০৩. সম্মাজীব কুমার জাতক
“আপনার শির উত্তোল করব” শান্তা জেতবনে অবস্থান কালে পিতৃ-মাতৃ সেবক এক ভিক্ষুকে উপলক্ষ করে বলেছিলেন–।
তখন উক্ত ভিক্ষু পর-গৃহে পিণ্ডাচরণ করে পিতা-মাতাকে আহার দান করবার পর অবশিষ্ট ভোজ্যদ্রব্য নিজে ভোজন করতেন। তিনি সর্বদা পালাক্রমে প্রদত্ত পিণ্ডপাত, বর্ষাবাসিক পিণ্ডপাত ও অন্যান্য পর্বোপলক্ষে লব্ধ পিণ্ডপাত ও তার পিতামাতাকে দিতেন। অন্য এক সময়ে তাঁর পিতা-মাতার সেবার জন্য বহু উদ্যোগ সহকারে শ্রম করায় ক্রমে তার শরীর অতিশয় দুর্বল ও পাণ্ডু বর্ণ হল। তাঁর সুপরিচিত ভিক্ষুগণ তাঁকে দেখে বললেন–“বন্ধু, পূর্বে তোমার শরীরবর্ণ অতিশয় শোভমান ছিল। এখন তুমি খুব কৃশ ও পাণ্ডুবর্ণ হয়েছ। তোমার কোন ব্যাধি উৎপন্ন হয়েছে কি?” তাদের কথা শুনে তিনি স্বীয়। পিতা-মাতা পোষণের কথা বললেন–। ইহা শুনে ভিক্ষুগণ এরূপ দুর্ণাম করতে লাগলেন–“বন্ধু, কেন তুমি দায়কের শ্রদ্ধা প্রদত্ত বস্তু গ্রহণ করে তা গৃহীদের দিয়ে অযৌক্তিক কাজ করছ? বন্ধু, শ্রদ্ধা প্রদত্ত বস্তু নষ্ট না করার জন্য শাস্তা শিক্ষাপদ প্রজ্ঞাপ্ত করেছেন নয় কি?” তাদের এসব নিন্দা অপবাদ শুনে ঐ পিতামাতা পোষক ভিক্ষু লজ্জায় অধোবদন হয়ে নিজের শয়নকক্ষে প্রবেশ করলেন। তৎপর ঐ ভিক্ষুগণ ভগবানের নিকট উপস্থিত হয়ে উক্ত ভিক্ষুর বিষয়গুলি প্রকাশ করলেন–। তখন ভগবান ঐ পিতা-মাতা পোষক ভিক্ষুকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন–“তুমি, সত্যই কি গৃহীদের পোষণ করছ?” ভিক্ষু বললেন–“হাঁ। ভগবান, তা সত্য।” বুদ্ধ পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন–সে গৃহী সম্বন্ধে তোমার কি হয়?” ভিক্ষু বললেন–“তারা আমার পিতামাতা।” ইহা শুনে বুদ্ধ বললেন–“সাধু সাধু হে ভিক্ষু, তুমি। আমারই আচরিত বিষয়ের অনুসরণ করছ। পিতা-মাতা পোষণ করা সৎপুরুষগণের বংশগত আচরণীয় ধর্মই বটে। পুরাতণ পণ্ডিতগণও পিতা-মাতার জন্য জীবন ত্যাগ করেছিলেন।” এবলে শাস্তা নীরব হলেন। অতঃপর ভিক্ষুগণের প্রার্থনায় ভগবান পূর্ব বৃত্তান্ত বলতে আরম্ভ করলেন–
“হে ভিক্ষুগণ, অতীতে বারানসী নগরে ব্রহ্মদত্ত রাজা রাজত্ব করবার কালে বোধিসত্ত্ব তথায় এক দরিদ্র কুলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি অনুক্রমে বয়ষ্ক হওয়ার পর পরের চাকুরী করেই সম্যক আজীব ধর্ম রক্ষা করে পিতা মাতাকে পোষণ করতেন। তাই তাঁর পিতা-মাতা তার নাম রেখেছিলেন। সম্মাজীব কুমার।” যৌবনকাল সম্প্রাপ্তে তিনি অতিশয় দর্শনীয় ও রূপ লাবণ্যে শোভমান হয়েছিলেন। সর্বদা তিনি পুণ্যকর্মে রত থাকতেন এবং ধর্মতঃ জীবিকা অর্জনে পিতা মাতার ভরণ-পোষণ নির্বাহ করে সেবা পূজা করতেন। এক সময় তাঁর পিতার মৃত্যু হল। পিতার মৃত্যুতে তিনি ক্রন্দনপরায়ন হয়ে বললেন–
১। আপনি কেন আমাকে ত্যাগ করলেন? আপনার মস্তক তুলে ধরব। বাবা মাতা এবং আমি এঘরে কিরূপে থাকব?
