যাজ্ঞবল্ক্য ও উপনিষদের যুগ
যাজ্ঞবল্ক্য বিশ্বামিত্রের বংশধর; এঁর পিতা চারায়ণ, দেবরাত, ব্রহ্মরাত, যজ্ঞবল্ক, বাজসনি, ইত্যাদি নানা নামে প্রসিদ্ধ; জননীর নাম সুনন্দা। যাজ্ঞবল্ক্যের দুই স্ত্রী, মৈত্রেয়ী ও কাত্যায়নী; কাত্যায়নীর পুত্র কাত্যায়ন। শতপথব্রাহ্মণ-এ বলা আছে শুক্লযজুর্বেদ যাজ্ঞবল্ক্যের রচনা বলে আখ্যাত। অর্থাৎ ইনি বাজসনেয়ী সংহিতা-র রচয়িতা; শতপথব্রাহ্মণ, বৃহদারণ্যকোপনিষদ্ এঁরই রচনা। একখানি ‘শিক্ষা’ গ্রন্থও যাজ্ঞবল্ক্যের নামে অভিহিত, দুই-একটি অন্য ক্ষুদ্র উপনিষদও এঁর নামে প্রচলিত, অতএব দেখা যাচ্ছে, প্রাচীন ভারতীয় চিন্তাধারা গঠনের ব্যাপারে যাজ্ঞবল্ক্যের দান প্রচুর ও তাৎপর্যপূর্ণ।
শুক্লযজুর্বেদ-এর টীকায় প্রথম দিকে টীকাকার মহীধর যাজ্ঞবল্ক্য ও যর্জুবেদ প্রসঙ্গে একটি কাহিনি বলেছেন:
‘ব্যাসের শিষ্য ঋষি বৈশম্পায়ন ব্রহ্মহত্যার পাতকী হয়ে প্রায়শ্চিত্তের জন্যে শিষ্যদের কৃচ্ছ্রসাধনের নির্দেশ দিলেন। তখন যাজ্ঞবল্ক্য একাই সকলের হয়ে কৃচ্ছ্রসাধন করতে চাইলেন। বৈশম্পায়ন এটাকে অসহ্য অহমিকা মনে করে অসম্ভব ক্রুদ্ধ হয়ে যাজ্ঞবল্ক্যকে আদেশ দিলেন অধীত বেদ প্রত্যর্পণ করতে। অগত্যা যাজ্ঞবল্ক্য অধীত বেদ বমন করলেন; তখন বৈশম্পায়নের অপর শিষ্যরা তিত্তিরির রূপ ধারণ করে সেই বমনকৃত যজুর্বেদ ভক্ষণ করেন। এ যজুর্বেদকৃষ্ণ, অর্থাৎ অশুচি, কারণ তা যাজ্ঞবল্ক্যের বমন-করা বেদ; তিত্তিরিপক্ষীর রূপে অন্য শিষ্যরা তা গ্রহণ করেছিলেন বলে তার নাম তৈত্তিরীয়।’
লক্ষণীয়, যে-বেদ যাজ্ঞবল্ক্য গুরুর কাছে লাভ করেছিলেন এ কাহিনির অন্তরালে তাকে শুচি, শুক্ল বলে স্বীকার করা হয়েছে এবং সেইটিই তাঁর নামে অভিহিত শুক্ল যজুর্বেদ-এর বাজসনেয়ী সংহিতা। বাজসনি যাজ্ঞবল্ক্যের পিতার নাম, তাই যাজ্ঞবল্ক্য বাজসনেয় এবং তাঁর লব্ধ সংহিতা বাজসনেয়ী। কাহিনিটি আক্ষরিক ভাবে সত্য নয় নিশ্চয়ই, কিন্তু প্রাচীন ভারতে যাজ্ঞবল্ক্যের চরিত্র ও কীর্তি সম্বন্ধে কী ধারণা চলিত ছিল তা এতে স্পষ্টই বোঝা যায়। যাজ্ঞবল্ক্য উদ্ধত, হয়তো কতকটা দাম্ভিকও— সমস্ত শিষ্যের করণীয় প্রায়শ্চিত্ত একাই করতে চাওয়ার প্রস্তাবে আত্মশক্তিতে প্রত্যয়ের সঙ্গে হয়তো কতকটা ঔদ্ধত্যও চোখে পড়ে। অন্তত গুরু সেইটিই দেখতে পেয়েছিলেন। কিন্তু এর মধ্যে যাজ্ঞবল্ক্যের পরার্থপরতাও তো আছে—সকলের হয়ে কৃচ্ছসাধনের চেষ্টা একা স্বীকার করতে চাওয়ার মধ্যে কি কিছু পরিমাণ মহত্ত্বও নেই? কাহিনিকার সে দিকটায় জোর দেননি, কিন্তু প্রসঙ্গত সে-কথাও কি বলা হয়নি! তিনি যে-সংহিতার প্রবক্তা তা শুক্ল; যা উদ্গীরণ করলেন এবং অন্য শিষ্যরা ভক্ষণ করল সেটা কৃষ্ণ। আজ আমরা জানি, শুক্লযজুর্বেদ শুদ্ধ মন্ত্রমাত্রের সংকলন বলেই ‘শুক্ল’ বলে অভিহিত, আর কৃষ্ণযজুর্বেদ-এ মন্ত্রের সঙ্গে অঙ্কুর-রূপে ‘ব্রাহ্মণ’-সাহিত্যধর্মী প্রচুর গদ্যনির্দেশের মিশ্রণ আছে বলেই তাকে বলে ‘কৃষ্ণ’। কিন্তু সে দিন এই কাহিনিতে যাজ্ঞবল্ক্যকে শুচিতর সংহিতার রচয়িতা বলেই নির্দেশ করা হয়েছিল।
শুক্লযজুর্বেদ সংহিতা-র শেষাংশে শতপথব্রাহ্মণ, তারও শেষাংশ বৃহদারণ্যকোপনিষদ্ একাধারে আরণ্যক ও উপনিষদ্; যাজ্ঞবল্ক্য এ সমস্ত ধারাটিরই রচয়িতা। শুক্লযজুর্বেদ সংহিতা-র বৈশিষ্ট্য তেমন কিছু নেই; কিন্তু সমস্ত ‘ব্রাহ্মণ’-সাহিত্যের মধ্যে শতপথ বিশিষ্টতম ব্রাহ্মণ এবং আরণ্যক ও উপনিষদসমূহের মধ্যে বৃহদারণ্যকোপনিষদ্ একখানি তাৎপর্যপূর্ণ স্বতন্ত্র রচনা। এগুলিকে সম্যক ভাবে বিশ্লেষণ করা এ-প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। এখানে শুধু যাজ্ঞবল্ক্য চরিত্রটিকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণ-উপনিষদের যুগটিকে আরও একটু স্পষ্ট করে বোঝাবার চেষ্টা করতে চাই। মহীধরের কাহিনির মধ্যে যাজ্ঞবল্ক্যকে অবাধ্য উদ্ধত ধরনের মানুষরূপে দেখানো হয়েছে; বস্তুত ব্রাহ্মণ-উপনিষদে প্রতিফলিত যাজ্ঞবল্ক্যের যে-চরিত্র তার দ্বারাও এ-ধারণা সমর্থিত।
প্রচলিত সংস্কারকে অস্বীকার করতে যাজ্ঞবল্ক্যের বাধেনি। তাঁর রচিত শতপথব্রাহ্মণ-এ আছে: ধেনু বা অনডুহ্ (ষাঁড়)-মাংস ভক্ষণ করলে পতিত হতে হয়। কিন্তু ঠিক তার পরেই যাজ্ঞবল্ক্য বলছেন, ‘আমি কিন্তু (গোমাংস) ভক্ষণ করব যদি সেটা সুসিদ্ধ (নরম) হয়।[১] প্রাচীন ভারতে গোমাংস ভক্ষণ প্রচলিত ছিল— সে অতি সত্য কথাটাকে চাপা দেওয়ার জন্যে আজকাল কত-না ছলকৌশলের আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে; যাজ্ঞবল্ক্য টের পাননি তাঁর উত্তরপুরুষকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে তাই অসংকোচেই বলে গেছেন: যজ্ঞের জন্যে যে-সোম কেনা হল তা হল অতিথির, তাই রাজার জন্যে ব্রাহ্মণের জন্যে মানুষের হব্য হিসেবে যেমন বড় ষাঁড় বা বড় হাতি বা বড় ছাগল রাঁধা হয় দেবতাদের জন্যেও এঁকে (সোমকে) এই আতিথ্যই করা হয়।[২] আবার বৃহদারণ্যকোপনিষদ-এ পড়ি: গৌরবর্ণ পুত্রকামনায় পিতা একটি বেদ পড়বেন, স্ত্রীকে ক্ষীরান্ন ভোজন করাবেন; কপিল পিঙ্গল পুত্রকামনায় দুটি বেদ পড়বেন ও স্ত্রীকে দধিযুক্ত অন্ন ভোজন করাবেন; শ্যাম-বর্ণ লোহিতাক্ষ পুত্রকামনায় তিনটি বেদ পড়বেন ও স্ত্রীকে জলে-সিদ্ধ অন্ন ভোজন করাবেন; পণ্ডিত দুহিতা কামনা করে স্ত্রীকে তিলমিশ্রিত অন্ন ভোজন করাবেন; এবং পণ্ডিত যশস্বী, সভায় সুপ্রতিষ্ঠিত সবাক্ পুত্রকামনায় চতুর্বেদ পাঠ করবেন ও স্ত্রীকে বলদের বা বৃষভের মাংসযুক্ত অন্ন ভোজন করাবেন।