চিত্র-কলা
আবুল ফজল
অবনীন্দ্রনাথের আবির্ভাবের পর থেকে দেশীয় চিত্রশিল্পের পুনর্জন্ম ঘটেছে-এইটী হাল আমলের প্রচলিত মত। সঙ্গে সঙ্গে এই মন্তব্যও শোনা যায় যে এই চিত্রশিল্পের অর্থকরী সাফল্য তেমন হচ্ছে না। অন্যান্য সভ্যদেশে চিত্রশিল্পের যে চাহিদা ও আদর, তার তুলনায় এদেশে তার চাহিদা ও আদর অতি নগণ্য। কাজেই চিত্রশিল্প এদেশে আশানুরূপ পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে না। এই আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে দেশীয় চিত্রশিল্পের উন্নতি ব্যাহত হচ্ছে এবং প্রতিভাবান শিল্পীদেরও বাধ্য হয়ে চাকরি করে জীবিকার্জন করতে হচ্ছে। অথবা স্বল্প পুঁজি ও সঙ্কীর্ণ আয়োজনের মধ্যে নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষা কল্পনা ও সাধনাকে সীমাবদ্ধ রেখে কায়ক্লেশে দিন কাটাতে হচ্ছে। ভারতীয় চিত্রশিল্প সম্বন্ধে এইসব মন্তব্য যে কিছুমাত্র অতিরঞ্জন নয়; এ বোধ করি সকলেই স্বীকার করবেন।
স্বদেশের নবজাগ্রত চিত্র-কলার প্রতি দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের এই যে অবহেলা ও অনাদর, এর মূলে, আমার মনে হয়, আমাদের কলা-শিল্প-জ্ঞানের অভাব ও অজ্ঞতাই দায়ী। অবশ্য শিল্পভাস্কর্য ইত্যাদি সুকুমার কলা কোনদিনই জনপ্রিয় ছিল না, হয়ত কোনদিন জনপ্রিয় হবেও না। তবুও বোধ হয়-এ সব শিল্পকলার সমজদারের সংখ্যা আমাদের দেশের মত এত শোচনীয়রূপে সীমাবদ্ধ অন্য কোন দেশেই নয়। মনে হয় চেষ্টা করলে আমাদের দেশেও শিক্ষিত সাধারণের মধ্যে শিল্প-সমজদার ও শিল্প-বোদ্ধার সংখ্যা সহজেই বাড়ানো যেতে পারে। এবং এও বোধ হয় সত্য যে এই সমজদারের সংখ্যা বৃদ্ধির উপরই ভারতীয় চিত্র-শিল্পের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। অবনীন্দ্রনাথের সামর্থø, নন্দলালের বিশ্বভারতীর আনুকূল্য, উকিল-ভ্রাতৃদ্বয়ের সুযোগ, দেবীপ্রসাদ, অসিতকুমার, মুকুল দে, আবদুর রহমান চাঘতাই ইত্যাদির মত চাকুরী লাভ, চিরকাল ধরে সব শিল্পীর ভাগ্যে জুটবে, এ কিছুতেই কল্পনা করা যায় না। অথচ সাধারণ লোকের মত শিল্পীদের জীবনেও তেল নূন লাকড়ির ভাবনা কিছুমাত্র কম নয় এবং ভাল ছবি আঁকতে পারেন বলেই যে কোনো দোকানদার এঁদের কাছ থেকে ‘তেল নূন লাকড়ি’র দাম এক কড়া ক্রান্তিও কম নেবেন, এও আশা করা যায় না। কাজেই চিত্র-শিল্পের মূল্যের উপরই শিল্পীদের নির্ভর করতে হবে, এবং তা দিয়েই তাঁদের বাঁচতে হবে।