এরূপ বিলাপ করে পুনঃ স্বীয় পিতার মৃতদেহ আলিঙ্গন করে বললেন–
২। হায়, হায়, বাবা আমার নিকট হতে পৃথক হলেন। আমা হতে বিয়োগ হয়ে গেলেন। আমাকেও আমার মাতাকে ত্যাগ করলেন।
৩। আমার যদি কোন দোষ থাকে, অনুকম্পা করে তা ক্ষমা করবেন। বাবা, আমি সর্বদা কৃতাঞ্জলি হয়ে আপনার চরণ যুগল বন্দনা করছি।
৪। আমি আপনার শির উত্তোলন করলে পা কে উত্তোলন করবে? যদি পা উত্তোলন করি, তবে শির কে উঠাবে?
৫। এখানে ভবদীয় কলেবর কি করে দগ্ধ করব? কেই বা এখানে এসে আমার পিতাকে দগ্ধ করবে? এরূপে বিলাপ করার পর পিতার মৃতদেহ শ্মশাণে নিয়ে গেলেন এবং তথায় চিতা সাজিয়ে পিতাকে দগ্ধ করলেন। এরূপে পিতার দেহ দগ্ধ করে মাতার নিকট এসে মাতাকে সম্বোধন করে নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
৬। মাতঃ, পরলোকে আমার পিতার সর্বদা সুখের জন্য যথাশক্তি পুণ্য কর্ম করব।
সেদিন হতে বোধিসত্ত্ব মাতার সহিত বাস করে ধর্মতঃ উপায়ে মাতাকে পোষণ করতে লাগলেন। একদা বোধিসত্ত্ব নিজের মাতাকে পোষণ করবার জন্য এক সঙ্গতি সম্পন্ন ব্যক্তির নিকট উপস্থিত হয়ে কৃষিকর্মে চাকুরীর প্রার্থনা করে নিন্মোক্ত গাথাযোগে বললেন–
৭। “নমস্কার প্রভো, আমি কাজ করবার জন্য আপনার নিকট এসেছি। আশাকরি, আমি ভবদীয় কাজ করে ভাতবেতন লাভ করব।”
বোধিসত্ত্বের কাতর প্রার্থনায় গৃহস্বামী তাঁকে চাষের কাজে নিযুক্ত করলেন। তিনি ও মনোযোগের সহিত যথা ধর্মানুসারে কাজ করে মাতাকে পোষণ করতে লাগলেন। এক সময় বারাণসীবাসী এক শ্ৰেষ্ঠী কাজকর্মে তাকে উৎসাহী, নিরলস ও উদ্যোগী দেখে নিজের বাড়ীর কাজে নিয়োগ করার মানসে বললেন–
৮। “তাত, আমার গৃহে অবস্থান করে আমার কাজ কর। আমি সর্বদা তোমার ও তদীয় মাতার ভাত-বেতন প্রদান করব।”
এ বলে শ্ৰেষ্ঠীমহোদয় বোধিসত্ত্বকে নিজের কাজে নিয়োগ করে বললেন–“তাত, তুমি আমার নিকট যথাসুখে জীবিকা নির্বাহ কর। “বোধিসত্ত্বও” সাধু বলে শ্ৰেষ্ঠীর কথায় সম্মত হয়ে চাষের কাজে নিযুক্ত হলেন। তথায় তিনি নিয়মিতভাবে কাজ করে শ্রেষ্ঠীকে প্রস্নন করলেন এবং যথাকালে প্রাপ্য বেতনাদি লয়ে মাতার নিকট উপস্থিত হলেন। তাঁর আনীত ধান্য ও বেতন মাতাকে দিয়ে বললেন–“মাতঃ আপনি এ ধান্য ও অর্থে। যথা সুখে দিন যাপন করুন।” এরূপে বোধিসত্ত্ব নিজের মাতাকে পোষণ করতে লাগলেন। অন্য একসময় মাঠে শস্যাদি পরিপক্ক হওয়ার সময় উপস্থিত হল। এমন সময় তিনি পাহারা দেওয়ার জন্য ও শস্য লওযার জন্য ক্ষেত্রে একখানা পুর্ণকুটির নির্মাণ করলেন এবং মাতার নিকট গিয়ে বললেন–“মাতঃ ক্ষেত্রে শস্য পাক ধরেছে। তা পাহারা দিতে হবে। ক্ষেত্র রক্ষার জন্য আপনি ও আমাকে সাহায্য করতে হবে। সুতরাং আমার সঙ্গে আপনিও ক্ষেত্রে গেলে আমার বড়ই উপকার হবে।” পুত্রের একথা শুনে মাতা সানন্দে বললেন–“সাধু তাত, তুমি নিশ্চিন্ত হও। আমিও তোমার সাথে যাব।” এবলে মাতা পুত্র উভয়েই যেতে লাগলেন। বোধিসত্ত্ব কিঞ্চিত খাদ্য ভোজ্য সঙ্গে লয়ে মাতার সহিত ক্ষেত্রে পর্ণশালায় প্রবেশ করলেন। তাঁরা তথায় ক্ষেত্র রক্ষা করে বাস করতে লাগলেন। বোধিসত্ত্ব প্রত্যহ। তথায় মাতাকে সযত্নে উষ্ণ জল ও যায়ূ-ভাত ইত্যাদি প্রদান করেন। একদিবস প্রাতে বোধিসত্ত্ব শরীরকৃত্য সমাপণ করে মাতাকে উষ্ণজলোন করালেন। যায়ূ-ভাত-পানীয় ইত্যাদি তাঁকে দিয়ে, শস্য কাটার জন্য ক্ষেতে যাওয়ার সময় মাতাকে বলেন–মাত, আপনি এ পর্ণকুটির হতে বের হবেন না। এ বলে মাতার পদধূলি নিয়ে ক্ষেত্রে গিয়ে শস্য কাটতে লাগলেন। তাঁদের শালার অনতি দূরে এক উইয়ের ঢিবি ছিল। সে ঢিবিতে অতি ঘোর বিষাক্ত এক সর্প বাস করত। সে সর্পটি আহার অন্বেষণে বের হয়ে বোধিসত্ত্বের মাতার নিকট গিয়ে পৌছিল। সে সময় বোধিসত্ত্বের মাতা নিদ্রিতাবস্থায় পাদ প্রসারিত করলেন। তখন ঐ ঘোর দারুণ বিষাক্ত সর্পটি প্রসারিত পায়ে দংশন করল। বৃদ্ধা জাগ্রত হয়ে বিষ-বেগে সহ্য করতে না পেরে পুত্রের জন্য রোদন-বিলাপ করে করে বললেন–
৯। “হায়! হায়! তাত প্রিয় পুত্র, তুমি সর্বদাই আমার প্রিয়। আমার চক্ষু ও হৃদয় অত্যন্ত উত্তপ্ত হয়েছে। হে পুত্র, তুমি শীঘ্রই আস্।
১০। তাত, আমি সর্প দংশিত হয়েছি। বিষবেগের দ্বারা আমি প্রত্যাহত। তোমাকে না দেখেই আমি নিশ্চয়ই মৃত্যুমুখে পতিত হব।”
