জঙ্ঘাস্থিতে চার দিয়ে দাঁড়িয়ে দেহ যখন উদ্ভিন্ন হয়, তখন মানব শরীরে রূপের বৈচিত্র্য প্রকট হয়ে ওঠে। সব ভুবনের শিল্পীরাই রূপের জন্য পিপাসার্ত। চারুশিল্পীদের কাছে মানুষের দেহই বিশেষভাবে ধ্যানলোক। সেই দেহ তাই যত বেশি বাঁক সৃষ্টি করে দাঁড়াতে পারে, ততই দেখা যায় প্রাণের শিহরণ। কাঙ্ক্ষিত ভঙ্গির প্রয়োজনে শিল্পীরা মডেলকে নানা দেহবল্লরীতে উদ্ভাসিত হতে বলেন। অবশ্য এ ভাবনাটা বিশেষভাবে কাজ করে ভাস্করের মনে। দাঁড়িয়ে থাকা কোনো এক মানবী অথবা মানবী নয়, শুধু এক বিশুদ্ধ গড়নের আকাশমুখিতার কথা মনে থেকে যায় শিল্পী আব্দুর রাজ্জাকের জীবনের পূর্বাপর কাজের দিকে তাকালে। ধানমন্ডির বেঙ্গল গ্যালারিতে চলছে পঞ্চাশের দশকের এই প্রধান শিল্পীর কাজের এক বিরাট প্রদর্শনী।
চিত্রকর ও ভাস্করসত্তা পরস্পরিত হয়ে থাকলেও দুটি লক্ষণের শেষ ফলে আব্দুর রাজ্জাকের কাজে ভাস্কর্যসুলভতারই প্রগাঢ় প্রকাশ থেকে যায়। শিল্পী এই জগৎ সংসারের সহস্র রূপের মধ্যে ঋজুতার ব্যঞ্জনা আর তির্যক গতিকে ঘনিষ্ঠ নয়নে পর্যবেক্ষণ করেছেন।
আব্দুর রাজ্জাকের জ্ন শরীয়তপুরে। নদী-নালা-ডোবা-ঝাড়-জঙ্গলের আদিমতাগন্ধী প্রকৃতির বেষ্টন, এর সঙ্গে পরিণত বয়সে অনতিবিকশিত ঢাকা শহরে এসে নিমনাগরিকতা অনুভব আর তারপর মার্কিন মুলুকে গিয়ে সহসা মহানাগরিকতাকে বিস্কারিত চোখে অবলোকন;-এভাবে চেতনার প্রান্তর আলোকিত হয় শিল্পীর। কর্কটক্রান্তির প্রখর আলোর নাতিশীতোষ্ণ গ্রী্নমণ্ডলীয় দেশের প্রকৃতিতে বসে সতীর্থদের সঙ্গে বাস্তববাদের মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ দিয়ে তার শিল্পার্থী জীবনের শুরু হয়। মণিবন্ধের পটুত্বে চোখের সামনের ছড়ানো প্রকৃতি এঁকে সূচনাপর্বে বি্নয়বোধ প্রকাশের অনুশীলন। প্রধান গুরু তাদের জয়নুল আবেদিন। তাই বারবার তুলিতে নদীর ছলাৎ ছলাৎ শোনা যায়। বৈশাখী ঝড়ে গাছ আর বাতাসের ঝালাপালা এবং আরও অনেক গীতিনাট্য মৌসুমি হাওয়ার নিত্য পরিবর্তনশীল ষড়ঋতুর দেশে নাটকের কি আর শেষ আছে! সতীর্থ তার আমিনুল, কাইয়ুম, রশিদ, মুর্তজা-সব আধুনিকতার মিছিলের প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে। একই কাফেলার যাত্রী হলেও তপোভূমি তাদের এক নয়, মনোভূমি তো আরও এক নয়। জয়নুলে আস্থা নেই কারও। কিন্তু যাদের আস্থা আছে তাদের একজন রাজ্জাক। জঙ্গম প্রকৃতির মধ্যে তার বিশেষভাবে ভালো লাগে বৃক্ষ। কেননা, বৃক্ষ সমতলের বিপরীতে দাঁড়িয়ে উজানির খেয়াল গায়। কাণ্ডের প্রকাণ্ড উত্থান, শাখা-প্রশাখাময়তার মধ্যে যে বিপুলতার সংগঠন, এসব শিল্পীকে আকর্ষণ করে। এর সঙ্গে কৃষি-বাংলার মানুষের প্রাণবান্ধব প্রাণী গরুর দেহ সংস্থান এবং গরু ও কৃষকের সমন্বিত প্রয়াসে ফসল ফলানোর নানা আয়োজন জয়নুল-শিষ্য রাজ্জাককেও প্রাণিত করে। আর নদী যখন বাংলার মাটি খুঁড়ে গান গায়, সেই জলও তাকে আনত হতে বলেছে। আকাশের মেঘও তাকে রূপ ভুলে অরূপের দেশে যাওয়ার বার্তা পাঠিয়েছে। এসবের পরও রাজ্জাক ছায়ার প্রপঞ্চে নয়, কায়ার নিরাবরণ রূপের স্পর্শ চেয়েছেন। স্বপ্রজ্নের শিল্পীদের মধ্যে যারা জলরঙের তুলিতে বাংলার নিসর্গ ও কৃষিজীবন এঁকেছেন, তাদের মধ্যে রাজ্জাক রঙের তারল্যের ধোঁয়াসে আবরণ ভেদ করে দৃঢ়রেখার জ্যামিতি উজিয়ে দিয়েছেন। গড়নের