কামুক কৈলাস কোলে অলকা সুন্দরী।
জানিতে পারিবে তারে নিরীক্ষণ করি।।
নিতম্বে স্খলিত তার গঙ্গারূপ শাটী।
হইয়াছে তাহে কিবা শোভা পরিপাটি।।
অম্বুদ অলকাজাল অলকার ভালে।
কামিনী-কবরী যেন বেড়া-মুক্তাজালে।। (৬৫)
দেখিবে হে মেঘ সেই অলকা নগরে।
তব সম যথা সুরপুর পরিকরে।।
বিরাজিত সুরূপসী সুরবালাগণ।
তব প্রিয়া সৌদামিনী স্বরূপ লক্ষণ।।
আর তব ইন্দ্রধনু ভূষণ সমান।
সুবিচিত্র নানা চিত্র তথা বিদ্যমান।।
আর যথা তব অঙ্গে নানা রঙ্গসাজে।
সেরূপ বিবিধ নিধি তথায় বিরাজে।।
আর তব দৃশ স্নিগ্ধ গম্ভীর নিস্বনে।
হতেছে সঙ্গীত বাদ্য অমর ভবনে।। (৬৬)
করকমলেতে শোভে লীলা শতদল।
নবকুন্দ কলি গাথা অলক কুন্তল।।
লোধ্র কুসুমের রজে ভূষিত আনন।
কবরী কলিত কুরুবকে বিমোহন।।
কোমল শিরীষ যুগ শ্রুতিমূলে দোলে।
সুশোভিত নব নীপ সীমন্তের কোলে।।[১] (৬৭)
যথা সিতমণিময়[২] রম্য হর্ম্ম্যচয়।
নক্ষত্র স্বরূপ নানা কুসুম উদয়।।
যক্ষগণ সঙ্গে লয়ে সুচারু তরুণী।
পান করে কল্পতরু প্রসূত বারুণী।।
রতিরস বৃদ্ধি তাহে গীত বাদ্য সহ।
গুরু গরজন যেন করে বারিবহ।। (৬৮)
যথা ভানুদয়ে প্রকাশিত সেই পথ।
যে পথে নিশায় নারী সাধে মনোরথ।।
করিতে চঞ্চল পদে তথা গতায়াত।
পতিত কবরী হতে পুষ্প পারিজাত।।
কর্ণ হতে পড়িয়াছে কনক কমল !
স্তনভরে হার ছিঁড়ে ভ্রষ্ট মুক্তাফল।।
কোথা বা পতিত কেশগুচ্ছ ছিন্ন হয়ে।
জানিবে অলকাপুরী এই চিহ্ন চয়ে।। (৬৯)
যথা বক্ষ স্বেচ্ছাধীন অনিভৃত করে।
নীবিবন্ধ শ্লথ করি প্রিয়াবাস হরে।।
নিবিড় নিতম্বধরা ললনা নিচয়।
লজ্জা ভয়ে কার্য্যাকার্য্য জ্ঞান শূন্য হয়।।
পুরোভাগে রত্নদীপ জ্বলে ধক্ ধক্।
তাহে চূর্ণ মুষ্টিক্ষেপ করে অনর্থক।। (৭০)
তোমার সদৃশ যথা জলধর কত।
উর্দ্ধগামী সমীরণে হয়ে সমুদ্গত।।
অট্টালিকা উপরেতে করি আরোহণ।
খণ্ড খণ্ড হয়ে করে বিন্দু বরিষণ।।
ভিত্তিস্থিত চিত্রচয়ে দোষ ঘটে তায়।
ধূম প্রায় তাই ভয়ে গবাক্ষে পলায়।। (৭১)
যথা প্রিয়তম ভূজে হয়ে উত্থাপিতা।
আলিঙ্গিতা বরবালা বিনোদে ব্যথিতা।।
তোমার অভাবে স্নিগ্ধ সুধাকর করে।
সুরত জনিত সেই গ্লানি দূর করে।।
শান্ত হয় চন্দ্রকান্ত[৩] রস পরশিয়া।
অথবা বেদনা হরে দোলায় বসিয়া।। (৭২)
যথা ধনেশের সখা মহেশের ডরে।
ভৃঙ্গ শ্রেণী গুণ ধনু অতনু না ধরে।।
কেবল কামিনীকুল বিলাস বিভ্রমে।
মদনের মনোরথ সিদ্ধ যথাক্রমে।।
ভুরুচাপ কটাক্ষে কামের খরশর।
কেমনে পাইবে ত্রাণ কামুক নিকর।। (৭৩)
ধনপতি পুরোত্তরে আমার আগার।
