কোন যক্ষ অভিশপ্ত হয়ে কর্ম্মদোষে।
মহিমা বিগত একবর্ষ প্রভুরোষে।।
বিরহের গুরুভারে দয়িতের সনে।
মুহ্যমান হয়ে রয় রামগিরি বনে।।
হেথা তরুগণ তোষে স্নিগ্ধ ছায়া দানে।
জলধারা পুণ্যময়ী জানকীর স্নানে।। (১)
কাটিল কয়েক মাস তনুক্ষীণ হয়।
মণিবন্ধ হতে খসে সুবর্ণ বলয়।।
আষাঢ়ের প্রথম দিবস সমাগতে।
হেরে যক্ষ মেঘ আসি উদয় পর্ব্বতে।।
সমাচ্ছন্ন সানুদেশ পয়োদ পাটলে।
যেন বপ্রক্রীড়া মত্ত মাতঙ্গের দলে।। (২)
রাজরাজ অনুচর যক্ষ বহুক্ষণ !
চাপিয়া অন্তরবাষ্প করে নিরীক্ষণ।।
কৌতুক-আধান মেঘ করে অন্যমন।
মিলন সুখেতে যারা থাকে অনুক্ষণ।।
কণ্ঠাশ্লেষ প্রণয়িনী দূরে থাকে যার।
মেঘাগমে মনোব্যথা কি বর্ণিব তার।। (৩)
আসন্ন শ্রাবণ মাস, দয়িতা জীবন।
কেমনে বাঁচাবে, তাই, করিল মনন।।
দূত করি পয়োমুচে দয়িতা সদন।
স্বকীয় কুশল বার্ত্তা করিবে প্রেরণ।।
কুটজ কুসুমে অর্ঘ্য সাজাইয়া ক্ষণে।
মেঘেরে স্বাগত দেয় বিনম্র বচনে।। (৪)
ধূমজ্যোতি জল আর মিশিয়া পবন।
সঞ্জাত যে পুরোবর্ত্তী মেঘ অচেতন।।
না করি বিচার তার প্রার্থনা জানায়।
কামাতুর যক্ষ মেঘে মনের জ্বালায়।।
সচেতন প্রাণী বিনা বার্ত্তা কেবা বয়।
কামীজন সেইজ্ঞান অবলুপ্ত হয়।। (৫)
পুষ্কর আবর্ত্ত বংশ বিদিত ভুবন।
তুমি তার বংশধর, ওহে মহাত্মন্ !
প্রকৃতি পুরুষ মেঘ কামরূপ-ধর !
ভাগ্যদোষে প্রিয়া মোর অতি দূরান্তর।।
ভিক্ষার্থী আজিকে তাই তোমার সকাশে।
প্রার্থনা উচিত সদা গুণীজন পাশে।।
মহতের বিমুখতা তবু সহনীয়।
অধমেতে লব্ধকাম নহে বরণীয়।। (৬)
তাপিত শরণ তুমি হে পয়োদ বর !
ধনপতি কোপে পাই দুর্দশা বিস্তর।।
সমাচার লয়ে মোর প্রিয়া পাশে যাও।
মরম যাতনা হতে তাহারে বাঁচাও।।
ধনবান যক্ষগণ বাস করে যথা।
অলকা নগরী নাম যাইবে হে তথা।।
পুরীর বাহিরে এক আছয়ে উদ্যান।
চন্দ্রমৌলি মহাদেব তথা রত-ধ্যান।।
ললাট চন্দ্রিকা হতে জ্যোৎস্না ধারা ক্ষরে।
সৌধ কিরিটিনী পুরী তাহে স্নান করে।। (৭)
নিত্যপুষ্প তরু সেথা, উন্মাদ ভ্রমর।
কুসুমের মধুপানে নিয়ত মুখর।।
সরোবর নিত্যপদ্মা মরাল-মেখলা।
ভবন-কলাপী-নিত্য কলাপ-উজ্জ্বলা।।
কেকারবে তারা সদা উৎকণ্ঠিত রয়।
নিত্য জ্যোৎস্না তমোনাশে প্রদোষ সময়।। (৮)
পবন সরণী ধরি চলিবে যখন।
পথিক বনিতা সবে করিবে ঈক্ষণ।।
সরায়ে অলকাবলী হতে পদ্মানন।
লভিবে আশ্বাস তারা প্রিয় আগমণ।।
মম হেন পরাধীন ভিন্ন কোন্ জন !
