বাউলকবি ও লালনগীতি
সাইম রানা
বাউল কবি লালন ও তাঁর গান,
মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী, প্রচ্ছদঃ মাসুক হেলাল, শিখা প্রকাশনী, প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০০৯, পৃষ্ঠা ২৬২, ৩০০ টাকা
ধীরে ধীরে লালন হয়ে উঠলেন সংস্কৃতির ভ্যানগার্ড। শীর্ণকায় সংস্কারপ্রবণ মানুষটি প্রায় সোয়া শ বছর আগে ওফাত লাভ করলেও এক-দেড় দশক আগেও নাড়া, ভিক্ষুক অচ্ছুত হিসেবে তাঁকে এবং তাঁর অনুসারীদের হীন চোখে দেখা হতো। ছোটবেলা কুষ্টিয়ার গ্রামগঞ্জের এমনকি প্রতিবেশীদের কাছ থেকে এমন ধারণাই পেয়ে এসেছি। কিন্তু বর্তমানে তা পাল্টে গর্বের ধনে রূপান্তরিত হয়েছে। এর জন্য কয়েকজন নিবেদিত গবেষক ও শিল্পী প্রশংসার দাবিদার হতেই পারেন। তাঁদের জন্য দেশ-বিদেশের গবেষকদের আজ এত আগ্রহ। কখনো কখনো তা থেকেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু; যেমন লালন গবেষণার ভাণ্ডারে নিজের নাম সংযুক্তির অভিপ্রায়। কারণও যথেষ্ট রয়েছে। এ দেশের সাম্প্রদায়িক মনোভাব, অমানবিকতা ও লোকসংস্কৃতির ধারালো খননকাজে লালনের রচনাকর্ম ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কশীল হিসেবে পাওয়া। তারপর দর্শন। বাঙালির দর্শনচর্চা অনুসন্ধান ও সাহিত্য উৎকর্ষ-পরিচর্যায় যখন বিদেশি নানা দর্শনের প্রভাব নিয়ে যত্রতত্র পদচারণ লক্ষ করা গেল-তখন প্রসঙ্গ এল শেকড়ের সন্ধান করার। দেখা গেল বিশ্বদর্শনের মানবিক মূল্যবোধের সঙ্গে লালনের মতাদর্শে গভীর সংযোগ। ফলে ধীরে ধীরে লালনকে দাঁড় করানো হলো বিশ্বদর্শনের অধিনায়ক স্বরূপ। তবে তা সংস্কৃতির মুক্তির প্রশ্নে লালনকে ‘ভর’ করা মাত্র। লালনকে জাতে তোলার চেষ্টা, হিন্দু-মুসলমান বা কমিউনিস্ট বানানোর চেষ্টা; এমনকি জন্মাঞ্চল নিয়ে, বংশপরম্পরা নিয়ে টানাটানি চলল দেদারসে। এতে লালনের আদর্শগত অবস্থানের লাভ-ক্ষতি যা-ই হোক, আবিষ্কারের জায়গা তো তৈরি হলো! অবশেষে লালন ব্যবসা-বাণিজ্যে এসে দাঁড়াল। যেমন লালনের মাজারে অট্টালিকা বানানোর ছুতোয় হোটেল ব্যবসার পরিকল্পনা, ক্যাসেট-সিডি বাজারে ছেড়ে লালনের গানকে পপ-রকের সঙ্গে মিশিয়ে নানা ধাঁচে চালানো, লালনবিষয়ক সংকলন-সংগ্রহ-সমগ্র করার হিড়িক-এমন কত কি!
তবে সার্বিকভাবে দেখলে লালন বাঙালি জাতির পুরোধা হয়ে উঠেছেন ভক্তি-প্রেম ও বিতর্কের মধ্য দিয়েই। এগুলো লালনের প্রাপ্য, যা আমরা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু নেওয়ার ব্যাপারটা কতটুকু সার্থক হয়েছে, সে বিষয়ে অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, লালনের গানের সুরকে যথার্থ অর্থে সংরক্ষণই করা হয়নি, শনাক্ত করা হয়নি সুরবৈশিষ্ট্য, তাল-আঙ্গিক বা গায়কির ধরন। গানের অর্থবিশ্লেষণনির্ভর গবেষণাও নজরে পড়ল না এখনো, গান ও সুরকে আন্তর্জাতিক উপযোগী স্বরগ্রাম প্রণয়ন কিংবা পরিবেশনার আঙ্গিক-বৈশিষ্ট্য নিয়েও কোনো পরিকল্পনা দেখা যায়নি-দু-দশজন সাধু ও নিবিষ্ট ব্যক্তির কিঞ্চিৎ উদ্যোগ ছাড়া। অথচ লালনকে প্রকৃত মূল্যায়নের জন্য এবং সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির জন্য এর বিকল্প নেই।
