পার্বতীর তপস্যা ও শিবের সাক্ষাৎলাভ
পিতা দক্ষের যজ্ঞসভায় সতী পতিনিন্দা শুনে সহ্য করতে পারেন নি। তিনি প্রাণত্যাগ করেন। তারপর জন্মগ্রহণ করলেন হিমালয়ের কন্যারূপে। তার নাম হল পার্বতী। তিনি পুনরায় শিবকে পতিরূপে পাবার অভিলক্ষিত হলেন। এর কারণে তিনি সখীর সঙ্গে শিবের সেবার জন্য হিমালয়ে যান। সেখানে মদন দহন দেখে তিনি ফিরে আসেন পিত্রালয়ে।
তার এখন কিছুই ভাল লাগছে না। নিজের রূপকে ধিক্কার দিচ্ছেন। কোনো কাজেই আনন্দ পাচ্ছেন না। মুখে শুধু ‘শিব’ নাম উচ্চারণ করছেন।
সেই সময় নারদ ঋষি তার কাছে আসেন। শিবকে পাবার একমাত্র উপায় তপস্যা, তা তিনি জানিয়ে দেন। কঠোর তপস্যা ব্যতীত তাঁকে বশীভূত করার অন্য কোনো উপায় নেই।
পার্বতী তখন মহাদেবকে পাবার জন্য তপস্যা করবেন বলে ঠিক করেন। পিতা হিমালয়কে নিজের মুখে পতি বিষয়ক কথা বলতে তিনি লজ্জা পেলেন। তাই এই কথা বলতে তিনি দুজন সখীকে পাঠালেন পিতার কাছে।
সখীরা হিমালয়ের কাছে গেল এবং বলল, গিরিরাজ আপনার কন্যা পার্বতী শিবকে পতিরূপে পাবার জন্য তপস্যা করবেন বলে মনস্থির করেছেন, দেবর্ষি তাকে এমন উপদেশ দিয়েছেন, অন্য কোন উপায়ে দেবাদিদেবকে লাভ করা যাবে না। তাই আপনি পার্বতীকে তপস্যা করার অনুমতি দিন।
দুই সখীর কথা শুনলেন হিমালয়। বললেন, এতো পরম সৌভাগ্যের কথা। আমি খুব আনন্দিত হয়ে অনুমতি দিচ্ছি। তবে তার মা মেনকার অনুমতি নিলে ভাল হয়। যদি তিনিও অনুমতি দেন তাহলে আমাদের গোটা কুলই ধন্য হবে। এর চেয়ে মঙ্গলকর আর কি আছে?
তখন দুই সখী পিতা হিমালয় রাজের অনুমতি নিল এবং তারপরে তারা পার্বতীর মায়ের কাছে গিয়ে বলল–আপনার কন্যা দেবাদিদেবকে পতিরূপে পাবার জন্য মহাদেবের তপস্যা করবেন বলে ঠিক করেছেন। এতে গিরিরাজ সম্মত হয়েছেন। এখন আপনিও যদি অনুমতি দেন তাহলে পার্বতীর মনোবাসনা পূর্ণ হবে।
মেনকা সব শুনে দুঃখিত হলেন। কন্যা উমাকে ডেকে বললেন, তুমি পূর্বজন্মে অনেক তপস্যা করেছিলে তাই তুমি আমাদের কন্যা। পার্বতীর তপস্যা শুরু হল। তখন শিব একজন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের রূপ ধারণ করেন। এবং তারপরে তিনি পার্বতীর আশ্রমে যান।
আশ্রমে অতিথিকে দেখে পার্বতী তাকে অভ্যর্থনা জানান এবং ফলাদি খেতে দেন। ফুল দিয়ে অতিথির পূজা করেন। তারপর তাঁর কুশল জিজ্ঞাসা করলেন।
তখন শিব নিজের আসল পরিচয় গোপন করলেন। পার্বতীর কাছে জানতে চাইলেন, দেবী তোমার এ আশ্রমে জল-ফলাদি সবসময় পরিপূর্ণ থাকে দেখছি। কিন্তু তুমি কেন নবীন বয়সে তপস্যা করছো? তাই তোমাকে জিজ্ঞেসা করতে চাই, তুমি তো সব বরই পেতে পারো, তাহলে এমন কী বর আছে যা পাবার জন্য তপস্যা করছো?