করয়ে উপেক্ষা বল প্রিয়া হেন ধন ! (৯)
তব অনুকূলে বায়ু মন্দ মন্দ ধায়।
বামেতে চাতক অই সুমধুর গায়।।
গর্ব্ভাধান অভিলাষী বলাকার দল।
আকাশে রচনা করে সুচারু শৃঙ্খল।। (১০)
শ্রুতি সুখকর তব নিনাদ সময়।
উঠিবে মহীরচ্ছত্র উচ্ছিলীন্ধ্র চয়।।
সে রবে মরালদল হবে মোদমান।
মানস সরসী জলে করিয়ে পয়ান।।
পাথেয় মৃণালখণ্ড লয়ে মুখে সবে।
তব সঙ্গে কৈলাস অবধি যাবে নভে।। (১১)
ওহে মেঘ পুরোবর্ত্তী এই উচ্চ নগ।
বন্দ্যনীয় রঘুপতি পদাঙ্কে সুভগ।।
ইনি তব প্রিয় বন্ধু দিয়ে আলিঙ্গন।
যথা সমাদরে কর প্রিয় সম্ভাষণ।।
কালে কালে সংযোগে বন্ধুতা বাড়ে ভারি।
বিরহান্তে তাই ত্যাগ করে বাষ্প করি।। (১২)
একমাত্র পত্নী মোর তব ভ্রাতৃপ্রিয়া।
হরিতেছে এবে কাল দিবস গণিয়া।।
দেখিতে তাহারে মেঘ পাইবে নিশ্চয়।
মোর আশে বেঁচে আছে বাঁধিয়ে হৃদয়।।
কুসুমের মত মৃদু নারীদের হিয়া।
বিরহ ব্যথায় পড়ে অচিরে ভাঙ্গিয়া।।
অবাধ গতিতে মেঘ যাত্রা কর ত্বরা।
ভাবিয়া সে অবলায় নিতান্ত কাতরা।। (১৩)
শুনহে জলদ ! এবে বলি বিবরণ।
যে মার্গে তোমার যোগ্য যাত্রার কারণ।।
তারপর প্রেরণীয় মম সমাচার।
পান করি শ্রুতি পথে হবে আগুসার।।
পথশ্রমে ক্লান্ত পদ হয়ে জলধর।
বিশ্রাম লইবে বসি শিখর উপর।।
বারি বরিষণে যদি ক্ষীণতনু হয়।
সেবিবে নির্ঝর হতে পরিলঘু পয়।। (১৪)
সরস বেতস কুঞ্জে শোভিত অঞ্চল।
তেয়াগি উত্তর মুখে যাইবে চঞ্চল।।
পথি মাঝে দিকনাগে ঊর্দ্ধে শুঁড় তুলি।
ধরিতে তোমায় মেঘ হইবে ব্যাকুলি।।
এড়াইবে সে সংঘাত নিজ বুদ্ধি বলে।
তোমার উৎসাহ হেরি সিদ্ধাঙ্গনা দলে।।
মুগ্ধনেত্রে ভাবিবেক সচকিত মনে।
হরিতেছে গিরিশৃঙ্গ বুঝিবা পবনে।। (১৫)
অই হের পুরোভাগে বল্মীকের পরে।
তোমার গমন বার্ত্তা ঘোষণার তরে।।
রত্নরাজি প্রভাময় হাসে ইন্দ্রধনু।
সাজাইতে জলধর তব শ্যাম তনু।।
ধরিবে অপূর্ব্ব রূপ যথা শ্যামরায়।
চূড়াতে কলাপ পরি ব্রজে শোভা পায়।। (১৬)
তোমার আয়ত্তাধীন কৃষিকাজ যত।
জনপদ বধূগণ জানে রীতিমতো।।
জানে না ভ্রুলীলা ছলা, প্রীতি স্নিগ্ধ মনে।
তোমারে করিবে পান নয়নের কোণে।।
মালভূমি ব্যাপী যত আছে ক্ষেত্র চয়।
সদ্য হল-কর্ষণেতে সোঁদাগন্ধ ময়।।
সেখানে পশ্চিমমুখে কিছুদূর গিয়া।
লঘুগতি যাবে পুনঃ উত্তর হইয়া।। (১৭)
আম্রকূটে বসি করো পথশ্রম দূর।
সে অদ্রি তোমার পাশে কৃতজ্ঞ প্রচুর।।
সেখানেতে দাবানল করিলে দমন।
বরষিয়া জলধারা ওহে মহামন !