-অথচ শিক্ষিত সাধারণের মনে যদি শিল্পবোধ না জাগে, তাঁরা যদি ছবির অর্থ বুঝতে না পারেন, তাঁদের কাছ থেকে কোনো ছবির যথাযথ মূল্য কিছুতেই আশা করা যায় না। শুধু গৃহসজ্জার জন্য তাঁরা অবনীন্দ্রনাথের ‘শাহজাহানের মৃত্যুশয্যা’ ও ‘পধচলার শেষ’, বা নন্দলালের ‘সতী’র চেয়ে হলিউডের অভিনেত্রীদের ছবিই যে বেশী পছন্দ করবেন-এতে আর আশ্চর্যের বিষয় কি আছে! মাঝে মাঝে আমাদের দেশের কোনো কোনো শিক্ষিত লোকের মুখে রাফেল, দা-ভিঞ্চি ইত্যাদি বিদেশী নামজাদা শিল্পীদের সুপ্রসিদ্ধ দু-একখানি ছবির নামও শুনতে পাওয়া যায়, অথচ এঁরা অবনীন্দ্রনাথ বা নন্দলালের কোন ভাল ছবির নাম করতেও পারেন না! সাহিত্যের সঙ্গে তুলনা করে দেখলে এই বিষয়ে আমাদের শোচনীয় অজ্ঞতা অধিকতর পরিস্কুট হবে। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল এমনকি অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত ও কম শক্তিমান লেখকদের লেখার সঙ্গে আমাদের যে পরিচয়, সে পরিচয় দেশের শিল্পকলার সঙ্গে আমাদের নেই;-আমাদের সাহিত্যের ভাল বই, গল্প-কবিতা এমনকি চরিত্রের নামও অধিকাংশ শিক্ষিত লোক (স্কুল কলেজের ছাত্রদের মধ্যেও অনেকেই) করতে পারবেন; অথচ দেশের বড় বড় শিল্পীদের আঁকা ভাল ভাল ছবিগুলির নাম শিক্ষিত সমাজের হাজার-করা একজনও করতে পারবেন কিনা সন্দেহ। অশিক্ষিত ও অর্ধ-শিক্ষিত যদি চিত্রকলার অর্থ না বোঝে তা’তে বিশেষ দুঃখ করার থাকে না, কিন্তু দেশের শিক্ষিত মণ্ডলী, বিশেষতঃ কবি-সাহিত্যিক, শিক্ষক-অধ্যাপক, সম্পাদক, দেশনেতা ও অভিজাত সম্প্রদায়, যাঁরা দেশের সমৃদ্ধ ও বিদগ্ধ মনের প্রতিনিধি, তাঁরা যদি দেশের শিল্প-কলার সঙ্গে পরিচয় না রাখেন এবং স্বদেশের বড় বড় শিল্পীদের আঁকা ছবির অর্থ বুঝতে ও তার কদর করতে না জানেন তা’হলে সত্যিই পরিতাপের বিষয় বই কি।
প্রবাসী বঙ্গ-সাহিত্যের কলিকাতা অধিবেশনের শিল্প-বিভাগের সভাপতি সুপ্রসিদ্ধ শিল্পী দেবীপ্রসাদ-ছবির সঙ্গে কাব্যের তুলনা করেছিলেন, মনে পড়ে। তিনি সেই প্রসঙ্গে আরও বলেছিলেন-কাব্যের অস্বাভাবিক উপমা পড়ে আমরা বি্নয় প্রকাশ করি না, অথচ ছবিতে অস্বাভাবিকতা দেখলে আমরা ‘ওরিয়েন্টাল আর্ট’ বলে হাসি আর নাক সিঁট্কাই। তাঁর ভাষা আমার ্নরণ নেই, তবে এই ধরনের অভিযোগ তিনি করেছিলেন তা মনে পড়ে। অভিযোগটি যে সত্য সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। মনে হয় ছবির ও কাব্যের প্রতি পাঠকের এই যে বিভিন্ন ব্যবহার তার মূলেও একই কারণ বিদ্যমান। কাব্যের অর্থ ভাষা ও ছন্দ আমরা বুঝি, না বুঝলেও বুঝিয়ে দেওয়ার লোকের অভাব হয় না। কিন্তু ছবির অর্থ ভাষা ও টেকনিক আমরা বুঝি না এবং সারা শহর খুঁজেও বুঝিয়ে দেওয়ার লোক পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।
