বেডরুমের সঙ্গের গ্রিলঘেরা লম্বা বারান্দাটা এতটা সরু যে তা কাপড় শুকাতে দেওয়া, আচারের বয়াম, সরষে ধুয়ে রোদে দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো কাজে আসে না। তবুও দোতলার গৃহবধূ মেয়েটি কাজে-অকাজে সময় পেলেই এখানে এসে দাঁড়ায়। চোখের সামনে তো শুধু বিল্ডিং আর বিল্ডিং। কোনোটা আকাশ ঢেকে দিয়েছে, আবার কোনোটা শব্দ-ধুলা-জঞ্জালে চারপাশটা বিশৃঙ্খল করে দিয়ে ক্রমাগত আকাশের সঙ্গে দূরত্ব ঘুচিয়ে চলেছে। লাগোয়া প্লটটিতে এখনো বিল্ডিং ওঠেনি এই যা বাঁচোয়া। সেখানে স্কুলঘরের মতো লম্বা একটি টিনের ঘর আছে। তাতে বেশ কয়েকটি পরিবার থাকে। টিনের ঘর এবং সীমানা দেয়ালের মাঝখানে আছে তিনটি গাছ—একটি খেজুর, একটি পেয়ারা আর একটি বরই।
মাঝারি আকৃতির তিনটি গাছ, সঙ্গে একটুকরো আকাশ—এর টানেই মেয়েটি বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে তখন দেখতে লাগে ঠিক খাঁচার পাখি কিংবা জেলখানার কয়েদিদের মতো। দোতলার মেঝে ছাড়িয়ে আরেকটু লম্বা খেজুরগাছটার সঙ্গে তার বেশি ভাব। হয়তো কাছে আছে বলে। গত এক বছরে গাছটা অনেকটা বেড়েছে। ঢাকায় আসার আগে এমন করে এতটা সময় নিয়ে কখনো খেজুরগাছ দেখেনি সে। আজকাল এই কাঁটাওয়ালা গাছটাকে বড্ড আপন মনে হয় তার। কী সুন্দর সবুজাভ ঘিয়ে রঙের কচি পাতাগুলো! মানুষ কাঁটার ভয়ে এ গাছটি এড়িয়ে চলে অথচ চড়ুই, শালিক, টুনটুনি পাখিগুলোর ভীষণ সাহস! তারা খেজুরডালে এসে বসে, এ ডাল-সে ডালে নেচে বেড়ায়, লেজ নাচিয়ে গান গায়। রাতের বেলায়ও কখনো কখনো মেয়েটি বেডরুমের সুইচ অফ করে বারান্দায় আসে। গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। আবার কখনো মেঝেতে পা ভাঁজ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকে। খেজুরগাছের পাশে বসে আকাশ, তারা আর অন্ধকারের রূপ দেখে। কত কিছু ভাবে! কতকিছু বলে! তার কথার একমাত্র শ্রোতা ওই খেজুরগাছ। সে জানে গাছটি অসীম মনোযোগে তার প্রতিটি কথা শোনে। পাতা নেড়ে মাঝেমধ্যে তার কথায় সম্মতি জানায়। মনের কথা বলতে বলতে যখন তার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে তখন খেজুরগাছটি অস্থির হয়ে ওঠে। তাকে সান্ত্বনা জানাতেই ঘন ঘন পাতা নাড়ে। নীরব ভাষায় বলে, ‘এভাবে ভাবছ কেন?’ কিংবা বলে ‘এমন করে না ভাবলেই কি নয়? এমন করে ভেব না। মনে সাহস রাখো।’ এসব কিছুই তার ভালো লাগে। কারণ এমন করে আর যে কেউ তাকে বলে না!
