৫০. মহাসুদর্শন জাতক
“যাহা কিছু দান” ইহা শাস্তা জেতবনে অজিত রাজার “অঠ পরিখার” দান সম্পর্কে বলেছিলেন।
এক সময় কোঞো স্থবির ভগবানের আদেশ নিয়ে স্বীয় পরিষদ সহ জেতবন হতে সাকেত নগরে উপস্থিত হলেন। সাকেত রাজ স্থবিরকে দেখে প্রসন্ন চিত্তে স্বীয় অমাত্যকে বললেন–“আমাদের বিহারে অবস্থানের জন্য মহামান্য এই স্থবিরকে তুমি নিমন্ত্রণ কর।” তখন অমাত্য রাজার আদেশ প্রতিপালন করলেন। স্থবির অমাত্যের আমন্ত্রণে রাজ বিহারে বাস করতে লাগলেন। তখন রাজা স্থবিরের নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁকে ভক্তি সহকারে বন্দনা করলেন এবং বিশেষ ভাবে অনুরোধ করে বললেন–“ভন্তে, আমাদের বিহারে বর্ষাবাস করুন।” স্থবিরও সে রাজ বিহারে তিনমাস বর্ষাযাপন করে রাজাকে বললেন–“মহারাজ, এখন আমরা অন্যত্র গমন করব।” রাজা স্থবিরের গমন বার্তা শুনে বিহারে এক কল্পতরু দানের অনুষ্ঠান করলেন। সে কল্পতরুর পূর্ব শাখায় শালি ধান্য, শালি তল, তিল, মুগ, কদলী ও ইক্ষু প্রভৃতি নানা খাদ্যদ্রব্য প্রচুর পরিমাণে ঝুলিয়ে দিলেন। পশ্চিম শাখায় কৌশিক বস্ত্র, গোলাপী ও রক্তবর্ণ কম্বল এবং কার্পাসের নানাবর্ণ মূল্যবান বস্ত্রাদি ঝুলিয়ে দিলেন। দক্ষিণ শাখায় স্বর্ণ, রৌপ্য, মণি, মুক্তা রত্ন, রত্নঘটিত কুণ্ডল ও দীর্ঘ মেখল হার ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে দিলেন। মধ্য শাখায় সপ্ত রত্নে খচিত সুবর্ণ ছত্র, কিন্ কিন্ শব্দকারী সুবর্ণ জালে পরিবেষ্ঠিত পঞ্চবর্ণ ধ্বজা পতাকায় পরিশোভিত করে ঝুলিয়ে রাখলেন। তারপর রাজা সুসজ্জিত কল্পতরু অষ্ট পরিখার, প্রচুর পরিমাণ অন্ন পানীয় দ্বারা শকট পূর্ণ করে বিহারে নিয়ে কোঞো প্রমুখ ভিক্ষু সংঘকে তা দান করলেন। স্থবির সে দান অনুমোদন করে রাজাকে ধর্মদেশনা। করলেন। তিনি সে ধর্মদেশনা শুনে প্রীতিফুল্ল মনে স্থবিরকে বন্দনা ও প্রদক্ষিণ করে চলে গেলেন।
অন্য এক সময় রাজা সপরিবার জেতবন বিহারে এসে বুদ্ধকে বন্দনান্তর একান্তে উপবেশন করে বললেন–“ভন্তে, সর্ববিধ পরিতভাগ্য বস্তু দ্বারা একটি কল্পতরু সুসজ্জিত করে ‘অষ্ট পরিখার’ ও প্রচুর পরিমাণে অন্ন পানীয় খাদ্য-ভোজ্যাদি সহ সংঘদান করছি। এ দান মহাফলপ্রসূ হয়েছে কিনা তা আপনার নিকট জানৃতে ইচ্ছা করি।” ভগবান বললেন–“মহারাজ, ভিক্ষু সংঘকে যা দান দেওয়া হয় তা মহাফলপ্রদ হয়।” ইত্যাদি বলে ধর্মদেশনা করলেন। সে ধর্মদেশনায় সপরিবার রাজা স্রোতাপত্তি ফলে প্রতিষ্ঠিত হলেন। তখন ভিক্ষুগণ ধর্মসভায় নিন্মোক্ত কথা উত্থাপন করলেন–“বন্ধুগণ, অজীত রাজা কোণ্ডঞো স্থবির প্রমুখ সংঘকে সর্ববিধ পরিভোগ্য বস্তুসহ কল্পতরু ও উৎকৃষ্ট অন্ন পানীয় খাদ্য ভোজ্যাদি দান করে সারা জম্বু দ্বীপে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন এবং সুপরিচিত হয়েছেন।” ভগবান বুদ্ধ গন্ধকুটি হতে দিব্য কর্ণে ভিক্ষুগণের এ আলোচনা শুনে তখনই সে সম্মিলনীতে উপস্থিত হলেন। তথায় তিনি শ্রেষ্ঠ আসনে বসে বললেন–“তোমরা এখন এখানে কোন বিষয়ের আলোচনা নিয়ে বসেছ? তখন ভিক্ষুগণ নিজেদের আলোচ্য বিষয় বুদ্ধের নিকট প্রকাশ করলেন–। তা শুনে শাস্তা বললেন–হে ভিক্ষুগণ, এ মহা দান বস্তু শুধু এখন যে দান করা হচ্ছে, তা নয় পূর্বেও এক পণ্ডিত ব্যক্তি কশ্যপ সম্যক সমুদ্ধের শ্রাবক সংঘকে সর্ববিধ পরিতভাগ্য বস্তু দান করেছিলেন।” এ বলে সে অতীত কাহিনী বলতে আরম্ভ করলেন–
