১৯৬৯ সালের এপ্রিল মাস। আমি জাহাজে চেপে জাপান থেকে এ দেশে এলাম। প্রথম চট্টগ্রাম এসে নামলাম। তারপর ট্রেনে করে ঢাকা। ঢাকায় আমার ঠিকানা হলো আসাদ গেট নিউকলোনি। এ বাড়ির গৃহকর্ত্রী পেশাগত কাজে জাপান গিয়েছিলেন। সেই সূত্রেই আমার সঙ্গে দেখা।
মধ্যবিত্ত পরিবার। কলোনির আড়াই কামরার বাসা। আমার চোখের সামনেই ১৯৭০ সালে এ বাড়ির ছেলের জন্ম হলো। সেই হিসাবে আমি ওর বড় ভাই নাকি বড় বোন? জানি না।
সম্বোধন যা-ই হোক, সম্পর্কটাই আসল। আমার ঠাঁই হলো তাঁদের খাস শোবার ঘরেই। ছোট্টখাট্ট গড়ন আমার। গায়ের রং সাদা। গৃহকর্তা, গৃহকর্ত্রী, তাঁদের মেয়ে এবং তাঁদের ভাইবোনদের সঙ্গে আমি যেন এ পরিবারের সদস্যই হয়ে গেলাম। আমার যত্ন তাঁরা নিজ হাতে নিয়েছেন, কখনো গৃহপরিচারিকাদের হাতে ছেড়ে দেননি। তখন ছুটির দিন ছিল রোববার। রোববার ছিল আমার গোসল দিবস। ছোট্ট নরম তোয়ালের মধ্যে গুঁড়ো সাবান মাখিয়ে আমার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরিষ্কার করা হতো। দু-তিনবার করে পানি দিয়ে ধুয়ে দেওয়া হতো। আমার শরীরের যে অংশগুলো খোলা যায় সেগুলো খুলে নিয়ে দাঁত মাজার পুরোনো ব্রাশ দিয়ে পরম যত্নে ওরা ময়লা খুঁজে বের করতেন। তারপর কলোনির ছোট্ট বারান্দায় মাদুর পেতে সে অংশগুলোর পিঠে রোদ লাগিয়ে শুকাতেন। অতঃপর শুকনো নরম তোয়ালে দিয়ে আমার সমস্ত শরীর মুছে দিতেন। মাথা ঠান্ডা আমার বরাবরই। মাঝেমধ্যে আবার বেশি ঠান্ডা হয়ে যেত। ওরা ঠিক নিয়ম করে বরফ ঝরিয়ে দিতেন। আমার মাথা ঠান্ডা ছিল বলে কতজনের মাথা যে ঠান্ডা করা গেছে!
একবার আমাদের ওপরতলার ছোট্ট একটি ছেলে আইসক্রিম খাবে বলে আইসক্রিমওয়ালার হাতে মায়ের সোনার চুড়ি গুঁজে দিচ্ছে। ভাগ্যিস বারান্দা থেকে দেখে ফেললেন এ বাড়ির গৃহকর্ত্রী। পরম আদরে ডেকে আনেন ছেলেটিকে। ‘আইসক্রিম খাবে, বাবা?’ তাড়াতাড়ি ‘অরেঞ্জ স্কোয়াস’ গুলে খোপ খোপ বরফ থালায় ঢেলে আমার ঠান্ডা মাথায় ঢুকিয়ে দিল। তারপর ছেলেটির সঙ্গে বসে এই গল্প ওই গল্প•••। আমি জানপ্রাণ দিয়ে আইসক্রিম তৈরি করছি। অতঃপর তৈরি। ছোট্ট ছেলেটা সে কী আনন্দ নিয়ে খেলো! বি্নয়ে চোখ বড় বড় করে বলল, ‘এত? সব আমার?’
