৪০. দ্বিতীয় সুবর্ণ কুমার জাতক
“ভবৎ, ইহা দেখব” এবিষয় শাস্তা জেতবনে বাস করবার কালে নিজের পূর্বকৃত পুণ্যে উৎপন্ন পুণ্যের তেজানুভাব প্রসঙ্গে বলেছিলেন।
একদিবস ভিক্ষুগণ শ্রাবস্তীর জেতবন বিহারে ধর্মসভায় উপবিষ্ট হয়ে পরস্পর এরূপ কথার উত্থাপন করলেন–“অহো, আমাদের শাস্তা দেবমনুষ্য হতেও অত্যন্ত মহাতেজানুভাব সম্পন্ন, মহালাভ সত্ত্বার পূজায় বিশিষ্টতর এবং বিপুল রূপলাবণ্যে ভরপুর আছেন।” শাস্তা নিজের দিব্য কর্ণে তাঁদের বাক্য শুনে সে ধর্মসভায় উপস্থিত হলেন। তথায় শ্রেষ্ঠ প্রজ্ঞাপ্ত বুদ্ধাসনে বসে বুদ্ধ বললেন–, “ভিক্ষুগণ, তোমরা এখন কি কথা নিয়ে এখানে বসে আছ?” তখন ভিক্ষুগণ তাঁদের আলোচ্য বিষয় বুদ্ধের নিকট যথাযথ ভাবে প্রকাশ করলেন–। বুদ্ধ তাদের কথা শুনে বললেন–“হে ভিক্ষুগণ, তথাগত যে এখন। মহাতেজানুভাব সম্পন্ন ও অতিশয় লাভ সত্ত্বার পূজায় বিশিষ্টতর এবং রূপ-লাবণ্যে শ্রেষ্ঠ; তা বড় আশ্চর্যের বিষয় নয়, পূর্বেও আমি বোধিসত্ত্বাবস্থায়ও অত্যন্ত আশ্চর্য ছিলাম।” এবলে মৌণভাব ধারণ করলেন। তখন ভিক্ষুগণ দ্বারা প্রার্থীত হয়ে সে অতীত বিষয় বলতে আরম্ভ করলেন–
অতীতে “সুরভট” নামক এক রাজা বারাণসী নগরে রাজত্ব করতেন। সে রাজার অগ্রমহিষীর নাম ছিল “চন্দ্রা দেবী।” এ চন্দ্রা দেবী পরিজন বর্গের শয়নের পরেই নিজে শয়ন করতেন, তাদের পূর্বেই শর্যা ত্যাগ করতেন। কখন কি করা কর্তব্য, তা নির্ধারণ কারিনী, প্রিয় বাদিনী ও সবারই মনোজ্ঞ আচরণ কারিণী এ পঞ্চবিধ গুণ ধর্মে সমন্বিতা ছিলেন। এসব কারণে সুরভট রাজা নিজের পঞ্চসহস্ৰ ভাৰ্য্যার মধ্যে এ চন্দ্রা দেবীকেই অগ্রমহিষী পদে স্থান দিয়েছিলেন। এ দেবী সে রাজার অতি প্রিয়া ও মনোজ্ঞা ছিলেন। এ রাজার পুত্রের সংখ্যা ছিল পঞ্চশত। তারা সবাই দিগ্বিজয়ী যোদ্ধা, বীর বিক্রমশালী ও নানা গুণে গুণান্বিত ছিলেন। তৎকালে বোধিসত্ত্ব তাবতিংশ দেবলোক হতে চ্যুত হয়ে সে চন্দ্রাদেবীর জঠরেই প্রতিসন্ধি। গ্রহণ করলেন। দশমাস পরিপূর্ণে চন্দ্রাদেবী মহাপুণ্যলক্ষণ সম্পন্ন সুবর্ণ প্রতিমার ন্যায় এক পুত্র সন্তান প্রসব করলেন, সে শিশুর নামকরণ দিবসে মহাজনগণ উল্লাসিত হয়ে তাঁর নাম রাখলেন “সুবর্ণ কুমার।” একুমার যখন ষোড়শ বর্ষে পদার্পণ করলেন, তখন তিনি নয়নাভিরাম রূপশালী, মহাশক্তিশালী, সর্ববিদ্যায় পারদর্শী ও ধনুবিদ্যায় প্রসিদ্ধ বলে দিকবিদিকে প্রকট হলেন। এক সময় অধিমাস (মল মাস) বৎসর সংপ্রাপ্তে সুরভট রাজা চতুরাঙ্গিণী সেনাবাহিনী একস্থানে একত্রিত করিয়ে সেনাপতিকে বললেন–“ভবৎ সেনাপতি, মহাসমুদ্র সর্ববিধ রত্নে ও বহু আশ্চর্য জনক ব্যাপারে পরিপূর্ণ। আমরা সবাই সে সমুদ্র তীর সমীপে গিয়ে ক্রীড়োসব করতে ইচ্ছা করি এবং তথায় মহাসমুদ্রের আশ্চর্য বিষয় দেখব।” এ বলে নিজে গাথাটি ভাষণ করলেন–
১। “ভদ্র সজ্জন মণ্ডলি, আমরা সমুদ্র তীরে সর্ববিধ রত্ন দেখব এবং সমুদ্র তীরে যথেচ্ছাভাবে ক্রীড়োসব করব।” রাজার এগাথা শুনে অমাত্যাদি জনগণ সন্তুষ্ট চিত্তে নিন্মোক্ত গাথাযোগে তাঁদের মনোভাব প্রকাশ করলেন–
২। “হে ক্ষত্রিয়, মহাসমুদ্রের সর্ববিধ রত্ন ও আশ্চর্য বিষয় দেখবার জন্য সমুদ্রতীরের ক্রীড়োৎসবে আমরা সবাই আপনার সাথে যাব”।
ইহা শুনে রাজা নিজের পুত্র ও বিংশতি সহস্র কন্যা এবং বহু সৈন্য সামন্তে পরিবৃত হয়ে প্রথমে বহু যান, বহু ধ্বজাধারী ব্যক্তি ও বহু পঞ্চাঙ্গিক তুর্য বাদ্যকারী লোক পুরোভাগে প্রেরণ করে বারাণসী নগরের পূর্বদ্বার দিয়ে বের হলেন। সে অভিযান অনুক্রমে গিয়ে সংকল্পিত সমুদ্রতীর সমীপে এক রমণীয় স্থানে উপস্থিত হলেন। তথায় শিবির স্থাপন পূর্বক চতুরঙ্গিণী সেনা সহ রাজা শ্রেষ্ঠাসনে উপবেশন করতঃ অমাত্যগণ দ্বারা পরিবৃত হয়ে প্রীতিফুল্ল হৃদয়ে নিজের অমাত্যকে সম্বোধন করে বললেন–“ভবৎগণ, তোমরা এস্থানে বাস করে উৎসবের স্থান যথাভিরুচি মতে তৈরী কর। আমরা সবাই সাতদিন ধরে নৌকাযোগে নানাবিধ সমুদ্রক্রীড়া করে তথায় এসে পুনঃ ক্রীড়োসব করব।” অমাত্যবৃন্দ সুরভট রাজার কথা শুনে “সাধু দেব” এবলে রাজার নির্দেশ মতে সর্ব কার্য সমাধা করলেন। তখন মহাসত্ত্ব সুবর্ণকুমার স্বীয় পিতা সুরভটের সাথেই ছিলেন। সে মহাসক্তের পুণ্য তেজানুভাবেই ভীষণ স্বভাব সম্পন্ন মহাসমুদ্রে ভয়ানক প্রচণ্ড কুম্ভীর, হাঙ্গর ও নানাবিধ সর্প এবং প্রচণ্ড প্রাণীকুল পরস্পর কারো কোন প্রকার অনিষ্ট সাধন করেনি। তৎপর মহাসত্ত্ব নিজের পুণ্যানুভাব প্রদর্শনের ইচ্ছুক হয়ে সংকল্প করলেন যে–“যদি আমার পুণ্য তেজানুভাব সত্য হয়, তবে, এমহাসমুদ্রের জল পৃথিবী তলের ন্যায় হোক যাতে আমরা সমুদ্র তলের সমস্ত রত্ন সম্ভার দেখতে পাই। সেরূপ ভাবে সমুদ্রের মধ্যভাগ হতে তা বের হোক্।” এসত্যাধিষ্ঠান করার পর মুহূর্তেই সে সমুদ্রজল পৃথিবীর ন্যায় শক্ত হল। তাতে মহাসত্ত্ব এদিক ওদিক পায়চারী করতে লাগলেন। তৎক্ষণে সমুদ্রে রক্ষিতা এক দেবধীতা নিজের অনুভাব বলে ছদ্দন্ত সরোবর হতে সর্বাঙ্গ সুন্দর লক্ষণ প্রতিমণ্ডিত সর্বশ্বেত একমঙ্গল হস্তী আনয়ন পূর্বক সূর্যোদয়ের সময় মহাসড়কে দান দিলেন। মহাসত্ত্ব সে মঙ্গল হস্তী লাভ করে তুষ্ট চিত্তে