মহতের কাছে বন্ধু কত বরণীয়।
সে কথা ভাষায় কভু নহে বর্ণনীয়।।
হইলেও ক্ষুদ্রজন স্মরি উপকার।
বন্ধুরে আশ্রয়দানে না করে বিচার।। (১৮)
প্রান্তদেশ সমাচ্ছন্ন আম্রের কাননে।
শোভে বৃক্ষ পক্ক ফলে পাণ্ডুর বরণে।।
বসিবে শিখরে যবে স্নিগ্ধ বেণী প্রায়।
অমর মিথুনে সবে নিরখিবে তায়।।
যেন ধরা সুন্দরীর শ্যামল চুচুক।
পাণ্ডুর বিস্তার সহ রয়েছে উন্মুখ।। (১৯)
বনচর বধূদের ভুক্তকুঞ্জ বনে।
ক্ষণেক বর্ষিবে বারি মৃদুমন্দ স্বনে।।
তারপর দ্রুতবেগে করিবে হে গতি।
বিন্ধ্যগিরি পাদদেশে যথা রেবা সতী।।
বিস্তর উপল মাঝে শীর্ণভাব গত।
ভক্তিভরে বিচিত্রিত গজ অঙ্গ মত।। (২০)
বমন করিয়া বৃষ্টি, ওহে নব ঘন!
অন্তঃসার শূন্য যদি হও সেইক্ষণ।।
পবন তোমারে লঘু তুলার মতন।
উড়াইয়া লয়ে যাবে যেথা চায় মন।।
অঙ্গপুষ্টি লাগি কিছু পান করি লবে।
রেবার সুপেয় নীর বাসিত সৌরভে।।
বনগজ মদস্রাব সে স্রোতে গলিত।
জম্বু কুঞ্জ পরিস্রুত হেতু দেহ-হিত।।
পূর্ণতায় বৃদ্ধি করি গুরুত্ব প্রথমে।
উপক্রমী হয়ো মেঘ পথ অতিক্রমে।। (২১)
কচ্ছভূমে কন্দলীর প্রথম মুকুল।
সুখেতে চর্ব্বনরত সারঙ্গের কূল।।
হেরিবে অদূরে নব অর্দ্ধ বিকশিত।
কদম্ব-কেশর বর্ণ কপিশ-হরিত।।
অরণ্যের সোঁদাগন্ধ আঘ্রাণ করিয়া।
ছুটিবে তোমার আগে মাতাল হইয়া।। (২২)
জলবিন্দু গ্রহণেতে চাতক চতুর।
হেরিয়া তোমায় লভে আনন্দ প্রচুর।।
অতৃপ্ত নয়নে তারা দেখিবে তোমায়।
বলাকা চলিবে নভে কিবা শৃঙ্খলায়।।
শ্রেণীবদ্ধ তার সংখ্যা গুণিতে গুণিতে।
চলিবে সুরঙ্গে মেঘ গম্ভীর ধ্বনিতে।।
শঙ্কিতা তোমার রবে সিদ্ধাঙ্গনা যত।
বেপথু বাহুতে বাঁধে প্রিয়ে দৃঢ় মত।।
প্রিয়া আলিঙ্গনে হৃষ্ট সেই সিদ্ধগণ।
কৃতজ্ঞতা মানিবেক তোমার সদন।। (২৩)
যদি ও উদগ্রীব সখে প্রিয় কার্য্যে মম।
দ্রুতগতি চলিবার করিছ উদ্যম।।
পর্ব্বতে-পর্ব্বতে তবু কালক্ষেপ হবে।
প্রস্ফুটিত ককুভের মোদিত সৌরভে।।
স্বাগত করিবে মেঘ ! কলাপীরা সবে।
শুক্লাপাঙ্গ সজল নয়নে কেকারবে।।
সে সবার অনুরোধ অবহেলা করি।
কেমনে চলিবে বলো স্বীয় মার্গ ধরি।। (২৪)
দশার্ণ দেশেতে যবে হবে উপনীত।
সঙ্গী তব হংসগুলি তোমার সহিত।।
করিবে বিশ্রাম সেথা দিন কতিপয়।
ওদিকে পাকিবে বনে শ্যাম জম্বুচয়।।
কণ্টকী কেতকী ফুল বেড়া প্রান্ত ভরি।
ফুটিবে গৌরবে মুখে পাণ্ডুরাগ ধরি।।
গ্রাম চৈত্যে গৃহবলীভূক পক্ষী সব।
নীড় রচনায় মাতি করে কলরব।। (২৫)
সেই সব দৃশ্য মেঘ দেখিতে দেখিতে।
আসিবে বিখ্যাত পুরী বিদিশা চকিতে।।