[৩] বৃহদারণ্যকোপনিষদ-এর শেষাংশে একটি কাহিনির অন্তে বলা আছে পাঁচটি পশু ব্রাহ্মণের অভক্ষ্য, কারণ এদের মধ্যে থেকে মেধ (যজ্ঞে হব্যরূপে ব্যবহার্যতা) বেরিয়ে গেছে। এই পাঁচটি হল: মানুষ, অশ্ব, গৌ, মেষ এবং অজ।[৪] স্পষ্ট বোঝা যায় সন্ন্যাসী সম্প্রদায়গুলি এবং বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের অনুশাসনে প্রাণীহত্যা সম্বন্ধে নিষেধবাক্য ও অহিংসার ব্যাপক প্রচারই এ নির্দেশের মূলে। লক্ষণীয়, মানুষ এ তালিকায় বিধৃত, সম্ভবত প্রাগৈতিহাসিক আদিমপ্রথা (যুদ্ধে পরাজিতকে হত্যা করে ভক্ষণ)-এর স্মরণে; কিংবা হয়তো মানুষ সর্বত্রই অভক্ষ্য জীবের তালিকায় অগ্রগণ্য, কিন্তু অশ্ব ও গৌ নিশ্চয়ই ভক্ষ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল যেমন মেষ বা অজ; এবং নিষেধ যখন এল তখন সচরাচর-ভক্ষিত মাংসের প্রায় সবগুলির ওপরেই এল। বাকি রইল এণ (হরিণ)-মাংস, শশমাংস ও বার্ধ্যীর্ণস (গণ্ডার)-মাংস, অর্থাৎ যেগুলি মৃগয়ালব্ধ, অতএব অনিশ্চিত। কিংবা হয়তো-বা মৃগয়া রাজাদের বিলাস বলে তার প্রতি কতকটা প্রশ্রয় দেওয়া রইল। আরও লক্ষণীয়: যাজ্ঞবল্ক্য ব্রাহ্মণকেই শুধু অমেধ্য মাংস ভক্ষণে বিরত থাকতে বলেছেন, অর্থাৎ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র তখনও অশ্ব গৌ মেষ ও অজ-মাংস ভক্ষণ করতে পারে। শুধু যজ্ঞে এগুলি ব্যবহার হতে পারবে না, এবং ব্রাহ্মণ খাবে না। অনুমান করা হয়তো অন্যায় হবে না যে, পূর্বে এ নিষেধ না থাকায় উল্লিখিত প্রাণীগুলি অত্যন্ত অধিক পরিমাণে যজ্ঞের জন্যে নিহত হওয়াতে সমাজে পশুধনের অভাব ঘটছিল; গোধন ক্ষয় হচ্ছিল, অশ্বের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছিল। দেশের পশুসম্পদ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যও হয়তো এ-নির্দেশের একটি কারণ।
নারী সম্বন্ধে যাজ্ঞবল্ক্য বলছেন, জায়া নিজের (অর্থাৎ পুরুষের) অর্ধাংশ।[৫] বিবাহে সম্প্রদানের প্রসঙ্গে বলছেন, কে দান করেছিল? কাকে দান করেছিল? কাম দিয়েছেন, কামকেই দিয়েছেন। কামই দাতা, কামই প্রতিগ্রহীতা।[৬] অর্থাৎ কামনাই বিবাহের ভিত্তি, কামনাই একটি পুরুষ ও একটি নারীকে অনুপ্রেরিত করে পরস্পরের কাছে আত্মদান করতে। এ উক্তির মধ্যে সত্যদ্রষ্টা ঋষির দৃষ্টির স্বচ্ছতাই চোখে পড়ে। আবার শুনি সৃষ্টি রহস্য উদ্ঘাটন করছেন ঋষি: একা থাকলে কেউ সুখ পায় না তাই লোকে একাকী না থেকে দ্বিতীয়ের সন্ধান করে। গাঢ়-আলিঙ্গনে-বদ্ধ নারী-পুরুষের মতো তিনি নিজেকে দ্বিধাবিভক্ত করলেন, তখন পতি পত্নী সৃষ্টি হল; তাই এই (যুগল) দ্বিদল বীজের মতো।[৭]
নারীপুরুষের প্রেমকে যাজ্ঞবল্ক্য চূড়ান্ত মর্যাদা দিয়েছেন বৃহদারণ্যকোপনিষদ-এ একে ব্রহ্মোপলব্ধির উপমানরূপে উপস্থাপিত করে: যেমন প্রিয় স্ত্রীর দ্বারা আলিঙ্গিত পুরুষের বাহ্যজগতের কিছুরই বোধ থাকে না তেমনই ব্রহ্মজ্ঞান হলে বাহ্যবস্তুর কোনও বোধই থাকে না।’ নিজের স্ত্রী মৈত্রেয়ীকে বলছেন: স্বামীর কামনাতে স্বামী প্রিয় নন, তাঁর মধ্যে (স্ত্রী) নিজেকে অভিস্থাপন করতে পারে বলেই স্বামী প্রিয় হন।[৮] এ-ও এক মোহমুক্ত দৃষ্টির প্রমাণ এবং মনস্তত্ত্বের সূক্ষ্মজ্ঞানের পরিচায়ক: স্বামী বন্ধু পুত্র এরা ততটাই প্রিয় হয়।[৯] যতটা নিজেকে তাদের মধ্যে অনুভব করা যায়। নারীর দুর্বলতা সম্বন্ধেও ঋষি অবহিত, বলছেন: যে পুরুষ নাচতে গাইতে পারে তার প্রতিই নারী সব চেয়ে বেশি আকৃষ্ট হয়।[১০]
যজ্ঞেরও অপরার্ধ যজমানপত্নী।[১১] পত্নীকে সহধর্মচারিণী বলা হয়, কিন্তু প্রত্যক্ষ যজ্ঞে পত্নীর করণীয় নিতান্তই গৌণ। মনে হয়, আর্যদের এ দেশে আসবার অব্যবহিত পরে এ অবস্থা ছিল না।[১২] যজ্ঞও দুই যজমান দম্পতির কৃত্য ছিল। পরবর্তীকালে প্রাগার্য নারীকে বিবাহ করলে নবাগতাকে আর্য সমাজ সামাজিক স্বীকৃতি দেয় কিন্তু, জন্মসূত্রে সে ভিন্নধর্মী বলে যজ্ঞে তাকে অধিকার দিতে সমাজ কুণ্ঠা বোধ করে, যার ফলে যজ্ঞে যজমানপত্নীর অধিকার ক্রমেই সংকুচিত হতে থাকে। কিন্তু যাজ্ঞবল্ক্য মনে করিয়ে দিতে চাইছেন যে, যজ্ঞে পুরুষের একাধিপত্য নেই, নারীও পূর্বে যজ্ঞের অর্ধাংশরূপে গণ্য হত। তাঁর সময়ে যজমানপত্নীর অধিকার যৎসামান্য তবু তার ভাবগত অধিকার তিনি স্বীকার করেছেন।
নিজের জীবনে নারীর সঙ্গে তাঁর দুটি সংলাপের কথা আছে বৃহদারণ্যকোপনিষদ-এ। একবার ব্রহ্ম সম্বন্ধে গার্গীর সঙ্গে প্রশ্নোত্তরের কথা আছে। তখন গার্গীর শেষতম প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আর বেশি প্রশ্ন কোরো না, গার্গি, তোমার মাথা খসে পড়বে।[১৩] বলা বাহুল্য, এই সতর্কবাণীর মধ্যে এক ধরনের পরাজয়স্বীকার অন্তর্নিহিত আছে; প্রকাশ্যে নারীর কাছে পরাজয় স্বীকার না করে তিনি গার্গীকে প্রকারান্তরে অস্বস্তিকর প্রশ্ন করা থেকে বিরত হতে বললেন। দ্বিতীয় উপাখ্যানে নিজের স্ত্রী মৈত্রেয়ীর সঙ্গে তাঁর সংলাপ। তপশ্চর্যার জন্যে বনে যাওয়ার পূর্বে তাঁর সম্পত্তি দুই স্ত্রীর মধ্যে ভাগ করে দিতে চাইলে কাত্যায়নী স্পষ্টতই সন্তুষ্ট হলেন; কিন্তু মৈত্রেয়ী প্রশ্ন করলেন: ‘যা দিয়ে যাচ্ছ তাতে কি আমি অমর হব?’ সত্যনিষ্ঠ স্বামী প্রতারণা করলেন না, বললেন, ‘অমরতার লেশমাত্র সম্ভাবনা এতে নেই।’ মৈত্রেয়ী বললেন, ‘যাতে অমর হব না তা দিয়ে কী করব?’ তখন তিনি আচার্যের দৃষ্টিতে মৈত্রেয়ীকে ব্রহ্মবিদ্যার যথার্থ অধিকারিণী জেনে অকুণ্ঠচিত্তে অকৃপণ ভাবে এই নারীকে ব্রহ্মবিদ্যা উপদেশ দিলেন।