এরূপে বিলাপ করে মনে করলেন–যদি আমার পুত্র এসে আমার মৃতদেহ দেখে, তখন সে অত্যধিক দুঃখীত হবে। এসব মনে করে বিলাপ পরায়ণ অবস্থায় এ দিক ওদিক গড়াগড়ি দিয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হল। বৃদ্ধার বিলাপ-শব্দ শুনে সে বিষাক্ত সর্পটি অতিশয় ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে খড়-পুঞ্জে লুকিয়ে গেল। এদিকে বোধিসত্ত্ব ও সূর্যাস্তের সময় মাতার পরিচর্যার জন্য ক্ষেত্র হতে শস্য-বোঝা মাথায় নিয়ে আগমন করলেন। পর্ণশালার দ্বার খুলে দেখলেন, তার মাতা মঞ্চে শায়িতাবস্থায়। আছেন। তার সর্বাঙ্গ শীতল, শ্বাস প্রশ্বাস নেই। দেহটা নীলবর্ণ হয়েছে। এতে সম্যক উপলব্ধি করলেন–মাতা সর্প দ্বারা দংশিত হয়ে কালক্রিয়া করেছেন। তখন তিনি দণ্ড হস্তে সর্প তালাস করতে লাগলেন। খড়-পুঞ্জে সর্প দেখে তিনি চিন্তা করলেন ইহাকে হত্যা করলে আমার শীল ভঙ্গ হবে মাত্র, কিন্তু মাতার জীবন পাবনা” অতঃপর সর্পকে তিনি সমোধন করে বললেন–“হে সর্প, তুমি আমার মাতাকে হত্যা করলে ও তোমার এ অমার্জনীয় অপরাধ, আমি মার্জনা করছি। কিন্তু আমার ইচ্ছা–তুমি যেরূপ জীবন লাভ করলে, আমার মাতাও সেরূপ জীবন লাভ করুক। তুমি যথা সুখে চলে যাও।” এবলে। খুব রোদন করলেন। মাতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন–
১১। হায়! হায়! মাতঃ, আমি আপনার প্রিয় পুত্র, আপনার নিকট এসেছি। পূর্বের ন্যায় উঠে আমাকে প্রিয় পুত্র বলে সম্বোধন করুন। যদি আমার কোন দোষ থাকে, তা ক্ষমা করুন।।
১২। মাতঃ আমি আর আপনি যে ধর্ম প্রাপ্ত হয়েছি, এখন আমি আপনা হতে বিয়োগ হয়েছি। কেন আপনি আমাকে ত্যাগ করলেন?
১৩। এ জন মানব শূন্য প্রদেশে রাত্রিকালে অমনুষ্য ভয়ে কি প্রকারে আমি আপনার কাজ করব?
১৪। আপনার শিরদেশ যদি আমি তুলে লই, তবে পাদদেশ কে তুলে লবে? আমি যদি নিাঙ্গ তুলে লই, তবে উদ্ধাঙ্গ কে তুলে লবে?
১৫। মাতঃ, আমি এখানে আপনার কি কর্ম করব? আপনি যে মৃত্যু বরণ করেছেন, এখানে আপনাকে কি প্রকারে দগ্ধ করব?
১৬। কোন দেব-মনুষ্য, মহাঋদ্ধিবান যক্ষ আমাকে এ দুঃখ হতে মুক্ত করুন। আমি আপনাদের শরনাপন্ন হচ্ছি।
১৭। আকাশবাসী ও ভূমিবাসী দেবগণ, আপনারা আমার উপকার করুন। আমি এখানে সবারই শরণাপন্ন হচ্ছি। মাতঃ কি করব? কি করে আপনার অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পাদন করব?