রাজধানী গিয়া পাবে সদ্য সদ্য ফল।
কামুকের কাম্য যত লব্ধ অবিকল।।
প্রান্ত দিয়া কুলুকুলু বেত্রবতী ধায়।
সুস্বাদু সে জলধারা পান করো তায়।।
সে চলোর্মি স্রোতস্বিনী মুখপদ্মে তারি।
ভ্রুভঙ্গি বিলাস খেলে অতি চমৎকারী।। (২৬)
নীচৈ নামে গিরি এক আছয়ে তথায়।
বিশ্রাম লইবে বসি তাহার মাথায়।।
তব আগে প্রস্ফূটিত প্রৌঢ় নীপদল।
তোমার পরশে হবে পুলক চঞ্চল।।
শিলা কাটি গুহা তথা হয়েছে রচনা।
উদ্দাম নাগর যায় সহ বারাঙ্গনা।।
গুহাতল পরিলিপ্ত রতি পরিমলে।
যৌবন সম্ভোগ কথা ব্যক্ত সেই ছলে।। (২৭)
বিশ্রামান্তে যাইবে হে বননদী তীরে।
উদ্যানে যূথিকাজালে জল দিবে ধীরে।।
সে মালঞ্চে কমলের কূণ্ডলধারিণী।
স্বেদসিক্ত গণ্ডস্থল অনেক মালিনী।।
যূথিকা চয়ন করি পরিশ্রান্ত হয়।
তাহাদের প্রতি তুমি হইবে সদয়।।
ছায়াপাত অছিলায় পুষ্পাবলী মুখে।
ক্ষণ পরিচিত হয়ে চলি যাবে সুখে।। (২৮)
যদিও উত্তর থেকে যেতে হবে ঘুরে।
তথাপিও যেও মেঘ উজ্জ্বয়িনী পুরে।।
সৌধের উৎসঙ্গ প্রেমে হয়োনা বিমুখ।
পুরাঙ্গনা পাশে পাবে লোলাপাঙ্গ সুখ।।
বিদ্যুদ্দাম স্ফুরিত সে চাহনি চকিত।
না হেরি নয়নে যেন করোনা বঞ্চিত।। (২৯)
হেরিবে নির্বিন্ধ্যা নদী। বীচিমালা পরে ;
মুখর বিহগ সারি অঙ্গবাস ধরে।।
স্রোতবেগে আলুথালু সে চারু বসন।
স্খলিত হয়েছে তার নাভি আবরণ।।
বিভ্রমেতে যেন বালা জানায় প্রণয়।
নামিও তাহার জলে হবে রসময়।। (৩০)
বেণীর আকারে ক্ষীণ বহে জলধার।
তট তরু জীর্ণপত্র পড়ি অনিবার।।
মনোহর অঙ্গ তার পাণ্ডু রাগ ধরে।
তোমার বিরহ চিহ্ন প্রকাশিত করে।।
তটিনীর কৃশদেহে আনিবে জীবন।
ভাগ্যবান পয়োধর ! তব দরশন।। (৩১)
অনন্তর অবন্তীতে করিবে হে গতি।
যেই পুরী কবিকৃত যশে ঋদ্ধিমতী।।
উদয়ন কথা লয়ে গরিমার ধাম।
বিশালা শ্রীশালী বলি কি বিশালা নাম।।
নিজ পুণ্যবলে যারা দিব্যলোকে যায়।
পুণ্যশেষে আর তথা থাকিতে না পায়।।
তাই বুঝি খণ্ড চারু করি তার চুরি।
ধরাধামে বসাইলা উজ্জ্বয়িনী পুরী।। (৩২)
বিকচ কমল গন্ধ অঙ্গময় মেখে।
উঠেছে শীতল বায়ু শিপ্রানদী থেকে।।
প্রভাত সময়ে কিবা ধীরে ধীরে ধায়।
সারসের মদকল দূরে লয়ে যায়।।
সুরতান্তে চাটুকার নায়ক যেমন।
কামিনীর শ্রমহরে করিয়া ব্যজন।।
সেইরূপ প্রাতে বায়ু করি ঝুর ঝুর।
করিতেছে নারীদের রতিখেদ দূর।। (৩৩)
পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে ওহে জলধর।
পোষণ করিতে যদি চাহ কলেবর।।
নবীন ললনাগণ উজ্জ্বয়িনী পুরে।
নানা গন্ধ ধূপদেয় চিকন চিকুরে।।