প্রাণ খুলে কথা বলার মতো একজন মানুষও তার এ শহরে নেই। সে ভাবতে বসে, পৃথিবীতে আছে কি? না, তাও আর নেই। তবে একসময় ছিল। জসীমউদ্দীনের সাজুর মতো সেই মানুষটির চোখজোড়া ছিল ভীষণ টানা টানা। চোখ দিয়েই হাজারো কথা বলতে পারত বলে তার কথা বলার তেমন প্রয়োজন পড়ত না। তবুও মেয়েটি তাকে বলত ‘একটা গাছ কোথাকার!’ কেন বা কেমন করে একজন মানুষকে ধরে রাখতে হয় তখন সেটা জানা ছিল না বলে ভালোলাগা গাছমানুষটিকে মেয়েটি ধরে রাখতে পারেনি। পরে শুনেছে সে তাকে সঙ্গে রাখেনি বা তার সঙ্গে সে থাকেনি কিংবা তাদের একসঙ্গে থাকা হলো না তাই মানুষটি অভিমানে হারিয়ে গেছে। কোথায় গেছে, কোন দেশে গেছে ওই মানুষটি, কোন পথে গেছে তাও সে জেনেছে। শুধু সে নয়, তার আগে পুরো গ্রামের মানুষই জেনেছে। এ শহর পর্যন্ত, তার এ ঘর পর্যন্ত সে খবর পৌঁছেছে। কিছুদিন পরে সে উপলব্ধি করেছে, একটু কেঁপে উঠলেও কারও অবর্তমানে পৃথিবী থেমে থাকে না। সে চলে নিজ গতিতে। গাছমানুষটির চলে যাওয়ায় কোথায় কী থমকে গেছে জানা যায়নি। কেবল তারপর থেকে প্রিয় ফল আম আর মেয়েটির মুখে কখনো ওঠেনি। না কাঁচা, না পাঁকা। ঢাকার লোক অবাক হয়ে মেয়েটিকে বলে, ‘আম খায় না, আম দেখলে বমি পায় এমন মানুষ আমরা জন্মেও দেখি নাই। তোমাকেই দেখলাম।’ কেবল সে-ই জানে ওটা বমি পাওয়া নয়, ওটা তার কষ্ট, অভিমান আর অপরাধবোধের দলা যা পেট, কলিজা, আত্মা ভেদ করে বের হয়ে আসতে চায়। ওই ঘটনার পর থেকেই গাছপালাগুলোকে তার পরমাত্মীয় বলে মনে হয়। অবশ্য গ্রামের হাটের মতো মানুষ গিজ গিজ করা মহানগরে আত্মীয় হওয়ার মতো আর কোনো মানুষকে পাশেও পায়নি সে।
তার কোনো বন্ধু নেই, আত্মীয় নেই এ সংসারে। বৈবাহিক এবং নিজের রক্তের পরিচয়ে বেশ কিছু রক্তীয় আছেন এ শহরে। তারা কদাচিত্ কখনো তাঁদের বাসায় আসেন। সৌজন্যমাফিক কথাবার্তা হয়, আপ্যায়নও চলে যথাসাধ্য। কিন্তু কেন যেন কারও সঙ্গেই তার আত্মীয়তা হয় না। যার সঙ্গে সে ঘর করে তার সঙ্গে তার রক্তের সম্পর্ক নেই, আত্মীয়তাও গড়ে ওঠেনি। কেন উঠল না সে সম্পর্কে সে অনেক ভেবেছে একসময়। অনেক সম্ভাব্য উত্তর মাথায় উঁকি দিয়েছে। কিন্তু সঠিক উত্তরে আজও তার টিক দেওয়া হয়নি। যখন সেই গাছমানুষটির আমগাছে ঝুলে চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার কাহিনী এই শহরে এসে পৌঁছেছিল তখন তার একবার গৃহহারা হওয়ার চরম আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। পরে গ্রাম থেকে বাবা এসে গৃহস্বামীর হাত-পা ধরে, মেয়েটি আর কোনোদিন গ্রামে যাবে না, তার পরিজনেরা শহরের এ বাসামুখো কখনো হবে না এমন নানা প্রতিজ্ঞা করে তার শহরবাস নিশ্চিত করে গেছেন। এটা সেই অনেকগুলো সম্ভাব্য উত্তরের একটি। তবে সঠিক উত্তর কিনা সে বলতে পারে না।
