০৬. সমুদ্র ঘোষ জাতক
“হে দেবতে, যে প্রিয়” ইহা ভগবান বুদ্ধ জেতবনে অবস্থানকালে যশোধরা দেবী সম্পর্কে বলেছিলেন।
একদা ভিক্ষুগণ শ্রাবস্তীর বিহারে ধর্মসভায় উপবিষ্ট হয়ে এরূপ কথার উত্থাপন করলেন–“অহো বন্ধুগণ, আমাদের শাস্তা গৃহে অবস্থান কালে যশোধরা দেবীকে পাওয়ার জন্য অন্যের অসাধ্য অসাধারণ মহাশিল্প ধনুর্বিদ্যা দেখিয়ে স্বীয় পত্নীরূপে তাঁকে লাভ করেছেন।” তখন তথাগত বুদ্ধ সে ধর্মসভায় এসে প্রজ্ঞাপ্ত বুদ্ধাসনে উপবেশন করে ভিক্ষুসংঘকে বললেন–“এখন তোমরা কি বিষয়ের আলোচনা নিয়ে এখানে উপবিষ্ট আছ? তখন ভিক্ষুগণ তাঁদের আলোচ্যমান বিষয় যথাযথভাবে বুদ্ধের নিকট প্রকাশ করলে, বুদ্ধ বললেন–“হে ভিক্ষুগণ, আমি শুধু যে এখন যশোধরা দেবীকে এরূপে লাভ করেছি তা নয়, পূর্বে ও তাকে স্ত্রীত্বে বরণ করবার জন্য বিরাট রাজ্যশ্রী, এমন কি মাতাপিতাকে পর্যন্ত ত্যাগ করে অন্যরাজ্যে গিয়েছিলাম।” এ বলে বুদ্ধ নীরব হলেন। তখন ভিক্ষুদের প্রার্থনায় তিনি সে পূর্বকাহিনী বলতে আরম্ভ করলেন–
“হে ভিক্ষুগণ, অতীতে কাশীরাজ্যে ব্রহ্মপুর নামক এক নগর ছিল। সে নগরে ‘বন্ধুমিত্র’ নামক এক রাজা সাম্যভাবে ধর্মতঃ রাজত্ব করতেন। তাঁর অগ্রমহিষীর নাম ছিল ‘দেবধীতা’। তৎকালে বোধিসত্ত্ব তাবতিংশ স্বর্গ হতে চ্যুত হয়ে দেবধীতা দেবীর জঠরে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করেছিলেন। দশমাস পর তিনি বিবিধপুণ্য লক্ষণ সম্পন্ন সুবর্ণ বর্ণ এক পুত্র সন্তান প্রসব করলেন। বোধিসত্ত্ব ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্রই মহাসমুদ্র সগর্জনে বা সঘোষে সংক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। তাই পিতা তাঁর নাম রাখলেন ‘সমুদ্র ঘোষ। সমুদ্র ঘোষ ষোল বৎসর বয়ঃক্রমকালে সর্বাবিধ শিল্পে নৈপুণ্য লাভ করলেন।
তাঁর অনুপম রূপলাবন্যের কথা সমগ্র জম্বুদ্বীপে প্রচারিত হল। সে সময় জম্বুদ্বীপে ‘রম্যপুর’ নামক এক নগর ছিল। সে নগরে “শ্রীসিহন গুপ্ত” নামক একরাজা রাজত্ব করতেন। এ রাজার অগ্রমহিষীর নাম ছিল কনকবতী। কনকবতীর ‘বন্ধুমতী’ নাদী এক কন্যা ছিল। সে ছিল অপরূপ রূপলাবণ্যবতী দেবলোকের অপ্সরার মত মনোহর রূপ তাঁর। রাজকন্যা বন্ধুমতী যেমন রূপবতী, তেমন শীলবতী ও গুণবতী ছিলেন। তিনি যখন বয়স্কা হলেন রাজকুমার সমুদ্র ঘোষের রূপ গুণের কথা শুনে স্বতঃই তাঁর অন্তরগহনে তীব্র অনুরাগের সঞ্চার হল এবং তাঁকে দর্শনেরও বলবতী ইচ্ছা জাগ্রত হল। এমন সময় বন্ধুমতীর পিতা শ্রীসিহন গুপ্ত স্বীয় রাজ্যের মধ্যস্থলে দেবতা পূজার জন্য “দেবকুল” নামক এক দেবগৃহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রাজা সর্বদা অমাবস্যা, পূর্ণিমা ও অষ্টমী দিবসে দেবকুল গৃহে উপস্থিত হয়ে দেবতার উদ্দেশ্যে সশ্রদ্ধ অন্তরে বন্দনা ও পূজা করতেন। একদা রম্যপুরের রাজকন্যা বন্ধুমতী এক সুবর্ণ স্যন্দনে আরোহণ করে বহু সখী ও দাসী পরিবৃতা হয়ে শ্বেতছত্র ধারণ করে তুর্যধ্বনি নিনাদিত করে রাজবাড়ী হতে বের হলেন দেবকুলের পূজার জন্য। তিনি মহা আড়ম্বরে অনুক্রমে দেবকুল গৃহে প্রবেশ করে অত্যাধিক ভক্তি সহকারে বন্দনা ও পূজা করে একান্তে দাঁড়িয়ে শিরোপরি কৃতাঞ্জলি হয়ে নিন্মোক্ত শ্লোকে বললেন–
১। “হে দেবতে, যে প্রিয়, সুরূপ ও মনোহর বলে আমি সৰ্ব্বদা শুনে আসছি, যাকে আমি সতত মানস নেত্রে দর্শন। করছি, তার নাম “সমুদ্র ঘোষ।” এ রাজ পুত্র মহাঋদ্ধিবান। তিনি সর্বদা আমার অন্তর বিচলিত করছেন।”
এবলে রাজধীতা সেখানেই দাঁড়িয়ে দেবতাদের নিকট প্রার্থনা করলেন।
২। “এখানে অবস্থানকারী মহাপ্রভাবশালী দেব, আমার মনোরথ পূর্ণ করুন, আমি আপনার বরলাভ করে আশা পূর্ণ হলে পুনরায় আপনার পূজা করব।”।
এবলে রাজকন্যা দেবতাকে বন্দনা করে রাজান্তঃপুরে চলে গেলেন। তখন চারজন ব্রাহ্মণ ‘রম্যপুর নগর হতে বের হয়ে। গ্রামান্তরে যাচ্ছিলেন। তাঁরা অনুক্রমে গিয়ে ব্রহ্মপুর প্রাপ্ত হলেন। নগর অভ্যন্তরে প্রবেশ করার ইচ্ছায় নগর-দ্বার সমীপে তাঁরা দাঁড়ালেন, এমন সময় রাজকুমার সমুদ্রঘোষ উদ্যানক্রীড়ায় গমন মানসে শ্রেষ্ঠ হস্তীস্কন্ধে আরোহণ করে শ্বেতছত্র ধারণ পূর্বক চতুরঙ্গ সেনায় পরিবৃত হয়ে উদ্যানাভিমুখে অগ্রসর হলেন। পথিমধ্যে রাজপুত্রকে দেখে ঐ ব্রাহ্মণগণ সমস্বরে বলে উঠলেন–“রাজ কুমারের জয় হোক।” তখন বোধিসত্ত্ব তাঁদের জিজ্ঞাসা করলেন–
৩-৪। “ভদ্রগণ, আপনারা অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে কোথা হতে এসে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন? আপনাদের জিজ্ঞাসা করছি যে আপনারা কি জন্য এরাজ্যে এসেছেন? ভোগ সম্পদের জন্য না কি অন্য কোন্ কারণে? আমাকে শীঘ্রই বলুন।” ইহা শুনে ব্রাহ্মণগণ বললেন–