যজ্ঞকালে ঋত্বিক্ প্রতিপ্রস্থাতা যজমানপত্নীকে প্রশ্ন করবেন, ‘কার সঙ্গে ব্যাভিচারিণী হয়েছ?’ সেই নারী বরুণের কাছে অপরাধিনী হন, যিনি একজনের (স্ত্রী) হয়ে অন্যের সঙ্গে ব্যভিচার করেন, তাই যজ্ঞকালে (এই গোপন তথ্য) অন্তরে শল্যের মতো যেন না থাকে সে জন্যে তিনি স্বীকার করেন। না স্বীকার করলে তাঁর আত্মীয়দের প্রতি অন্যায় করেন।[১৪] বলা বাহুল্য, প্রতিপ্রস্থাতার প্রশ্ন এবং যজমানপত্নীর উত্তর যাজ্ঞবল্ক্যের উদ্ভাবন নয়, যজ্ঞে আচরিত বিধিমাত্র। উদ্ভাবন ব্যাখ্যাটুকু। গোপন পাপ অন্তরে শল্যের মতো বহন করে যেন সে নারী আত্মীয়দের কাছে অপরাধিনী না হয় তাই এ স্বীকারোক্তি। লক্ষণীয়, যজমানপত্নী ব্যভিচারিণী হওয়া সত্ত্বেও যজ্ঞে অধিকারচ্যুতা নন, স্বীকারোক্তির দ্বারাই তিনি শুচি। এ কথা সত্য যে, যজমানকে অনুরূপ কোনও প্রশ্ন করা হত না, অর্থাৎ নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে দুটি পৃথক নৈতিক মানদণ্ড তখনই সমাজে আছে। তবু, সমাজের স্থিতিস্থাপতা এবং যাজ্ঞবল্ক্যের এই বাস্তবনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি বিস্ময় উৎপাদন করে। কোনও শাস্তির কথাই নেই, শুধুমাত্র স্বীকারোক্তি; মানুষের স্বাভাবিক দুর্বলতা সম্বন্ধে নীতিবাগীশের মতো কোনও উত্তুঙ্গ মনোভাব দেখা গেল না ঋষির, বরং ‘অন্তঃশল্যা’ শব্দটার মধ্যে যেন অপরাধিনীর মঙ্গলচিন্তাই আছে।
যজ্ঞ করা ধর্মাচরণ কিন্তু মানুষ যজ্ঞ কেন করে সে বিষয়ে যাজ্ঞবল্ক্য বলছেন, পুরাকালে ঋষিরা কামনার বশেই যজ্ঞ করেছিলেন, ‘এই আমাদের কামনা, এটি পূর্ণ হোক’—এই বলে।[১৫] যাজ্ঞবল্ক্যের দৃষ্টিতে দেবতা ও মনুষ্য নিতান্ত পৃথক নয়, দেবতারা মানুষের উপরে নির্ভরশীল, পৃথিবীর হবির্দানেই দেবতারা বেঁচে থাকেন।[১৬] মানুষ যেমন অসুরদের বঞ্চিত করতে চায় তেমনই দেবতারাও মানুষকে স্বর্গ থেকে বঞ্চিত করতে চান। মানুষ পশু লাভ করে সমৃদ্ধ হয় এটা দেবতারা পছন্দ করেন না।[১৭] দেবতারা মানুষ সম্বন্ধে ঈর্ষাকাতর এমন আভাস প্রায়ই পাওয়া যায়।
মানুষ প্রজাপতির সব চেয়ে কাছের (জীব), সে শতায়ু, শততেজা, শতবীর্য।[১৮] স্বৰ্গ আগে মর্তের অতি নিকটে স্পর্শলভ্য ছিল, দেবতারা চাইলেন স্বর্গ ও মর্ত পৃথক ও পরস্পর থেকে দূরবর্তী হোক, তাই হল।[১৯] এই সেই ঈর্ষা যা নিত্যবিদ্যমান মানুষ ও অসুরের মধ্যে; দেখা যাচ্ছে, যাজ্ঞবল্ক্যের দৃষ্টিতে দেবতারাও তা থেকে মুক্ত নন। যাজ্ঞবল্ক্য দেবতাদের নির্দোষ বা স্বনির্ভর মনে করেননি, বরং এমন কথাও বলেছেন যে দেবতারা মানুষের চেয়ে কনীয়া, কারণ দেবতারা মানুষের তুলনায় সংখ্যালঘু।[২০] দেবতারা সত্য কথা বলতে বলতে দরিদ্র ও তুচ্ছ হয়ে যান, মানুষেরও তাই হয়, তবে অন্তিমে সত্যবাদী মানুষ শ্রীলাভ করে, যেমন দেবতাদেরও সমৃদ্ধিলাভ ঘটেছিল।[২১] এ দেবতা তো মানুষের চেয়ে খুব উঁচু স্তরের জীব নয়, এদের ক্ষুধা তৃষ্ণা দারিদ্র্য তুচ্ছতা ঈর্ষা দ্বেষ উত্থানপতন সবই আছে; অর্থাৎ যাজ্ঞবল্ক্যের দৃষ্টিতে দেবতারা মানুষের খুব কাছাকাছি স্তরের জীব। এতে দেবতার গৌরব ততটা ক্ষুণ্ণ হয়নি যতটা মানুষের মর্যাদা বেড়েছে।
বর্ণবিভক্ত সমাজে বর্ণগুলির নির্দিষ্ট স্থান ও আপেক্ষিক মর্যাদা সম্বন্ধে যাজ্ঞবল্ক্য খুবই সচেতন, বিশেষত রাজার সঙ্গে বৈশ্য ও ব্রাহ্মণের সম্পর্ক নিয়ে। স্বচ্ছদৃষ্টি ঋষি স্পষ্টই দেখছেন প্রজার সম্পত্তি নানা ভাবে রাজকোষে আসছে। তাই বারবার বলছেন, প্ৰজা অন্ন, ভোক্তা ক্ষত্রিয় (অর্থাৎ রাজন্য)।[২২] শ্রেণি হিসাবে এ সময়ে ক্ষত্রিয়ের প্রাধান্যই চোখে পড়ে। রাজ্যচালনায় ব্রাহ্মণ অযোগ্য এ কথা স্পষ্টই বলা আছে।[২৩ খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকের পর থেকেই উত্তর ভারতে বহু খণ্ড-রাজ্যের অভ্যুত্থানের যুগ— সে-সব রাজ্যের রাজারা নিজেদের সীমানার মধ্যে একচ্ছত্র অধিপতি। ফলে রাজন্য এবং ক্ষত্রিয় শ্রেণি হিসাবে ক্রমেই শক্তিমত্ত হয়ে উঠছে। রাজকোষ সমৃদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এঁরা নানা যজ্ঞের অনুষ্ঠান করছেন এবং যাজক ব্রাহ্মণ যজমান ক্ষত্রিয়কে অন্নদাতা ও প্রতিপালকরূপে দেখছে। ক্ষত্রিয়ের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে ব্রাহ্মণের শ্রেণিসত্তা নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি লাভ করছে। অতএব ক্ষত্রিয়ের শ্রেণিগৌরব ব্রাহ্মণের দৃষ্টিতে স্পষ্ট প্রতিভাত হচ্ছে তখন। এই কথাই পুরাকল্পরূপ পাচ্ছে: পূর্বে কেবল ব্রহ্ম (ব্রাহ্মণ) ছিলেন; একাকী কর্মসম্পাদনে অসমর্থ হয়ে তিনি শ্রেয়োরূপে দৃষ্টি করলেন ক্ষত্রিয়কে। দেবতাদের মধ্যে ক্ষত্রিয় হলেন ইন্দ্র বরুণ সোম রুদ্র পর্জন্য যম মৃত্যু ঈশান। তাই ক্ষত্রিয়ের অধিক আর নেই, তাই ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়কে নীচে থেকে উপাসনা করে রাজসূয় যজ্ঞে;ক্ষত্রিয়ে যশ আধান করে।[২৪] রাজসূয় যজ্ঞে আসন্দীতে উপবিষ্ট রাজা ঋত্বিককে ব্রহ্মন্ সম্বোধনে আহ্বান করেন। উত্তরে ঋত্বিক্ বলেন হে, রাজন, আপনিই ব্রহ্মা। এ-সব নির্দেশে মনে হয় ক্ষত্রিয় রাজা এবং ব্রাহ্মণ পুরোহিতের মধ্যে ক্ষমতার আপেক্ষিকতা নিয়ে একটা অন্তর্নিহিত আন্দোলন তখনই সমাজে দেখা দিয়েছে। স্মরণীয় যে, তৎকালীন সমাজে এঁরা দুজনেই ক্ষমতার শিখরে সমারূঢ়। মধ্যযুগের ইয়োরোপে চার্চ ও স্টেটের যে দ্বন্দ্ব তা হয়তো অঙ্কুররূপে এখানে এ ভাবে প্রকটিত; বিশেষত যখন উপনিষদের যুগ ক্ষত্রিয় অভ্যুত্থানেরই যুগ।