লজ্জায় পার্বতী কিছু বলতে পারলেন না। তিনি হিমালয় নন্দিনী বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের জিজ্ঞাসার উত্তরে তাঁর প্রার্থিত অভিলাষ তার সখীদের দ্বারা ব্যক্ত করালেন। মহাদেবকে পাবার জন্যই এমন তপস্যা করছেন। এই গাছগুলি পার্বতী রোপণ করেছিলেন। সেগুলোই এখন ফল প্রদান করছে। কিন্তু আমার সখীর মনোবাসনার কোনো ফল দেখতে পাচ্ছি না।
আমার সখী প্রথমে তার রূপের পসরা নিয়ে শিবের তপস্যা করেন। কিন্তু শিবকে রূপ দ্বারা বশ করা যায় না। তারপরে দেবর্ষি পরামর্শ দেন তপস্যা করার, এবং এজন্যই তিনি তপস্যা করছেন।
সখীর মুখে সব কথা শুনলেন সেই ছদ্মবেশী মহাদেব। শুনে বললেন, এইসব কথা কি সত্য? নাকি পরিহাস? তখন পার্বতী বললেন, আমার সখী যা বলেছেন, তা সবই সত্য। আমি মনে মনে শিবকেই পতিরূপে বরণ করেছি। কোনো নারীর পক্ষে তাকে পতিরূপে পাওয়া পরম সৌভাগ্য।
বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ পার্বতীর কথা শুনলেন। তিনি মনে মনে ভেবেছিলেন তার সঙ্গে মিত্ৰতা করবেন। কিন্তু এখন অন্যরকম মনে হচ্ছে। আমার সম্মান ও ভক্তির পাত্র হয়েছিলে তুমি। তোমার কথা শুনে সেই শ্রদ্ধা ভক্তি নষ্ট হয়ে গেল।
এই কথা বলে বৃদ্ধ আসন ছেড়ে উঠে পড়লেন। তখন পার্বতী তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি আমার মধ্যে কি বিপরীত ভাব দেখতে পেলেন, আমাকে বলুন। তখন বৃদ্ধ তাকে সব বললেন, “তুমি তো সোনা ফেলে কাঁচের কদর করছো। চন্দন না মেখে কাদা মাখতে যাচ্ছো। হাতিকে বাদ দিয়ে বলদকে বাহন করতে চাইছ। গঙ্গার জল ফেলে দিয়ে কূপের জল পান করতে চাইছো। তুমি দেবতাদের বাদ দিয়ে দানব সহবাস চাইছো। তুমি দেবতাদের বাদ দিয়ে মহাদেবের প্রতি অনুরক্ত হয়েছে। এটা কিন্তু লোকবিরুদ্ধ কাজ করছ।”
“হে কমলনয়না, তুমি কোথায় আর সেই শঙ্করই বা কোথায়? তোমার মুখ পূর্ণিমার চাঁদের মতো অতীব সুন্দর। আর শিব পাঁচমুখো, তোমার মাথার খোঁপা সৌন্দর্য আবর্তিত আর সেখানে শিবের মাথায় জটা। তোমার সারা গায়ে চন্দনের লেপন, কিন্তু শিব সারা গায়ে ছাই মেখে আছেন। তোমার গায়ে অলঙ্কার আর শিবের গলায় সাপ। এই দুয়ের কোন তুলনা হয়?”
“তোমার সব আত্মীয়রা দেবতা। আর অন্যদিকে মহাদেবের পরিজন হল ভূত, পিশাচের দল। তাই বলছি তোমার সঙ্গে শিবের কোনো তুলনা হয় না। এবং মহাদেবের কোনো সম্পত্তি নেই। তিনি তো শ্মশানে ঘুরে বেড়ান আর তুমি হলে গিরিরাজের কন্যা।”
তিনি সুন্দরী কন্যার পাত্র হবার কোন যোগ্যতা শিবের নেই। তাঁর কণ্ঠ বিষে পূর্ণ। তাকে সকলেই অনাদর করে। তাই তো তিনি বনে ঘুরে বেড়ান, তাঁর কোনো জাতের ঠিক নেই। কোন জ্ঞান বিদ্যাও তাঁর নেই। তাই তোমাকে বলছি তুমি তার সঙ্গে তোমার মনের যোগ ছিন্ন কর। অন্য কোন দেবতাকে পতিরূপে গ্রহণ করো।
এমন ব্রাহ্মণের মুখে শিবের নিন্দা শুনে পার্বতী ক্রোধে জ্বলতে থাকলেন। তিনি বললেন, ব্রাহ্মণ আপনি শিবের বিষয়ে কিছুই জানেন না। আমার মনে হচ্ছে আপনি কোন ছদ্মবেশী ব্রাহ্মণ। যাইহোক শিবের প্রকৃত গুণ আমার কাছ থেকে শুনে নিন।
শিব পরম মঙ্গলময়, নির্গুণ, কখনো কখনো কারণবশে সগুণ হন। তিনি তো সদাশিব। তাই সকল বিদ্যাই তাতে অধিষ্ঠান করে। তাই তিনি পরমাত্মা এবং এইজন্য তাঁর বিদ্যার প্রয়োজন হয় না। তার থেকেই প্রকৃতির উদ্ভব। তাই তার শক্তির হিসাবের প্রয়োজন কি?
