তারকাসুর বধ
অদিতির বারোজন ছেলেই অমৃত খেয়ে অমর। আর দিতির পুত্ররা মহাবীৰ্য্যশালী হয়েও সকলকে একদিন মরতে হল।
কাঁদতে কাঁদতে একদিন দিতি স্বামী প্রজাপতি কশ্যপকে বললেন–হে স্বামী, আপনার ঔরসজাত আমার পুত্রদের কেন এমন দশা হল? আপনি আমার গর্ভে এমন এক পুত্র সৃষ্টি করুন, যে হবে অজেয় বীর।
তখন মহামতি কশ্যপ দিতিকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন–যদি দশ বছর ধরে তুমি তপস্যা করতে পার, তাহলে তোমার যে পুত্র জন্মাবে, সেই পুত্রের সকল অঙ্গ হবে বজ্রসারময়। তাই বজ্ৰাদি কোন অস্ত্রশস্ত্রের দ্বারাও সে বিনষ্ট হবে না।
তখন স্বামীর উপদেশমত দিতি বনে গিয়ে দশ বছর তপস্যা করলেন। তারপর লাভ করলেন এক দুর্জয় পুত্র। তার নাম রাখলেন বজ্রাঙ্গ। ক্রমে বজ্ৰাঙ্গ সব শাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে মা দিতিকে প্রণাম করে জানতে চাইল যে, সে এবার কি করবে।
দিতি মনের আনন্দে বললেন–আমার বহু পুত্রকে ইন্দ্র বিনাশ করেছে, এখন তুমি তার প্রতিশোধ– নাও। সেই উদ্দেশ্যেই আমি তোমাকে সৃষ্টি করেছি।
সেই কথা শুনে বজ্ৰাঙ্গ স্বর্গলোকে গিয়ে পাশের দ্বারা ইন্দ্রকে বেঁধে মা দিতির কাছে নিয়ে এল। বজ্রাঙ্গের এমন ক্ষমতা দেখে ব্রহ্মা এবং তার পিতা কশ্যপ তার কাছে গিয়ে বললেন–পুত্র, এই যে ইন্দ্রকে তুমি বেঁধে নিয়ে এলে, তাতে তোমার কি লাভ হল? ছেড়ে দাও ওকে। সম্মানীয় অপমান মৃত্যুতুল্য। বিশেষ করে আমাদের অনুরোধে যাঁর মুক্তি হল, একরকম মৃতই তিনি।
এমন কথা শুনে দৈত্য বজ্ৰাঙ্গ তাদের বলল–ইন্দ্রে কোন প্রয়োজন নেই আমার। কেবলমাত্র মায়ের আজ্ঞা পালন করেছি। হে প্রপিতামহ, আমি আপনার বাক্য পালন করছি। ইন্দ্রকে মুক্ত করলাম, হে দেব, আমাকে একটি বর দিন, তপস্যায় আমার যেন মতি থাকে। আর তা যেন নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়।
ব্রহ্মা বললেন–হে তাত, আমার নির্দেশ পালন করে তুমি তপস্যাই করলে। এই চিত্তশুদ্ধির দ্বারাই তোমার জন্মের পর্যাপ্ত ফল হয়েছে। .