শুধু যে প্রতাপ-পরাক্রমে ক্ষত্রিয় শ্রেষ্ঠ তা নয়, জ্ঞানেও, এমনকী, ব্রহ্মজ্ঞানেও ক্ষত্রিয়ই প্রথম অধিকারী ও প্রবক্তা। শ্বেতকেতু আরুণেয় বললেন, ‘গৌতম…এই বিদ্যা এর আগে কোনো ব্রাহ্মণে বাস করেনি।’[২৫] ক্ষত্রিয় রাজা জনক যাজ্ঞবল্ক্যের কাছে ‘কামপ্রশ্ন’ বর লাভ করেন, অর্থাৎ যাজ্ঞবল্ক্যকে যখন যা ইচ্ছা সেই প্রশ্ন তিনি করতে পারেন।[২৬] যাজ্ঞবল্ক্য জনকের ক্ষুরধার বুদ্ধিকে ভয় পেলেন, বিশেষত সৃষ্টির অন্তর্নিহিত শেষ তত্ত্বটি সম্বন্ধে যদি ওই বুদ্ধিমান রাজা অনুনয় করেন বসেন।[২৭] জরৎকারু আতভাগ যাজ্ঞবল্ক্যকে মিনতি করেন একটি প্রশ্নের উত্তরের জন্যে: মৃত্যুর পর আত্মা কোথায় থাকে। তখন যাজ্ঞবল্ক্য তাঁকে নিরালায় নিয়ে গিয়ে ‘কর্ম’ সম্বন্ধে আলোচনা করেন।[২৮] রাজা প্রবাহণ জৈবলির কাছে প্রশ্নে পরাস্ত হয়ে শ্বেতকেতু আরুণেয় পিতা গৌতমের কাছে এসে অনুযোগ করলেন পিতা তাঁকে যথেষ্ট জ্ঞান দান করেননি। নিজের অপূর্ণতা সম্বন্ধে অবহিত হয়ে গৌতম স্বয়ং প্রবাহণ জৈবলির কাছে বিদ্যার্থী হয়ে এলেন। ক্ষত্রিয় রাজা প্রবাহণ ব্রাহ্মণ বিদ্যার্থীকে এ কথা বাইরে প্রকাশ করতে নিষেধ করে বললেন: এ বিদ্যা তোমার পূর্বে ব্রাহ্মণদের কাছে যায়নি, তাই সর্বলোকে ক্ষত্রিয়েরই প্রশাসন।[২৯]
ব্রহ্মতত্ত্ব সম্বন্ধে বৃহদারণ্যকোপনিষদ্ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ গ্রন্থ; এখানে যাজ্ঞবল্ক্য এ-তত্ত্বের প্রবক্তা রূপে উপস্থাপিত। মূল উপনিষদ্গুলি প্রত্যেকটিরই প্রধান বিবক্ষিত বিষয় ব্ৰহ্মবাদ। কিন্তু বহু পরবর্তীকালের শংকরভাষ্য থেকে দৃষ্টি মুক্ত করে নিলে সব-কটি উপনিষদের তত্ত্বদৃষ্টির মধ্যে খুব সাধারণ একটা ঐক্য থাকলেও পরস্পরে প্রচুর পার্থক্যও চোখে পড়ে। প্রবক্তাদের মধ্যে যাজ্ঞবল্ক্যের দৃষ্টি যেমন স্বচ্ছ তেমনই কবিত্বপূর্ণ। তত্ত্বের দিকের আলোচনা এ প্রবন্ধের পরিসরের বাইরে, এখানে শুধু দ্রষ্টার বোধ ও সংবেদনশীলতাই দেখবার চেষ্টা করছি। ‘আত্মা কী?’ ‘প্রাণ দ্বারা যে প্রাণিত হচ্ছে সেই তোমার আত্মা। সব কিছুরই সে অভ্যন্তরবর্তী।[৩০] পুত্রের চেয়ে প্রিয়, বিত্তের চেয়ে প্রিয়, অন্য সব কিছুরই অন্তরতর যা, তাই আত্মা।[৩১] যে পৃথিবীতে থেকে পৃথিবীর অন্তরালে, পৃথিবী যাকে জানেনি, পৃথিবী যার শরীর, যে পৃথিবীর অভ্যন্তরে (থেকে) নিয়ন্ত্রিত করছে, এই সেই তোমার আত্মা— অন্তর্যামী, অমৃত।[৩২] বিদগ্ধ শাকল্য যাজ্ঞবল্ক্যকে প্রশ্ন করছেন: কা প্রিয়তা যাজ্ঞবল্ক্য?
উত্তর দিচ্ছেন ঋষি: প্রাণ এব সম্রাট্।[৩৩]
রাজা জনক প্রশ্ন করছেন, ‘পুরুষের জ্যোতি কি?’
যাজ্ঞবল্ক্যের উত্তর, ‘সূর্য’।
‘সূর্য অস্ত গেলে?’
‘চন্দ্ৰমা’।
‘চন্দ্ৰমা না থাকলে?’
‘অগ্নি’।
‘তাও না থাকলে?’
‘বাক্’।
‘তাও নীরব হয়ে গেলে?’
‘আত্মাই পুরুষের জ্যোতি’।[৩৪] এই আত্মার লীলাই লোকে দেখে, তাকে কেউ দেখে না।[৩৫] এই আত্মাই ব্রহ্ম— এ কথাই উপনিষদের কেন্দ্রীয় প্রতিপাদ্য। ব্রহ্ম মানে বৃহৎ। মানুষ নিজেকে চেনে ব্যষ্টিসত্তায় ও সমষ্টিসত্তায়— অর্থাৎ ব্যক্তিরূপে এবং পরিবারে সমাজে ও দেশে। এর পরেও একটি দৃষ্টি আছে, তা হল: অতীতে অনাগত সৃষ্টির তাবৎ মানুষের মধ্যে নিজের সত্তাকে ভাবলোকে সম্প্রসারিত করে দিয়ে তার মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়া। উপনিষদের ঋষি এই বৃহৎকেই ব্রহ্ম বলে অভিহিত করেছেন, বলেছেন, এ-ই মানুষের চরম সত্তা। মনে রাখতে হবে, আর্যরা ভারতবর্ষের বাইরে থেকে মাত্র কয়েক শতাব্দী আগে এসেছেন, এবং প্রথম পর্বের যুদ্ধের পরে যথাসম্ভব শান্তিতে বিনা রক্তপাতে প্রাগার্যদের সঙ্গে সহবসতি করেছেন। বিবাহসূত্রে বহু প্রাগার্য নারী ও পুরুষ আর্যসমাজে অনুপ্রবিষ্ট; এঁরা সঙ্গে এনেছেন প্রাগার্য ধর্মমত, অনুষ্ঠান-পদ্ধতি। আর্যরা ধীরে ধীরে সেগুলি আত্মস্থ করে সমৃদ্ধ করে তুলছেন ব্রাহ্মণ্য ধর্ম উপাসনা ও দর্শন। বিনা রক্তপাতে এই যে দ্বিতীয় পর্যায়ের বিপ্লব, যাতে আর্য জীবনযাত্রার ধারা বিশ্বাস আচার— সবই গভীর ভাবে প্রভাবিত ও পরিবর্তিত হল, এটিকে সার্থক করার জন্য আর্য মনীষীরা এক দিকে যেমন আর্য দেবমণ্ডলীর মধ্যে প্রাগার্য দেবতাদের স্থান দিলেন, অন্য দিকে তেমনই ভাবদৃষ্টি সম্প্রসারিত করে এমন একটি চিন্তাধারার প্রবর্তন করলেন যার মধ্যে বিভেদ গৌণ হয়ে ঐক্যই মুখ্য হয়ে উঠল।[৩৬] আর্যাবর্তে বহু খণ্ড-রাজ্য, নানা রাষ্ট্রব্যবস্থা, নানা জাতি মত ও আচার, এগুলিকে কল্পলোকে উপনিষদ্ একটি সংহতি দিয়ে বলল, সবই সেই একক সত্তার প্রকাশ, সত্য সেই এক, সেই বৃহৎ ব্রহ্ম, সেই পরম-সত্তা আত্মা, স্ব-রূপ।
সমাজে অনুষ্ঠিত বহু সম্প্রদায়ভেদগত অন্যায়ের একটি কাল্পনিক ক্ষতিপূরণের এ চেষ্টার যে ত্রুটি, ভারতবর্ষের সমাজ তার পূর্ণ মূল্য আজও শোধ করছে। কিন্তু সে দিন সম্ভবত এ বোধের উদয় হয়েছিল জীবনকে তার স্বরূপে বুঝে নিয়ে ক্ষুদ্র ব্যক্তিসত্তাকে বৃহৎ সমষ্টিসত্তার অন্তর্গতরূপে জেনে তার যথার্থ তাৎপর্য খুঁজে পাওয়ার জন্যে। যাজ্ঞবল্ক্যের চোখে এ জানাটা খুবই জরুরি; তাই বলছেন: ‘গার্গি, এই অক্ষয়কে না জেনে যে এই পৃথিবী থেকে চলে যায় সে কৃপার পাত্র, যে এই অক্ষয়কে জেনে পৃথিবী থেকে যেতে পারে সেই ব্রাহ্মণ।[৩৭] ব্রাহ্মণ কেন? ব্ৰহ্ম বা বৃহৎকে সে জেনেছে, তাই। এই পৃথিবীতে থেকেই সে (তত্ত্ব)-টিকে আমরা জানব, নইলে মহতী বিনষ্টি। যারা তা জানে তারা অমৃত হয়, অন্যেরা দুঃখ পায়।[৩৮] এই তোমার আত্মা সব কিছুরই অভ্যন্তরে, এর বাইরে সব কিছু আর্ত।[৩৯] এর বাইরে কী আছে? আছে বিচ্ছিন্ন এককের বোধ, যে বোধে আমরা শুধুই স্বতন্ত্র, শুধুই খণ্ডিত একটি ব্যক্তি মাত্র। সেই একক সত্তার বোধও মিথ্যা নয়, তবে সে-বোধ অসম্পূর্ণ, সে-বোধে ব্যক্তির মৃত্যু আত্যন্তিক; তাই সে-বোধ মৃত্যুর চরম আর্তিতে ক্লিষ্ট। মানুষের আত্মা তো তার একার শুধু নয়, সমগ্র মানবজাতিরই। সেইখানে সে পূর্ণ; তার বাইরে সে দ্বীপমাত্র, বিচ্ছিন্ন, তুচ্ছ, খণ্ডিত, একান্তবিধ্বংসী। এই সত্তাই যে মানুষের চূড়ান্ত সত্তা নয় সেইটুকু জানার দ্বারাই মানুষ তার মৃত্যুসীমা উত্তরণ করে তার পরম মানবসত্তায় অমরতা লাভ করে।
