড়ে চেয়ে দ্যাখে, আরো পরিসীমা
আকাশের নীলে, চাঁদে, নক্ষত্রের আহ্বানে নিহিত।
২৮ এপ্রিল ১৯৬২
কবে যেন একবার বিদ্ধ হ’য়ে বালুকাবেলায়
সাগরের সাহচর্য পেয়েছিলো অলৌকিক পাখি।
উদ্যত সংগীতে কবে ভরেছিলো হর্ম্যতল, তবু
পেরেক বিফল হ’লো গহ্বরের উদ্ধার পেলো না।
মাথা কুটে, ছিঁড়ে-খুড়ে, ঘুড়ির মতন ত্যক্ত হ’য়ে
দ্যাখে, পৃথিবীর শিক্ষা ধারণার ক্রমসংশোধনে।
যেন শিশু বায়ুলোকে নির্ভয়ে বিহার ক’রে শেষে
পথে প’ড়ে ধ্বংস হয়। তেতলার থেকে পতনের
অন্তিম, অজ্ঞাতপূর্ব মর্ম বোঝে শবের জীবনে।
৯ মে ১৯৬২
এরূপ বিরহ ভালো ; কবিতার প্রথম পাঠের
পরবর্তী কাল যদি নিদ্রিতের মতো থাকা যায়,
স্বপ্নাচ্ছন্ন, কাল্পনিক ; দীর্ঘকাল পরে পুনরায়
পাঠের সময়ে যদি শাশ্বত ফুলের মতো স্মিত,
রূপ, ঘ্রাণ ঝ’রে পড়ে তাহ’লে সার্থক সব ব্যথা,
সকল বিরহ, স্বপ্ন ; মদিরার বুদ্বুদের মতো
মৃদু শব্দে সমাচ্ছন্ন, কবিতা, তোমার অপ্রণয়।
হাসির মতন তুমি মিলিয়ে গিয়েছো সিন্ধুপারে।
এখন অপেক্ষা করি, বালিকাকে বিদায় দেবার
বহু পরে পুনরায় দর্শনের অপেক্ষার মতো –
হয়তো সর্বস্ব তার ভ’রে গেছে চমকে-চমকে।
অভিভূত প্রত্যাশায় এরূপ বিরহব্যথা ভালো।
১৮ মে ১৯৬২
ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম ?
লীলাময়ী করপুটে তোমাদের সবই ঝ’রে যায় –
হাসি, জ্যোৎস্না, ব্যথা, স্মৃতি, অবশিষ্ট কিছুই থাকে না।
এ আমার অভিজ্ঞতা। পারাবতগুলি জ্যোৎস্নায়
কখনো ওড়ে না ; তবু ভালোবাসা দিতে পারি আমি।
শাশ্বত, সহজতম এই দান – শুধু অঙ্কুরের
উদ্গমে বাধা না দেওয়া, নিষ্পেষিত অনালোকে রেখে
ফ্যাকাশে হলুদবর্ণ না-ক’রে শ্যামল হ’তে দেওয়া।
এতই সহজ, তবু বেদনায় নিজ হাতে রাখি
মৃত্যুর প্রস্তর, যাতে কাউকে না ভালোবেসে ফেলি।
গ্রহণে সক্ষম নও। পারাবত, বৃক্ষচূড়া থেকে
পতন হ’লেও তুমি আঘাত পাও না, উড়ে যাবে।
প্রাচীন চিত্রের মতো চিরস্থায়ী হাসি নিয়ে তুমি
চলে যাবে ; ক্ষত নিয়ে যন্ত্রনায় স্তব্ধ হব আমি।
২১ মে ১৯৬২
নানা কুন্তলের ঘ্রাণ ভেসে আসে চারিদিক থেকে।