এই কথা বলে ব্রহ্মা বরাঙ্গী নামে এক কন্যার সৃষ্টি করে বজ্রাঙ্গকে পত্নীরূপে দান করে সেখান থেকে অদৃশ্য হলেন।
তারপর তপস্যার জন্য বজ্রাঙ্গ পত্নী বরাঙ্গীকে সঙ্গে নিয়ে বনে গমন করলেন। হাজার বছর উপরদিকে হাত তুলে হাজার বছর নীচের দিকে মুখ রেখে, হাজার বছর পঞ্চাগ্নির মধ্যে থেকে অনাহারে ঘোর তপস্যা করল। তাতে রাশি রাশি পুণ্য সঞ্চয় হল তার। তারপর এক হাজার বছর জলের মধ্যে থেকে তপস্যা করল।
যখন তপস্যার জন্য সেই দৈত্য জলের মধ্যে প্রবেশ করল, তখন তার স্ত্রী বরাঙ্গী নির্বাক হয়ে অনাহারে তপস্যা করতে লাগল।
ইন্দ্র খুব ভয় পেয়ে বরাঙ্গীর কাছে গিয়ে নানান বিভীষিকা সৃষ্টি করে তার তপোভঙ্গ করার চেষ্টা করলেও দৈত্য পত্নীর কোন ক্ষতিই করতে পারলেন না। বানর, মেষ ও সাপের রূপ ধরে তার তপোবিঘ্নে অক্ষম হয়ে শেষে শৃগালের রূপ ধরে আশ্রমকে অপবিত্র করেন। তারপর মেঘের রূপ ধারণ করে মুষলধারে বৃষ্টিপাত শুরু করলেন। জলে ভাসিয়ে দিতে চান আশ্রমকে।
এভাবে বিঘ্ন সৃষ্টি করে ব্যর্থ হয়েও ইন্দ্র নিবৃত্ত হলেন না। তখন বরাঙ্গী ইন্দ্রকে জানতে পেরে ক্রোধবশে অভিশাপ দিতে উদ্যত হলে, তখন ইন্দ্ৰ আপন রূপ ধরে দৈত্যপত্নীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।
এদিকে বজ্রাঙ্গের জলের মধ্যে তপস্যার হাজার বছর পূর্ণ হল। ব্রহ্মা তুষ্ট হয়ে তাকে বর দেওয়ার জন্য সেখানে এলেন।
বজ্রাঙ্গ ব্রহ্মাকে প্রণাম করে বলল–আমাকে অক্ষয়লোক দান করুন। আমার অসুরভার দূর করুন।
ব্রহ্মা সেই ভাব দূর করে চলে গেলেন। তখন ভীষণভাবে ক্ষুধার্ত দৈত্য নিজের আশ্রমে এসে দেখলেন শূন্য আশ্রম। তার পত্নী সেখানে নেই। ক্ষুধার জন্য ফলমূল সংগ্রহ আর পত্নীকে খোঁজ করার উদ্দেশ্যে সে বনে গেল। সহসা এক জায়গায় ক্রন্দনরতা বরাঙ্গীকে দেখতে পেল।
তখন দৈত্য তাকে জিজ্ঞাসা করল–কি হয়েছে তোমার? এভাবে কাঁদছ কেন তুমি? তোমাকে কেউ অপমান করেছে? বরাঙ্গী বলল–দেবরাজ ইন্দ্র বহু চেষ্টা করেছে আমার তপোবিঘ্নের জন্য। সেই ভয়ে দুঃখে আমি প্রাণত্যাগের কথা চিন্তা করছি। হে স্বামী, তুমি আমায় এক পুত্র দান কর, যে আমার সব দুঃখ দূর করতে পারবে।
পত্নীর মুখে এই কথা শুনে বজ্ৰাঙ্গ রাগে ইন্দ্রের প্রতি প্রতিশোধ নিতে সক্ষম হলেও আবার তপস্যা শুরু করল। তা দেখে ব্রহ্মা এসে বললেন–হে দৈত্য, হাজার বছর নিরাহারে থেকে যে ফল, উপশিত আহার ত্যাগ করে ক্ষণমাত্রেই তা লাভ হয়। তোমাকে আমার অদেয় কিছুই নেই। তপস্যা করতে হবে না। বল, তোমার কি চাই?
