পাঠ প্রতিক্রিয়া – কবিতার ইশতেহার, কবিতার হিসেব-নিকেশ
কবিবন্ধু সাজ্জাদ শরিফের লেখা ‘কবিতার অর্থ, কবিতার অনর্থ’ পাঠের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশে কবিতাচর্চার আস্ত ইতিহাসের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় আমাদের। পাশাপাশি ২৫ বছর ধরে এ দেশের কবিতার ওই নাতিদীর্ঘ বাস্তবতায় আমরা যারা ওপরে নাক তুলে ভেসে আছি, তাদের কিছু প্রশ্নের মুখেও ঠেলে দিয়েছেন সাজ্জাদ। ওঁর বক্তব্য প্রাসঙ্গিক ও তাৎপর্যময়; বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কবিতার গন্তব্য নিয়ে সুস্পষ্ট উদ্বেগ আছে সাজ্জাদের। ওঁর বিশেষণে উঠে এসেছে এই ভূভাগে বাংলা কবিতার ভাষিক রূপ বদলের গোড়ার দিকটিও।
আমরা জানি, নানা কালপর্বে কবিতার ভাষা বদলায়, আর সেটা ঘটে চর্চাকারীর রুচি আর মর্জিমাফিক। কিন্তু কবিতা লিখতে গিয়ে কবি পথ চলেন অনুমানে—গাণিতিক নিশ্চয়তার ওপর ভর করে নয়। তাই কবি কখনোই পুরোপুরি জানতে পারেন না, আসলে কী ঘটছে। কবি তাঁর অনুভূতিদেশ থেকে যা তুলে দিতে চান, তা তাঁর নিজের মনের মতো পুরোপুরি কখনো হয় না, কিছু একটা অপূরণ থাকে বরাবরই। এই ঘাটতি পূরণ কবির কোনো দিনই হয় না। এটা কবিদের এক ধরনের নান্দনিক বিপর্যয়, দার্শনিক বাধা (অ্যাপোরিয়া)। এই বাধা ডিঙোনোর চেষ্টায় কবি রূপ বদলান, ভঙ্গি পাল্টান, এক অনিঃশেষ ভাষার আবর্তে প্রবেশ করেন কবি।
গত শতকের আশির দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত এ দেশের কবিদের এমনই এক নান্দনিক বিপর্যয়ের কথা বলতে গিয়ে সাজ্জাদ একদল তরুণ কবির দ্রোহের প্রসঙ্গ টেনেছেন। বাংলামোটরের মোড়ে জহুরা মার্কেটের কথিত সস্তা হোটেলে বসেই তৈরি হয়েছিল সেই ইশতেহার—আমাদের কবিতার। আমরা তার নাম দিয়েছিলাম ‘সমগ্রবাদী ইশতেহার’। আমরা মানে—সাজ্জাদ শরিফ, শোয়েব শাদাব আর আমি। তিনজনের স্বাক্ষরে সেই ইশতেহার প্রথম ছাপা হয়েছিল হাবীব ওয়াহিদ সম্পাদিত ছোটকাগজ অনিন্দ্যতে। এরপর আরও কিছু যোগ-বিয়োগের পর এটি আবার প্রকাশিত হয় ছোটকাগজ গাণ্ডীব-এ।
স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদের তার্তুলিয়াসে কাফে কলোনিয়ালে বসে আল্ট্রুয়িস্ট মুভমেন্টের এমনই এক ইশতেহার লেখার কথা আমরা জানি। সেদিন আমাদের মতোই একদল কবি স্পেনের ‘মদার্নিসমো’ কবিতার বিরোধিতায় শামিল হয়ে লিখেছিলেন ‘আলত্রুইস্ত’ কবিতা আন্দোলনের ইশতেহার। তাতে শরিক হয়েছিলেন তখন স্পেনে বসবাসকারী আর্জেন্টিনার কবি হোর্হে লুইস বোর্হেসও। ইশতেহার রচনার পর থেকে লেখা, সহযোগ ও বন্ধুত্বের সূত্রে যোগ ঘটতে থাকে আরও নানা সুহূদের সঙ্গে—তাঁরা কেউ সম্পাদক, কেউ গল্পকার, কেউ চিত্রশিল্পী, কেউ বা স্রেফ উৎসাহদাতা। এর মধ্যে ছিলেন গল্পকার