৫। “দেব, আমরা অনুপম রম্যপুর নগরে বাস করি। আপনাকে দর্শনেচ্ছায় এখানে এসেছি।”
ইহা শুনে মহাসত্ব তাদের বললেন–“ভদ্র ব্রাহ্মণগণ, আসুন আমরা সকলেই উদ্যান ক্রীড়া করব।” এবলে ব্রাহ্মণগণ সহ উদ্যান-অভিমুখে অগ্রসর হলেন। বোধিসত্ত্ব উদ্যানে প্রবেশ করে ব্রাহ্মণগণ সহ স্বীয় পরিষদ বর্গের সঙ্গে উদ্যান ক্রীড়া সমাপন করে একস্থানে উপবেশন করলেন। তখন রাজপুত্র ব্রাহ্মণগণকে সম্বোধন করে বললেন–
৬। “মহোদয়গণ, আপনাদের নগরে যদি কোন আশ্চর্য বিষয় থাকে, আমাকে তা বলুন। আমি তা জানতে একান্তই ইচ্ছুক।”
ইহা শুনে ব্রাহ্মণগণ বললেন–“দেব, আমাদের রাজার নাম শ্রীসিহন গুপ্ত।” তাঁর অগ্রমহিষীর নাম “কনকবতী দেবী।” তাঁর এক কন্যা আছে। নাম “বন্ধুমতী।” রাজকন্যা অত্যন্ত অভিরূপা, দর্শনীয়া, প্রসাদিকা, সৌভাগ্যবতী, মনোহরা, দেবারীনিভা ও পুণ্যলক্ষণ সম্পন্না। সমগ্র জম্বুদ্বীপের রাজাগণ এ রাজ কন্যার রূপশ্রীর কথা শুনে প্রত্যহ বহু উপহার সহ এসে তাঁকে প্রার্থনা করছেন। কিন্তু আমাদের রাজা কারো প্রার্থনা পূর্ণ করছেন না। দেব, ইহাই আমাদের নগরের আশ্চর্য কথা। রাজ কুমার ব্রাহ্মণদের কথা শুনে আনন্দে উফুল্ল হয়ে প্রত্যেক ব্রাহ্মণকে যথেষ্ট সম্মান, সত্ত্বার করে পঞ্চশত হিসাবে সুবর্ণ মুদ্রা প্রদান করলেন। তৎপর তিনি সূর্যাস্তের পর নগরে প্রবেশ করে স্বীয় প্রাসাদে উপস্থিত হলেন। পরদিবস তিনি পিতামাতার নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন–
৭-৮। “পূজাৰ্হ মাতঃ পিতঃ আমি রম্যপুর গমনের ইচ্ছা করছি। তজ্জন্য আপনাদের অনুমতি প্রার্থনা করছি। তথা হতে পুনঃ এ রাজান্তঃপুরে প্রত্যাবর্তন করব। রম্যপুরের রাজকন্যা দেবকন্যার ন্যায় অনুপম রূপবতী। তাকে দর্শন মানসে আমি তথায় যেতে ইচ্ছা করি।”
কুমারের একথা শুনে রাজরাণী উদ্বিগ্ন হৃদয়ে পুত্রকে আলিঙ্গন করে তাঁরা শির চুম্বন করার পর অপূর্ণ নেত্রে তাঁর গমন নিবারণ মানসে বললেন–
৯-১০। তুমি আমাদের উভয়েরই প্রিয়পুত্র। তোমার পিতা রাজা, এবং তোমার মাতা রাজ মহিষী। তুমি আমাদের নিকট হতে পৃথক হলে, তোমায় সতত দর্শনে বঞ্চিত হব। তুমি যে কন্যাকে ইচ্ছা করছ, তাকে এখানে আনবার জন্য তথায় দূত পাঠিয়ে প্রার্থনা জানাব।”
রাজপুত্র পিতা মাতার একথা শুনে তাদের বন্দনা করে নিজের প্রাসাদে চলে গেলেন। তথায় নিজের আবরণ ভাণ্ডটি গ্রহণ করে তা অমাত্য পুত্রের হস্তে দিলেন। তারপর তিনি তাকে সাথে করে ব্রাহ্মণ চতুষ্টয় সহ রম্যপুরের দিকে যাত্রা করলেন। বোধিসরে অনুভাববলে দেবতাগণ দীর্ঘপথ সংক্ষেপ করে দিল। তাই সে ছয়জন একরাত্রে শতযোজন পথ অতিক্রম করে প্রাতেই রম্যপুরে উপস্থিত হলেন। সে বিষয় প্রকাশ মানসে সৰ্ব্বজ্ঞবুদ্ধ নিন্মোক্ত গাথাযোগে বললেন–
১১। “দেবগণ, তাঁদের প্রতি অনুকম্পা করে পথ সংক্ষেপ করেছিলেন। রাত্রি শেষ হওয়ার পরই তাঁরা ব্রহ্মপুর সপ্রাপ্ত হলেন।”
অতঃপর রাজকুমার এ পাঁচজনকে সঙ্গে নিয়ে বহির্নগর দ্বার-সমীপে এক পান্থশালায় প্রবেশ করে নিরাপদ স্থানে উপবেশন করলেন। সে দিবসে শ্রী সিহনগুপ্ত রাজা বিপুল পূজোপচার লয়ে দেবকুল পূজা করে তথায় একপ্রান্তে উপবেশন করলেন। তারপর রাজকন্যা বন্ধুমতী সুবর্ণ স্যন্দনে আরোহন করে বহু সখী দাসী সহ দেবকুল গৃহে গিয়ে রাজার নিকট উপবেশন করলেন। তখন রাজপুত্র মহামূল্য অলঙ্কারে বিভূষিত হয়ে উক্ত পাঁচজনকে সাথে করে দেবকুল গৃহের দিকে অগ্রসর হলেন। তখন যে কোন মানুষ দেব প্রভাব সম্পন্ন বোধিসত্ত্বের সম্মুখে স্থিত হতে সক্ষম হল না। তিনি দেবলীলায় ও নিজের বিলাস লীলায় দেবকুল গৃহে প্রবেশ করে রাজার পুরোভাগে বসে বীণাবাদ্য করতে আরম্ভ করলেন–। রম্যপুর নগর দীর্ঘপ্রস্থে সপ্তযোজন ছিল। বোধিসত্ত্বের বীণার শ্রুতি মধুর মনোমুগ্ধকর ঝঙ্কার তার তেজ-প্রভাবে সমগ্র রম্যপুর নগর পরিব্যাপ্ত হল। তখন শ্রী সিহনগুপ্ত রাজা বীণার সুমধুর নিক্কন শুনে আশ্চর্য হয়ে অনিমেষ নেত্রে বোধিসত্ত্বের দিকে চেয়ে রইলেন। তাঁর বীণা বাদনে প্রসন্ন হয়ে রাজা ব্রাহ্মণদের জিজ্ঞেস্ করলেন–
১২। “ওহে ভদ্রগণ, এ বাণীবাদক যুবকটি কার পুত্র?” ব্রাহ্মণগণ বললেন–“মহারাজ, ইনি ব্ৰহ্মপুর নগরের বন্ধুমিত্র রাজার পুত্র, নাম ‘সমুদ্রঘোষ। গাথাযোগে বললেন–
১৩। রাজন, এ বীণা বাদন কারীর নাম “সমুদ্রঘোষ”। ইনি ব্রহ্মপুর রাজ্যবাসী বন্ধুমিত্র রাজার পুত্র।”
