কোন্ ভিনারের মা
বরোদায় চাকরি নেবার কয়েকদিন পরেই ডাঃ এর্নস্ট কোন-ভিনারের (অর্থাৎ ভিয়েনার cohn) সঙ্গে আলাপ হয়। যদিও নাম থেকে বোঝা যায়, ‘কোন পরিবার এককালে ভিয়েনায় বসবাস করতেন তবু ইনি বার্লিনেই জন্মান, পড়াশুনো করে সেখানে নামজাদা অধ্যাপক হন এবং হিটলার ইহুদিদের উপর চোটপাট আরম্ভ করার সঙ্গে সঙ্গেই সন্ত্রীক লন্ডন চলে যান। বুড়ো মহারাজ তৃতীয় সয়াজীরাও তাঁকে সেখান থেকে পাকড়াও করে নিয়ে এসে বরোদা যাদুঘরের বড়কর্তা বানিয়ে বসিয়ে দেন।
লোকটির পাণ্ডিত্য ছিল অসাধারণ এবং তার স্ত্রীও এতখানি লেখাপড়া জানতেন যে তিনি তার স্বামীকে পর্যন্ত কাজকর্মে সাহায্য করতে পারতেন। সয়াজীরাওয়ের পাঠানো ‘ভিনাস দি মিলো, মাইকেল এঞ্জেলোর তৈরি ‘মোজেস’ ও মুমূর্ষ দাসের’ প্লাসটার-কাস্ট যেদিন বার্লিন থেকে বরোদা এসে পৌঁছল, সেদিন ফ্রাউ কোন-ভিনারের কী উত্তেজনাউৎসাহ! স্টেশনে গিয়ে সেই বিরাট বিরাট বাক্স নিজে তদারকি করে নামালেন, আহার নিদ্রা শিকেয় তুলে দিয়ে কাস্টগুলোকে যাদুঘরে সাজালেন-সে সময় তিনি যাদুঘরে একটানা চব্বিশ ঘণ্টা কাটিয়েছিলেন,–তারপর ফোলা-ফোলা লাল-লাল চোখ নিয়ে বেরলেন, আমাদের খবর দিতে, প্রভুরা বহাল-তবিয়তে যাদুঘরে আসর জমিয়ে আমাদের জন্য প্রতীক্ষা করছেন। পাছে আমি হুজুরদের কিমৎ ঠিকমত মালুম না করতে পেরে তেনাদের তাচ্ছিল্য’ করি, তাই আমাকে তাঁর মোটরে তুলে নিয়ে গিয়ে হুজুরদের সঙ্গে নিজে পরিচয় করিয়ে দিলেন। হুজুরদের নাম-গোত্র, হাল-হকিকৎ, হাড়-হাদ্দ এমনি গটগট করে বয়ান করে দিলেন যে, তার থেকেই বুঝতে পারলুম। যে এর এলেমের এক কাহিন পেলেও আমি সুবে বোম্বাইবরোদ-আহমদাবাদের কলাবাজারে’ বাকি জীবন বেপরোয়া হয়ে দাবড়ে বেড়াতে পারব। আর হ্যার ডক্টর কোন-ভিনারের পাণ্ডিত্য আমাকে ফলিয়ে বলতে হবে না। নন্দনশাস্ত্র এবং বিশ্ব-স্থাপত্যের বিভিন্ন শৈলী সম্বন্ধে তিনি যেসব কেতাব লিখে গিয়েছেন, সেগুলো নাৎসী-পতনের পর ফের ছাপা হতে শুরু হয়েছে।
স্থাপত্যে পণ্ডিত অথচ বাল্যকালে তিনি লেখাপড়া শেখেন রাব্বিদের (ইহুদি পুরুষপণ্ডিত) টোলে। তাই ইহুদি ধর্ম সম্বন্ধে তার জ্ঞান ছিল গভীর; অথচ ইহুদিদের আচারব্যবহার, তাদের কঞ্জসি নিয়ে তিনি ঠাট্টা মস্করা করাতে ইহুদির শত্ৰু ক্রীশ্চানের চেয়েও ছিলেন বাড়া। সেসব রসিকতা একদিন মোকামাফিক ছাড়িবার বাসনা আমার আছে।
স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। পুত্ৰ-কন্যা হয় নি, অথচ দুজনেরই হৃদয় ছিল স্নেহে ভরা। ‘দেশ’র পাঠক এই ইঙ্গিত থেকেই টক করে বুঝে যাবেন, আমি তার নাসিকে সুযোগ নিতে কসুর করি নি। যতদিন কোন ভিনাররা এদেশে ছিলেন, ততদিন জর্মন বই, মাসিক, খবরের কাগজের জন্য আমাকে কিছুমাত্র দুর্ভাবনা করতে হয় নি।
‘সে বছরে ফাক, পেনু কিছু টাকা’ ধরনে কি করে যে কিছু টাকা আমার হাতে ’৩৮ (ইংরেজিতে) জমে গিয়েছিল, সেটা নিতান্ত আমি বলছি বলেই আজ আমার বিশ্বাস হয়হায়, এখন যা অবস্থা, ’৩৮-এর মুজতবা আলীকে পথে পেলে দাদা, বাছা’ বলে তার কাছ থেকে দু-পয়সা হাতিয়ে নিতুম।
তা সে কথা যাকগে। সে জমানো টাকাটা হাতে বড় বেশি চুলকোচ্ছিল বলে বাসনা হল জর্মনিতে গিয়ে সে-টোকাটা পুড়িয়ে আসি। বন্ধুবান্ধব সে দেশে মেলা, ওদিকে হিটলার যা নাচন-কুদ্দন আরম্ভ করেছে, কখন না। দুম করে লড়াই লেগে যায়, আর র্তারাও সেই বেপ্যাচে পড়ে প্ৰাণটা হারান।
বরোদা ছোট্ট জায়গা-তাই খাসা জায়গা। তিন দিনের ভিতর পাসপোর্ট হয়ে গেল। বোম্বাই কাছে; ট্রাঙ্ককল করে জাহাজের টিকিট কাটা হয়ে গেল।–আর গরম সুটিমুট তো ছিলই। শিকের হাঁড়ি থেকে নামিয়ে ঝেড়ে-ঝুড়ে তৈরি করে নিলুম।
কোন-ভিনারদের বললুম, জর্মনি যাচ্ছি।
শুনে দুজনেই চমকে উঠলেন। তারপর অনেকক্ষণ ধরে চুপ কুরে রইলেন। বুঝলুম, দেশের ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠেছে-যে-দেশ আবার দেখবার সৌভাগ্য হয়ত তাঁদের জীবনে আর কখনো আসবে না। আর কিছু বুঝি না বুঝি, বিদেশে দেশের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে বুকটা যে কি রকম তেলে-ফেলা বেগুনের মত ছাৎ করে ওঠে, সেটা বিলক্ষণ বুঝি; এবাবতে আমি বিস্তর পোড়-খাওয়া গরু। চুপ করে রইলুম!
কোন-ভিনার শুধালেন, ‘আপনি কি বার্লিন যাবেন?’
আমি বললুম, ‘এবারে জর্মনি যাচ্ছি বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা করতে। তারা তামাম জর্মনি ছড়িয়ে। বন্ন, কলোন, হানোফার, বার্লিন অনেক জায়গায়ই যেতে হবে।’
কোন-ভিনার বললেন, ‘আমরা বার্লিন ছাড়ি ৩৩এ। এদেশে আসি ৩৫-এ। এখানে আসার পর আমার পরিচিত কেউ বার্লিন যায় নি; আমার বুড়ি মাকে এই তিন বৎসরের ভিতর কেউ গিয়ে বলতে পারে নি যে সে আমাকে দেখেছে, আমি ভালো আছি। আমি ছাড়া আমার মায়ের এ সংসারে আর কেউ নেই। আপনি যদি-’
আমি বললুম, ‘আমি অতি অবশ্য তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাব; আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।’
খানিকটা কিন্তু-কিন্তু করে কোন-ভিনার শেষটায় বললেন, ‘তবে দেখুন, একখানা পোস্টকার্ড লিখে তার পর যাবেন। আমার মার বয়স আশীর কাছাকাছি। আপনি যদি হঠাৎ গিয়ে উপস্থিত হন তবে তিনি জোর শক পাবেন। সেটা সামলাবার জন্য—’
আমি বললুম, ‘নিশ্চয়, নিশ্চয়। আমি খবর দিয়েই যাব।’
কোন-ভিনার বললেন, আর দেখুন, আমার যে হার্ট-ট্রাবল সেটা একদম চেপে যাবেন! কি হবে বুড়িকে জানিয়ে? আমার বাবাও হার্টের রোগে মারা যান।’
আমি বললুম, ‘বুঝিয়ে বলতে হবে না। আমি ঠিক ধরতে পেরেছি। এ-জিনিস সবাই করে থাকে। আমি ওঁকে বলব, আপনারা দুজনেই আরামে দিন কাটাচ্ছেন। এই তো?
পবননন্দনপদ্ধতিতে এক লম্ফে বার্লিন পৌঁছই নি। বোম্বাই, জেনওয়া, জিনীভা, লেজাঁ, বন্ন, কলোন, ডুসেলডর্ফ, হানোফার হয়ে হয়ে শেষটায় বার্লিন পৌঁছলুম। পূর্বেই নিবেদন করেছি, বিষ্ণুচক্ৰে কর্তিত খণ্ড খণ্ড সতীদেহের ন্যায় আমার বন্ধুবান্ধব ছড়িয়ে আছেন দেশ-বিদেশে।
’৩২এ নাৎসিরা রাস্তায় কম্যুনিস্টদের উপর গুণ্ডামি করতো, ‘৩৪এ তারা ছিল দন্তী-এবারে ‘৩৮এ দিয়ে দেখি, তাদের গুণ্ডামিটা চলছে ইহুদিদের উপর। তার বর্ণনা অনেকেই পড়েছেন, আমাকে আর নূতন করে বলতে হবে না।
পোস্টকার্ডে লিখলুম, ‘আমি এর্নস্ট কোন-ভিনারের মিত্র; বরোদা থেকে এসেছি, আপনার সঙ্গে বুধবার দিন সকাল দশটায় দেখা করতে আসব।’
যে মহল্লায় কোন-ভিনারের মা থাকতেন আমি সে পাড়ায় পূর্বে কখনো যাই নি। যে বিরাট চক-মেলানো বাড়ির সম্মুখে উপস্থিত হলুম, সেখানে অন্তত চল্লিশটা ফ্ল্যাট থাকার কথা। অথবা অবাক হলুম, জর্মন বাড়ির দেউড়িতে যে রকম সচরাচর সব পরিবারের নাম আর ফ্ল্যাটের নম্বর লেখা থাকে। এখানে তার কিছুই নেই। ওদিকে দেউড়ির চেহারা দেখে মনে হল, এককালে নেমপ্লেটগুলো দেউড়ির পাশের দেয়ালে লাগানো ছিল। যে দু’একটি লোক আনাগোনা করছে তাদের চেহারা দেখে স্পষ্ট বোঝা গেল এরা ইহুদি—অনুমান করলুম, সমস্ত বাড়িটাই ইহুদিদের—এবং চোখেমুখে কেমন যেন ভীত সন্ত্রস্ত ভাব। আমার দিকে তাকালও সন্দেহের চোখে, আড়নয়নে।
বুড়ির ফ্ল্যাটের নম্বর আমি জানতুম। একজনকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘বারো নম্বর ফ্ল্যাট যেতে হলে কোন সিঁড়ি দিয়ে একতলায় যেতে হয় বলতে পারেন?’ ‘না’ বলে লোকটা কেটে পড়ল। আরো দু-তিনজনকে জিজ্ঞেস করলুম, সবাই বলে না’।
আমি অত্যন্ত আশ্চর্য হলুম, কারণ আমার অজানা ছিল না যে ইহুদিরা পাড়াপ্রতিবেশীর খবর রাখে। সবচেয়ে বেশি-এবং বিশেষ করে প্রতিবেশী যদি আপন জাতের লোক হয়।
তখন হঠাৎ আমার মাথার ভিতর দিয়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। মনে পড়ল, দশ বৎসর পূর্বে কাবুলেও আমার ঐ অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেখানেও রাস্তায় কেউ কারো বাড়ি বাৎলে দেয় না। কারণ অনুসন্ধান করাতে এক বিচক্ষণ কাবুলী বলেছিলেন, ‘বলতে যাবে কেন? তুমি যদি লোকটার বন্ধু হও, তবে তার বাড়ি কোথায়, সে-কথা তো তোমার জানা থাকার কথা। হয়ত তুমি স্পাই, কিংবা রাজার কাছ থেকে এসেছ তাকে তলব করতে। সেখানে হয়ত তার ফাঁসি হবে। লোকটার বাড়ি বাৎলে দিয়ে আমি তার অপমৃত্যুর গৌণ কারণ হতে যাব কেন?’
