কাছে-দূরে
৪২·
ড· ক্যারল সলোমান পেনসিলভিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ ছেড়ে সিয়াট্লে চলে এসেছে। সেখানে ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনে তার স্বামী রিচার্ড সলোমান ইতিহাসের অধ্যাপক। ক্যারল আপাতত পড়াচ্ছে না, নিজের লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত। আমি কলাম্বিয়াতে আসছি জেনে সে খবর পাঠালো, সিয়াট্লে যেতে হবে এবং ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনে বক্তৃতা দিতে হবে, নিউ ইয়র্ক থেকে সিয়াট্লে আসা-যাওয়ার বিমানভাড়া তারাই দেবে। আমি জানালাম, কলাম্বিয়ার জন্যে প্রবন্ধ লিখতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি, আবার সিয়াট্লের জন্যে লিখব কখন? ক্যারল লিখলো, ওই প্রবন্ধটাই সিয়াট্লে পড়লে চলবে-এখানকার শ্রোতাদের কেউ তো আর কলাম্বিয়ার সেমিনারে উপস্থিত থাকছে না। সমাধান এত সহজ যে দ্বিরুক্তির অবকাশ নেই।
সেইমতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব প্রান্ত থেকে পশ্চিম প্রান্তে চলে এলাম। বিমানবন্দরে রিচার্ড এবং ক্যারল উভয়েই উপস্থিত। আমার ভারী স্যুটকেসটা টানাটানির ভার রিচার্ড নিয়েছেন দেখে লজ্জা পেলাম। টার্মিনাল ভবন থেকে শাট্ল ট্রেনে করে গাড়ি পার্কিংয়ের এলাকায় পৌঁছোনো গেল। রিচার্ডই গাড়ি চালিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন। সেখানেই আমার থাকার ব্যবস্থা। ক্যারলদের দোতলা বাড়ি-আমার জন্যে বরাদ্দ কক্ষটা ওপরতলায়। রিচার্ড সেখানেই আমার স্যুটকেস পৌঁছে দিলেন।
পরদিন ক্যারল আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়-এলাকা ঘুরিয়ে দেখালো। শিক্ষকদের ক্লাবে দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা। সেখানে আমাদের শিকাগো-যুগের বন্ধু ফ্র্যাংকের সঙ্গে দেখা। সে আমার আসবার খবর জানতো, তাই আমাকে দেখে অবাক হয়নি। তবে তার ভালুকোচিত আলিঙ্গনের উষ্ণতায় আমি একটু অবাক হলাম বইকি! ফ্র্যাংক বললো ক্যারলকে, জানো, আনিস আমাকে ডোনার কাবাব খাওয়া শিখিয়েছে! আমি একটু বি্নিত হয়েই প্রশ্ন করি, সে কবে? ফ্র্যাংক বলে, তোমার কিছু মনে নেই-লন্ডনে, ১৯৭৯ সালে।
খেতে খেতে কাচের দেওয়াল দিয়ে বাইরে তাকাই। ক্লাব-ভবনের গা ঘেঁষেই চমৎকার একটি লেক। লেকের অন্য প্রান্তে মনোরম একটি বাড়ি। আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে ফ্র্যাংক বলে, বাড়িটা কার জানো? বিল গেট্সের। আমি বলি, তাহলে আমরা এখানে বসে মিছেমিছি সময় নষ্ট করছি কেন? ‘ভিক্ষা দাও গো’ বলে ওই বাড়ির দরজায় করাঘাত করা যাক।
ফ্র্যাংক বললো, লোকটা আসলে মন্দ নয়। যদি সত্যি সত্যি ওর সামনে গিয়ে হাত পাততে পারো, তাহলে হয়তো খালি হাতে ফিরতে হবে না। তবে তার সামনে যাওয়াটাই সমস্যা। সেজন্যে শক্তিসঞ্চয় করতে হলে আরো এক পাত্র পান করতে হবে।