বজ্রাঙ্গ ব্রহ্মার কথা শুনে তার স্ত্রীর উপর ইন্দ্রের অত্যাচারের কথা বলে, এক স্বর্গজয়ী পুত্রের কামনা করল। ব্রহ্মা প্রসন্নচিত্তে বললেন–বৎস, তারক নামে তোমার এক পুত্র লাভ হবে।
ব্রহ্মার কথায় দৈত্য খুশী হয়ে বরাঙ্গীকে গিয়ে সব বলল, যথাসময়ে এক হাজার পূর্ণ হয়ে এক ভয়ঙ্কর পুত্র জন্মাল। সেই পুত্রের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে সসাগরা পৃথিবী কম্পিত হল। ভীষণ বায়ু বইতে লাগল। সেই মহাসুরের জন্মের খবর পেয়ে অসুরেরা আনন্দ-উৎসবে মাতোয়ারা হল। অন্যদিকে দেবতারা বিষণ্ণভাবে দিন কাটাতে লাগলেন।
যথাসময়ে সেই তারককে অসুর রাজ্যে অভিষিক্ত করা হল।
পুরুষ যদি আগে উপায় স্থির করে নেয়, তারপরে সে স্থির লক্ষ্মী লাভ করতে পারে। চপল ব্যক্তি কখনই চঞ্চলা লক্ষ্মীকে লাভ করতে পারে না। এই চিন্তা করে তারক তপস্যায় মন দিল। কখন নিরাহারে, কখন গাছের পাতা খেয়ে বা শুধু জল খেয়ে তপস্যাচারণ করতে লাগল। তারপরে দেহ থেকে একটু একটু করে মাংস কেটে আগুনে আহুতি দিল। ক্রমে তার দেহ মাংসহীন হল। তখন সে বহু পুণ্য সঞ্চয় করল। তারকের তপস্যায় দেবতারা খুব ভয় পেয়ে গেল।
সন্তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা তাকে বর দিতে এলেন। বললেন–বৎস তারক, আর তোমার তপস্যার প্রয়োজন নেই। তোমার অসাধ্য এমন কিছুই নেই। কি বর চাও তুমি?
তারক বলল–আমি সর্ব মহাস্ত্র ও সকল প্রাণীর অবাধ্য হব। এই বর চাই। অন্য কোন বরের প্রয়োজন নেই।
এই প্রার্থনা শুনে ব্রহ্মা বললেন–যখন জন্মেছ তখন একদিন না একদিন মরতেই হবে। তবে যার থেকে সহজে মৃত্যুর আশঙ্কা নেই, এমন কোন জনের হাতে তোমার মৃত্যু হবার বর চেয়ে নাও।
তখন তারক বলল–যখন আমার মৃত্যু হবেই, তাহলে সাত বছরের বালকের হাতে আমার মৃত্যু হোক। ব্রহ্মা সেই বরই দিলেন তাকে।
তারক নিজের রাজ্যে ফিরে এসে সিংহাসনে বসল। বড় বড় দানবরা তার সেবা করতে লাগল। বেশ কিছুদিন এভাবে কেটে গেল।
এতদিন দৈত্যরাজ তার মন্ত্রীদের বলল–যদি স্বর্গ জয় না করলাম আমি, তাহলে আমার এ রাজ্যে সুখ কোথায়? শত্ৰু নির্যাতন না করলে মনে স্বস্তি লাভ করতে পারছি না। এখনও স্বর্গে দেবতারা সুখভোগ করছে। আমার আট চাকার রথ সাজাও। দৈত্য সৈন্যদের সাজতে বল। শত্রুজয় করবার জন্য এক্ষুনি যাব।
আদেশ পাওয়া মাত্র যুদ্ধের জন্য সব দৈত্যসৈন্যরা বেরিয়ে পড়ল। ঐ বিশাল বাহিনীর নায়ক দশজন। তারা হলেন জম্ভ, কুজম্ভ, মহিষ, কুঞ্জওর, মেমস, কালা নেমি, নিমি, মথন, জম্ভক আর শুম্ভ।
গ্রসনকে সেনাপতি করা হল। একশ বাঘে টানা রথে সে চড়ল। জম্ভের রথ একশ সিংহে টানে। অসংখ্য পিশাচ কুজম্ভের রথ টেনে নিয়ে চলেছে। মহিষের রথ টানছে বহু উট। কালনেমির রথ টানছে অসংখ্য কুকুর।
মহাকোলাহল করে দানব-সৈন্যরা চলেছে। এক দেবদূত তাদের সমর সজ্জা দেখে কালবিলম্ব না করে স্বর্গে গিয়ে ইন্দ্রকে সেই খবর দিল।
তারক স্বর্গ জয় করতে আসছে শুনে ইন্দ্ৰ ভয় পেলেন। ইন্দ্র জানেন তারক যুদ্ধে কারোর হাতে মরবে না। তখন ইন্দ্র গুরুদেব বৃহস্পতিকে জিজ্ঞাসা করলেন–আপনি বলুন গুরুদেব, আমাদের এখন কি কর্তব্য?