এখানে ইহুদিরাও ঠিক সেই পন্থাই ধরেছে। হয়ত আমি নাৎসি স্পাই-কি মতলবে এসেছি কে জানে?
শেষটায় অনেক ওঠা-নামা করে বারো নম্বর ফ্ল্যাট খুঁজে পেলুম-ফ্ল্যাটের নম্বর পর্যন্ত ইহুদিরা সরিয়ে ফেলেছে। ঘণ্টা বাজাতে দরজার একটা কাচের ফুটো (এ ফুটোটা আবার পিতলের চাক্তি দিয়ে ভিতর থেকে ঢেকে রাখা হয়) দিয়ে কে যেন আমায় দেখে নিলে। আমি একটু চেচিয়ে আমার পরিচয় দিলুম।
একটি তরুণ-তারও মুখে উত্তেজনা আর ভীতি-দরজা খুলে দিল। আমি ঢুকতেই তড়িঘড়ি দরজা বন্ধ করে দিল।
আমাকে নিয়ে গেল ড্রয়িং-রুমে। সেখানে দেখি এক অথৰ্ব থুরথুরে বুড়ি কৌচের এক কোণে কৌচেরই চামড়ার সঙ্গে হাত আর মুখের শুকনো চামড়া মিলিয়ে দিয়ে বসে আছেন। আমাকে দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেন। আমি বললুম, করেন কি, করেন কি, আমি এর্নস্টের বন্ধু, আমার সঙ্গে লৌকিকতা করতে হবে না।’
তবু বুড়ি অতিকষ্টে উঠে দাঁড়ালেন। দুখানা হাডি-সার ফালি ফালি হাত দিয়ে আমার দু-বাহু ধরে বললেন, ‘বারান্দায় চলুন—সেখানে আলোতে আপনাকে ভালো করে দেখব।’
বাইরে বসিয়ে আমাকে তার ঘোলাটে চোখ দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে দেখলেন।
তারপর হঠাৎ ঝর ঝর করে দু’চোখ দিয়ে জল ঝরে পড়ল-আমি তাঁর চোখের দিকে তাকিয়েছিলুম, হঠাৎ যে এ রকম দু’চোখ ভেঙে জল নেমে আসবে তার কণামাত্র পূর্বাভাস পাই নি।
চোখ মুছে বললেন, ‘মাপ করবেন, আমি কাঁদেছিলুম না, আমার চোখ দিয়ে যখনতখন এ রকম জল নেমে আসে। আমি ঠেকিয়ে রাখতে পারি নে। আমি এখন কাঁদব কেন? আমি কত খুশি। এর্নস্ট কি রকম আছে? তার বউ?’
আমি বললুম, ‘বড় আরামে আছেন। জানেন তো, ভারতবর্ষ খারাপ দেশ নয়। এর্নস্টের কাজও শক্ত নয়। ভালো বাড়িঘর পেয়েছেন। আর জানেন তো এনস্টের স্বভাব–দু’বছর হয়েছে মাত্র এরই মধ্যে বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে নিয়েছেন। আপনার বৌমা প্রায় প্রতি সপ্তাহেই আমাদের লাঞ্চ-ডিনার খাওয়ান। আমাকে বড্ড স্নেহ করেন।’
দেখি বুড়ি কাঁপছেন আর বার বার রুমাল বের করে চোখ মুচছেন।
আমার হাত দুখানি ধরে বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না। আমি বড় উত্তেজিত হয়ে পড়েছি।–কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছি নে। আমার বুকের ভিতর কি যেন হচ্ছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি কাল আবার আসতে পারবেন? না,—হয়ত আপনার অনেক কাজ?’