যে নিত্য শিবের আরাধনা করে তার শক্তির বিকাশ হয়। তার সেবা করে মানুষ নিশ্চিত মৃত্যুকে জয় করে। তাই তিনি মৃত্যুঞ্জয়। যারা পাপী হয় তারা শিবের আসল তত্ত্ব জানতে পারে না। যারা শিবের প্রকৃত তত্ত্ব না জেনে তার নিন্দা করেন তার সকল পুণ্য নষ্ট হয়ে যায়।– পার্বতী ক্ষোভের সঙ্গে এই কথাগুলি বললেন। তারপর তার সখীকে বললেন, এই শিব নিন্দুকের মুখ আমি দেখতে চাই না। শিবের যে নিন্দা করে, আর যে সেই নিন্দা শোনে তারও পাপ হয়। আমার মনে হচ্ছে এই বিপ্র আবার শিবনিন্দা করবেন। তাই চলো, আমরা অন্য কোথাও চলে যাই।
পার্বতী তাঁর সখীদের সাথে চলে যাবার উদ্যোগ নিচ্ছেন, তখনই ব্রাহ্মণ সাক্ষাৎ শিবমূর্তি ধারণ করলেন, এবং পার্বতীর হাত ধরে তাকে আটকালেন।
এতদিন পার্বতী যে মূর্তির ধ্যান করেছেন, সেই মূর্তি তিনি চোখের সামনে দেখে লজ্জা পেলেন। তখন শিব তাকে বললেন, প্রিয়ে, তুমি আমাকে ছেড়ে কোথায় যাবে? আমি তোমার তপস্যায় প্রসন্ন হয়েছি। এখন বর চাও। এখন আমি তোমার প্রেমের দাস হলাম। এবার তুমি লজ্জা ত্যাগ করো। চলো আমার গৃহে নিয়ে যাই।
তখন লজ্জাবনত পার্বতীর হয়ে তার সখীরা মনের কথা বললেন–এখন আপনার অনুমতিতে পিতৃগৃহে যাচ্ছি। কীর্তিমান পুরুষেরা যেমন বিবাহ করেন, ঠিক সেই রীতিতেই আপনি আমাকে বিবাহ করে ঘরে নিয়ে আসুন।
সখীর মুখে উমার মনের কথা জানতে পেরে শিব বললেন, তাই হবে।
এই কথা বলে শিব সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। তপস্যায় শিবের সাক্ষাৎ পেয়ে পার্বতী নিজের গৃহে তথা হিমালয়ে ফিরে গেলেন।
পার্বতীর মনের বাসনা পূর্ণ করার জন্য মহেশ্বর নিজের বিয়ের উদ্যোগ শুরু করে দিলেন। তিনি সাতজন ঋষিকে ডাকলেন। তারা শিবের আহ্বানে কৈলাসে এলেন। সেই সপ্তর্ষির সঙ্গে অরুন্ধতীও এসেছেন।
তারা সকলে মহেশ্বরকে প্রণাম জানালেন এবং বললেন, হে দেবাদিদেব মহেশ্বর, আমাদেরকে আপনি ডেকেছেন কেন? আপনি তো স্বয়ং পরিপূর্ণ, তবুও আমাদের সৌভাগ্য হেতু, যদি কৃপা করেন, তাহলে আমাদের আদেশ করুন।
ঋষিদের কথা শুনে শিব খুশি হলেন। এবং বললেন–ঋষিরা সবসময় পূজ্য, আমি বর্তমানে গিরিরাজের কন্যা পার্বতীকে বিবাহ করতে চাই। তাই আপনারা ঘটকরূপে গিরিরাজের কাছে যান।
শিবের ইচ্ছাতে সপ্তর্ষি ও অরুন্ধতী গিরিরাজের কাছে গেলেন। হিমালয় নিজের প্রাসাদ থেকে দেখলেন–যেন সাতটি সূর্য এক সঙ্গে তার গৃহের দিকে আসছেন। এমন জ্যোতিষ্মন সেই ঋষিগণ, তিনি তাঁর পত্নী মেনকাকে ডাকলেন, এবং বললেন, আমার জীবন আজ ধন্য হলো, আমরা গৃহস্থ, তাই এই অতিথিদের সেবার ব্যবস্থা কর। ব্যবস্থাতে যেন কোনরূপ ত্রুটি না হয়।
ঋষিগণ প্রাসাদ সম্মুখে এসে হাজির হলেন। তখন গিরিরাজ সস্ত্রীক সঙ্গে এসে প্রণাম জানিয়ে তাদের প্রাসাদের ভেতরে নিয়ে গেলেন। পবিত্র স্থানে বসতে দিলেন। বললেন, হে ঋষিগণ, আজ আমার গৃহ ধন্য মনে হয়। আমার এই গৃহটি পবিত্র করতেই আপনারা এসেছেন। এখন আপনারা আদেশ করুন, আমি আপনাদের জন্য কি করতে পারি?