রাজা তাঁদের কথা শুনে আসন হতে উঠে বোধিসত্ত্বকে বক্ষে জড়িয়ে ধরে তার শির চুম্বন করলেন এবং সাদরে বললেন–“বাবা কুমার, কেন তুমি তোমার রাজ্যশ্রী ত্যাগ করে এখানে এসেছ?” কুমার বললেন–মহারাজ, আমি আপনার গুণ-কীর্তি শুনে, আমার এ দেহকে সানন্দে আপনার দাসরূপে সমর্পণ করবার ইচ্ছায় এখানে এসেছি।” এ কথা শুনে রাজা প্রীতিফুল্ল চিত্তে সে দেবকুল গৃহেই নিজের কন্যার সাথে বোধিসত্ত্বকে বসালেন এবং তাঁদের হস্তদ্বয় গ্রহণ করে সুবর্ণ ভৃঙ্গার হতে জল ঢেলে উভয়ের আবাহ-বিবাহ মাঙ্গলিক কার্য সম্পন্ন করলেন। তারপর দম্পতি যুগলকে সুবর্ণ স্যন্দনে বসিয়ে বিরাট শোভা যাত্রা সহকারে রাজপ্রাসাদে নিয়ে এলেন। তখন শ্রী সিহনগুপ্ত রাজা নানাবিধ উপহার দ্রব্য সজ্জিত করে সপরিষদ দু’জন রাজদুত দ্বারা তা ব্ৰহ্মপুর নগরে প্রেরণ করলেন। তাঁরা অনুক্রমে ব্ৰহ্মপুর নগরে প্রবেশ করে বন্ধুমিত্র রাজার নিকট উপস্থিত হয়ে, তাকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শনের পর উপহারগুলি প্রদান করে বললেন–“মহারাজ আমাদের রাজা আপনার সাথে মিত্ৰতা করতে ইচ্ছুক। অপিচ সমগ্র জম্বুদ্বীপের রাজাগণ আমাদের রাজকন্যা যাচ্ঞা করলেও তিনি কাকেও দেননি। কিন্তু আপনার পুত্রকে দেখামাত্র তার শির চুম্বন করে তাকে কন্যা সম্প্রদানের ইচ্ছা পোষণ করেছেন। তাই আপনাকে সে কারণ জ্ঞাপনার্থ আমাদিগকে আপনার নিকট পাঠিয়েছেন। রাজা এ খবর পেয়ে অতিশয় সন্তোষ হলেন এবং পরদিবস চতুরঙ্গ সেনাবাহিনী পরিবেষ্টিত হয়ে স্বীয় প্রধান মহিষী সহ ব্ৰহ্মপুর নগর হতে যাত্রা করে অনুক্রমে। রম্যাপুর নগরের বহ্রিদ্বারে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তখন শ্রী সিহনগুপ্ত রাজা বন্ধুমিত্র রাজার আগমন সংবাদ শুনে কুমার সমুদ্রঘোষ সহ মহাপরিষদ সমভিব্যাহারে এসে সসম্মানে সপরিষদ তাঁকে আগু বাড়িয়ে স্বীয় প্রাসাদে নিয়ে গেলেন। সে দিনই রাজা দেবলোকের ন্যায় নগর সুসজ্জিত করে উভয়ের আবাহ-বিবাহ মাঙ্গলিক কার্য সম্পন্ন করলেন। তখন শ্রীসিহন রাজা ও বন্ধুমিত্র রাজা, উভয় ক্ষত্রিয় বৈবাহিক সুত্রে আবদ্ধ হয়ে এক পালঙ্কে বসে একই সুবর্ণ পাত্রে ভোজন করলেন। অতঃপর রাজা বন্ধুমিত্র রম্যপুরের রাজার সাথে প্রিয়বাক্যে নিন্মোক্ত গাথা ভাষণ করলেন–
১৪। ১৫। “রাজ পূর্ণচন্দ্র যেমন নক্ষত্রের চেয়েও অতিশয় বিরোচিত হয়, সেরূপ আমিও পরিষদ মধ্যে সর্বদা বিরোচিত হই। আমার রাজ্য আর আপনার রাজ্য দ্বিভাগ হলেও এক বলে মনে করবেন। আপনার দুঃখ হলে তা আমারই দুঃখ, আমার দুঃখ হলে তা আপনারই দুঃখ বলে ধারণা করবেন।” আর এবাক্য শুনে শ্রীসিহন গুপ্ত রাজা নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
১৬। “রাজন, আপনার এবাক্য অতি উত্তম, আমাদের উভয়ের রাজ্য একরাজ্য বলেই ধারণা সকল সময় চিন্তা করব।”
অতঃপর বোধিসত্ত্বের পিতা-মাতা উভয়ে সপরিষদ শ্রীসিহনগুপ্ত রাজার নিকট বিদায় নিয়ে রম্যপুর নগর হতে স্বীয় রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করলেন। কুমার সমুদ্রঘোষ রম্যনগরে রাজকন্যার সাহচর্যে অবস্থান করে দিব্য সুখের ন্যায় অভূতপূর্ব সুখ পরিভোগ করতে লাগলেন। সে বিষয় প্রকাশ মানসে জগৃজ্যোতিঃ বুদ্ধ নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
১৭। তদবধি সমুদ্র ঘোষ তথায় দীর্ঘদিন যাবৎ অবস্থান। করে রাজকন্যা সহ সর্বদা ইহলৌকিক সর্বসুখ পরিভোগ করছিলেন।
অতঃপর সমুদ্র ঘোষের পত্নী বন্ধুমতী পূর্বে যে দেবতার সমীপে পূজা দেওয়ার জন্য মানত করেছিলেন, তদনুরূপ পূজা দেবার ইচ্ছায় স্বামীকে বললেন–“মিন, আমি দেবকুলের সমীপে পূজা দেওয়ার জন্য মানত করেছিলাম। আমার আশা যখন পূর্ণ হয়েছে, তাই আজ দেবতাকে পূজা দেব। ইহা শুনে। বোধিসত্ত্ব বললেন–“ভদ্রে, তখন তুমি কি প্রার্থনা করে মানত করেছিলেন?” রাজকন্যা বললেন–
১৮। “দেব, আপনাকে বিবিধ গুণবত্তার কথা শুনে আমি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। আমার মনশ্চক্ষে রাত দিন কেবল আপনাকেই দেখেছি, আপনার কথাই চিন্তা করেছি। আমার একমাত্র কামনা–আপনার সাথে আমার মিলন হউক, মধুর মিলন, যুগল মিলন। দেবতার নিকট কেবল প্রার্থনা আমার আশা পূর্ণ করুন’ আমি পূজা দেব।” আমার আশানুরূপ প্রার্থনা পূর্ণ হয়েছে। চলুন প্রাণেশ্বর, দেবমন্দিরে যাই। আজ আমরা উভয়ে দেবপূজা করব। “ইহা শুনে বোধিসত্ত্ব প্রীত হয়ে বললেন–
১৯। ২০। “ভদ্রে, ব্রাহ্মণের মুখে যেদিন তোমার রূপগুণের কথা শুনেছি, সেদিন হতেই সর্বদা তোমার কথা চিন্তা করে উন্মাদের মত হয়েছিলাম।
২১। তোমাকে পাওয়ার ইচ্ছায় আমি স্বীয় রাজ্য, ধন-জন ও পিতা-মাতা সবাইকে ত্যাগ করে তোমার নিকট ছুটে এসেছি।”