ক্যারল তার বাড়িতে রাতে খেতে ডেকেছে আরো কয়েকজনকে। তাদের মধ্যে আছে নন্দিনী এবং তার স্বামী ফাহাদ। নন্দিনী ঢাকা বেতারের এককালীন অধিকর্তা জায়নুল আবেদীন এবং আমাদের অনেককালের নূরু আপার কন্যা। ফাহাদ মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানের পুত্র। খাওয়া-দাওয়ার পরে ওরা দুজন আমাকে নিয়ে বেড়াতে বের হলো। সিয়াট্ল পার্বত্য এলাকা। এদিক-ওদিকে বৈদ্যুতিক আলোগুলো জ্বলছে তারার মতো-তবে একই তলে নয়, উঁচুনিচুতে-তাই নক্ষত্রখচিত আকাশের চেয়ে চারপাশটা মনোরম দেখাচ্ছে।
পরদিন আমার প্রবন্ধপাঠ। প্রবন্ধের শিরোনাম বোধহয় ছিল ওনপষয়ময়ী থষন চসলময়মধঢ় মষ ইথষবলথনপঢ়ভ-এই প্রবন্ধটাই কলাম্বিয়ায় পড়েছিলাম (রওনক জাহান-সম্পাদিত বইতে শিরোনাম খানিকটা বদলে দেওয়া হয়েছে, আমার নামের আগেও একটা অনাবশ্যক ‘এম’ এসে জুটেছে)। কলাম্বিয়ার শ্রোতারা ছিলেন দক্ষিণ এশীয় বিদ্যার শিক্ষক ও ছাত্র- আমার বর্ণিত ঘটনার সঙ্গে বেশ খানিকটা পরিচিত। সিয়াট্লে নানা বিদ্যার লোক এসেছেন। ছাত্রদের কেউ কেউ অতি সরল প্রশ্ন করে বসলো, এক স্বনামধন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আমার সঙ্গে তর্ক জুড়ে বসলেন-আমার পক্ষপাত উদ্ঘাটন করাই তাঁর লক্ষ্য বলে মনে হলো। ফেরার পথে রিচার্ডকে বললাম, আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকে সন্তুষ্ট করতে পারিনি। রিচার্ড সারাক্ষণই চুপচাপ ছিলেন। এবারে মুখ খুললেন, তুমি কি এমন কাউকে জানো যে ওঁকে খুশি করতে পেরেছে?
সিয়াট্ল থেকে পরদিন নিউ ইয়র্কে ফিরলাম। জে এফ কে থেকেই টার্মিনাল ভবন বদলে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ ধরে স্বদেশযাত্রা। লাউঞ্জে অপেক্ষা করছি, দেখা হয়ে গেল মাহফুজ আনামের সঙ্গে। কলাম্বিয়ার সেমিনারে যোগ দিতে মাহফুজ নিউ ইয়র্কে এসেছিল আমাদের পরে-এখন ফিরে যাচ্ছে। আমরা একই বিমানের যাত্রী।
ঢাকায় ক্লাস নেওয়ার তাগাদা থাকায় এবারে লন্ডনে থামছি না। হিথরো বিমানবন্দরে অনেকক্ষণ বসে থাকতে তাই বেশি খারাপ লাগছিল। আরো একটা ফ্যাকড়া আছে। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ আমাদের ঢাকা পর্যন্ত নেবে না- ফেলে যাবে দুবাইতে। সেখান থেকে ঢাকায় ফিরতে হবে এমিরেট্সে, তবে দুবাই বিমানবন্দরে থাকতে হবে প্রায় সাত ঘণ্টা।
এতক্ষণ সময় কী করা যায়? আয়েশ করে মুখহাত ধোওয়া হলো, জানলা দিয়ে দোকানের জিনিসপত্র দেখা হলো, কিছু চকোলেটও কেনা হলো। তারপর? মাহফুজ বললো, ‘চলেন, কিছু খেয়ে নেওয়া যাক্।’
বললাম, ‘প্লেনে উঠলেই তো খেতে দেবে।’
মাহফুজের যুক্তি, ‘তার তো অনেক দেরি।’
চীনা খাদ্য দিয়ে নৈশভোজ সারা হলো। খাবার যা আনা হয়েছিল, তার সবটা খাওয়া যায়নি।
খেয়েদেয়ে যথাসময়ে বোর্ডিং কার্ড সংগ্রহ করা হলো। তার অনেকক্ষণ পরে যখন উড়োজাহাজে উঠতে যাচ্ছি, এমিরেট্সের এক কর্মী ‘একটু অপেক্ষা করো’ বলে মাহফুজ আর আমার বোর্ডিং কার্ড নিয়ে কোথায় যেন চলে গেল। ফিরে এলো একজিকিউটিভ ক্লাসের দুটো বোর্ডিং কার্ড নিয়ে এবং মাথা ঝুঁকিয়ে তা আমাদের হাতে সমর্পণ করলো।
জানতে চাইলাম, আমাদের কোন সুকৃতির ফলে এই সমাদর?
