যেখানে জীবন বাঁচে মৃত্যু মরে
রোবায়েত ফেরদৌস
আমি মানুষ – সরদার ফজলুল করিম, ফেব্রুয়ারি ২০০৯, কথাপ্রকাশ, ঢাকা, প্রচ্ছদঃ সাইফুল হক সদল, ৮০ পৃষ্ঠা, ৮০ টাকা
সরদার ফজলুল করিম। লেখক ও অনুবাদক, জীবনদার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী-বাংলাদেশের এক জীবিত মহাগ্রন্থ। এ বছর বেরিয়েছে তাঁর আমি মানুষ বইটি। ছোট বই। ৮০ পৃষ্ঠার। দাম ধরা হয়েছে ৮০ টাকা। আমি মানুষ বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে ‘মানুষ’কে।
বইটিকে বলা যায় নিত্যদিনের দর্শন। যতটা সহজে জীবনকে দেখা যায়, জীবনকে বিশ্লেষণ করা যায়, যতটা সহজে যাপিত জীবনের আখ্যানচিত্র এঁকে মানুষের জন্য লাগসই করা যায়, গ্রন্থটি এরই এক অনবদ্য উদাহরণ। প্রতিদিনকার জীবনের কষ্ট, যন্ত্রণা, তামাশাকে তিনি দর্শনের রাবারে ঘষামাজা করে বইটিতে তুলে ধরেছেন। এখানে রাষ্ট্র ও কাঁচাবাজার, মারণাস্ত্র ও শসা, ব্যাংকের টাকা তোলা থেকে প্লেটোর সংলাপ, আকাশ-এম এম আকাশ ও প্রকৃতির খোলা আকাশ-দুটোই আছে। ক্যালেন্ডারের তারিখ ধরে ধরে প্রতিদিনের ঘটনা, খবরের কাগজে প্রকাশিত সংবাদ ও লেখা, মানুষ, প্রকৃতি আর বস্তুরাজির সঙ্গে সরদারের যে মিথস্ক্রিয়া, এর বিবরণ এখানে আছে। এ বিবরণের সঙ্গে বাড়তি যা আছে, তা হলো সরদারের দার্শনিক ফুটনোট, টীকা-টীপ্পনি আর অন্তদৃêষ্টি। ভাষা দারুণ সহজ আর সাবলীল। বুদ্ধিবৃত্তিক প্যাঁচগোচ নেই, আছে নৈর্বøক্তিক সততা। যখন যাঁর লেখা, বক্তব্য তাঁর ভালো লাগছে, অবলীলায় তিনি তা বলে দিচ্ছেন, কারও কারও লেখা কেটে রাখছেন, পরে পড়বেন বলে। কিন্তু সেগুলো আদৌ কখনো পড়া হবে কি না, দ্বিধাহীনভাবে সে দ্বিধাও প্রকাশ করেছেন। বইটিতে আত্মসমালোচনা আছে-প্রায়শ নিজেকে তিনি কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে নিজের কোর্ট মার্শাল করার চেষ্টা করেছেন। অফিসের পিয়ন কিংবা সবজিবিক্রেতা-প্রতিদিনকার জীবনাচরণে মানুষের প্রতিনিয়ত যে সম্মান তিনি দেখিয়েছেন, তা বিরল।
সরদার ফজলুল করিমকে আমরা জানি শিক্ষাবিদ ও জীবনসংগ্রামী হিসেবে। কিন্তু নিজেকে তিনি সগর্বে ‘কৃষকের পোলা বলে’ পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। বইটিতে নিজের দীনতা, অক্ষমতার কথা চাবুকের মতো প্রকাশের যে সাহস তিনি দেখিয়েছেন, এতে পাঠক হিসেবে আমাদের লজ্জা আরও বেড়ে যায়। আমরা আমাদের সীমাবদ্ধতা নিয়ে আরও সংকুচিত হয়ে পড়ি। কর্তব্যে ফাঁকি দিয়ে যখন আমরা পালানোর পথ খুঁজি, বইটিতে ঠিক তখনই তিনি সক্রেটিসকে হাজির করেনঃ ‘সক্রেটিসকে শিষ্যরা বললেন, তুমি কারাগার থেকে পালাও। সক্রেটিস বললেন, আমি যুক্তি আর নিয়মের বন্দী। আমি পালাতে পারিনে।’