ভারতীয় শিল্পের একটা নিজস্ব ভাষা আছে এবং প্রত্যেক শিল্পীর আলাদা স্বকীয় টেকনিক আছে। এবং আছে বলেই ইউরোপীয় ছবি থেকে জাপানী ছবি আর জাপানী ছবি থেকে ভারতীয় ছবি বিশিষ্টরূপে পৃথক;-এবং একই ‘স্কুল’ ও আদর্শভূক্ত হওয়া সত্ত্বেও অবনীন্দ্রনাথের ছবি থেকে নন্দলালের ছবি বা নন্দলালের ছবি থেকে অসিতকুমারের ছবি পৃথক ও আলাদা-যেমন পৃথক ও আলাদা রবীন্দ্রনাথের রচনা থেকে শরৎচন্দ্রের রচনা-বা শরৎচন্দ্রের রচনা থেকে নজরুল ইসলামের রচনা।-তাই মনে হয়, ছবি বুঝতে হলে ছবির ভাষা ও শিল্পীর টেকনিকের সঙ্গে ছবি-পাঠকের পরিচয় থাকা দরকার। দেশের শিল্পানুরাগীদের এ বিষয়ে অবহিত হওয়া উচিত-এবং শিক্ষিত সমাজ যাতে আমাদের দেশের বড় বড় শিল্পীদের ভাল ভাল ছবিগুলোর পরিচয় পেতে পারেন তার ব্যবস্থা বাঞ্ছনীয়। আমার মনে হয় দেশের সাময়িক পত্রিকাগুলো এ বিষয়ে কিছুটা দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে। তাঁরা যদি মাসে মাসে অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, দেবীপ্রসাদ ইত্যাদি বড় বড় শিল্পীদের ভাল ভাল ছবিগুলোর প্রতিলিপি ও সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃত শিল্প সমজদারের লেখা ঐ সব ছবির বিস্তৃত পরিচয় ছাপেন তা’হলে শিক্ষিত সমাজে ছবিগুলো সহজে পরিচিত হতে পারে এবং দেশের মানুষের মনে শিল্পবোধ জাগাবারও একটা সুযোগ হয়।
রবীন্দ্রনাথের ছবি বিদেশে শিল্প-সমজদারদের সমাদর লাভ করেছে অথচ শিল্প-ভাষা-জ্ঞানের অভাবে আমাদের শিক্ষিত মহলে ঐগুলো এখনো হাসির বিষয় হয়েই আছে।
জাতীয় চিত্রশালা জাতীয় চিত্র-শিল্পকে অমরত্ব দানের অন্যতম উপায়। কিন্তু জাতীয় চিত্রশালা এখনো আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় নি। ভারতীয় চিত্র-কলার এই যে নতুন যুগ তার প্রবর্তক বাংলাদেশ এবং আজও বাংলাদেশের কৃতী শিল্পীরাই ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে এই শিল্পের পৌরাহিত্যে রত। কাজেই এতদিনে, অন্ততঃ বাংলাদেশে, একটি জাতীয় চিত্রশালা প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু মনে হয় যত দিন চিত্র-শিল্প শিক্ষিত সমাজে দুর্বোধ্য থেকে যাবে ততদিন পর্যন্ত চিত্র-কলার জন্য তাঁদের কাছ থেকে কোন প্রকার অর্থকরী পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া যাবে না। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কর্পোরেশন, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল ইত্যাদি বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলি যদি সমবেত ভাবে সহযোগিতা করেন তা’হলে কলিকাতায় একটা জাতীয় চিত্রশালা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। ভবিষ্যতে সরকারী রাজস্ব-নিয়ন্ত্রণের ভার যদি দেশীয় লোকদের হাতে আরও ব্যাপকভাবে আসে, সরকারের পক্ষেও এই জাতীয় দাবির প্রতি বেশীদিন উদাসীন থাকা তখন সম্ভব হবে না। বর্তমানে সরকারী স্কুল-কলেজগুলোতে