তখনই দেবরাজের বাসভবন উত্তপ্ত হয়ে উঠল। এতে দেবরাজ সন্ত্রস্ত হয়ে নিজে গাথাটি ভাষণ করলেন–
১৮। মনে হয় কোন দেবতা অথবা মনুষ্য সম্যকরূপে পারমীধর্ম পূর্ণ করছেন, একারণেই আমার আসন উত্তপ্ত ও কম্পিত হচ্ছে।
দেবরাজ বোধিসত্ত্বের এসব ব্যাপার দিব্য দৃষ্টিতে দর্শন করে তখনিই তিনি ব্রাহ্মণ বেশে দিভ্রান্ত পথিকের ন্যায় বোধিসত্ত্বের পর্ণশালার সমীপে এসে বললেন–“তাত, তুমি আমাকে বারাণসি গমনের পথটা বলে দাও।” বোধিসত্ত্ব বললেন–“প্রভু, আপনি এখানে কেন এসেছেন?” আমি পথভ্রান্ত হয়ে এখানে এসেছি।” আপনি কি একাই এখানে এসেছেন? “তাত, আমি একাকীই বহু দূর হতে আসছি।” “প্রভু–ইহাই বারাণসি যাওয়ার পথ। আপনি এ রাস্তা দিয়েই গমন করুন”। “তাত, এখানে তুমি কি করছ?” “ব্রাহ্মণ, আমার মাতা সর্পদংশিত হয়ে কালক্রিয়া করেছেন। তাই আমি এখানে অনুতাপ ও বিলাপ করে বসে আছি।” “ব্রাহ্মণেরা নানাবিধ তন্ত্র-মন্ত্র জানেন বলে শোনা যায়। এখন আমি এব্রাহ্মণকে তা জিজ্ঞেস করব।” এ চিন্তা করে বোধিসত্ত্ব বললেন–
১৯। সর্প দংশনে মৃত্যু হলে তার পুনর্জীবন লাভের কোন মন্ত্র বা ঔষধ আপনি জানেন কি? ব্রাহ্মণ, তা যদি জানেন, সে মন্ত্র পাঠ করে আমার মাতার জীবন দান করুন।”
ব্রাহ্মণ বললেন–“তাত, আমি কেবল মাত্র মন্ত্রই জানি।” কিন্তু আমার নিকট কোন ঔষধ নেই। যদি আমাকে মানুষের হৃদয়-মাংস দাও, তা মন্ত্র প্রভাবে ঔষধ করে তারা তোমার মাতার জীবন দান করতে পারবো।” বোধিসত্ত্ব বললেন–“ব্রাহ্মণ, আপনি মস্তক, চক্ষু, হৃদয় ও রক্তাদির মধ্যে যা কিছু চান, তা আপনাকে দেব। দেবরাজ বললেন–“তা হলে তাত, হৃদয়-মাংসই দাও।” তখন মহাসত্ত্ব নিজের হৃদয় ছিন্ন করে দেওয়ার জন্য অস্ত্র পাওয়ার ইচ্ছায় আকাশের দিকে অবলোক করে নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
২০। এখানে আগত ভদ্র দেবগণ, আমার বাক্য শ্রবণ করুন। আপনারা আমার প্রতি অনুকম্পা করে শস্ত্র প্রদান করুন।
তৎক্ষণাৎ বোধিসত্ত্বের কৃতজ্ঞতা তেজানুভাব আকাশবাসী দেবগণ একখানা শস্ত্র নানারত্ন বিরচিত রজ্জু দ্বারা বন্ধন করে আকাশ হতে তার সম্মুখে ঝুলিয়ে নামিয়ে দিলেন। তখন তিনি তা হস্তে নিয়ে দেবতাদের এবলে বিজ্ঞাপিত করলেন–“ভদন্ত, আমার এ হৃদয় দান চক্রবর্তী সম্পদ লাভের জন্য নয়, একমাত্র সর্বজ্ঞতা জ্ঞান লাভের জন্যই।” এবলে দেবতাদের দ্বারা নিজের হৃদয় দান অনুমোদনের জন্য নিন্মোক্ত গাত্রয়যোগে বললেন–