কিছু বিষয় দারুণ দাগ কেটে যায়। যেমন নিজেকে তিনি বলদ বলেছেন। কিসের বলদ? বইয়ের বলদ। বই কী? ‘বই অবশ্যই লিখিত এবং মুদ্রিত, মানুষের এক মহৎ আবিষ্কার। কিন্তু তথাপি, যে দেশে বই পাঠ করা হয় না, অক্ষম আমার বাসার মতো কেবল স্তূপ করে রাখা হয়, তা বস্তু বটে তবে বই নয়। ·· যে বই পঠিত হয়, কিন্তু এর বিষয়বস্তু আলোচিত হয় না, তার বক্তব্য অনুসৃত হয় না, সে বইও বই নয়। বস্তুমাত্র।’ তিনি অবসান চেয়েছেন মানুষের ওপর মানুষের শাসনের। কার্ল মার্ক্সকে উদ্ধৃত করেছেন, ‘মানুষের উপর মানুষের শাসন কোন যৌক্তিক ব্যাপার নয়ঃ আমরা কল্পনা করি, এমন একদিন আসবে যে-দিন মানুষের উপর মানুষের শাসনের জায়গাতে বস্তুর উপর মানুষের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে।’
তিন স্তরে নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি-মানুষ, কমিউনিস্ট ও বাঙালি। তিনি যৌবনের জয়গান গেয়েছেন, তারুণ্যের প্রতি ব্যক্ত করেছেন অবিচল আশাবাদ।
বইটিতে নিজের ভালো লাগা কিছু বইয়ের কথা জানিয়েছেন। যেমন, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের শাহজাদা দারাশুকো। এ জন্য খবরের কাগজে শ্যামলের মৃত্যুসংবাদ পড়ে তিনি দুঃখ পেয়েছেন। অ্যারিস্টটলের জন্য তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার বয়ান আছে এই বইতে। সরদার লিখেছেন, ‘অ্যারিস্টটলের জন্য আমার মায়া হয়। আড়াই হাজার বছর বয়সী বৃদ্ধ অ্যারিস্টটল।··· তিনি আমাকে আজও মুগ্ধ করেন।··· অ্যারিস্টটলের পলিটিকসের গায়ের ধুলো আমার গায়ের জামা দিয়েই মুছলাম।’
আরেকটি বই মোহাম্মদ নজরুল ইসলামের ‘সুন্দরের সংগ্রাম ও বুদ্ধিবাদের ট্র্যাজেডি’র উল্লেখ করেছেন তিনি। বলেছেন, বইটির লেখক তাঁর অচেনা কিন্তু তাঁর রচনা জীবনসত্যের দলিল। এ প্রসঙ্গেই বাংলাদেশের রাজনীতি আর ভাবিষ্যৎকে রবীন্দ্রনাথের শিশুতীর্থ থেকে উদ্ধৃত করে বোঝানোর চেষ্টা করেছেনঃ ‘···কিন্তু সূর্য আর ওঠে না। অন্ধকার গভীর থেকে গভীরতর হয়। আর্তনাদ ওঠে। এখন কি উপায়? কোথায় যাব আমরা? কোথায় যাচ্ছি? এখন কে আমাদের পথ দেখাবে?···’
এত মৃত্যু, হত্যা, যুদ্ধ দেখে এই বয়সে সরদার যেন ক্লান্ত; কখনো তিনি হতাশ হয়েছেন, মানুষের প্রতি ক্ষোভ আর বিরক্তি প্রকাশ করেছেন, সিদ্ধান্তের দ্বান্দ্বিকতায় একই সঙ্গে তাড়িত ও পীড়িত বোধ করেছেন। কিন্তু মানুষের ওপর আস্থা হারাননি; চূড়ান্ত বিচারে তিনি তাই জীবনবাদী, আশাবাদী। আত্মম্ভর আশায় অন্যত্র তিনিই আবার বলেছেন, ‘জীবন বনাম মৃত্যুর যে লড়াই আজ চলছে, তাতে জীবনই জয়ী হবে, মৃত্যু নয়।’
বইটিতে মানুষের শক্তি ও সম্ভাবনার কথাই বড় হয়ে বেজেছে। পুরো বইয়ের আলোচনা তাই মানুষময় হয়ে উঠেছে। বইটির সবশেষ লেখায় সরদার বলেছেন, ‘মহৎ কোনো চিন্তার সাক্ষাৎ পেলে চিন্তাটি কার সে প্রশ্নের চেয়ে বড় হচ্ছে চিন্তার মহত্ত্বটি। মহৎ সত্যের যেমন কোনো বিকল্প নেই, তেমনি মহৎ চিন্তার মালিকানা নিয়েও বিরোধের কোনো হেতু নেই।’ কী অসাধারণ দার্শনিক উচ্চারণ!
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০৩, ২০০৯
শাহনাজ পারভীন
এই গানের প্রতিটা লাইন নিয়ে অনেক অনেক আলোচনা হতে পারে। এতটাই meaningful গানটা। এর মোহ থেকে বের হওয়াটা কঠিন।