তখন রাজপুত্র স্বীয় পত্নী বন্ধুমতী সহ দেবকুল-গৃহে গিয়া পূজা-সকার সম্পাদনের পর পুনঃ উভয়ে আপন প্রাসাদে প্রত্যাবর্তন করলেন। এরূপে বোধিসত্ত্ব তথায় একবৎসরকাল অতিক্রমের পর উদ্যান ভ্রমনের তার ইচ্ছা উৎপন্ন হল। তাই তিনি সস্ত্রীক এক সুবর্ণ স্যন্দনে আরোহণ করে সপরিষদ উদ্যানাভিমুখে যাত্রা করলেন। তৎকালে এক বিদ্যাধর কৈলাস পর্বতের রৌপমান শিখরে পত্নী সহ বিচিত্র সুন্দর পুষ্পমাল্য বিভূষিত হয়ে আনন্দ উপভোগ করার পর একহস্তে খড়গ এবং অপর হস্তে এক পাতকা ধারণ করে ভার্যাকে স্বীয় জানুতে বসিয়ে আকাশ পথে গমন করতে লাগল। তখন সুবর্ণময় সুদর্শন পর্বত কুটে একাকী বাসকারী অপর এক বিদ্যাধর তথায় একাকীই ক্রীড়া করে মালার ইত্যাদি নানাবিধ পুষ্পে নিজকে বিভূষিত করল এবং ঢাল-খড়গে সজ্জিত হয়ে সুদর্শন পর্বত শিখর হতে আকাশ-পথে চলতে লাগল। কৈলাস কুটপর্বতবাসী বিদ্যাধরের নাম ছিল রণাভিমুখ। আর সুদর্শন পর্বত কুটবাসী বিদ্যাধরের নাম ‘রণাপতিতা। এরূপে তারা আকাশপথে গমন কালে পরস্পর সম্মুখীন হল। সুদর্শন পর্বত বাসী বিদ্যাধর কৈলাস-কুট-পর্বতবাসী বিদ্যাধরকে দেখে বলল–“হে, তোমার নাম কি?” ইহা শুনে সে বলল–আমার নাম ‘রণাভিমুখ। তুমি আমাকে জাননা?’ এরূপে উভয়ে বাবিতণ্ডা আরম্ভ করে ক্রোধান্বিত হয়ে আকাশেই যুদ্ধ আরম্ভ করল। ইহাতে-রণাভিমুখ বিদ্যাধর পরাজিত হল। তৎপর রণাপতিত বিদ্যাধর রণাভিমুখের ভার্যালয়ে প্রস্থান করল। তখন রণাভিমুখের দেহের খড়ুগাহত স্থান হতে নিরন্তর রক্ত নিঃসরণ বিধায় লাক্ষা রসেন করার ন্যায় হয়েছিল। সে রণাভিমুখ বিদ্যাধর স্মৃতি ও ধৈর্য ধারণ করতে অসমর্থ হয়ে খড়গ হস্তে বোধিসত্ত্বের উদ্যানে পতিত হল। বোধিসত্ত্ব উদ্যানে প্রবেশ করে পত্নী সহ উদ্যান ক্রীড়া সমাপ্তির পর উদ্যানের মধ্য স্থলে সুনির্মিত উদ্যান-প্রাসাদে প্রবেশ করলেন। তথায় পত্নীকে রেখে পুরোহিত পুত্র এবং অমাত্য পুত্রকে সম্বোধন করে বললেন–“ওহে, এস এখন আমরা উদ্যানের বৃক্ষ-বনান্তরে ক্রীড়া করব।” এবলে তারা তথায় যাওয়ার সময় দূর হতে ঐ বিদ্যাধরকে দেখতে পেয়ে তার নিকট উপস্থিত হলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন–‘তুমি কিজন্য এখানে এসেছ? সে বলল মন, আমরা দু’জন বিদ্যাধর আকাশেই যুদ্ধারম্ভ করেছিলাম। আমি পরাজিত হয়ে এখানে পতিত হয়েছি। রাজকুমার ইহা শুনে কারুণ্য চিত্তে নিজেই তাকে উঠিয়ে উদ্যান-প্রাসাদে নিয়ে গেলেন। তথায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হল। চার পাঁচ দিনের মধ্যেই সে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করল। এতে বিদ্যাধর। রাজপুত্রের উপকারের প্রত্যুপকার স্বরূপ ওর খখানা তাঁকে দান করে বলল–“এখক্ষ মহাতেজস্বী ও মহানুভাব সম্পন্ন। ইহা আপনি হস্তে ধারণ করে আপনার ইচ্ছানুযায়ী ভূমি প্রদেশে
ও আকাশ মার্গে দ্রুত বেগে গমন করতে পারবেন।” এ বলে। খখানা সমুদ্র ঘোষকে প্রদান করল। তৎপর সে স্ব-স্থানে চলে গেল। অতঃপর কুমার পত্নী বন্ধুমতীকে সম্বোধন করে বললেন–
২২। “ভদ্রে, আমি এখন মনোরম হিমালয়ে যেতে ইচ্ছা করছি। তুমিও আমার সাথে এস।”
এবলে মহাসত্ত্ব স্ত্রীকে নিজের জানুর উপর বসায়ে খক্ষখানা হস্তে ধারণ করে আকাশে উত্থিত হলেন এবং আকাশ পথে উত্তরাভিমুখে যেতে লাগলেন। নি প্রদেশে তারা অনেক পর্বত দেখতে পেলেন। আরো কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর দেখলেনএক রৌপ্যময় পর্বত। তৎপর সুবর্ণময় পর্বত, এরপর অপর এক রৌপ্যময় পর্বতের পর দেখলেন হিমালয় পর্বত। এ। গিরিরাজ শতকূট ও সপ্ত রতনময় চুরাশি হাজার শিখর মালায় পরিশোভিত। পঞ্চশত যোজন উচ্চ, উহা নানাবিধ কল্পবৃক্ষ প্রতিমণ্ডিত, বিভিন্ন প্রকার কিন্নর-কিন্নরী ও পক্ষী মৃগ সমাকুল এবং হস্তী, অশ্ব, সিংহ, ব্যাঘ্র, গণ্ডার, ভল্লুক ও তরঙ্কু প্রভৃতি হিংস্রপ্রাণী সমাকীর্ণ। অতঃপর রাজপুত্র হিমবন্ত পর্বতে অবতরণ করলেন। তথায় বিবিধ বর্ণের পুষ্প নিচয়ে উভয়ে। সজ্জিত হলেন ও নানাবিধ ফলমূল সংগ্রহ করে ভক্ষণ করলেন।
তৎপর নানাপ্রকার হংস ও পঞ্চবিধ পদ্ম সমাচ্ছন্ন এক সরোবরে উভয়েন ও জলপান করলেন। তথায় তারা ভ্রমন করে বহু পর্বত ও গুহা দেখলেন। একটি গুহায় প্রবেশ করে এক দিবারাত্র বাস করলেন।
এদিকে রমপুরের উদ্যানে সমুদ্র ঘোষের সঙ্গে আগত অমাত্য প্রমুখ জনগণ তাকে ও রাজকন্যাকে না দেখে তারা সমস্ত উদ্যান অন্বেষণ করলেন। কোথাও তাদের না দেখে তারা এসে শ্রীসিহন গুপ্ত রাজাকে এবিষয় জ্ঞাপন করলেন। ইহা শুনে রাজা চিন্তিত হয়ে এক অমাত্যকে বললেন–“হে ভদ্র, তুমি এখন ব্রহ্মপুরে গিয়ে আমার সুহৃদ বন্ধুমিত্র রাজাকে এবিষয় বল-” তিনি তখনি রাজাদেশ প্রতিপালন করলেন, ব্রহ্মপুর নগরে উপস্থিত হয়ে রাজাকে বললেন–
২৩। নরেন্দ্র, আপনার পুত্র সমুদ্রঘোষ ও তৎপত্নী বন্ধুমতীকে আমাদের সেখানে কোথাও দেখছিনা। আপনার পুত্র কি এখানে এসেছেন? তা অবগতির জন্য রাজা আমাকে আপনার নিকট পাঠিয়েছেন।
রাজা চিন্তিত হয়ে বললেন–তারা ত এখানে আসেনিই গেল কোথায়?
