বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি। হাসপাতালের করিডরের কাচ চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ছে। আশপাশের নিচু বিল্ডিংগুলোকে কেমন ঝাপসা লাগছে দেখতে। হারুন খন্দকার তাকিয়ে আছেন কাচের দিকে। তবে তিনি বৃষ্টি দেখছেন কি না বোঝা যাচ্ছে না। তাঁর ভাবভঙ্গি বোঝা মুশকিল। এমনিতেও তাঁর মুখাবয়বে চিন্তা তেমন কোনো ছাপ ফেলে না। করিডরের একটু পেছনে, ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের দরজার সামনে একটা টুলে বসে আছেন নাসিম বানু। তাঁর হাতে তসবি। কিছুক্ষণ পর পর ওড়নাটাকে মাথার ওপর তুলে দিচ্ছেন। ওড়না বারবার মাথা থেকে সরে যাচ্ছে। দুদিন হলো তিনি এই টুলে বসে তসবি জপছেন। বিড়বিড় করছেন আর লোকজনকে নানা আদেশ-নির্দেশ দিচ্ছেন। ‘জহির, ডিউটি ডাক্তারকে আরেকবার ডাকো না’, ‘মোজাম্মেল, নার্সটাকে একটু বলো তো রোগীর বেডটা একটু তুলে দিতে’, ‘জহির, বাসায় কি ড্রাইভারকে পাঠাইছ?’-এ রকম। মুমূর্ষু স্বামীর জন্য শোকটা কতখানি, তাঁর হাবভাবে ঠিক আন্দাজ করা যায় না। তবে তসবি তিনি গুনে চলেছেন। আর ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট বা আইসিইউয়ের ভেতর নাকে অক্সিজেনের নল এবং হাতে-পায়ে-বুকে কিছু প্লাস্টিকের লিড লাগিয়ে শুয়ে আছেন গওহর চৌধুরী। দুদিন হলো তিনি অচেতন। গওহর চৌধুরীর আশপাশে কয়েকটি পরিমাপক যন্ত্রে বিভিন্ন ধরনের গ্রাফ উঠছে-নামছে। আইসিইউয়ের ভেতরের পরিবেশের সঙ্গে গওহর চৌধুরীর মোটা শরীর বেশ মানিয়ে গেছে।
আইসিইউয়ের সামনের করিডরে লোকজনের ভিড় লেগে আছে। এদের কেউ কেউ গওহর চৌধুরীর আত্মীয়, কেউ গুণমুগ্ধ, কেউ পরিচিত। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, রাজনীতিক, বিশিষ্ট হাইকমিশনাররাও তাঁকে দেখতে এসেছেন। গওহর চৌধুরী একজন জাতীয় ব্যক্তিত্ব। শিল্পপতি হিসেবে তিনি ঈর্ষণীয় রকমের সফল। অনেক কলকারখানার মালিক। সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবেও তিনি গ্রহণযোগ্য। আইসিইউয়ের আশপাশে তাই টিভি ক্যামেরা ঘুরঘুর করছে। নার্সদের কপালে বিরক্তির ভাঁজ। কিন্তু করিডরে ভিড় করে থাকা অধিকাংশ মানুষ এসব পরিচয়ের কারণে গওহর চৌধুরীকে দেখতে আসেননি; তাঁরা এসেছেন অন্য কারণে।
গওহর চৌধুরী একজন লেখকও। বছর পনেরো ধরে তিনি লিখছেন। শুরু করেছিলেন দৈনিক পত্রিকায় কলাম দিয়ে। তারপর বইমেলায় বের করলেন কলাম সংকলন। এরপর রাজনীতির কিছু ইস্যু নিয়ে প্রবন্ধের বই। তারপর আস্তেধীরে পত্রিকায় একটা-দুটো গল্প। কোনো এক ঈদসংখ্যায় উপন্যাসও লিখলেন। এর পর থেকে দুই হাতে লিখে চলেছেন। পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখছেন, ভ্রমণকাহিনী লিখছেন, বইমেলায় লিখছেন উপন্যাস। লোকে তাই গওহর চৌধুরীকে চেনে প্রথমত একজন লেখক হিসেবে।
