বাংলাদেশের ফুল
এম এ তাহের
নভেম্বর ২০০৭
সিঙ্গার বাংলাদেশ লিঃ
ঢাকা
প্রচ্ছদঃ কাইয়ুম চৌধুরী
২০৭ পৃষ্ঠা
২০০ টাকা
বইটি দেখে যে কারোরই অন্তত দু-চার পৃষ্ঠা পড়ে দেখার লোভ হতে পারে। আর প্রকৃতির অনুরাগী হলে তো কথাই নেই। একসঙ্গে দুই শতাধিক ফুলের ছবি, প্রলুব্ধ করার মতো বিষয়ও বৈকি। তার ওপর লেখক নিজেই একজন ভালো আলোকচিত্রী। নিশ্চয় তিনি তাঁর প্রিয় ছবিগুলোকে এখানে প্রাধান্য দিয়েছেন। বাংলাদেশের ফুল নামের এ অ্যালবামটির লেখক এম এ তাহের। আপনমনেই দেশের প্রত্যন্ত জনপদে ঘুরে ঘুরে ছবি তোলেন। সবকিছুর সঙ্গে ফুল-পাখি এসবের প্রতিও আসক্তি প্রবল। জীবনের কিছু সঞ্চিত ছবি দিয়ে সাজিয়েছেন আলোচ্য গ্রন্থটি। লেখক গ্রন্থ শিরোনামেই ভেতরের বিষয়বস্তু বলে দিয়েছেন। প্রচ্ছদপটে স্থান পেয়েছে বাংলার অন্তরঙ্গ ফুল হিজল। যেন চোখের সামনেই রূপসী বাংলার ছবি। মলাট খুললে ভেসে ওঠে প্রাণবন্ত সব ফুলের ছবি। তারপর মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুধু পৃষ্ঠা ওল্টানোর পালা। এসব ঝকঝকে ফুলের ছবির প্রতিটিরই আলাদা ভাষা আছে, আলাদা গল্প আছে। কে বঞ্চিত হতে চায় এমন সুযোগ থেকে।
বর্ণনার ক্ষেত্রে বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষার ব্যবহার এ বইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক বলা যেতে পারে। বাংলাভাষাভাষী ছাড়া ভিনভাষীরাও খুব সহজেই আমাদের উল্লেখযোগ্য ফুল সম্পর্কে জানতে পারবেন। ভাষান্তরের কাজটি করে দিয়েছেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। অনুবন্ধে অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা বলেছেন, ‘আসলে তার তোলা চমৎকার ছবিগুলোই আমাকে পোষ মানিয়েছিল আর আমার বিশ্বাস পোষ মানাবে পাঠকদেরও।’ সবকিছু মিলিয়ে ফুল চেনানোর এক জম্পেশ আয়োজন। না বললেই নয়, আমাদের নিজস্ব ফুলের রঙিন ছবি সংবলিত অ্যালবাম খুব বেশি বাজারে নেই। বাংলাদেশের ফুল কিছুটা হলেও এমন বইয়ের দৈন্য ঘোচাবে। প্রসঙ্গত ড· নওয়াজেশ আহমদের ওয়াইল্ড ফ্লাওয়ারস অব বাংলাদেশ এবং বাংলার বুনোফুল নামের গ্রন্থ দুটোর কথা বলা যায়। সেখানেও পাওয়া যাবে বাংলার চিরায়ত ফুলগুলো।
