২০০৬-এর ২০ আগস্ট, শামসুর রাহমানের মৃত্যুর তিন দিন পর, নিউইয়র্ক প্রথম আলো বন্ধুসভা আয়োজন করেছিল কবি শামসুর রাহমান স্মরণসন্ধ্যা। সেই সন্ধ্যায় অসুস্থ শরীর নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন শামসুর রাহমানের দীর্ঘদিনের বন্ধু, সহযাত্রী কবি শহীদ কাদরী। তিনি তাঁর কবিবন্ধু সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করেন। শহীদ কাদরীর সেদিনের সেই স্মৃতিচারণার ভাষ্য এখানে ছাপা হলো। তাঁর বক্তব্য ধারণ করেছিলেন আদনান সৈয়দ।
আমি সত্যি এখনো শামসুর রাহমানের এই প্রয়াণ মেনে নিতে পারছি না। বছর দুয়েক আগে আমার সাথে শামসুর রাহমানের শেষ কথা হয় টেলিফোনে। তখন আমি অসুস্থ, শামসুর রাহমান নিজেও অসুস্থ ছিলেন। তিনি তখন আমাকে বলেছিলেন, ‘আই সিনসিয়ারলি উইশ ইওর স্পিডি রিকভারি।’ তারপর আর শামসুর রাহমানের সাথে আমার কথা হয়নি। কিন্তু আমার সৌভাগ্য হয়েছিল শামসুর রাহমানকে সেই কৈশোরকাল থেকে চেনার। কবিতা পাঠ এবং কবিতা নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর।
আমাদের কলকাতার এক বন্ধু ছিলেন, যাঁর মাধ্যমেই কবি শামসুর রাহমানের সাথে আমার পরিচয় হয়। আমরা বায়ান্ন সালে ঢাকায় এসেছিলাম। আমাদের এক বন্ধু, নাম খোকন, ওঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল কলকাতায়। চুয়ান্ন সালে হঠাৎ তিনি ঢাকায় আমাদের বাসায় এসে হাজির হলেন। তিনি আবার বড় ভাইয়ের ক্লাসমেটও ছিলেন। আমাকে দেখেই বললেন, ‘এই, তোরা এসেছিস কবে?’ তখন আমি সুকান্তর কবিতার একজন নিমজ্জিত পাঠক। সুকান্তর মতোই লেখার চেষ্টা করছি। তা আমার বড় ভাই খোকনকে বললেন, ‘শহীদ তো আজকাল কবিতা-টবিতা লেখার চেষ্টা করছে, জানিস নাকি?’ শুনে তিনি আমাকে বললেন, ‘দেখা তো তোর কবিতা? তিনি আমার কবিতা দেখলেন-টেখলেন কিন্তু কোনো মন্তব্য করলেন না। আমাকে বললেন, ‘তুই শামসুর রাহমানের নাম শুনেছিস?’
আমি বললাম, ‘না তো?’
‘কী বলিস! শামসুর রাহমানের কবিতা প্রত্যেক সপ্তাহে দেশ-এ ছাপা হচ্ছে।’
তখন পর্যন্ত আমি শামসুর রাহমানের নাম শুনিনি। সদরঘাটের উল্টো দিকে খান মজলিসের একটা বুক স্টল ছিল। সেখানে পরিচয়, নতুন সাহিত্য, দেশ, পূর্বাশাসহ সব রকম পত্রিকাই আসত। এর মধ্যে আমার একটি কি দুটি কবিতা হয়তো ছাপাও হয়েছে। তখন মহিউদ্দিন আহমেদ সাহিত্য পত্রিকা বের করতেন, নাম ছিল স্পন্দন। স্পন্দন-এ আমার একটা কবিতা বের হয়। কবিতা বের হওয়ার পরই নিজেকে লেখক-টেখক ভাবতে শুরু করে দিয়েছিলাম। ওই কবিতাটি ছিল টিপিক্যাল মার্কসিস্ট, কিছুটা মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়-ভাবধারায় লেখা। তারপর পূর্বাশা আর চতুরঙ্গ পড়তে শুরু করলাম। আমার চিন্তাভাবনা ধীরে ধীরে রোমান্টিক কবিতার দিকে মোড় নিল। তখন আমি ‘জলকন্যার জন্যে’ কবিতাটি লিখি। কবিতাটি খুবই আনাড়ি ছিল, তবে এই কবিতাটির শরীরজুড়ে ছিল এক ধরনের বিষণ্ন রোমান্টিকতা।