হৃদয় উতলা হয়, ফুটন্ত জলের মতো মোহে।
অনেকেই ছুঁয়ে গেছে, ঘুম ভেঙে গেছে বারবার।
ত্রুটিপূর্ণ মুকুরের মতো তারা আমাকে প্রায়শ
বিকৃত করেছে ; হায়, পিপীলিকাশ্রেণীতে একাকী
কীটের মতন আমি অনেক হেঁটেছি অন্ধকারে।
তোমাকে তো ঈর্ষা করি ; হে পাবক, তুমি সব কিছু
গ্রাস ক’রে নিতে পারো – তোমার বাঞ্ছিত যুবকের
জীবন, মরণ, মন ; কখনোই প্রেমে ব্যর্থ নও।
আর আমি বারংবার অসফল, ক্ষমতাবিহীন।
প্রায়শ নিষ্ক্রিয় থাকি, প্রত্যাশায় দ্যুতিময় মনে,
অপরের অভ্যন্তরে ক্ষুধার মতন সংগোপন
দুর্বোধ্য সমস্যাগুলি নিবেদিত হবে – এই ভেবে।
কিছুই বলে না কেউ ; হে পাবক, তুমি বিশ্বজয়ী।
২৩ মে ১৯৬২
করুণ চিলের মতো সারাদিন, সারাদিন ঘুরি।
ব্যথিত সময় যায়, শরীরের আর্তনাদে, যায়
জ্যোৎস্নার অনুনয় ; হায়, এই আহার্যসন্ধান।
অপরের প্রেমিকার মতন সুদূর নীহারিকা,
গাঢ় নির্নিমেষ চাঁদ, আমাদের আবশ্যক সুখ।
এতকাল চ’লে গেলো, এতকাল শুধু আয়োজনে।
সকলেই সচেতন হ’তে চায় পরিসরে, ক্ষুধার মতন
নিরন্তর উত্তেজনা নাড়িতে-নাড়িতে পেতে চায়।
হস্তগত আহার্যের গূঢ় ঘ্রাণ, স্বাদ ভালোবেসে
বিহ্বল মুহূর্তগুলি যেন কোনো অর্ঘ্যে দিতে চায়।
অথচ চিলের মতো আয়োজনে আয়ু শেষ হয়।
ব্যর্থ অনাশ্রয় কেউ চাই না ; তোমাকে পেতে চাই
তবু আশ্রয়েরও আগে, পরিহিত অবস্থায় কোনো
অঙ্গুরীয় হারানোর ক্ষিপ্ত ভয় লোপ পায় ব’লে।
২৪ মে ১৯৬২
যখন কিছু না থাকে, কিছুই নিমেষলভ্য নয়,
তখনো কেবলমাত্র বিরহ সহজে পেতে পারি।
তাকেই সম্বল ক’রে বুঝি এই মহাশূন্য শুধু
স্বতঃস্ফূর্ত জ্যোৎস্নায় পরিপূর্ণ, মুগ্ধ হ’তে পারে।
ফলে গবেষণা করি ; পর্বতে, ব-দ্বীপে যেতে চাই ;
চোখ বুজে হাস্যহীন দেহ তুলে দিতেও গিয়েছি
ব-দ্বীপের অন্ধকার হ্রদের গভীরে একবার।
অবশ্য পাখির মতো জলভ্রমে তেলের সকাশে
গিয়ে ফের ফিরে আসি ; ফলে শুধু তৃষ্ণা বৃদ্ধি পায়।
এরূপ সম্ভার আছে ; কতিপয় কুসুমের মুখ
আহত করেছে দীর্ঘ রজনীগন্ধার মতো রূপে।
তবুও গভীর কেন্দ্রে কেবলই চেতনা ব’লে যায়-
এই সব নাতি-উষ্ণ ক্রীড়া ফেলে শিশুর মতন