২১। হে দেবগণ, মাতার জীবন লাভের জন্য ব্রাহ্মণকে আমার হৃদয় দান আপনারা অনুমোদন করুন।
২২। মাতার জীবনের জন্য আমার হৃদয় প্রদত্ত হবে। বোধিলাভের জন্য সে দান মহাফলপ্রদ হবে।
২৩। এ হৃদয় আমার অপ্রিয় নয়। এর চেয়ে সর্বজ্ঞতাই আমার অতি প্রিয়। তদ্ধেতু আমি হৃদয় দান করছি। আমার এ দান আপনারা অনুমোদন করুন।”
এবলে মহাসত্ত্ব নিজের বক্ষ নিজে ছেদন করবার পূর্বে প্রথমে অধিষ্ঠান পারমী পূর্ণ করবার ইচ্ছায় “এখন আমার হৃদয় ছেদন করব। এ শরীরে যা কিছু রক্তাদি পূতিময় ঘৃণ্য বস্তু আছে, তা বের না হোক।” এরূপ অধিষ্ঠান করে চিত্তকে দৃঢ় করলেন এবং স্বীয় বক্ষ বিদীর্ণ করার পর হৃদয়টি ছেদন করে ব্রাহ্মণের হস্তে অর্পণ করলেন। তখন ব্রাহ্মণ বললেন–“হে তাত, মহাপুরুষ, তোমার মাতার জীবন দানের ভার আমার উপরই রইল। এখন তুমি আমার হস্ত হতে এ হৃদয়টি লয়ে তোমার মাতার মুখে দিয়ে দাও। আমি মন্ত্র আবৃত্তি করব।”
তখন মহাসত্ত্ব ব্রাহ্মণের নির্দেশ মতে কাজ করলেন। তৎপর ব্রাহ্মণ নিজের দিব্য শক্তি প্রভাবে হৃদয়টা প্রতিচ্ছাদিত করে অমৃতোদক লয়ে মৃতার দেহে সিঞ্চন করলেন। তন্মুহুর্তে বোধিসত্ত্বের মাতা জীবিত হয়ে নিদ্রা হতে জাগ্রত হওয়ার ন্যায় উঠে বসলেল। ইহা দেখে মহাসত্ত্ব প্রীতি-ফুল্ল মনে মাতার পাদে বন্দনা করে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় বলেন–
২৪। “মাতঃ, আমার হৃদয় আপনাকে দিয়েছি। এ পুণ্য কর্মে অনাগতে আমি বুদ্ধ হব।
২৫। এ রাত্রিতেই আপনি আমাকে এখানে মৃত দেখবেন। আমার অদর্শনে আপনি বিলাপ করবেন।”
এরূপ বলার পর সেখানেই তখন মহাসক্তের মৃত্যু হল। এ ব্যাপার দেখে বৃদ্ধমাতা বিলাপ পরায়ণা হয়ে নয়টি শোক গাথা বলেন–
২৬। “হায়! হায়! প্রিয় পুত্র, তোমাকেই আমার প্রিয়রূপে লাভ করেছিলাম। এখানে তোমার পিতাও নেই। হে পুত্র, আমি এখানে কি করে থাকব?
২৭। এখানে আমি আহারের অভাবে ক্ষুধা পিপাসায় পীড়িত হলে, কে আমাকে আহার দেবে? এবং পুণ্যই বা কিরূপে করব?
২৮। তুমিই আমার একমাত্র আশ্রয়। এখানে আমি চির দুঃখিনী, কে আমার এ দুঃখ বিনোদন করবে?
২৯। হে পুত্র, তুমি ধর্মতঃ জীবন যাপনকারী, কৃতজ্ঞ ও সংযত। সর্বক্ষণ সর্ববিধ পুণ্যকারী হে পুত্র, এখন তুমি এখানে এস।
৩০। হে তাত, দুঃখে পীড়িত আমাকে সর্বদা পুণ্যপ্রভাবে দুঃখ হতে শীঘ্রই মুক্ত করেছ।
৩১। আমি সে দুঃখে দীর্ঘদিন ক্রন্দন করতে হবে নয়কি? অর্ধরাত্রি রোদন পরায়ণা হয়ে নদীর ন্যায় বিশুষ্ক হব নয়কি?