এর মধ্যে একদিন খোকন আমাকে বললেন, ‘তোর কথা আমি শামসুর রাহমানকে বলব এবং তোর সাথে পরিচয় করে দেব।’ ‘জলকন্যার জন্যে’ কবিতাটি ছাপা হবার পর আমি প্রায়ই পত্রিকার স্টলে দাঁড়িয়ে আমার কবিতাটি বারবার পড়তাম এবং আড় চোখে দেখতাম অন্য কেউ আমার কবিতাটি পড়ছে কি না। রোজই আমাকে এ কাজ করতে হতো। একদিন দুপুরবেলার দিকে স্টলে দাঁড়িয়ে আছি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার কবিতাটি পড়ছি। আমার পেছনে দাঁড়িয়ে একজন ভদ্রলোক যে আমাকে লক্ষ করছিলেন তা আমি বেশ টের পাচ্ছিলাম। আমি ঘাড় ফিরিয়ে দেখি, খুব ফরসামতো, মানে সর্ব-অর্থে সুন্দর একজন সুপুরুষ স্পন্দন খুলে আমার কবিতাটি পড়ছেন। তখন আমাদের চোখাচোখি হলো। শামসুর রাহমান বললেন, ‘আচ্ছা, আপনি কি শহীদ কাদরী?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, কী করে বুঝলেন?’
‘আপনার কথা আমাকে খোকন বলেছে।’
আমি খুব অভিভূত হয়ে গেলাম শামসুর রাহমানের সাথে পরিচিত হয়ে। তখন সদরঘাটে একটা রেস্টুরেন্ট ছিল, নাম ‘রিভার ভিউ’। সেখানেই চা খেতে খেতে শামসুর রাহমানকে বললাম, ‘আপনার কবিতা তো দেশ-এ পড়ছি।’ শামসুর রাহমান তাঁর পকেট থেকে বের করে অনেকগুলো কবিতা আমাকে পাঠ করে শোনালেন। তখন আমাদের সবার পকেটেই কবিতা থাকত।
আমি বললাম, ‘আমার পকেটেও একটা কবিতা আছে, শুনবেন?’ কবিতাটি তাঁকে পড়ে শোনালাম। সেটাও ছিল গতানুগতিক রোমান্টিক ধারার একটা কবিতা। ওই কবিতার একটা লাইনে ‘ভূল’ শব্দটির দিকে ইঙ্গিত করে শামসুর রাহমান বললেন, ভুল শব্দটার বানান ভুল হয়েছে।
সেখান থেকে শামসুর রাহমানের বাসায় গেলাম। শামসুর রাহমান আমাকে কালের পুতুল বইটি পড়তে বললেন। সেই থেকে আমরা বহুদিন মধ্যরাত পর্যন্ত একসাথে ঢাকার রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছি, চা খেয়েছি, সিগারেট খেয়েছি। আমাদের আড্ডায় ফজল শাহাবুদ্দীন থাকত আর মাঝে মাঝে আল মাহমুদ যোগ দিত।
আমার সঙ্গে শামসুর রাহমানের এত ্নৃতি জড়িয়ে আছে যে আমি এ মুহূর্তে বুঝতে পারছি না যে আমি কোনটা ছোঁব আর কোনটা ছোঁব না। এখনো আমার মনে হচ্ছে শামসুর রাহমান আছেন, আমি সুস্থ হয়ে যখন ঢাকায় যাব তখন শামসুর রাহমানের সাথে আবার আমার দেখা হবে। তাই প্রেস, টিভি-খবরটি যে-ই দিক, শামসুর রাহমানের প্রয়াণের খবর আমার কাছে ভয়াবহভাবে অপ্রত্যাশিত। আমি পুরোপুরিভাবে এখনো এই শোক কাটিয়ে উঠতে পারিনি।
আমার মতে, আমি বিশ্বাস করি যে ১৯৪৭ সাল পার হওয়ার পর এই মুহূর্ত পর্যন্ত বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠতম ফসল কবি শামসুর রাহমান। শামসুর রাহমান আমাদের এই দেশে যা কিছু সুন্দর, যা কিছু সুচারু, যা কিছু সংবেদনশীল, যা কিছু মহৎ, যা কিছু শ্রেষ্ঠ তার সবকিছুর এক অসমান্য সমন্বয় ঘটেছিল তাঁর মধ্যে। শামসুর রাহমান সারা বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ২৪, ২০০৮
Leave a Reply