দলিতদের জীবনচিত্র
নাসির উদ্দিন হায়দার
দক্ষিণ এশিয়ার জাতি-বর্ণ বৈষম্যঃ পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ-ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী, জুলাই ২০০৮, সেন্টার ফর সোশ্যাল রিসার্চ, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, চট্টগ্রাম,
১৬০ পৃষ্ঠা, ২০০ টাকা
“ভোরের আলো ফোটার আগেই তাঁরা ছড়িয়ে পড়েন শহরের প্রতিটি সড়কে-অলিগলিতে। গায়ে লাল শার্ট, হাতে ঝাঁটা-নাগরিকেরা পথে নামার আগেই গোটা শহরটাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ফেলেন তাঁরা। সিটি করপোরেশন তাদের নাম দিয়েছে সেবক। শহরটাকে রূপবতী করে ঘরে ফেরেন তাঁরা।
“এ সেবকদেরই আরেকটি পরিচয় তাঁরা নিচু বর্ণ-জাতি। তাঁদের মতো আরও কয়েকটি শ্রেণীর মানুষ রয়েছেন যাঁরা অস্পৃশ্য ও দলিত হিসেবে পরিচিত। হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্প্রদায়েই এঁদের অস্তিত্ব রয়েছে। এঁরা উচ্চবর্ণের মানুষের কাছে অশুচি-অপবিত্র। উচ্চবর্ণের মানুষের বাড়ি, মন্দির, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, চা দোকান, খেলার মাঠ, নাটক-সিনেমা হল, শ্মশান, সামাজিক সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দলিতদের প্রবেশে বিভিন্নভাবে ও বিভিন্ন মাত্রায় অস্বীকৃতি জানানো হয়। যেহেতু তাঁরা ‘অশুচি ও অপবিত্র’ তাই তাঁরা প্রতিবেশী বা পবিত্র জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা স্থানে বাস করেন। নির্ধারিত বসতির বাইরে বাড়ি তৈরি বা ভাড়া নেওয়া সমাজে অনুমোদিত নয়। অথচ গ্রামীণ ও আধা-নগর অধ্যুষিত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সামাজিক সম্পর্ক ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ঐতিহ্যিক পেশাগুলোর সঙ্গেই জড়িত দলিত সম্প্রদায়। অবশ্য পেশাগত ক্ষেত্রে এঁরা দাসসুলভ আচরণই পান অদলিতদের কাছ থেকে।”
দলিতদের প্রতি নিষ্ঠুর বৈষম্য ও তাঁদের এই জীবনচিত্র ফুটে উঠেছে ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর দক্ষিণ এশিয়ার জাতি-বর্ণ বৈষম্যঃ পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ গ্রন্থে।
লেখকের এই সমীক্ষার প্রতিপাদ্য সমকালীন গ্রামীণ বাংলাদেশে অধস্তনতা এবং শ্রমভিত্তিক বৈষম্যের প্রকৃতি ও মাত্রা নির্ণয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, হিন্দু দলিতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শ্রেণী হলো বাশপর (মৃতের সৎকার করে), ডোম, মেথর, নাপিত, মুশাহরী (ইঁদুর ও বাইন মাছভোজী), ধোপা, মুচি, তেলি, কলু, তাঁতি, মাদিগা (চা-বাগান কর্মী), কুমার, জলদাস, যুগী, ধোপা, মাসুয়ারা (শূকরপালক); মুসলিমদের মধ্যে দলিতরা তেলি, নাপিত, তাঁতি, হাজাম, কসাই, বেদে ও হিজড়াসহ আরও অনেক নামে পরিচিত। দলিতরা তাঁদের পেশা ও জাতি-বর্ণ অনুযায়ী ৪৫টি সম্প্রদায়ে বিভক্ত।
গবেষণায় দেখা যাচ্ছে-বেশির ভাগ দলিত, বিশেষ করে হিন্দু অস্পৃশ্যরা ভারতীয়দের উত্তরসূরি, তাঁরা এসেছেন মূলত বিহার, কানপুর, হাসিরবাগ, উত্তর প্রদেশের জব্বলপুর, অন্ধ্র প্রদেশ এবং এ ধরনের অঞ্চল থেকে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা ‘দাসসুলভ হীন কাজ’ করানোর জন্য মূলত এদের এ দেশে এনেছিলেন। যাঁরা সাধারণের কাছে মেথর বা ডোম হিসেবে পরিচিত। মূল জনবসতির বাইরেই তাঁদের বসতিগুলো মেথর বা হরিজনপট্টি, বেদে কলোনি, সুইপার কলোনি, জেলেপাড়া ও নাপিতপাড়া হিসেবে পরিচিত।
লেখক উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশে দলিতদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান বা তথ্য নেই। তবু বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এ সংখ্যা তিন দশমিক পাঁচ মিলিয়ন থেকে পাঁচ দশমিক পাঁচ মিলিয়ন হতে পারে।
বাংলাদেশে প্রচলিত ধারণা হলো দলিতরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী। লেখক দেখিয়েছেন ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও দলিতদের সংখ্যা কম নয়। তবে মুসলমানদের চেয়ে হিন্দুরা সংখ্যালঘু এবং দলিতরা এই সংখ্যালঘুদের মধ্যে সবচেয়ে প্রান্তিক ও বঞ্চিত।
লেখকের গবেষণায় দেখা গেছে, হিন্দু ও মুসলিম দলিতদের মধ্যে যথাক্রমে ৩৯ শতাংশ ও ৪১ শতাংশ উত্তরদাতার মাসিক আয় এক হাজার থেকে দুই হাজার ৯৯৯ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। হিন্দুদের মধ্যে ৬৪ শতাংশ ও মুসলমানদের মধ্যে ৬১ শতাংশ উত্তরদাতার শিক্ষা নেই। উভয় দলিত সম্প্রদায় রাজনৈতিকভাবেও বৈষম্যের শিকার। নিজস্ব নেতা নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ, রাজনৈতিক সমাবেশে অংশ নেওয়া, পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে দলিতদের অবস্থান খুবই দুর্বল। এ ছাড়া দলিত সম্প্রদায়ের নারীরা ফতোয়া, রাজনৈতিক ও পুলিশ সহিংসতার শিকার হন। প্রান্তিক স্তরে অবস্থানকারী দলিত সম্প্রদায়ের জীবিকায়ন বর্তমানে বিপন্ন হতে চলেছে।
বইটিতে সমকালাীন গ্রামীণ বাংলাদেশের এবং শ্রমভিত্তিক বৈষম্যের প্রকৃতি ও মাত্রা নির্ণয় যে শতভাগ সম্ভব হয়েছে তা বলা যাবে না। এ দেশের দলিতদের জীবনচিত্রের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর দলিতদের তুলনা করা গেলে বিষয়টা আরও পরিপূর্ণ হতো।
তবে ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর গবেষণা গ্রন্থটি অস্পৃশ্যদের ব্যাপারে সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। বইটির বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে গবেষকের সহকারী ইন্দ্রজিৎ কুণ্ডু মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন।
সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক অনুপম সেন লেখক পরিচিতিতে বইটিকে সুবিধাবঞ্চিত, নিগৃহীত ও অবহেলিত দলিত জনগোষ্ঠীকে নিয়ে বিভিন্ন বৈষম্যের ওপর রচিত একটি অসাধারণ দলিল বলে উল্লেখ করেছেন।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০৩, ২০০৯
Leave a Reply