গবাক্ষে করিয়া গতি সে ধুম সেবিবে।
ললিত-বণিতা-পদ-চিহ্ন নিরখিবে।।
কুসুম সুরভীযুত হর্ম্ম্য সৌধোপর।
গৃহশিখী প্রীতিভরে হবে নৃত্যপর।। (৩৪)
চণ্ডেশ্বর নিকেতনে করিলে গমন।
তব পুণ্যদেহ নিরখিবে শিবগণ।।
নীলতনু তব, নীলকণ্ঠ-কণ্ঠ-প্রায়।
প্রভু প্রভা সমাদরে দেখিবে হে তায়।।
কুবলয় গন্ধে আমোদিত গন্ধবতী।
জলকেলি করে তথা যতেক যুবতী।।
সেই সুরভিতে বায়ু একে বিমোহন।
আরো তাহে গন্ধ গন্ধে কাঁপে কুঞ্জবন।। (৩৫)
মহাকাল মন্দিরেতে হয়ে উপনীত।
প্রদোষ অবধি তথা হবে অবস্থিত।।
প্রদোষে প্রমথপতি আরতির ক্ষণে।
অতিশয় পরিতোষ প্রাপ্ত পট স্বনে।।
তোমার গম্ভীর স্বরে হবে অবিকল।
পাইবে তাহার ফল গর্জ্জন সফল।। (৩৬)
নৃত্যতাল পদন্যাসে দেবদাসীগণ।
নিতম্বের চন্দ্রহারে তুলিবে নিক্কণ।।
রতন মণ্ডিত দণ্ড চামর সুন্দর।
ঢুলাইয়া সাবলীলে হবে ক্লান্ত-কর।।
অবশ হাতের নখ-ক্ষত বেদনাতে।
নব বরষার তব জলবিন্দু পাতে।।
হইবে পরম তুষ্ট দিবে উপহার।
মধুকর-শ্রেণী-দীর্ঘ কটাক্ষ-সম্ভার।। (৩৭)
সান্ধ্যতেজে নবজবা রক্তরাগ শোভা।
ধরিবে হে কলেবরে অতি মনোলোভা।।
অনন্তর পশুপতি নৃত্যকালে যবে।
শত শত বাহু মেলি অভিলাষী হবে।।
পাইবারে প্রিয় তাঁর আর্দ্র নাগাজিন।
নিজ দেহ করো মেঘ শিব-বাহুলীন।।
ভব প্রতি ভক্তি ভঙ্গীযুক্ত তব কায়া।
হেরিবেন স্তিমিত নয়নে ভবজায়া।। (৩৮)
যেখানে সঙ্কেত স্থানে রজনী সময়।
নরপতি পথে যায় ভাবিনী নিচয়।।
দেখিতে না পায় পথ তিমির ঘটায়।
দেখাইও দামিনীর কনক ছটায়।।
বরষিয়ে বারিধারা গুরু গরজনে।
কাতর করো না সেই বিলাসিনীগণে।। (৩৯)
সৌধোপরি কপোত বড়ভী শোভা পায়।
সুপ্ত পারাবত সহ নিদ্রা গিয়ে তায়।।
প্রভাত সময়ে শীঘ্র করিবে গমন।
তোমার বিরহে খিন্ন সৌদামিনীগণ।।
তুমি থাক নানা রসে ব্যস্ত নানা স্থানে।
হেন রীতি কেমনেতে সবে তারা প্রাণে।।
বিশেষতঃ বন্ধু কার্য্য করিয়া গ্রহণ।
বল কেবা অন্যমত করে সুভাজন।। (৪০)
ঊষায় গৃহেতে ফিরি প্রণয়ির দল।
মুছাবে খণ্ডিতাননে নয়নের জল।।
কমলের দল হতে শিশিরের দাগে।
তুলিবেন ত্বরা আসি তপন সোহাগে।।
সে সময় রবি তেজে করো না আটক।
ওহে মেঘ ! কিবা কাজ দ্বেষে অনর্থক।। (৪১)
তোয় সুধা গম্ভীরার করে ঢল ঢল।
প্রসন্ন হৃদয় যেন স্বচ্ছ সুবিমল।।
অভিলাষী ধরিবারে বক্ষে আপনার।
স্বভাব সুন্দর ছায়া পয়োদ তোমার।।
তার জলে খেলা করে শফরী চঞ্চল।
মনোহর কান্তি যেন কুমুদ ধবল।।
আঁখি ভরি সেই রূপ লয়ে প্রবাহিনী।
হানিবে কটাক্ষশর মরম দাহিনী।।
আর কি সংযম সাজে, ওহে জলধর !