সবদিক বিবেচনা করে বৃহস্পতি বললেন–এমন দৈত্যদের আক্রমণ করাই উচিৎ।
তখন দেবরাজ ইন্দ্র সকল অমরগণকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বললেন। যমরাজ মহিষের পিঠে চড়ে এগিয়ে চললেন। কুবের চললেন মানুষের কাঁধে চড়ে। পবনদেব মৃগে এবং অগ্নিদেব ছাগলের পিঠে চড়ে চললেন। সূৰ্য্য, চন্দ্র, বরুণ কেউই স্থির হয়ে বসে রইলেন না। সকলেই বহু কোটি সৈন্য নিয়ে রণক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন। স্বয়ং দেবরাজ রথে চড়ে সবার শেষে এলেন। রথ চালিয়ে নিয়ে চলল সারথি মাতলি।
যক্ষ, কিন্নর, গন্ধর্ব নাগরাও এল এই যুদ্ধে। দেব সৈন্যদের সংখ্যা হল সর্বমোট তেত্রিশ কোটি। সবার হাতে তির-ধনুক, গদা, চক্র, বজ, খঙ্গ, শূল, তলোয়ার, গরুড়াস্ত্র, ব্রহ্মাস্ত্র প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র। প্রত্যেকের একটাই উদ্দেশ্য যেমন করে থোক, তারকাসুরকে রুখতে হবে।
তারপর দেবতা ও অসুরদের মধ্যে শুরু হল তুমুল যুদ্ধ। রথীর সঙ্গে রথীর, পদাতিকের সঙ্গে পদাতিকের, অশ্বারোহীর সঙ্গে অশ্বারোহী। সেখানে জলধারার মত অস্ত্রের বর্ষণ শুরু হল। রক্তের স্রোত বয়ে যেতে লাগল।
যমরাজ গ্রসনের সঙ্গে যুদ্ধে মাতলেন। দুরন্ত সেই দানব গ্রসনের দাপটে যমসৈন্য কেউই স্থির থাকতে পারল না। যমরাজ গ্রসনের হাতে প্রহৃত হয়ে রাগে তার দণ্ড ছুঁড়লেন। তাতে গ্রসনের কিছু হল না কিন্তু বাঘগুলোর মৃত্যু হল। এমন যমরাজের গায়ে প্রচণ্ড আঘাত করলে, তিনি তাতে জ্ঞান। হারিয়ে ভূমিতে লুটিয়ে পড়লেন।
এদিকে কুবের আর জম্ভাসুরের মধ্যে লড়াইতে, কুবেরের বিক্রম বেশিক্ষণ টিকল না। কুবের পরাজিত হলেন জম্ভাসুরের কাছে। পিশাচ অধিপতি নিঝতি ভীষণ যুদ্ধ করলেন কুজম্ভের সঙ্গে। কিন্তু তিনি হার স্বীকার করতে বাধ্য হলেন।
মহিষাসুর আর বরুণদেবের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে, কেউ কাউকে হারাতে পারছেন না। তখন মহিষাসুর হাঁ করে বরুণদেবকে গিলতে এল। চন্দ্র এই দেহে বহু অস্ত্র মারলেন মহিষের উপর। কিন্তু সবই ব্যর্থ হল। তখন চন্দ্র সোমাস্ত্র নামে নতুন অস্ত্র সৃষ্টি করে, সেটি অসুরদের উপর ছুঁড়ে মারলেন। তাতে ঠাণ্ডায় অসুরদের হাত-পা অবশ হয়ে গেলে, তারা আর স্থির হয়ে দাঁড়াতে না পেরে মাটিতে পড়ে যেতে লাগল। এই সুযোগে দেবসেনারা অসুরদের নির্বিচারে মেরে ফেলতে লাগল।