ইন্দ্রধনু প্রায় চারু তোরণ[৪] তাহার।।
দূরে থেকে দেখিতে পাইবে সেই দ্বার।
পুরোদ্যানে আছে এক কুমার মন্দার।।
কৃত্রিম তনয় সম পালিলেন প্রিয়া।
করলভ্য গুচ্ছ তার পড়েছে নামিয়া।। (৭৪)
উপবনে আছে এক বাপী বিদ্যমান।
মরকত মণি বাঁধা তাহার সোপান।।
তাহে মুকুলিত কত কনক কমল।
বৈদুর্য্য মৃণালে কিবা করে ঢল ঢল।।
তার নীরে বাস করে রাজহংস চয়
হে নীরদ ! নিরখিয়ে তোমার উদয়।।
অদূরেতে মানস সরসী সুপ্রকাশ।
আর কি করিবে তথা যেতে অভিলাষ।। (৭৫)
তার তীরে চিত্র গৃহ শোভে মনোহর।
ইন্দ্রনীল[৫] রত্নে যার রচিত শিখর।।
চারি ধারে চারু তরু কনক কদলী।
মম প্রেয়সীর সেই অতি প্রিয়স্থলী।।
তোমার স্বরূপ সেই ক্রীড়া শৈলবর।[৬]
সৌদামিনী শোভা ধরে কদলী নিকর।। (৭৬)
লোহিত অশোক[৭] সুচঞ্চল নবদলে।
আর আছে কেশর[৮] শোভিত সেই স্থলে।।
নিকটে বিলাস গৃহ মাধবী মণ্ডিত।
করুবক[৯] ঝাড়ে ঘেরা তারি চার ভিত।।
মম সহ প্রিয়া বাম পদ[১০] এক আশা।
অপরেতে তাঁর মুখ মদিরা পিপাসা।। (৭৭)
হেমদণ্ড আছে সেই তরুযুগ মাঝে।
কাঁচা বাঁশ সম মণি মূলে তার সাজে।।
স্ফটিক ফলক তার অতি শোভাকর।
তব প্রিয়া নীলকণ্ঠ কলাপী নিকর।।
তদুপরি নৃত্য করে দিবা অবসানে।
মম প্রিয়া রণৎকারী বলয়ের তানে।। (৭৮)
ওহে সাধু ! নিরখিয়া এই চিহ্ন হয়।
নিশ্চয় জানিবে তুমি আমার আলয়।।
দ্বার পাশে লেখা আছে শঙ্খ শতদল।
আমার বিরহে শোভা শূন্য গৃহস্থল।।
স্বীয় প্রিয় মিত্র মিত্র অভাবে যেমন।
কমলিনী শোভা কভু না করে ধারণ।।
প্রিয়াত্রাণ হেতু সেই রম্য সানুপরি। (৭৯)
বসিও হে ক্ষুদ্র করি শিশুরূপ ধরি।।
তড়িৎ প্রকাশে মৃদু মেলিত নয়নে।
নিরখিবে অঙ্গনারে পতিত অঙ্গনে।।
নাহিক সে রূপপ্রভা বিরহে আমার।
জ্যোতিরিঙ্গণের শ্রেণী স্বরূপ আকার।। (৮০)
হীরকদশনা তন্বী পক্ক বিম্বাধরা।
শ্যামা[১১] মধ্যক্ষামা নিম্ননাভি মনোহরা।।
চকিত হরিণী প্রায় চঞ্চল নয়না।
নিবিড় নিতম্ব ভরে মন্থর গমনা।।
স্তনভারে আছে দেহ স্তোক নম্র হয়ে।
বিধিআদ্য সৃষ্টি তিনি যুবতী বিষয়ে।। (৮১)
জানিতে পারিবে সেই মিত ভাষিনীরে।
দ্বিতীয় জীবন প্রিয় আমার শরীরে।।
চির বিরহেতে বালা বিশেষ বিকলা।
নাথহীনা চক্রবাকী যেরূপ চঞ্চলা।।
শিশির পতনে শীর্ণা যেরূপ নলিনী।
এখন প্রেয়সী মম সেরূপ মলিনী।। (৮২)
অনুমানে এই বুঝি ওহে কামচর।
দুর্দ্দিনেতে দীন যথা হন নিশাকর।।
সেইরূপ ম্লান তাঁর মুখ শশধর।
আলুয়িত সুদীর্ঘ অলক তদুপর।।
রোদনে রোদনে স্থূল নয়ন যুগল।
চন্দ্রাননে সদা সমর্পিত করতল।।
অশীতল নিঃশ্বাসে নীরস বিম্বাধর।