সেই থেকে শহরের প্রায় শেষ মাথার এই বাড়ির পেছনের গাছ কটিই তার বন্ধু, আত্মীয়, সঙ্গী—সব। দিনরাত কত কথা যে চলে তাদের সঙ্গে! কিন্তু এমন করে তার কথা বলার দিন শেষ হয়ে এসেছিল। একদিন সকালে সে দেখল একদল লোক ওই টিনের ঘরের সামনের জায়গায় লোহার বেশ লম্বামতো কয়েকটি পাইপ মাটির মধ্যে ঢুকিয়ে কী যেন করছে। পরে শুনেছে যে ওটা ‘সয়েল টেস্ট’। মানে এখানেও বিল্ডিং হবে। সেই থেকে তার মধ্যে যে কী একটা আতঙ্ক ভর করেছিল। গাছগুলোর জন্য তার মনটা কেমন শঙ্কিত হয়ে উঠেছিল। রোজ দমবন্ধ করা কষ্ট নিয়ে ঘুমুতে যাওয়া আবার ঘুম থেকে ওঠা। তারপরের দিনগুলোতে সে গাছগুলোর সঙ্গে কথা বলা বাড়িয়ে দিয়েছিল। খেজুরগাছে কয়টা নতুন পাতা গজাচ্ছে, পেয়ারা গাছে, বরই গাছে ফুল এসেছে কি না গভীরভাবে সে দেখত। খেজুরগাছের সঙ্গে কথাগুলো যেন হতো অবিকল কয়েক বছর আগে সেই হারিয়ে যাওয়া গাছমানুষটির সঙ্গে কথা বলার মতো। শেষদিকে খেজুরগাছটাই যেন প্রকটরূপে সেই মানুষটা হয়ে উঠেছিল। বেশির ভাগ সময় নির্বিকার অথচ নিবিষ্ট শ্রোতা, মাঝেমধ্যে পাতা দুলিয়ে প্রশান্তি দেওয়ার চেষ্টা যদিও তার কার্যক্ষমতা নিতান্তই সাময়িক। কিন্তু ওই অল্পসময়টুকুই যে কতটা কাঙ্ক্ষিত ছিল, কতটা শান্তির প্রলেপদায়ী ছিল তা মেয়েটি ছাড়া আর কে বুঝবে?
এমনিভাবে দেখতে দেখতে মাস চলে গেল। একদিন ভোরে সে দেখতে পেল লম্বা ঘরের ভাড়াটিয়ারা ঠেলাগাড়িতে খাট, তোষক, আলনা, হাঁড়িকুড়ি নিয়ে কোথায় যেন চলে গেল। পরের দিন লেবাররা এসে ঘরের টিন খুলে ফেলল। তারপরের দিন থেকে বিশাল আকৃতির হাতুড়ি দিয়ে ঘরের দেয়াল ভাঙার কাজ শুরু হলো। হাতুড়ি চালাতে কাঁটার খোঁচা লাগে বলে তারা দা দিয়ে বরইগাছটার ডালপালা সব কেটে ফেলল। পেয়ারাগাছটারও বেশ কিছু ডাল ছেঁটে দেওয়া হলো। অস্থিরতা ভর করেছিল মেয়েটার মধ্যে। বারবার সে বারান্দায় আসছিল। অথচ মাত্র কয়েক হাত দূরের হাতুড়ির ভীষণ শব্দ, ঘন ধুলা, তাকে দেখে অল্পবয়স্ক লেবারদের অশালীন কথাবার্তা—এগুলোর কিছুই মেয়েটার বোধ বুদ্ধিকে স্পর্শ করতে পারছিল না। বারবার সে বারান্দায় এসে দাঁড়াচ্ছিল। সেদিন কোনো পাখি বসেনি গাছগুলোয়। ধুলায় ধূসরিত খেজুরগাছটা যেন তাকে বলছিল, ‘তুমি ভেতরে যাও। এত অস্থির হবার কী আছে? আমি তো এখনো আছি। আমি ভালো আছি। তুমি সুস্থির হও। সুস্থির হও।’ মেয়েটা তবুও স্থির হতে পারেনি। লেবারদের কন্ট্রাক্টরকে গলা উঁচু করে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আপনারা কি এই খেজুরগাছটাকেও কেটে ফেলবেন? এটা রেখে বিল্ডিং তোলা যায় না?’ উত্তরে ভদ্র্রলোক বলেছিলেন, ‘এটা রাখা বোধ হয় সম্ভব হবে না। তবে চেষ্টা করব রাখতে।’ ভদ্রলোক সে চেষ্টা করেছিলেন। টিনের ঘরের সব নিশানা মুছে গেলেও খেঁজুরগাছটা সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। মেয়েটা গাছটাকে বাঁচাতে পেরেছে বলে মনে মনে যে কী শান্তি আর স্বস্তি পেয়েছিল তা বোধহয় সে আর গাছটা ছাড়া আর কেউ বুঝত না। বোকা মেয়েটা মনে করেছিল বুঝি সে তার গাছমানুষটিকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে। সে আর হারিয়ে যাবে না কোনোদিন।
