ইলিয়াসের দোকানপাট
মেহেদি রাসেল
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস চূর্ণ ভাবনা ও চূর্ণ কথা সংগ্রহ \ সংকলন ও সম্পাদনা: আলাউদ্দিন মণ্ডল \ প্রকাশক: পার্থশঙ্কর বসু \ নয়া উদ্যোগ \ মূল্য: ১৮০ টাকা
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস নিঃসন্দেহে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিকদের অন্যতম। দুই বাংলাতেই তাঁর মতো কথাসাহিত্যিক দুর্লভ। ইলিয়াসের জীবনবোধ, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, যেকোনো কিছু নিয়ে ঠাট্টা করবার ক্ষমতা, রসবোধ, প্রতীক নির্মাণের কৌশল ও তার ভেতরকার নিগূঢ় নন্দন এবং সর্বোপরি তার অন্তর্দৃষ্টি তাঁকে পৃথক ও স্বতন্ত্র করে তুলেছে অন্যান্য সমকালীন আর পূর্বজ লেখকদের থেকে। ব্যক্তির মনস্তত্ত্বের ভেতরে চলমান দ্বন্দ্ব-সংঘাত, চরিত্রের স্ববিরোধী কার্যকলাপ, ‘মানুষ’ অভিধাটির অনন্ত সম্ভাবনা তাঁর মতো করে আর কেউ দেখেননি। তথাকথিত ভালো ও মন্দের ধারণা তাঁর কাছে অন্য রকম, যা সাধারণের আর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ। জগৎ সম্পর্কে নিজস্ব এক হিসাব-নিকাশ অন্যদের সঙ্গে তাঁর সুস্পষ্ট পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। ফলে, পরিমাণে কম লিখেও ইলিয়াস অপরিহার্য। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা তাঁর ট্রিলজির শেষ উপন্যাসটি পাইনি। পরিবর্তমান সময়ে তাঁর উপন্যাসটি হয়তো মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আরও দরকারি দৃশ্যপট ও বাস্তবতাকে হাজির করতে পারত। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে বোঝার জন্য তাঁর সাহিত্যিক টেক্সটই একমাত্র হয়ে উঠতে পারত, যদি তাঁর প্রতীক আর চিত্রকল্পময় ভাষাটি আরেকটু কম্যুনিকেটিভ হতো। ফলে বেশির ভাগ পাঠকের কাছে এই সাহিত্যিক ব্যক্তিত্বটি ও তাঁর সাহিত্যকর্ম বোঝার জন্য তাঁর সাক্ষাৎকার, চিঠিপত্র, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বয়ান ও বিতর্ক, ডায়েরি ইত্যাদি জরুরি হয়ে উঠতে পারে।
আলাউদ্দিন মণ্ডল তাঁর আখতারুজ্জামান ইলিয়াস চূর্ণ ভাবনা ও চূর্ণ কথা সংগ্রহ বইটিতে এসবই সংকলিত করেছেন। প্রথমেই এখানে স্থান পেয়েছে সাক্ষাৎকার। বিভিন্ন সময়ে নেওয়া এ সাক্ষাৎকারগুলোতে ইলিয়াসের শৈশব, সাহিত্যিক জীবন, ব্যক্তিজীবন, পেশা ইত্যাদি বেশ সাবলীলভাবেই উঠে এসেছে। জীবনের নানা অজানা বিষয় নিয়ে প্রগলভ হয়ে উঠেছেন তিনি। ইলিয়াসের যত বলবার ছিল সে তুলনায় তার সাহিত্যকর্ম নিতান্তই কম, ফলে সাক্ষাৎকারগুলোতে বারবার প্রগলভ হয়ে উঠতে দেখা যায় তাঁকে। এই বইয়ে সংকলিত সাক্ষাৎকারগুলোর মধ্যে ‘লিরিক’ পত্রিকার জন্য কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের নেওয়া সাক্ষাৎকারটি সবচেয়ে দীর্ঘ। প্রচুর প্রসঙ্গ নিয়ে ইলিয়াস কথা বলেছেন এখানে। সারা দিন ধরে নেওয়া এ সাক্ষাৎকারটিতে ইলিয়াস অনেক বেশি স্বতঃস্ফূর্ত। ছোটদের পত্রিকা শিশুতে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটিও বেশ মজার। মুক্তিযুদ্ধ ও তার ফলাফল সম্পর্কে উচ্ছ্বাস ও হতাশা প্রকাশিত হয়েছে কয়েকটি সাক্ষাৎকারে।
বাবা সক্রিয় রাজনীতিবিদ হওয়ায় এবং শৈশবেই বিভিন্ন ধরনের বইয়ের সংস্পর্শে আসায় প্রথম থেকেই একটি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছিল ইলিয়াসের। লোকজ সংস্কৃতি, তার ভেতরকার মিথ, বৃহৎ ঘটনায় তৃণমূল মানুষের অন্তর্ভুক্তির ধরন তিনি চিহ্নিত করেন গভীরভাবে। গ্রামকে যেমন তিনি গ্রামের লোক হয়ে দেখতে পারেন, তেমনি স্বাধীনতার সময়কালে গড়ে উঠতে থাকা নব্য ঢাকাকে দেখেন সেখানকারই একজন হয়ে। ফলে তাঁর লেখায় গ্রামের লোক যেমন তার স্বাভাবিক আর খাঁটি রূপ নিয়ে হাজির, একইভাবে শহরের মানুষও তার দ্বন্দ্ব-সংকট নিয়ে উপস্থিত।