নিজকে অলঙ্কৃত করে সুক্ষণ লগ্নে সে মঙ্গল হস্তীতে আরোহণ করতঃ সমুদ্র মধ্যে স্থিত হলেন। মহাজনগণ মহাসড়কে এরূপভাবে দেখে অভূতপূর্ব আশ্চর্যান্বিত ও রোমাঞ্চিত হয়ে প্রফুল্লচিত্তে মহাউল্লাস ধ্বনি করলেন। মহাসত্ত্বও তথায় সুরভট রাজা প্রমুখ মহাজনগণ দ্বারা পরিবৃত হয়ে মঙ্গল হস্তিটি সমুদ্রের মধ্যাভিমুখে চালিয়ে দিলেন। বোধিসত্ত্বের ইঙ্গিতানুসারে হস্তীটি সমুদ্রের মধ্যভাগের দিকে চতে লাগল। সে চতুরাশীতি যোজন পরিমিত গভীর জল দ্বিভাগে বিভক্ত হয়ে দেওয়ালের ন্যায় সংস্থিত হল। মহাসত্ত্বের পুণ্যানুভাব তেজে মহাজনগণ হস্তীর পিছুপিছু সমুদ্রের মধ্যভাগে গিয়ে বহু রত্ব গ্রহণ করলেন এবং তা মহাসত্বকে প্রদান করলেন। সে জল দেওয়ালের উভয় পার্শ্বে পঞ্চবর্ণ পুষ্পমালা ও নানাবিধ রত্ন মালা সমূহ ঝুলতে লাগল। নাগরাজ ও নাগ কন্যাগণ রত্ন প্রদীপ হস্তে চারিদিকে আলোকিত করে মহাসত্ত্বকে পরিবেষ্টন করল। মহাসত্ত্ব তিন দিবস ব্যাপী মহাজনগণের সাথে সে সমুদ্রের মধ্যভাগে অবস্থান করলেন এবং নাগরাজ ও নাগকন্যাগণ দ্বারা প্রদত্ত দিব্য খাদ্য ভোজ্য ভোজন করে ও নানাবিধ দিব্য সম্পত্তি পরিভোগ করলেন। তখন বোধিসত্ত্বের পিতা মাতা চিন্তা করলেন–“আমাদের পুত্র মহাজনগণ সহ সমুদ্র-মধ্যে গিয়ে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করছে। এখন তাদের অবস্থা কিরূপ হল;” এমনে করে একজন অমাত্যকে আহ্বান করে বললেন–“তুমি গিয়ে মহাজনগণ সহ সুবর্ণ কুমারকে নিয়ে আস।” এবলে সে অমাত্যকে সমুদ্র মধ্যে প্রেরণ করবার সময় নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
৩। “ভবৎ অমাত্য, আমার পুত্রের পুণ্যানুভাবে অদ্যই তাকে সমুদ্রের মধ্যভাগ হতে মহাজনমণ্ডলী সহ শীঘ্রই আমার। নিকট নিয়ে আস।” রাজার এ আদেশ মাত্র অমাত্য বোধিসত্নের পুণ্যতেজানুভাবে তাঁর গমন পথে বোধিসত্নের নিকট গিয়ে উপস্থিত হলেন। তিনি বোধিসত্ত্বকে বন্দনা করে তাঁর পিতামাতার প্রেরিত খবর নিবেদন করলেন। বোধিসত্ত্ব তা শুনে সাধুবাদের সাথে বললেন–“ভবৎ অমাত্য, মহাজনমণ্ডলী সহ আমি আছি।” এবলে মহারাজ, নাগকন্যা ও সমুদ্র রক্ষাকারী দেবতাকে সম্বোধন করে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন—
৪। “আমি আপনাদিগকে জ্ঞাপন করছি যে–“আমার পিতা-মাতা ক্ষত্রিয়দ্বয় আমার নিকট খবর পাঠিয়েছেন। আমি এখন তাদের নিকট চলে যাব। এখানে উপস্থিত আপনারা সবাই সুখী ও ভয়শূন্য হউন।” ইহা শুনে সপরিষদ সমস্ত নাগরাজ কৃতাঞ্জলি হয়ে তাকে বন্দনা করে স্তুতি করণাচ্ছলে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
৫। “বুদ্ধাঙ্কুর যে দেশে গমন করেন সে দেশ সমৃদ্ধ হয় এবং তদ্দেশবাসীদের জীবন সফল হয়। আমরা নিজেই তাদিগকে পোষণ করব।” এবলে নাগরাজগণ দিব্য পুষ্প নানাপ্রকার অমিত মহার্ঘ রত্ন সমূহ বোধিসত্ত্বকে দান করে, মহাজনগণকে ঘোষণা করে বললেন–“আপনারা সবাই সমুদ্রতীর হতে যথেচ্ছামতে নানা প্রকার মহার্ঘ রত্নরাজি গ্রহণ করতে আসুন।” এঘোষণা শুনে মহাজনগণ প্রমুখ সুরভট রাজা শিবির হতে অতি তুষ্ট চিত্তে শকটাদি লয়ে এসে মহার্ঘ রত্নে স্বীয় স্বীয় শকট পূর্ণ করলেন। এবং সোৎসাহে তা গ্রহণ করে। বোধিসত্ত্বকে প্রশংসা করে নিন্মোক্ত গাথায় ভাষণ করলেন–
৬-৭। “সুরভট রাজা ও চন্দ্রাদেবী প্রিয় পুত্র লাভ করে তাঁরা নিজকে সৌভাগ্যবান বলে মনে করতেন। সপরিবার নগরবাসীগণ এখানে এসে সফলকাম হয়েছেন। সাফল্যমণ্ডিত সে সুবর্ণ বর্ণ রাজপুত্র সর্বদা সবারই প্রিয়।”
অতঃপর মহাসত্ত্ব সে রত্নরাজি বিতরণ করে মহাজনগণ সহ শিবিরে পিতা মাতার নিকট উপস্থিত হলেন। তিনি পিতা মাতাকে বন্দনা করে রত্নরাজি ও আভরণ সমূহ দ্বারা পিতা মাতাকে পূজা করে তাঁদের নিকট দাঁড়িয়ে রইলেন। তখন রাজা রাণী উভয় ক্ষত্রিয় অদৃষ্টপূর্ব মহার্ঘ রত্নরাজি দেখে হৃষ্ট প্রহৃষ্ট চিত্তে স্বীয় পুত্রকে আলিঙ্গণ পূর্বক তাঁর শির চুম্বন করে নিজের ক্রোড়ে বসালেন। তৎপর স্বকীয় তুষ্টভাব প্রকাশ করনোদ্দেশ্যে নিতাক্ত গাথাটি বললেন–
৮। “আমাদের সুবর্ণ কুমার মহাপুণ্যবান। চক্রবর্তী রাজার ন্যায় চতুদ্বীপের শ্রীধর।” এবলে ক্ষত্রিয়দ্বয় নিজের প্রিয় পুত্র সুবৰ্ণ কুমারকে তুষ্ট চিত্তে পুনঃ এ গাথায় বললেন–
৯। “আমাদের এপুত্ৰই একমাত্র শ্রেষ্ঠ পুণ্যবান। সে আমাদের পঞ্চশত পুত্রের অগ্র-শ্রেষ্ঠ ও অতি প্রিয়তর।” ।
অতঃপর রাজা এসব মহার্ঘ্য রত্নসার সহ প্রিয় পুত্র সুবর্ণ। কুমারকে নিখুঁত শ্বেত মঙ্গল হস্তীতে আরোহণ করালেন এবং চতুরঙ্গিনী সেনাদল সহ পুরোধা করে নিজে বোধিসত্ত্বের শ্রী সম্পদ দর্শন করে করে পশ্চাতে চললেন। তখন হতে বোধিসত্ত্বের যশঃ কীৰ্ত্তি চারদিকে বিশেষভাবে ব্যাপ্ত হল। সমুদ্রের তীরে স্থাপিত শিবির হতে মহাজনগণ দ্বারা রত্নসার নেওয়ার পরও যা-ই রত্নসার অবশিষ্ট ছিল, দেবতাগণ তা নিয়ে বোধিসত্ত্বের কোষাগার পূর্ণ করলেন। তৎকালে বারাণসী নগর বোধিসত্ত্বের ও সর্বশ্বেত মঙ্গল হস্তীর তেজানুভাবে সর্বদিকে সুসমৃদ্ধ সুরপুরের ন্যায় হয়েছিল। বোধিসত্ত্ব মহাপুণ্যপ্রভাবে সমুদ্র মধ্যেও প্রতিষ্ঠা লাভ করে নানাবিধ মহার্ঘ রত্নসার কেন লাভ করলেন?