৩২। অনাথিনী আমি পুত্রশোকে ক্রন্দন নিরতা হয়ে শীঘ্রই ক্ষুদ্র নির্জলা নদীর ন্যায় শুষ্ক হব।
৩৩। এখন আমি একান্ত দীনা, অনাথিনী ও দুঃখিনী নয়কি? এখানেই তোমাকে আমি মৃত দেখে একাকিনী কিরূপে জীবিত থাকব?।
৩৪। তাত, এখন আমি একান্তই দুঃখিনী, দীনা ও একাকিনী। হে পুত্র, আমি পুত্রহীন একাকিনী হয়ে কিরূপে বেঁচে থাকব?”
বৃদ্ধা এরূপে বিলাপ করে চিন্তা করলেন–অতীতকালের সৎপুরুষগণ নিজের সত্যক্রিয়া দ্বারা পরের জীবন দান করেছেন। এখন আমি নিশ্চয়ই সত্যক্রিয়া করব।” এচিন্তা করে সে পূর্বদিকাভিমুখী কৃতাঞ্জলী হয়ে সত্যক্রিয়ায় রত হয়ে গাথাযোগে বললেন–
৩৫। যে সময় হতে আমার বুদ্ধি হয়েছে এবং জীবনের যত দিনগুলি স্মরণ আছে, ততদিন কখনো আমি ক্ষুদ্র পিপীলিকা পর্যন্ত হত্যা করিনি। এ সত্যবাক্য প্রভাবে আমার পুত্র জীবিত হোক্।।
৩৬। একক্রান্তি মাত্রও অদত্ত বস্তু কখনো গ্রহণ করিনি। এসত্য বাক্য প্রভাবে অদ্যই আমার পুত্র জীবিত হোক্।।
৩৭। জীবনে কখনো পরপুরুষের দিকে খারাপ মনে দৃক্পাত করিনি এবং মিথ্যা ভাষণ করিনি। এসত্যবাক্য প্রভাবে অদ্যই আমার পুত্র জীবিত হোক।
৩৮। সুরা-গাঁজা প্রভৃতি নেশাদ্রব্য কখনো সেবন করিনি। আমার শীল সতত পরিশুদ্ধই আছে। এসত্য প্রভাবে অদ্যই আমার পুত্র জীবিত হোক।
৩৯। পুত্র আমাকে হৃদয় দিয়েছে। পাপ হতে আমার পুত্র সতত বিরত। সর্বদা লোকের হিতের জন্য আমার পুত্র উত্তম বোধি প্রার্থনা করছে।
৪০। আমার পুত্র দানের রত ও বিশুদ্ধ শীল পরিপূর্ণকারী, এ সত্যবাক্য প্রভাবে অদ্যই আমার পুত্র জীবিত হোক।”
বৃদ্ধার সত্যক্রিয়া শেষ হওয়ার সাথেই দেবরাজ নিজের দিব্যানুভাবে অমৃতোদক নিয়ে মহাসক্তের মৃত দেহে সিঞ্চন করলেন। ইহাতে বোধিসত্ত্ব জীবন লাভ করে সুস্থ দেহে শয্যায় উপবেশন করলেন। তখন বোধিসত্ত্বের মাতা তাঁকে আলিঙ্গণাবদ্ধ করে আমার পুত্র জীবন লাভ করেছে।” এবলে আনন্দমনে দাঁড়ালেন। তখন মাতা পুত্র উভয়ে দেখলেনব্রাহ্মণবেশধারী দেবরাজ দিব্যরূপ ধারণ করে দিব্য তেজে জ্যোতির্ময় হয়ে তরুণ সূর্যের ন্যায় দশদিক উদ্ভাসিত করে আকাশে স্থিত হয়েছেন। তখন সমগ্র ক্ষেত্র, মাঠ ও বনাদি সকল স্থান দিব্যালোকে আলোকিত করে দেবরাজ দেবত্বভাব প্রকাশ করে বললেন–