উপনিষদে এই বৃহৎ বা ব্রহ্মের উপরে যে গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে তার আর-একটা কারণ হয়তো এই যে, এখানে সমস্ত চিন্তার আদিম প্রেরণা আসছে মৃত্যু থেকে। ব্যক্তিসত্তার এই একান্ত বিলুপ্তি, মানবজীবনের সমস্ত তাৎপর্যের এই আপাত প্রবল অস্বীকৃতি, জীবিতের পক্ষে একে স্বীকার করাই যেন এক ধরনের পরাজয়। কোনও-না-কোনও ভাবে তাই মানুষ চিরদিনই বলতে চেয়েছে মৃত্যুতে সব শেষ হয় না। জন্মান্তরবাদে মৃত্যুর দ্বারা বিনাশ আপেক্ষিক বা আপাতরূপে প্রতিভাত। কিন্তু উপনিষদে আরও সার্থক ভাবে মৃত্যুর সঙ্গে অমরতার সমন্বয় করা হয়েছে। মৈত্রেয়ী যখন বললেন, ‘যাতে অমর হব না তা দিয়ে আমি কী করব’ তখন তার উত্তরে যাজ্ঞবল্ক্য তাঁকে যে উপদেশ দিলেন তা হল: আপন ব্যক্তিসত্তাকে বিশ্বসত্তার মধ্যে স্থাপিত করে স্ব-রূপে তাকে জানো; সেই সত্তাই আত্মা, সেই ব্রহ্ম। প্রকারান্তরে বলা হল, এই সেই জ্ঞান যা অমর করে মানুষকে; কারণ ব্যক্তির নাশ হয় ‘মানুষের’ ধ্বংস নেই। ইতিহাসের আদিপর্ব থেকে যে-মানুষের অভিযান নানা দেশে নানা কালে অনাগতের অভিমুখে, তার বিনাশ নেই; সেই ‘পুরুষ’, সেই ব্রহ্ম, মানুষের ভাবসত্তায় সে-ই আত্মা। সেইটে জেনে এ-পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার দিনে মানুষ আশ্বস্ত হয়ে যেতে পারে যে, নিরবধি কাল ও বিপুল পৃথ্বীতে সে অক্ষয়, অমর। বহু জাতি ও সংস্কৃতির সার্থক সমন্বয়ের ঐকান্তিক প্রয়াসেই এ-তত্ত্বটির উদয় হয়েছিল।
উপসংহারে উপনিষদের পরিপ্রেক্ষিত সম্বন্ধে কিছু বলা প্রয়োজন। বারেবারেই দেখা যায় ব্রহ্মোদ্য বা তত্ত্বজিজ্ঞাসার উপক্রমণিকারূপে অত্যন্ত তুচ্ছ ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে: কোথাও দুর্ভিক্ষের সময়ে হস্তিপকগ্রামে ব্রহ্মবাদী হীনবর্ণের উচ্ছিষ্ট কুল্মাষ (খারাপ মাষকলাই) ভক্ষণ করছেন, কোথাও শকটের নীচে বসে গাত্রকণ্ডূয়ন করছেন, কোথাও দরিদ্র ঋষির কাছে যজ্ঞের ঋত্বিকের আহ্বান এসে পৌঁছচ্ছে, কোথাও বৃদ্ধ শীর্ণ গাভী দক্ষিণার জন্যে সাজানো আছে, কোথাও-বা পিতৃপরিচয়হীন বালক আচার্যের কাছে বিদ্যার্থী হয়ে এসেছে। তত্ত্বজিজ্ঞাসার ভূমিকা হিসেবে এগুলি অপরিহার্য নয়; আচার্য ও জিজ্ঞাসুর সংলাপ সরাসরিই আরম্ভ হতে পারত, যেমন অধিকাংশ মূল উপনিষদে হয়েছে। যে-সাহিত্য কথ্য ও শ্রব্য— যেমন উপনিষদ্— তাতে শব্দবাহুল্য সর্বদাই পরিহার করা হয়, কাজেই ধরে নিতে হবে এ-সব ভূমিকার কোনও তাৎপর্য আছে। মনে হয়, উপনিষদ্ধাররা বলতে চেয়েছেন, এই দৈনন্দিন তুচ্ছতা— দৈন্য কুশ্রীতা অভাব কার্পণ্য ও হীনতা— এ-সবের মধ্যেই তত্ত্বজ্ঞানের প্রয়োজন, এ-সবের জন্যেই প্রয়োজন। এ-সবের থেকে পলায়ন করবার জন্যে উপনিষদ্ নয়, ক্ষুদ্রতার পরিবেশে থেকেও ক্ষুদ্রতাকে অতিক্রম করে সেই-বৃহৎকে জানবার জন্যে উপনিষদ্, যে-বৃহতের মধ্যে বিচ্ছিন্ন খণ্ড ক্ষুদ্রও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। আদিত্যবর্ণ মহান্ ‘পুরুষ’ সর্বমানবের প্রতিভূ। দেশে কালে সীমাবদ্ধ, জাতি আচার সংস্কৃতিতে খণ্ডিত, হীনতায় দৈন্যে কুশ্রীতায় ক্লিষ্ট একক মানুষ, জরামরণশীল অসহায় ব্যক্তি মানুষ, একটি অবিনশ্বর মর্যাদা লাভ করে তার সেই ভাবরূপে— সেই পুরুষে, অনাদ্যন্ত কালের মানুষের যিনি কল্পরূপ। এখানে যাজ্ঞবল্ক্য আদর্শবাদী বা ভাববাদী,[৪০] কিন্তু বেদান্তের এই প্রাথমিক পর্যায়ে ভারতবর্ষের জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সংস্কৃতির ভেদ সত্ত্বেও একটি সংহতি দেওয়র চেষ্টায় এ-দর্শনের হয়তো একটা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল।
একবার বিদেহের রাজা বসে আছেন এমন সময়ে যাজ্ঞবল্ক্য এলেন। জনক তাঁকে বললেন, ‘যাজ্ঞবল্ক্য কী প্রয়োজনে এসেছেন— পশুধনলাভের আশায়, না সূক্ষ্মতত্ত্বের সন্ধানে?’ যাজ্ঞবল্ক্য বললেন, ‘উভয়ের জন্যই সম্রাট।’[৪১] আর-একবার ব্রহ্মতত্ত্ববিচারে বেদজ্ঞদের মধ্যে যিনি শ্রেষ্ঠ হবেন, তাঁর উদ্দেশে বিদেহরাজ জনক সোনায়-শিং-মোড়া এক হাজার গাভী বেঁধে রাখলেন। যাজ্ঞবল্ক্য নিজের শিষ্যকে বললেন, ‘সোমশ্রবা, গোরুগুলোকে বাড়ি নিয়ে চল।’ ব্রাহ্মণরা ক্রুদ্ধ হলেন; তাঁদের মধ্যে অশ্বল বললেন, ‘যাজ্ঞবল্ক্য, আপনিই বুঝি আমাদের মধ্যে ব্রহ্মিষ্ঠ (ব্রহ্মজ্ঞানে শ্রেষ্ঠ)?’ যাজ্ঞবল্ক্য বললেন, ‘ব্রহ্মিষ্ঠকে আমরা নমস্কার করি (আজ এখানে) আমরা তো গোধনের কামনায় (এসেছি)।’[৪২] শ্বেতকেতু, সোমশুষ্ম ও যাজ্ঞবল্ক্য ব্রহ্মতত্ত্ব আলোচনার জন্যে জনকের কাছে এলেন; একদিন আলোচনার পর ঠিক হল, পরদিন ব্রহ্মোদ্যে (ব্রহ্ম সম্বন্ধে আলোচনায়) নিষ্পত্তি হবে। যাজ্ঞবল্ক্য ব্রাহ্মণদের বললেন, ‘আমরা ব্রাহ্মণ, ইনি রাজন্য; যদি আমরা এঁকে জয় করি তবে আর কাকে জয় করলাম বলব? ইনি যদি আমাদের জয় করেন তবে কিন্তু ‘রাজন্য ব্রাহ্মণদের পরাজিত করেছে— এই কথাই লোকে আমাদের বলবে, (কাজেই) এ-ব্যাপারে উৎসাহ ত্যাগ করো।’[৪৩]