২৪। অমাত্য প্রবর, এ যে খুব চিন্তার বিষয়, তারা কোথায় গেল। আমার নিকট আসেনি। এখানে তাকে কোথাও কেহ দেখেনি।” ইহা শুনে রাণী দেবধীতা বললেন–
২৫। দেব, উপায় কি? এখন কি করা যায়? আপনিও তাকে কি করে দেখবেন। বোধ হয় পূর্ব কর্মের বিপাকবশে তারা নষ্ট হয়েছে।”
ইহা শুনে বন্ধুমিত্র রাজা দুঃখিত ও বিমর্য হলেন এবং রাজা-রাণী উভয়ে বক্ষে করাঘাত ও ক্রন্দন করে বললেন–
২৬। হায় হায়, পুত্র ও রাজ্য উভয় নষ্ট হল। তারা কোথায় গেল? আমরা কিরূপে জীবিত থাকব?
২৭। কোন রাজ্যে বা দেশে তাদের কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছেনা। তাদের অদর্শনে আমরা এখন সুখ লাভে বঞ্চিত।
অতঃপর রাজা-রাণী অমাত্যকে উপহার দিয়ে বিদায় করার পর পুত্রবিয়োগ দুঃখে ম্রিয়মান হলেন। উক্ত অমাত্যও স্বীয় দেশে প্রত্যাবর্তন করে রাজাকে সমুদ্রঘোষের পিতার খবর বললেন–
২৮। “রাজন, বন্ধুমিত্র রাজা পুত্রকে দেখেননি। তাঁরা খবর পেয়ে অতীব বিলাপ করছেন।”
তা শুনে রাজা অতিশয় দুঃখিত হলেন। অতঃপর রাজকুমার হিমবন্তে দু’মাসেরও অধিককাল অবস্থান করে পুনঃ আকাশ পথে যেতে লাগলেন। কৈলাস পর্বতের কুট প্রদেশে সুবৰ্ণ নামক এক স্থানে কিন্নর কিন্নরিগণ বাস করে। কিন্নর রাজ। বিদ্যাধরের নাম ছিল ‘দুমরাজ। বোধিসত্ত্ব দেবীর সহিত আকাশ পথে যাওয়ার সময় দেবনগর সদৃশ সে স্থানটি দেখে তথায় অবতরণ করলেন এবং এ মনোহর সুবর্ণ নগরে দেবরাজ-লীলায় ও স্বীয় বিলাস লীলায় প্রবেশ করলেন। দুমরাজ বোধিসত্ত্বকে দেখে ‘একুমার সমুদ্র ঘোষ হবে। এ চিন্তা করে বললেন–এস, বাবা, আমার সাথে একাসনে উপবেশন কর।” ইহা শুনে বোধিসত্ত্ব ভার্ষাসহ তথায় কিন্নর রাজার সঙ্গে একাসনেই উপবেশন করলেন। তখন কিন্নর রাজ বোধিসত্ত্বকে আলিঙ্গন ও শির চুম্বনের পর বললেন–
২৯। “এ নগর অত্যন্ত মনোরম। ইহা পুণ্যকামীদের জন্য উৎপন্ন হয়েছে। স্বর্ণালঙ্কার সমলস্কৃত এ শ্রেষ্ঠ রাজ্য তোমাকে দিচ্ছি।” দুমরাজের কথা শুনে রাজকুমার বললেন–
৩০। “রাজন, ইহা আপনার সাধুবাক্য। আপনার নিকট আমরা অবস্থান করব। এ পর্বতে মাসেক কাল বাস করে ইচ্ছামত আনন্দ উপভোগ করব।”
তখন রাজপুত্র কৈলাসকুটে মাসাধিক কাল বাস করে দুমরাজের নিকট হতে বিদায় নিয়ে আকাশ পথে বহুদূর যাওয়ার পর দেখলেন চারধারে মনোরম ঘাঠযুক্ত সপ্ত রত্নময়
অনোবতপ্ত হ্রদ। এ চার ঘাটের মধ্যে এক ঘাঠে দেবতাগণমান। করেন। একঘাঠে দেবকন্যাগণ, একঘাঠে যক্ষগণ এবং অপঘাঠে বিদ্যাধরগণ লন করেন। সমুদ্রঘোষও দেবীসহ আকাশ হতে অবতরণ করে সে অনোবতপ্ত হ্রদে জল ক্রীড়া করে মাসেককাল তথায় বাস করলেন। পুনঃ সেখান হতে আকাশ পথে যাওয়ার সময় ছদ্দন্ত হ্রদ দৃষ্টি গোচর হল। এ হ্রদের পরিমণ্ডল পরিক্ষেপ ছয়ত্রিশ যোজন পরিমাণ। এ হ্রদে কোন শৈবাল বা পানাদি কিছুই নেই। এ হ্রদটি রৌপ্য, সুবর্ণ মনি, জাতি, হিঙ্গুল, অঞ্জন ও সেল এ ষড়রত্নময় পর্বতদ্বারা পরিবেষ্টিত। মহাসত্ত্ব এরূপ মনোরম ছদ্দন্ত হ্রদ দেখে আকাশ হতে অবতরণ করে সে হ্রদ তীরে স্থিত হলেন। মহাসত্ত্ব জাতিস্মর জ্ঞান সম্পন্নছিলেন। তিনি তাঁর পূর্ব নিবাস স্মরণ করে দেবীর সহিত এরূপ আলাপ করলেন
৩১। “আমি এক পূর্বজন্মে এ মনোহর হ্রদে হস্তীদের প্রধান মহাঋদ্ধিবান নাগরাজ ছিলাম।
৩২। ভদ্রে এ ছদন্ত সরোবরে আট হাজার হস্তীর মধ্যে আমিই সর্বশ্রেষ্ঠ বলশালী হস্তীরাজ ছিলাম।”
বন্ধুমতী দেবীও তথায় সেরূপ জাতিস্মর জ্ঞান লাভ করে স্বামী সমুদ্রঘোষকে বললেন–
৩৩। “দেব, আমিও পূর্বজন্মে এ ছদন্ত সরোবরে সুভদ্রা নামিকা হস্তিনী হয়ে এখানে আপনার নিকট বাস করেছিলাম নয় কি?”
এরূপে উভয়ে পরস্পর আলাপের পর ছদ্দন্ত হ্রদে অবতরণ করলেন এবং পদ্ম ও অন্যান্য পুষ্প সংগ্রহ করে উভয়ে পুষ্পমাল্যে সুসজ্জিত হলেন। তথায় কিছুকাল অবস্থানের পর আকাশ পথে যাওয়ার সময় এক রমণীর সুবর্ণভূমি দেখলেন। তথায় এক বৈদূর্য ও রত্নময় পঞ্চদশ হস্ত উচ্চ ও দীর্ঘ-প্রস্থে ত্রিশ হস্ত ফলক দেখলেন। তখন বোধিসত্ত্ব এরূপ সম্পদ দেখে
দেবীকে সম্বোধন করে বললেন–
৩৪। “ভদ্রে, আমরা এখন এ বৈদূর্য ফলকে অবতরণ করব। সেখানে বিশ্রাম করে পরে আমরা রম্যপুরে যাব।”
এবলে উভয়ে উক্ত বৈদূর্য ফলকে অবতরণ করলেন। তথায় একটি জলপূর্ণ, আর একটি সুগন্ধি পূর্ণ সুবর্ণকূপ আছে। পূর্বে বিদ্যাধরগণ সে সুবর্ণকূপ হতে জল ব্যবহার করে। সুগন্ধিপূর্ণ সুবর্ণকূপ হতে সুগন্ধি নিয়ে নিজদেহে মণ্ডিত করে ঐ বৈদূর্য ফলকে উপবেশন করত। তারা সে সুবর্ণকূপ হতে জল নিয়ে মুখপাত প্রক্ষালন করে সুগন্ধিকূপ হতে সুগন্ধি বিলেপন করলেন। তারপর বিশ্রামের জন্য উভয়ে ঐ বৈদূর্য রত্নময় ফলকে গিয়ে শয়ন করে নিদ্রিত হলেন। তখন এক বিদ্যাধর আকাশ পথে যাওয়ার সময় এদের নিদ্রিতাবস্থায় দেখে তথায় অবতরণ করল এবং রাজকুমারের দিব্য খড়গখানা নিয়ে আকাশ পথে চলে গেল। পরে উভয়ে নিদ্রা হতে জাগ্রত হয়ে খড়গ না দেখে চারদিকে অন্বেষণ করলেন। কোথাও সন্ধান না । পেয়ে বন্ধুমতী স্বামীর পাদমূলে মস্তক রেখে সরোদনে বললেন–
৩৫। “দেব, আপনাকে আমার এ শেষ বন্দনা ও শেষ দেখা। হে ক্ষত্রিয়, যদি আপনার প্রতি আমার কোন কৃত অপরাধ থাকে, তা ক্ষমা করুন।”
৩৬। “ভদ্রে কায়-চিত্তে যে দুঃখ উৎপন্ন হয়, তা ক্ষমা করব। সম্পত্তি ও বিপত্তি জগতের নিয়ম। প্রাণীদের জীবন
অনিত্য। তুমি বিহ্বল হয়ে আর বিলাপ করোনা!”