বহু অতীতকালে বারাণসী নগরে ব্রহ্মদত্ত রাজা ধর্মতঃ রাজত্ব করতেন। তাঁর অগ্রমহিষীর নাম ছিল সুমনা দেবী। তথায় মহাধনী মহাভোগ সম্পদশালী ও মহাপরিবার সম্পন্ন। এক শ্ৰেষ্ঠী বাস করতেন। তখন বোধিসত্ত্ব ঐ শ্ৰেষ্ঠী পত্নীর জঠরে জন্ম নিয়ে মহাপরিবারের পরম যত্নে বর্ধিত হলেন। তথাকালে পিতার মৃত্যুর পর বোধিসত্ত্বই শ্ৰেষ্ঠীর পদে উন্নীত হলেন। তৎকালে কশ্যপ সম্যক সম্বুদ্ধ জগতে উৎপন্ন হয়ে দেব নরের উপকারে রত হয়ে তত্রস্থ মহাবিহারেই বাস করতেছিলেন। তখন তার এক শ্রাবক স্থবির বিবেক প্রিয় হয়ে অরণ্যে কর্মস্থান ভাবনায় নিরত ছিলেন, এমন সময় বোধিসত্ত্ব নিজের প্রয়োজনে অরণ্যে প্রবেশ করে এদিক ওদিক ভ্রমণ করছিলেন। এমন সময় তিনি দেখলেন এ স্থবির এস্থানে ভাবনায় নিরত আছেন। তখন তিনি প্রসন্ন মনে স্থবিরের নিকট গিয়ে তাঁকে বন্দনা করে বললেন–‘ভন্তে, আপনি কি এখানেই বাস করেন?’ স্থবির বললেন–“হাঁ, উপাসক’ ইহা শুনে বোধিসত্ত্ব চিন্তা করলেন–এখানেই পুণ্য কর্ম করবার এখন উপযুক্ত সময়। এ মনে করে তিনি একখানা পর্ণশালা তৈরী করে তার চারিদিকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে ও বালুকা ছিটে গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন। পর দিবস তিনি দীপ, ধুপ, সুগন্ধি, পুষ্প, মাল্য, বিলেপন ও নানাবিধ দানীয় বস্তু নিয়ে স্থবিরের নিকট উপস্থিত হলেন। তিনি তাঁকে পঞ্চাঙ্গ লুটিয়ে বন্দনা করে বললেন–‘ভন্তে, আমার প্রতি অনুকম্পা করে এ পর্ণশালায় বাস করুন। এবলে দ্রব্য সামগ্রী দিয়ে স্থবিরকে পূজা করলেন। তৎপর হতে বোধিসত্ত্ব চর্তুপ্রত্যয়ের মধ্যে স্থবিরের যখন যা প্রয়োজন হত, প্রচুর পরিমাণে দান করে প্রার্থনা করতেন–“এ দান আমার সর্বজ্ঞতা জ্ঞান লাভের হেতু হউক।” স্থবির তার এ দান অনুমোদন করার কালে নিন্মোক্ত গাথা চতুষ্টয় ভাষণ করলেন–
১-৪। যারা পর্ণশালা দান করেন, তাঁরা প্রসাদ লাভ করেন। যারা পানীয় দান করেন, তাঁরা দিব্য পানীয় লাভ করেন। চংক্রমণ দায়ক প্রকাণ্ড আবাস লাভ করেন এবং স্থান বা ভূমি দায়কেরা পৃথিবীশ্বর হন। অন্নদানকারীরা জন্মজন্মান্তরে শক্তিশালী, নানা বস্তু দান কারীরা ভবে ভবে সর্বস্তু লাভী হয়। যান দান কারীরা সুখী হয় ও দীপ দানকারী চক্ষুষ্মণ হয়। যারা মঞ্চ দান করেন, তারা দিব্য পালঙ্ক লাভ করেন, দণ্ড দানকারীরা বহু পুত্র লাভ করেন এবং বড় জলপাত্র দানকারীরা বড় রত্ন পাত্র লাভ করেন। এবম্বিধ বস্তু দান দ্বারা অনাগতে সম্যক সম্বুদ্ধত্ব লাভের সদিচ্ছা পূর্ণ হয়।”