তরুণটি মাথা ঝুঁকিয়ে জবাব দিলো, এটা এমিরেট্সের সেবার ধরন। তারপর বললো, দেখা যাচ্ছে, তোমরা নিউ ইয়র্ক থেকে আসছ অনেক পথ পাড়ি দিয়ে। বাকি পথটা একটু আরামে যেতে তোমাদের নিশ্চয় ভালো লাগবে।
আমি বললাম, তুমি তো জানো না আমি সিয়াট্ল থেকে আসছি আরো বেশি পথ পেরিয়ে। জানলে বোধহয় আমাকে ফার্স্ট ক্লাসে বসাতে। তাই না?
৪৩·
নিউ ইয়র্কেই সুগত বসু বলে রেখেছিল, ১৯৯৭ সালের জানুয়ারিতে কলকাতায় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জ্নশতবার্ষিক অনুষ্ঠানে আমাকে যোগ দিতে হবে-লিখিত প্রবন্ধ উপস্থাপন আবশ্যিক নয়, মুখে বললেই চলবে। ঢাকায় ফিরে আসার পরপরই নেতাজী রিসার্চ ব্যুরোর আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ পাওয়া গেল সুগতর বাবা ডা· শিশিরকুমার বসুর স্বাক্ষরে।
শিশিরকুমার বসু খুব নামজাদা শিশুরোগ-বিশেষজ্ঞ। ১৯৪১ সালে যখন তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র, তখন সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তর্ধানের ঘটনাটি ঘটে। শিশির বসুই এলগিন রোডের বাড়ি থেকে গাড়ি চালিয়ে ছদ্মবেশী সুভাষ বসুকে বিহারের গোমো রেলস্টেশনে পৌঁছে দেন-সুভাষ চলে যান পেশোয়ারে এবং সেখান থেকে কাবুল হয়ে মস্কোয়। পুলিশ শিশির বসুকে গ্রেপ্তার করে দিল্লির লাল কেল্লা ও লাহোর দুর্গে দুবছর বন্দি করে রাখে। মুক্তিলাভের পর তিনি কলকাতায় পড়াশোনা শেষ করে ভিয়েনায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি ২০ বছর ধরে কলকাতার ইনসটিটিউট অফ চাইল্ড হেলথের ডিরেক্টর ছিলেন এবং ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্সের একজন প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তিনি অনেক কাজ করেছিলেন। আশির দশকে কংগ্রেসপ্রার্থীরূপে তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হন। পিতা ও পিতৃব্য এবং তাঁদের কাল সম্পর্কে ইংরেজি ও বাংলায় তিনি কয়েকটি বই লিখেছেন, আরো কয়েকটি সম্পাদনা করেছেন। তাঁর স্ত্রী কৃষ্ণা বসুও সুভাষ সম্পর্কে অনেক লিখেছেন। তিনি প্রথমে কংগ্রেস দলের ও পরে তৃণমূল কংগ্রেসের মনোনয়ন লাভ করে লোকসভার সদস্য হন।
সুগত নিজেও কলকাতায় এসেছিল সুভাষ-জ্নশতবার্ষিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। তার সুবাদে ডা· বসু ও কৃষ্ণা বসু আমাকে যথেষ্ট সমাদর করেন। ১৯৭১ সালে শিশির বসুর সঙ্গে আমার সামান্য আলাপ হয়েছিল, সে কথা তাঁকে মনে করিয়ে দিই। তিনি যে তা মনে রাখেননি, তার জন্যে যথেষ্ট লজ্জিত হয়েছিলেন, যদিও অত সামান্য আলাপ মনে রাখার কোনো কারণ ছিল না।
সুভাষের জ্নশতবার্ষিক অনুষ্ঠানে আলোচনার বিষয় সুভাষ ও তাঁর সময়ের রাজনীতিতেই কেবল সীমাবদ্ধ ছিল না, সমকালীন ভারতীয় পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়েছিল। কাশ্মিরের হুররিয়াত কনফারেন্সের তিন প্রতিনিধি এসেছিলেন আবদুল গনি লোনের নেতৃত্বে-তাঁরা কাশ্মিরিদের আত্মনিয়ন্ত্রাধিকার দাবি করেছিলেন এবং সেখানে মানবাধিকার-পরিস্থিতির অবনতির কথা বলেছিলেন। অনেক নামিদামি ব্যক্তির মধ্যে ছিলেন জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা-তিনি ভারতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সমস্যা সম্পর্কে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। আমাদের কালের পরিপ্রেক্ষিত থেকে আমি সুভাষ বসু সম্পর্কে দু-চার কথা বলেছিলাম। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করেছিলাম প্রেসিডেন্সি কলেজে সুভাষের সহপাঠী কাজী আবদুল ওদুদের ‘সুভাষচন্দ্র’ কবিতাটির কথা। দেখলাম, কাজী আবদুল ওদুদের নাম জানলেও তিনি যে সুভাষের সহপাঠী ছিলেন, সে কথা উপস্থিত কেউ জানতেন না এবং তাঁর ওই কবিতাটিও কেউ পড়েননি। শিশির বসুর অনুরোধে পরে তাঁকে আমি কবিতাটি পাঠিয়ে দিই। তিনি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র বসুর বক্তৃতা ও রচনার দুটি সংকলন।
