সম্প্রতি আমেরিকার টাইম ম্যাগাজিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে নিয়ে একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, মনমোহন সিং হয়তো কথা দিয়ে নিযুত অনুসারীর চিত্ত জয় করতে পারেন না, কিন্তু তিনি তাঁর কাজ দিয়ে কোটি কোটি মানুষের ভাগ্যের উন্নতি ঘটিয়েছেন। তিনি পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রটিকে পৃথিবীর দ্রুততম অগ্রসরমাণ অর্থনৈতিক শক্তিতেও উন্নীত করতে পেরেছেন। নানা কর্মসুচির মধ্য দিয়ে তিনি গরিব মানুষের নেতা হিসেবেও গণ্য হচ্ছেন। কথা নয়, কাজই মনমোহন সিংকে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতাসমেত দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এনেছে।
কথা নয়, কাজে বড় হবে−এ ধরনের মানুষ কি আমরা বাঙালি সমাজে পাব না?
কবি জীবনানন্দ দাশের মা কুসুমকুমারী দাশ বরিশালের একান্নবর্তী বাড়িতে বসে ঘরকন্না করতেন, রান্নাঘরে উনুনের পাশেই বসে যেতেন কবিতার খাতা নিয়ে, তেল-হলুদ মাখা হাতেই রচনা করে ফেলতে পারতেন কবিতা। একটা লাগসই কবিতা তিনি লিখে গিয়েছিলেন−আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে। তাঁর ছেলে জীবনানন্দ দাশ মায়ের এই চাওয়া পূরণ করতে পেরেছিলেন, তিনি একেবারেই কথা বলতে পারতে পারতেন না, মুখে কথা আটকে যেত, হাতের তালু ঘামত, কিন্তু লিখে রেখে গিয়েছেন অবিনাশী সব পঙ্ক্তিমালা, যা চিরকাল আলো দেবে বাঙালিকে। জীবনানন্দ দাশের মতো এ রকম একজন-দুজন মানুষ বাদ দিলে কুসুমকুমারী দাশের এই আক্ষেপ বাঙালি জাতির শাশ্বত আক্ষেপ হিসেবে আজও উচ্চারণযোগ্য −আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে। আর সেই কথাটিকে আরও নির্দিষ্ট করে নিয়ে বলা যায়−আমাদের দেশে কবে সেই মন্ত্রী কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।
দিনবদলের সনদ ঘোষণাকারী শেখ হাসিনা নির্বাচনে অভুতপূর্ব সাফল্য অর্জন করার পর মন্ত্রিসভা গঠন করলেন। সেই মন্ত্রিসভা ছিল একেবারেই খোলনলচে পাল্টে ফেলা। সেটা দেখে এই অরণ্যে রোদনকারী কলামলেখক প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় একটা মন্তব্যকলাম লিখে ফেলেছিল। এই পরিবর্তনকে সাধুবাদ জানানোর পরে অর্বাচীন লেখক পরামর্শ দিয়েছিল, মন্ত্রীরা যেন কথা কম বলেন। বলা হয়েছিল, টেলিভিশনগুলোর নিশিরাতের টকশোগুলোয় তাঁরা যেন একটু কম যান। আর সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল বর্তমান যুগের সবচেয়ে বিপজ্জনক বস্তুটি সম্পর্কে−যার নাম টেলিভিশন খবরের ক্যামেরা। যেকোনো আলোচনা-অনুষ্ঠান-বিয়ের দাওয়াত-সচিবালয়ের অফিস কক্ষের দুয়ার−সর্বত্রই এই আপাত নিরীহ যন্ত্রটি মূর্তিমাণ বিপদের মতো হাজির হয়। অত্যন্ত সুমিষ্ট ভাষায় আবদার জানায় চলমান ঘটমান কোনো একটা জ্বলন্ত প্রশ্ন বিষয়ে মন্ত্রীর একটা মন্তব্যের জন্য। নানা কথাই মন্ত্রীরা বলেন। অনেক কথা বললে দুয়েকটা কথা অনবধানতাবশত বলা হয়ে যায়, যেটা স্িলপ অব টাং, অর্থাৎ কথার তোড়ে বলে ফেলা। পরে প্রচারমাধ্যমে আর সব কথা ফেলে দিয়ে রাখা হয় ওই জিহ্বার পিচ্ছিলতাজনিত বাক্যটিকেই। সেটিই প্রচারিত হয়। পরের দিন দেশজোড়া হইচই, মন্ত্রী এটা কী বললেন! এই সরকারের একেবারে শুরুর দিনগুলোতেই কাঙাল কলামলেখক এ বিষয় থেকে সাবধান থাকতে পরামর্শ দিয়েছিল সদ্য নির্বাচিত ও অভিষিক্ত মন্ত্রীবর্গকে। কাঙালের কথা কেবল বাসি হলেই ফলে, তা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না।
মন্ত্রীদের কথা বলতেই হবে কেন? যেকোনো অনুষ্ঠানস্থল থেকে বেরিয়েই কেন তাঁদের টেলিভিশন খবরের ক্যামেরাগুলোর সামনে দাঁড়াতে হবে এবং হক না-হক একটা মন্তব্য করতেই হবে? পৃথিবীর যাবতীয় বিপদ যে কথা থেকে সৃষ্টি হয়, তা কি তাঁরা জানেন না? নাকি টেলিভিশনের একটা জাদুকরী আকর্ষক ক্ষমতা আছে, তা মন্ত্রীদের চুম্বকের মতো টানে, তাঁরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো টিভি ক্যামেরার সামনে চলে আসেন এবং নিজের অজান্তেই কথা বলে ওঠেন?