বোধিসত্ত্ব স্থবিরের এ ধর্মদেশনা শুনে অতিশয় প্রসন্ন হলেন। তিনি সে আশ্রমে সুদৃঢ় ঘেরা দিয়ে সুরক্ষার ব্যবস্থা করলেন। সারা জীবন তিনি পঞ্চশীল এবং অমাবস্যা, পূর্ণিমা ও অষ্টমী তিথিতে উপোসথ শীল রক্ষা করতেন ও দান ধর্ম পুণ্য কর্ম করতেন। অতঃপর পরমায়ুর অবসানে তিনি কৃতপুণ্য স্মরণ করার পর ইহলোক হতে চ্যুত হয়ে দেব লোকে উৎপন্ন হলেন। তথায় তাঁর সুবর্ণময় বিমান শতযোজন উচ্চ হয়েছিল। এ বিষয় প্রকাশ মানসে শাস্তা নিন্মোক্ত ত্রয়োদশটি গাথা বললেন–
৫-১৭। “সেই কৃত সুকর্ম ও সৎচিত্তে প্রার্থনা দ্বারা মনুষ্যদেহ ত্যাগ করে তাবতিংশ দেবলোকে গিয়েছিলাম। তথায় আমার জন্য ব্যাম প্রভা সম্পন্ন প্রভাস্বর, ষাট যোজন দীর্ঘ ও ত্রিশ যোজন প্রস্থ শত যোজন উচ্চ প্রাসাদ উৎপন্ন হয়েছিল। সে প্রাসাদ নানা বর্ণ ধ্বজা ও কুট প্রতিমণ্ডিত। সে প্রাসাদের শুম্ভাবলী লোহিঙ্কময়, মণিময় স্বর্ণময় ভিত্তি; ইন্দ্র। নীল মণিময় ছাউনি; স্ফটিকময় কবাট। সে প্রাসাদে নিত্য সুমধুর স্বরে তুযধ্বনি ঘোষিত হত। কবাট বিবৃত ও বন্ধনকালে মধুর শব্দ নিঃসৃত হত। মণিময় গবাক্ষ, ভাস্বর বৈদুর্যে তৈরী কবাট, শ্রেষ্ঠ কূট সম্পন্ন পালংক যথাস্থানে সুন্দররূপে স্থাপিত। খােম বস্ত্রের দুগ্ধ ফেননীভ শয্যা মনোহর দিব্য রক্ত কম্বলে শোভিত অপ্সরাগণ পরিবৃত শ্রেষ্ঠ পালংকে পরিশোভিত এই দিব্য বিমান। সর্বদা বহু দেবারা সর্বালংকারে সুশোভিতা হয়ে আকাশে বিদ্যুৎ লহরীর ন্যায় শোভা পেতো। গীত-বাদ্যে মধুর নৃত্যে এবং মৃদঙ্গ পণব, শংখ ও ভেরী সমূহের মধুর শব্দে সর্বদা সে প্রাসাদ মুখরিত থাকত। সে প্রাসাদ দিব্য ময়ুর বকাদি সুন্দর পক্ষী এবং কিংকিনীকালে পরিবেষ্টিত ছিল। এমন দিব্য প্রাসাদে সপরিবারে সর্বদা আনন্দময় সুখ পরিভোগ করেছি। তথায় সুবর্ণ, মণি, রৌপ্য ও লোহিঙ্কময় থালাই নিত্য ব্যবহার করতাম। দিব্যাসনে বসে দিব্যময় থালাই নিত্য ব্যবহার করতাম। দিব্যাসনে বসে দিব্য মালা-গন্ধ-বিলেপন ধারণ করে সর্বদা দিব্য ভোজন ভোগ করতাম। নানা মনোহর পরিপূর্ণ প্রাসাদে দিব্য পঞ্চ কামগুণ পরিভোগ করতাম।”
বোধিসত্ত্ব তাবতিংশ স্বর্গে দীর্ঘকাল ধরে দিব্য সম্পত্তি ভোগ করার পর যথাকালে সেখান হতে চ্যুত হয়ে কুশাবতি নামক মহানগরে রাজকুলে জন্মগ্রহণ করলেন। তিনি সে মহাপরিবারে অতি যত্নের সহিত বর্ধিত হয়ে দর্শনীয়, সুপ্রসন্ন । সুবৰ্ণবর্ণ হয়েছিলেন। রাজা যথাকালে বোধিসত্ত্বকে উপরাজ্যে অভিষিক্ত করে অচিরেই পরলোক প্রাপ্ত হলেন। সে হতে মহাসত্ব ক্রমে চারদ্বীপের সুদর্শন নামক চক্রবর্তী রাজা হয়ে সপ্তবিধ রত্ন সম্পন্ন মহাতেজশালী হয়েছিলেন। সপ্তরত্ন হল এই–“চক্ররত্ন, হস্তীর, অশ্বরত্ন, মণিরত্ন, স্ত্রীরত্ব, গৃহপতিরত্ন, ও পরিনায়ক রত্ন।” এ সপ্তবিধ রত্ন পিতা, মাতা, দেবতা, দেবরাজ ইন্দ্র ও ব্রহ্মাদি কেহই দেননি। ইহা নিজের পূর্বকৃত কর্মের দ্বারা লাভ করেছেন।
-সপ্ত রত্নের আগমন বিবরণী—