“অতীতে বোধিসত্ত্ব একজন্মে এবারাণসী নগরে অত্যন্ত রূপ লাবণ্যে ভরপুর, দানবীর এক শ্রেষ্ঠী পুত্র ছিলেন। একদিন সে বোধিসত্ত্ব “বিপশ্যি” ভগবানের এক শ্রাবক স্থবির পিণ্ডাচরণ করতে দেখলেন। তিনি স্থবিরের সুসংযতভাব দেখে তাঁর প্রতি অত্যন্ত প্রসন্ন হলেন। তাই তিনি স্থবিরের হস্ত হতে পাত্রটি নিয়ে স্থবিরকে গৃহে নিয়ে গেলেন। তথায় তাঁকে আসনে বসিয়ে অত্যুত্তম খাদ্য ভোজ্যে পাত্র পূর্ণ করে তা স্থবিরের হস্তে তুলে দিলেন। তারপর স্থবিরকে বন্দনা করে বললেন–“ভন্তে, আপনি নিত্য আমার গৃহে এসে পিণ্ডপাত গ্রহণ করবেন।” ইহা শুনে স্থবির বোধিসত্ত্বকে ‘তথাস্তু’ বলে প্রতিশ্রুতি দান করলেন এবং সে দিনকার পিণ্ডপাত দানানুমোদন করে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
১০। “হে শ্ৰেষ্ঠী-পুত্র যে ব্যক্তি অক্ৰোধী, বৈরী ভাব শূন্য ও সত্যবাদী, সে ব্যক্তি দেব-মনুষ্যলোকে উৎপন্ন হলে সর্বদা ত্রিবিধ সুখ লাভ করে।”
এরূপে স্থবির বোধিসরে অনুদানানুমোদন করে স্বীয় বিহারে চলে গেলেন। পর দিবস পুনঃ ঐ স্থবির বোধিসত্ত্বের গৃহে পিণ্ডপাত গ্রহণের জন্য উপস্থিত হলেন। স্থবির তথায় পিণ্ডপাত গ্রহণ করে বোধিসত্ত্বকে অল্পক্ষণ ধর্মদেশনা করলেন। ধর্ম শ্রবণের পর বোধিসত্ত্ব স্থবিরকে বন্দনা করে প্রীতিফুল্ল হৃদয়ে বললেন–“ভন্তে, আপনিই আমার আচার্য। অদ্য হতে নিত্য আমাকে উপদেশ দেবেন।” স্থবিরও বোধিসত্ত্বের প্রার্থনানুযায়ী সর্বদা তাঁকে ধর্মদেশনা করতেন। বোধিসত্ত্ব স্থবিরের ধর্মদেশনানুশাসনে অনুপ্রাণিত হয়ে বিবিধ পুণ্যকর্ম সম্পাদন করতে লাগলেন। এরূপে বোধিসত্ত্ব বিপশ্যি ভগবানের শাসনে স্থবিরকে পিণ্ডপাত দান দিয়ে ও ধর্ম শ্রবণ করে ত্রিবিধ সুচরিত কর্ম পূর্ণ করে সুখে জীবন যাত্রা নির্বাহ করেছিলেন। এরূপে অতীত ভবে নিজের কৃত পুণ্য কর্ম দ্বারা সুবর্ণ কুমার মহাতেজানুভাব সম্পন্ন হয়েছিলেন। সে সময় পঞ্চশত ব্যবসায়ী মহানৌকাযোগে সিংহল দ্বীপে বাণিজ্যের জন্য গিয়েছিলেন। তথায় তাঁরা ঐ বোধিসত্ত্ব সুবর্ণকুমারের মহাসম্পত্তি লাভ, নিখুঁত শ্বেত মঙ্গল হস্তী লাভ এবং মহাধন সম্পদ লাভের বিষয়ে আলাপ আলোচনা করে নানা স্থানে বিচরণ করতে লাগলেন। সিংহল দ্বীপ বাসী জনগণ তা শুনে সে দ্বীপের ‘ভটসুর’ নামক রাজাকে সুবর্ণ কুমারের প্রশংসনীয় কথাগুলি জ্ঞাপন করলেন। রাজা তা শুনে নিজের ঐশ্বর্যের কথা চিন্তা করে অহঙ্কার উৎপন্ন হল এবং ঈর্ষাভিভূত হয়ে বণিকগণকে নিজের নিকট আহ্বান করে এনে নিন্মোক্ত গাথায় জিজ্ঞেস্ করলেন–
১১। “হে ভবৎগণ, শ্বেত হস্তীর মালিক সে কুমার যদি মহাপুণ্যবান হয়, তবে তার তেজানুভাব কি প্রকার, তা আমাকে। বলুন। আমি তা শোতে ইচ্ছা করি।”
ভটসুর রাজার একথা শুনে সে পঞ্চশত বণিক করযোড়ে বললেন–“মহারাজ, এসুবর্ণ কুমার আমাদের প্রভু সুরভট নামক রাজার পুত্র মহাঋদ্ধিবান, মহাতেজানুভাব সম্পন্ন এবং পরসেনা বিমর্দনে সুদক্ষ। শত রাজাও এ সুবর্ণ কুমারের সানে দাঁড়াতে সমর্থ হয় না। এরূপ মহাতেজানুভাবে আমাদের রাজপুত্র বারাণসী নগরে মহাসুখ সম্পত্তি পরিভোগ করছেন।” ইহা শুনে সিংহলদ্বীপ রাজা ভটসুর ভীষণ ঈর্ষাভিভূত হয়ে লাঙ্গুলে লৌহদণ্ডে প্রহৃত নাগরাজের ন্যায় ক্রুদ্ধ হলেন।
এরাজার চারজন মহাবিক্রমশালী সুদক্ষ যোদ্ধা ছিলেন। তাঁরা রাজার যে কোন জটিল কাজ সম্পন্ন করতেন। তখন সিংহল রাজ এ মহাবীর যোদ্ধা চতুষ্টয়কে আহ্বান করে বললেন–“হে ভবৎ যোদ্ধাগণ, তোমরা এচারজন ব্যবসায়ীর সাথে বারাণসী। নগরে গিয়ে সুরভট রাজাকে এরূপ বলবে–“ভবৎ সুরভট রাজ সিংহল দ্বীপে বাসকারী আমাদের ‘ভটসুর’ নামক মহারাজ অন্যান্য রাজা হতে মহানুভাব সম্পন্ন, মহাতেজবান, মহের্ধিক, মহাশক্তিশালী এবং বহু রাজা কর্তৃক অভিপূজিত হন। আপনার সর্বক্ষণে প্রতিমণ্ডিত সে সর্বশ্বেত মঙ্গল হস্তীটি তাঁর জন্য দিয়ে দিন। যদি তা প্রদান না করেন, তবে তিনি এ বারাণসী নগরে এসে আপনাকে সহ এরাজ্যবাসী সবাইকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেবেন। আপনি এরূপে মহাদুঃখে নিপতিত হলে কীই বা করবেন? তখনই আপনি আমাদের রাজাকে সে শ্বেত হস্তী প্রদান করবেন, নয় কি?” তখন সে প্রসিদ্ধ যোদ্ধা চারজন। সাধুবাদ সহকারে রাজবাক্য গ্রহণ করে ঐ ব্যবসায়ীদের সাথে মহা নৌকাযোগে বারাণসী নগরে উপস্থিত হলেন। তথায় ‘ভটসুর’ রাজার প্রেরিত সব খবর ‘সুরভট’ রাজাকে বললেন–। এখবর শুনে তিনি ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে নিজের সেনাপতি পুরোহিত পুত্রকে ডাকিয়ে বললেন–“ভবৎ, এখন মহাবীর ও মহা তেজানুভাব সম্পন্ন ভটসুর রাজা আমার নিকট এরূপ খবর দিয়েছেন।” এবলে খবরগুলি যথাযথ ভাবে প্রকাশ করে বললেন–। তার পর তিনি স্বীয় মন্তব্য প্রকাশ করলেন–“এখন। আমরা তাঁর নিকট উপস্থিত হব কিনা, যদি আমরা সে রাজার। নিকট উপস্থিত না হই, তা হলে সে রাজা জনগণ সহ । এবারাণসী রাজ্য চূর্ণবিচূর্ণ করবে। অদ্যই আমরা সবাই সে রাজার নিকট যাব।” তখন সমস্ত বারাণসীবাসী জনগণ সে ভটসুরের মহাতেজানুভাব শ্রবণ করে ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে নীরবতা অবলম্বন করবেন। তখন সুবর্ণকুমার