মহেশ্বরকে স্মরণ করে ঋষিগণ বললেন, হে গিরিরাজ তুমি ধন্য, এবং ভাগ্যবানও বটে। শিব পরোপকারের জন্য সন্তান সৃষ্টি করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। আমাদের দ্বারা স্বয়ং শঙ্কর তোমার কন্যা পার্বতীকে বিবাহের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। শিব জগৎগুরু সেই শিবের অনুগ্রহে তোমার কন্যা জগজ্জননী হবেন। সেই শিবকে তুমি কন্যা দান কর। তাহলে তোমার জন্ম সার্থক হবে।
ঋষিদের মুখে শিবের মনোবাসনা জানতে পেরে গিরিরাজ খুশি হলেন। তিনি পার্বতীকে নানা অলংকারে শোভিতা করে তাদের সামনে আনলেন। বললেন, হে ঋষিশ্রেষ্ঠগণ, আজ আমি এই কন্যাকে ভিক্ষা দেব।
গিরিরাজের কথা শুনে ঋষিগণ প্রসন্ন হলেন এবং তারা গিরিরাজকে, বললেন, তোমার দুয়ারে আমাদের মত ভিক্ষুক যখন উপস্থিত হয়েছে তখন তুমি নিজেই দাতা আর পার্বতীকে ভিক্ষার বস্তুরূপে কল্পনা করেছ, তাহলে এর থেকে উত্তম আর কি হতে পারে? তোমার শিখরগুলো যেমন উচ্চ তেমনি তোমার মনও খুব উঁচু।
তারপর ঋষিগণ কন্যার প্রতি আশীষ বাণী উচ্চারণ করলেন, এবং মঙ্গল কামনা করলেন। তারপর বললেন, তুমি মহাদেবকে সুখী কর।
মেনকা সব শুনে চোখের জল দমন করতে পারলেন না। তাই দেখে অরুন্ধতী বললেন, তুমি পরম সাধ্বী, তোমার কন্যা আপন গুণেই মহাদেবের মন হরণ করেছে।
এই বলে তিনি হলুদ ও কুমকুম দিয়ে মেনকার চোখের জল মুছিয়ে দিলেন।
ঋষিগণ চতুর্থ দিনে বিবাহের লগ্ন স্থির করলেন। গিরিরাজের কাছে বিদায় নিয়ে শিবের কাছে চলে এলেন। শিবের কাছে সকল কথা জানালেন। তখন শিব বললেন, আপনারাই এই বিবাহে পৌরোহিত্য করবেন। আপনারা আপনাদের শিষ্যদেরও সঙ্গে আনবেন। তারপর ঋষিগণ শিবকে প্রণাম করলেন এবং তারা তাদের আশ্রমে চলে গেলেন।
এতক্ষণ মহেশ্বর মহাকাশীতে ছিলেন।
তিনি নিজের বিবাহ অনুষ্ঠানের জন্য কৈলাস পর্বতে এলেন। নারদকে ডেকে পাঠালেন, শীঘ্র উপস্থিত হলেন দেবর্ষি। সব শুনে খুব খুশি হলেন। মহাদেব দেবর্ষিকে ভার দিলেন সবাইকে নিমন্ত্রণের জন্য। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, দেবগণ, যক্ষ, গন্ধর্ব, কিন্নর, সিদ্ধাদি কেউ যেন বাদ না পড়ে। তারপর তিনি বললেন, যারা আমার বিয়েতে আসবেন না তারা কেউ আমার আত্মীয় নন।
নারদ খুব আনন্দিত হলেন। ত্রিভুবনের সবাইকে নিমন্ত্রণ করলেন। এরপরে ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতাগণ শিবের জন্য বহু উপহার পাঠিয়ে দিলেন, অপ্সরা ও গন্ধর্বগণ এসে গীত, বাদ্য ও নৃত্য করতে শুরু করলেন। শিবকে সাজানোর কাজে নিমগ্ন হলেন।
শিব তো সব সময় পরিপূর্ণ। তাই তার বেশভূষা স্বতঃসিদ্ধ, এইজন্য তাঁর বেশভূষার কোন প্রয়োজন ছিল না। চাঁদ হল তার মুকুট। কপালের তৃতীয় নয়নটি হল তিলক। কানের কুন্তলটি তো ছিলই। গায়ে চন্দন লেপন করলেন, তাঁর সর্প নানারকম মণিময় অলঙ্কারে পরিণত হলো। শিবের প্রভাবে প্রকৃত বস্তুগুলি কৃত্রিমরূপ ধারণ করল। এইসবের পরে তার রূপ এমন সুন্দর হল যে, তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।
শিবের অনুচরগণ নানারকম সাজসজ্জা করল ও বাদ্য বাজাতে লাগল। শিবের বিয়েতে বরযাত্রী হবার জন্য ব্রহ্মা বিষ্ণু প্রমুখ দেবতাগণ আর সকল ঋষিগণ কৈলাসে হাজির হলেন। গঙ্গা, সাগর, নদী, তাঁরাও দিব্যরূপ ধারণ করে কৈলাসে এলেন। গান্ধর্ব চারণ, সিদ্ধ, কিন্নর, যক্ষ সকলেরই আজ খুব আনন্দ, সকলেই অপূর্ব পোশাক পরে এসেছেন।
শুভলগ্ন উপস্থিত হতেই কৈলাস থেকে সবাই হিমালয়ের উদ্দেশে রওনা দিলেন। শিব দেবতাদের আগে আগে যেতে বললেন। তখন বিভিন্ন রকমের বাদ্য-বাজনা, নানা ধরনের আতসবাজি পোড়ানো হতে লাগল। সে সত্যিই একটি অপূর্ব দৃশ্য! এমন বরযাত্রীর শোভাযাত্রা এর আগে কেউ কখনো প্রত্যক্ষ করেনি।