লাইব্রেরীর সাহায্য বাবদ সরকার কিছু কিছু অর্থসাহায্য দিয়ে থাকে। সেইসঙ্গে কর্তৃপক্ষ যদি প্রত্যেক স্কুল-কলেজে ছোটখাট এক-একটি চিত্রশালা (স্কুল লাইব্রেরী বা কমনরুমেও তা হতে পারে) প্রতিষ্ঠার আদেশ ও সেই বাবদ কিছু কিছু অর্থসাহায্যের ব্যবস্থা করেন তা’হলে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজ থেকেই শিল্প-শিক্ষা আরম্ভ হতে পারে। সরকারী ও বেসরকারী বিদ্যালয়গুলোতে ড্রইং-শিক্ষকের যে পদ আছে সেগুলোর মূল্য যদি আরও বাড়ানো হয়, এবং আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলার জ্ঞান ও পরিচয় আছে এমন লোক যদি ঐ পদে নিযুক্ত হন, তা’হলে শিক্ষার গোড়া থেকেই শিক্ষার্থীরা ভারতীয় চিত্র-শিল্পের ভাষা ও টেকনিকের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ পেতে পারে। এবং ভারতীয় চিত্র-শিল্প অজ্ঞ লোকের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ থেকেও রেহাই পেয়ে একটা স্থায়ী উন্নতির উপর প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে।
ভূমিকাঃ আবুল মনসুর
১ জুলাই ২০০৯ আবুল ফজলের ১০৬তম জন্মবার্ষিকী। আমার বাবা আবুল ফজলের পরিচয় মূলত কথাসাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ এবং সমাজ ও রাজনীতিসচেতন প্রাবন্ধিক হিসেবে। দেশ ও জাতির বিভিন্ন সংকটকালে তাঁর সাহসী উচ্চারণ দেশবাসীকে দিকনির্দেশনা দিয়েছে। পারিবারিক ও পেশাগত দায়িত্বের বাইরে সাহিত্য, শিক্ষা, সমাজ ও রাজনীতি ছাড়া অন্য বিষয়ে তাঁর আগ্রহের পরিচয় আমরা ছোটবেলা থেকে কমই পেয়েছি। চিত্র-ভাস্কর্যের বিষয়ে তাঁর কোনো মুগ্ধতার কথা তিনি আমাদের কোনো দিন বলেননি। তাঁর ছয় সন্তানের মধ্যে একমাত্র আমি চিত্রকলা বিষয়ে পড়াশোনা করার আগ্রহ প্রকাশ করি। তিনি এ বিষয়ে সম্মতি বা অসম্মতি কোনোটিই প্রকাশ করেননি, তবে আমাকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে তাঁর বন্ধু শিল্পী জয়নুল আবেদিনের পরিচালনাধীন তৎকালীন আর্ট কলেজে ভর্তি করিয়ে এসএম হলে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া আমার প্রায় সমবয়সী মামার জিম্মায় রেখে চট্টগ্রাম ফিরে আসেন। নিজ নিজ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার তিনি ছোটবেলা থেকে আমাদের দিয়েছিলেন। এর পরও আমার শিল্পচর্চায় অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি কখনো জানার আগ্রহ প্রকাশ করেননি, শুধু ছাত্র থাকাকালীন তাঁর বসার ঘরে টাঙানোর জন্য আমাকে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের দুটি তেলরং চিত্র আঁকিয়ে নিয়েছিলেন।