কিন্তু হায়! তার মনে আবার অশঙ্কা দেখা দিল যখন বিল্ডিং তোলার জন্য মাটি খোঁড়ার কাজ শুরু হলো। ফাউন্ডেশন দিতে ড্রেনের মতো করে মাটি কাটা চলছে। একটা ড্রেন খেঁজুরগাছটার দিকে এগিয়ে আসছিল। করণীয় কী মেয়েটি আরেকটিবার বুঝতে পারল না যেমন বুঝতে পারেনি কয়েক বছর আগে বিয়ের কথাবার্তা চলার সেই সময়টিতে। লোহার গ্রিলটাকে শক্ত মুঠোয় ধরে রেখে সে অপলক তাকিয়ে ছিল লেবারদের মাটিকাটার দিকে। একসময় গোধূলির আলোয় কন্ট্রাক্টরের চোখে চোখ পড়তেই লোকটি বলে উঠলেন, ‘খেঁজুরগাছটাকে বোধহয় আর বাঁচাতে পারলাম না।’ মেয়েটি কিছু না বলে ঘরে ঢুকে বারান্দার দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল।
পরদিন সকালে গৃহস্বামী অফিসে চলে গেলে দরজা খুলে মেয়েটি দমবন্ধ করে আবারও বারান্দায় এল। এসে দেখল যে খেজুরগাছটি তখনো দাঁড়িয়ে। তবে গোড়া থেকে তার শেকড়ের অর্ধেকটা কাটা পড়েছে। ড্রেনটা তার ঋজু শরীর ঘেঁষে চলে গেছে। গাছটিকে দেখে মনে হচ্ছে ক্র্যাচ ছাড়া বিপজ্জনকভাবে দাঁড়িয়ে থাকা একপেয়ে একজন মানুষ, যিনি যেকোনো সময় ভারসাম্য হারিয়ে মাটিতে পড়ে যাবেন। পাতাগুলোকে বড় ম্লান দেখাচ্ছিল। মেয়েটি গ্রিল ধরে তার কাছাকাছি দাঁড়াতেই যেন গাছটি একটু নড়েচড়ে উঠল। হয়তো পাতা দুলিয়ে প্রশান্তি দিতে চাইল তাকে। অবশেষে বহু দিন আগে শোনা শেষ কথাটাই যেন উচ্চারণ করল, ‘কিছুই যখন করতে পারছ না, শুধু শুধু মন খারাপ করো না। বাস্তবতাকে মেনে নিতে চেষ্টা করো। তাহলেই সুখী হতে পারবে। মনে রেখো সবাই সবকিছু পায় না।’ মেয়েটি ঘরে ঢুকে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিল।
সারা দিন এলোমেলো হাতে অথচ যান্ত্রিক নিপুণতায় ঘরকন্যার কাজ সারল সে। বিকেলের রোদ পশ্চিম দিকে হেলে পড়তেই আবার বারান্দার দরজাটা খুলে গেল। দরজায় পা রাখল মেয়েটা। স্তব্ধ মুখে বিস্ফোরিত চোখ তার। সামনে খেজুরগাছটা নেই। শূন্যতায় পূর্ণ বারান্দার সঙ্গে লাগোয়া সে জায়গাটা। মুহূর্তে দৃষ্টি গেল সীমানা দেয়ালের পাশটিতে, যেখানে ত্রিখণ্ডিত খেজুরগাছটা এলোমেলো ভাবে শুয়ে আছে। কাছেই জড়ো করে রাখা খেজুরপাতার ডালগুলো।
সময় পেরিয়ে গেল কিছুটা। মেয়েটা আবারও ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। তবে এরপর আর কেউ সে দরজাটা খুলতে দেখেনি। জানালার পর্দাটাও ফাঁক হয়নি একবারের জন্যও। গৃহস্বামী দরজা খোলার কথা বললেও তার উত্তর ছিল, ‘লেবারগুলো বড্ড বাজে কথা বলে। তা ছাড়া ঘরে ধুলা আসে খুব।’
২.