এ ক’টি উপাখ্যানে যে-যাজ্ঞবল্ক্যকে দেখি, তাঁর ঋষিজনোচিত তুরীয় ভাব নেই তাতে। বরং, তাঁর সাধারণ বুদ্ধি এবং কাণ্ডজ্ঞান প্রবল আর প্রবল তাঁর অসংকোচ সত্যনিষ্ঠা। উপনিষদে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ও ব্যবহারিক জীবন সম্বন্ধে কোনও কৃত্রিম সংকোচ নেই। বেঁচে থাকার জন্যে অর্থের প্রয়োজন আছে, পশু দরকার, স্বর্ণশৃঙ্গ গাভী পেলে নিতে হয়— এবং বড় বড় ব্রহ্মজ্ঞ যা স্বীকার করতে পারেননি যাজ্ঞবল্ক্য অনায়াসে তা উচ্চারণ করলেন: রাজসভায় যাঁরা সমবেত তাঁরা ব্রহ্মের জন্যে আসেননি, এসেছেন সোনা আর গরুর জন্যে। রাজাকে তেমনই সহজেই তিনি জানাতে পেরেছিলেন যে শুধু ব্রহ্মতত্ত্ব আলোচনার জন্যেই আসেননি পশুধন লাভের প্রত্যাশাও তাঁর আছে। পরবর্তীকালে ঐহিকজীবন সম্বন্ধে অনীহা প্রকাশ এমনই ব্যাপক হয়ে উঠল যে, এই অকুণ্ঠিত সত্যভাষণের সাহস বিরল হয়ে এল। দৈনন্দিন প্রয়োজনগুলো মায়া নয়, অত্যন্ত জরুরি তাদের তাগিদ এবং সে তাগিদ মেটানোতে যে পাপও নেই, লজ্জাও নেই, যাজ্ঞবল্ক্যের আচরণে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ‘কেউ বলেন অন্ন ব্রহ্ম, কেউ বলেন প্রাণ ব্রহ্ম; প্রাণ এবং অন্ন দুটি দেবতা এক হয়ে পরমতা প্রাপ্ত হয়; অন্নে এই সমস্ত প্রাণী আশ্রিত।’[৪৪] উপনিষদ্গুলিতে অসুরদের চেয়েও প্রবলতর শত্রু দুটি: অশনায়া (বুভুক্ষা) ও মৃত্যু। যজ্ঞের প্রাথমিক প্রয়োজন অন্ন সৃষ্টি ও রক্ষার জন্যে। বারবার ঋষিরা বলছেন, অন্নকে উপেক্ষা কোরো না, অন্নকে রক্ষণ করো, তার বৃদ্ধি করো।
মানুষের সকলের বড় এবং অমোঘ শত্রু মৃত্যু। বস্তুত বহু তত্ত্বচিন্তার সূত্রপাতই হয়েছে মৃত্যুসচেতনতায়। জীবনের তাৎপর্য বুঝতে শুরু করলে প্রথম ধাক্কাই আসে মৃত্যু থেকে: মৃত্যুতে এসে যা ঠেকে যায় তার আত্যন্তিক মূল্য কী? সমস্ত উপনিষদ্ জুড়ে তাই কেবলই বলা হচ্ছে ব্রহ্মজ্ঞান জাগলে মৃত্যু পরাভূত হয়, মানুষ মৃত্যুকে পেরিয়ে যায়। কেমন করে? খণ্ড ব্যক্তিসত্তা যেখানে নশ্বর, সামগ্রিক জাতিসত্তায় মানুষসংজ্ঞিত জীবের অনাদ্যন্ত ইতিহাস সেখানে শাশ্বত। ‘আমি মরব, কিন্তু আমরা মানুষরা কখনও নিঃশেষিত হব না’—এই প্রত্যয়েই অমরতা, এতেই জীবনের তাৎপর্য। একক জীবনে যে উদ্যম অর্থহীন, মানবজাতির দূর-প্রসারী সত্তার পরিপ্রেক্ষিতে তা মূল্যবান। মনে হয়, এই বৃহতের চেতনা থেকেই ব্রহ্মকল্পনার উদ্ভব, এ বৃহতের ক্ষয় নেই, ধ্বংস নেই।
যাজ্ঞবল্ক্যকে বৈদিক যুগের শেষার্ধের একটি যুগমানব বলে ধরা যায়। তাঁর মধ্যে কতকগুলি বৈশিষ্ট্য আছে যেগুলির উপরে সচরাচর বেশি গুরুত্ব অর্পণ করা হয় না, অথচ মনে হয়, এগুলি উপনিষদ্-যুগেরই বৈশিষ্ট্য। ইহজীবনকে মায়া বলে উড়িয়ে না দিয়ে তাকে স্বীকার করে, বৃহতের দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যক্তিসত্তার সীমা অনাদি-অনন্ত কালে পরিব্যাপ্ত করে দিয়ে, তার ক্ষুদ্রতা নশ্বরতাকে অতিক্রম করে, ভাবগত মানবসত্তার মধ্যে তার অমৃতরূপকে উপলব্ধি করা—সমস্ত যাজ্ঞবল্ক্যকে সংহত ভাবে দেখলে এই দৃষ্টিভঙ্গিই প্রতিভাত হয়। শংকরভাষ্য-নিরপেক্ষ ভাবে সমস্ত উপনিষদকে মিলিয়ে দেখলেও এই বোধটিই স্পষ্ট ভাবে চেতনায় সঞ্চারিত হয়।
স্বাভাবিক ভাবেই, উপনিষদের সব ঋষির দৃষ্টিভঙ্গি এক রকম নয়, তাঁরা সুসম্বন্ধ কোনও দর্শনপ্রস্থান রচনার চেষ্টামাত্র করেননি, শুধু ক্রান্তদর্শীর দৃষ্টি নিয়ে অব্যবহিত উপলব্ধি ও ঐকান্তিক মননের মাধ্যমে একাগ্র নিষ্ঠায় জীবনকে গভীর ভাবে বুঝবার চেষ্টা করেছেন। ফলে তাঁদের দৃষ্টির মধ্যে দার্শনিক সংহতি থাকার কথাই নয়, ছিলও না। শংকরাচার্য নিজের দার্শনিক মতকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে উপনিষদগুলিকে ব্যবহার করেছেন মাত্র। তাঁর রচনায় তাই উপনিষদ্ পাই না, পাই শংকরদর্শন, যা উপনিষদ্ যুগের দেড় হাজার বছর পরের দর্শন এবং অন্তর্বর্তীকালের সমস্ত মতাদর্শের দ্বারা প্রভাবিত। এই কারণে উপনিষদকে তার নিজস্ব চিন্তার ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে বোঝার পক্ষে শংকরদর্শনের উপযোগিতা যৎসামান্য। শংকরদর্শন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বেদান্তপ্রস্থান; কিন্তু তার কৃতিত্ব শংকরাচার্যেরই, তার মধ্যে উপনিষদের বোধ খুঁজতে যাওয়া নিষ্ফল। উপনিষদ্ধার ঋষিদের দৃষ্টির মধ্যে বহু পার্থক্য আছে। তবু, যেহেতু একই অর্থনৈতিক উৎপাদনব্যবস্থা থেকে উদ্ভুত এবং একই সামাজিক ঐতিহাসিক বোধের সংঘর্ষ ও সমন্বয়চেষ্টায় এদের সৃষ্টি, সেই হেতু মতগুলির মধ্যে এক ধরনের অন্তর্নিহিত মিল— অত্যন্ত অস্পষ্ট ভাবে হলেও— আছে। ফলে, খুব সাধারণ ভাবে উপনিষদের ভাবধারা বলতে আমরা কয়েকটি কথা বুঝি। সেই প্রধান কয়েকটি বিষয়ের একজন মুখ্য-প্রবক্তা বৃহত্তম উপনিষদটির রচয়িতা যাজ্ঞবল্ক্য। তাই যাজ্ঞবন্ধ্যে যখন দেখি জীবনবিমুখতা নেই, বরং এ-জীবনকে সর্বতো ভাবে স্বীকার করেই বৃহত্তর পটভূমিকায় তাকে অর্থপূর্ণ করে দেখার প্রচেষ্টা আছে তখন সমস্ত উপনিষদের যুগটিই আমাদের কাছে অন্য ভাবে প্রতিভাত হয়।