ইলিয়াসের উপন্যাস দুটির প্রেক্ষাপট ‘পরিবর্তমান’ দুটি সময়। একটি হলো ১৯৬৯ এর গণ-আন্দোলন, অপরটি ১৯৪৭ সালের দেশভাগ। দুটি সময়ই প্রচণ্ড রকমের অস্থির। সাধারণ মানুষ এ রকম বৃহত্তর ঘটনার সঙ্গে কীভাবে জড়িত হয়ে পড়ে অথবা বিপ্লব ও পরিবর্তনে তার ভূমিকাটা কিরূপ হয়, তা-ই দেখাতে চেয়েছেন ইলিয়াস। তিনি ঘটনা ও বিষয়কে দেখেন আবহমান ইতিহাসের অংশ হিসেবে। ফলে ঘটনার গতি-প্রকৃতি ও কার্যকারণ বোঝার জন্য তাঁকে পাঠ করা জরুরি। ভারতবর্ষের ইতিহাসে নিম্নবর্গের মানুষ চিরকালই শোষিত। অথচ যেকোনো লড়াইয়ে তার অংশগ্রহণই সবচেয়ে বেশি। নিম্নবিত্ত চিরকাল ফসল ফলায় ও ফসল পাহারা দেয়। আর উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত তা দখল আর ভোগ করে। মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষ বলেই মধ্যবিত্তের বেহায়া চরিত্র তিনি নিখুঁতভাবে আঁকতে পেরেছেন। সুযোগসন্ধানী মধ্যবিত্তকে ইলিয়াস কখনোই মহৎ করে তুলতে চাননি। সে যা, তা-ই দেখাতে চেয়েছেন। তাঁর মধ্যবিত্ত বিপ্লবের ভাষণ দেয় আবার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পেছন দিক দিয়ে পলায়ন করে। তাঁর মধ্যবিত্ত ধার্মিক অথচ হস্তমৈথুনের পর অনুশোচনায় বিদ্ধ হয়।
এই বইয়ে সংকলিত ইলিয়াসের চিঠিপত্রে আমরা তাঁর আরও একটি রূপ আবিষ্কার করতে পারি। বেশ বড়সড় পরিসরে এখানে অনেক চিঠিপত্র সংকলিত হয়েছে। এর মধ্যে যেমন সাহিত্যিক চিঠিপত্র আছে, তেমনি একান্ত ব্যক্তিগত চিঠিও এখানে স্থান পেয়েছে। ফলে এর মাধ্যমে নানামাত্রিক ইলিয়াসকে আবিষ্কার করা সহজতর হয়ে ওঠে। জীবন সম্পর্কে সর্বদা আশাবাদী এই লেখকের ব্যক্তিত্বের বিষণ্ন রূপটি তাঁর চিঠিপত্র থেকে ধরা পড়ে। চিঠিগুলো ব্যক্তি ইলিয়াসকে আমাদের আরও নিকটবর্তী করে তোলে। চিঠিপত্র ছাড়াও এখানে স্থান পেয়েছে শাহাদুজ্জামান সম্পাদিত তাঁর ব্যক্তিগত ডায়েরি। নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা ছাড়াও বহুবিচিত্র সাহিত্যিক টেক্সট এখানে প্রকাশিত।
পেশা হিসেবে ইলিয়াস বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতাকে। তিনি মনে করতেন, এই পেশা তাঁর লেখালেখির সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়, সহায়ক। শিক্ষকতার খাতিরে এবং একজন গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক হিসেবে তাঁকে পাঠ্যসূচির জন্যও কিছু লেখা লিখতে হয়েছে। এই লেখাগুলোর বিষয়ও বিচিত্র। হয়তো ফরমায়েশি লেখা, তবু এখানেও ইলিয়াসের নিজস্বতা বিদ্যমান।
ফলে, বইটি নানামাত্রিক ইলিয়াসকে পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। তাঁর সাহিত্যের পৃথক পাঠের জন্যও বইটি জরুরি। ব্যক্তি ইলিয়াস, সাহিত্যিক ইলিয়াস, তাঁর জীবন, বেড়ে ওঠা, রাজনৈতিক মতাদর্শ, দৃষ্টিভঙ্গি, সমসাময়িক ও অতীত প্রেক্ষাপট ইত্যাদি বোঝার জন্য বইটির গুরুত্ব রয়েছে। তবে বইটিতে সম্পাদকের বক্তব্য খুবই সামান্য। নেহাতই দায়সারা। যেটি তাঁর এই বৃহৎ কাজের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। ইলিয়াস সম্পর্কে আগ্রহী পাঠকদের কাছে বইটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও অবশ্যপাঠ্য বলে বিবেচিত হবে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ৩০, ২০১১
Leave a Reply