ছুটে যাবো যদি শুনি, মিষ্টদ্রব্য স্বগৃহে ফিরেছে।
৭ জুন ১৯৬২
তোমাদের কাছে আছে সংগোপন, আশ্চর্য ব-দ্বীপ
কৃষ্ণবর্ণ অরণ্যের অন্তরালে ঘ্রাণময় হ্রদে
আমার হৃদয় স্বপ্নে মুগ্ধ হয়, একা স্নান করে।
হে শান্তি, অমেয় তৃপ্তি, তুমি দীপ্ত হার্দিক প্রেমের
মূলে আছো, আছো ফলে ; মধ্যবর্তী অবকাশে প্রাণ
তবুও সকল কিছু সংযমে নিক্ষেপ করে দূরে ;
ক্ষণস্থায়ী তৃপ্তিজাত আসক্তিতে চিরন্তন মোহে
রূপ দিতে বর্ণ, গন্ধ খুঁজে ফেরে, বায়ব আকাশ,
খুঁজে ফেরে চন্দ্রাতপ ; যেন সরোবরে মুগ্ধ তাপ –
জ্যোৎস্না উদ্ভাসিত হ’লে তবে তার স্নান গ্রহণীয়।
এসো হে ব-দ্বীপ, এসো তামোরস, এসো জ্বালা, প্রেম,
আলোড়ন, ঝঞ্ঝা, লোভ, সংযত সংহারমালা, এসো।
নিয়ে যায় মূলে, রসে, বাষ্পীভূত ক’রে মেলে দাও
আয়ুষ্কালব্যাপী নভে, আবিষ্কৃত আকাশের স্বাদে।
৭ জুন ১৯৬২
আমার আশ্চর্য ফুল, যেন চকোলেট, নিমিষেই
গলাধঃকরণ তাকে না-ক’রে ক্রমশ রস নিয়ে
তৃপ্ত হয়, দীর্ঘ তৃষ্ণা ভুলে থাকি আবিষ্কারে, প্রেমে।
অনেক ভেবেছি আমি, অনেক ছোবল নিয়ে প্রাণে
জেনেছি বিদীর্ণ হওয়া কাকে বলে, কাকে বলে নীল –
আকাশের, হৃদয়ের ; কাকে বলে নির্বিকার পাখি।
অথবা ফড়িং তার স্বচ্ছ ডানা মেলে উড়ে যায়।
উড়ে যায়, শ্বাস ফেলে যুবকের প্রাণের উপরে।
আমি রোগে মুগ্ধ হ’য়ে দৃশ্য দেখি, দেখি জানালায়
আকাশের লালা ঝরে বাতাসের আশ্রয়ে-আশ্রয়ে।
আমি মুগ্ধ ; উড়ে গেছো ; ফিরে এসো, ফিরে এসো, চাকা,
রথ হ’য়ে, জয় হ’য়ে, চিরন্তন কাব্য হ’য়ে এসো।
আমরা বিশুদ্ধ দেশে গান হবো, প্রেম হবো, অবয়বহীন
সুর হ’য়ে লিপ্ত হবো পৃথিবীর সকল আকাশে।
২২ জুন ১৯৬২
খেতে দেবে অন্ধকারে—সকলের এই অভিলাষ।
কে জানে কী ফল কিংবা মিষ্টদ্রব্য কোনো-
বয়স্কা, অনূঢ়া, স্ফীত ; কিন্তু হায়, আমার রসনা
ভালোবাসে পূর্বাহ্নেই রূপে, ঘ্রাণে রসাপ্লুত হ’তে।
হয়েছিলো কোনোকালে একবার হীরকের চোখে
নিজেকে বিম্বিত দেখে ; তারপর আর কেন আরো
উদ্বৃত্ত ফুলের প্রতি তাকাবো উদ্যত বাসনায়?
কেন, মনোলীনা, কেন বলো চাকা, কী হেতু তাকাবো?