ধরা দিয়ে জয় করো কোমল অন্তর।। (৪২)
বেতসের শাখা ঝুলে দুই তট ভরি।
সুনীল বসনা নদী দুই হাত ধরি।।
নিতম্ব ঢাকিতে করে মৃদু আকর্ষণ।
বৃথায় প্রয়াস তার থাকে না বসন।।
বিবসনা জঘনার সে মোহিনী টান।
পারিবে কি উপেক্ষিতে মেঘ লম্বমান ? (৪৩)
যাইবে যখন তুমি দেবগিরি ধাম।
মন্দ মন্দ সমীরণে পাইবে আরাম।।
বসুধায় গন্ধ জাগে বারি বরিষণে।
মাতঙ্গে অনিল পান করে গুরু স্বনে।।
কাননেতে উদুম্বর পরিণত হয়।
শীতল বাতাস পাকে কিবা রসময়।। (৪৪)
সদা তথা বিরাজিত স্কন্দদেব রন।
পুষ্পমেঘী হইবেক করিয়া যতন।।
আকাশগঙ্গায় স্নান করি সমাপন।
পুষ্পবৃষ্টি সহ তাঁরে করিবে ভজন।।
বাসববাহিনী রক্ষা কারণে শঙ্কর।
সূর্য্যসম জ্যোতির্ময় তেজ ভয়ঙ্কর।।
হুতাশনে অর্ঘ্যরূপে করি সমর্পণ !
সৃজিলেন স্কন্দদেব সন্তান আপন।। (৪৫)
তারপর গুরুগুরু স্বনন্ করিবে।
অদ্রিগণ শুনি যাহে প্রতিধ্বনি দিবে।।
পাবকী কলাপী রঙ্গে হবে নৃত্যপর।
হর-শির-চন্দ্রালোক-ধৌত-দৃষ্টি-ধর।।
স্খলিত-কলাপ যার শ্রবণ কমলে।
ধরেন ভবানী যত্নে পুত্রস্নেহে গলে।। (৪৬)
শরবন-ভব-দেবে আরাধনা সারি।
চলিবে আকাশ পথে যবে তাড়াতাড়ি।।
সিদ্ধ মিথুনের দল জলকণা ভয়ে।
বীণাসহ পলাইবে ত্রস্ত-পদ হয়ে।।
চর্ম্মণ্বতি নদী হেরি জলস্পর্শ আশে।
নামিয়া আসিবে মেঘ সেই অবকাশে।।
রন্তিদেব কীর্ত্তি সেই করিবে প্রণতি।
সুরভি-তনয়া লহু-মূর্ত্ত-স্রোতস্বতী।। (৪৭)
শার্ঙ্গপাণি শ্রীবিষ্ণুর ওহে বর্ণ চোর।
নামিবে জলেতে যবে হয়ে ভক্তিভোর।।
দূর হতে ব্যোমচারী সে পৃথু সরিতে।
হেরিবে মুকুতা মালা বসুধার চিতে।।
সেই সূক্ষ্ম হার মাঝে তব অবস্থান।
ইন্দ্রনীল মণিসম হবে দৃশ্যমান।। (৪৮)
নদী ত্যাগি দশপুরে যবে উত্তরিবে।
মুগ্ধনেত্রে বধূগণ তোমারে হেরিবে।।
জনে জনে পরিচিতা ভ্রুলতা লীলার।
চটুল নয়ন পক্ষ্ম তোলে বার বার।।
শ্বেতক্ষেত্র মাঝে কৃষ্ণ তারকার শোভা।
কুন্দ কুসুমেতে যেন মুগ্ধ মধুলোভা।।
কটাক্ষের শরভরা সে ভ্রমর দলে।
হানিলে উন্মত্তে ছোটে অতি কুতুহলে।।
দশপুর বধূকুলে হবে দর্শনীয়।
দর্শক হয়ো না কভু ওহে রমণীয়।। (৪৯)
ব্রহ্মাবর্ত্ত দেশে মেঘ করি ছায়াদান।
রণভূমি কুরুক্ষেত্রে করিবে পয়ান।।
সেখানে কৌরব সনে পাণ্ডবের রণ।
ক্ষত্রকূল অন্তঃকারী ঘটেছে ভীষণ।।
প্রফুল্ল কমলদলে বারিধারা প্রায়।
অর্জ্জুন গাণ্ডীবধন্বা রাজন্যের গায়।।
শত শত শরক্ষেপ করিল জর্জ্জর।
হেরিবে সেখানে তার চিহ্ন বহুতর।। (৫০)
যদিও অসিতবর্ণ তুমি বারিধর।
সরস্বতী[১] জলে হবে বিমল অন্তর।।
যার তীরে বান্ধব প্রণয়ে হলধর।
তপ আচরিল ঘোর ত্যজিয়ে সমর।।
রেবতীর আঁখি বিভাসিত কাদম্বরী।