হইয়াছে এখন বিভিন্ন বর্ণধর।। (৮৩)
এইরূপ অবস্থায় দেখিবে তাহারে।
অথবা ব্যাকুলা বালা পূজার আগারে।।
অথবা বিরহে মম তনু তনুতর।
লিখিছেন প্রতিকৃতি ফলক উপর।।
অথবা পিঞ্জর স্থিতা সারিকার প্রতি।
করিছেন এই প্রশ্ন প্রিয়ম্বদা সতী।।
তুমি লো তাঁহার প্রিয়া ছিলে বিলক্ষণ।
নিভৃতে বসিয়া তাঁরে স্মর কি এখন ? (৮৪)
ওহে সৌম্য ! আর এই করি অনুমান।
বিরচিত করি মম নামাঙ্কিত গান।।
বীণা লয়ে কোলে, প্রিয়া, মদন বিহ্বলে।
মাজিয়ে তাহার তার নয়নের জলে।।
ব্যাকুলা বণিতা বসি মলিন দুকূলে।
বার বার স্বকৃত মূর্চ্ছনা যায় ভুলে।। (৮৫)
অথবা দেহলী[১২] মুক্ত কুসুম দর্শনে।
শাপান্তের শেষ মাস দিন দিন গণে।।
ঝরিল কুসুম এক করে অনুমান।
এই একমাস কাল হলো অবসান।।
এই ফিরে আইলেন মম প্রাণ পতি।
এই সংমিলনে হল্যো তাহার সংহতি।।
এইরূপ হৃদয়েতে করিয়া কল্পনা।
বিরহে বিনোদ লভে ললিত ললনা।। (৮৬)
গৃহ কার্য্যে কুলবধূ দিনগত করে।
ক্ষণদা যাতনা প্রদা অতি তার তরে।।
অতএব বাতায়নে অবস্থিত হয়ে।
মম বার্ত্তা আলাপিয়া নিশীথ সময়ে।।
প্রবোধিবে সেই তব ভাতৃ বণিতায়।
ধরাসন শ্বেতা সাধ্বী নিদ্রা নাহি যায়।। (৮৭)
এবে কৃশ তনু কান্তা বিষম বিয়োগে।
পূর্ব্বে মম সহ ইচ্ছা সুরত সম্ভোগে।।
ক্ষণপ্রায় ক্ষণদায় পরিতেন বোধ।
এবে উষ্ণ অশ্রুজলে নেত্রপথ রোধ।।
বিরহ শয্যায় এক পাশে নিপতিতা।
শেষ শশীকলা যথা প্রচীতে উদিতা।। (৮৮)
দুঃখে দীর্ঘশ্বাস বহে তাম্রাধর দলে।
উড়াইয়া দেয় তায় অলক কুন্তলে।।
রুক্ষ স্নানে কেশজাল হয়ে অচিক্কণ।
যুগল কপোলে প্রলম্বিত অনুক্ষণ।।
স্বপ্নে মম সহ সংমিলন ইচ্ছা করি।
নিদ্রা যেতে অভিলাষ করেন সুন্দরী।।
কেমনে প্রবেশ নিদ্রা করিবে নয়নে।
সদা অবরুদ্ধ আঁখি অশ্রু বিসর্জনে।। (৮৯)
বেঁধে দিব পুনঃ কেশ শাপ অবসরে।
ইতে শোকগতা আদ্য বিরহ বাসরে।।
একবেণী বদ্ধ করি রেখেছেন প্রিয়া।
আছে সেই বেণী গণ্ডস্থল সমাশ্রিয়া।।
নিরলক্ত নখরে উৎক্ষিপ্ত অনিবার।
চিকুরের চারু চিকণতা নাহি আর।। (৯০)
গবাক্ষে শীতল শশী কিরণ সঙ্কাশ।
পূর্ব্বরীতি হেতু দেখিবার অভিলাষ।।
নিরখিতে নয়নে শোকাশ্রু ধারা বয়।
অমনি মুদেন গুরু আর্দ্র পক্ষ্মদ্বয়।।
ওহে সখে ! দেখ গিয়ে প্রিয়া সন্নিধান।
মেঘাচ্ছন্ন দনে স্থল নলিনী সমান।।
নহেন জাগ্রত প্রিয়া নহেন নিদ্রিত।
যথা সে নলিনী নহে ফুল্ল কি মুদিত।। (৯১)
নাহিক সুন্দর দেহে কোন অলঙ্কার।
শয্যাতলে অস্থির শরীর অনিবার।।
দারুণ বিরহ ব্যথা সে দেহে কি সয় ?
