জীবন ও সম্পর্কের উপরিতল
পরালালনীল-রাশিদা সুলতানা, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, প্রচ্ছদঃ ধ্রুব এষ, ৯৬ পৃষ্ঠা, ১২০ টাকা
রাশিদা সুলতানার তৃতীয় গল্পগ্রন্থ পরালালনীল সেই লেখকেরই স্বভাব নিয়ে হাজির হয়েছে, যে লেখক গল্প বলেন খুব সহজ-সরল সাধারণ ভাষায়, সাহিত্যিক কলাকৌশলহীন কৌশলে। তিনি গল্প বলেন মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের খুঁটিনাটি নানা দিক নিয়ে, নারী ও পুরুষের মধ্যকার বৈধ-অবৈধ সম্পর্ক নিয়ে, আরও অনেক কিছু নিয়েই, তবে তাঁর বিশেষ মনোযোগ এখনো পর্যন্ত বেশি কেন্দ্রীভূত নারী-পুরুষের যৌন সম্পর্কের প্রতি।
এই লেখকের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, তাঁর বর্ণিত কাহিনী অনায়াসে বাস্তবের বিশ্বাস উৎপাদন করে। তাঁর গল্প পড়ে মনে হয় বর্ণিত ঘটনাগুলো সত্যি সত্যিই ঘটেছে, কোনো কিছুই যেন কল্পিত বা বানিয়ে তোলা নয়। বিশেষ করে বিবাহবহির্ভূত যৌন সম্পর্ক নিয়ে তিনি যে কয়েকটি গল্প লিখেছিলেন আগের কোনো কোনো বইতে, সেগুলো এতটাই বিশ্বাসযোগ্য ঠেকেছিল যে দুয়েকটি গল্প নিয়ে রীতিমতো চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল। এমনটি বিশেষভাবে ঘটে যখন তিনি কোনো গল্পের বয়ান রচনা করেন উত্তম পুরুষে। গল্প বা আখ্যানগদ্যের আরেকটি বড় হাতিয়ার যে সংলাপ, রাশিদা সুলতানা সেই সংলাপ রচনায়ও পারদর্শী। তাঁর গল্পের পাত্রপাত্রীদের জীবন্ত ও স্বতঃস্কূর্ত মনে হয় মূলত বাস্তবানুগ সংলাপেরই কারণে।
পরালালনীল গল্পগ্রন্থটিতে গল্প আছে সাতটি। প্রথম গল্প ‘স্বপ্নমঙ্গল’-এ পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই এক পৃথুলা নারী সম্ভবত বিদেশের কোনো হোটেলে ওঠেন, যেখানে তাঁর সঙ্গে মিলিত হন তাঁর গোপন প্রেমিক, একজন রাজনৈতিক নেতা। গল্পটা বর্ণিত হয় ওই পৃথুলারই বয়ানে, যিন কিনা সব কথা বলেন ওই পুরুষকে লক্ষ্য করে, মানুষ মরে যাওয়ার পর কিছু কিছু অবিচুয়ারি যে স্টাইলে লেখা হয়, ঠিক সেভাবে। তাঁদের দুজনের মধ্যে ইতিমধ্যে যা কিছু ঘটেছে, যার সবকিছু তাঁরা দুজনেই জানেন, সেগুলো নিয়েই তাঁরা নিজেদের মধ্যে কথা বলেন; আসলে তাঁদের লক্ষ্য পাঠক। এ সেই প্রাচীন অবিচুয়ারি টেকনিকঃ তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে এক বিকেলে আমরা দুজনে নদীতীরে বেড়াতে গিয়েছিলাম··· এই রকম। কিন্তু পৃথুলার চরিত্রটি পরিষ্কার পরিস্কুট হয় না, তিনি বারবণিতা কি না, তাঁর নিজের স্বামী-সংসার আছে কি না, রাজনৈতিক ওই নেতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক রক্ষক-রক্ষিতার কি না-এসবের কিছুই পরিষ্কার নয়। পুরো গল্পটি হয়তো পৃথুলার স্বপ্ন এবং স্বপ্নের মধ্যেই স্বপ্নের বিবরণ, যার কোনো ফোকাস নেই, লক্ষ্য নেই।
‘পরালালনীল’ নামের গল্পটিও এক ধনাঢ্য পতিতার গল্প, যাঁর বয়স এখন ৪৫, যিনি আর পয়সার বিনিময়ে কোনো পুরুষের সঙ্গে শোন না, যাঁর ব্যবসা অল্পবয়সী সুন্দরী তরুণীদের নিয়ে, অর্থাৎ তিনি এখন একজন সরদারনি। তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক দেশের সমস্ত ক্ষমতাবান রুই-কাতলার-রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সরকারের সচিব, পুলিশের বড় কর্তা পর্যন্ত। লিপি নামের এই নারীটিও ‘স্বপ্নমঙ্গল’ গল্পের ওই পৃথুলার মতোই গল্পটা বলেন নিজেরই বয়ানে, মানে উত্তম পুরুষে। এই গল্পের বড় মুশকিলের দিক হলো, লিপি নামের বারবণিতার ভাষা আর লেখক রাশিদা সুলতানার ভাষাভঙ্গির মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। উত্তম পুরুষে লেখা না হলে এই মুশকিলটা হয়তো হতো না।