নিজের পিতার চিত্তের দুঃখভাব জেনে বললেন–“বাবা, আপনি ভয় করবেন না, যথাসুখে বাস করুন। কোথাও যাবেন না, যদি আপনি তথায় উপস্থিত হন, তা হলে শীঘ্রই সে রাজা আপনার পুত্র-দারাদির বিয়োগ সাধন করবে। আমি আপনার পুত্র নিজেই সে ভটসুর রাজার নিকট গিয়ে আমার তেজানুভাবেই সসৈন্যে সে রাজাকে এখানে এনে আপনার পাদ বন্দনা করাব।” বোধিসত্বের কথা শুনে রাজা বললেন–“বাবা সুবর্ণ কুমার, তুমি এখন বালক। এ ভটসুর রাজা আমার চেয়ে বহুগুণে শক্তিশালী ও মহাতেজবান। তাই তার নিকট আমাদেরই যাওয়া উচিত মনে করি। যেহেতু আমাদের রাজ্য হতে সে রাজ্য বহুগুণ বিরাট, শ্রেষ্ঠ এবং সে রাজার বহু চতুরঙ্গিনী সেনাবাহিনী অত্যন্ত বিক্রমশালী। তুমি সিংহল দ্বীপে গিয়ে কিরূপে সে রাজাকে আবে?” ইহা শুনে বোধিসত্ত্ব বললেন–“বাবা, সে রাজা আমাদের চেয়ে অতিশয় বলশালী, তেজশালী ও বীর্যবান বটে। কিন্তু আমি সে রাজার নিকট গিয়ে আমারই সত্যক্রিয়াধিষ্ঠান তেজ প্রভাবে তাঁকে পরাজয় করে আপনার নিকট তাঁর বলবাহন সহ তাকে এখানে নিয়ে আস্ত। মহাসক্তের এ দুঃসাহসিক বাক্য শুনে অমাত্য প্রমুখ মহাজনগণ প্রীতিফুল্ল মনে সাধু সাধু রাজকুমার, আপনিই গমন করুন, নিশ্চয়ই আপনার মনোরথ পূর্ণ হবে।” এবলে সবাই সম্মতি জ্ঞাপন করলেন। ইহা শুনে সুরভট রাজা মহাসত্বকে সম্বোধন করে বললেন–“বাবা, তোমার বাক্য যুক্তিযুক্ত। সুতরাং তথায় তোমার গমন অনুমোদন করছি।” এবলে মহারাজ জনগণকেও সম্বোধন করে নিন্মোক্ত গাথাযোগে বললেন–
১২। “সুধীবৃন্দ, এখানে আগত জনগণ আপনারা ছত্র, চোমর, উষ্ণিষ, খক্ষ ও পাদুকা, এপঞ্চ রাজোপকরণ গ্রহণ করে শীঘ্রই আমার পুত্রকে রাজ্যাভিষেক প্রদান করুন।”
তখন তথায় পঞ্চবিধ রাজ্যাভিষেক উপকরণ আনয়ন করা হল। সুরভট মহারাজের ব্রাহ্মণ পুরোহিত ও মহাজনগণ রাজাঙ্গনে সমবেত করা হল। সুবাসিত জলে পরিপূর্ণ বহু সুবর্ণ ঘট আনিয়ে রাখলেন। স্থানে স্থানে ধ্বজা, পতাকা ও ছত্রাদি দ্বারা সুসজ্জিত করলেন। ইক্ষু কদলী প্রভৃতি সমবায়ে সভার অষ্টদিকে ধর্মপূজা স্থাপন করালেন। সে রাজাঙ্গনের মধ্যভাগে সুবৰ্ণ প্রাসাদে বহুবিধ রত্ন পূঞ্জীভূত করালেন। সে রত্ন পুঞ্জের। উপর মহাসত্ত্ব সুবর্ণ কুমারকে উপবেশন করালেন। তৎপর সুরভট রাজা প্রমুখ মহাজনগণ তথায়ই রত্ন রাশিতে উপবিষ্ট মহাসত্ত্বের মস্তকে সুবাসিত অভিষেক জলসিঞ্চনে নিরত হয়ে বললেন–“অদ্য হতে ভবৎ দীর্ঘায়ু হউক” ইত্যাদি সুখমঙ্গল। বাক্যাদি বলে বারাণসী নগরে মহাসত্বকে যথাবিধান মতে রাজ্যভার প্রদান করলেন। রাজ্যাভিষিক্ত মহাসত্ব চতুরঙ্গ সেনাদল পরিবৃত হয়ে সুনক্ষত্র লগ্নে বারাণসী নগর হতে বহির্গত হলেন। তৎক্ষণে মহাসক্তের পুণ্যতেজানুভাবে আকাশে শ্বেতছত্র ও ধ্বজাদি পূজোপকরণে সুসজ্জিত হয়ে স্থিত হল। তখন মহাসত্ত্ব নিজের সেনাবৃন্দকে অবলোকন করে চিন্তা করলেন–“অহো এমনুষ্যলোকে স্থিত সকল সত্ত্ব ও দেব ব্রহ্মলোকে স্থিত সমস্ত সত্ত্ব স্বীয় কৃত পুণ্যবলে নানাবিধ সুখসম্পত্তি লাভ করেছেন, কৃত পুণ্য ব্যতীত এসব লাভ হয় না। নিশ্চয়ই এখন এখানে এসব সেনা দ্বারা পুণ্যকর্ম করাব। পুণ্যকর্ম করার অযোগ্য কেহ নহে। ইহলোকে সর্ববিধ ভয়উপদ্রব হতে প্রাণীদের পুণ্যেই রক্ষা করে এবং সর্বদা সুখী করে। যারা শ্রদ্ধার সহিত পুণ্যকর্ম করে না, তারা সর্ববিধ ভয়োপদ্রবে অনবরত দুঃখ প্রাপ্ত হয়। যদি আমাদের সিংহল দ্বীপে গমনের উদ্দেশ্যে পুণ্য তেজানুভাবে পরিপূর্ণ হয়, তবে সর্বদাই আমি ইহলোকে সুখ-সম্পত্তি লাভ করব।” মহাসত্ত্ব এচিন্তা করে মহাজনগণ দ্বারা সে রাত্রেই সব্যঞ্জন বহু পিণ্ডপাত, যাথু ও শ্রেষ্ঠ খাদ্যভোজ্য তৈরী করিয়ে বিপশি ভগবানের শাসনস্থ ভিক্ষুসংঘকে নিমন্ত্রণ করালেন। তাঁদের সাদরাহ্বানে ভিক্ষুগণ তথায় উপস্থিত হলে তিনি নিজে ত্রিরত্নের শরণ গ্রহণ পূর্বক পঞ্চশীল গ্রহণ করলেন ও ধর্মশ্রবণ করলেন। তৎপর ত্রিরত্নের উদ্দেশ্যে পূজা করে সে ভিক্ষুগণকে পিণ্ডপাতাদি সপরিখার মহাদান দিলেন। তারপর চতুরঙ্গ সেনানিকায়, পিতা মাতা ও জ্ঞাতিবর্গকে নিজের দান-পুণ্য ফল প্রদান করতঃ সে স্থানে দক্ষিণােদক সিঞ্চনে রত হয়ে নিজে গাথায় ভাষণ করলেন–
১৩-১৫। “জ্ঞাতি বা অজ্ঞাতি অবীচি নিরয় হতে ভবাগ্রে এবং অনন্ততির্যভবে উৎপন্ন প্রাণী সমূহ আমার পুণ্য-তেজে সর্বদা দুঃখ হীন, নিরুপদ্রব, দীর্ঘায়ু ও ধনবান হোক। আমি বিজয়ের জন্য ও সুখের জন্য সিংহল দ্বীপে যাব। পুনঃ সেখান হতে এসে আমার পিতা-মাতা ও জনগণের সঙ্গে আমার দেখা হবে।”