গওহর চৌধুরীর একজন বিশেষ কর্মচারী হারুন খন্দকার। ‘বিশেষ’ শব্দটা এই কারণে ব্যবহার করতে হচ্ছে যে হারুন খন্দকারের কাজটা আসলে লেখালেখি করা। গুরুত্বপূর্ণ মিটিং, সেমিনার, উদ্বোধন-গওহর চৌধুরীর কাজের তো আর অভাব নেই। লেখালেখির দায়িত্বটা তাই তিনি হারুন খন্দকারকেই দিয়েছেন। তবে হারুন খন্দকারের যে প্রতিভা আছে, এটা খুঁজে বের করার কৃতিত্ব অবশ্যই গওহর চৌধুরীর। হারুন খন্দকার তখন মাত্র ঢাকায় এসেছেন। মেসে থাকেন, টিউশনি করেন, পত্রিকা অফিসে গিয়ে চাকরি খোঁজেন আর গল্প জমা দেন। এবং সে গল্প ছাপা হয় না। হারুন যে মেসে থাকেন সে মেসের এক বোর্ডার-শাহিন ভাই-গওহর গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের অন্তভুêক্ত চৌধুরী মেলামাইন ফ্যাক্টরির সুপারভাইজার। সে কোম্পানির কী এক অনুষ্ঠান উপলক্ষে একটা স্যুভেনির বের হবে। শাহিন ভাই সে স্যুভেনিরে লেখা দেবেন। হাতের কাছে হারুন খন্দকারের এতগুলো গল্প থাকতে তিনি আর কষ্ট করতে চাইলেন না। হারুনের একটা গল্প নিজের নামে ছাপিয়ে দিলেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে এলেন চেয়ারম্যান গওহর চৌধুরী। দীর্ঘ আলোচনা পর্বে তিনি করার মতো আর কিছু না পেয়ে স্যুভেনিরে চোখ বোলালেন। অনুষ্ঠান শেষে শাহিন ভাইয়ের ডাক পড়ল চেয়ারম্যান সাহেবের খাসকামরায়। গওহর চৌধুরী ভেবে রেখেছিলেন, এই গল্পের লেখককে হেড অফিসে বদলি করে এনে নিজের কাছে রাখবেন। শাহিনকে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘স্যুভেনিরের লেখাটা তুমিই লিখেছ?’ শাহিন এই সহানুভূতিসম্পন্ন প্রশ্নের ভিন্ন অর্থ বুঝলেন। হড়বড় করে বললেন, ‘স্যার, আমাকে মাফ করে দেন, স্যার, এই চাকরিটা গেলে আমি মারা যাব···।’
ফলে শাহিনের চাকরি গেল। আর হারুন খন্দকারকে গওহর চৌধুরীর পিএর রুমের পাশে একটা রুম দেওয়া হলো।
সেই থেকে হারুন খন্দকার লিখে চলেছেন। রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে লেখা কলামগুলো যখন জনপ্রিয় হতে লাগল, হারুন একদিন গওহর চৌধুরীকে বললেন, ‘স্যার, দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতাগুলো তো গল্প ছাপে···।’ গওহর চৌধুরী ব্যাপারটা নিয়ে ভাবনায় পড়লেন। কিন্তু মুখে বললেন, ‘না, হারুন, গল্প আমি লিখতে চাই না।’ তিনি সব সময় এভাবেই বলতেন। ধরুন, কোনো এক দৈনিকের সম্পাদক একটা লেখা দেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করেছেন। তিনি এসে হারুনকে বলবেন, ‘হারুন, আমি একটা কলাম লিখতে চাই।’ ইচ্ছাটুকুই তিনি করবেন। বাদবাকি দায়িত্ব হারুনের। তো, গল্প লেখার বায়নাটা নিয়ে তিনি চিন্তায় পড়লেন। এরপর তাঁর মনে হলো, খারাপ কি! ‘কলাম লেখক’ তো আর সেই অর্থে লেখক না। গল্প-উপন্যাসের দু-একটা বই থাকলে তবেই লেখক। ফলত, দৈনিকের সাহিত্য পাতায় গওহর চৌধুরীর গল্প আসতে লাগল। এর ধারাবাহিকতায় উপন্যাস।