সেবারের অনুষ্ঠানে জগজিৎ সিং অরোরার সঙ্গে আমার খুব সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়ে গেল। অনুষ্ঠানের সকল অংশগ্রহণকারীকে শিশির বসু ক্যালকাটা ক্লাবে নৈশভোজে আপ্যায়িত করেছিলেন। পুরো সময়টা জেনারেল অরোরা এবং আমি এক সোফায় বসে গল্প করে কাটিয়েছিলাম। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করি, ১৯৭১ সম্পর্কে তিনি কিছু লিখলেন না কেন? তিনি মৃদু হেসে বললেন, যুদ্ধে জয়লাভ করলে সে-সাফল্য অনেকে দাবি করে, কিন্তু পরাজিত হলে তার দায় কেউ নিতে চায় না। ১৯৭১ সম্পর্কে অনেকেই তো লিখেছে, আমি আর ভিড় বাড়াই কেন? আমার আমার একাত্তর বইটি তখন প্রকাশের পথে। ১৫-১৬ ডিসেম্বরের কিছু ঘটনা সম্পর্কে আমি তাঁর কাছে জানতে চাই, তিনিও অকপটে উত্তর দেন। কিছুকাল আগে ফুয়াদ চৌধুরীকে জেনারেল অরোরা ক্যামেরায় যে-সাক্ষাৎকার দেন, ফুয়াদ তা আমাকে দেখিয়েছিল। সেখানে তিনি তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন। আমি সে-প্রসঙ্গ উত্থাপন করি। জেনারেল অরোরা আবার তাজউদ্দীনের নানা গুণের কথা বললেন এবং তাঁর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে শোকপ্রকাশ করলেন। তিনি যে লোকসভার নির্বাচনে একবার প্রার্থী হয়েছিলেন, সে-বিষয়ে প্রশ্ন করায় জেনারেল বললেন, আমার কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ছিল না। তবে ইন্দিরা গান্ধির দুর্ভাগ্যজনক হত্যাকাণ্ডের পরে শিখেরা যেভাবে সর্বত্র নিগৃহীত হয়, তার প্রতিবাদে ওই সম্প্রদায়ের একজন হিসেবে একটা ভূমিকা নিতে চেয়েছিলাম। ওই মুহূর্তে নির্বাচনপ্রার্থী হওয়াই তার একটা উপায় বলে মনে হয়েছিল। বিদায় নেওয়ার সময়ে তিনি বেশ আবেগের সঙ্গে আমাকে তাঁর দিল্লির বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালেন।
সুতরাং এর কয়েক মাস পর যখন দিল্লি যাই, তখন জেনারেল অরোরাকে ফোন করি। নাম বলতেই তিনি চিনতে পারলেন এবং তাঁর বাড়িতে যেতে বললেন। তিনি থাকতেন দিল্লির ফ্রেন্ডস কলোনি ইস্টে। নির্ধারিত সময়ে তাঁর ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করে দেখি, তিনি পানীয় সাজিয়ে বসে আছেন। তাঁর স্ত্রী অল্পকাল আগে মারা গেছেন, একটিমাত্র মেয়ে নিজের সংসারে থাকে। এসব বিষয়ে অনেকক্ষণ ধরে কথা হলো। ১৯৭১-এর পর তিনি আর বাংলাদেশে যাননি। ১৯৯৬ সালের বিজয় দিবস বেশ জমকালো করে পালিত হয়েছে, অনেক বিদেশি অতিথি তাতে যোগ দিয়েছিলেন-এসব কথা তিনি শুনেছেন। বাংলাদেশে যে তিনি কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে নিমন্ত্রিত হননি, তার জন্যে একটু দুঃখবোধ হয়তো তাঁর মধ্যে ছিল, কিন্তু আত্মসম্মানজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি যেমন এ ধরনের বোধ নিজের মধ্যেই রেখে দেন, তিনিও সম্ভবত তাই করেছিলেন। আরেকবার দিল্লিতে গেলাম খুশী কবিরের ব্যবস্থাপনায়-সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী একটি সম্মেলনে। রথ দেখা কলা বেচার মতো তখন নিজের স্বাস্থ্য পরীক্ষাও করালাম। সেবারেও জেনারেল অরোরার বাড়িতে যাই, তিনি বলেন, যদি ডা· নিহানকে দেখাই তবে আমি যেন তাঁর উল্লেখ করি।