যতদিন যাবৎ চক্রবর্তী রাজা হবার যোগ্য পুণ্যবান সত্ত্ব পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ না করেন ততদিন যাবৎ চক্ররত্ন প্রথম কল্প হতেই মহাসমুদ্র গর্ভে সুপ্রতিষ্ঠিত থাকে। যখন যশবান চক্রবর্তী রাজা হওয়ার যোগ্য ব্যক্তি পৃথিবীতে উৎপন্ন হন, তখন দেবরাজ ইন্দ্রের বৈজয়ন্ত রথচক্র প্রমাণ সপ্তরত্ন সমুদ্র গর্ভ হতে অই পুণ্যবান চক্রবর্তী রাজার নিকট এসে উপস্থিত হয়। হস্তীর সর্বলক্ষণ সম্পন্ন, সর্বশ্বেতবর্ণ, কৈলাস কূট সদৃশ ও অভিমঙ্গল স্বভাব হস্তীকে হস্তীরত্ন বলা হয়। ছদ্দন্ত, ক্লাবক অথবা উপোসথ জাতীয় হস্তীকুল হতেই কর্মানুরূপ চক্রবর্তী রাজার নিকট এসে উপস্থিত হয়। অশ্বত্ব সর্ব সুলক্ষণ সম্পন্ন, সর্বশ্বেত রৌপ্যবর্ণ দর্শনীয় অশ্বকেই অশ্বরত্ব বলে। বলাহক দেবপুত্রই তা রক্ষা করেন। যখন চক্রবর্তী রাজা উৎপন্ন হন, তখন যথাকালে ঐ অশ্বরত্ন বলাহককুল হতে রাজার নিকট উপস্থিত হয়। মণিরত্ন–এ মণিরত্ন বৈপুল্ল পর্বতবাসী কুম্ভণ্ড নামক যক্ষ সহস্র পরিবার দ্বারা সুরক্ষিত থাকে। যখন চক্রবর্তী রাজা উৎপন্ন হন তখন যথাকালে বৈপুল্য পর্বত হতে এসে তা রাজার হস্তগত হয়। স্ত্রীরত্ব–এ স্ত্রী রত্ন উত্তর কুরুতেই বাস করেন। যখন পুণ্যবান চক্রবর্তী রাজা পৃথিবীতে উৎপন্ন হন, তখন যথাকালে দেবরাজ ইন্দ্র প্রমুখ দেবগণ উত্তর কুরুদ্বীপ হতে এ স্ত্রীর এনে চক্রবর্তী রাজাকে দিয়ে যান। গৃহপতি রত্ন–এ গৃহপতি রত্ন জম্বুদ্বীপেই বাস করেন। পুণ্যবান চক্রবর্তী রাজা যখন পৃথিবীতে উৎপন্ন হন, তখন যথাকালে দেবরাজ প্রমুখ দেবতা বৃন্দ এ গৃহপতি রত্নকে এনে দিয়ে যান। পরিনায়ক রত্ন–এ পরিনায়ক রত্ন পূর্ব বিদেহ দ্বীপেই বাস করেন। চক্রবর্তী রাজা অভিষিক্ত হওয়ার পর দেবরাজ ইন্দ্র প্রমুখ দেবতা বৃন্দ এ পরিনায়ক রত্নকে পূর্ববিদেহ হতে এনে চক্রবর্তী রাজাকে দিয়ে যান।
-উক্ত সপ্ত রত্নের প্রভাব—
চক্রবর্তী রাজা যদি কোনও দিকে যেতে ইচ্ছা করেন, তা হলে নর্তকী প্রভৃতি সপরিষদ সে চক্র রত্রে আরোহণ করলে তখন তাহা রাজধানীকে প্রদক্ষিণ করে ক্ষণকালের মধ্যেই অযুত পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় বিরোচিত হয়ে আকাশ পথে ইচ্ছিত স্থানে। উপস্থিত হয়। রাজা তথা হতে শত, সহস্র, অযুত, লক্ষ, কোটি বা তদুর্ধ প্রমাণ অর্থাৎ যত সংখ্যক সৈন্য ইচ্ছা করেন; তত সংখ্যক সৈন্য চক্র রত্নে তুলে আকাশ পথে স্বীয় রাজধানীতে মুহূর্ত মধ্যে উপস্থিত হতে পারেন। যে স্থানে চক্ররত্ন অবতরণ করে সে স্থানের জনগণ মহামূল্যবান বহু উপহার দিয়ে রাজাকে পূজা ও ভক্তি সহকারে বন্দনা করেন। চক্রবর্তী রাজা ও তথায় দাঁড়িয়ে বলেন–সজ্জনগণ আপনারা শীল পালন করুন। ইত্যাদি বলে উপদেশ প্রদান করেন। পূর্ববিদেহ রাজ্যে উপস্থিত হলে, তথাকার জনগণ চক্রবর্তী রাজাকে সত্ত্বার ও বন্দনা করে চলে যায়। চক্রবর্তী রাজা দেবলোকে যাওয়ার ইচ্ছা করে। চক্ররত্নে আরোহণ করলে তখন চক্ররত্ন আকাশ পথে রাজধানী। প্রদক্ষিণ করে দেব লোকের দিকে যাত্রা করে। চক্ররত্নে আরূঢ় সেনাবাহিনীরা আনন্দে অধৈর্য হয়ে কেহ কেহ নৃত্য করে, কেহ গান করে; কেহ কেহ বাদ্য করে, কেহ কেহ আস্ফালন করে; কেহ কেহ করতালী দেয়, কেহ কেহ সাধুবাদ প্রদান করে আর কেহ কেহ তুর্যধ্বনী করে। তখন যেন বোধ হয় সমুদ্র মধ্যে মেঘগর্জনের ন্যায় সর্ব তুর্যের নির্ঘোষ বিঘোষিত হয়। চক্ররত্ন দেবলোকে উপস্থিত হলে দেবরাজ ইন্দ্র দেব পরিষদের সহিত চক্রবর্তী রাজাকে আগু বাড়াইয়া বহুবিধ দিব্য উপহারে ও দিব্য পূজায় সগৌরবে তাবতিংশ ভবনে নিয়ে যান। তথায় তাঁকে পঞ্চকামগুণ দানে অভিরমিত করে কয়েক দিবস তথায় রখে দেন। দেবরাজ ইন্দ্র চক্ররত্নের এরূপ অনুপম প্রভাব দেখে বিস্মিত হন। চক্রবর্তী রাজা এ চক্ররত্নের প্রভাবে এক দিবসেই চার মহাদ্বীপ পরিভ্রমণ করে পুনঃ রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেন। চক্ররত্নের প্রভাব এরূপই।
–হস্তীরত্বের প্রভাব—
চক্রবর্তী রাজা হস্তীরত্বকে পরীক্ষার নিমিত্ত পূর্বাহ্নকালে উহাতে আরোহণ করে আসমুদ্র চক্রবাল পরিভ্রমণ করে পুনঃ স্বীয় রাজধানীতে এসে প্রাতরাশঃ পরিভোগ করেন। ইহা হস্তীরত্বের প্রভাব। অশ্বত্বের প্রভাবচক্রবর্তী রাজা অশ্বরত্নের মীমাংসা করার মানসে ঐ অর্শ্বে পূর্বাহ্নকালে আরোহণ করে অসমুদ্র পৃথিবী পরিভ্রমণ করে পুনঃ স্বীয় রাজধানীতে এসে প্রাতরাশঃ গ্রহণ করেন। ইহা অশ্বরত্বের প্রভাব। চক্রবর্তী রাজা যে যে দেশে যাওয়ার চিন্তা করেন হস্তী ও অশ্বরত্ব তাঁর মনোভাব জ্ঞাত হয়ে সে দেশে নিয়ে যায়। মণিরত্ব প্রভাব–এমণিরত্ন পার্বত্য আলুর ন্যায় বৃহৎ। ইহা বৈদুর্যাদি শুদ্ধ জাতীয় বস্তু হতে উৎপন্ন হয়। এ মণি যথাবিহিত রূপে পরিষ্কার করলে বিপ্রসন্ন ও সমুজ্জল হয়। ইহার আভা চারিদিকে এক এক যোজন পরিমাণ স্থান ব্যাপ্ত হয়। চক্রবর্তী রাজা এ মণিরত্নকে পরীক্ষা করার মানসে চতুরঙ্গিনী সেনা সজ্জিত করে সে মণিরত্ন ধ্বজাগ্রে বন্ধন করে রাখেন। তখন সে মণি-প্রভায় ঘোর অমাবস্যাতেও সেনাদের চলা ফেরার ও যুদ্ধকার্যে কোন অসুবিধা হয় না। ইহার স্বচ্ছ আলোতে গ্রামবাসীরাও যাবতীয় গৃহকাজ সুষ্ঠুরূপে সম্পাদন করতে পারেন। জলের প্রয়োজন হলে, মণিরত্ব যখন পৃথিবীর দিকে নিক্ষেপ করা হয়, তখন মণি পৃথিবীতে নিমগ্ন হয়ে বিরাট জলরাশি তালবৃক্ষের প্রমাণ অথবা হস্তী প্রমাণ জলধারা আকাশ
স্পর্শী হয়ে উঠে। আর তা যদি আকাশের দিকে উৎক্ষেপণ করা হয়; তখন তা আকাশে গিয়ে প্রকাণ্ড মেঘ উৎপাদন করে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি বর্ষণ করায়। যখন অগ্নি উৎপাদনের ইচ্ছা হয়, তখন তা পৃথিবীতে নিক্ষেপ করা মাত্র মণি পৃথিবীতে নিমগ্ন হয়ে প্রবল জ্যোতিঃ সম্পন্ন অগ্নি উৎপাদন করে। তা পুনঃ আকাশে উৎক্ষিপ্ত হলে আকাশ হতে সজ্যোতিপূর্ণ উকট অগ্নি বর্ষিত হয়। যখন বায়ু সেবনের ইচ্ছা হয়; তখন সে মণিরত্ন দিকবিদিকে ছুটাছুটি করে প্রচণ্ড ও মৃদু বায়ুর উৎপাদন করে। সর্বদিকে বায়ু প্রবাহিত করে। চক্রবর্তী রাজা যা যা ইচ্ছা করেন মণিরত্ন প্রভাবে সবই পূর্ণ হয়। ইহা মণি রত্নের প্রভাব। স্ত্রীর প্রভাব–এ নারী সুরূপা, সুচারু দর্শনা