শয়নেতে যাতনা কখন গত হয়।।
দেখি অশ্রুপাত তব হবে ঘন ঘন।
করুণায় আর্দ্র সদা হন সাধুগণ।। (৯২)
ওহে সখা ! এম করোনা তুমি মনে।
বাচালতা করিতেছি তোমার সদনে।।
প্রথম বিরহে বালা বিধুরা হইয়া।
আমাতে আছেন স্নেহে চিত্ত সমর্পিয়া।।
করিলাম যেইরূপ অবস্থা বর্ণন।
সেইরূপ অবিকল করিবে দর্শন।। (৯৩)
তাঁহার সমীপে তুমি হইলে উদয়।
মীন উদ্ঘাটনে যথা কাঁপে কুবলয়।।
সেইরূপ মম দারা নয়ন যুগল।
পুনঃ পুনঃ স্পন্দমান হবে অনর্গল।।
আলুয়িত লম্বিত চিকুরে সে নয়ন।
অপাঙ্গে রঙ্গহীন হয়েছে এখন।।
অঞ্জন বিরহে এবে পাইবে প্রকাশ।
অধুনা নাহিক তাহে ভ্রুভঙ্গি বিলাস।। (৯৪)
হে নীরদ ! তোমারে করিয়ে নিরীক্ষণ।
চারু বাম উরু তাঁর করিবে স্পন্দন।।
কনক কদলীসম গুরু গৌরতর।
মুক্তামালে শোভিত থাকিত নিরন্তর।।
এখন অঙ্কিত নহে আমার নখরে।
সুরতান্তে সম্বাহিত নহে মম করে।। (৯৫)
নিদ্রিতা থাকেন যদি এমন সময়ে।
এক যাম থাকিও হে রবশূন্য হয়ে।।
তোমার নিনাদে নিদ্রা হইবে বিগত।
তাহে প্রিয়া পাইবেন মনোদুঃখ কত।।
মমভুজে বাঁধা যদি থাকেন স্বপনে।
সে বন্ধনচ্যুত হবে তোমার গর্জ্জনে।। (৯৬)
বরষিয়ে বারিবিন্দু শীতল সমীরে।
তারপর উঠাইয়ে দিও প্রেয়সীরে।।
বাতায়নে বসি ধীর ধীর বিঘোষণে।
তুষিও তাঁহারে তুমি সুখ সম্ভাষণে।।
চঞ্চলা দর্শনে তাঁর নয়ন চঞ্চল।
আশ্বাসের স্থল নব মালতী কেবল।। (৯৭)
কবে – “ওহে অবিধবে ! করি নিবেদন।
আমি মেঘ, আসিয়াছি তোমার সদন।।
যেই মেঘ প্রবাসী পুরুষে দেয় ত্বরা।
বাঁধিবারে বনিতার বেণী মনোহরা।।
পথশ্রমে যদি কোথা করে অবস্থান।
স্নিগ্ধ মন্দ্রস্বরে করে উপদেশ দান।।” (৯৮)
শুনিয়ে তোমার কথা অতি সাবধানে।
সম্ভাষণা করিবেন বিহিত বিধানে।।
মারুতীর কথা যথা শুনিলেন সীতা।
সেইরূপ হইবেন অতি ব্যগ্র চিতা।।
পতিবার্ত্তা শুনি সতী পতিবন্ধু মুখে।
মুগ্ধ হয় কথঞ্চিত সংমিলন সুখে।। (৯৯)
ওহে আয়ুষ্মান্ ! মম মঙ্গল উদ্দেশে।
বলিও হে এই সমাচার সবিশেষে।।
হে অবলে, রামগিরি আশ্রম উপর।
জীবিত আছেন তব জীবিত-ঈশ্বর।।
মৃত্যুমুখে পতিত যদিচ জীবগণ।
তথাপিও এই বাক্য আশ্বাস বন্ধন।। (১০০)
বলিবে হে – “তব নাথ ক্ষীণ কলেবর।
গাঢ় তাপে তপ্ত উৎকণ্ঠিত নিরন্তর।।
দরদর ধারা বরষিছে দু’নয়ন।
সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস প্রবাহিত অনুক্ষণ।।
বৈরি বিধিকৃত হয়ে বঞ্চিত বিশেষ।
মানসে তোমার দেহে করিছে প্রবেশ।।[১৩]
(১০১)
পরশিতে তোমার ও বদন কমল।
একদা সঙ্গিনী মাঝে হইয়ে বিকল।।
তব কানে কানে কথা কহিল যে জন।
শ্রবণ নয়ন পথ অন্তরে এখন।।
প্রবাসে যে সব পদ করিল রচনা।
মম মুখে সে সকল শুন সুলোচনা।। (১০২)
হে মানিনি ! কেমনে সে ভুলিবে তোমারে !