বোধিসত্ত্বের এক পূর্বজন্মে তাঁর বহু জ্ঞাতি দুশ্চরিত কর্মাচরণ করে চতুর্বিধ অপায়ে উৎপন্ন হয়েছিল। তাঁর এদান পুণ্য-ফলেই তারা সবাই অপায় দুঃখ হতে মুক্তি লাভ করল এবং তাবতিংশ স্বর্গে উৎপন্ন হয়ে বহু দেবতা দ্বারা পরিবৃত হল। বোধিসত্ত্বও নিজের সেনাদল সহ সমুদ্রতীরে গিয়ে রাত্রিতে চিন্তা করলেন–“এভটসুর রাজার শক্তি সামর্থ কি পরিমাণ হবে?” এরূপ ঐকান্তিক ভাবে চিন্তা করা মাত্র মহাসত্ত্বের পুণ্যতেজ প্রভাবেই দেবরাজ ইন্দ্রের বাসভবন উত্তপ্ত হল। দেবরাজ ইহার কারণ চিন্তা করে জ্ঞাত হওয়ার পরক্ষণেই তিনি পঞ্চশর সহ ইন্দ্র ধনু লয়ে মহাসড়ের নিকট সে রাত্রিতেই উপস্থিত হলেন। তথায় তিনি নিজের দিব্য জ্যোতিঃ নিঃসৃত করে মহাসত্ত্বকে বললেন–“মারিস, এখন আপনার শত্রু মর্দনের জন্য পঞ্চশর সহ এ আয়ুধ গ্রহণ করুন। এ পঞ্চশরের মধ্যে এশটি নিক্ষেপ করলে, তা বিদ্যোতের ন্যায় গিয়ে একযোজন দূরস্থ দেব-মানবের কেশচ্ছেদনে সমর্থবান। এশটি যান নির্মাণে সমর্থ। এতৃতীয় শরটি আকাশে বিমান তৈরী করে স্থিত থাকতে সমর্থ। এচতুর্থ শরটি মহাঅগ্নিরাশি উৎপাদনে সমর্থ। আর এপঞ্চম শরটি বহু দূর স্থানে গিয়ে শত্রুগণকে নিহত করতে সমর্থ হয়। এপঞ্চশর সহ শর নিক্ষেপনী ধনুটি আমার নিকট হতে গ্রহণ করুন। এবলে দেবরাজ নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
১৬। “এপ্রথম শরটি কেশ ছেদনকারী, দ্বিতীয়টি শকট নির্মাণে সমর্থ। তৃতীয়টি আকাশে বিমান নির্মাণে সমর্থ, চতুর্থটি অগ্নিরাশি উৎপাদনে সমর্থ এবং এপঞ্চম শরটি শত্রুদের নিহত করণে সমর্থ হয়। আমি আপনাকে এ ধনুসহ শরগুলি প্রদান করছি।” মহাসত্ব দেবরাজের নিকট হতে পঞ্চশর সহ এ ইন্দ্র ধনু গ্রহণ করে প্রহৃষ্ট চিত্তে তথায় বসলেন। তখন দেবরাজ বোধিসত্ত্বকে বর প্রদানচ্ছলে নিন্মোক্ত গাথাটি ভাষণ করলেন–
১৭। “হে জনেন্দ্র, আপনার জয় হবে। সর্বস্থানে আপনি। প্রকট হয়েছেন। চর্তুদ্বীপে আপনার আদেশ তেজ প্রবর্তিত হউক।”
এবলে দেবরাজ নিজের বাস স্থান দেবলোকে চলে গেলেন। তখন বোধিসত্ত্বও শুভলগ্নে স্বীয় বলবাহণ সহ মহা নৌকায় আরোহণ করলেন। মহাসমুদ্র রক্ষাকারী এমহানৌকাকে সুষ্ঠুরূপে সুচালিত করে বোধিসত্ত্ব প্রমুখ সেনাবাহিনীকে পরিচয় প্রদান করলেন এবং তাদের দিব্য খাদ্য ভোজ্য দ্বারা সেবা। করলেন। মহানৌকা বিনা বাধায় নিরাপদে মহাসমুদ্রের মধ্যভাগ দিয়ে চলতে লাগল। তা ক্রমান্বয়ে সমুদ্রের পর তীরে গিয়ে পৌছিল। তথায় তারা শিবির স্থাপন করে ভটসুর রাজার নিকট দূত পাঠালেন। সে দূত সিংহলবাসী জনগণের ঈশ্বর ভটসুর রাজার নিকট গিয়ে বললেন–“ভবৎ রাজন, আমাদের প্রভু রাজাধিরাজের প্রিয়পুত্র সুবর্ণ কুমার নামক শ্রেষ্ঠ পুত্র মহাবীর পর-রাজগণকে পরাভূত করণে সমর্থবান। তিনি স্বীয় শর দ্বারা আপনার সমগ্র রাজ্য চূর্ণ বিচূর্ণ করতে সমর্থ হবেন। এ রাজপুত্র নিজের সেনাবাহিনী সহ আপনার রাজ্যে উপস্থিত হয়েছেন। এখনই আপনি সে রাজপুত্রের নিকট গিয়ে নিজের জীবন যাঞ্চা করুন। যদি তা করতে সমর্থ না হন, তবে সঅমাত্য সমর সজ্জায় প্রস্তুত হয়ে শীঘ্রই বের হউন।” এরূপ বলে পুনঃ ভটসুরের কর্ণ-সমীপে গিয়ে বললেন–“ভবৎ রাজন, এখন যদি আপনি আমাদের প্রিয় রাজপুত্র সুবর্ণ কুমার রাজার পাদ বন্দনার্থ গমন না করেন, তা হলে এখানেই আমি আপনার শিরচ্ছেদ করব।” ইহা শুনে সে রাজা লৌহদণ্ডে প্রহৃত লাঙ্গুল নাগরাজের ন্যায় ক্রোধাভিভূত হলেন বটে, কিন্তু ভীত ও সন্ত্রস্থ হয়ে নিজের বীর অমাত্যবৃন্দকে রাজাঙ্গনে সমবেত করিয়ে বললেন–“ভবৎগণ, এ সুবর্ণকুমার ধনুবিদ্যায় অত্যন্ত সুদক্ষ। যদি সে আমাদের রাজ্যে শর নিক্ষেপ করে, তবে নিশ্চয়ই আমাদের পরাজয় হবে।” ভটসুরের একথা শুনে সিংহল দ্বীপবাসী মহাজনগণ সংগ্রাম করনার্থ একস্থানে সমবেত হলেন। ইহাতে সারা সিংহল নগরে মহাকোলাহলের সৃষ্টি হল। তখন মহাসত্ত্ব শিরকেশ ছেদনে সমর্থ এক শর নিক্ষেপ করলেন। এতদ্বারা সিংহলদ্বীপ নগরবাসীদের শিরকেশ ছেদন করে সে শর পুনঃ মহাসক্তের নিকট ফিরে আসৃল। তৎকালে সারা সিংহল দ্বীপবাসী মহাজনগণ অত্যন্ত কোলাহলে রত হয়ে নিজদের মস্তক স্পর্শ করে দেখলেন, মস্তক কেশশূন্য। তারপর মহাসত্ত্ব তথায় সম্মিলীত মহাজনগণের মধ্যে শকট নির্মাণে সমর্থ দ্বিতীয় শর নিক্ষেপ করলেন। তদ্বারা তথায় হস্তী, অশ্ব শকটাদি বহু শকট ও বহু রথ তৈরী হল। তথায় সমবেত মহাজনগণ এরূপ শকট নির্মাণকারী শরকলাপ দেখে অতিশয় আশ্চৰ্যন্বিত হলেন এবং ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে মৌনভাব ধারণ করলেন। তারপর মহাসত্ত্ব বিমান নির্মাণে সমর্থ তৃতীয় শর নিক্ষেপ করলেন। এতদ্বারা নানাবিধ রত্ন প্রতিমণ্ডিত পঞ্চাঙ্গিক তুর্যশব্দ সমন্বিত অপ্সরা কন্যার পরিপূর্ণ বিমান আকাশে স্থানে স্থানে প্রতিষ্ঠিত হল। সমবেত মহাজনগণ ক্ষিপ্ত শরের এরূপ। অনুভাব দেখে অত্যন্ত ভীত ও ত্রাসিত হলেন। তারপর মহাসত্ত্ব মহাঅগ্নিরাশি উৎপাদক চতুর্থ শর ক্ষেপণ করলেন। তদ্বারা তথায়ই মহাঅগ্নিরাশি প্রজ্বলিত হয়ে সারা আকাশে বিস্তৃতি লাভ করল এবং নগরের বহির্ভাগে চারিদিকে বারক্রয় প্রদক্ষিণ করার পর পুনঃ চারদিকে বজ্রপাতের ন্যায় শব্দ হল এবং মহা লোকে আলোকিত হল। তখন নগরের সমস্ত জনগণ এরূপ অভূতপূর্ব শর দেখে ভীত-ত্রাসিত হয়ে নিজদের স্ত্রী-পুত্রকন্যাগণকে জড়িয়ে ধরল এবং রোদন বিলাপে রত হয়ে অতি দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তখন সিংহল রাজা অতি গর্বিত অন্তরে নিজের অমাত্যবৃন্দকে বললেন– ভবৎগণ, সে কুমারের আয়ুধ এত শক্তি ধারণ করে কি?” জনগণ বললেন–“মহারাজ, এরাজপুত্র এতই মহানুভাব সম্পন্ন যে-তা বর্ণনার অতীত। তার প্রভাবেই তার সে ধনুও মহাপ্রভাব সম্পন্ন। তদ্ধেতু আমরা সবাই ভীত ও ত্রাসিত। হায়! এখন আমরাও যথাসুখে বাস করতে পারব কি?”