এক চসকেতে পান পরিহার করি।।
অঞ্জলি ফলকে সেই সরস্বতী নীর।
পানে কুতুহলী হইলেন হলী বীর।। (৫১)
পরিহরি ব্রহ্মাবর্ত্ত দেশ অনন্তর
কনখল[২] দেশে গঙ্গা পাবে পয়োধর।।
শৈলরাজ অবতীর্ণা জাহ্নবীর বেণী।
সগর বংশের স্বর্গ সোপানের শ্রেণী।।
ফেনছলে হাসি হর জটা আকর্ষণে।
ভ্রুকুটি রচেন সতী সতিনী বদনে।।
আর নিজ তরল তরঙ্গ রূপ করে
পরশেন শিব শির শোভী শশধরে।। (৫২)
জাহ্নবীর নীর যেন স্ফটিক বিমল।
এই মনে করি পান হেতু সেই জল।।
নামিয়া পড়িলে তুমি ত্যজিয়া আকাশ।
সুরেশের গজ সম পাইবে প্রকাশ।।
অথবা যেখানে নাই যমুনা সঙ্গম।
সেখানে হইবে সেই শোভা মনোরম।। (৫৩)
জাহ্নবী জনম স্থান সেই হিমালয়।
শ্রম দূর যাবে তথা পাইলে উদয়।।
উপবিষ্ট হেতু তথা কুরঙ্গ নিচয়।
সুরভিত শিলাতল মৃগমদ ময়।।
তুষারে তুষার গিরি ধবল উজ্জ্বল।
তার শৃঙ্গে হবে তব শোভা সুবিমল।।
যেন বৃষেশের বৃষ বিষাণে খুঁড়িয়ে।
ধরিয়াছে পঙ্ক রাশি মস্তক জুড়িয়ে।। (৫৪)
প্রচণ্ড পবনে ঘরষিত শাখা দল।
তাহাতে সরল বৃক্ষে[৩] উদিত অনল।।
লাগিয়ে সে হুতাশন চামরী চামরে।
বিশাল মশাল হেন দিগ্দাহ করে।।
সেই দাবদাহে যদি গিরি হিমালয়।
ঘোরতর তপ্ত তাপে তপ্ত তনু হয়।।
সহস্র সহস্র ধারা বরষি তখন।
নির্ব্বাণ করিও সেই বিষম দহন।।
সাধুদের সম্পদের এই ত উদ্দেশ।
হরণ করণে যত বিপন্নের ক্লেশ।। (৫৫)
তবোদয়ে হিমালয়ে হবে ঘোর রব।
সে রবে শরভে[৪] হবে মদ সমুদ্ভব।।
বলদর্পে তোমার লঙ্ঘন অভিলাষ !
করকা বরষ তুমি প্রকাশিবে হাস।।
গর্ব্ব খর্ব্ব আর অঙ্গ ভঙ্গ হবে তায়।
বৃথা আকুঞ্চনে কেনা পরাভব পায়।। (৫৬)
চন্দ্রচূড় চারু চরণে চিহ্ন রেখা।
হে নীরদ ! সেই শিলাতলে আছে লেখা।।
যেই চিহ্ন উপহারে পূজে সিদ্ধগণে।
প্রদক্ষিণ করো তারে ভক্তি নম্র মনে।।
হে পদাঙ্ক দরশনে পাপ পরিগত।
কল্পান্তে শিবত্ব লাভ করে ভক্ত যত।। (৫৭)
মুরজ[৫] মৃদঙ্গ রবে কিন্নর নিকর।
ত্রিপুর বিজয় গীত গায় নিরন্তর।।
কন্দরে যখন তব প্রতিধ্বনি হবে।
কীচকে পূরিলে বায়ু সুমধুর রবে।।
সঙ্গীত হইবে যেন ত্রিপুর সম্বাদ ;
বাজাবে মুরজ বাদ্য তোমার নিনাদ।। (৫৮)
হিমালয় উপতটে গিরি নদীগণ।
অতিক্রম করি পরে করিতে গমন।।
ভৃগুরাম কীর্ত্তি ক্রৌঞ্চরন্ধ্র[৬] শোভা করে।
সেই রন্ধ্র দিয়া তুমি যাইবে উত্তরে।।
পরশু আঘাতে হলো সেই পথ প্রকাশ।
সেই পথ হয়ে যায় মরাল সঙ্কাশ।।
বলি দমনার্থে যথা বামনের পদ।
সেরূপ সে পথে তুমি শোভিবে বিষদ।। (৫৯)
যার মূল শ্লথীভূত দশমুখ করে।[৭]
উদয় হইবে হেন কৈলাস শিখরে।।
ত্রিদশ বণিতা বৃন্দ মোহন দর্পণে।
অতিথি হইও নিরছায়া সমর্পণে।।
কুমুদ সদৃশ শুভ্র প্রকাশে কৈলাস।