কালনেমি অসুরদের এমন অবস্থা দেখে আর স্থির থাকতে পারল না। মায়াধারী এই অসুর, মায়ার সাহায্যে নিজের শরীরটাকে বিশাল করে গোটা আকাশটাকে ছেয়ে ফেলল, তারপর হাজার হাজার মায়া সূর্যের সৃষ্টি করল। সেই সব সূর্যের তাপে ঠাণ্ডা দূর হল। আবার দৈত্যসেনারা চাঙ্গা হয়ে উঠতে লাগল।
আবার অসুররা দেবসেনাদের মারতে লাগল। সূর্যদেব এতক্ষণ প্রায় চুপ করেই ছিলেন। কালনেমির এমন কাণ্ড দেখে এক মোক্ষম অদ্ভুত বাণ মারলেন। সেই বাণ রণস্থলের মধ্যে পড়ার পর দেব সেনারা হয়ে দানব সৈন্য আর দানবেরা হল দেবসৈন্য। এ বড় আশ্চর্য ব্যাপার। কিন্তু কালনেমি সূর্যের এমন ধাঁধা বুঝতে না পেরে দেবসেনা মনে করে দানব সৈন্যদের মারতে লাগল।
এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর খুব সন্দেহ হল কালনেমির। তখন সূর্যের এই তাজ্জব ব্যাপার কালনেমিকে জানাল। তখন কালনেমি সাবধান হয়ে বিপরীত পক্ষকে মারতে লাগল।
তা দেখে একটি মোক্ষম অগ্নিবাণ ছুঁড়লেন সূর্যদেব।
তার ফলে দানব সেনাদের গায়ে ভীষণ জ্বালা করতে লাগল। হস্তী ঘোড়ারাও ছটফট করতে লাগল সেই তাপ সহ্য করতে না পেরে।
কালনেমি দানবদের এই অবস্থা দেখে একটি শরের দ্বারা মেঘ আর বৃষ্টির সৃষ্টি করল। আর দেবতাদের সোমস্ত্রকে আরও উন্নত করে ছুঁড়ল তাদেরই দিকে।
এই অবস্থায় দেবতারা নিজেদের প্রাণ বাঁচাবার দায়ে রণক্ষেত্র থেকে যুদ্ধ ছেড়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করলে, কালনেমি তাদের ধারালো অস্ত্রের দ্বারা মারতে লাগল।
তাই দেখে কালনেমির ওপর অশ্বিনীকুমারদ্বয় চড়াও হয়ে বানের পর বাণ ছুঁড়তে লাগলেন। তখন কালনেমি ক্রোধে গর্জন করতে করতে গদা দিয়ে তাদের ভীষণ মারল। সেই গদার আঘাতে দেববৈদ্য অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের রথ চৌচির হয়ে ভেঙে গেল। তখন তারা অন্য একটি রথে চড়ে কালনেমির দিকে বজ্ৰাস্ত্র ছুঁড়ে মারলেন।
কিন্তু রণে মহাদক্ষ কালনেমি বজ্র দেখে নারায়ণাস্ত্র মারল। তার ফলে বজ্রের তেজ নষ্ট হয়ে গেল। তাই দেখে দেববৈদ্যরা ভয় পেয়ে ইন্দ্রের রথের কাছে এসে আশ্রয় নিল।
যত দক্ষ, গন্ধর্ব, কিন্নররা এসেছিল, দেবতাদের সাহায্য করতে, তারাও এই যুদ্ধে বিপর্যস্ত হল। অনেকেই ইন্দ্রের শরণাপন্ন হল। এই অবস্থা দেখে কালনেমি তার সৈন্যবল নিয়ে ইন্দ্রকে ঘিরে ধরল। সকলের তখন ত্রাহি মুধুসূদন অবস্থা। ইন্দ্র সহ অন্যান্য দেবতারা তখন স্মরণ করলেন বিপদহারী মধুসূদনকে।
বিপদের বন্ধু মধুসূদন তখন বহু অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন।