লেখক প্রতিটি ফুলের বর্ণনায় প্রচলিত নাম, ইংরেজি নাম, বৈজ্ঞানিক নাম, পরিবার এবং ছবি তোলার স্থান ও তারিখ উল্লেখ করেছেন। সব ভুক্তির ক্ষেত্রেই ছবি ও বর্ণনার জন্য আলাদা পৃষ্ঠা ব্যবহার করা হয়েছে। আলোচনায় ক্ষুদ্র ঘাসফুল থেকে সুউচ্চ নাগলিঙ্গমও স্থান পেয়েছে। লতা, গুল্ম, ওষুধি, বুনো-সব ধরনের ফুলই ভিড় করেছে এখানে। সব মিলিয়ে একজন অনুসন্ধানী পাঠক খুব সহজেই বিষয়বৈচিত্র্য খুঁজে পাবেন। স্থির চিত্রের ফুলের সঙ্গে নিজের দেখা বাস্তব ফুলটিও মিলিয়ে নিতে পারবেন। যাঁরা গাছপালা চিনতে আগ্রহী তাঁরা গাইড বই হিসেবেও ব্যবহার করতে পারেন।
কিন্তু এমন চমৎকার একটি আয়োজনের মধ্যে বেশ কয়েকটি অসংগতি লক্ষ করা যায়, যা না বললেই নয়। ২৭ নম্বর পৃষ্ঠায় ব্যবহৃত ফুলটি আমাদের দেশে নতুন এবং ল্যাজারস্ট্রমিয়া ইন্ডিকার একটি ভ্যারাইটি তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে লেখক ছোট জারুল নামটি কোথায় পেলেন। জানামতে, সদ্য আমদানি করা এ ফুলটির বাংলা নাম নেই। মনগড়া যেকোনো নাম পাঠকের মনে বিভ্রান্তি তৈরি করে। অধিকাংশ ফুলের ক্ষেত্রে লেখক প্রচলিত বা স্থানীয় কিংবা অন্যান্য পোশাকি নাম ব্যবহার করেননি। ২৯ নম্বর পৃষ্ঠায় মান্দার উল্লেখ করা হলেও পোশাকি নাম পারিজাত ব্যবহার করা হয়নি। একইভাবে ৩১ পৃষ্ঠায় সোনালুর বহুল ব্যবহৃত নাম সোনাইল বা বান্দরলাঠিও বলা হয়নি। ৩৩ পৃষ্ঠায় বন সোনালু নামটিও লেখকের মনগড়া। আদতে গাছটি ৮-১০ বছর আগে মালয়েশিয়া থেকে আমাদের দেশে নিয়ে আসা হয়। বৈজ্ঞানিক নাম ক্যাশিয়া সুরাটেনসিস নয়, ক্যাশিয়া গ্লাওকা। ক্যাশিয়া সুরাটেনসিস ক্যাশিয়ার আরেকটি স্বতন্ত্র ভ্যারাইটি। ওই ফুলকেই আবার সূচিপত্রে সুরাটি সোনাইল বলা হয়েছে। ৫৭ পৃষ্ঠায় কলকে ফুলের ইংরেজি নাম হবে ইয়েলো ওলিয়েনডার। ৬৩ পৃষ্ঠায় কানুর নামটি বোধগম্য নয়; প্রচলিত নাম সুখদর্শন বা টাইগার লিলি। ৯৫ পৃষ্ঠার ফুলটি বহুল পরিচিত ভাঁট বা ঘেঁটু। লেখক পরিচয় লিখতে গিয়েও এসব নাম ব্যবহার করেননি। বনজুঁই সম্ভবত আঞ্চলিক নাম। ১০৫ পৃষ্ঠায় শ্বেতাদ্রোণের বহুল প্রচলিত নাম দণ্ডকলস। একইভাবে জাম্বুরা আঞ্চলিক নাম, প্রচলিত নাম বাতাবি লেবু। কোথাও কোথাও মূল নাম এবং বৈজ্ঞানিক নামে অসংগতি লক্ষ করা যায়। লেখক এসব ক্ষেত্রে বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করলে আরও ভালো হতো। তবু এত বড় একটি কর্মযজ্ঞে এটুকু ভুল তেমন ধর্তব্যের বিষয় নয়। এখানে লেখকের ভালোবাসা ও আগ্রই প্রধানত বিবেচ্য। আশা করি প্রকৃতিপ্রেমিকেরা এ বই থেকে নানাভাবে উপকৃত হবেন।
মোকারম হোসেন
সূত্রঃ প্রথম আলো, ডিসেম্বর ডিসেম্বর ০৫, ২০০৮
Leave a Reply