পরে মেয়েটা কাজের ফাঁকে কারণে-অকারণে বেডরুমের বিছানাটায় এসে চিত হয়ে শুয়ে পড়ত। যুবতী মেয়েটির হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে শুয়ে থাকার দৃশ্যটা কী ভীষণ সুন্দর কিংবা কতটা অশালীন তা দেখার কেউ ছিল না। তবে একেবারেও যে কেউ দেখত না তা-ই বা বলি কী করে? তার ক্লান্ত দেহে শীতল বাতাস দিতে দিতে বহু বছরের বিবর্ণ ৫৬ ইঞ্চি ন্যাশনাল ফ্যানটি নিশ্চয় তা দেখত। ফ্যানটা তাকে দেখত বা সে ফ্যানটাকে দেখত। যাই হোক, মেয়েটি ফ্যানটির প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। কারণ যে একবার প্রেমে পড়ে সে বারবার প্রেমে পড়তেই পারে। নিজের চারিদিকে তাকিয়ে মেয়েটির কাছে একমাত্র প্রাণময় জীব বলে মনে হতো ফ্যানটিকেই। আরও মনে হতো আসলে ফ্যানটাই তার প্রেমে পড়েছে। কেননা এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আর কেউ তার দেহের ক্লান্তি দূর করে দেয় না, একটানা স্নিগ্ধ বাতাসের ঝাপটায় তার প্রাণকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াস চালায় না কিংবা একটু থেমে থেমে ঘটাংঘটাং শব্দে তার কাছে তার কষ্টের কথা শুনতে চায় না। প্রেমে পড়ার জন্য মেয়েটির পক্ষে প্রেমিকের এটুকু গুণ থাকাই যথেষ্ট।
আর কী চাই এক জীবনে? ফ্যানটার দিকে তাকালেই মেয়েটির মধ্যে প্রাণসঞ্চার হয়। সে ভাবে মানুষের চেয়ে এ যন্ত্রটি বা কম কিসে? ভালোবাসার মানুষকে আলিঙ্গন করার জন্য মানুষের হাত আছে মাত্র দু৪িট। কিন্তু ফ্যানটি তার তিন তিনটি হাত বাড়িয়ে দিয়ে ভালোবাসা ছড়িয়ে দেয় অবিরাম। মেয়েটি অনুভব করেছে গৃহস্বামী সমেত ঘরের সবকিছু প্রকৃত অর্থে নিষ্প্রাণ। টিভিটা আছে শুধু কথা বলে বলে তাকে ক্লান্ত করে তুলতে, কারও কথা শোনায় তার কোনো আগ্রহ নেই। হয়তো নেই সময়ও। প্রেমিকসুলভ কোনো ভাবই নেই তার মধ্যে। বড়জোর ক্যানভাসারের সঙ্গে তার তুলনা চলে। বাচাল এ যন্ত্রটিকে মেয়েটির বড়ই অপছন্দ। তার চেয়ে তিন-হাতি ফ্যানটা প্রেমিক হিসেবে অনেক অনেক ভালো।