বিষ্ণুকে দেখে দানবদের মধ্যে কোলাহল পড়ে গেল। ঐ কাপুরুষ ইন্দ্রের সঙ্গে না লড়াই করে বিষ্ণুর সঙ্গেই যুদ্ধ করা যাক।
বিষ্ণুকে তারা চারিদিক থেকে আক্রমণ করল। কেশবও পাল্টা আক্রমণ করলেন। দানবরা সবাই বিষ্ণুর আক্রমণে বিপর্যস্ত সেই সময় কালনেমি এক ভীষণ গদা ছুঁড়ল। সেই গদার আঘাতে গরুড় জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাওয়াতে, তার পিঠে বসে থাকা নারায়ণও পড়ে যেতে বাধ্য হলেন। তখন নারায়ণকে লক্ষ্য করে জম্ভাসুর অস্ত্র নিক্ষেপ করাতে তিনিও জ্ঞান হারালেন।
তখন দানব সেনাদের উল্লাস শুরু হল। জ্ঞান ফিরে শ্রীহরি বুঝতে পারলেন–এই দুর্জয় অসুরদের সঙ্গে পেরে ওঠা যাবে না। সঙ্গে সঙ্গেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন তিনি।
শ্রী হরিকে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখে ইন্দ্র ভীষণ ভয় পেয়ে ভাবল, কে তাহলে এখন তাদের সাহায্য করবে?
তখন অদৃশ্য ভাবে নারায়ণ বললেন–হে ইন্দ্র, গ্রসন আমার হাতে নিহত হয়েছে। একমাত্র জম্ভাসুরকে তুমি মারতে পার, তাতে আমি তোমাকে সাহায্য করব। কিন্তু আর কোনো অসুরই আমাদের হাতে বধ্য নয়।
দৈববাণী শুনে ইন্দ্র মনোবল ফিরে পেয়ে লড়াই শুরু করলেন জম্ভাসুরের সঙ্গে। কিন্তু রণে মহাদক্ষ জম্ভাসুর ইন্দ্রের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিল।
ইন্দ্রের এই অবস্থা দেখে আবার নারায়ণ এলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। জম্ভাসুর ইন্দ্রকে উপেক্ষা করে চোখ বুজে নারায়ণের সঙ্গে যুদ্ধ করার কথা চিন্তা করছে। তখন নারায়ণের ইঙ্গিতে সেই সুযোগে ইন্দ্র জম্ভাসুরকে বধ করলেন।
এইভাবে যুদ্ধে গ্রসন ও জম্ভাসুরের নিহত হবার কথা তারকের কাছে পৌঁছোল, সে ক্রোধে অন্যান্য জীবিত দানব সৈন্যদের নিয়ে রণক্ষেত্রে হাজির হল।
শুরু হল আবার ভীষণ যুদ্ধ। ব্রহ্মার বলে বলীয়ান তারকাসুরের বিরুদ্ধে কেউ এগিয়ে এলেন না। তাকে সাহায্য করার জন্য নারায়ণ এলেন। অন্যান্য দেবতারাও এলেন এই যুদ্ধে। তারা সবাই অনেক অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন তারকের বিরুদ্ধে। কিন্তু সব অস্ত্রই ব্যর্থ হল। তারককে ছুঁতেও পারল না।
দানবদের অস্ত্রেই বিধ্বস্ত হতে লাগলেন দেবতারা। এমনকি, এই যুদ্ধে স্বয়ং হরিও পরাজিত হলেন। তারকের সঙ্গে।
জয় হল দানবদের। দানবরাজ তারক মহা উল্লাসে ফিরে গিয়ে সিংহাসনে বসল। কালনেমি এসে বলল–মহারাজ, এখানে কি নিয়ে আসব বন্দীদের? কিংবা অন্য কোথাও রাখব?