যথা তথা তব রূপ স্বরূপ নেহারে।।
অঙ্গের বলনী তব, শ্যামা লতিকায়।
চঞ্চল অপাঙ্গ ভঙ্গী কুরঙ্গী দেখায়।।
কপোলের প্রভা শশী কিরণে প্রকাশ।
কলাপী কলাপে হেরে তব কেশপাশ।।
তটিনীর মৃদুতরে তরঙ্গ উচ্ছ্বাস।
তাহাতে নিরখে তব ভুরুর বিলাস।। (১০৩)
ধারাসিক্ত ভূমি প্রায় পরিমল যুত।
তব মুখ অন্তরে এখন দূরীভূত।।
বিরহ অনলে তনু একে তনুতর।
তাহে আরো ক্ষীণকরে পঞ্চশর শর।।
নিদাঘ অত্যয়ে নব নীরদ নিকর।
দশদিক আঁধার করিবে ঘোরতর।।
দিনকর কর তাহে হইলে বিলীন।
কেমনে কাটিবে সেই বরষার দিন।। (১০৪)
কোপভরে অরুণিত তব কলেবর।
গিরি মৃত্তিকায় লিখি শিলার উপর।।
পদতলে পড়িবার যবে ইচ্ছা করে।
দৃষ্টি পথ রোধ হয় অশ্রুজল ভরে।।
হায় কাল কৃতান্ত কি নির্দয় হৃদয়।
প্রতিকৃতি সহ সঙ্গ, তাও সহ্য নয়।। (১০৫)
স্বপনে তোমার রূপ করি দরশন।
গাঢ় আলিঙ্গন হেতু করি আকুঞ্চন।।
অম্বরে ওঠাই যবে বাহুলতাদ্বয়।
দেখি দশা বনদেবতার দয়া হয়।।
হিমবিন্দুছলে তরু কিশলয়োপরে।
মুক্তাফল সমস্থূল অশ্রুপাত করে।। (১০৬)
দেবদারু[১৪] পত্রচারু করিয়ে ভঞ্জন।
মোদিত তাহার ক্ষীর গন্ধে প্রভঞ্জন।।
হিমালয় পরিহরি বহিলে দক্ষিণে।
আলিঙ্গন করে তারে এই আশাধীনে।।
যদি কভু প্রেয়সীর রুচির শরীর।
পরশিয়ে থাকে সেই শীতল সমীর।। (১০৭)
তোমার বিরহে ওহে চঞ্চল নয়নে।
নিয়ত ব্যথিত চিত্ত দহে অনুক্ষণে।।
নিরুপায়ে করে কত দুর্লভ কামনা।
দীর্ঘযামা ত্রিযামা হউক স্বল্পক্ষণা।।
পূর্ব্বাহ্ন, মধ্যাহ্ন আর সায়াহ্ন সময়।
মন্দ মন্দ তাপযুক্ত যেন তারা হয়।। (১০৮)
আর তাঁরে একথা বলিও জলধর।
এইরূপ চিন্তা আমি করি নিরন্তর।।
ধৈর্য্য ধরিলাম শেষে আপনা আপনি।
অতএব কাতর না হন যেন ধনী।।
চিরদিন সুখ দুঃখ না থাকে কাহার।
রথচক্র সম উচনীচ বারম্বার।। (১০৯)
শের শয্যা হরি[১৫] হরি করিলে উত্থান।
আমার এ অভিশাপ হবে অন্তর্ধান।।
কোনরূপে বরাননে মুদিয়া নয়ন।
এই চারিমাস কাল করহে ক্ষেপণ।।
অনন্তর শারদীয় শশাঙ্ক কিরণে।
বিরহ বসনা যত পুরাব দু’জনে।। (১১০)