ও অনতিপরের গাণ্ডীব-সম্পাদক তপন বড়ুয়া, গল্পকার সেলিম মোরশেদ, গল্পকার ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আন্দোলনের কর্মী প্রয়াত তারেক শাহরিয়ার, গাণ্ডীব-এর নামকরণকারী চলচ্চিত্রকর্মী জাহেদুর রহিম অঞ্জন। বন্ধুদের বৃহত্তর দলে পরে একে একে যুক্ত হন সদ্যপ্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ, চিত্রশিল্পী ঢালী আল মামুন আর ওয়াকিলুর রহমানরা। সেই স্মৃতি পিছে রেখে এবার প্রসঙ্গে ফেরা যাক।
সাজ্জাদ তাঁর লেখায় দাবি করেছেন, ‘ইশতেহার দিয়ে কবিতা হয় না।’ অথচ এর পর পরই তিনি লিখেছেন, ওই তরুণ কবিদের ‘কবিসুলভ সংবেদনশীলতা যে তাঁদের সঠিক সংকেত দিয়েছিল, গত দুই-আড়াই দশক ধরে বাংলা কবিতার ক্রমাগত পাল্টে যাওয়া ভাষা দেখে আজ তা-ই মনে হয়।’ এর অর্থ দাঁড়ায় নতুন কবিতা লেখায় সমসাময়িকদের মধ্যে সেই ইশতেহারের একটা গ্রহণযোগ্যতা ছিল বা এখনো আছে। কিন্তু কী ছিল সেই ইশতেহারে? তাই ইশতেহারটা একবার খুলে দেখা দরকার:
১. প্রচলিত পঙ্কস্রোত থেকে মুক্তি দিতে হবে কবিতাকে। ২. কবিতার শব্দ হবে এমন, যা পাঠকের চেতনায় আছড়ে পড়বে হাতুড়ির মতো; গুঁড়ো গুঁড়ো করে দেবে চৈতন্যের ইট। ৩. আমরা এবং একমাত্র আমরাই নির্মাণ করব শব্দের অতিব্যক্তিক সংরক্ত চরিত্র। ৪. পাঠকের জন্য কবিতা পাঠের অভিজ্ঞতা হবে মৃত্যুযন্ত্রণার মতো। কবিতা শাণিত কৃপাণের মতো ঢুকে যাবে পাঠকের মনোরাজ্যে; আর পাঠক আর্ত ঘোড়ার মতো ছুটতে ছুটতে দেশকাল পেরিয়ে পৌঁছে যাবে এক আতীব্র বোধের চূর্ণিত জগতে। ৫. থুতু ছুড়ি তথাকথিত সুন্দর ও কুৎসিতের স্থূল কাব্যবন্দনায়। কেবল আমাদের অভিজ্ঞানে রয়েছে রহস্যময় সংবেদনের আবর্ত। ৬. এইমাত্র জন্মান্তর ঘটেছে প্রাজ্ঞ অশ্বত্থের, তার অনন্ত শিকড় শুষে নেবে প্রতিটি রসকুম্ভের আত্মা—আর তার মহাবিস্তৃত প্রশাখার করতল অধিকার করে নেবে সমগ্র বিশ্ব এবং অবিশ্বকে। ৭. চাই চামড়া ছাড়ানো দগদগে আদিমতা আর রক্তের ফেনময় ঘূর্ণিনাচ। ৮. ক্ষেত্রবিশেষে ব্যাকরণ আগ্রাহ্য করে কবিতায় প্রয়োগ করতে হবে বিন্দুবাদী প্রক্রিয়া।
এ দেশে কবিতায় বাঁক ফেরানোর আন্দোলনে এই ইশতেহারের অনুঘটকের ভূমিকা আমরা আজও উপভোগ করি, এর নান্দনিক গুরুত্বের প্রতি এখনো বিশ্বাসটুকু অটুট আছে আমাদের অনেকের। কারণ এই ইশতেহারে নতুনতর ভাবনার মাল-মসলা আছে, প্রতিচেতনার উন্মেষ আছে; আর এর সবই মেটাফর-কনসেপ্ট, আমাদের কল্পনাকে ছুঁয়ে যায় রূপকাকারে। কিন্তু সাজ্জাদের ওই মন্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট নয়, আসলে, দর্শনগত বা নান্দনিক, কোন অর্থে এই ইশতেহারের গ্রহণযোগ্যতা নেই? এটা কি বাংলা কবিতায় স্বতন্ত্র ধারা—দেরিদীয় অর্থে ‘ডিফারেন্স’—তৈরিতে এক ফোঁটা শিশিরও যোগ করেনি?