গুরুর প্রদত্ত বেদবিদ্যা প্রত্যর্পণ করেও যাজ্ঞবল্ক্য ‘শুক্ল’ বেদের ঋষি; নারী ও প্রেমকে তিনি গৌরবে মণ্ডিত করে দেখেছেন; গোমাংস ভক্ষণ সম্বন্ধে অহেতুক নিষেধ মানতে তিনি রাজি নন বরং তার উপযোগিতা অকুণ্ঠচিত্তে ঘোষণা করেছেন; ক্ষত্রিয়কে ব্রহ্মবিদ্যার শ্রেষ্ঠ আচার্য বলে অনায়াসে স্বীকার করেছেন; মৈত্রেয়ী নারী হওয়া সত্ত্বেও যথার্থ অধিকারিণী জেনে অকাতরে তাকে ব্রহ্মবিদ্যা দান করেছেন; গোকামনা ধনকামনা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই; উপযক্ত পুত্র ও কন্যা লাভের স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষাকে মেনে নিয়ে ভাবী পিতাকে সে সম্বন্ধে নির্দেশ দিচ্ছেন; যৌনজীবনের স্খলনকে উগ্র ভাবে আক্রমণ না করে মমত্বপূর্ণ ভাবে প্রতিকার নির্দেশ করেছেন; ক্ষুধা ও মৃত্যুকে পরম শত্রু বলে অভিহিত করেছেন; দেবতাদের মানুষের অনুজ ও মানুষ সম্বন্ধে ঈর্ষাকাতর বলে বর্ণনা করেছেন— এক কথায়, সুস্থ স্বচ্ছন্ন ঐহিক জীবনযাত্রাকে স্বীকার করে মানুষকে মহত্ত্বে ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই সমস্তই সে-যুগ ও যুগপ্রতিভু যাজ্ঞবন্ধ্যের উপরে নূতন এক আলোকপাত করে। আমরা বুঝতে পারি, বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের অভুত্থান ও বহু সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের প্রাদুর্ভাব হওয়া সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত কী গুণে ব্রাহ্মণ্যধর্ম অধিকতর শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল: জীবন সমাজ সংসার সব-কিছুরই স্বীকৃতি ছিল এর মধ্যে— শুধু ছিল না সংকীর্ণ বিচ্ছিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির। যাজ্ঞবল্ক্যও বললেন অনাদিকালের ভূমিকায় মানুষকে তার স্বরূপে না জেনে মৃত্যুতে ব্যক্তির বিনাশের আতঙ্কে মুহ্যমান হয়ে যে ইহলোক থেকে প্রস্থান করে সে কৃপার পাত্র। এ পৃথিবীতে থেকেই উপলব্ধি করতে হবে যে একের মৃত্যুতে একই শেষ হয়— ‘মানুষ’ শেষ হয় না। অতএব একের জন্যে জীবনধারণ করা চূড়ান্ত ব্যর্থতা, মহতী বিনষ্টি।
‘এই পৃথিবী সমস্ত প্রাণীর মধু, সমস্ত প্রাণী এ পৃথিবীর মধু।”[৪৫] পৃথিবীর ধূলিও যেন মধুমান্ হয়— সংহিতার ঋষি এমন প্রার্থনা করেছেন। উপনিষদের ঋষিও পার্থিব এই-জীবনকে তাচ্ছিল্য করেননি। আয়ু সুখ ঐশ্বর্য পরিপূর্ণ জীবনের তৃপ্তি— কোনওটাই উপেক্ষণীয় নয়, কিন্তু একক জীবনের পরিপেক্ষিতে— মৃত্যু যেখানে অনিবার্য ও চূড়ান্ত সত্য, সেখানে— এ সব সুখই নিরতিশয় ভঙ্গুর। তাই সাহস করে সত্যের উপরকার সোনার আবরণখানি খসিয়ে নিরঞ্জনরূপে তাকে দেখতে হবে সেখানেই, যেখানে প্রতিষ্ঠিত-মানব-জাতি, যা ‘ক্ষুদ্র-আমার ‘ জন্মের পূর্বেও ছিল এবং ‘ক্ষুদ্র-আমার’ মৃত্যুর পরেও থাকবে। তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে এই আপাত-নিরর্থক জীবনকে অর্থবহ করে তুলতে হবে। তখন এক দিকে যেমন পার্থিব সুখ বর্জনীয় মনে হবে না, অন্য দিকে তেমনই তা একান্ত হয়ে উঠবে না। এই জ্ঞানই বৃহতের জ্ঞান, ব্রহ্মজ্ঞান। যাজ্ঞবল্ক্য এই ব্রহ্মবিদ্যারই পরম প্রবক্তা, তাই ব্যবহারিক জীবন থেকে পলায়নের পরামর্শ তিনি দেননি, ব্যবহারিক উপলব্ধি অভিজ্ঞতাকে, সুখসম্ভোগকে বৃহতের পটভূমিকায় স্থাপনা করাই তাঁর কীর্তি, কারণ এর মধ্যেই জীবনের চরম মূল্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে পারে।
***
টীকা
১. যো ধেন্বনডুহোরশ্নীয়াদন্তগতিরিব… পাপী… তস্মাদ্ধেন্বনডুহোর্নাশ্নীয়াত্তদু হোবাচ যাজ্ঞবল্ক্যো শাম্যেবাহমংসলং চেদ্ভবতীর্তি। শতপথ ব্রাহ্মণ ৩:১:২:২১
২. অতিথির্বা এষ এতস্যা আগচ্ছতি যৎ সোমঃ ক্রীতস্তস্মা এতদ্ যথা রাজ্ঞে বা ব্রাহ্মণায় বা মহোক্ষং বা মহাগজং মা মহাজং বা পচেত্তদহ মানুষং হবির্দেবানামস্মা এতদাতিথ্যং করোতি। প্রাগুক্ত ৩:৪:১:২
৩. …ঔক্ষেণ বার্ষভেণ বা। বৃহদারণ্যকোপনিষদ ৬:৪:১৪-১৮
৪. এতে পঞ্চ পশবঃ অভবংতে অত উৎক্রান্তমেধা অমেধ্যা অযজ্ঞিয়াস্তেষাং ব্রাহ্মণো নাম্নীয়াত্তান্। প্রাগুক্ত ৭:৫:২:৩৭
৫. অর্ধো বা এষ আত্মনো যজ্জায়া। শতপথ ব্রাহ্মণ ৫:২:১:১০
৬. কোহদাৎ কস্মা অদাৎ কামোহদাৎ মামায়াদাৎ কামো দাতা কামঃ প্রতিগ্রহীতা। প্রাগুক্ত ৪:৩:৪:৩৩
৭. স বৈ নৈব রেমে তস্মাদেকাকী ন রমতে স দ্বিতীয়মৈচ্ছৎ। স হৈতাবানাস যথা স্ত্রীপুমাংসৌ সম্পরিম্বক্তৌ স ইমমেবাত্মানং দ্বেধাপাতয়ৎ ততঃ পতিশ্চ পত্নী চাভবতাং তস্মাদিদমর্ধবৃগলমিব। প্রাগুক্ত ১:৪:৩
৮. যথা প্রিয়য়া স্ত্রিয়া সম্পরিম্বক্তো নবাহ্যং কিঞ্চন বেদ…। বৃহদারণ্যকোপনিষদ :৩:২১
৯. ন বা অরে পত্যুঃ কামায় পতিঃ প্রিয়ো ভবত্যাত্মনস্ত কামায় পতিঃ প্রিয়ো ভবতি। প্রাগুক্ত ২:৪:৫
১০. য এক নৃত্যতি যো গায়তি তস্মিন্নেবৈতা নিমিশ্লতমা ইব। শতপথ ব্রাহ্মণ ৩:২:৪:৬
১১. জঘনার্ধো বা যঞ্জস্য যৎ পত্নী। প্রাগুক্ত ৩:৪:২:২
১২. গৃহের অধিপতি ছিলেন দম্পতী (মৌলিক অর্থ দম=গৃহ, তার পতী অর্থাৎ স্বামী স্ত্রী)।
১৩. গার্গি মাতিপ্ৰাক্ষীমা তে মূর্ধা ব্যপপ্তৎ। বৃহদারণ্যকোপনিষদ ৩:৬:১
১৪. স পত্নী মুদানেষ্যন্ পৃচ্ছতি কেন চসরীতি। বরুণ্যং বা এতৎ স্ত্রী করোতি যদন্যস্য সত্যন্যেন চরত্যথো নেন্মেহন্তঃশল্য জুহবদিতি… সা যন্ন প্রতিজানীতে জ্ঞাতিভ্যো হাস্যৈ তদহ্নিতং স্যাৎ। শতপথ ব্রাহ্মণ ২:৫:২:২০
১৫. কামৈই স্ম বৈ পুরষয়ঃ সত্রমাসতে… অসৌ নঃ কামঃ স সমৃধ্যতামিতি। প্রাগুক্ত ৪:৬:৯:২৩
১৬. ইতঃ প্রদানাদ্ধি দেবা উপজীবস্তি। প্রাগুক্ত ১:৩:১:১৫
১৭. তস্মাদেষাং তন্ন প্রিয়ং যদেতন্মনুষ্যা বিদ্যুঃ। বৃহদারণ্যকোনিবদ ১:৪:১০
১৮. পুরুষো বৈ প্রজাপতের্নের্দিষ্ঠঃ সোহয়ং শতায়ুঃ শততেজাঃ শতবীর্যঃ। শতপথ ব্রাহ্মণ ৪:৪:১:৯ ১৯.