আমি বুঝতে পারলুম, বুড়ি নিজেকে সামলাবার জন্য সময় চান। বললুম, ‘নিশ্চয় নিশ্চয়। আমি কাল আসব। আমার কোনো অসুবিধে হবে না। আমার তো এখানে কোনো কাজ-কর্ম নেই; ছুটি কাটাতে এসেছি মাত্র।’
বানিয়ে বানিয়ে গল্প জমাচ্ছি না, তাই যদি বিবরণটি নন্দনশাস্ত্রসম্মত স্বরূপ গ্ৰহণ না করে তবে আশা করি সুশীল পাঠক অপরাধ নেবেন না। কোন-ভিনারের মা’র বেদনা নিয়ে সুন্দর গল্প রচনা করা যায় জানি, কিন্তু আমার মনের উপর সে এমনই দাগ কেটে গেছে যে সেটাকে গল্পের খাতিরে ফের-ফার করতে আমার বড্ড বাধো বাধো ঠেকে। সুরসিক পাঠক সেটা হয়ত বুঝতে পারবেন না, তবে সহৃদয় পাঠকের সহানুভূতি পাব সে আশা মনে মনে পোষণ করি।
দ্বিতীয়বারে বুড়ি অতটা বিচলিত হলেন না। এবারেও কাঁদিলেন তবে জার্মানি বিজ্ঞানের দেশ বলে তার একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও দিলেন; বললেন, চোখের কাছের যে স্যাক থেকে জল বেরোয়, বুড়ো বয়সে মানুষ নাকি তার উপর কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলে। হবেও বা, কিন্তু বিদেশে ছেলের কথা ভেবে মা যদি অঝোরে কাব্দে। তবে তার জন্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার কি প্রয়োজন?
শুধালেন, ‘এসপেরেগাস খাবেন-একটুখানি গলানো মাখনের সঙ্গে?
আমি তো অবাক। এসপেরেগাস মানুষে খায় পশ্চিম বাংলায় যে রকম আসল খাওয়া হয়ে গেলে টক খাওয়া হয়। বলা নেই কওয়া নেই, সকাল বেলা দশটার সময় সুস্থ মানুষ হঠাৎ টিক খেতে যাবে কেন?
মজাটা সেইখানেই। আমি এসপেরেগাস খেতে এত ভালোবাসি যে রােত তিনটের সময় কেউ যদি ঘুম ভাঙিয়ে এসপেরেগাস খেতে বলে তবে তক্ষুনি রাজী হই। ভারতবর্ষে এসাপেরেগাস আসে টিনে করে-তাতে সত্যিকার সোয়াদ পাওয়া যায় না।–তাজা ইলিশ নোনা ইলিশের চেয়েও বেশি তফাৎ। সেই এসপেরেগাসের নামেই আমি যখন অজ্ঞান তখন এখানকার তাজা মাল!