জ্যামিতিক বাঁধুনির মধ্যে বিন্যাসের সুন্দরকে দেখেছেন তিনি। এভাবে তিনি মহাজাগতিক প্রেক্ষাপটে বস্তুর অবস্থিতি বিবেচনা করেছেন। গতিশীল বস্তুর মধ্যে বেগের বিশেষ রূপ ও ছন্দ আছে। রাজ্জাকের সৃজনের সারসংক্ষেপ করে যদি বলা হয় যে তিনি এই বস্তুপৃথিবীর ছন্দ নানা তাল-মাত্রায় অনুভব করেছেন, তা হলে অসংগত শোনায় না। স্পেসকে তিনি কালো ও আলো দিয়ে কেটেছেন। অনুষঙ্গ ও অনুষঙ্গের শূন্যতার মধ্যে মালা গেঁথেছেন। ছন্দময়তা থেকে পুরো কাজে অখণ্ডতার আবেশ তৈরি হয়েছে। সাদা-কালোর বিন্যাসের হার্মনিটা বিশেষ করে বোঝা যায় তার উডকাটে।
জল রং, তেল রং, অ্যাক্রিলিক, এচিংয়ের নানা প্রক্রিয়া, লিথোগ্রাফ, ভাস্কর্য-এত সব মাধ্যমে কাজ করেছেন রাজ্জাক। আয়তন, আনুপাতিক বণ্টন, ভর, মাধ্যাকর্ষণের টান -এসব নিরীক্ষকের চোখে তাকে বুঝতে হয়েছে। ভাস্কর্য গড়তে গেলে এসবের জ্ঞান অর্জন করতে হয়। মানুষের অস্তিত্বে একাধিক সৃজনসত্তা থাকতে পারে। কিন্তু সেই সত্তা কি তাকে দ্বিখণ্ডিত করে রাখতে পারে? রাজ্জাকের ভাস্করসত্তা ও চিত্রকরসত্তা পরস্পরকে ভেদ করেছে। এই মিথস্ক্রিয়ায় ঋজুতাকে আলিঙ্গন করেছেন শিল্পী। উত্থিত গড়ন, তা হোক মানুষ কিংবা বৃক্ষ অথবা স্তম্ভপ্রতিম কোনো বিষয়, তাতেই তার আরাধনা দানা বেঁধেছে। তার সমকালের সব শিল্পীর চেয়ে তিনি বেশি মানুষের মুখ এঁকেছেন ও গড়েছেন। শুধু প্রতিকৃতিচিত্র দিয়েও রাজ্জাকের একটা বিশেষ প্রদর্শনী হতে পারত। নিজের মুখ, স্ত্রী-পুত্র-কন্যার, গুরুর ও সহপাঠীদের মুখ তার শিল্পভাবনায় অনুরণন তুলেছিল। দ্বিতল জমিনের মুখকে তিনি ভাস্করপর্বের জীবনে সিমেন্টে, তামায়, লোহায় নতুন করে নির্মাণ করেছেন। আমার মনে হয়েছে, মানুষের মুখের মায়াকে মাপতে গিয়েই রাজ্জাক ভাস্কর্য মাধ্যমে সৃষ্টির পূর্ণতা খুঁজেছেন। ইলিউশন বা বিভ্রমের বিপ্রতীপে তিনি যে স্বচ্ছ এলাকাটা বেছে নিয়েছেন, তাতে ত্রিমাত্রার ভাস্কর্য তাকে গন্তব্যে পৌঁছানোর স্বস্তি দিয়েছেন। কংক্রিট ও ধাতব শরীর ছুঁয়ে-ছেনে তিনি বস্তুসার বা পরিণামে প্রাণময় কোনো দেহকেই রক্তজ উষ্ণতায় চনমনিয়ে বুঝেছেন। খরবেগ, উজান টান, খাড়া উত্থানে প্রাণশক্তির দুর্মর সংকেত যুক্ত রয়েছে। তিনি ধাতব পাতের অমসৃণ ত্বক ও জ্যামিতিক গড়নগুলো পরস্পরিত করে ক্যাকটাসের ভাস্কর্য রচনা করেছেন, কাঠের উপরিতলের সুচিক্কণ ত্বক ছিঁড়ে ভেতরের খড়খড়ে তলটা প্রদর্শন করে বিমূর্তের জ্যামিতিকে আরও শোধিত করেছেন। মেশিনের কলকব্জার জড়াজড়ির মধ্যে ছন্দ প্রদর্শন করেছেন।
রাজ্জাকে গতির জায়মান অবস্থা বিধৃত রয়েছে। স্থির, অচঞ্চল হিমায়িত কোনো ভঙ্গিতে এ ভাস্করের তৃপ্তি নেই। তিনি তার কালের আরেক প্রধান ভাস্কর নভেরার মতো মুর বা বারবারা হেপওয়ার্মের শিল্পভাষার দিকে তাকিয়ে সৃজনের পথ খুঁজে পাননি। রুমানিয়ান ব্রকুজি অবশ্যই তার কাজকে নির্মাণের ইশারা দিয়েছে। বেগের তোড়ে পাখি বা মানুষের প্রত্যঙ্গ যেন শক্তিপিণ্ড হয়ে ছুটেছে। বিপরীত ভাবনাটাও সক্রিয় রয়েছে। বস্তুপিণ্ড পাখির মতো ডানা মেলে বা মানবিক প্রত্যঙ্গ বিস্তার করে। রাজ্জাকের শিল্প দেখার পর গতির গতায়ত সংবেদী মন আবিষ্ট করে রাখে।
মইনুদ্দীন খালেদ
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ২৪, ২০০৮
Leave a Reply