কয়েক বছর ধরে প্রথম আলো একুশের নির্বাচিত ১০টি প্রকাশনা বাছাই করে তাদের গ্রন্থ-সমালোচনা ছেপে থাকে। যদিও কোথাও স্পষ্ট করে বলা হয় না-তবু পাঠকেরা বুঝে নেন-এই ১০টি প্রকাশনা প্রথম আলোর বিবেচনায় সেরা দশ। এবারের গ্রন্থনায় শাহাদুজ্জামানের ক্রাচের কর্নেল বইটির সমালোচনা পড়ে ঠিক বুঝতে পারলাম না, প্রথম আলো না সমালোচক-কার বিবেচনা যথার্থ। সমালোচনার পুরোটা জুড়ে বইটি উপন্যাস হয়নি এবং কেন উপন্যাস হয়নি তা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। বইটিতে সৃজনশীলতা বা ভালো দিকের তেমন কোনো উল্লেখ নেই। তাই একজন পাঠক হিসেবে সমালোচকের সঙ্গে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণ করছি।
ঐতিহাসিক পাত্রপাত্রী নিয়ে উপন্যাস বা যেকোনো গল্প রচনা অত্যন্ত দুরূহ কাজ। একদিকে ইতিহাসঘনিষ্ঠ থাকা, অন্যদিকে কথাশিল্পের ব্যাকরণ মেনে চরিত্র নির্মাণ, বর্ণনাকৌশলে শিল্পিত থাকার চেষ্টা করা কঠিন কাজ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঠিক আগের ও পরের ঘটনাবহুল বছরগুলো ছিল ঘটনাবহুল ও বিচিত্র চরিত্রের প্রাচুর্যে ঐশ্বর্যময়। অন্য কথায়, সময়ের দিক থেকে এটি একটি বিশাল ক্যানভাস। শতবর্ষের হিরণ্ময় নীরবতা ভেঙে বাঙালি জাতির স্বাধীনতার ইতিহাসের মাহেন্দ্রক্ষণের পারিপার্শ্বিক বর্ণনা কোনো অনায়াসের বিষয় নয়। খাটাখাটুনি বা সহজ ভাষায় আমরা যাকে হোমওয়ার্ক বলি, এর পরিমাণের চেয়ে পাঠকের কাছে ঐতিহাসিক তথ্যের যৌক্তিক সংযোজন (আর্টিকুলেশন) ও উপস্থাপনের মুনশিয়ানাতেই নির্ধারিত হয়ে যায়-এটি ইতিহাসের দলিল, ইতিহাসনির্ভর বীরগাথা, ব্যক্তিগত শ্রদ্ধাঞ্জলি, না শিল্পসুষমায় পরিমার্জিত উপন্যাস। শাহাদুজ্জামান কঠিন পরিশ্রম করে সেই বিশাল ক্যানভাসে কথাসাহিত্যে ইতিহাস এঁকেছেন। সমালোচক মহোদয় বিষয়টি বিবেচনা বা শনাক্ত করতে কার্পণ্য করেছেন বলে মনে হচ্ছে। সমগ্র সমালোচনায় লেখকের দরদ, সহানুভূতি ও সহৃদয় বর্ণনার কথা ছাড়া এই গ্রন্থের আর কোনো ভালো দিক সমালোচকদের চোখে পড়েনি।
পাঠক হিসেবে আমি বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী পরিণত বয়সের কয়েকজন মানুষকে বইটি পড়তে দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম-বইটাকে তাদের কী মনে হয়েছে। জীবনী গ্রন্থ? গবেষণা-অভিসন্দর্ভ? ইতিহাস? উপন্যাস? না অন্য কিছু? তাদের কারও কাছেই এটাকে গবেষণা অভিসন্দর্ভ মনে হয়নি। এটা কর্নেল তাহেরের জীবনীগ্রন্থও নয়। এটাকে ইতিহাসের বই বা ইতিহাসভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনামূলক বইয়ের তালিকাতেও ফেলা যায় না। তবে এটা উপন্যাস কি না-এ প্রশ্নে সবাই যেন হকচকিত। এ কেমন প্রশ্ন? বলা বাহুল্য, এঁরা পাঠক, সমালোচক নন। ধীরে ধীরে কথকতার বাতাবরণ থেকে বেরিয়ে আসে-এ বইয়ের কেন্দ্রীয় চরিত্র কর্নেল তাহের সবার কাছে একনায়কোচিত চরিত্রে আবিভূêত হয়েছেন, যা তাদের সাধারণ জ্ঞানে কখনো জানা ছিল না। ভাবনার