হারুন খন্দকারের পেমেন্টটা ছিল লেখাভিত্তিক। অর্থাৎ চাকরিটা কখনোই তাঁর স্থায়ী হয়নি। উপন্যাসের জন্য এক রকম পেমেন্ট, গল্পের জন্য আরেক রকম। কলামের পেমেন্টেরও আলাদা স্কেল আছে। গত পনেরো বছরে হারুন খন্দকার কেবল লিখেই গেছেন। লেখালেখি ছাড়া আর কোনো দক্ষতা কিংবা যোগ্যতা তাঁর হয়ে ওঠেনি। গওহর চৌধুরীর অসুস্থতায় তাই সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন হারুন খন্দকার।
গওহর চৌধুরী যে অসুস্থ, এই তথ্যটা হারুনকে কেউ জানায়ওনি। অনাহূতর মতো এই হাসপাতালে এসেছেন। দুই দিন ধরে আছেন। নার্সদের কাছে মাঝেমধ্যে গিয়ে খোঁজটোজ নিচ্ছেন। নার্সরা যখন বলেন, ‘ঘাবড়ানোর কিছু নেই, আল্লাহ্ আছে’, তখন বোঝা যায়, অবস্থা আসলেই খারাপ। তখন হারুন খন্দকারের কেমন ভয় ভয় লাগে। এই যে এত বড় গওহর গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ, সেখানে কেউ তাঁকে চেনে না। এতগুলো পত্রিকায় তাঁর লেখা এসেছে, এর একটাও তাঁকে চেনে না। এতজন প্রকাশক তাঁর বই ছাপল, তারাও না। গওহর চৌধুরী মারা গেলে হারুনের কী হবে? হারুন খন্দকার এলোমেলো পায়চারি করতে থাকেন।
করিডরে যে জটলাটা ঘোঁট পাকাচ্ছিল, সেখানে হঠাৎ একটু চাঞ্চল্য চোখে পড়ে। দেশের একজন বিখ্যাত সম্পাদক সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছেন। আলি আহমদ। একটা বড় পত্রিকার সম্পাদক। গওহর চৌধুরীর লেখা তাঁর পত্রিকায়ও আসে। গওহর হার্ট অ্যাটাক করার দিনই তিনি একটা লিড নিউজ রেডি করে রেখেছেন। একটু আগে আরেকটা বিশেষ আইটেম রেডি করতে বলে এসেছেন। সেখানে গওহর চৌধুরীর সাহিত্য-বৃত্তান্ত থাকবে। শিরোনাম হবে ‘একজন লেখকের চলে যাওয়া’। তিনি নাসিম বানুর সঙ্গে কুশলবিনিময় করেন। বিভিন্ন সান্ত্বনাবাণী শোনাতে থাকেন।
এদিকে আইসিইউয়ের ভেতর হঠাৎ করে একটা ঘটনা ঘটে যায়। সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না চেক করতে গিয়ে একজন নার্স আবিষ্কার করেন, গওহর চৌধুরী তাঁর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। নার্স দৌড়ে গিয়ে ডিউটি ডাক্তারকে ডেকে আনেন। ডাক্তার এসে নানা জিনিসপত্র নেড়েচেড়ে দেখেন। তারপর যেন যুদ্ধ জয় করেছেন এমন ভঙ্গিতে বাইরে এসে ঘোষণা করেন, রোগীর জ্ঞান ফিরেছে। নাসিম বানু ভেতরে ঢুকলে গওহর চৌধুরী পরিষ্কার গলায় বলেন, ‘খুব ক্ষুধা লাগছে, নাসিম।’