এদিকে গিরিরাজ হিমালয় তার সকল আত্মীয়স্বজনদের নিমন্ত্রণ করেছেন। তাদের সাহায্য নিয়ে বিধিমতো মণ্ডপাদি তৈরি করেছেন। মণ্ডপে সাজানো হয়েছে, বিচিত্র সব তোরণ রঙবেরঙের পতাকা, কত ধরনের ফুলের মালা এবং বহু ধরনের গাছের পাতা। সেই সময় হিমালয় গৃহের শোভা সত্যিই অবর্ণনীয়।
গিরিরাজ কন্যা উমাকে সম্প্রদানের জন্য স্নান করানো হলো, তাকে নানা অলংকারে সজ্জিত করা হলো। সব আয়োজন শেষে ভৃত্য ও গন্ধমাদন গেলেন শিবকে আনতে। শিবের প্রতীক্ষায় রইলেন। গিরিরাজ ও তার আত্মীয়স্বজনেরা।
এমন সময়ে দেবাদিদেব তাঁর সকল বরযাত্রীদের নিয়ে গিরিরাজের ভবনের কাছে এসে পৌঁছলেন। সেই মহাশব্দ শুনে গিরিরাজ নিজেকে ধন্য মনে করলেন এবং তিনি তার আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে আদর ও অভ্যর্থনা জানাতে প্রাসাদের বাইরে শিবের কাছে উপস্থিত হলেন। শিবের দলবল দেখে হিমালয়বাসীরা অবাক হয়ে গেলেন। আবার গিরিরাজের দলবল দেখে দেবতারাও অবাক হলেন।
এইভাবে গিরিদল আর শিবদলের মিলন ঘটল। বরযাত্রীর দল ক্রমশ আসছে। যখন এগিয়ে প্রায় গিরিরাজের গৃহের কাছে উপস্থিত। তখন গিরিরাজের পত্নী মেনকা নারদকে নিয়ে ছাদে দাঁড়ালেন এটা দেখার জন্য যে, তার মেয়ে উমা যাকে পাবার জন্য এতো তপস্যা করলো তিনি কত সুন্দর!
শিব অন্তর্যামী তিনি মেনকার অভিসন্ধি জানতে পেরে তার যাতে বুদ্ধিভ্রম হয় তেমন রূপ দেখালেন।
মেনকা সুন্দর সাজে সজ্জিত দেবতাদের দেখে ভাবলেন শিব এঁদের অধিনায়ক, তাঁকে নিশ্চয়ই আরো সুন্দর দেখতে হবে।
এই শোভাযাত্রার সামনে সামনে চলেছেন গন্ধর্বগণ। তারা সকলে নানা অলঙ্কারে সজ্জিত। তারা নানা রকম বাহনে চড়ে আসছে। কত বাজনা বাজছে। নানা রকম নৃত্য হচ্ছে। সেই গন্ধবদের নায়ক বিশ্বাসুকে দেখে মেনকা খুব খুশি মনে তাকে শিব ভাবতে লাগলেন। তখন নারদ বললেন, ইনি দেবতাদের একজন গায়ক। দেবর্ষির কথা শুনলেন মেনকা, এবং ভাবলেন শিব নিশ্চয়ই এর থেকেও সুন্দর হবে।
তারপর এলেন যক্ষের দল। তাদের অধিপতি কুবের। তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে মেনকা তাইে শঙ্কর মনে করলেন।
নারদ বললেন, ইনি যক্ষরাজ কুবের।
তারপর এলেন বরুণ। যিনি রূপে সবার থেকে অধিক সুন্দর। তার দলবলও ততোটাই সুন্দর। তখন মেনকা ভাবলেন, এই শিবকে পেলে উমার জীবন সত্যিই সার্থক হবে। কিন্তু নারদের কথায় তিনি অবাক হলেন।
তারপরে এলেন যমরাজ। বরুণের থেকেও যমের শোভা অতুলনীয়। কিন্তু তিনিও শিব নন, নারদের মুখে এই কথা শুনে মেনকা বিস্মিত হলেন।
এরপরে ক্রমে ক্রমে দ্বিগুণ সৌন্দর্য নিয়ে এলেন ইন্দ্র, সূর্যদেব, চন্দ্রদেব, এঁদের পেছনে এলেন ব্রহ্মা। মেনকা তাঁকেই রুদ্র মনে করলেন। নারদ উত্তর দিলেন, ইনি শিব নন।
এদের পরে এলেন বক্ষে শ্রীবৎসচিহ্ন, শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী কমললোচন লক্ষ্মীপতি বিষ্ণু, কোটি মদনের সমতুল্য তার লাবণ্য।
তাকে দেখে মেনকা স্থির করলেন, ইনিই শিব, আমার কন্যা সত্যিই ভাগ্যবান, নারদ বললেন, ইনি নারায়ণ। মেনকা অবাক হলেন এবং বললেন, বরযাত্রীরা যদি এতো সুন্দর হয় তাহলে শিব তো অতীব সুন্দর হবে।
নারদ বললেন, আপনি ঠিক বলেছেন, শিব এদের সবার থেকে শ্রেষ্ঠ এবং সুন্দর।
তারপর মহা আনন্দে এলেন ভৃগু, আদি মুনিগণ, গঙ্গাদি তীর্থগণ। সবার মুখে মুখে বেদধ্বনি, এঁদের মধ্যে বৃহস্পতিকে দেখে মেনকা ভাবলেন, ইনিই শিব, কিন্তু নারদ বললেন, ইনি শিব নন।
মেনকা নারদের কথা শুনলেন, এবং মনে মনে ভাবলেন যিনি বৃহস্পতির থেকেও শ্রেষ্ঠ অর্থাৎ শিব কেমন হবেন?