যতো বলি, অন্ধকার, আমার তারকা আছে, ততো
দেখি, আকাশের প্রতি পাখিটির ভালোবাসা কারো
শ্রদ্ধায় স্বীকৃত নয় ; অশিক্ষিত গর্তরাশি আসে।
মনে হয়, জ্যোৎস্না নয়, অন্ধকারে বৃষ্টিপাত চায়।
এ-সকল ক্ষোভ বুঝে চতুর্দিকে হেসে ওঠে বহু
গহ্বর, বৃদ্ধার মতো বালকের রূপকথা শুনে।
২২ জুন ১৯৬২
চিৎকার আহ্বান নয়, গান গেয়ে ঘুম ভাঙালেও
অনেকে বিরক্ত হয় ; শঙ্খমালা, তুমি কি হয়েছো?
আজ তা-ই মনে হয় ; তবু তুমি পৃথিবীতে আছো।
অমোঘ শিকারীদের লক্ষ্যভেদে সফলতা তবে
কোনো মুগ্ধ নিয়মের বশবর্তী নয় ; যেন বাঘ
লাফ দিলে কুমারীটি স’রে গেছে লক্ষ্যবিন্দু থেকে ।
তোমার হৃদয়ে দিতে রোমাঞ্চিত সংক্রামক ব্যাধি
বীজাণু বহন করি ; তুমি থাকো দূরে সিন্ধুপারে ;
ফলে নিজে পূর্বাহ্নেই আরো বেশি বিষক্রিয়া পাই।
হৃদয় যদি না থাকে, তবু অন্য ঐশ্বর্য রয়েছে –
গুদামে তো বিস্ফোরণ হ’তে পারে, সেও ভালোবাসা।
যা-ই হোক, শঙ্খমালা, তোমাকে সর্বস্ব দিতে চাই,
যে-কেনো কারণে খোলো, তা-ই মহত্তম প্রেম হবে।
২২ জুন ১৯৬২
যাক, তবে জ্ব’লে যাক, জলস্তম্ভ, ছেঁড়া যা হৃদয়।
সব শান্তি দূরে থাক, সব তৃপ্তি, সব ভুলে যাই।
শুধু তার যন্ত্রণায় ভ’রে থাক হৃদয় শরীর।
তার তরণীর মতো দীর্ঘ চোখে ছিলো সাগরের
গভীর আহ্বান, ছায়া, মেঘ, ঝঞ্ঝা, আকাশ, বাতাস।
কাঁটার আঘাতদায়ী কুসুমের স্মৃতির মতন
দীর্ঘস্থায়ী তার চিন্তা ; প্রথম মিলনকালে ছেঁড়া
ত্বকের জ্বালার মতো গোপন, মধুর এ-বেদনা।
যাক, সব জ্ব’লে যাক, জলস্তম্ভ, ছেঁড়া যা হৃদয়।
২৭ জুন ১৯৬২
করবী তরুতে সেই আকাঙ্খিত গোলাপ ফোটেনি।
এই শোকে ক্ষিপ্ত আমি ; নাকি ভ্রান্তি হয়েছে কোথাও?
অবশ্য অপর কেউ, মনে হয়, মুগ্ধ হয়েছিলো,
সন্ধানপর্বেও দীর্ঘ, নির্নিমেষ জ্যোৎস্না দিয়ে গেছে।
আমরা নিদ্রার মাঝে, স্তন্যপান করার মতন
ব্যবহার ক’রে বলে শিহরিত হৃদয়ে জেগেছি।
হায় রে, বাসি না ভালো, তবু এও ধন্য সার্থকতা,
এই অভাবিত শান্তি, মূল্যায়ন, ক্ষিপ্ত শোকে ছায়া।
তা না-হ’লে আস্বাদিত না হবার বেদনায় মদ,
হৃদয় উন্মাদ হয়, মাংসে করে আশ্রয়—সন্ধান।
অথচ সুদূর এক নারী শুধু মাংসভোজনের
লোভে কারো কাছে তার চিরন্তন দ্বার খুলেছিলো,
যথাকালে লবণের বিস্বাদ অভাবে ক্লিষ্ট সেও।
এই পরিণাম কেউ চাই না, হে মুগ্ধ প্রীতিধারা,