৪১। “মহাসত্ত্ব, আমি দেবরাজ ইন্দ্র, আপনার পারমী ধর্মের পূর্ণতা প্রাপ্তির ইচ্ছায় আপনার নিকট এসেছি। প্রমাদিত হবেন না। সর্বদা পরাক্রম করুন।
৪২। আপনার সর্বদাই মঙ্গল হোক্। আপনি যে জ্ঞান প্রার্থনা করেছেন, তা আপনি অনাগতে লাভ করবেন, নিশ্চয়ই আপনি জগতে বুদ্ধ হবেন।”
এবলে তাঁদের উপদেশ প্রদান প্রসঙ্গে পুনরায় নিন্মোক্ত পাঁচটি গাথা বললেন–
৪৩। হে মাতঃ প্রিয় পুত্র সহ আপনি ধর্মাচরণ করুন। এখানে ধর্মাচরণের ফলে স্বর্গে গমন করবেন।
৪৪। হে তাত, মাতার প্রতি প্রীতিময় প্রগাঢ় শ্রদ্ধা রেখে উভয়ে ধর্মাচরণ করুন। ইহলোকে ধর্মাচরণের ফলে স্বর্গে গমন করবেন।
৪৫। আপনারা এরূপে ধর্ম পরিপূর্ণ করুন। ধর্মাচরণের দ্বারা সুখ আনয়ন করে। ধর্মাচরণের ইহাই ফল। ধর্মাচরণকারীরা কখনো দুর্গতিতে যায় না।
৪৬। দেব-ইন্দ্র প্রভৃতি সবাই ধর্মাচরণ দ্বারাই দেবলোক সম্প্রপ্ত হয়েছেন। ধর্মাচরণ দ্বারাই শ্রেষ্ঠ সুখ ভোগ করা যায়।
৪৭। ভবৎ এখানে আপনারা অপ্রমত্ত হউন। আপনারা ধর্ম পূরণ করে স্বর্গেই গমন করুন।”
দেবরাজ তাঁদের এরূপ উপদেশ দিয়ে স্বীয় স্থানেই চলে গেলেন। বুদ্ধ সে বিষয় প্রকাশ করার মানসে বললেন–
৪৮। দেবরাজ ইহা বলে এবং উভয়কে উপদেশ দিয়ে সুজম্পতি দেবলোকে স্বীয় স্থানে প্রত্যাবর্তন করলেন।
তদবধি মাতা-পুত্র উভয়ে অপ্রমত্তভাবে যথায়ুষ্কাল জীবন ধারণ করে মৃত্যুর পর দেবলোকেই উৎপন্ন হলেন। হে ভিক্ষুগণ, পুরাতণ পণ্ডিতেরা ও পিতা-মাতার জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত ত্যাগ করেছেন।” এবলে ভগবান বুদ্ধ জাতক সমাপন করে নিন্মোক্ত পাঁচটি সমাপ্তি গাথা ভাষণ করলেন–
৪৯। সারীপুত্র তখনকার বারাণসীবাসী ধনবান ও যশবান মহাশ্রেষ্ঠী।
৫০। আনন্দ ব্রহ্মদত্ত মহারাজ, অনুরুদ্ধ দেবরাজ ইন্দ্র।
৫১। বোধিসত্ত্বের মাতা পিতা বর্তমানের মহামায়া ও রাজা শুদ্ধোদন।
৫২। নগর ও জনপদের সমস্ত জনগণ শাসন পরিপূর্ণকারী আমারই পরিষদ।
৫৩। সম্মাজীব কুমারই এখন লোকনাথ বুদ্ধ হয়ে উৎপন্ন হয়েছেন। অতি গৌরব চিত্তে এ জাতক ধারণ কর।
(সম্মাজীব কুমার জাতক সমাপ্ত।)
Leave a Reply