সম্প্রতি প্রকাশিত লালনবিষয়ক আরও একটি গ্রন্থ বাউল কবি লালন ও তাঁর গান সংযোজিত হলো। গ্রন্থটি পাঠ করতে গিয়ে উপরিউক্ত প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল বলেই পাঠককে অবহিত করলাম। ড· মৃদুলকান্তি চক্রবর্তীর গবেষণালব্ধ গ্রন্থটির প্রসঙ্গ নিয়েও সরাসরি কথা বলা যেত, কিন্তু চার পর্বে বিভাজনের কারণ দেখেই উপরিউক্ত আলোচনা। প্রথম পর্বে বাউলগানের উৎপত্তি, দ্বিতীয় পর্বে নির্বাচিত লালনগীতি, তৃতীয় পর্বে স্বরলিপি এবং শেষে ইংরেজি অনুবাদ। গ্রন্থটির নামকরণে লালন সম্পর্কে বিশেষণ রাখা হয়েছে ‘বাউলকবি’ বলে। আমরা ইতিপূর্বে সাঁই, শাহ্, ফকির, দরবেশ, সাঁইজি প্রভৃতি উপাধি ব্যবহৃত হতে দেখেছি। এ নিয়ে অনেক বিতর্কও চলমান আছে। বিতর্কের কারণ লালনকে কবি বা গীতিকার-সুরকার কিংবা গানের আঙ্গিক-বৈশিষ্ট্যে বিচার না করে দর্শন বা মতাদর্শ বিচারই মুখ্য থেকেছে। এই গ্রন্থে দার্শনিক বিশ্লেষণের দিকে মনোযোগ না দিয়ে পদ, স্বরলিপি ও অনুবাদের দিকেই নজর দেওয়া হয়েছে বলে ‘বাউলকবি’ বলাটা সরল অর্থে যথার্থ বিবেচ্য। দ্বিতীয় পর্বে ১২৯টি গান নির্বাচন করে ছেপেছেন, সেখানে কোনো ধরনের গানকে নির্বাচনের জন্য গুরুত্ব দিয়েছেন, তা আলোকপাত করলে আরও বোধগম্য হতো। এ ছাড়া ছাপা হওয়া গান আর বাউলশিল্পীদের প্রচলিত গীতের শব্দের ও বাক্যবিন্যাসের মধ্যে ভিন্নতাও লক্ষ করা যায়। যথার্থ পাণ্ডুলিপির নিদর্শন না থাকার জন্য এই বিতর্ক যুগ যুগ ধরেই রয়েছে। লেখক অবশ্য পূর্বাভাষে বলেছেন, এগুলো তাঁর ফিল্ডওয়ার্কের ভিত্তিতে সংগৃহীত। সে ক্ষেত্রে গানের শিল্পী ও সংগৃহীত অঞ্চলের উল্লেখ করলে তাৎপর্যবহুল হতো। তৃতীয় পর্বে ৩১টি স্বরলিপি সম্পাদনের ক্ষেত্রে লেখক খোদাবকশ সাঁইয়ের গায়নরীতিকে মুখ্য করে প্রবীণ স্বরলিপিকার সুধীন দাশের স্বরলিপিকেই এখানে ছেপে দিয়েছেন, যা লালন সংগীত সংরক্ষণে অন্যতম আদরণীয় সম্পদরূপে বিবেচিত। তবে স্বরলিপির পাতায় তাল, মাত্রা, লয়সহ স্বরলিপিকারের নাম উল্লেখ থাকলে আরও প্রাণবন্ত হতো। শেষ অধ্যায়ে নির্বাচিত ৫১টি গানের অনুবাদ, যা অধ্যাপক আবু রুশদ ও সমীর দাশগুপ্তকৃত।
সার্বিক বিবেচনায় লেখক গ্রন্থটিতে ‘বাউল’ শব্দটাকেই অধিক গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন। বাউল শব্দের অর্থকে ঐতিহাসিক অবস্থান, আদিত্ব, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য থেকে সুচয়ন করেছেন। এতে বাংলার লোকজীবনের সঙ্গে বাউলের নিবিড় সম্পর্কের বয়ান ভূমিকাতে উঠে এসেছে। উপাত্ত হিসেবে চর্যাগীতি, শ্রীকৃষ্ণ বিজয়, চৈতন্য চরিতামৃত, রাগাত্বিকা, রবিদর্শন, সুফিদর্শন, তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম, সাংখ্যদর্শন, যোগদর্শনসহ নানা বিষয়ের মধ্য দিয়ে বাউলসমাজ, বাউলদর্শন ও বাউলগানকে পর্যালোচনা করেছেন। সমৃদ্ধ ভূমিকা ছাড়া এটি একটি সম্পাদনা শ্রেণীর গ্রন্থ, যা আগ্রহী গবেষক ও পাঠকের কাছে লালন সম্পর্কে প্রায়োগিক ও সাহিত্যমূল্যের নতুন খোরাক জোগাবে। এমন ধরনের প্রায়োগিক পর্যায়ের কাজ আরও অনেক বেশি বেশি হওয়া দরকার-অন্তত প্রজন্মের কাছে লালনকে চর্চাপোযোগী করে তোলার স্বার্থে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০৩, ২০০৯
asad
lalol er gaan thake onek kisu sikhar asa
boshirullaha
laloner bani allah o parakaler path dekhay.
fazlul karim
ভাল
সাগর
””লালেনর গানেক পপ-রেকর সেঙ্গ িমিশেয় নানা ধাঁেচ চালােনা “”””
এর িবপেখ আিম িতব্র প্রিতবাদ করিছ।