সূবর্ণ বা মণিরত্বের ন্যায়। বর্ণ শালিনী। ঐ নারী নাতীদীর্ঘা, নাহ্রিস্বা, নাতিস্তুলা, নাতি কৃশা নাতি সাদা অতীত যুগের মানুষের মত দিব্যবৰ্ণা ও সূখস্পর্শা ও সুধূনিত কার্পাস তুলার ন্যায় দেহবতী। তার রূপ উন্মাদকারী। চক্ষু নিগ্রোধফলের ন্যায়। তাঁর দেহ হতে সর্বদা চন্দন গন্ধ মুখ হতে পদ্ম সুগন্ধ প্রবাহিত হয়। তাঁর দন্ত শুষ্ক শঙ্খের ন্যায় ধ্বল বর্ণ ফাঁক বিরহিত সমদন্তাবলী। তাঁর চর্মবর্ণ সাদা, কাল, নীল, পীত; অতি কাল নহে। মন্দা নীলোৎপলের বর্ণনিভ, কেশের বর্ণ নীল ভ্রমর বা ময়ুর পালকের ন্যায় জ্যোতির্ময়। হস্ত পদের বর্ণ লোহিত মণির ন্যায়। সর্বমূলক্ষণ সম্পন্না। ধন্যবতী সুশীলা পতিব্রতা পতির পূর্বে গাত্রোত্থান কারিনী সর্বকর্ম পরিচালনে সুদক্ষা ও মনোজ্ঞ আচরণ কারিনী, সর্বকর্ম পরিচালনে সুদক্ষা ও মনোজ্ঞ আচরণ কারিনী প্রিয় ভাসিনী ও অতি মনোেহারিনী। তাঁর দেহ শীতকালে উষ্ণ ও গ্রীষ্মকালে শীতল হয়। ইহাই স্ত্রী রত্নের লক্ষণানুভাব। গৃহপতির প্রভাব–গৃহপতিরত্ন যে ক্ষেত্রে, প্রকোষ্টগারে, গোশালায় বা হস্তীঅশ্বালয়ে গমন করে, তার প্রভাবে ক্ষেত্রে বহুবিধ শস্য প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয়। প্রকোষ্টাগারে বহু ধন বর্ধিত হয়, গো-হস্তী অশ্ব বহু বাছুর সম্পন্ন হয়। ধনাগারের ধন, জল অগ্নি ও চোরাদি দ্বারা নষ্ট হয়না। তিনি যে যে স্থানে যান, সে সে স্থান নিরাপদ হয়। তাঁর দ্বারা গৃহীত মৃত্তিকা, কাঁকর, চার, কাষ্ঠ, প্রস্তর বা তৃণ তার ইচ্ছানুযায়ী উত্তম ধনে পরিণত হয়। তাঁর পূর্বকর্মজ বিপাক দ্বারা নিধিদর্শনের দিব্য চক্ষু উৎপন্ন হয়। তিনি চক্রবর্তী রাজার নিকট উপস্থিত হয়ে বলেন–দেব, আপনি ধনবিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনার যা ধনের প্রয়োজন হবে, তা আমিই মিটিয়ে দেবো। যেহেতুঃযেখানে গুপ্তধন আছে, তা আমি দিব্য চক্ষে দেখতে পাই। পরীক্ষা করিবার জন্য রাজা গৃহপতিত্বকে সাথে করে গঙ্গার এক নৌকায় আরোহণ করেন। নৌকা গঙ্গার মধ্যস্রোতে উপনীত হলে, রাজা গৃহপতিরত্নকে বলেন–এখন আমার হিরণ্য ও সুবর্ণের একান্তই প্রয়োজন। ইহা শুনে তখনই গৃহপতিত্ব গঙ্গার জলে হস্তমগ্ন করে হিরন্ময় ও সুবর্ণপূর্ণ কুম্ভী তুলে রাজাকে প্রদান করেন। ইহা গৃহপতিরত্নের প্রভাব। পরিনায়কর প্রভাব–পরিনায়করত্ন পণ্ডিত, বুদ্ধিমান মেধাবী, সমর্থবান, প্রত্যুৎপন্নমতি, উৎসাহদাতা ও বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন হন। তিনি চক্রবর্তী রাজার নিকট উপস্থিত হয়ে বলেন–দেব, আপনি নিরাপদে নির্বিঘ্নে ও নির্ভয়ে বাস করুন। সহজ জটিল যা কিছু অভিযোগ আছে, সবকিছুর সমাধান আমিই করে দেবো। শাসন অনুশাসনের সুষ্ঠু পরামর্শ আমিই দেবো। আপনি কেবল দশটি হস্তীর পরিমাণ সুরযোদ্ধা সেনাবাহিনী যোগাড় রাখবেন। তারা যেন বিপক্ষ অরিদল দলনে সমর্থবান, প্রজ্ঞাবান। ও যুদ্ধবিদ্যা বিষয়ে বিচারকুশল এবং সুদক্ষ হয়। তারা যে যে স্থানে গমণ করবে, সে সে স্থান নিরাপদ হবে। সব রাজা এসব যোদ্ধা দেখে দূর হতেই পলায়ন করবে। ইহাই পরিনায়কত্বের প্রভাব।