আসলে কবিতার ইশতেহার কেবল একটি ইশতেহারই, ইশতেহার ছাড়া অন্য কিছু নয়। গাণিতিক সূত্র বা সমাজ বদলের রূপরেখার মতো এর দাবিগুলোর স্বতঃসিদ্ধতাও নেই। কিন্তু যেকোনো কবি-লেখকের মূল্যায়ন তার অবস্থানের নিরিখেই হয়, যা পুরোপুরি তার চর্চার সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট; লেখালেখির মধ্য দিয়েই লেখক হয়ে ওঠেন স্বতঃপ্রসারিত (রিফ্লেক্সিভ)। ঠিক এখানেই কবি-লেখকের দায়িত্বের প্রশ্ন আসে, কাজ করে তার ইনটেনশনালিটি। একজন সক্রিয় কবির হাতে তৈরি হয় কবিতার পাল্টা মূল্য, পাল্টা প্রতিনিধিত্ব। কারণ কোনো সাহিত্যকর্মের লক্ষ্য একজন পাঠককে ভোক্তা বানানো নয়, বরং তাকে ওই টেক্সটের অন্তর্ভুক্ত করে তোলা।
এখানে একটি তথ্য না দিলেই নয়: এই ইশতেহার তৈরির অগ্রণী কুশীলব ছিলেন সাজ্জাদও। তারপর কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সরে গিয়েছিলেন তিনি। আজ পর্যন্ত সংগত কারণটুকু আমাদের জানা হয়নি। সাজ্জাদের বিশ্বাসের বদল ঘটতে পারে, এমনকি আদর্শেরও। কিন্তু ওর ইশতেহারপর্বে লেখা কবিতাগুলোই এখন পর্যন্ত ওর কবিতার উজ্জ্বল বিদ্যুচ্চমক বলে মনে হয়। গভীর অনুভূতি থেকে জেগে ওঠা তাঁর পঙিক্তগুলো এখনো নবীন কবিদের লেখায় পুষ্টি জোগায়, তখন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের তর্কটা বড় নয়, ওই কবিতা নিংড়ে বের করা নির্যাসটুকু পান করে পরের কবিরা পান কাব্যিক শুশ্রূষা।
কবি, কবিতা ও কবিতাতত্ত্ব পরস্পর পরিপূরক বিষয়। কবিতার আলোচনা ছাড়া আমরা যেমন একটি কবিতাকে কোনোভাবেই পাতে তুলতে পারি না, তেমনি কোনো কবিতা তার শর্তটুকু পূরণ না করলে আমরা সেটি নিয়ে আলোচনাও করি না। আবার একটি কবিতাকে অপর একটি কবিতা থেকে আলাদা করার অর্থ যুগল বিরোধাভাস (বাইনারি অপজিশন) থেকে দেখাও নয়, বরং এই হিসেবটা যোগাচারী (রিলেশনাল)। আমরা ধরে নিতে পারি, ভিন্ন ধারার চর্চা থেকে তৈরি হয় ভিন্ন মাত্রার কবিতা।
সাজ্জাদ ওর লেখায় শেষ পর্যন্ত যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেন তার বক্তব্য আমলে নিয়ে বলা যায়, নতুন কবিতামাত্রই আমাদের যাপন ও সমাজ-রাষ্ট্রের বিদ্যমান ছকের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ। ওর বক্তব্য থেকেই তর্কের সুতাটা টেনে বের করলে দাঁড়ায়: নতুন কবিতার জন্য বিদ্যমান ছকের (স্ট্রাকচার) বিরুদ্ধে পাল্টা ছক খাড়া করা জরুরি। একটি ছককে আরেকটি ছক দিয়ে সরাতে গেলে বৈপ্লবিক কিছু ঘটাতে হয়, তাই র্যাডিক্যালিটি ভিন্ন অন্য পথ নেই। ঠিক একইভাবে সমগ্রবাদী ইশতেহারে নতুন কবিতা লেখার শর্তগুলোও এই বিদ্রোহেরই তো সাক্ষ্য দেয়। এই ইশতেহারের মাধ্যমে কার্যত সেই ছকই তৈরি হয়েছে। কবিতার অর্থ ও যোগ্য ভাষা বিনির্মাণ উভয় দিক থেকেই এই ছক নিখাদ আলাদা।