আনন্দের সঙ্গে তারক জিজ্ঞাসা করল– কে কে বন্দী হয়েছে?
উত্তরে কালনেমি বলল–ইন্দ্র সহ সব দেবতারাই বন্দী হয়েছেন, আর কেশবও আছেন। তারক বলল-এই ত্রিভুবন এখন আমার অধিকারে। কোথায় আর এদের বন্দী করবে। এদের ছেড়ে দাও। ঘুরে বেড়াক যেখানে খুশী। এর বাইরে তো আর কোথাও যেতে পারবে না।
দানবেন্দ্রের আদেশে সবাইকে ছেড়ে দিল কালনেমি। লজ্জায় দেবতারা আর মাথা তুলতে পারছেন না–কাঁদতে কাঁদতে ইন্দ্র নারায়ণকে বললেন–প্রভু, আপনি সঙ্গে থাকাতেও এই অবস্থা আমাদের কেমন করে হল?
তার উত্তরে নারায়ণ বললেন–বহু কঠোর তপস্যা করে তারক ব্রহ্মার বর পেয়েছে। তার মৃত্যু হবে সাত বছরের একটি ছেলের হাতে। তাহলে তাকে মারার সাধ্য কোথায় আমাদের?
ইন্দ্রসহ দেবতারা চিন্তা করতে লাগলেন, কে সেই বালক, যে হবে তারকের হত্যাকারী? তখন তারা ব্রহ্মার বহু স্তব স্তুতি করলে, ব্রহ্মা জানালেন-তারক এমন তপস্যা করল যে, ত্রিভুবন পুড়ে যাওয়ার উপক্রম হল, তাই আমি তখন বাধ্য হয়ে দেবতাগণের অবধ্য হওয়ার বর দিলাম তাকে। তবে আমি। তার মৃত্যুর ব্যবস্থার করে রেখেছি।
দক্ষযজ্ঞে সতী প্রাণত্যাগ করেছেন। তাই শিব এখনও চঞ্চল। সেই সতী হিমালয়ের কন্যারূপে মেনকার গর্ভে জন্মগ্রহণ করবেন। নাম হবে তার পার্বতী। পার্বতী শিবের আরাধনা করে তাকেই বিয়ে করবেন। তখন পার্বতীর গর্ভে জন্মলাভ করবেন কার্তিক। আর সেই কার্তিকের হাতেই তারকের মৃত্যু হবে। কাজেই কিছুকাল তোমারা অপেক্ষা কর।
যথাসময়ে পার্বতীর জন্ম হল। তপস্যা করলেন। শিবের সঙ্গে বিয়ে হল। তারপর শিবের শক্তি বহুজনের হাত ঘুরে দুজন কীর্তিকার কাছে এল। তাদের কাছ থেকে পেলেন হর-পার্বতী। পুত্রে নাম রাখা হল কার্তিক। ব্রহ্মা তাঁকে সেনাপতি রূপে অভিষিক্ত করলেন।
কার্তিকের যখন সাত বছর বয়স তখন দেবতারা তাকে তারকের কথা শোনালে, কার্তিক বললেন–আপনারা নির্ভয়ে থাকুন। ব্রহ্মা যখন বলেছেন যে, সে আমার হাতে মরবে, তাহলে আর চিন্তা কিসের!
