কালোর ওপর হালকা হলুদ ডোরাকাটা খসখসে শীতল একটা পার্স যখন কেনার জন্য নেড়েচেড়ে দেখছিলাম, তখন কাউন্টারের উল্টো পাশে বসে থাকা অল্পবয়সী মেয়েটি হাসি-হাসি মুখে বেশ কায়দা করে বলল, ‘নিয়ে যান, ম্যাডাম। ভালো জিনিস। একদম খাঁটি আর খুব রেয়ার। সত্যিকারের সাপের চামড়ায় তৈরি।’
সাপের! শোনার সঙ্গে সঙ্গেই পার্স ধরে রাখা আমার হাতটা কেমন যেন একটুখানি কেঁপে উঠল। মনে হলো সরসর করে একটা কালো হলুদ ডোরাকাটা সাপ আমার হাতের নিচ দিয়ে পিছলে বেরিয়ে গেল। সম্ভবত আমার ওই সামান্য চমকে ওঠার ধাক্কায় পার্সটা ছিটকে পড়ল মেঝেতে।
‘ভয় পেলেন নাকি, ম্যাডাম?’ মেয়েটা পার্সটা কুড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
‘আমাদের দোকানের নাম দেখেননি, ম্যাডাম? স্কিন, ত্বক, বা চামড়া-যেটাই বলেন, সেটা নিয়েই কারবার আমাদের•••।’
আমার অনেক দিনের সঙ্গী বাদামি র্যাক্সিনের পার্সটা পুরোনো হয়ে যখন প্রায় ছিঁড়ি ছিঁড়ি অবস্থায়, তখন এসেছি নতুন একটা পার্স কেনার জন্য স্কিন নামের এই নতুন দোকানটায়। সরীসৃপের প্রতি কোনো ঘৃণা নেই আমার। তেমন কোনো ভালোবাসা আছে কি না তাও কখনো ভেবে দেখিনি। ভয়? হ্যাঁ, শিরশিরে একটা ভয়ের অনুভূতি হয়তো খানিকটা আছে।
‘নিয়ে যান, ম্যাডাম।’ মেয়েটা সাপের মতো ঠান্ডা চোখ মেলে আবার বলে। আমার চোখও যেন সম্মোহিতের মতো আটকে গেছে ওই সাপের চামড়াটার আঁশভর্তি গায়ে আর কেন যেন ঘুরেফিরে মনে হচ্ছে জীবন্ত সাপটার কথা, না-জানি কোন গহিন জঙ্গলে বুক ঠেকিয়ে ঝরাপাতার মর্মর শুনতে শুনতে কিংবা মাটির বুকের ধুকধুক অনুভব করে করে সাপটা তার লকলকে জিভ বের করে ছুটত খাবারের খোঁজে, একটা ব্যাঙ কিংবা একটা ইঁদুর, নিদেনপক্ষে সামান্য পোকামাকড়•••। একটা সাপ কতটুকু খায় কে জানে। হয়তো এঁকেবেঁকে যেতে যেতে, হয়তো পালাতে পালাতে কোনো সুনিপুণ শিকারির হাতে বা কোনো চামড়ালোভী বিষদন্তময় মানুষের আঘাতে তার আক্নিক মৃত্যু এসে খুলে নিয়েছে আবরণটুকু। চিকন লম্বা একটা অসহায় নরম হাড়ের শরীর বেদনায়-যন্ত্রণায় ছটফট করে মরে যায়। হঠাৎ নিজেকে ওই হতভাগ্য সাপের জায়গায় ভাবতে থাকি। মনে হয়, চারপাশে চামড়া তুলে নেওয়া মানুষের রক্তাক্ত মাংসল বীভৎস শরীরগুলো নীরবে আর্তনাদ করছে। যেন আমার শরীর থেকেও চামড়া খুলে নিয়েছে কেউ, শরীরময় বয়ে যাচ্ছে তীব্র তীক্ষ্ন যন্ত্রণা, তরল আগুনের স্রোত। মনে হয়, স্কিন নামের দোকানটায় সুদৃশ্য তাক ভর্তি করে মানুষের চামড়ায় তৈরি অসংখ্য জিনিস থরেবিথরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সাদা মানুষের, কালো মানুষের, বাদামি মানুষের চামড়ায় তৈরি চকচকে ব্যাগ, পার্স, জুতা, বেল্ট, মানিব্যাগ•••।
‘না, ম্যাডাম, মানুষের চামড়া খুব পাতলা, কোনো কাজেই আসে না।’
আমাকে আরেক দফা চমকে দিয়ে কর্কশ হেসে মেয়েটা বলে ওঠে।
আমি টের পাই, আমার হাতের নিচের কালো হলুদ ডোরাকাটা শীতল পার্সটা তার পুরোনো মাংসের গন্ধ পেতে নড়েচড়ে উঠছে। ফণা তুলছে। ছোবল দিচ্ছে।
পার্সটা এখন আবার সাপ হতে চাইছে।
শাহনাজ মুন্নী
সূত্রঃ প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৬, ২০০৮
Leave a Reply