বাংলা কবিতার এক ঘোর-লাগা দশার কথা বলতে গিয়ে ফরাসি কিন্নরকবি পল এলুয়ারের কৃতিত্বকে প্রমাণ মেনেছেন সাজ্জাদ। অথচ ফরাসি কবিতা আন্দোলন দাদাবাদের অন্যতম একজন প্রতিভূ এলুয়ার নিজেও। মূলত বিশ্বসাহিত্যে একেকটি যুগাবসানে যেসব কবি ‘ডিফারেন্স’ তৈরির শর্ত পূরণ করছেন, তাঁদেরই আমরা যুগন্ধর বলে মানি। রোমান্টিক পর্বের কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘লিরিক্যাল ব্যালাড্স্’ বা বোদলেয়ারের ‘লে ফ্লর দ্য মাল’-এর ভূমিকা এক অর্থে ইশতেহার নয় কি? ইমেজিস্ট ধারার কবি এজরা পাউন্ড কিংবা স্পেনের ‘জেনারেশন অব টোয়েন্টি সেভেন’-এর বিসেন্তে আলেহান্দ্রে, রাফায়েল আলবের্তি, পেদ্রো সালিনাস বা ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকাদের উত্থানপর্ব এই ইশতেহার দিয়েই শুরু হয়েছিল। রুশ রূপবাদী, ইতালীয় ভবিষ্যবাদী, ফরাসি পরাবাস্তববাদী, চিলির সৃজনবাদী কিংবা প্রতীকবাদী বা প্রতিমাবাদী আন্দোলন থেকে সাম্প্রতিক মার্কিন ল্যাংগোয়েজ পোয়েট্রি ম্যুভমেন্টের আভাঁ-গার্দ অব্দি কবিতাচর্চার তুমুল ইতিহাস এই প্রমাণই হাজির করে: কবিতার ইতিহাস প্রতিচেতনার এক অমোঘ বৃত্তে বাঁধা।
সাজ্জাদের সংশয়ভরা বক্তব্যের জের টেনে তর্কের খাতিরে যদি দাবি করা হয়, গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের কবিতায় এই ইশতেহারটি একটি মাপকাঠি হিসেবে কাজ করেছে বা কবিতার গতিপথ বাতলে দিয়েছে, তাহলে এই দাবি কি খুব অসংগত মনে হবে? বরং পাল্টা ভাষ্য হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশে আশির দশকে শুরু হওয়া নতুন ধারার কবিতাচর্চা আর লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনে এই ইশতেহার যেমন গভীর প্রভাববিস্তারী, তেমনি একজন তরুণ কবিকে নতুনতর কবিতা লেখার আলাদা পথ কেটে নেওয়ার মানসিক বল ও চিন্তার স্বাধীনতা এনে দিয়েছে ইশতেহারটি। এ দেশের কবিতায় ‘সমগ্রবাদী ইশতেহার’-এর অনন্যতা এখানেই। এটি তার ইতিহাসের মূল্য নিয়ে টিকে থাকবে, এমন বিশ্বাসই জারি রাখতে চাই।
শান্তনু চৌধুরী
মালিবাগ, প্রথম লেন, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৯, ২০১১
Leave a Reply