বাংলা সাহিত্যের নায়িকারা
জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে’র টুনি
মুর্তজা বশীর
হাজার বছর ধরে উপন্যাসের নারী চরিত্র টুনি শিল্পী: মুর্তজা বশীর জহির রায়হান: প্রবাদপ্রতিম কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা।
উল্লেখযোগ্য কথাসাহিত্য: শেষ বিকেলের মেয়ে, হাজার বছর ধরে, আরেক ফাল্গুন, বরফ গলা নদী, একুশে ফেব্রুয়ারি, কয়েকটি মৃত্যু প্রভৃতি।
তিনি ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট বর্তমান ফেনী জেলার অন্তর্গত মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি মুক্তিযুদ্ধে নিখোঁজ বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে ঢাকার মিরপুরে অজ্ঞাতপরিচয় শত্রুদের হাতে নিহত হন।
টুনি বুড়ো মকবুলের তৃতীয় পক্ষ। গায়ের রং কালো। দোহারা গড়ন। আয়ত চোখের এই মেয়েটির বয়স তেরো-চৌদ্দর মাঝামাঝি। কিশোরীর চঞ্চলতা এখনো তার মধ্যে বিরাজমান। তাই ঘর-সংসার কাকে বলে সে বুঝে ওঠেনি। সমবয়সী কারোর সঙ্গে দেখা হলে সে গল্পে মেতে ওঠে। কখনো হাসতে হাসতে মেঝেয় গড়াগড়ি খায়।
পরীর দীঘির পশ্চিম ও পুব ধারে চারটি করে সামনে নুয়ে পড়া বাঁশের তৈরি বেড়ার ছোট ছোট আটটি কুঁড়েঘর একসঙ্গে লাগানো। পুবের দিকের উত্তরের ঘরে থাকে মকবুল। তার তিন বিবি আমেনা, ফাতেমা ও টুনিকে নিয়ে বসবাস করে।
মন্তুর সঙ্গে টুনির খুব ভাব। রাত-বেরাতে টুনির আবদারের সঙ্গী হয় সে। কখনো অন্ধকার রাতে পরের পুকুরে মাছ ধরার জন্য জাল ফেলে। কখনো শীতের হাড়কাঁপুনি রাতে টুনি অন্যের খেজুরগাছে সিরনি রাঁধার জন্য হাঁড়ি নিয়ে গাছে ওঠে, তারও সঙ্গী হয়।
তিন বউকে খাওয়ানোর মতো জমিজমা মকবুলের তেমন নেই। বউরা কাজ করে আয় করে, তা দিয়েই মকবুলের দিনগুজার হয়। টুনি সদ্যজাগ্রত যৌবন নিয়ে ভালোবাসার কাঙাল। স্বামীর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত, টুনি তাই মন্তুর প্রতি আকর্ষিত হয়। একেবারে দক্ষিণের ছোট্ট ঘরটায় থাকে মন্তু। এই দুনিয়ায় তার কেউ নেই। বাবা, মা, ভাই, বোন কেউ না। মন্তু পরের জমিতে লাঙল চষে ধান বোনে। তারপর ধানের মৌসুম শেষ হলে কলাই, মুগ, তিল ও সরিষার খেতে কাজ করে। মাঝেমধ্যে লাকড়ি কাটার চুক্তি নেয়। আবার যাত্রী কিংবা মালামাল নিয়ে নৌকায় মাঝির কাজ করে। যদিও সবাই মন্তুকে মনে করে একগুঁয়ে, বদমেজাজি স্বভাব, জানোয়ারের মতো। কিন্তু টুনির চোখে এমন মাটির মানুষ এ জন্মে দেখেনি। তাই তার কোনো রকম ব্যথাবেদনায় টুনি বিচলিত হয়ে যায়। টুনির সঙ্গে পুকুরে মাছ চুরি করার সময় সগন শেখের পুকুরপাড়ে একটা বুনোলতার কাঁটায় মন্তুর পিঠ কেটে গিয়েছিল। তা দেখে উতলা হয়ে যায় টুনি। টুনি সেদিকে করুণ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে দরদ গলায় বলে, ‘চলো, কচুপাড়ের ক্ষির লাগাইয়া বাইন্দা দি, নইলে পাইকা যাইব, শেষে কষ্ট পাইবা।’ আবার গ্রামে যখন কলেরার প্রকোপ বেড়েছে, তখন মন্তুর জন্য টুনির উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার অন্ত থাকে না। মন্তু গিয়েছিল মিয়াবাড়ি, গাছ কাটার চুক্তি নিয়ে। ঘরে এসে কুড়োল মাটিতে রাখতে না রাখতে টুনি তাকে নিয়ে যায় একধারে। বলে, মাঝিবাড়ি যাও নাই তো? জোছনা, ওই বাড়ির দিকে গেলে কিন্তু আমার মাথা খাও। যাইও না ক্যান? কিন্তু মন্তু যখন টুনির স্বামী মকবুলের জ্বরের জন্য কবিরাজের কাছ থেকে ওষুধ তার হাতে দিয়ে বলে ঠিকমতো খেতে। তখন টুনি বলে, ‘কী অইব ওষুধ খাইয়া, বুড়া মরুক।’ একসময় টুনি জানতে চায় কবিরাজ কী বলেছে। মন্তু যখন বলে, কিছু না, ভালো হয়ে যাবে, তখন টুনি চোখজোড়া কপালে তুলে বলে, ‘ভালো অইয়া যাইব?’ টুনি চায় না তার স্বামী সুস্থ হোক। তাই তার রাগ গিয়ে পড়ে, ঘুরঘুর করে তার আশপাশের ঘোরা কুকুরের ওপর। হঠাৎ দাওয়া থেকে পিঁড়ি ছুড়ে মারে কুকুরের গায়ে। মন্তুর কেউ নেই, মকবুল বাড়ির মুরব্বি। সে ঠিক করে, মন্তুর বিয়ে দেবে আম্বিয়ার সঙ্গে। নন্তু শেখের মেয়ে আম্বিয়া, আঁটসাঁট দেহের ভাঁজে ভাঁজে উপচে পড়া যৌবন আট হাত শাড়ির বাঁধন ভেঙে বের হতে চায়।
আম্বিয়ার সঙ্গে মন্তুর মেলামেশায় ঈর্ষান্বিত হয়। মকবুলের মেয়ে হীরনের বিয়ের দিন আম্বিয়া ও মন্তুকে নিয়ে রসিকতা সহ্য করতে পারে না। হাজার বছর ধরে উপন্যাসে লেখক লিখেছেন, “হঠাৎ টুনির কণ্ঠস্বরে চমকে উঠল সবাই। তীব্র গলায় সে বলল, ‘কী অইতাছে অ্যাঁ? কী অইতাছে। কামকাছ ফালায়া কী শুরু করছ তোমরা। অ্যাঁ?’ সহসা সবাই চুপ করে গেল। একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগল। ওরা।…সালেহা বলল, ‘আমরা না হয় মন্তু মিয়া আর আম্বিয়ারে নিয়া একটুখানি ঠাট্টামশকরা কইরতাছিলাম, তাতে টুনি বিবির এত জ্বলন লাগে ক্যান?’