আমরা অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, মন্ত্রীরা মুখ খুলেছেন তো বিপদে পড়েছেন। যে মন্ত্রী যত কথা বলেছেন, তিনি তত অজনপ্রিয় হয়েছেন। বিএনপির জোট সরকারের আমলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তো চিহ্নিত হয়েছিলেন ‘আল্লার মাল’ বলে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও যেই উপদেষ্টার ওপর দায়িত্ব পড়েছিল গণমাধ্যমে কথা বলার, তিনিই হয়ে উঠেছিলেন সবচেয়ে বিতর্কিত।
এ সরকারের আমলে এই অপ্রীতিকর কাজটির দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে যাঁর ওপরে বা যিনি স্বেচ্ছায় এই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন, তিনি হলেন বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান। তিনি কথা বলেছেন বেশি, বিতর্কও তাই তাঁর কথা নিয়েই সৃষ্টি হয়েছে বেশি। গতকালকের সংবাদপত্রেও জ্বলজ্বল করছে তাঁর পরিবেশিত খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক তথ্য: বিডিআর বিদ্রোহের বিচার প্রচলিত আইনেই হবে। এ বিষয়ে আমরা কত কথাই না শুনলাম বিভিন্ন মন্ত্রীর মুখ থেকে, আর সেসব কত বিচিত্র ও কত পরস্পরবিরোধী। আমরা শুনেছি, বিডিআর ঘটনায় জঙ্গি সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে এবং পাওয়া যায়নি।
টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও মন্ত্রীদের মুখের বাঁধ খুলে গেছে। তাঁরা বলে চলেছেন। এক মন্ত্রী বললেন, যাঁরা টিপাইমুখ নিয়ে কথা বলছেন, তাঁরা না জেনে বলছেন। টিপাইমুখে বাংলাদেশের উপকার হবে। আরেক মন্ত্রী বললেন, সব বাঁধই ক্ষতিকর, তবে টিপাইমুখ নিয়ে কী হবে তা ভারতের কাছ থেকে জানতে চাওয়া হবে। এক মন্ত্রী বললেন, ভারতের হাইকমিশনার কুটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করেছেন। আরেক মন্ত্রী বললেন, ভারতের হাইকমিশনার কুটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করেননি। সবই বচনামৃত। আমাদের মন্ত্রীরা কথাসরিৎসাগর বা তার প্রণেতা হয়ে উঠেছেন।
যে মন্ত্রীদের কথা নিয়ে কথা বলছি, তাঁদের কারও কারও সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সুসম্পর্কও আছে। আমি তাঁদের এবং এই সরকারের সাফল্য কায়মনোবাক্যে কামনা করি। করি বলেই একেবারে হিতাকাঙ্ক্ষী হিসেবেই এই আকুল আবেদন জানাই, দয়া করে কথা কম বলুন। নীরবতা হীরণ্ময়। মতিয়া চৌধুরীকে শ্রদ্ধা করে না এমন মানুষ বাংলাদেশে কমই আছে। তিনি হাসিনা সরকারের গত মেয়াদে কথা কম বলে কাজ বেশি করে কৃষি খাতকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দিয়ে সবার কাছে স্নরণীয় হয়েছিলেন। সেই মতিয়া চৌধুরীও কথা বলতে শুরু করেছেন। বেয়াদবি নেবেন না, বলতে বাধ্য হচ্ছি, যেসব কথা তিনি অন্যের পারিবারিক ব্যাপারে বলছেন, তা তিনি বলেছেন, নিজের কান এখনো নিজের বিবেককে এটা মানাতে পারছে না।
একমাত্র উজ্জ্বল ব্যতিক্রম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং। তিনি কথা কমই বলছেন। কম বলছেন বলে বিপদ সৃষ্টি হচ্ছে না আর তাঁর ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর হচ্ছে। মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর এই বাক্সংযম অক্ষুণ্ন রাখুন বরং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত করে দিন।