একথা শুনে দেবী বললেন–“দেব, এখন আমরা কি করে যাব? ভদ্রে, এখন সমুদ্র পার হতে হবে।” “দেব, কি করে এ সমুদ্র পার হব?” প্রত্যুত্তরে রাজ কুমার বললেন–
৩৭। “ভদ্রে, মনুষ্যগণ সমুদ্রে পতিত হলে যে ভাবে সমুদ্রের পরপারে উত্তীর্ণ হয়, আমরাও তাদের অনুকরণ করে সমুদ্র উত্তীর্ণ হব।”
এ বলে তিনি দেবীকে সাথে করে সেখান হতে সমুদ্র তীরে উপস্থিত হলেন। তথায় অনেক অন্বেষণ করে কোথাও নৌকা দেখলেন না। পরে দেখলেন এক পুরাতণ শিমুল বৃক্ষের একখানা কাণ্ড ভাসছে। তারা উভয়ে সেটায় উঠে ক্ৰমশঃ সমুদ্রের মধ্যদেশে এসে পড়লেন। তখন অর্ধরাত্রি, ঘোর অন্ধকার। চারিদিকে মহামেঘ উঠে প্রবল বায়ু প্রবাহিত হল ও মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ হতে লাগল। এর ফলে সমুদ্রে ভয়ঙ্কর তরঙ্গের সৃষ্টি হল। প্রকাণ্ড তরঙ্গের আঘাতে উক্ত শিমূল বৃক্ষের কাণ্ডখানি মধ্যস্থলে ভেঙ্গে গেল। তখন একভাগে একাকিনী বন্ধুমতী দেবী, অপরভাগে একাকী রাজপুত্র। তখন দেবী স্বামী হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে রোদন করতে করতে সমুদ্র মধ্যে শিমূল বৃক্ষের কাণ্ড আশ্রয় করে ভেসে চললেন। রাজপুত্র ও কেঁদে কেঁদে অপর কাণ্ডের আশ্রয়ে সমুদ্রে ভেসে চল্লেন। এরূপে উভয়ে প্রবল বাত্যাঘাতে জর্জরিত ও ব্যতিব্যস্ত হয়ে সমুদ্রমধ্যে রাত্রি অতিবাহিত করলেন। ঊষার আবির্ভাব হল, প্রভাতে দেবী দেখলেন সমীপে এক ভেলা। তিনি সেই ভেলায় উঠে ক্রমে সমুদ্র তীর প্রাপ্ত হলেন। তীরে দাঁড়িয়ে স্বামীকে কোথাও না দেখে বিলাপ করতে করতে সেখানেই মূৰ্ছিত হয়ে ভূতলে লুটিয়ে পড়লেন। পুনঃ তিনি স্মৃতি লাভ করে পুনঃরায় কেঁদে কেঁদে স্বামীকে অন্বেষণ করতে লাগলেন। তার দেখা না পেয়ে। বললেন–
৩৮। “সমুদ্রে বোধ হয় আমার পতিকে মৎস্য-কচ্ছপে খেয়ে ফেলেছে। তাই তাঁকে দেখছিনা। এখানে আমার পতিকে কে জানাবে? কেই বা তার খবর দেবে?”
দেবী এরূপ বিলাপ করে সেখানেই নিজের বস্ত্র শুকিয়ে নিলেন। অলঙ্কারগুলি কাপড়ের কোণায় বেঁধে ধীরপদ-বিক্ষেপে ‘ম রাজ্যের রাজধানীতে উপস্থিত হলেন। তখন দেবী নিজের সর্বাঙ্গে অঙ্গার চূর্ণ মর্দন করে নগরে প্রবেশ করলেন। এক বৃদ্ধা নারী তাঁকে দেখে জিজ্ঞেস করল–“মা তুমি কোথা হতে আসছ?” দেবী বললেন–“আর্যে, আমি রম্যপুর নগর হতে আসছি।” বৃদ্ধা বলল–“মা, এ নগরে তোমার পরিচিত কেহ আছে কি? দেবী বললেন–“আর্যে, এখানে আমার পরিচিত কেহ নেই।” তখন বৃদ্ধা বলল–“মা, তাহলে তুমি এ নগরে আমার গৃহেই বাস করবে।” তখন দেবী ‘সাধু আর্যে বলে বৃদ্ধার কথা অনুমোদন করে তৎসঙ্গে ওর গৃহে গেলেন। তথায় সে রাত্রি অতিবাহিত করে প্রভাতে দেবী স্বীয় এক অঙ্গুরীয়ক ও পদ্মরাগমণি এক শ্ৰেষ্ঠীর নিকট বিক্রি করতে গেলেন। শ্রেষ্ঠী মণি দেখে বুঝলেন–‘এ মণি অমূল্য সম্পদ। তিনি দেবীকে বললেন–“ভদ্রে, এ মণি মুণ্ড রাজ্য হতেও অধিক মূল্যবান। আমার নিকট যা ধন আছে, তা এ মণির মূল্যের পরিমাণ হবে না। যদি তুমি এর মূল্য পঞ্চ গো শকট পরিপূর্ণ ইচ্ছা কর, তা হলে তার বিনিময়ে এ মণি আমাকে দিতে পার।’ দেবী শ্রেষ্ঠীর কথায় সম্মত হয়ে তাঁর নিকট হতে পঞ্চশকট পূর্ণ স্বর্ণ গ্রহণ করলেন। তৎপর সে নগর-দ্বারে দেবী আশানুরূপ সুন্দর এক নক্শা অঙ্কণ করে বর্ধকী ডেকে সপ্ততল এক সুদৃশ্য মহাশালা। নির্মাণ করালেন। তথায় চিত্রকর আহ্বান করে বললেন–“হে চিত্রকর, এ শালায় প্রথম দেবতার রূপ অঙ্কণ করুন। তারপর বন্ধুমতী দেবীর সাথে সমুদ্র ঘোষের শুভ মিলন অঙ্কণ করুন। সুবৰ্ণ ভূমি অঙ্কণ করে তথায় বৈদূর্যরত্নময় ফলকে শায়িত নারীপুরুষ দু’জনের ছবি অঙ্কণ করুন। সমুদ্র মধ্যে শিমুল বৃক্ষের কাণ্ড গ্রহণকারী দু’জন স্ত্রী-পুরুষের সমুদ্রে ভাসমানাবস্থা এবং আবার দ্বিভাগে এক এক জনের ভাসমান চিত্র অঙ্কণ করুন।” চিত্রকরও দেবীর নির্দেশানুরূপ সমস্ত চিত্র অঙ্কণ করলেন। তৎপর দেবী নিজের দাসীকে বলে রাখলেন–‘মাতঃ, যারা আমার এ শালায় উপস্থিত হয়, তাদের ভোজন কৃত্য সম্পাদন করিবে আমার প্রকোষ্ঠে তাদের নিয়ে আসবে।” রাজকন্যা দিবারাত্র কেবল স্বামীকে স্মরণ করে অশ্রুবর্ষণ ও বিলাপ করে এ গৃহে অবস্থান করতে লাগলেন।