যেন দশদিশি ভরি শম্ভু অট্টহাস।। (৬০)
দ্বিরদ রদন নিভ কৈলাস শেখর।
তুমি তাহে প্রকাশ পাইলে অম্বুধর।।
তবদেহ যেন স্নিগ্ধ দলিত অঞ্জন।
একচক্ষে নিরখিবে যতজন গণ।।
এই মনে করি যেন নীল পট্টবাস।
হলধর স্কন্ধে শোভা করিল প্রকাশ।। (৬১)
ভুজঙ্গ বলয় শূন্য পতিকর ধরি।
ক্রীড়া শৈলোপরে যদি ভ্রমেন শঙ্করী।।
তাঁর পদ স্পর্শ সুখ প্রাপন কারণ।
দেহস্থিত বারিবেগ করিয়ে স্তম্ভন।।
বাঁকাইয়ে নিজ তনু ভক্তি ভঙ্গি ছলে।
পড়িবে সোপান হয়ে গৌরী পদতলে।। (৬২)
সুরবালা বালা বিজড়িত হীরাহারে।
বমন করিবে বারি তাহার প্রহারে।।
তাহাতে ঘটিবে তব অপরূপ রূপ।
হবে সে ললনাদলে জলযন্ত্ররূপ।।
অঙ্গ সঙ্গ হেতু যদি গ্রীষ্ম বোধ হয়।
গরজিয়ে বালা বৃন্দে দেখাইও ভয়।। (৬৩)
স্বর্ণ শতদল যুত মানসের জল।
পান করি বহিবে হে সমীর শীতল।।
উড়াইয়ে দিও কল্পতরু স্থিত কেতু।
অনন্তর ঐরাবত প্রীতি বৃদ্ধি হেতু।।
নীলচেলী সমাসৌম্য শরীর তোমার।
ক্ষণকাল তার মুখে করিও বিস্তার।।
ছায়াশূন্য স্ফটিক সদৃশ গিরিবরে।
হে পয়োদ ! প্রবেশ করিও তার পরে।। (৬৪)
————————————
টীকা
1. ব্রহ্মাবর্ত্ত দেশে এইক্ষণে সরস্বতী নদী বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। ফলতঃ ব্রহ্মাবর্ত্তের আধুনিক সময়ের হিন্দুদিগের মধ্যে প্রকৃত সরস্বতী বহুদিন হইল বিলুপ্ত হইয়াছেন। কুরুক্ষেত্রের বর্ত্তমান নাম পানীপথ অর্থাৎ পানীয় পতিত ; ইহাতেই সরস্বতীর এক সময়ে আবির্ভাব ছিল – এমন প্রমাণ প্রাপ্তি হইতেছে।
2. বর্ত্তমানে কনখল হরিদ্বারের একক্রোশ পূর্ব্বে গঙ্গা ও নীলধারার সংযোগ স্থলে একটি ক্ষুদ্র জনপদ। এক সময়ে কনখলের পরিসর বহু বিস্তৃত ছিল। পৌরাণিক দক্ষযজ্ঞের এই স্থানে অনুষ্ঠান হয়। লিঙ্গ পুরাণের মতে কনখল গঙ্গা ধারার সমীপবর্ত্তী স্থানে অবস্থিত।
3. সরল বৃক্ষ অতি ঋজুভাবে তুষারাবৃত প্রোচ্চ পর্ব্বত শেখরে জন্মে। ইহার উদ্ভিদ তত্ত্ব ঘটিত নাম Pinus Longifolia. কোন অনভিজ্ঞ বাঙ্গালা কোষকার সরল শব্দে শাল বৃক্ষ লিখিয়াছেন। শালবৃক্ষের সহিত সরল বৃক্ষের কোন বিষয়ে ঐক্য নাই। শাল এবং সরল যে বিভিন্ন প্রকার বৃক্ষ তাহা বাল্মীকি রচিত গঙ্গাস্তোত্রে প্রকাশ পাইতেছে।
4. মৃগ জাতি বিশেষ।
5. মুরজ – মৃদঙ্গ ভেদ হইতে পারে। যেহেতু মুরজ ফলা পনস বৃক্ষের নাম। কাঁঠালের আকৃতি মৃদঙ্গ তুল্য।
6. ক্রৌঞ্চরন্ধ্র – ভারতবর্ষ হইতে তিব্বতে যাইবার অন্যতম পথ। এই গিরিবর্ত্ম অদ্যাপিও বর্ত্তমান আছে।
7. Quotation from the Ramayana
—————————
অনুবাদ : রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়
Leave a Reply