হাসান আজিজুল হক অতিপ্রজ লেখক নন; প্রত্যেক বইমেলায় তাঁর নতুন বই বেরোয় না। পত্রপত্রিকায়ও যে তাঁর লেখা হরহামেশা প্রকাশিত হয় এমনও নয়। কিন্তু আমরা তাঁর নতুন লেখার অপেক্ষায় থাকি; বিশেষত গল্পের। কারণ তাঁর গল্পগুলো পড়ে মনে গৌরব বোধ হয় এই ভেবে যে, বিশ্বমানের গল্প আমাদের দেশে, আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষাতেও লেখা হচ্ছে। এ পর্যন্ত হাসান আমাদের উপহার দিয়েছেন নয়টি গল্পগ্রন্থ। সেসব বইয়ের অধিকাংশ গল্পই আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের মর্যাদা বাড়িয়েছে। বাংলা যে একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধ ভাষা, তা দিয়ে যে উৎকৃষ্টমানের কথাসাহিত্য রচিত হতে পারে তা প্রমাণিত হয়েছে হাসান আজিজুল হকের গল্পগুলোর মধ্য দিয়ে। শুধু কথাসাহিত্য নয়, বাংলা যে মননশীল প্রবন্ধ রচনারও কার্যকর এক ভাষা তারও স্বাক্ষর মেলে হাসান আজিজুল হকের সাহিত্য, সমাজ ও দর্শনবিষয়ক লেখায়। উপন্যাস তিনি লিখেছেন, সত্যি করে বললে, একটি; এবং তাতেও প্রমাণ করেছেন যে শুধু প্রমিত লেখ্য বাংলা নয়, আঞ্চলিক মুখের বাংলাও জীবন, সমাজ, রাজনীতি, ভূগোল বেশ ভালোভাবেই উপস্থাপন করতে পারে।
এমন একজন লেখকের যেকোনো বইয়ের প্রকাশ সাহিত্যরসিকদের জন্য আনন্দসংবাদ। সম্পূর্ণ নতুন বই হলে তো অবশ্যই, এমনকি পুরোনো লেখার পুনঃপ্রকাশও। আর যদি এমন হয় যে একটি বইয়ের মধ্যে তাঁর অনেক লেখাকে একসঙ্গে পাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে; তাহলে তাঁর অনুরাগী পাঠকদের কাছে সেটা একটা খুশির খবর হয়েই আসে। গত একুশের বইমেলায় হায়াৎ মামুদ ও আহমেদ মাহমুদুল হক তেমনই একটা কাজ করেছেন। নির্বাচিত হাসান আজিজুল হক নামে ৬৬৮ পৃষ্ঠার যে ঢাউস বইটি বের হয়েছে, প্রথমজন সেটির সম্পাদক, আর দ্বিতীয় জন প্রকাশক, মাওলা ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী। তাঁদের জানা ছিল যে ইতিমধ্যে পাঁচ খণ্ডে বেরিয়ে গেছে হাসান আজিজুল হকের রচনাসংগ্রহ; কিন্তু দুই মলাটের মধ্যে একটি মাত্র গ্রন্থে তাঁর প্রতিনিধিত্বমূলক লেখাগুলোর সন্নিবেশ ঘটানোর উদ্যোগ তাঁরা নিয়েছেন, সম্পাদকের ভাষায়ঃ ‘রসগ্রহিষ্ণু পাঠকের সামনে এমন একটি সংকলন থাকা প্রয়োজন যাতে খণ্ডিত অবয়বে নয়-বরং বলা ভালো বামনাকারে-সবটুকুই অথচ খাটো করে নিয়ে, হাসানকে পাওয়া যায়।’ ভালো, প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিঃসন্দেহে।
নয়টি গল্পগ্রন্থ থেকে ২৪টি গল্প, চারটি প্রবন্ধের বই থেকে ১৬টি প্রবন্ধ বাছাই করে, তার সঙ্গে একটি উপন্যাস ও একটি বড় গল্প জুড়ে দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে নির্বাচিত হাসান আজিজুল হক। এই বাছাই প্রক্রিয়ার সঙ্গে লেখকের কোনো সংস্রব ছিল না এ কথা লেখকের বক্তব্য থেকে জানা যাচ্ছে। লেখাগুলো বাছাই করেছেন সম্পাদক হায়াৎ মামুদ, যিনি বইটির ভূমিকায় বলেছেন, সবটুকুই অথচ খাটো করে নিয়ে হাসানকে পাওয়ার লক্ষ্য সাধনের চেষ্টা করেছেন। সেই লক্ষ্য কতটা সাধিত হয়েছে তার কোনো সাধারণ বিচার করতে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। কারণ হাসান আজিজুল হকের মনোযোগী পাঠকদের মধ্যে বিষয়রুচির বিচারে পার্থক্য আছে। কেউ কেউ মনে করেন, রাষ্ট্র, সমাজ ও প্রকৃতির বিরুদ্ধতার সামনে নিরন্তর সংগ্রামরত প্রান্তিক মানুষের জীবনের ছবি আঁকার জন্য হাসান গুরুত্বপূর্ণ, কারও কারও কাছে হাসানকে সুদক্ষ ও শক্তিমান শিল্পী মনে হয়, যখন তিনি ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক জগতের উন্মোচন ঘটান, আবার কারও বিচারে হাসান আজিজুল হকের গল্প-উপন্যাসের প্রধান বিষয় দেশভাগ। মোটা দাগে এই তিনটি বিষয়ে সর্বোৎকৃষ্ট বা অন্ততপক্ষে সবচেয়ে প্রতিনিধিত্বমূলক লেখাগুলো এ বইয়ে সংকলিত হয়েছে কি না এ নিয়ে তর্ক উঠতে পারে। সম্পাদকের ব্যক্তিগত রুচি ও পছন্দের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকা অস্বাভাবিক নয়, কারণ তিনি নিজেও একজন পাঠক। কিন্তু নিজের ব্যক্তিগত পাঠরুচির ঊর্ধ্বে উঠে তিনি কতটা উদারতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে লেখা বাছাইয়ের কাজটি করতে পেরেছেন সেটা অবশ্যই দেখার বিষয়।
তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, নির্বাচিত হাসান আজিজুল হক নামের এই একটিমাত্র বইয়ে লেখকের পুরো ইতিহাসটাই ধরা আছে। ১৯৬০ সালে ২১ বছর বয়সে লেখা গল্প শকুন আর ২০০৬ সালে ৬৫ বছর বয়সে লেখা উপন্যাস আগুনপাখি-এই ৪৪ বছরের মাঝখানে রচিত বাকি সব লেখার মধ্য থেকে নির্বাচিত গল্প ও প্রবন্ধগুলো হাসান আজিজুল হকের লেখকসত্তার বিকাশের ইতিহাস বহন করে। অবশ্য একটি বিষয়ে ঘাটতি রয়ে গেছে। শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা তাঁর কোনো গল্প-উপন্যাস এ বইতে নেওয়া হয়নি। অথচ লাল ঘোড়া আমি নামের কিশোর-উপন্যাসটি না পড়লে, বা ফুটবল থেকে সাবধান গল্পগ্রন্থের চরু নামের ছোট্ট গল্পটি বাদ দিলে হাসানের শিল্পিমনের আরও এক বি্নয়কর সুন্দর দিকের প্রতিনিধিত্ব বাদ পড়ে যায়। সম্পাদক কৈফিয়ত দিয়েছেন, অনিচ্ছা সত্ত্বেও শিশু-কিশোরপাঠ্য রচনা বর্জন করতে বাধ্য হয়েছেন ‘সাধ্যের সীমা বিবেচনা করে’। লক্ষ করেছি, লেখকের প্রথম দিকের গল্পগ্রন্থগুলো থেকে নেওয়া হয়েছে বেশি গল্প, শেষের দিক থেকে কম। এর তাৎপর্য ঠাহর করা কঠিন; তবে কি হাসানের ষাট ও সত্তরের দশকে লেখা গল্পগুলোই তাঁর বেশি প্রতিনিধিত্ব করে বলে সম্পাদকের মনে হয়েছে? প্রথম দিকের গল্প কিছু কম নিয়ে যদি শিশু-কিশোরদের জন্য কয়েকটি গল্পকে জায়গা করে দেওয়া হতো, তাহলে এ বই আরও বেশি সম্পূর্ণতা পেতে পারত।
বইটিতে সংকলিত লেখাগুলো সম্পর্কে আলোচনা করার অবকাশ এখানে নেই; হয়তো সে প্রয়োজনও নেই, কেননা সেগুলো সম্পর্কে বিভিন্ন সময় অনেক আলোচনা হয়েছে। তবে তাঁর সর্বসাম্প্রতিক যে লেখাটি বেশ আলোড়ন তুলেছে, দুই বাংলায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারে ভূষিত সেই আগুনপাখি নিয়ে দু-একটি কথা বলার ইচ্ছা দমন করা সম্ভব হচ্ছে না। আমার বিচারে এটি হাসান আজিজুল হকের একমাত্র উপন্যাস, লিখনশৈলীর বিচারে বাংলা কথাসাহিত্যে যার দৃষ্টান্ত বিরল। এর বিষয় ভারতবর্ষের বিভাজন; উত্তম পুরুষে এক বয়স্ক নারীর বয়ানে রচিত সুদীর্ঘ মনোলগ। বিশ শতকের শুরুর দিকে তাঁর জন্ম, সামান্য অক্ষরজ্ঞান আছে, বঙ্গবাসী পড়তে পারেন কিন্তু সংসারের ঘানি তাঁকে সে ফুরসত দেয় না। তিনি কথা বলেন বর্ধমানের আঞ্চলিক ভাষায়, যা আমার কাছে খুব পরিচিত নয়, ফলে উপন্যাসটি পড়তে শুরু করে মনে হয় এক অশিক্ষিত গ্রাম্য বৃদ্ধার মুখে প্রায় ২০০ পৃষ্ঠার বয়ান পড়ে শেষ করা সম্ভব হবে না। কিন্তু কাহিনীর ভেতরে ঢুকে পড়ার পর ভাষা আর কোনো সমস্যা থাকে না। লেখক এমন কুশলতার সঙ্গে ওই নারী চরিত্রটি এঁকেছেন, তাঁর মুখে তাঁর সংসার, গ্রাম, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি ও তাঁর সময়ে ঘটমান ঘটনাবলির বিবরণ দিয়েছেন যে, তাঁর পেছনে লেখক নিজে হাজির রয়েছেন। আগুনপাখি একটি রাজনৈতিক দর্শনের এমন এক সৃজনশীল উপস্থাপনা, যার সাক্ষাৎ পাওয়ার আগ পর্যন্ত ধারণা করা কঠিন যে একে সম্ভব করে তুলতে হলে কোনো লেখককে কত বড়, কত শক্তিমান, কত মহৎ একজন শিল্পী হতে হয়।
নির্বাচিত হাসান আজিজুল হক; মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০০৮
মশিউল আলম
সূত্রঃ প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৫, ২০০৮
Leave a Reply