মাই বললেন, ‘আমি যখন এর্নস্টের কাছ থেকে খবর পেলুম, আপনি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন, তখন বউমাকে লিখলুম, আপনি কি খেতে ভালোবাসেন সে খবর জানাতে। বউমা লিখলে পুরো লাঞ্চ খাওয়াতে হবে না, শুধু এসপেরেগাস হলেই চলবে। সৈয়দ সাহেব মোষের মত এসপেরেগাস খান—বেলা-অবেলায়।’
বুড়ি মধুর হাসি হেসে বললেন, ‘পুরো লাঞ্চ এখন আমি আর রাঁধতে পারি নে, বউমা জানে। তাই আমার মনে কিন্তু-কিন্তু রয়ে গিয়েছে, হয়ত আমাকে মেহন্নত থেকে বাঁচাবার জন্য লিখেছে আপনি বেলা-অবেলায় এসপেরেগাস খান।’।
আমি বললুম, ‘আপনাকে দেখিয়ে দিচ্ছি।’
‘দেশের চতুর পাঠকদের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখে আর কস্য লভ্য যে আমি পেটুক। উল্টে তাঁরা বুঝে যাবেন, মিথ্যেবাদীও বটে।
এসাপেরেগাসের পরিমাণ দেখে আমার চোখ দুটো পটাং করে সকেটু থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল। মহা মুশকিল। সেগুলো কাপেট থেকে কুড়িয়ে নিয়ে সকেটে ঢুকিয়ে এসাপেরেগাস গ্রাস করতে বসলুম।
জানি, এক মণ বললে আপনারা বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু প্লীজ, আধা মণ না মানলে আমাকে বড় বেদনা দেওয়া হবে। সুকুমার রায়ের ‘খাই-খাই খানেওয়ালাও সে-খানা শেষ করতে পারত না।
আমি ঐ এক বাবদেই আমার মাকে খুশি করতে পারতুম—গুরুভোজনে। ধর্মসাক্ষী, আর সব বাবদে মা আমাকে মাফ করে দিয়েছেন। কোন-ভিনারের মা পর্যন্ত খুশি হলেন, তাতে আর কিমাশ্চৰ্যম!
হায় রে দুর্বল লেখনী-কি করে কোন-ভিনারের মায়ের এসপেরেগাস রান্নার বর্ণনা বতরিবৎ বয়ান করি। অমিত্ৰাক্ষর ছন্দে শেষ কাব্য লিখেছেন মাইকেল, শেষ এসপেরেগাস রোধেছেন কোন ভিনারের মা।
আহারাদি শেষ হলে পর কোন-ভিনারের মা বললেন, ‘আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে।’
আমি বললুম, ‘আদেশ করুন।’
তিনি বললেন, ‘আপনি যদি না করতে পারেন, তবে আমি কিছুমাত্র দুঃখিত হব না।’ একটি অপরূপ হিরে লাগানো সোনার আংটি বের করে বললেন, নাৎসিরা এখন আর কোনো দামী জিনিস জার্মানির বাইরে যেতে দেয় না-সে নিয়ে তাদের উপর আমার কোনো ক্ষোভ নেই-আমি কি করে জানবো দেশের মঙ্গল কিসে। কিন্তু এ আংটিটা এর্নস্টের প্রাপ্য। তার বা পঠাকুদ্দা চোদপুরুষ এই আংটিটা পরে বিয়ে করেছিলেন; এ আংটিটা তাকে দেবেন।’
আমার আঙুলে ঠিক লেগে গেল। আমি বললুম, ‘আপনাকে ভাবতে হবে না।’
একটা সোনার চেনে ঝোলানো জড়োয়া পদক দিয়ে বললেন, ‘এটা এনস্টের বাপ আমাকে বিয়ের রাতে বাসরঘরে দিয়েছিলেন, (পঞ্চাশ বছর পরে এই পরবের স্মরণে তিনি একটুখানি লাজুক হাসি হাসলেন) এটা বউমার প্রাপ্য। এটা আপনি তাকে দেবেন।’
আমি কলার খুলে গলায় পরে নিয়ে বললুম, ‘নিশ্চিন্ত থাকুন।’
কোন-ভিনারের পা পইপই করে বললেন, ‘কাস্টমসের বিপদে পড়লে জানলা দিয়ে ফেলে দেবেন। কিংবা ওদের দিয়ে দেবেন। আমি কোন শোক করব না। ছেলে, বউকে আমি চিঠিতে এ বিষয়ে কিছুই জানাচ্ছি নে। তাদেরও কোনো শোক করতে হবে না।’
বরোদা ফিরে আমি কোন-ভিনারকে আংটি দিলুম, তাঁর বউকে পদক দিলুম।
***
ছ’মাস পরে বুড়ি মারা যান। কোন-ভিনার এক বছর পরে মারা যান। তার স্ত্রী এখন কোথায় জানি নে।