পূর্বজন্মের সর্ববস্তু দান-পুণ্য প্রভাবেই চক্রবর্তীরাজগণ এসপ্তরত্ন লাভ করেন। ক্ষুদ্র পর্ণশালা দান-পুণ্য-প্রভাবে সপ্তরত্ন, চুরাশী সহস্র নগর, সহস্র প্রাসাদ, ও সহস্র কূটাগার উৎপন্ন হয়। মাচাদানের পুণ্য-প্রভাবে চুরাশী সহস্র হিসাবে পালঙ্ক, হস্তী, অশ্ব ও রথ উৎপন্ন হয়। বসিবার আসন দানের পুণ্য-প্রভাবে, কেহ সুবর্ণালঙ্কার, কেহ রৌপ্যালঙ্কার, কেহ লোহিতঙ্ক অলঙ্কার, কেহ স্ফটিকালঙ্কার, কেহ মহাসারালঙ্কার, কেহ মণিবর্ণালঙ্কার মুক্তালঙ্কার, সপ্তরত্নলঙ্কার দ্বারা বিভূষিত জনগণ চক্রবর্তী রাজাকে পরিবেষ্টন করে থাকেন ও তাঁর সাথে চলাফেরা করে। একটি পুষ্করিনী দান-পুণ্যে সহস্র পুষ্করিনী উৎপন্ন হয়। দণ্ডপ্রদীপ দান-পুণ্য-প্রভাবে চক্রবর্তী রাজার নিকট চুরাশী সহস্র করে স্ত্রী, গৃহপতি, পরিভোজনীয় থালা, পাত্র, সপাত্র জলছাঁকুনী, চিরুনী, নখছেদনকারী কাচি, কর্ণমলহরণী উপহান ও ছত্র উৎপন্ন হয়। ভোজনদান-পুণ্যে চুরাশী হাজার খাদ্য ভোজ্য পরিপূর্ণ পাত্র উৎপন্ন হয়। দীপদান-পুণ্যে চুরাশী হাজার মণিরত্ন লাভ হয়। করণ্ডদান-পুণ্য প্রভাবে চক্রবর্তীরাজার বিপক্ষ সেনা দলন সমর্থবান সহস্র বীরপুত্র লাভ হয় এবং স্বহস্তে দান-পুণ্যে উত্তমরূপকারী দেবস্পরার ন্যায় সেবিকা লাভ হয়। আস্তরণ দান-প্রভাবে মণিমুক্তা খচিত চুরাশী হাজার প্রকাণ্ড আস্তরণ লাভ হয়। চীবর দানপুণ্যে চুরাশী হাজারবস্তু কোষ্ঠাগার লাভ হয়। তন্মধ্যে এক এক প্রকোষ্ঠ একেক জাতীয় বস্ত্র কম্বলে পরিপূর্ণ থাকে। যথা–কোসেয়্য কর্পাস, দুকুল, খােম, কৌষিক, শ্বেতবস্ত্র, রক্ত, নীল, পীত, কাল কম্বল। অবশিষ্ট প্রকোষ্ঠগুলি নানা দিব্য বস্ত্রেপরিপূর্ণ থাকে। জল রাখবার ছোট বড় পাত্র দানপুণ্যে চুরাশী হাজার স্বর্ণময়, রৌপ্যময়, জল পাত্র উৎপন্ন হয়। চাঁদোয়া দানের পুণ্য-ফলে চুরাশী সহস্র চাদোয়া উৎপন্ন হয়। হেলান দেওয়ার বস্তু দানপুণ্য প্রভাবে চুরাশী হাজার আরাম দায়ক আসন উৎপন্ন হয়। আশ্রমে ঘেরা দান পুণ্য প্রভাবে চক্রবর্তী রাজার বাড়ীতে সপ্তবিধ ঘেরা উৎপন্ন হয়। যথা সুবর্ণ ময়, রৌপ্যময়, বৈদুর্যময়, স্ফটিকময়, লোহিতাঙ্কময়, মাসর গল্পময় ও সর্বরত্নময় ঘেরা উৎপন্ন হয়। আশ্রমে তালবৃক্ষ রোপণ দ্বারা ঘেরা দেওয়ার পুণ্যে সপ্ততাল বৃক্ষপংতি ঘেরা উৎপন্ন হয়। যথা–প্রথম পংতি সুবর্ণ ময়, দ্বিতীয় পংতি রৌপ্যময়, ক্রমান্বয়ে বৈদুর্যময়, স্কটিকময়, লোহিঙ্কময়, মসার গল্লাময় ও সর্বরত্বময়। সুবর্ণময় তালবৃক্ষের কাণ্ড ভাগ ছিল সুবর্ণময় এবং পত্র ও ফল ছিল রৌপ্যময়। রৌপ্যময় তালবৃক্ষের কাণ্ড ছিল রৌপ্যময়পত্র ও ফল ছিল বৈদুর্যময়। লোহিতাঙ্ক তালবৃক্ষের কাণ্ড ছিল লোহিতাঙ্গময় পত্র ও ফল ছিল মসার গল্পময়। মসার গল্লময় তালবৃক্ষের পত্র ও ফল ছিল লোহিতাঙ্কময়। সপ্তরত্নময় তালবৃক্ষের সপ্তরত্নময় কাণ্ড এবং পত্র ও ফল ছিল সপ্তরত্নময়। সে তালবৃক্ষ সমূহ যখন বায়ু দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন এমন একটা শব্দ বের হত, যা অতি মধুর, রমনায়, শান্ত নির্ভয়, মোহনীয় এবং পঞ্চবিধ তুর্য ধ্বনির ন্যায়। কুসবতী নগরের চারটি তোরণ দ্বার ছিল। একটি সুবর্ণময়, একটি রৌপ্যময়, একটি বৈদুর্যময় ও একটি স্ফটিকময়।