ছবি আঁকার দিকে ঝোঁকটা বরং আমরা পেয়েছিলাম আমাদের নানা-মামাদের কাছ থেকে। আমার নানা কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক মাহবুবুল আলমের ছোট ভাই কবি ওহীদুল আলম (যাঁকে আমরা ছোট নানা বলে ডাকতাম) ভালো ছবি আঁকতেন। আর মামা-খালাদের প্রায় সবারই সহজাত আঁকার ও গাওয়ার ক্ষমতা ছিল। মামা মঈনুল আলম কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই অসাধারণ বাস্তবানুগ প্রতিকৃতি আঁকতে পারতেন। আরেক মামা সবিহ উল আলম পাকিস্তান আমলেই লাহোরের ন্যাশনাল কলেজ অব আর্ট থেকে ডিগ্রি নিয়ে ফিরেছিলেন। মূলত সবিহ মামাই আমার শিল্পী হওয়ার প্রচেষ্টার পেছনে আসল প্রণোদনা। তাঁকে দেখে এবং তাঁর কাছে কিছুটা শিখেই এ পথে আগ্রহী হয়েছিলাম। এ বিষয়ে বাবা বা তাঁর পরিবারের কারও প্রতিভার খবর কখনো শুনিনি। বাবার প্রচুর লেখালেখির জগতেও চারুকলার কখনো ঠাঁই হয়েছে এমনটি জানা ছিল না।
সম্প্রতি হঠাৎ করেই বাবার এ রচনাটি চোখে পড়ল। এটি চট্টগ্রামের বইঘর থেকে বাংলা ১৩৮২ সালে প্রকাশিত আবুল ফজল রচনাবলী (প্রথম খণ্ড)-তে ছাপা হয়েছে। রচনাবলিতে উল্লিখিত হয়েছে যে নিবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল মাসিক সওগাত পত্রিকায় আনুমানিক ১৩৩৪ সালে, অর্থাৎ ইংরেজি ১৯২৭ সালে। ক্ষুদ্রাকৃতির এ রচনাটি পড়ে বি্নয়ের সীমা থাকে না। বি্নয় নানা কারণে। প্রথমত, অতি নিকট সান্নিধ্যে থেকেও চিত্র-ভাস্কর্য সম্পর্কে যাঁর বিশেষ কোনো আগ্রহের প্রকাশ কখনো দেখিনি, তিনি মাত্র ২৪ বছর বয়সে এ সম্পর্কে ভেবেছেন ও লিখেছেন। দ্বিতীয়ত, ওই বয়সে ভারতীয় চিত্রকলা বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও এর সমস্যাগুলোর সমাধানের ব্যাপারে তাঁর ভাবনার আধুনিকতা পরম বি্নয়কর। মনে রাখতে হবে যে এ নিবন্ধটি যখন রচিত হচ্ছে তখন জয়নুল আবেদিন বা অন্য কোনো মুসলিম শিল্পী চিত্রকলার জগতে নাম কুড়াননি, এমনকি বাঙালি মুসলিম সমাজে চিত্রকলা ছিল প্রায় অপরিজ্ঞাত একটি বিষয়। এটি কোনো ফরমায়েশি লেখা-তা-ও মনে হয় না, আবুল ফজল তখনো এতটা পরিচিতি অর্জন করেননি যে তাঁর কাছে এ রকম বিষয়ে লেখার অনুরোধ আসবে। তবে নানা পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় আমার মনে হয় ১৯২৭ সালে নয়, নিবন্ধটির রচনাকাল ১৯৩০-এর পরে ও ১৯৪৩-এর আগে কোনো এক সময়। এর দুটি কারণ। প্রথমত, লেখক রবীন্দ্রনাথের চিত্রকৃতির উল্লেখ করেছেন, বিদেশে তাঁর চিত্রের সমাদরের কথা বলেছেন। বিদেশে রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রথম প্রদর্শনী হয় প্যারিসে ১৯৩০ সালে, এর আগে চিত্রশিল্পী হিসেবে রবীন্দ্রনাথের মূল্য বা বিদেশে প্রশংসার কথা বলা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, লেখাটির কোথাও জয়নুল আবেদিনের নাম উল্লিখিত হয়নি। চিত্রশিল্পী জয়নুল খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ চিত্রমালার মধ্য দিয়ে। অতএব, লেখাটি ১৯৪৩-এর পর রচিত হলে এতে জয়নুল আবেদিন অবশ্যই উল্লেখিত হতেন।