ঠিক সেই সময় রুদ্র এসে দাঁড়ালেন। নারদ বলে উঠলেন, ইনিই শিব। তখন নারদ অঙ্গুলি দিয়ে শিবের অনুচরদের দেখিয়ে দিলেন। এরা সব ভূত, প্রেত, পিশাচ, কারো মুখ ছিল বাঁকা, কারো আবার কদাকার। এদের বর্ণ ছিল কৃষ্ণ, এরা কেউ খোঁড়া ছিল, কেউ উ পায়ে হাঁটছে। কেউ সারাক্ষণ বাজে কথা বলছে। কেউ করতালি দিচ্ছে, কেউ নিন্দা করছে, কেউ ডমরু বাজাচ্ছে। তারা এমন ব্যবহার করছিল যাতে মেনকা এদের দেখে ভয় পান।
এদেরকে দেখে মেনকা সত্যিই ভীত হলেন। তার মন অস্থির হয়ে পড়ল। তারপরে তিনি পাঁচমাথা, তিন চোখ, দশ হাত, ভস্মমাখা, বাঘছাল পরা, পিনাক হাতে শিবকে দেখতে পেলেন। তিনি একটি ষাঁড়ের উপর চড়ে আসছেন। তখন নারদ অঙ্গুলি নির্দেশ করে দেখিয়ে দিলেন, ইনিই শিব।
ঝড়ে যেমন করে গাছ উপড়ে পড়ে তেমনি করে নারদের মুখে এই কথা শোনার পর মেনকা মূৰ্ছিত হয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পরে তার জ্ঞান ফিরল এবং তিনি বললেন, তুই একি করলি? তোকে ধিক্ আর আমাকেও ধিক্! তারপরে তিনি শিব ও নারদকে তিরস্কার করলেন এবং উমাকেও নিন্দা করলেন।
নারদকে তিনি দোষারোপ করলেন। তার কারণ নারদই উমাকে শিবকে পাবার জন্য তপস্যা করতে বলেছিলেন। আপনি উমাকে বঞ্চনা করেছেন। এতে কারোর কোন ক্ষতি হবে না। ক্ষতি হবে আমার কন্যার, আমার গৃহের মর্যাদার।
মেনকা তখন যে ঋষিগণ শিবের জন্য উমাকে চাইতে এসেছিলেন তাঁদের অনুসন্ধানে রত হলেন। ক্রোধান্বিত হয়ে বিলাপ করতে লাগলেন, প্রত্যেকের গোঁফ দাড়ি ছিঁড়ে ফেলবো। আর সেই মুনিদের সঙ্গে যিনি এসেছিলেন, বশিষ্ঠের পত্নী অরুন্ধতী, তিনি এখন কোথায়? না, না এদের দোষ কোথায়? সব দোষের মূল তো আমার কন্যা।
সেই তো দেবতাদের ত্যাগ করে শিবকে বেছে নিয়েছে! সোনা ছেড়ে কাঁচকে বেছে নিয়েছে, চন্দন ফেলে কাদা মাখলো, হাঁসকে ছেড়ে কাককে ধরলো, সূর্যকে বাদ দিয়ে জোনাকির আলোকে বেছে নিল। সিংহের সেবা না করে শৃগালের সেবা করল।
হায়রে আমার কপাল, পার্বতী ধিক্, তোর বুদ্ধিকেও ধিক! এমন সন্তান হবার চেয়ে আমি বন্ধ্যা হলাম না কেন? পার্বতী যখন বনে তপস্যা করতে গিয়েছিল তখন তাকে বাঘ ভাল্লুকে খেয়ে নিলে ভালো হত। আজ আমি নিজেই তাকে মেরে ফেলব।
কাঁদতে কাঁদতে মেনকা আবার অচেতন হয়ে পড়লেন। এমন সময় ব্রহ্মা সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি তার কমণ্ডলুর জল ছিটিয়ে মেনকার জ্ঞান ফেরালেন। তারপর বললেন–মেনকা, তুমি শিবের যথার্থ রূপ দেখনি। তিনি স্বয়ং লোককর্তা, তিনি সকলকে পালন করেন, এবং তিনিই অন্তিমে সকলকে বিনাশ করেন।
ব্রহ্মার কথা মেনকা বুঝতে পারলেন না। তিনি বললেন, আপনারা পার্বতীকে বিনাশ করুন, কিন্তু শিবকে কন্যাদান করতে বলবেন না। মেনকার কথা সেখানে উপস্থিত সকল দেবতারা শুনলেন এবং তারা বললেন, শিব হলেন দুঃখনাশক এবং পরম ভগবান, আজ আমাদের পরম সৌভাগ্য যে আমরা শিবের সঙ্গে তোমার কন্যা পার্বতীর মিলন দেখতে পাব।
দেবতাদের কথা শুনেও মেনকা তার মত পরিবর্তন করলেন না। তিনি পুনরায় বললেন, তোমরা আমাকে মেরে ফেল, আমি কিছুতেই কুরূপা শিবের হাতে আমার কন্যাকে দেবো না।
ঠিক সেই সময়ে সপ্তর্ষিরা এলেন, তাঁরা বললেন–আমরাই ঘটকরূপে এখানে এসেছিলাম। আমরা কখনোই বিরুদ্ধ কাজ করি না। শঙ্করের দর্শন লাভই আমাদের পরম সৌভাগ্য। আমাদের শিব বরবেশে তোমার গৃহে উপস্থিত হয়েছেন, এর থেকে মঙ্গলের কিছু হয় কি?