১৯. সমন্তিকমিব হ বা ইমেহগ্রে লোকা আসুরিত্যুন্মশ্যা হৈব দ্যৌরাস। প্রাগুক্ত ১:৪:১:২২
২০. কনীয়াংসো হি দেবা মনুষ্যেভ্যঃ। প্রাগুক্ত ২:৩:২:১৮; ২:৩:৩:১৮
২১. প্রাগুক্ত ৯:৫:১:১৩-১৬
২২. অত্তা বৈ ক্ষত্রিয়য়োহন্নং বিট্। প্রাগুক্ত ৮:৭:১:২; ৮:৭:২:২; ৯:৪:৩:৫
২৩. ন বৈ ব্রাহ্মণো রাজ্যায়ালম্। প্রাগুক্ত ৫:১:১:১৩
২৪. ব্রহ্মা বা ইদমগ্র আসীদেকমেব তদেকং সন্ন ব্যভবৎ। তচ্ছেয়োরূপমত্যসৃজত ক্ষত্ৰং যান্যেতানি দেবত্রা ক্ষত্রাণীন্দ্রো বরুণঃ সোমো রুদ্রঃ পর্জন্যো যমো মৃত্যুরীশান ইতি। তস্মাৎ ক্ষত্রাৎ পরং নাস্তি। তস্মাদ্ ব্রাহ্মণঃ ক্ষত্রিয়মধস্তাদুপাস্তে রাজসূয়ে ক্ষত্রে এব তদ্ যশো দধাতি। প্রাগুক্ত ১:৪:১১-১৫
২৫. ইয়ং বিদ্যেতঃ পূর্বং ন কস্মিংশ্চন ব্রাহ্মণ উবাস। বৃহদারণ্যকোপনিষদ ৬:২:৪
২৬. প্রাগুক্ত ৪:৩:১
২৭. যাজ্ঞবল্ক্য হ বিভয়াঞ্চকার মেধাবী রাজা সর্বেভ্যো মাহন্তেভ্য উদরৌৎসীৎ। প্রাগুক্ত ৪:৩:৩৩
২৮. তৌ হ যদুচতুঃ কৰ্ম হৈব তদুচতুঃ। প্রাগুক্ত ৩:২:১৩
২৯. যথেয়ং ন প্রাক্ ত্বত্তো পুরা বিদ্যা ব্রাহ্মণান্ গচ্ছতি তস্মাদু সর্বেষু লোকেষু ক্ষত্রস্যৈব প্রশাসনমিতি। প্রাগুক্ত ৫:৩:৬
৩০. যঃ প্রাণেন প্রাণিতি স ত আত্মা সর্বান্তরঃ। প্রাগুক্ত ৩:২:১১
৩১. প্রেয়ঃ পুত্রাৎ প্রেয়ো বিত্তাৎ প্রেয়োহন্যস্মাৎ সর্বস্মান্তরতরং যদয়মাত্মা তদেব। প্রাগুক্ত ১:৪:৮
৩২. যঃ পৃথিব্যাং তিষ্ঠন্ পৃথিব্যা অন্তরে যং পৃথিবী ন বেদ যস্য পৃথিবী শরীরং যঃ পৃথিবীমন্তোরো যময়ত্যেষ ত আত্মা অন্তর্যাম্যমৃতঃ। প্রাগুক্ত ৩:৭:৩
৩৩. প্রাগুক্ত ৪:১:৩
৩৪. প্রাগুক্ত ৪:৩:১১:১২
৩৫. আরামমস্য পশ্যন্তি ন তং পশ্যতি কশ্চন। প্রাগুক্ত ৪:৩:১৪
৩৬. এই সামগ্রিক সত্তাকে কালে ব্যাপ্ত করে দেওয়ার একটি উপায় হল জন্মান্তরবাদ। এই তত্ত্ব অনুসারে একই সত্তা বহুজন্মে নানা রূপে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়। ব্রাহ্মণ শূদ্র নারী পুরুষ হস্তী মেষ নানা বিচিত্র প্রকাশ তার; অর্থাৎ আত্মসত্তার কেন্দ্রসূত্রে জীবের বিভিন্নরূপে আত্মোদ্ঘাটন এবং তা দীর্ঘকালে বহুদূরে পরিব্যাপ্ত। এর দ্বারা ভাবলোকে শ্রেণিসম্প্রদায় প্রাণীর প্রকারভেদ সবই একটি অলক্ষ্য কেন্দ্রসূত্রে বিধৃত হয়ে রইল। সমাজে তখন জাতিভেদ ক্রমে প্রবল হয়ে উঠছে; হয়তো ভাবলোকে সে-অপরাধবোধের একটি প্রায়শ্চিত্ত জন্মান্তরবাদের এই দিকটায়।
৩৭. খ এতদক্ষরং গার্গ্যবিদিত্বাস্মাল্লোকাৎ প্রৈতি স কৃপণোহথ য এতদক্ষরং গার্গি বিদিত্বাস্মাল্লোকাৎ প্ৰৈতি স ব্রাহ্মণঃ। প্রাগুক্ত ৩:৮:১০
৩৮. ইহৈব সন্তোহথ বিস্মস্তদ্বয়ং ন চেদবেদিমহতী বিনষ্টিঃ। যে তদ্বিদুরমৃতান্তে ভবন্ত্যাথেতরে দুঃ খমেবাপিযস্তি। প্রাগুক্ত ৪:৪:১৪
৩৯. এষ ত আত্মা সর্বান্তারাহতোহন্যদাতম্। প্রাগুক্ত ৩:৪:২
৪০. Uddalaka and Yajnavalkya, the first representing the earliest naturalistic point of view recorded in Indian literature and the latter the most important early idealistic view to be ultimately consummated in the Vedanta philosophy…the first famous idealistic philosopher of India was Yajnavalkya. Dale Riepe: The Nuturaliatic Tradition in Indian Thought, Motilal Banarasidas, 1964, pp. 27-28, 30.
৪১. জনকো হ বৈদেহ আসাঞ্চক্রেহথ হ যাজ্ঞবল্ক্য আবব্রাজ। তং হোবাচ যাজ্ঞবল্ক্য কিমর্থর্মচারীঃ পশুনিচ্ছন্ন স্বস্তানিতি। উভয়মেব সম্রাডিতি হোবাচ। প্রাগুক্ত ৪:১:১
৪২. নমো বয়ং ব্রহ্মিষ্ঠায় কুর্মো গোকামা এব বয়ম্। প্রাগুক্ত উ. ৩:১:২
৪৩. ব্রাহ্মণা বৈ বয়ং স্নো রাজন্যবন্ধুরসৌ যদ্যুমুং বয়ং জয়েম কমজৈম্মেতি য়ামাথ যদ্যসাবস্মান্ জয়েদ্ গ্রাহ্মণান্ রাজন্যবন্ধুরজৈষীদিতি নো ব্লুয়ুমেদমাদৃঢব ম্। শতপথ ব্রাহ্মণ ১১:৬:২:৫
৪৪. অন্নং ব্রহ্মেত্যেক আহুস্তন্ন…প্রাণো ব্রহ্মত্যেক আহুস্তন্ন…এতে হ ত্বেব দেবত্বে একধাভূয়ং ভূত্বা পরমতাং গচ্ছতঃ…অন্নে হীমানি সর্বানি ভূতানি বিষ্টানি। বৃহদারণ্যকোপনিষদ ৫:১২:১
৪৫. ইয়ং পৃথিবী সর্বেষাং ভূতানাং মধ্বস্যৈ পৃথিব্যৈ সর্বাণি ভূতানি মধু। প্রাগুক্ত ২:৫:১