এদিকে রাজ পুত্র সমুদ্র ঘোষও প্রচণ্ড বাত্যাঘাত প্রহৃত হয়ে সমুদ্রের মধ্যস্থলে এসে পড়লেন। কি কারণে তাঁরা স্বামী-স্ত্রী উভয়ে এরূপ মহাবিপদ ও দারুণ দুঃখ ভোগ করলেন? এর কারণ নিশ্চয়ই আছে। ইহা তাদের পূর্বজন্মার্জিত দুষ্কর্মেরই ফল। সে সম্বন্ধে বর্ণিত আছে
অতীতকালে বারাণসীতে এক তরুণ যুবক অবস্থান করতেন। একদা তিনি সস্ত্রীক নদীতেন করতে গিয়েছিলেন। তখন এক সম্যক সমুদ্ধের শাসনে প্রব্রজিত এক ছোট শ্রামণ তাঁদের সমীপন্থ ঘাটে একখানা ক্ষুদ্র নৌকায় আরোহণ করে জলক্রীড়া করছিল। তখন ঐ জয়মতি হস্ত দ্বারা জল তরঙ্গ উৎপাদন করলেন। তরঙ্গাঘাতে ক্ষুদ্র নৌকাখানি নিমগ্ন হল। তখন শ্রামণ জলে নিমগ্ন ভয়ে ভীত হয়ে জল-তরঙ্গে ভেসেড়ুবে কষ্ট পেতে লাগল। তৎকালে উক্ত দম্পতি যুগল সে শ্রামণকে ধরে নদী-তীরে তুলে দিলেন। এ কর্মের ফলেই তারা স্বামী-স্ত্রী উভয়ে পঞ্চশত জন্মে সমুদ্রে এরূপ দুঃখ ভোগ করেছিলেন। তদ্ধেতু বোধিসত্ত্ব সভার্যা সে কর্মবিপাকবশে এ জন্মে সমুদ্র মধ্যে এরূপ দুঃখ ভোগ করেছেন। সমুদ্র ঘোষ ছিলেন তখনকার যুবক এবং বন্ধুমতী দেবী ছিলেন যুবকের স্ত্রী। সে বিষয় প্রকাশ মানসে তথাগত বুদ্ধ নিন্মোক্ত ছয়টি গাথায় বললেন–
৩৯। অতীত জন্মে পাপকর্ম করে সমুদ্রঘোষ সস্ত্রীক এজন্মে এরূপ দুঃখ প্রাপ্ত হলেন।
৪০। সুকৃত দুষ্কৃত কর্মের বিপাক কখনো ব্যর্থ হয়না। ক্ষুদ্রতম কর্মকেও অবহেলা করতে নেই।
৪১। পূর্ব বা বর্তমানের কৃতকর্ম ক্ষুদ্র হউক বা বৃহৎ হউক, অথবা বহু অতীতকালে কৃত হউক, তা কখনো নিষ্ফল হয় না।
৪২। ইহলোকে যে ব্যক্তি পাপ বা পুণ্য কর্ম করে, তা-ই সর্বদা ছায়ার ন্যায় তার সঙ্গেই গমন করে।
৪৩। তদ্ধেতু নিজের সুখকামী জ্ঞানীগণ পাপে চিত্ত সংযুক্ত না করে পুণ্যেই চিত্ত সংযুক্ত করে।
৪৪। সুপতি রূপ সম্পদ দায়ক পুণ্য কর্মই করা উচিত। তা-ই সর্বদা প্রণীদের পরলোকে প্রতিষ্ঠা হয়।
অতঃপর সমুদ্র ঘোষ সমুদ্রে নিমগ্ন হবার উপক্রম হল। তখন সমুদ্রের অধিষ্ঠাত্রী মণিমেখলা নাম্নী দেবধীতা সাতদি যাবৎ দেবলোকে দেবসভায় উপস্থিত ছিলেন। তৎপর সমুদ্র রক্ষাকারিণী সে দেবকন্যা দিব্যনেত্রে দেখলেন–সমুদ্রে বোধিসত্ত্ব নিমগ্ন হচ্ছেন। ইহা দেখে তন্মুহুর্তে দেববালা দেবরাজ সমীপে উপস্থিত হয়ে তাঁকে এ বিষয় জ্ঞাপন করলেন। দেবরাজ শুনে দেবকন্যাকে ভৎর্সনা করে বললেন–“দেবীতে, শীলবান, পিতৃপোষক সৎপুরুষ এবং মাতা-পিতা পোষিকা, শীলবতী ও পন্ত্রিতা নারী সমুদ্রে পতিত হলে তাদের রক্ষা করা তোমারই কর্তব্য। অথচ মহাপুরুষ বোধিসত্ত্বকে নিরাপদে রক্ষা না করে এখানে কেন এসেছ?” দেবরাজের ভৎর্সনায় দেবকন্যা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তখনি বোধিসত্ত্বের নিকট উপস্থিত হলেনঃ এবং তাঁর হস্তে একখানা খড়গ প্রদান করে স্বীয় দোষের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।। তখন সমুদ্রঘোষ খড়গ প্রভাবে সমুদ্র হতে আকাশে উঠে শূন্যমার্গে গমন করবার সময় ‘মুণ্ড রাজ্য তার দৃষ্টি পথে পড়ল। তিনি লোকালয় দেখে চিন্তা করলেন–“আমি এখন খুব ক্ষুধাতুর সুতরাং এখানে অবতরণ করে সর্বাগ্রে ভোজন করা প্রয়োজন।” এ চিন্তার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি আকাশ হতে অবতরণ করে নগরে প্রবেশ করলেন। তখন তিনি তাঁর পত্নীকে স্মরণ করে চিন্তা করলেন–এখানে লোকদের নিকট দেবীর খোঁজ নিয়ে পরে সমুদ্র-তীরে অন্বেষণ করব।” এ চিন্তা করে নিজের দেহ হতে আভরণ সমূহ উন্মোচন করে এক গুপ্তস্থানে রেখে দিলেন। তারপর ব্রাহ্মণবেশ ধারণ করে গ্রামে প্রবেশ করলেন। জনগণকে জিজ্ঞাসা করলেন–“বাবারা এরূপ লক্ষণবতী কোনও নারী এ নগরে আছে কি?” লোকেরা বলল–”হাঁ ব্রাহ্মণ ঠাকুর, আপনার বর্ণনানুরূপ এক নারী অমূক স্থানে একখানি গৃহ প্রস্তুত করেছেন। এ নগরে আগন্তুক জনগণ সে গৃহে গিয়ে অন্ন পানীয়াদি পরিভোগ করে বিশ্রাম করেন। আপনিও তথায় গিয়ে আহারাদি করতে পারেন। বোধিসত্ত্ব তাদের কথা শুনে সে গৃহে গিয়ে উত্তম খাদ্য ভোজন করে গৃহের অভ্যন্তর প্রদেশ দেখতে লাগলেন। তথায় অঙ্কিত চিত্রে নিজের ভার্যার অবিকল চিত্র দর্শন করে ক্রন্দন করতে লাগলেন। তখন তথায় দেবীর দাসী এ অভ্যাগতের অশ্রুবর্ষণ দেখে দেবীর নিকট গিয়ে বলল“মাতঃ” এখন এক তরুণ ব্রাহ্মণ আপনার শালায় প্রবেশ করে চিত্র দেখে ক্রন্দন করছেন। দাসীর কথা শুনে দেবী তথায় গিয়ে ব্রাহ্মণকে দেখেই চিন্তে পারলেন। তখন দেবী তাঁর পায়ে পড়ে ক্রন্দন পরায়ণ হয়ে নিজে গাথায় বললেন–