“ওর কথা শেষ না হতে ঝড়ের বেগে রসুইঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এল টুনি। ‘কী কইল্যা অ্যাঁ।’ চুলগুলো বাতাসে উড়ছে ওর। চোখজোড়া জ্বলছে। সালেহা সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘যা কইবার তা কইছি, তোমার এত পোড়া লাগে ক্যান।’ বলে মুখ ভ্যাংচালো সে।
“পরক্ষণে একটা অবাক কাণ্ড করে বসল টুনি। সালেহার চুলের গোছাটা ধরে হ্যাঁচকা টানে ওকে মাটিতে ফেলে দিল। তারপর চোখে-মুখে কয়েকটা এলোপাতাড়ি কিলঘুসি মেরে দৌড়ে সেখান থেকে পালিয়ে গেল টুনি।” আম্বিয়া যাতে মন্তুর জীবনে না আসে, সে জন্য টুনি তাকে সতিনরূপে গ্রহণ করতেও দ্বিধা করে না। তাই তার স্বামীকে আম্বিয়াকে বিয়ে করার জন্য প্ররোচিত করে, সেই সঙ্গে প্রলোভন দেখায়। জহির রায়হান লেখেন, ‘মকবুল বড় বোকা। নইলে এমন সুযোগটা কেন হেলায় হারাচ্ছে সে। একটা বসতবাড়ি। একটা খেত। আর একটা নৌকো। ইচ্ছে করলে ওগুলোর মালিক সেও হতে পারে। সে কেন বিয়ে করে না আম্বিয়াকে।’ হিসেবি মকবুলের আম্বিয়ার সহায়-সম্পদ থেকে বেশি করে নজর কাড়ে তার শক্ত-সামর্থ্য দেহ। একটানা সারা দিন ধান ভানতে পারে। খাটতেও পারবে তেমনি। তবু মকবুল ভাবে, বড় বউ আমেনা ও সেজো বউ ফাতেমা মত দেবে। টুনি বলে, ‘রাজি অইব না কেন। নিশ্চয় অইব কিন্তু আম্বিয়া সে কি রাজি হবে?’ টুনি জানায়, চেষ্টা করলে সবকিছুই সম্ভব। স্ত্রীদের তীব্র প্রতিবাদের মুখে মকবুল তাদের একসঙ্গে তালাক দিয়ে দেয়। একপর্যায়ে আম্বিয়ার প্রণয়প্রার্থী আবুল পিঁড়ি তুলে সজোরে ছুড়ে মেরে মকবুলকে আহত করে। রক্তাক্ত মকবুলকে দুহাতে কাছে টেনে সেখান থেকে নিয়ে যায় টুনি। এই ঘটনায় সবাই টুনিকে দায়ী করে, কিন্তু টুনি নির্বিকার হয়ে থাকে। কথার কোনো জবাব দেয় না। এদিকে আম্বিয়া জানায়, সে মকবুলকে বিয়ে করবে না।
আঘাতজনিত কারণে মকবুল মারা গেলে টুনির বিলাপ দেখে বিস্মিত হলো মন্তু। সূর্য ওঠার আগে যখন পুব আকাশে শুকতারা জ্বলজ্বল করে জেগে থাকে, তখন দীঘি থেকে শাপলা তুলে টুনির জন্য আনে মন্তু। সুগুপ্ত ভালোবাসা হাতে নিয়ে এক অব্যক্ত বেদনার যন্ত্রণা বুকে নিয়ে টুনি নিথরভাবে থাকে দাঁড়িয়ে। ভোরের আকাশে সূর্যের লালিমা নিয়ে ভালোবাসার জাগ্রত বর্ণচ্ছটা।
টুনির জীবনেই মন্তু চোরা স্রোতের মতো। একদিকে বৃদ্ধ স্বামী মকবুল, অন্যদিকে যৌবনের জয়গান নিয়ে মন্তু। এই দ্বৈরথ নিয়ে টুনি।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ৩০, ২০১১
Leave a Reply