এই বারবণিতা কবিতা লেখেন, গাজীপুরের বাগানবাড়ির ছাদে তারকাখচিত রাতে পাটি বিছিয়ে বসে আকাশ দেখেন, কখনো ইংলিশ গান গানঃ ক্লোজ ইয়োর আইজ অ্যান্ড আইল বি ওন মাই ওয়ে ওয়ান মোর টাইম লেট মি কিস ইউ···। তিনি তাঁর খদ্দের কিংবা প্রেমিকদের গল্প বলেন, তিনি কতবার কতজনের প্রেমে পড়েছিলেন, কতজন তাঁর প্রেমে পড়েছিল, তাঁদের কে কীভাবে আবার তাঁকে ত্যাগ করে চলে গেছে, কষ্ট দিয়েছে, কার কার কল্যাণে তিনি গাজীপুরে একটি বাগানবাড়িসহ অনেক কিছু পেয়েছেন-এই সমস্ত গল্প বলেন লিপি নামের এই বারবণিতা, যাঁকে উচ্চশিক্ষিত, একজন কবি ও লেখক বলে মনে হয়। তিনি কখন কী কারণে কোন প্রেমিকের গল্প বলেন, কেন কখন কোন ঘটনাটির ্নৃতিচারণা করেন, কাকে লক্ষ করে সেসব কথা বলেন, কিছু বোঝা যায় না। গল্পটা শেষ হয় শিহাব নামে একজন প্রেমিকের (একজন রাজনীতিক) জন্য ওই বারবণিতার নিজের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টার মধ্য দিয়ে। ‘পরালালনীল’ একটি সংহত, সুসংবদ্ধ গল্প না হয়ে হয়েছে অনেকগুলো গল্পের একটা ঘোঁট, যার একটা কাহিনী অন্য কাহিনীর সঙ্গে জোড়া লাগেনি। এই গল্পের প্রত্যেকটি চরিত্রকে কেন্দ্র করে একটি করে স্বতন্ত্র গল্প হতে পারত। আর সবগুলো চরিত্রকে নিয়ে লিপির পুরো জীবনকাহিনী আদ্যোপান্ত ধারণ করতে হলে গল্প নয়, প্রয়োজন উপন্যাসের। ‘পরালালনীল’ একটা উপন্যাসের উৎস বা উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
যদি ভুল না করি, মনে হয় যেন গল্পকার রাশিদা সুলতানার সমস্ত মনোযোগই কেন্দ্রীভূত থাকে শুধু ঘটনা বর্ণনা করার প্রতি। গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি যা করেন, তা মূলত ঘটনারই বর্ণনা, যেসব দেখা যায় জীবনের উপরিতলে। এমন বিবরণ রচনার জন্য শিল্পী হওয়া অনিবার্য নয়, স্টেনোগ্রাফার বা ক্রনিকলার হলেই চলে। কী ঘটেছিল, ঘটেছে এবং ঘটছে রাশিদা সুলতানা শুধু তারই বিবরণ দেন সহজ-সরল, প্রায়-অলংকারহীন, আটপৌরে, প্রায়-মুখের ভাষায়। কেন ও কীভাবে ঘটেছিল, ঘটেছে বা ঘটছে-এসব গভীর-জটিল প্রক্রিয়ার বর্ণনা বা বিশ্লেষণে প্রবেশ করতে সাধারণত দেখা যায় না তাঁকে। আটপৌরে অথবা রোমহর্ষক-সকল প্রকার ঘটনার বিবরণ নিছক ফটোগ্রাফিক পুনঃস্থাপনের স্তর অতিক্রম করে কখন কীভাবে সাহিত্য বা শিল্প হয়ে ওঠে এই প্রশ্ন নিয়ে রাশিদা সুলতানা ভাবিত বলে তাঁর লেখা গল্পগুলো সাক্ষ্য দেয় না। ‘রাহুর আরোহী’, ‘বারিধি’ বা শেষ গল্প ‘নাহার বেগমের শেষ দিনগুলি’সহ বইটির সবগুলো গল্পেরই সাধারণ বৈশিষ্ট্য এই-ঘটনার উপরিতল থেকে গভীরতার দিকে যাত্রা করে না কোনোটাই।
তবে রাশিদা যেহেতু ঘটনা বর্ণনা করতে জানেন, কথাশিল্পের প্রাথমিক একটা কৌশল তাঁর রপ্ত হয়েছে এ কথা বলা যায়। এখন প্রয়োজন নিরেট ঘটনার বিবরণকে শিল্পমণ্ডিত, প্রসাদগুণসম্পন্ন সাহিত্য করে তোলার দিকে মনোযোগী হওয়া। এর কোনো সর্বজনীন ব্যাকরণ নেই, এই ঘটনা কী করে ঘটে তাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। একেক শিল্পী একেক প্রকরণে তা করে থাকেন। যখন তা হয়ে ওঠে, তখন পাঠকের মনে স্থায়ী অভিঘাত সৃষ্টির ক্ষমতা অর্জন করে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ১২, ২০০৯
Leave a Reply