মহাসত্ত্বও স্বীয় চিত্তে প্রবর্তিত করুণা বশে সে মহাজনগণের দুঃখ দুর্দশা উৎপাদন না করলেও কিন্তু অতি মান ও ক্রোধ চিত্ত বিধায় ভটসুর রাজা নিজেই বিনাশভাব প্রাপ্ত হবেন বলে জ্ঞানবলে জ্ঞাত হলেন। তাই পুনঃ আর একজন দূত ভটসুর রাজার নিকট এবলে পাঠালেন–“রে দূত, তুমি পুনঃ এখন ভটসুর রাজার নিকট গিয়ে বলবে–ভবৎ রাজন, আমাদের রাজপুত্র অদ্য সায়াহ্ন কালে পুনঃ একটি শর নিক্ষেপ করবেন।” দূতও যথাশীঘ্র গিয়ে রাজাকে সে খবর জ্ঞাপন করলেন। সিংহল রাজ এখবর পেয়ে অতিশয় কম্পিত ও দুঃখীত হৃদয়ে নিজের অমাত্যবৃন্দকে বললেন–“ভবৎগণ আমরা সবাই আমাদের নগর হতে বের না হয়ে সে রাজপুত্রের নিকট আমাদের জীবন যাঞ্চা করব।” অমাত্য প্রমুখ মহাজনগণ রাজার এ প্রস্তাব সানন্দে সমর্থন করলেন। তখন ভটসুর রাজা বহু স্বর্ণ, রৌপ্যাদি সহ স্বীয় স্বীয় অমাত্যগণ সহ সিংহল দ্বীপ নগর হতে বের হয়ে শিবিরে বাসকারী সুবর্ণ কুমার বোধিসত্ত্বের নিকট উপস্থিত হলেন। তথায় সর্বসার রত্ন সমূহ বোধিসত্ত্বকে প্রদান করলেন এবং ভূলুণ্ঠিত হয়ে বোধিসত্ত্বকে বন্দনায় রত হয়ে এ গাথাদ্বয় ভাষণ করলেন–
১৮-১৯। “দেব, আমি এ মহীতলে আপনার এরূপ তেজানুভাব আর কারো নিকট কখনো দেখিনি। আমার নগর রাজ্য প্রাসাদ ও ধন ধান্য সবই এখন আপনাকে দিচ্ছি। তৎবিনিময়ে আমাদের জীবন যাঞ্চা করছি।” ইহা শুনে মহাসত্ত্ব সে সম্পদ প্রদান প্রতিক্ষেপ করে নিন্মোক্ত গাথা যোগে বললেন–
২০-২১। “আমি আপনার রাজ্য, নগর, রাজসম্পত্তি ও ধন ধান্য কিছুই গ্রহণ করব না। আমি ধন প্রয়াসী নহি। হে ক্ষত্রিয় প্রবর, আপনি ভীত হবেন না। আমি আপনার হৃদয় গ্রহণ করতেই ইচ্ছুক।” একথায় সিংহল রাজ অতি দুঃখে প্রকম্পিত দেহে অধোমুখী হয়ে রইল এবং স্বীয় দেহ হতে ঘর্ম বের হতে লাগল। ভটসুর রাজার এঅবস্থা দেখে বোধিসত্ত্ব তাঁর প্রতি করুণা পরবশ চিত্তে তার সাথে আলাপচ্ছলে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় বললেন–
২২-২৩। “হে জনেন্দ্র, আমাকে ভয় করবেন না। আমার অনুকম্পায় আপনি সুখী হবেন। আপনার হৃদয় মাংসের আমার কোন প্রয়োজন নেই। রাজন, আমার পুণ্যের প্রয়োজন। তাই আপনার হৃদয় পুনঃ আপনাকে দান করলাম। আপনার ভালবাসা আমার প্রতি হউক এবং আমার ভালবাসা আপনার প্রতি হউক।” এরূপ বলে মহাসত্ব পুনঃ জনগণকে বললেন–“পরকে হৃদয় দান করা বড়ই দুষ্কর ব্যাপার। যারা অন্যের প্রতি অনুকম্পা চিত্ত সম্পন্ন, তারা পরকে পাপকর্ম হতে নিবারণ করা উচিত। যারা মর্যাদা মৈত্রী চিত্ত সম্পন্ন, তারাই সুন্দর মিত্র। তারা সর্বদা নিজের চিন্তামণির ন্যায় হয়। এবলে নিতাক্ত গাথাটি ভাষণ করলেন–
২৪। “রাজন, যারা সর্বদা সুকর্মে নিরত, তারা সর্বদা ইহলোকে প্রশংসা লাভ করেন এবং মৃত্যুর পর সুগতিতে গমন করেন। যে মিত্র সর্বদাই কায়-বাক্য-মনে সুখ-দুঃখে সহায় হয়, তিনিই মিত্র ধর্মে প্রতিষ্ঠিত। যিনি অনর্থ কর্ম দেখেন, দোষ সম্বন্ধে বলেন এবং পাপকর্ম হতে নিবারণ করেন, তিনিই প্রকৃত মিত্র। হে রাজন, আপনার ভয় উৎপন্ন হলে, তা স্বীয় প্রজ্ঞা দ্বারা
জ্ঞাত হয়ে, আমাকে যথাযথ ভাবে বলবেন তাতে আমার প্রভাবে আপনি সুখী, ভয়শূন্য, দীর্ঘায়ু ও যশস্বী হবেন।” সিংহল দ্বীপের রাজা ইহা শুনে প্রীতিফুল্ল অন্তরে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয়ে বললেন–
২৯-৩০। “সাধু সাধু রাজপুত্র, আপনার সমস্ত বাক্যই সুভাষিত। ইতিপূর্বে কখনো এরূপ বাক্য শুনিনি। আপনার তেজানুভাবে সর্বদাই আপনি আমার প্রিয় হন। তাই শ্রদ্ধা অন্তরে আপনাকে আমার রাজ্য প্রদান করছি। আপনি তা গ্রহণ করুন।”
ইহাশুনে বোধিসত্ত্ব বললেন–“মহারাজ, আপনার বাক্য যদি সত্যই হয়, তবে এখন আপনি আমার সাথে চলুন। আমরা উভয়ে গিয়ে আমার পিতা মাতার পাদ বন্দনার্থ যাব।” বোধিসত্ত্বের একথা শুনে ভটসুর রাজা বললেন–“সাধু সাধু রাজপুত্র,” এবলে পুনঃ বললেন–“রাজপুত্র, আপনি এখানে একটু অপেক্ষা করুন, আপনার সাথে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে হবে।” তখন বোধিসত্ত্ব বললেন–“মহারাজ, আপনি যথারুচিভাবে আপনার গমন সজ্জা করুন। তারপর ভটসুর রাজা সর্বাভরণে প্রতিমণ্ডিত সহস্র তরুণী নারী পরিবেষ্টিতা উত্তম রূপবতী অষ্টাদশ কন্যা ও ষষ্টিতম মহার্ঘ রত্ন এবং বিশিষ্ট পূজার দ্রব্য সমূহ বোধিসত্ত্বকে প্রদান করলেন। তখন হতে সে কন্যাগণ দিবারাত্র বোধিসত্ত্বকে সেবা দ্বারা রমিত করতে লাগলেন। তারপর ভটসুর রাজা নিজের সেনাধ্যক্ষকে ডেকে বললেন–“হে সেনাপতি মহোদয়, আপনি আমার হয়ে সেনাগণকে বলুন–“তারা যেন আমার সাথে যাওয়ার জন্য গমন সজ্জা করেন। আমি তাদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে বারাণসী নগরে সুবর্ণ কুমারের সাথে অনুগমন করব।” এবলে তিনি নিতাক্ত দ্বাদশটি গাথায় বললেন–