এই রূপান্তর ঘটেছে লেখকের বর্ণনাশৈলীতে, ইতিহাস পাঠে নয়। সবার কাছে মনে হয়েছে-তরুণ বয়সে রোমান্টিক চিন্তাভাবনা ও রাজনৈতিক মতাদর্শ অন্তরে ধারণ করে জনবিচ্ছিন্ন থেকেও নিয়তি-নির্ধারিত পথে পৌরাণিক চরিত্রের মতো তাহের এগিয়ে যান-ক্রাচের খট খট শব্দ তুলে। সমালোচকের কাছে এটা পূর্বগঠিত ও অপরিবর্তিত। পরিবার, প্রেম, ভালোবাসা, সন্তান-কোনো কিছুই তাঁকে স্পর্শ করে না। এই গুণ প্রতিবেদন লেখার নয়, কথাসাহিত্যিকের, লেখার এই দক্ষতার কারণেই তাহের ইতিহাসের চরিত্র থেকে পাঠকের কাছে উপন্যাসের চরিত্রে রূপান্তরিত হন। এ যেন ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া’। তাহেরকে পাঠক নতুন করে দেখেন-মূলত লেখকের শিল্পিত উপস্থাপনার কারণে।
পাঠক মানতে রাজি নন-এ বইয়ে যারা ভালো তারা সবাই ভালো, যারা খারাপ তারা পুরোপুরি খারাপ। জিয়াউর রহমানকে ‘কৌশলী’ করে উপজীব্য করা হয়েছে-না ভালো না মন্দ এমন নির্মোহতায়। একইভাবে লেখক তাহেরের পরিবারের সব সদস্যের প্রতি একই রকম শ্রদ্ধাশীল, এমন প্রতিফলন বইয়ে আছে বলে মনে হয় না। মিশুর প্রসঙ্গ সমালোচকের কাছে অবান্তর মনে হয়েছে। কিন্তু এর মাধ্যমে লুৎফে তাহেরা, আনোয়ার, বেলাল বা মিশুকে নিয়ে এ উপন্যাসের ধারাবাহিকতায় কোনো ডুলজি বা ট্রিলজি রচনার অমিত সম্ভাবনা সমালোচকের চোখে পড়েনি বলেই তা অবান্তর মনে হয়েছে। বড় মাপের কাজ বোঝার ক্ষমতা সবার হয় না।
বাংলাদেশে ইতিহাস রচিত হয় বা বর্ণিত হয় রাজনৈতিক মতাদর্শ অনুযায়ী; কোনো এক দিকে উৎসাহের আতিশয্য নিয়ে। সমালোচক মহোদয় এটাকে যতই পারিবারিক শ্রদ্ধানামা বা বীরগাথা বলুন-এর সুসবল দিক হলো, ইতিহাস বিনির্মাণে সত্যাশ্রয়ী ও নির্মোহ থাকা এবং প্রচণ্ড রকমের পরিমিতি বোধের মাধ্যমে জাতির ক্রান্তিলগ্নের ইতিহাসের বিশাল ক্যানভাসকে ৩৫০ পৃষ্ঠায় সীমিত রেখে পাঠককে ‘সেই সময়’ সম্পর্কে সমৃদ্ধ করা। লেখক রাজনীতিসচেতন কিন্তু নিরপেক্ষ; এবং তার নিরপেক্ষতা নৈর্ব্যক্তিকভাবেই বইয়ে প্রতিফলিত হয়েছে। এটি আওয়ামী, জাতীয়তাবাদী বা জাসদীয় বিষয় নয়। পাঠকের কাছে এটিই গ্রন্থের সবচেয়ে সবল দিক; সমালোচনায় এর অনুল্লেখ শাইলকসুলভ কৃপণতা মনে হয়েছে।
সর্বোপরি প্রতিবেদনসুলভ বীরস্তুতি কখনো ‘এক নিঃশ্বাসে’ পড়া যায় না; ক্রাচের কর্নেল যে পড়া শুরু করেছে-শেষ না করা পর্যন্ত তার স্বস্তি নেই; এবং শেষ হবে সম্ভবত একটি দীর্ঘশ্বাস দিয়ে-যা কেবল উপন্যাসেই সম্ভব। সামগ্রিকভাবে লেখার সবল দিকগুলোর অনুল্লেখ এবং অনুপাতের আধিক্যে ‘অন-উপন্যাস’ প্রমাণ করার প্রয়াস পাঠক হিসেবে ভালো লাগেনি, বরং সমালোচনাটিকে একপেশে ও অসম্পূর্ণ মনে হয়েছে।
খায়রুল ইসলাম
ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০৩, ২০০৯
অর্ণব
খুবই ভালো লিখেছেন।এতো অসাধারণ একটা উপন্যাসের বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা না করে শুধু ের বর্ণন্রীতি নিয়েই ঊঠেপড়ে লেগেছ।পুরোপুরি সহমত। 🙂