কোরবানির ঈদে কাঠমান্ডুতে থাকব বলে একজনের প্রশ্নঃ
ওখানে কোরবানি দিতে পারবেন? খাসি কি সস্তা হবে? মসজিদের অবস্থা কী?
বললামঃ কোরবানি তো সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি।
প্রশ্নঃ গরু বা খাসি প্লেনে বয়ে নিয়ে যাবেন?
না, তা নয়। কোরবানি দেব আমার মনের পশুকে। সেটা তো প্রতিনিয়ত আমার সঙ্গে। বিমানের ফ্লাইটে ওই পশুটাকেও সঙ্গে নিয়ে চলেছি।
মসজিদের ব্যবস্থাটি হলো, যেখানেই আমার নিয়ত, সেখানেই আমার মসজিদ। ফজরে, জোহরে, আসরে, মাগরিবে, এশার নামাজিদের দেখা নেই। দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ নিয়ে যত দুশ্চিন্তা! গুলশান আজাদ মসজিদে ফজরের ফরজ আদায়ের সময় এক কাতারও পূর্ণ হয় না। অথচ সকাল আটটায় লক্ষাধিক মানুষ উপস্থিত, এক হাজার গাড়ি, এসেছে নতুন সাজে, আজ যে ঈদ। ঈদ মোবারক!
আজ ভাবছি অন্য কথা।
থাইল্যান্ডে যখন প্রথম যাই, দেখেছিলাম বৌদ্ধ ভিক্ষুরা নিজের দেহে পেট্রল ঢেলে অগ্নিসংযোগ করছেন, একজন নয়, কয়েকজন। ১৯৬৪ সালে। জাপানিরা তরবারি দিয়ে নিজেদের খণ্ডিত করে ফেলেছে হারিকিরি করে, দুই শ বছর থেকে। ফিলিস্তিনে অল্পবয়স্ক তরুণ আর মা-বোনেরাও নিজেদের শরীরে তাজা বোমা বেঁধে আত্মাহুতি দিচ্ছে। আমার একজন প্রিয় ব্যক্তিকে ফুল দিতে গিয়ে তামিল মহিলা হত্যা করেন, নাম রাজীব গান্ধী। এই হননের দৃশ্য বাগদাদ-বসরা-কারবালার পথে পথে, আফগানিস্তানের কাবুল-কান্দাহারের মোড়ে মোড়ে। অবশেষে, কদিন আগে বাড়ির পাশে, ইন্ডিয়া গেটের সামনে তাজ হোটেলে। প্রশ্ন, কেন এই আত্মহনন?
এই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজছে সবাই। তাত্ত্বিকেরা ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, ইন্টারনেটে ক্লিক করলেই তা পাওয়া যাচ্ছে। বড় পত্রিকায় একই প্রসঙ্গ। ভাবছি আমাদের কোরবানির কথা। এই ঈদে লাখ লাখ পশু কোরবানি হবে আরাফাত ময়দানে। আমিও দিয়ে এসেছি ‘৮২ সালে। কত পশু কোরবানি হবে বাংলাদেশে, তার পরিসংখ্যান কারও কাছে নেই। ধরা যাক ১০ লাখ।
প্রতিবার প্রথম জিলহজ থেকেই প্রস্তুতি নিতে থাকি। রোজা রাখি, আরাফাতের দিন পর্যন্ত, নামাজ, তাসবিহ-তাহলিল। জিলহজ মাসের ৯ তারিখে পবিত্র হজ ও ১০ তারিখে কোরবানি।
জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিন সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে সূরা আল-ফাজর-এর দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘ওয়া লায়ালিন আশরিন’ অর্থাৎ ‘শপথ দশ রজনীর’।
আল্লাহ তাআলা এই ১০ রাতের কসম খেয়েছেন।
জিলহজের প্রথম ১০ দিন সম্মানিত, সর্বোত্তম।
এর প্রতিদিনের রোজা এক বছরের রোজার সমতুল্য। প্রতি রাতের ইবাদত শবে কদরের ইবাদতের সমতুল্য। কে না জানি, শবে কদরের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম।
কোরবানির দিন রোজা রাখা হারাম বা নিষিদ্ধ।
জিহাদের কথা সব সময়ই বলি। অথচ শুনুনঃ
জিলহজের প্রথম দিন যে রোজা রাখবে, সে যেন এক ঘণ্টাও বিশ্রাম না করে একাধারে দুই হাজার বছর ধরে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করল।