গৃহকর্ত্রী মাথা নাড়লেন। বললেন, ‘তোমার যখন আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করবে চলে আসবে।’ তারপর কৌশলে সোনার চুড়িটি উদ্ধার করে ওর মায়ের কাছে পৌঁছে দেওয়া হলো।
মাঝেমধ্যে আমার আফসোস হতো আমার মাথাটা কেন আরেকটু বড় হলো না। যখন দেখতাম বিল্ডিংয়ের অন্য ফ্ল্যাটের নম্বর লিখে ছোট ছোট মাংস বা মাছের প্যাকেট গচ্ছিত রাখতে গিয়ে গৃহকর্ত্রী হিমশিম খাচ্ছেন। আর কোরবানি ঈদের সময় তো কথাই নেই।
তবে এই পরিবারের সঙ্গে সঙ্গে আমার ওপর দিয়েও কম ঝড় যায়নি। নতুন দেশ নতুন পরিবার, এর মধ্যেই এসে গেল ১৯৭১। পরিবারের মানুষগুলোর গ্রামে-শহরে ছুটে চলা, উৎকণ্ঠা। তবে এত কিছুর মধ্যেও ওঁরা আমার নিরাপত্তার কথাটা ভোলেননি। আমি যে তাঁদের পরিবারেরই একজন! প্রথমে আমাকে রাখা হলো আরামবাগে তাঁদের এক ভাইয়ের মেসে। সেখান থেকে পরে গাইড হাউসে। অনেক দিন ছিলাম সেখানে। ১৯৭২ সালে স্বাধীন দেশে ওঁরা আবার নতুন করে বাড়িঘর গুছিয়ে আমাকে যেদিন নিতে এলেন, সেদিন আনন্দে আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। সবাইকে আবার ফিরে পেলাম। শুধু পেলাম না এ বাড়ির এক ভাইকে। শুনলাম, সে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ। আহা রে, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ঢাকায় এলে প্রথমেই তার দেখা হতো আমার সঙ্গে। এক বোতল ঠান্ডা পানি হাতে নিয়ে তবে সে সবার সঙ্গে কথা শুরু করত।
১৯৬৯ থেকে ২০০৮। বয়স তো আমার কম হলো না। মাঝখানে শরীরটা ভালো ছিল না। সে সময়টা পরিবারের অনেক কষ্ট হয়েছে। একবার তো ভাবলাম আর বোধ হয় বাঁচব না। ওঁরা বাসা বদল করলেন। আমি অকেজো। বারান্দার একপাশে আছি। কোনো ডাক্তারই কিছু করতে পারছে না। সবার এক কথা, দিন ফুরিয়ে গেছে। এ কথা শুনে আমার চেয়েও মন খারাপ এই পরিবারের মানুষগুলোর। হবে না? দীর্ঘ এই জীবনে কত জন্ম, মৃত্যু ও বিয়ের সাক্ষী আমি।
হঠাৎ একদিন বাড়ির গৃহকর্ত্রী আবিষ্কার করলেন নতুন গৃহপরিচারিকা আমাকে অকেজো ভেবে আমার ডালায় পেঁয়াজ, রসুন রাখা শুরু করেছে। প্রচণ্ড খেপে গেলেন তিনি। গৃহপরিচারিকা ভেবে পান না এই অকেজো জিনিস নিয়ে কেন এত উত্তেজনা। অতঃপর এই বাড়ির বড় মামা খুঁজে পেতে একজন ডাক্তার নিয়ে এলেন। যিনি বয়সে নবীন। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের অনুভূতিটি তার হৃদয় ছুঁয়ে গেল। ইতিমধ্যে আমার একজন জ্ঞাতি ভাই বাড়িতে এসেছে বটে, কিন্তু আমার জন্য সবার মন কাঁদে। ধীরে ধীরে আমি সুস্থ হলাম। কী আশ্চর্য, আবার আমার স্থান তাঁদের ঘরে। আবার আমি মাথা ঠান্ডা রেখে চলছি।
আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি যেন সুস্থ থাকি। সামনে কোরবানি ঈদ। আমার তো এখন অনেক কাজ।
শুনলাম, সেদিন ঢাকার উত্তরায় এক ছেলে আর ছেলের বউ চাটাই দিয়ে পেঁচিয়ে এক বৃদ্ধ মানুষকে ডাস্টবিনের পাশে ফেলে রেখে গেছে। মোহাম্মদপুরে রিকশা করে আরেক ছেলে তার মাকে এক জায়গায় রেখে ‘এই আসছি’ বলে আর আসেনি। দোষ তাদের একটাই, তাদের বয়স হয়েছে। হয়তো সন্তানদের বোঝা। অথবা বোঝার ভুল।
আর সেই তুলনায় আমি? আমার মতো ভাগ্য কয়জনের আছে? আপনারা মানুষেরা এই ছোট্ট হিটাচি ফ্রিজটিকে ঈর্ষাই করতে পারেন।
সুমনা শারমীন
সূত্রঃ প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৬, ২০০৮
Leave a Reply