৪৫। “স্বামিন, আমার শোক, ভয় ও দুঃখের এখন উপশম হয়েছে। আপনার দর্শনে আমার মনোরথ পূর্ণ হয়েছে।”
হঠাৎ এরূপ মিলন হওয়াতে উভয়ের চিত্ত আনন্দে ভরপুর হয়ে উঠল। পরদিন তারা প্রাতেই সুবাসিত জলোন করে অলঙ্কৃত হয়ে নগরের ব্রাহ্মণ ও জনগণকে আহ্বান করে বিবিধ দানীয় সামগ্রী দান করলেন। অতঃপর স্বামী-স্ত্রী পরম সুখে কিছুকাল তথায় অবস্থান করার পর বোধিসত্ত্ব দেবীর পঞ্চশত দাসীকে মুক্তি দিলেন, আশ্রয় দায়িকা বৃদ্ধাকে বহু সুবর্ণ ও ধনসম্পদ সমস্তই প্রদান করে স্বীয় পত্নীসহ মুণ্ড নগর ত্যাগ করলেন। কিছুদূর গিয়ে এক স্থানে বিশ্রাম করার পর পত্নীকে স্বীয় জানুপ্রদেশে বসিয়ে খড়ুগের প্রভাবে আকাশে উঠে অগ্রসর হলেন। রাত্রি প্রভাত হওয়ার পর রাজ কুমার সস্ত্রীক রম্যপুর নগর সমীপস্থ উদ্যানে এসে অবতরণ করলেন। উদ্যান পাল সমুদ্র ঘোষ ও রাজকন্যাকে দেখে ত্বরিত গমনে শ্রীসিহন গুপ্ত। রাজার নিকট গিয়ে বলল–“দেব, আপনার জামাতা সমুদ্র ঘোষ ও কন্যা বন্ধুমতী দেবী উদ্যানে এসে অবস্থান করছেন। এ খবরে রাজা অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে আমাত্যগণ সহ উদ্যানে উপস্থিত হলেন। তথায় জামাতা ও কন্যাকে দেখে রাজা তাঁদের আলিঙ্গন ও শির চুম্বন করে বললেন–“বাবা, তোমরা কোথা গিয়াছিলে এবং কোথা হতে আসলে?” ইহা শুনে মহাসত্ত্ব তাদের সমস্ত বিষয় প্রকাশ করে বললেন–। ইহা শুনে রাজা আনন্দ মনে নগর সজ্জিত করিয়ে বোধিসত্ত্বকে রাজ্যে অভিষিক্ত করলেন। এরূপে জামাতাকে রাজ্যভার দিয়ে তিনি হিমালয়ে গিয়ে ঋষি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করলেন। তিনি ক্রমান্বয়ে ভাবনা করে পঞ্চ অভিজ্ঞা ও অষ্ট সমাপত্তি উৎপাদন করলেন। তিনি দীর্ঘদিন ধ্যান সুখে অতিক্রম করে মৃত্যুর পর ব্রহ্মলোক পরায়ণ হলেন। তখন সমুদ্রঘোষের পিতা রাজা বন্ধুমিত্র রম্যপুর নগরে পুত্রের আগমন বার্তা শুনে তাঁকে স্বীয় রাজ্যে আহ্বান করে সমগ্র রাজ্য তাঁকে প্রদান করলেন। তারপর তিনিও হিমালয়ে গিয়ে ঋষি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করলেন। তারপর তিনিও ধ্যান করে পঞ্চাভিজ্ঞা ও অষ্ট সমাপত্তি উৎপাদন করলেন এবং বহু বৎসর ধ্যান-সুখে অবস্থান করে মৃত্যুর পর ব্রহ্মলোকে উৎপন্ন হলেন। তখন। মহাসত্ত্ব নিজের জন্মভূমি ব্ৰহ্মপুর নগরে উপস্থিত থেকে নগরের চার দ্বারে চারখানা, মধ্যস্থলে একখানা এবং প্রাসাদ দ্বারে একখানা এ ছ’খানা দানশালা প্রতিষ্ঠা করে প্রত্যহ অর্থীদের মহাদান দিতে আরম্ভ করলেন–। স্বীয় পত্নীর জন্মভূমি রম্যপুর নগরে ও উক্তরূপে ছয়খানা দানশালা প্রতিষ্ঠা করে প্রত্যহ তথায় মহাদান দিতে লাগলেন। তিনি দশবিধ রাজধৰ্ম অতিক্রম
করে রাজ্যদ্বয়ে যথাধর্ম অনুসারে রাজত্ব করতে লাগলেন। তখন রাজ্যদ্বয়ের প্রজাবৃন্দ রাজা সমুদ্রঘঘাষের উপদেশ রক্ষা করে সর্বদা পঞ্চশীল পালন ও দানাদি পূণ্য কর্ম সম্পাদনে নিরত হলেন। এরূপে তারা ধর্মানুরূপ জীবিকা নির্বাহ করে পরিশেষে মৃত্যুর পর দেবলোকেই উৎপন্ন হলেন। অমিতাভ বুদ্ধ জাতক কাহিনী পরিসমাপ্ত করে বললেন–“হে ভিক্ষুগণ, শুধু এখন নহে, পূর্বেও এ যশোধরা দেবীকে এভাবেই লাভ করেছিলাম।” এ বলে ভগবান নিন্মোক্ত সমাপ্তি গাথা বললেন–
৪৬-৫৬। তখন পাপচিত্ত খড়গচোর বিদ্যাধর এখন আমার বৈরী দেবদত্ত। বন্ধুমতীর শ্ৰীসিহনগুপ্ত রাজা আমার পিতা, এখন আমার শাসনে মহাপ্রজ্ঞাবান সারিপুত্র। কিন্নরাধিপতি দুমুর নামক রাজা এখন আমার শাসনে মহাঋদ্ধিবান মোগ্নল্লায়ণ। দেবরাজ ইন্দ্র এখন আমার শাসনে দিব্যচক্ষুধারীদের প্রসিদ্ধ অনুরূদ্ধ। পুরোহিত পুত্র এখন কুমার রাহুল। বন্ধুমিত্র রাজা এখন শুদ্ধোদন। দেবীত্তা রাজমাতা এখন মহামায়া। কনকবতী দেবী এখন প্রজাপতি গৌতমী। মণিমেখল দেবধীতা এখন উৎপলবর্ণা। যশোধরা ছিল রাজা সমুদ্র ঘোষের অগ্রমহিষী বন্ধুমতী দেবী। পূর্বোক্ত রাজ্যদ্বয়ের অধিবাসীরা এখন আমার পরিষদবৃন্দ। রাজ্যদ্বয়ের রাজা সদ্ধর্মপরায়ণ মহারাজা সমুদ্রঘোষই এখন তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ শ্রেষ্ঠ অনুত্তর লোকনাথ আমি। তোমরা সবাই ত্রিবিধ সুখসম্পত্তি প্রার্থনাকারীগণ অতি গৌরব চিত্তে এ জাতক ধারণ কর।
(সমুদ্র ঘোষ জাতক সমাপ্ত।)
Leave a Reply