[অর্থাৎ ১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২০০১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সে জিহাদ করল]
৯ তারিখে অর্থাৎ আরাফার দিনে পবিত্রতা অর্জনের উৎকৃষ্ট সুযোগ। সকাল থেকে পূতপবিত্র হয়ে থাকতে হবে, আল্লাহ তার যেকোনো প্রার্থনা কবুল করবেন, ৭০টি রহমতের দরজা তার জন্য উন্মুক্ত হবে। দোয়া কবুলের দিন। ৮ তারিখে যে রোজা রাখবে, তার জন্য বেহেশতের আটটি দরজাই উন্মুক্ত হবে।
৭ তারিখে যে রোজা রাখবে, তার জন্য দোজখের সাতটি দরজাই বন্ধ থাকবে।
৬ তারিখে যে রোজা রাখবে, সে ছয় হাজার শহীদের সওয়াব লাভ করবে।
৫ তারিখে যে রোজা রাখবে, সে যেন পাঁচ হাজার অভাবী বস্ত্রহীন ব্যক্তিকে বস্ত্র দান করল।
৪ তারিখে যে রোজা রাখবে, সে যেন ৪০০ বছর ধরে আল্লাহর জিকিরে মগ্ন ছিল।
যে ৩ তারিখে রোজা রাখবে, সে যেন হজরত ইসমাইল (আ•) বংশের তিন হাজার গোলামকে মুক্ত করে দিল।
কোরবানির শিক্ষা হলো উৎসর্গের শিক্ষা। নিজেকে, নিজের আরাম-আয়েশকে প্রহার করো। বস্তুপূজা, দুনিয়ার মহব্বত দূরে ফেলে দাও। সবচেয়ে প্রিয়তম বস্তু ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি, স্ত্রী-পরিজন। তাদের চেয়েও প্রিয় আল্লাহ তাআলা।
পরীক্ষাটি হলো আল্লাহর হুকুম মানব।
মানুষের হুকুম নয়, আল্লাহর হুকুম।
আল্লাহর হুকুম হলো তাঁর ইবাদত ও মানুষের সেবা। কোনোটা বাদ দিয়ে কোনোটা নয়। মানুষের সেবা ও পশুদেরও সেবা। রাসূলুল্লাহ (সা•) তা-ই করেছেন সারাটা জীবন।
বিনা কারণে নিরপরাধ মানুষকে হনন করা ইসলামের শিক্ষার বিপরীত। মানুষকে অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা, কথা দিয়ে আঘাত করা-সবই অমানবিক, অনৈসলামিক। কোরবানির পশু কোরবানি দেওয়া একটি বড় আমল; ঈদের নামাজ আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে, নামাজের আগে নয়। তাকবিরে তাশরিক জোরে পড়া ১৩ জিলহজের আসর পর্যন্ত। ঈদের দিনে নতুন কাপড় পরা এবং মিসকিনদের যথাসম্ভব আগের সব কাপড় দিয়ে দিতে হবে। আল্লাহ তাআলা এমন ব্যক্তিকে ৭০টি নূরের তাজ পরাবেন এবং নবী করিম (সা•)-এর পতাকার নিচে আশ্রয় দেবেন।
আবার ফিরে আসি নেপালের হিমালয় পর্বতমালার কাছে, পোখরাতে। জানি, নেপালের গুহাতেই খুঁজে পাওয়া গেছে চর্যাগান ও দোহা; অল্প খুঁজেই সন্ধান পান মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। বাংলা ভাষার ইতিহাস এই চর্যাগানেই লুকোনো। পোখরাতে শত শত পর্যটক এসেছে। ওরা কোরবানি জানে না।
হেরার গুহায় রোজ যেতেন আমাদের নবীশ্রেষ্ঠ। সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান ছিল সেটাই। হিমালয় পর্বতে, এক নিভৃত জনারণ্যে নগর কোটে যেখানে আজ আমি, ভাবছি কোরবানির কথা। নরাধম আমি, মনের পশুকে এখানে কোরবানি দেব হিমালয়ের শিখরে দাঁড়িয়ে, সামনে প্রবাহিত খরস্রোতা, তুর্ষা, যা পরে নাম নেবে ‘তোরষায়’। তোমরা সাক্ষী রইলে।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী
সূত্রঃ প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৬, ২০০৮
Leave a Reply