একদা আমার কোলে দেখিয়ে স্বপন।
জাগিয়া উঠিলে তুমি করিয়ে রোদন।।
কেন কেন বলি আমি জিজ্ঞাসিলে পরে।
বলেছিলে মৃদু মৃদু সহাস্য অধরে।।
ওরে ধূর্ত্ত ! করিলাম স্বপনে দর্শন।
রমিলে রমণ পর রমণীর মন।। (১১১)
বলো – হে অসিত নেত্রে ! কুলমান ভরে।
অবিশ্বাস করিওনা এই জলধরে।।
কহিলাম যেই গুপ্ত কথা রসময়।
ইথে আমি হিতকারী জানিহ নিশ্চয়।।
যেহেতু বিরহ ঘোরে শুধু স্নেহবশে।
বচনীয় নহে হেন কোন ভুক্ত রসে।।
পুনরায় নয়নগোচর যদি করে।
প্রণয় প্রবাহ বহে প্রেমিক অন্তরে।। (১১২)
ওহে সৌম্য ! তোমারে নিরখি নিরুত্তর।
আশ্বাসিত হইতেছে আমার অন্তর।।
যাচক চাতকে দেহ নীরবেতে জল।
সেরূপ বাসনা মম করিবে সফল।।
বন্ধু প্রতি সাধুদের এই ব্যবহার।
প্রত্যুত্তর দান করে করি উপকার।। (১১৩)
স্নেহ হেতু বন্ধু কার্য্য করি সমাধান।
কিম্বা মম দুঃখ দেখি করি কৃপাদান।।
পরে বরষার শোভা ধরি বিমোহন।
বাঞ্ছনীয় দেশে তুমি করিও গমন।।
নিরন্তর সুখে থাক সৌদামিনী সহ।
আমার স্বরূপ যেন না হয় বিরহ।। (১১৪)
————————————
টীকা
1. এই কবিতায় মহাকবি ষড়ঋতু জাত ভিন্ন ভিন্ন ছয়টি পুষ্পের উল্লেখ করিয়াছেন। যথা :- পদ্ম, কুন্দ, লোধ্র, কুরুবক, শিরীষ এবং নীপ। পদ্ম শারদীয় ; কুন্দ হৈমন্তিক ; লোধ্র শিশির সাময়িক ; কুরুবক বাসন্তীয় ; শিরীষ নৈদাঘ কালীয় এবং নীপ প্রাবৃষেণ্য। ইহাতে নৈসর্গের বিরোধ উপস্থিত হইতে পারে ; এক ঋতু প্রভাব সময়ে ছয় ঋতু জাত বিভিন্ন কুসুম কলাপ সম্ভবে না , কিন্তু অলকাপুরী মনুষ্যলোক নহে। মনুষ্য লোকের নিসর্গ সহ অলকা প্রভৃতি দিব্য লোকের নিসর্গের একতা হইতে পারে না। মহাকবি মিলটন প্যারাডিস বর্ণনায় এইরূপ নিসর্গ-বিরোধ বর্ণন করিয়াছেন। যথা :- “The rose without thorn” etc ফলতঃ মহাকবিগণ নিসর্গ প্রেমিক হইলেও কখ তাহার অসদ্ভাব স্থলে সদ্ভাব সংস্থান করিয়া দেন। সুন্দরী স্ত্রী বর্ণনায় তাহাকে সর্ব্বাঙ্গ শুদ্ধ করিয়া থাকেন কিন্তু সর্ব্বাঙ্গ সুন্দরী স্ত্রী কোথায়?