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জেনারেল অরোরাকে বক্তৃতাদানের আমন্ত্রণ জানাবার কথা ভাবছিলেন এর ট্রাস্টিরা। তাঁদের কথায় আমি ঢাকা থেকে তাঁকে ফোন করি। আমার অনুরোধ তিনি সঙ্গে সঙ্গেই গ্রহণ করলেন। ১৯৯৮ সালের মার্চ মাসের সম্ভবত ১৯ তারিখে তিনি ঢাকায় এলেন। অন্যদের সঙ্গে আমিও বিমানবন্দরে তাঁকে অভ্যর্থনা জানালাম। তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয় হোটেল শেরাটনে। রাতে সেখানে আমরা একত্রে খেলাম। ২১ তারিখে জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিক বক্তৃতা। সেখানে লোকে লোকারণ্য। রেহমান সোবহান সভাপতি, আমি স্বাগত ভাষক, জেনারেল অরোরা মূল বক্তা। তিনি বলেছিলেন, ভারতের সাহায্য ছাড়াও বাংলাদেশ স্বাধীন হতো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচেষ্টায়, তবে তাতে সময় লাগত, অনেক বেশি রক্তক্ষয় হতো। জেনারেল অরোরার সঙ্গে আমি গেলাম সাভারে জাতীয় ্নৃতিসৌধে এবং সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে যেখানে তাঁর কাছে পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করেছিল, সেখানে। তিনি সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানালেন, সাভারে পবিত্র দর্শক বইতে মন্তব্য লিপিবদ্ধ করলেন।
জেনারেল অরোরা একটি সরকারি আমন্ত্রণের প্রত্যাশা করছিলেন। তিনি আমাকে খোলাখুলিই বলেন যে, কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়মে তাঁর একটা নিমন্ত্রণ আছে। তবে ২৬ মার্চ যদি ঢাকায় সরকারি অনুষ্ঠানে তিনি আমন্ত্রিত হন, তাহলে তিনি আর সেখানে যাবেন না। আমার মনে হলো, আমাদের স্বাধীনতা-দিবসের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তাঁকে নিমন্ত্রণ করা হবে না। আমি বললাম, আপনার কর্মসূচি আপনি ঠিক রাখুন, এখানে কিছু হলে পরে দেখা যাবে।
অবশ্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ তাঁকে মধ্যাহ্নভোজে আমন্ত্রণ করেছিলেন রাষ্ট্রীয় অতিথি-ভবনে। সেখানে অনেকে এসেছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আসতে দেরি হয়েছিল, তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী যথাসময়ে উপস্থিত ছিলেন। পৌঁছোবার পরও মধ্যাহ্নভোজ শুরু করতে মন্ত্রী দেরি করছিলেন-কারণ তিনি অপেক্ষা করছিলেন শেরে খাজার কন্যার জন্যে। মেয়েটি কমবয়সী ও চঞ্চল, ওই অনুষ্ঠানের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিল বলে মনে হয় না। মন্ত্রীকে অপেক্ষা করতে দেখে প্রতিমন্ত্রীও বিরক্ত হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য মেয়েটি উপস্থিত হওয়ার আগেই ভোজ শুরু হয়েছিল।
একটি নৈশভোজের আয়োজন করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। দলমতনির্বিশেষে তাঁরা এসেছিলেন। ঢাকায় উপস্থিত সকল সেক্টর কম্যান্ডার হাজির ছিলেন। রাষ্ট্রদূত আশরাফ-উদ্-দৌলার মতো আহত মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। এই সন্ধ্যার স্বতঃস্কূর্ততা জেনারেল অরোরার হৃদয় স্পর্শ করেছিল, তা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল।
শেষ পর্যন্ত ২৫ মার্চ তারিখে জেনারেল অরোরা দিল্লি ফিরে গেলেন। এর পরে যখন দিল্লি যাই, তখন তাঁর স্বাস্থ্যের গুরুতর অবনতি হয়েছে। টেলিফোনে কথা শুনতে পাচ্ছেন না বললেন, আমার মনে হলো, তিনি আমাকে চিনতে পারছেন না। (চলবে)
সংশোধনঃ গত কিস্তিতে (১০ অক্টোবর ২০০৮) যাঁকে আঞ্জুমন আরা বলে উল্লেখ করেছি, তিনি নিজের নাম লেখেন আঞ্জু মনোয়ারা।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ২৪, ২০০৮
Leave a Reply