মেনকা তবুও নিজেকে স্থির রাখতে পারলেন না। বললেন, আজ আমি নিজে অস্ত্র দিয়ে পার্বতীকে মেরে ফেলবো; কিন্তু শিবের সঙ্গে বিয়ে দেবো না।
তারপরে গিরিরাজ এলেন এবং তিনি মেনকাকে বোঝালেন। বললেন, ব্রহ্মাদি দেবতাগণ, ঋষিগণ কি আমাদের অমঙ্গল চান? সকলেই তারা আজ আমার ঘরে, তুমি শিবকে জানো না, তাকে আমি চিনি, তিনি জগতের পালক তিনি জগতের পূজনীয়। দুঃখ করো না, বিবাহের লগ্ন পেরিয়ে যাচ্ছে, বিবাহের আয়োজন করো।
মেনকা গিরিরাজুকে বললেন, ওই মেয়ের গলায় দড়ি বেঁধে পর্বত থেকে সাগরে ফেলে দিয়ে সুখী হব, তবু শিবকে দান করব না। এই আমার শেষ কথা। আর যদি আমার কথা না শুনে শিবকে কন্যাদান কর, তাহলে আমি নিজে প্রাণত্যাগ করবো।
এমন সময় পার্বতী সেখানে এলেন। তিনি মায়ের কথা শুনে বললেন, তোমাকে কুবুদ্ধি আশ্রয় করেছে। ওই শিবই জগতের কারণ, উনিই ঈশ্বর, উনিই আশ্রয়, উনিই পালক, উনিই দেব সনাতন। এখানে যতজন দেবতা এসেছেন তাদের সকলের প্রভু উনিই। শিবের হাতে তোমার এই কন্যাকে তুলে দিয়ে জীবন সার্থক করো। আর দুঃখ করো না।
তুমি শিব ছাড়া যদি অন্য কোন দেবতার সঙ্গে আমার বিয়ে দাও তাহলে আমি বিবাহ করবো না। আমি কায়মনোবাক্যে সেই শিবকেই পতিরূপে বরণ করেছি। এই কথার কোন নড়চড় হবে না। এই আমি সত্যি করে বলছি।
উমার মুখে এই কথা শুনে মেনকা ভীষণভাবে ক্রুদ্ধ হলেন। দাঁতে দাঁত চেপে তিনি উমাকে প্রহার করতে উদ্যত হলেন।
মেনকার কাছ থেকে পার্বতীকে নারদ ও ঋষিগণ সরিয়ে নিয়ে গেলেন। তখন মেনকা পার্বতীকে তিরস্কার করে বললেন, এই মেয়েকে নিয়ে আমি কি করি? ওকে বিষ খাইয়ে মারব। ওকে অস্ত্র দিয়ে কেটে ফেলব। আর তা নাহলে আমি নিজেই কূপে ঝপ দিয়ে পড়ে প্রাণত্যাগ করবো।
তারপরে মেনকার রাগ একটু স্তিমিত হলে তিনি বললেন, আপনারা দেখুন এই মেয়ে কেমন বরের জন্য পাগল। যার মাতা পিতা নেই, কুল গোত্র নেই, রূপ ঐশ্বর্য নেই; এমনকি ঘরও নেই। বিদ্যা নেই, ধন নেই, বয়স নেই এমন পাত্রের হাতে কেউ কি তার কন্যা দান করবে?