গওহর চৌধুরী এরপর যেন তড়বড় করে শরীরে শক্তি ফিরে পান। নার্স তাঁকে একটু তুলে বসায়। গওহর চৌধুরী নার্সকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আমাকে কেউ দেখতে আসেনি?’ ফলে, দর্শনার্থীরা একে একে গওহরের সঙ্গে দেখা করতে থাকেন। সম্পাদক আলি আহমদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। তিনি একটু আড়ালে গিয়ে পত্রিকায় ফোন করে বলেন, ‘লিডটা আপাতত সাসপেন্ড রাখো তো।’ তারপর ভেতরে গিয়ে গওহর চৌধুরীকে বলেন, ‘স্যার, এত মানুষের শুভকামনা কীভাবে ব্যর্থ হয়? আপনি আমাদের অভিভাবক। নিজেকে এতিম এতিম লাগতে শুরু করেছিল।’ গওহর চৌধুরী মিটিমিটি হাসেন। গলা একটু তুলে বলেন, ‘আবারও লিখব ভাবছি।’ সম্পাদক বলেন, ‘জি স্যার, অবশ্যই। আগামী সপ্তাহেই একটা কলাম দেন না।’ গওহর চৌধুরী বেডের আশপাশে কাকে যেন খোঁজেন।
এসব যখন ঘটছে, হারুন খন্দকার তখন সিগারেট খেতে নিচে গিয়েছেন। ওপরে এসে কেবিনের সামনের টুলে নাসিম বানুকে না পেয়ে তাঁর বুকটা ধক করে ওঠে। লোকজনের জটলাও মনে হয় হালকা হয়েছে। তিনি ভয়ে ভয়ে আইসিইউয়ের ভেতর উঁকি দেন। দেখেন, নাসিম বানু চামচে করে গওহর চৌধুরীকে স্যুপ খাওয়াচ্ছেন। হারুন খন্দকার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ দৃশ্যটা দেখেন। ভেতরে ঢুকে গওহর চৌধুরীকে সালাম দেন। গওহর চৌধুরী হাত নাড়িয়ে সালাম গ্রহণ করেন। হারুন জিজ্ঞেস করেন, ‘এখন কেমন লাগছে, স্যার?’ গওহর আরেক চামচ স্যুপ খেয়ে বলেন, ‘আলি এসেছিল। ভাবছি আগামী সপ্তাহের জন্য একটা কলাম লিখব।’ হারুন বলেন, ‘জি স্যার, অবশ্যই লিখবেন।’ কিছুক্ষণ ইতস্ততভাবে বিভিন্ন যন্ত্রপাতির দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করেন, ‘স্যার, আমি এখন যাই?’ গওহর চৌধুরী হাত তুলে অনুমতি দেন। আইসিইউ থেকে বের হয়ে হারুন খন্দকার সোজা লিফটের লাইনে গিয়ে দাঁড়ান। বাসায় ফিরতে হবে। খুব ক্লান্ত লাগছে।
রাস্তায় নেমে তিনি সিএনজি খোঁজেন। বৃষ্টি থেমে গেছে। রাস্তাঘাট একেবারে খটখটে। মূল রাস্তার কাছে এসে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। তাঁকে পাশ কাটিয়ে নানা যানবাহন যায়, কিন্তু সিএনজি পাওয়া যায় না। রাস্তা পার হতে যাবেন, এমন সময় কোথা থেকে একটা মাইক্রোবাস যেন ঝড়ের গতিতে এসে তাঁকে ধাক্কা মেরে চলে যায়। হারুন খন্দকার ছিটকে গিয়ে পড়েন আরেক সাইডে। মানুষজন হইহই করে ছুটে আসে তাঁর কাছে। তারা বলাবলি করতে থাকে, লোকটা মনে হয় বেঁচে নেই।
তানিম হুমায়ুন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০৩, ২০০৯
Leave a Reply