2. এ স্থলে সিতমণি যে শ্বেত মার্ব্বেলের উদ্দেশ্য তাহার আর সন্দেহ নাই। হোরেস হেমান উইলসন মহোদয় এরূপ নিষ্পন্ন করিয়াছেন মার্ব্বেলের সংস্কৃত নাম রত্নশীলা। মার্ব্বেল প্রস্তরে যে পূর্ব্বে প্রাসাদাদি প্রস্তুত হইত ; ভারতবর্ষের নানা স্থানে ইহার প্রমাণ প্রান্ত হইয়া গিয়াছে, বিশেষত উক্ত বহুমূল্য শিলা মধ্য-দেশের বিস্তর পর্ব্বতে পাওয়া যায়।
3. চন্দ্রকান্ত মণির বর্ত্তমান নাম নির্ণয় করা কঠিন। ডাক্তার কেরী স্বীয় কোষমধ্যে সন্দেহ ক্রমে লিখিয়াছেন ইহা জাস্পার (Gasper) হইতে পারে। জাস্পরকে পারস্য প্রভৃতি দেশে য়াম্পিন কহে। কবির লিখন ভঙ্গীতে বোধ হইতেছে; তাহাতে রস নির্গত হইত। মণি জাতি মধ্যে এবম্প্রকার কোন রত্ন আছে কিনা মণিবেত্তাগণের অনুসন্ধেয়।
4. ↑ ভারতবর্ষে পুরাকালীন অট্টালিকা নিকরে যে অর্দ্ধ অর্কাকার খিলান গ্রথিত হইত ; উপরি উক্ত কবিতায় তাহার প্রমাণ প্রাপ্ত হইতেছে।
5. কোন বঙ্গাভিধানে ইন্দ্রনীলের অর্থে পান্না লিখিত আছে। ফলতঃ ইন্দ্রনীল মণি পান্না নহে। মণিকারেরা ইহাকে ফিরোজা কহে। ইহা নির্ম্মল আকাশের ন্যায় নীল বর্ণধর। পান্নার সংস্কৃত নাম মরকত এবং বৈদুর্য্য।
6. ক্রীড়াশৈল পর্য্যায়ে হড্ডচন্দ্র লেখেন, – “ক্রীড়া শৈলশ্চিত্র গৃহে সুরালিপ্ত গৃহান্তর”। ইহাতেই এবম্প্রকার স্থলের প্রয়োজনীয়তা এবং রমণীয়তা অনুভূত হইবে। আধুনিক ইউরোপীয়দিগের ন্যায় পূর্ব্বতন কালে ভারতবর্ষীয় ধনীদিগের প্রমোদবনে এইরূপ কৃত্রিম শৈল সকল ক্রীড়ার্থ সংস্তরিত হইত, ইহাই সপ্রমাণ হইতেছে।
7. বৃক্ষ রাজ্য মধ্যে শোভাকল্পে অশোকের প্রতিযোগী আর নাই। মহাত্মা স্যর উইলিয়ম জোন্স ইহা ব্যক্ত করিয়া গিয়াছেন। কুসুমিত অশোকের সদৃশ শ্রী আর কুত্রাপি দৃষ্ট হয় না ; যেন বনস্থল আলোকময় করিয়া দেয়। জোন্স সাহেবের নামেই এইক্ষণে ইহা বিখ্যাত হইয়াছে।
8. কেশর শব্দে তিন ভিন্ন ভিন্ন পুষ্প বৃক্ষকে বুঝায়। যথা নাগকেশর, বকুল, পুন্নগা। কবি কোন্ বৃক্ষকে লক্ষ্য করেন, স্থিরী করণ করা দুরূহ, উক্ত তিন কুসুমই কবিজন মনোহর।
9. রক্তঝিণ্টি বা ঝাঁটি বৃক্ষের নাম, ইহা দ্বারা সুন্দর রূপ বৃত্তি প্রস্তুত হইয়া থাকে।
10. সংস্কৃত কাব্যকলা বিলসিত মহাশয়দিগের নিকটে অশোক বৃক্ষে সুন্দরী নারীর বাম চরণাঘাত রূপ দোহদ ক্রিয়ার টিপ্পনা করণের প্রয়োজন নাই, তপভিন্ন অপর সম্প্রদায় কাব্যামোদপরায়ণ যুবক গণের প্রতি বিজ্ঞাপ্য এই যে, অশোক বৃক্ষ মঞ্জুরিত না হইলে তৎপ্রতি বরবর্ণিনাদিগের বামপদ স্পর্শরূপ মিষ্ট তিরস্কারের প্রয়োজন হইত।
11. এই ‘শ্যামা’ পদে কবি এস্থলে কৃষ্ণবর্ণা লক্ষ্য করেন এমত বোধ হয় না। যেহেতু যক্ষাঙ্গনাকে গৌরবর্ণ রূপে অন্যত্র বিন্যাস করিয়াছেন। ‘শ্যামা’ পদে এস্থলে সুলক্ষণাক্রান্তা নায়িকা ভেদ –
তথাহি ত্রিকাণ্ডে : – “শীতকালে ভবেদুষ্ণা গ্রীষ্মকালে চ শীতলা।/
নারী লক্ষণ সম্পন্না শ্যামা সা স্বেদ বর্জিতা।।” – বিশেষতঃ হিমালয়ের উত্তর প্রদেশে শ্যামবর্ণা স্ত্রী নাই।