এমন সময় বিষ্ণু এসে মেনকাকে বললেন, তুমি পিতৃগণের মানসী কন্যা। তাতে আবার ব্রহ্মাকুলজাত হিমালয়ের পত্নী। এমন ধর্মাধারভূতা হয়ে তুমি কি করে ধর্মত্যাগ করতে চাইছো? ব্রহ্মা, আমি ও ঋষিগণ কি বিরুদ্ধ কথা বলছি? তুমি একাই কি ঠিক বলছো? আসলে তুমি শিবতত্ত্বের কিছুই জান না। এই ত্রিলোকে কেউ তার রূপ বর্ণনা করতে পারবেন না। তার কারণ তিনি অজেয়, অমর, তাঁর প্রকৃত স্বরূপ নেই।
শ্রীহরি আরও বহু তত্ত্ব কথা শোনালেন মেনকাকে, মেনকা শান্ত হলেন।
তারপরে নারদ শিবের কাছে অনুরোধ করলেন তাঁর মনোহর রূপ দেখানোর জন্য। তখন মহেশ্বর তার সেই রূপ মেনকাকে দেখালেন।
মেনকা দেখলেন কোটি সূর্যের মতো সেই রুদ্রের বর্ণ, তাঁর ত্রিনয়নের শোভা অতি সুন্দর, মস্তকে কিরীট। পরিধানে বিচিত্র বসন, বদনে মধুর হাসি। আর বাহন ষাঁড়েরও শোভা অবর্ণনীয়।
তার মাথায় ছাতা ধরেছেন স্বয়ং সূর্য, চন্দ্র চামর ব্যজন করছেন, নাচছে অষ্টসিদ্ধি, গঙ্গা যমুনাদি, তীর্থগণ চামর ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, শিবের জয়ধ্বনি করছেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্রাদি দেবতাগণ, গন্ধর্বাদিগণ গান গাইছেন, সকল অপ্সরাগণ নাচছেন।
মহেশ্বরের এই রূপ দেখে মেনকা হতবাক হয়ে গেলেন। তারপর নিজের কন্যার প্রশংসা করতে লাগলেন। দেবতারা শিবের যেমন বর্ণনা দিয়েছিলেন তা যথার্থই ছিল। তখন তিনি লজ্জিত হলেন। তারপরে তিনি ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং সেই সঙ্গে শিবের পূজা করলেন।
তখন হিমালয়ের ভবনে যত রমণী ছিলেন তারা সকলেই শিবকে দেখতে এলেন। সবাই তাদের কাজ ফেলে চলে এলেন শিবকে দেখবে বলে। শঙ্করের রূপ দেখে সবাই মুগ্ধ হলেন। সবাই বললেন, পার্বতী মহা ভাগ্যবতী। যিনি এমন রূপবান শিবকে পতিরূপে লাভ করেছেন। যে এই রূপ দেখবেন তার চক্ষু সার্থক হবে। তপস্যা ছাড়া এমন রূপবান শিবকে পতিরূপে লাভ করা অসম্ভব। পার্বতীর তপস্যা সার্থক হল।
রমণীগণরা চন্দনাদি দিয়ে শিবের পূজা করলেন। এরই মধ্যে মেনকা সুন্দর সাজে সজ্জিত হলেন। আনন্দের সঙ্গে শিবের সম্মুখে গেলেন এবং বিধিমতে পূজা করলেন।
তারপরে ব্রহ্মা ঋষিগণকে নিয়ে বিবাহের বেদীতে গেলেন। শিবকে সেই বেদীতে নিয়ে যাওয়া হল। গিরিরাজ মেনকাকে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন। ব্রহ্মার সঙ্গে ঋষিরা বেদমন্ত্র উচ্চারণ করলেন। তারা হর-পার্বতীর জয়গান গাইতে লাগলেন। তারপর হিমালয় শিবকে আহ্বান করে খাদ্যাদি সকল বিধিমত দান করলেন।
তারপর সেই বেদীতে আগুন জ্বালানো হলো এবং বিবাহের কাজ সুসম্পন্ন করা হলো। মালা বদল, অগ্নি প্রদক্ষিণ সকলই করা হলো, পরে শুভ স্বস্ত্যয়ণ করা হল সেই সময় সকল দেবতারা হর-পার্বতীকে নমস্কার করলেন এবং বললেন–হে ভগবান শিব, আপনিই জগতের পিতা আর আজ থেকে পার্বতী হলেন জগতের মাতা।
সেই সময় দেবতা, গন্ধর্ব, কিন্নর, অপ্সরাগণ পরম আনন্দে নাচ গান বাদ্য সহকারে মেতে উঠলেন। হিমালয় শিব সেনাগণকে বিধিমতে পূজা করলেন। পরে তিনি দেবতা ও ঋষিগণের সামনে এসে বললেন–আজ আমার জীবন সার্থক হল। এরপর মেনকাও এসে সকলের কাছে ক্ষমা চাইলেন। কারণ তিনি না বুঝেই শিবনিন্দা করেছিলেন। তিনিও বললেন–আমি ধন্যা, আমার কন্যার জন্যই আমাদের কুল পবিত্র হল। যদি আমার এই কন্যা না জন্মাত, তাহলে আমার গৃহে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ সহ দেবতারা আসতেন না। ধন্যা আমার কন্যা।
তারপরে মেনকা হাতজোড় করে বললেন–আমি যা করেছি, যা কুবাক্য বলেছি তার জন্য ক্ষমা করুন। গিরিরাজ ও তাঁর পত্নীর হাতে পূজা পেয়ে মহেশ্বর খুব খুশি হলেন এবং বললেন–হে গিরিরাজ, তুমি ধন্য, তোমার জীবন সফল হল। হে গিরিরাজ পত্নী তুমিও ধন্যা, যেহেতু তোমার গর্ভে পার্বতীরূপ রত্নের জন্ম হয়েছে।
তারপরে দেবতা ও ঋষিগণ সকলকে আশীর্বাদ করে বিদায় নিয়ে নিজ নিজ স্থানে চলে গেলেন।
দেবী পার্বতী মহাদেবের সঙ্গে বৃষের পিঠে চড়ে কৈলাসের দিকে চললেন। গন্ধমাদন প্রভৃতি পর্বতগণ তাদের অনুগমন করলেন।