কুশাবতী নগরবাসী জনগণ সর্বদা মধুর ভোজ্যদ্রব্য ভোজন, জয়পানীয় পান ও মাংসরস পান করত এবং সর্ববিধ অলঙ্কারে নিজকে ভূষিত করে কেহ কেহ সোল্লাসে নাচ গান। বাদ্য ও করতালী যোগে সবাই নির্ভয়ে নিরুপদ্রবে, নিরোগে ও সুখে মহানন্দে, বাস করত। সে নগরে সর্বদা হস্তী, অশ্ব, রথ, মৃদঙ্গ, করতাল, কাঁসা, ভেরী ও গীতশব্দে সর্বদা অনির্বচনীয়ভাবে পৃথিবী গর্জনের ন্যায় মহোল্লাসশব্দ বিঘঘাষিত হত। তারা সর্বদাই সর্ববিধ উত্তম আহারে ও সর্ববিধ অলঙ্কারে সমৃদ্ধ ছিলেন। সুদর্শন নামক চক্রবর্তী রাজা তথায় রাজত্ব করতেন। তিনি চুরাশী সহস্র বৎসর বাল্যাবস্থায় ধূলিক্রীড়ায় দিন অতিবাহিত করেছিলেন। চুরাশী সহস্র বৎসর উপরাজ অবস্থায় ছিলেন এবং চুরাশী সহস্র বৎসর চক্রবর্তী রাজত্ব ভোগ করছিলেন। তৎপর চুরাশী সহস্ৰ বত্সর ব্রহ্মচর্য আচরণ করেছিলেন। তিনি সংসারে জীবিত ছিলেন দুইলক্ষ বিরাশী হাজার বৎসর। তিনি এক জন্মে এক ভন্তেকে একখানা পর্ণশালা ও অষ্ট পরিখার দান দিয়েছিলেন। তত্যলে তিনি এজন্মে চক্রবর্তী রাজা হয়ে দীর্ঘকাল যাবৎ ঐ মহাপূণ্যফল ভোগ করেছিলেন। সে বিষয় প্রকাশ মানসে বুদ্ধ নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় বললেন–
১৮-১৯। “তিনি পর্ণশালা ও যাবতীয় দানীয় বস্তু দান। দিয়ে চক্রবর্তী রাজত্ব ভোগ করে মৃত্যুর পর স্বর্গে উৎপন্ন হয়েছিলেন। দানাদি পুণ্যকর্ম সহযোগে দীর্ঘদিন যাবৎ রাজত্বসুখ পরিভোগ করার পর ঋষি প্রব্রজ্যায় প্রব্রজিত হয়েছিলেন। তদাবস্থায় ধ্যান অভিজ্ঞাদি উৎপাদন করেছিলেন। অতঃপর মৃত্যুর পর ব্রহ্মলোকে উৎপন্ন হয়েছিলেন।”
ভগবান এধর্মদেশনা সমাপ্ত করে বললেন–“হে ভিক্ষুগণ, শুধু এখন নহে, পূৰ্ব্বেও আমার দান আশ্চর্যজনক ছিল।” এ বলে জাতক সমাপ্ত করতঃ নিন্মোক্ত আটটি অবসান গাথা ভাষণ করলেন–
২০-২৭। “বর্তমান আমার যে জ্ঞাতিগণ আছেন, তারাই ছিল সে চক্রবর্তী রাজার জ্ঞাতি। তখনকার চক্রবর্তী রাজার যানবাহন স্বরূপ যে হস্তীরত্ন ছিল; সে হস্তী এখন আমার পিতা। শুদ্ধোদন রাজার মঙ্গল হস্তী। তখনকার অশ্বরত্ন এখন কন্থক নামক শ্রেষ্ঠ অশ্ব। চক্রবর্তী রাজার পিতা এখন আমার পিতা শ্রদ্ধোদন রাজা। মাতা বর্তমান মহামায়া। উত্তর কুরু হতে আনীত সুভদ্রাই এখন যশোধরা। গৃহপতিরত্নই বর্তমানকালের আমার সেবক আনন্দ স্থবির। পরিনায়কত্ব এখন দক্ষিণ শ্রাবক সারিপুত্র। চক্রবর্তী পরিষদ বর্তমান বুদ্ধ পরিষদ। মহাসুদর্শন চক্রবর্তীরাজা এখন আমি লোকনাথ তথাগত সম্যক্সমুদ্ধ। তোমরা সর্বদা ত্রিবিধ সুখের কারণে অতি গৌরব চিত্তে এ জাতক ধারণ কর।
(মহাসুদর্শন জাতক সমাপ্ত।)
জাতক পঞ্চাশক সমাপ্ত।
Leave a Reply