12. এই ‘দেহলী’ শব্দ হইতে হিন্দী “দেহড়ী” এবং তাহার বাঙ্গালা অপভ্রংশ “দেউড়ী” শব্দ উৎপন্ন হইয়াছে। দেহলীর উপর পুষ্প রচনা করা সকল সুসভ্য জাতির মধ্যেই রীতি আছে। ফলতঃ গৃহ প্রবেশে তাহা শুভদ শকুন এবং নয়নের প্রসন্নতা প্রদ বটে। পশ্চিমাঞ্চলে অদ্যাপি এরূপ পুষ্প রচনার প্রথা প্রসিদ্ধ আছে, বিশেষতঃ বিবাহ বাসরে পাত্রকে দেহলীর উর্দ্ধে সজ্জিত পুষ্প রচিত যন্ত্রভেদ করিয়া ভাবী শ্বশুরালয়ে প্রবেশ করিতে হয়, – ইহাকে “তোরণ তোড়না” কহে। তোরণ-তোড়নের সময়ে মহা কৌতুক হয় – পাত্রীর সহচরী বরবালাগণ কন্দর্প সেনাবৎ শ্রেণীবদ্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া থাকেন – তোরণ তোড়নে পাত্র যাহাতে পরাভূত হন, তদুদ্দেশে কৈতব শর প্রভৃতি শর সন্ধানে ত্রুটি করেন না।
13. যেরূপ ধাতুরত্ন প্রভৃতি বিভিন্ন দেশে জন্মিলেও তাহাদিগের বিভিন্ন প্রকৃতি হয় না ; মহাকবি জাতিও তদ্রূপ প্রতীয়মান হন। তাঁহাদিগের হৃদয়রাজীবস্থ ভাবমধু একই রূপ হয়। মহাকবি সেক্সপীয়র বরহ বর্ণনে উপরিউক্ত কবিতার ভাব একস্থানে এইরূপে প্রকটন করিয়াছেন যথা : –
If the dull substance of my flesh were thought,
Injuious distance should not stop my way ;
For then despite of space I would be brought.
Form limits for remote where thou dost stay.
অস্য ভাবার্থ
যদি ভাবরূপী হতো মম জড় কায়।
তবে কি দূরতা দুষ্ট রাখিত আমায়।।
আসিতাম ছার মানি ব্যবধান ভূমি।
মিলিতাম যথায় বিরাজ কর তুমি।।
14. মহাকবি কালিদাস যে ভারতবর্ষীয় ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের উদ্ভিদ তত্ত্বজ্ঞ ছিলেন, তাহা বিলক্ষণ সপ্রমাণ হইয়াছে ! তিনি মধ্য-দেশীয় পর্ব্বত-শ্রেণীতে বেত্স ; কুন্দ ; নীপ , ককুভ প্রভৃতি বৃক্ষের সংস্থাপন করেন এবং হিমালয়ে ধবল, দেবদারু এবং অপর আর আর হিম প্রধান দেশজ তরুলতা বর্ণন করিয়াছেন। এই প্রকৃতিতত্ত্ব আধুনিক ইউরোপীয় ভ্রমণ কর্ত্তাদিগের লিপিতে সপ্রমাণ হইতেছে।
15. কার্ত্তিকেয়ী শুক্লা চতুর্দ্দশী রজনী অতি মনোহারিনী সন্দেহ নাই। পশ্চিমাঞ্চলে অদ্যাপি উক্ত রজনীতে মহা সমারোহ হয়। এই পর্ব্বাহের নাম জলযাত্রা। অগ্ন্যুৎসব ও নৌকারোহণে জলক্রীড়া ইহার প্রধান অঙ্গ। ফলতঃ সূক্ষ্মরূপে বিবেচনা করিলে আষাঢ়ী শুক্লা একাদশী হইতে উক্ত দিবস পর্য্যন্ত চাতুর্মাস্য নির্ণয়ের মূলীভূত কারণ জলদজালে প্রায় সূর্য্য মণ্ডল আচ্ছন্ন, সুতরাং তাহা নারায়ণের শয়নউক্ত করা উপযুক্ত বটে। হরিপদে যেরূপ বিষ্ণুকে বুঝায় ; সেইরূপ সূর্য্যের প্রতিও তাহা আদিষ্ট হয়। বস্তুতঃ বিষ্ণু এবং সূর্য্য অভেদ দেবতা। অনেক দূরদর্শী ইউরোপীয় পণ্ডিত এরূপ মীমাংসা করিয়াছেন।
—————————-
অনুবাদ: রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়
ভাস্কর ভট্টাচার্য
আমি মেঘদুতের রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় কৃত অনুবাদটি কি আবৃত্তি করতে পারি social media platform e ? আমাকে দয়া করে জানালে ভীষণ উপকৃত হব।