টিপাইমুখ বাঁধ ফারাਆার মতো নয়। বিদ্যুৎ যদি উৎপাদন করতে হয়, পানি ছাড়তেই হবে। বর্ষা মৌসুমে পানি ধরে রাখলে বন্যার প্রকোপ কমতে পারে, শীতকালে পানির প্রবাহ বাড়লে তা আমাদের রবিশস্য উৎপাদনে অবদানও রাখতে পারে। আবার টিপাইমুখ বাঁধ থেকে যদি ভারত সেচ প্রকল্পের জন্য পানি সরায়, তাহলে আমাদের হিস্যা কমে যাবে। শীতকালে পানির প্রবাহ বাড়লে আমাদের রবিশস্যের ভুমি জলমগ্ন হয়ে আবাদি ভুমির পরিমাণ কমতে পারে। ভুমিকম্পপ্রবণ এলাকায় জলাধার ভুমিকম্পের আশঙ্কা বাড়াতে পারে। কাজেই এটার কিছু ভালো দিকও থাকতে পারে, কিছু খারাপ দিকও আছে। পৃথিবীতে এমন কোনো উন্নয়ন প্রকল্প হতে পারে না, যেটার নেতিবাচক প্রভাব নেই। আসলে যা দরকার তা হলো স্বচ্ছতা। আমাদের জানতে হবে আসলে ভারত কী করছে। বাংলাদেশের পরিবেশের ওপর এর প্রভাব কী পড়বে সে বিষয়টাও জরিপের আওতায় থাকতে হবে। চুলচেরা বিশ্লেষণের পর যদি আমরা দেখি, এতে আমাদের উপকারই, তবে আমরা এটাকে স্বাগত জানাব। যদি দেখি আমাদের অপকারের পরিমাণই বেশি হবে, আমরা প্রতিবাদ জানাব। কিন্তু আগে থেকেই মন্ত্রীরা কেউ যদি বলেন, এতে উপকার হবে, কেউ বলেন, এতে কিছু অপকার হবে, এসব কথামালা শুধু কোলাহলই তৈরি করবে, কাজের কাজ কিছু হবে না।
বলা হয়ে থাকে, তোমাকে কান দেওয়া হয়েছে দুটো, মুখ একটা, বেশি শোনো, কম বলো। তার চেয়েও বেশি করা দরকার কাজ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন বিদ্যাসাগরচরিত। তাতে তিনি বাঙালির চরিত্র নিয়ে কতগুলো লক্ষ্যভেদী মন্তব্য করে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না, আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি, তাহা পালন করি না; ভুরি পরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিল পরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না; আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতালাভের চেষ্টা করি না; সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি; পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধুলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিক্স এবং নিজের বাকচাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া ওঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হূদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিਆার ছিল। কারণ সর্ববিষয়েই তিনি ইহাদের বিপরীত ছিলেন।’
নিজের বাকচাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হওয়া থেকে আমাদের মন্ত্রীরা নিজেদের নিবৃত্ত রাখুন। এই লেখাটির শুরুতে টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাকপ্রতিভাহীনতার বিপরীতে কর্মবীরত্বের প্রশস্তির কথা উল্লেখ করেছি। আমাদের মন্ত্রীরাও সবাই হয়ে উঠুন কর্মবীর, বাক্যবীর নন। কুসুমকুমারী দাশের প্রার্থনা ও প্রত্যাশা আমাদের মন্ত্রীদের মধ্যেই চরিতার্থ হোক। আমাদের মন্ত্রীরা কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হয়ে উঠুন। তাতে শব্দদুষণ কেবল কম হবে তা-ই নয়, আমাদের মন্ত্রীদের জনপ্রিয়তার পারদও ওপরের দিকেই থাকবে। ছয় মাস তো তেমন কিছু সময় নয়, সবে তো কলির সন্ধ্যা।
পূর্ববর্তী:
« আবুল হোসেনের কবিতা – সোহেল হাসান গালিব
« আবুল হোসেনের কবিতা – সোহেল হাসান গালিব
পরবর্তী:
আহসান হাবীব : কবির প্রতিকৃতি »
আহসান হাবীব : কবির প্রতিকৃতি »
Misty
Excelent…..
Rajon
Good Story. Amader minster ra kakhono manus habena.