ফ্যানটির সঙ্গে মেয়েটির নানা ধরনের কথা হয়। বলা বাহুল্য প্রেমিক-প্রেমিকার কথার মতোই তার কথাগুলো তেমন কোনো অর্থ বহন করে না। এই যেমন মেয়েটি একদিন ফ্যানটিকে বলছিল, ‘জানো, আমার না একজন গাছমানুষ ছিল, মানুষটি আমাকে সেভাবে কাছে ডাকেনি আবার আমার কাছেও আসেনি অথচ সে নাকি আমার কারণে একটা আমগাছে নিজেকে সমর্পণ করেছে! কী নিষ্ঠুর! আমাকে ডাকলে বুঝি আমি তার সঙ্গে যেতাম না? নিজেই সে একা কোথায় হারিয়ে গেল! কিন্তু কি জানো? ভালোবাসলে ভালোবাসার মানুষকে কাছে ডাকতে হয়, ভালোবাসার মানুষের ডাকে সাড়া দিতে হয়, হতে হয় সাড়াশীল, নয়তো নিজে থেকেই তার কাছে যেতে হয়। দ্যাখো, তুমি আমগাছ না, তুমি একটা ফ্যান। তারপরও আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি যদি বলো তোমার কাছে চলে আসতে পারি আমি, যেকোনো সময়ে। তোমার কাছে আমি নিজেকে সমর্পণ করতে পারি। তোমাকে জড়িয়ে শূন্যে ভাসতে পারি। তোমার কাছে যাওয়ার জন্য যা লাগে তা আমার অনেক আছে। আমার শাড়ি আছে, আছে ওড়নাও। এ ঘরে টেবিলও আছে একটা। কী বল তুমি? আসব আমি তোমার কাছে?’
তারপর এমনই এক একান্ত দুপুরে ফ্যানের হাওয়া খেতে খেতে মেয়েটি ফ্যানটির কাছে জানতে চেয়েছিল, ‘এবার বল, তুমি আমার কাছে আসবে, না আমি তোমার কাছে?’ এমনতরো কথা বলতে বলতে শীতল ভালোবাসার পরশে কখন যেন ক্লান্ত মেয়েটির মন সুস্থির হলো, চোখজুড়ে নেমে এল একরাশ ঘুম।
ফ্যানটি বোধহয় যথার্থ অর্থেই মেয়েটিকে ভালোবেসেছিল। তাই তার মানুষ ও গাছপ্রেমিকের মতো সে তাকে দূরে রাখতে পারেনি। নিজেই প্রচণ্ড শব্দে অমর প্রেমের ঘোষণা দিয়ে ঝাঁপ দিয়ে নেমে এসেছে তার বুকে, মাথা রেখেছে মজনু কিংবা রোমিওর মতো করে। প্রথমবারের মতো যে প্রেম তার কাছে এসেছে মেয়েটি তাকে প্রত্যাখ্যান করেনি বরং ভালোবেসে বুকে ঠাঁই দিয়েছে।
৩.
সন্ধ্যায় গৃহস্বামী ফিরলেন কিন্তু রোজকার মতো ঘরের দরজাটা আর খুলল না। প্রতিবেশীরা জানাল, দুপুরের দিকে একটি মাত্র ভয়ানক শব্দ তাদের কেউ কেউ শুনেছিল বটে। দরজা ভেঙে যারা যারা ঘরে ঢুকেছিল তাদের কারও কারও কাছে পরে ভালোবাসার সে দৃশ্যটির বর্ণনা শোনা গেছে। তাদের ভাষ্যমতে, ‘বুকটা থেতলে দিয়ে ফ্যানটা পাশেই পড়েছিল। তারপরও বউটির মুখে যন্ত্রণার কোনো আভাস দেখা যায়নি। চোখের কোণ বেয়ে জলের রেখা থাকলেও মনে তার ভালোবাসার পুলক ছিল সেটা নিশ্চিত। তা না হলে মিষ্টি হাসি স্পষ্টতই কী করে তার ঠোঁট দুটি ছুঁয়েছিল?’
কেকা অধিকারী
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ৩০, ২০০৯
Nadim Mahmud Babu
ভালোবাসলে ভালোবাসার মানুষকে কাছে ডাকতে হয়, ভালোবাসার মানুষের ডাকে সাড়া দিতে হয়। লেখাটা পড়ে ভালো লাগলো।