৩১-৪২। “ভবৎগণ, আপনারা শীঘ্রই হস্তী, অশ্ব, রথ পত্তি ও সেনাদল নানা অলঙ্কারে অলঙ্কৃত করে আমার নিকট নিয়ে আসুন। সমস্ত জনগণ সহ ব্রাহ্মণ পুরোহিতগণও নানা অলঙ্কারে বিভূষিত করে শীঘ্রই আমার নিকট নিয়ে আসুন। সুর ও মহাশক্তিশালী দশ সহস্র যোদ্ধা নানাবিধ বস্ত্রালঙ্কারে অলঙ্কৃত ও সশস্ত্রে সজ্জিত করে নিয়ে আসুন। নীল, পীত ও রক্তবর্ণ বস্ত্রধারী এবং রক্তবর্ণ উষ্ণীষ ধারী সশস্ত্রে সজ্জিত সেনাগণ শীঘ্রই আমার নিকট আনয়ন করুন। মদীয় দশ সহস্র হস্তীতে জনবল ও সেনাবল আরোহণ করে হেমবর্ণ বস্ত্রালঙ্কার পরিধান পূর্বক সুবর্ণ কুমারের পশ্চাদানুবর্তী হউন। হস্ত্যাচার্যগণ তোমরাও অঙ্কুশ সহ সশস্ত্ৰে নিজকে সজ্জিত করে হস্তী স্কন্ধে আরোহণ করে প্রস্তুত হউন। আমার দশ সহস্র মহাশক্তিশালী। অজানীয় তীব্র গতিশালী সৈন্ধব ঘোটক সজ্জিত করুন। সশস্ত্রে সজ্জিত ইন্দ্রধনুধারী সেনাগণ অশ্বতরপৃষ্ঠে আরূঢ় হয়ে প্রস্তুত হউন। জনগণ আমার দশ সহস্র রথ যোজনা করে সুবর্ণচিত্র নামক পুষ্করিণী তীরে সমাবেশ করুন। মঙ্গল অশ্ব সংযুক্ত রথে আরোহণ করে রথিক সহ সুসজ্জিতভাবে অবস্থান করুণ। সারথিগণ রথে আরামপ্রদ নানাবিধ ধ্বজা, বর্ম, কবচ, চাপ ও উকট প্রহার যন্ত্রাদি রথে সমাবেশ করে শীঘ্রই প্রস্তুত হউন। মহাবীর বহু যোদ্ধা পুরুষ, নানা বর্ণে অলঙ্কৃত ও নানাবর্ণের উষ্ণীষ ধারী বহু শত সহস্র মহাজনগণ শীঘ্রই সশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আসুন।”
এরূপে ভটসুর রাজা নিজের সেনা নিকায়কে মাসেক কাল ধরে গমন সজ্জার সমস্ত কাজ সমাপনান্তর বোধিসত্ত্বকে যাত্রার সময় জ্ঞাপন করলেন। তখন বোধিসত্ত্ব মহাসৈন্যসামন্ত পরিবেষ্টিত হয়ে সর্বলক্ষণ প্রতিমণ্ডিত সর্বশ্বেত মঙ্গল হস্তীস্কন্ধে আরোহণ পূর্বক শিবির হতে বের হয়ে সুসজ্জিত পথে যাত্রা করলেন। ভটসুর রাজাও সুসজ্জিত স্বীয় মহাসেনাদল সমভিব্যাহারে বোধিসত্নের গমন-পথেই চলতে লাগলেন। বোধিসত্ত্ব সিংহল দ্বীপ রাজা প্রমুখ মহাসেনাবলে পরিবৃত হয়ে সমুদ্র তীরের সমীপবর্তী হলেন। তথায় মহাসমুদ্রের তীর সমীপে এক রমণীয় ভূমিভাগ দেখে আনন্দিত হলেন। তথায় তাঁরা মহোৎসব করবার ইচ্ছায় মনোরম গীতাভিনয়ে ব্যবস্থা করলেন। সাতদিন যাবৎ তথায় মহাসেনাদল সহ মহোৎসব করলেন। সাতদিন পর সিংহল রাজা বোধিসত্ত্বকে বললেন–প্রভু রাজপুত্র, আমরা সবাই শুভ নক্ষত্রযুক্ত দিবসেই মহাসমুদ্র পার হবার জন্য মহানৌকায় আরোহণ করব।” রাজার কথা শুনে বোধিসত্ত্ব সাধুবাদের সহিত অনুমোদন করে তা সকলের নিকট প্রচার করলেন। অতঃপর সুনক্ষত্র দিবস সমাপ্ত হলে মহাপরিবার সহ মহানৌকায় আরোহণ করে রত্নখচিত বিচিত্র প্রাসাদে উপবেশন করলেন। তখন সিংহল রাজাও স্বীয় বলবাহন সহ মহানৌকায় আরোহণ করলেন। তখন বোধিসত্ত্বের তেজানুভাবে মহাসমুদ্র রক্ষিকা দেবতা ও মনুষ্য বেশধারী নাগরাজগণের ঋদ্ধি প্রভাবে মহানৌকা মহাসমুদ্রের মধ্যভাগে উপস্থিত হল। দেবগণ নৌকারোহী সবাইকে শ্রেষ্ঠ দিব্য খাদ্য ভোজ্য প্রদান করলেন। নাগরাজগণ দিব্যগন্ধ মালাদি দ্বারা প্রতিমণ্ডিত হয়ে কেহ কেহ নৃত্য করতে লাগল, কেহ কেহ গান-বাদ্য করতে লাগল, কেহ কেহ অঙ্গভঙ্গী করতে লাগল, কেহ কেহ মনোমুগ্ধকর হাস্য করতে লাগল ও কেহ। কেহ করতালি দিয়ে ক্রীড়া উৎসব করতে লাগল। মহাসমুদ্র অতিক্রমের সময় তাদের কোন প্রকার দুঃখ ভোগ করতে হয়নি। এরূপে মহাসত্ত্ব মহানৌকায় সাতদিন যাবৎ নিজের অনুভাব বলে নৌকায় আরূঢ় জনগণ সহ দিব্য সম্পত্তি পরিভোগ করার পর সমুদ্রের অপর পার প্রাপ্ত হলেন। তখন তিনি পিতা মাতার নিকট দূত পাঠিয়ে স্বীয় আগমন বার্তা জ্ঞাপন করলেন। এসংবাদ পেয়ে তাঁর পিতামাতা সমগ্র বারাণসী রাজ্য কদলী, ইক্ষু ও নানাবিধ ধ্বজাদি দ্বারা সুসজ্জিত করালেন। রাস্তাদি সমতল করিয়ে গমনাগমনের সুব্যবস্থা করলেন। তারপর নানাবিধ মনোজ্ঞ উপহারাদি সঙ্গে করে মহাযশস্বী পরিবার সহ আগত মহাসত্বকে আগুবাড়িয়ে বারাণসী নগরে আনয়ন করা হল। তৎপর মহাসত্ত্ব পিতা মাতাকে স্বীয় প্রাপ্ত উপহার স্বর্ণ রৌপ্য ও রত্নাদি নানাবিধ দ্রব্য সমূহ প্রদান। করলেন। তখন ভটসুর রাজা সসৈন্যে বোধিসত্ত্বের পিতামাতাকে অভিবাদন করলেন। তখন উভয় ক্ষত্রিয় নানাবিধ উপহার লাভের পর ও প্রীতি পূর্ণ আলাপের পর সানন্দে মহাসত্বকে এরূপ বর’ প্রদান করলেন।