গলিত আগ্রহে তাই লবণ অর্থাৎ জ্যোৎস্নাকামী।
২৯ জুন ১৯৬২
কবিতা বুঝি নি আমি ; অন্ধকারে একটি জোনাকি
যৎসামান্য আলো দেয়, নিরুত্তাপ, কোমল আলোক।
এই অন্ধকারে এই দৃষ্টিগম্য আকাশের পারে
অধিক নীলাভ সেই প্রকৃত আকাশ প’ড়ে আছে –
এই বোধ সুগভীরে কখন আকৃষ্ট ক’রে নিয়ে
যুগ যুগ আমাদের অগ্রসর হয়ে যেতে বলে,
তারকা, জোনাকি – সব ; লম্বিত গভীর হয়ে গেলে
না দেখা গহ্বর যেন অন্ধকার হৃদয় অবধি
পথ ক’রে দিতে পারে ; প্রচেষ্টায় প্রচেষ্টায় ; যেন
অমল আয়ত্তাধীন অবশেষে ক’রে দিতে পারে
অধরা জ্যোৎস্নাকে ; তাকে উদগ্রীব মুষ্ঠিতে ধ’রে নিয়ে
বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশের, অনন্তের সার পেতে পারি।
এই অজ্ঞানতা এই কবিতায়, রক্তে মিশে আছে
মৃদু লবণের মতো, প্রশান্তির আহ্বানের মতো।
২৯ জুন ১৯৬২
আঘাত দেবে তো দাও। আর নেই মৃত স্মৃতিরাশি।
অনেক মদিরা পান করেছি, হে আঁখি, ওষ্ঠ, চাকা।
রক্তের ভিতরে জ্যোৎস্না ; তবু বুঝি, আজ পরিশেষে
মাংসভোজনের উষ্ণ প্রয়োজন ; তা না হলে নেই
মদিরার পূর্ণ তৃপ্তি ; তোমার দেহের কথা ভাবি –
নির্বিকার কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে অন্ধকার, সুখ
এমন আশ্চর্যভাবে মিশে আছে ; পৃথিবীতে বহু
গান গাওয়া শেষ হল, সুর শুনে, ব্যথা পেয়ে আজ
রন্ধনকালীন শব্দ ভালোবেসে, কানে কানে মৃদু
অর্ধস্ফুট কথা চেয়ে, এসেছি তোমার দ্বারে, চাকা।
মুগ্ধ মিলনের কালে সজোরে আঘাতে সম্ভাবিত
ব্যথা থেকে মাংসরাশি, নিতম্বই রক্ষা করে থাকে।
২৯ জুন ১৯৬২
তুমি যেন ফিরে এসে পুনরায় কুন্ঠিত শিশুকে
করাঘাত ক’রে ক’রে ঘুম পাড়াবার সাধ ক’রে
আড়ালে যেও না ; আমি এতদিনে চিনেছি কেবল
অপার ক্ষমতাময়ী হাত দুটি, ক্ষিপ্র হাত দুটি –
ক্ষণিক নিস্তারলাভে একা একা ব্যর্থ বারিপাত।
কবিতা সমাপ্ত হতে দেবে নাকি? সার্থক চক্রের
আশায় শেষের পংক্তি ভেবে ভেবে নিদ্রা চ’লে গেছে।
কেবলি কবোষ্ণ চিন্তা, রস এসে চাপ দিতে থাকে ;
তারা যেন কুসুমের অভ্যন্তরে মধু-র ঈর্ষিত
স্থান চায়, মালিকায় গাঁথা হয়ে ঘ্রাণ দিতে চায়।
কবিতা সমাপ্ত হতে দাও, নারী, ক্রমে — ক্রমাগত
ছন্দিত, ঘর্ষণে, দ্যাখ, উত্তেজনা শীর্ষলাভ করে,
আমাদের চিন্তাপাত, রসপাত ঘটে, শান্তি নামে।
আড়ালে যেও না যেন, ঘুম পাড়াবার সাধ ক’রে।
***
Leave a Reply