বালকের কথা শুনে দেবতাদের মনে আশার সঞ্চার হল, এবার তাহলে নিশ্চয় তারক মরবে।
তখন ইন্দ্র এক দূত পাঠালেন তারকের কাছে। সে তখন গিয়ে তারককে বলল–হে দানবেন্দ্র, এই ত্রিভুবন উৎপীড়ন করে তুমি যে পাপ করেছ, তার শাস্তি এখন পাবে।
দূতের মুখে ইন্দ্রের অস্পর্ধার কথা শুনে দেখে তারক অবাক হয়ে ভাবল বারে বারে যুদ্ধে পরাজিত হয়েও কি এতটুকু লজ্জাবোধ নেই ইন্দ্রের? দূত চলে যাওয়ার পর দানবেন্দ্র তারক চিন্তা করল–ইন্দ্রে এমন সাহস হল কেমন করে? নিশ্চয় কারো আশ্রয় পেয়েছে।
এমন সময়ে সেই অসুর দেখল–আকাশ থেকে রক্ত বৃষ্টি হচ্ছে। চোখ আর বাহু কাঁপছে। প্রাণীগণ অমঙ্গল সূচক রব করছে।
কয়েকদিন পরে তারকের দূত এসে খবর দিল–যুদ্ধের জন্য দেবতারা আসছে। তারক তাড়াতাড়ি প্রাসাদের ছাদে উঠে দেখল-ময়ূরের পিঠে একটি বালক, হাতে ধনুর্বাণ আর দেবসৈন্যরা তার চারিদিকে তারই জয়ধ্বনি দিতে দিতে আসছে।
সেই বালককে দেখে ব্রহ্মার কথা মনে পড়ল তারকের। সাত বছরের বালকের হাতে তার মৃত্যু হবে। তাহলে এই কি সেই মৃত্যুরূপী কাল তার?
দানব সেনাদের তৈরী হতে বলে নিজেই তারক এগিয়ে গেল সেই বালকের কাছে। তারপর বলল-বালক, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, তোমার যুদ্ধ করবার ইচ্ছা হয়েছে। তুমি এমন বালক, খেলাধুলা করবে। তা ছেড়ে যুদ্ধের জন্য এসেছ? তুমি ভয়ঙ্কর দানবদের এখনও দেখনি।
দানবেন্দ্রের কথা শুনে কার্তিক হেসে বলল–আমাকে বালক দেখে অবজ্ঞা কোরো না। আমাকে যাচাই করতে চাও, দেখ তবে।
কার্তিকের এমন কথা শুনে দানবেন্দ্র তারক খুব রেগে গিয়ে তার দিকে একটা মুদগর ছুঁড়ে মারল। কুমার বর্জ্যের দ্বারা সেই মুদগরকে বিনষ্ট করে দিলেন। তার একটা ভিন্দিপাল ছুঁড়লে কার্তিক সেটাকে হাতে ধরে, তাকে মুগুর তুলে মারলেন। তারক বুঝতে পারল বালকের শক্তি কত। এ যে সে বালক নয়। নিশ্চয় ব্রহ্মার কথামতো সেই বালক, তার কাল।
ইতিমধ্যে শত শত দানবসেনারা আক্রমণ করলে, কার্তিক নানান অস্ত্র মারতে লাগলেন দানবদের উপর। অস্ত্রের আঘাত সহ্য করতে না পেরে দানবরা প্রাণ ভয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালাল। এই দেখে তারকাসুর খুব রেগে গিয়ে একটা গদা ছুঁড়ে মারলো। তার আঘাতে কার্তিক আহত হলেন। তারপর তারক একটি ধারাল বাণ ছুঁড়লে, কুমারের বাহন ময়ূর বাণের আঘাতে রণক্ষেত্র ছেড়ে পালান।
কুমার তখন একটি অস্ত্র নিয়ে তারককে উদ্দেশ্য করে বললেন–ওরে দানব, আজ আমার এই শক্তির প্রহারে তোমার বিনাশ হবে। যদি এই অস্ত্র নিবৃত্ত করার শিক্ষা তোমার জানা থাকে, তাহলে স্মরণ কর।
এই কথা বলে কার্তিক সেই শক্তি দানবের প্রতি প্রয়োগ করলেন। দানবের পাষাণময় হৃদয় বিদীর্ণ হল, তারকের প্রাণহীন দেহ ভূতলে লুটিয়ে পড়ল। দেবতারা আনন্দোৎসবে মেতে উঠলেন।