এ রচনাটির লেখক যে প্রাচ্য ও ইউরোপীয় চিত্রকলার মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল সেটি যেমন বোঝা যায়, তেমনি তিনি যে ভারত, চীন, জাপান, পারস্য ইত্যাদি প্রাচ্যদেশীয় শিল্পের পরস্পরের মধ্যে ফারাকটিও ধরতে পারেন, সেটিও জানা যায়। অবনীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে আধুনিক ভারতীয় শিল্পের উন্মেষ বিষয়ে যেমন তিনি সচেতন, তেমনি চিত্রশিল্পী হিসেবে রবীন্দ্রনাথের অবস্থান তখনো এ দেশে বিশেষ পোক্ত না হওয়া সত্ত্বেও আবুল ফজল তাঁর শিল্পের গুরুত্ব অনুমান করতে পারছেন। অবনীন্দ্রনাথ-রবীন্দ্রনাথ বা রাফায়েল-দা ভিঞ্চি ছাড়াও শিল্পীদের মধ্যে তিনি নন্দলাল বসু, অসিতকুমার হালদার, দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী, উকিল ভ্রাতৃদ্বয় (সারদাচরণ ও বরদাচরণ), মুকুল বসু, আবদুর রহমান চাঘতাই প্রমুখের উল্লেখ করেছেন। এমনকি তিনি অবনীন্দ্রনাথ ও নন্দলালের কয়েকটি চিত্রকর্মেরও উল্লেখ করেছেন, যাতে বোঝা যায় এসব ছবি তাঁর দেখার অভিজ্ঞতায় রয়েছে। শিল্পী দেবীপ্রসাদের যে বক্তৃতার উল্লেখ করেছেন তাতে মনে হয় তিনি ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত থেকে সে বক্তৃতা শুনেছেন।
আজ থেকে প্রায় ৭০-৮০ বছর আগে আবুল ফজল চিত্রশিল্প অনুধাবনের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনি এও সঠিকভাবে অনুমান করতে পেরেছিলেন যে চিত্রশিল্পের বিকাশ ও জনগণের শিল্পরস উপলব্ধির উন্নতি ঘটাতে হলে জাতীয় চিত্রশালা স্থাপনের বিকল্প নেই। উল্লেখ্য, এত বছর পরও সে প্রত্যাশিত চিত্রশালাটি আমাদের দেশে স্থাপিত হয়নি। চিত্রশালা ছাড়াও তিনি বিদ্যালয়গুলোতে আধুনিক শিল্পের গতি-প্রকৃতি বিষয়ে জ্ঞানসম্পন্ন ড্রয়িং শিক্ষক নিয়োগ ও পাঠাগারের পাশাপাশি ক্ষুদ্রায়তনে শিল্প-সংগ্রহালয় গড়ে তোলার পরামর্শ দেন, যাতে কোমলমতি শিশুরা ছোটবেলা থেকেই চিত্র-ভাস্কর্যের রস আহরণে সক্ষম হয়। এ উপলব্ধি আজকের দিনেও প্রাসঙ্গিক। পূর্ব প্রকাশিত হলেও আবুল ফজলের এ রচনাটি দীর্ঘবি্নৃত এবং তাঁর কালের ও বর্তমান প্রজন্মের কারোরই বিশেষ নজরে পড়েনি। কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ আবুল ফজলের জন্মতিথিতে তাঁর একটি ভিন্ন আগ্রহের বিষয়ের পুনরুদ্ধার তাঁর গুণগ্রাহীদের বিশেষ আকর্ষণের বিষয় হবে বলে মনে করি।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০৩, ২০০৯
Leave a Reply