৪৩। “পুত্র, তুমি দীর্ঘদিন জীবিত থাক। তুমি যেন কখনো আমাদের নিকট হতে বিচ্ছেদ না হও, তথা প্রিয় বস্তু হতেও। শীঘ্রই তোমার সংকল্প পঞ্চদর্শীর চন্দ্রের ন্যায় পরিপূর্ণ হউক।”
এরূপ আশীর্বাদ করার পর রাজা সমগ্র বারাণসী রাজ্য মহাসড়কে প্রদান করলেন। তখন জম্বুদ্বীপের রাজন্য বৃন্দ মহাসত্বের তেজানুভাব শুনে ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে নানাবিধ। উপহার দ্রব্য সহ সসৈন্যে বারাণসী নগরে উপস্থিত হলেন। তথায় তারা মহাসড়কে বন্দনা করে সমস্ত উপহার তাঁকে প্রদান করলেন।
এক সময় জম্বুদ্বীপের সমস্ত রাজা বোধিসত্ত্বের নিকট এসে তার সহিত প্রিয়ালাপ করার পর তাঁকে “রাজ শ্রেষ্ঠ” এ অভিধায় বিভূষিত করে যথাযোগ্য মর্যাদা প্রদান করলেন। তখন বোধিসত্ত্ব সমস্ত রাজা ও সেনাদের উস্কৃষ্ট অন্ন-পানীয় এবং বস্ত্রাভরণ দান করলেন। এমন কি হস্তী-অশ্ব পালক সহ সেনাবৃন্দের প্রত্যেককে যথাযোগ্য ভাবে স্বর্ণ, রৌপ্য ও ধনাদি প্রদান করলেন। তখন দ্বাদশ যোজন বারাণসী নগরের মহাজনগণ স্থানে স্থানে সমবেত হয়ে নাচ-গান-বাদ্য ও অভিনয়ে চতুর্দিক মুখরিত করে তুলল। মহাসক্তের পুণ্যানুভাবে রাজ্যবাসী নীরোগ ও সুখী হল। এক সময় সমস্ত রাজা সপরিষদ মহাবিচারালয়ে উপস্থিত হয়ে কৃতাঞ্জলী হয়ে অবনত শিরে রত্ন পালঙ্কে উপবিষ্ট মহাসত্ত্বকে বন্দনা করে নিন্মোক্ত গাথা চতুষ্টয়ে বললেন–
৪৪-৪৭। “আমরা আপনাকে দেবরাজের ন্যায় মনে করছি। আপনি স্বীয় দিব্য পুণ্যানুভাবে সবাইকে স্বর্গে নিয়ে যাবেন বলে মনে করছি। পূর্বজন্মের কৃতপুণ্য প্রভাবে আপনার ন্যায় তেজানুভাব সম্পন্ন আর কাউকেও দেখছিনা। এজগতে রাজন্যবর্গের মধ্যে শুধু আপনিই সুন্দর বর্ণশালী ও তেজানুভাব সম্পন্ন। কি পুণ্যের দ্বারা আমরা সবাইকে পরাজয় করলেন? সূর্য যেমন স্বীয় রশ্মি প্রভাবে অন্ধকার বিধ্বংস করে বিরোচিত হয়, আপনিও সেরূপ তেজবান ও মহানুভাব সম্পন্ন।” অতঃপর মহাসত্ত্ব নিজের জাতিস্মর জ্ঞানের দ্বারা পূর্বকৃত পুণ্য কৰ্ম প্রকাশ করনোদ্দেশ্যে নিন্মোক্ত গাথায় ভাষণ করলেন–
৪৮-৫০। সজ্জন মণ্ডলি, আমি পূর্বজন্মে যা পুণ্য কর্ম করেছি, তদ্বারা আমি এতাদৃশ্য শ্রীধর, তেজানুভাব, রূপ-লাবণ্য ও মহাবলশালী হয়েছি। ইহা আমার পুণ্যানুভাব। আমি অত্যন্ত গুরু বাক্য বলছি, তরুণ জনগণ তা শ্রবণ কর। আমি পঞ্চ বৈরকর্ম করিনি, ঈর্ষা ও ক্রোধভাব জানিনা। সে পুণ্যকর্মেই ঈদৃশ সুখ লাভ করছি।” তৎপর মহাসত্ব সপরিষদ রাজন্যবর্গকে পুনঃ উপদেশ প্রদান প্রসঙ্গে নিন্মোক্ত পাঁচটি গাথা ভাষণ করলেন–
৫১-৫৫। “সজ্জনমণ্ডলি, ইহপরলোকে জয়, সুখ ও দীর্ঘায়ু কামনাকারী কখনো প্রাণীহত্যা, পরদার লঙ্ঘন ও মিথ্যাবাক্য ভাষণ করেন না। সুরাদি নেশাপান সর্বদা বর্জন করেন। ক্রোধ, অভিমান, ঔদ্ধত্য, কৃপণতা, পরের দুঃখ উৎপাদন ও স্বীয় চিত্তে মিথ্যাদৃষ্টি ভাব উৎপাদন করবেন না। সর্বদা স্বীয় চিত্ত বিশুদ্ধি কারক সম্যক দৃষ্টি সম্পন্ন হবেন। যারা সর্বদা স্বীয় চিত্তকে সম্যক কর্মে নিযুক্ত রাখেন, তারা সর্বদা যশঃ কীর্তি, ধন ও সুখ ইত্যাদিতে যথেচ্ছা বর্ধিত হন।” মহাসক্তের এরূপ বাক্য শুনে সপরিষদ রাজগণ প্রীতিফুল্ল চিত্তে নিন্মোক্ত গাথাটি ভাষণ করিলেন
৫৬। “আপনার সুভাষিত বাক্য আমরা রক্ষা করব। আপনি আমাদের প্রভু। আপনিই আমাদিগকে সুগতি দান করলেন। অতপর মহাসত্ত্ব সপরিষদ রাজাগণকে উপদেশ দিয়ে স্বীয় মহাসৈন্য সামন্ত সহ ভটসুর রাজাকে তাঁর নগরে পাঠিয়ে দিলেন। তখন অপর রাজাগণ ও সপরিষদ প্রীতিচিত্ত হয়ে মহাসত্ত্বের স্তুতি পরায়ণ হয়ে নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
৫৭। অদ্য আমাদের সকলেরই মনুষ্য জন্ম সফল হল। সৎপুরুষের সমাগমে আমাদের জীবন সার্থক হয়েছে। তার প্রভাবেই আমরা সবাই জয়ী হব।”
এবলে রাজাগণ স্বীয় স্বীয় সেনা বাহিনী সঙ্গে করে স্ব স্ব রাজ্যে প্রস্থান করলেন। তারা প্রত্যেক বৎসরের নির্দিষ্ট দিনে নানাবিধ উপহারাদি সাথে করে মহাসত্বের নিকট উপস্থিত হতেন। সে উপহার সমূহ তাকে প্রদান করতেন এবং তার নিকট হতে উপদেশ গ্রহণ করে স্ব স্ব দেশে প্রত্যাবর্তন করতেন। তৎকালে মহাসত্ত্ব বিনাদণ্ডে ও বিনাশস্ত্রে সমগ্র জম্বুদ্বীপের রাজাদের শাসন-পালন করতেন। স্বীয় রাজ্য বারাণসী নগরের চারদ্বারে চারখানা, নগরের মধ্যভাগে একখানা এবং স্বীয় প্রাসাদের দ্বারে একখানা, এ ছয়খানা দানশালা তৈরী করালেন। সে দানশালা সমূহে প্রত্যহ এক এক নিযুত টাকার দানীয় বস্তু মহাজনগণকে প্রদান করতেন। মহাসত্ত্ব পূর্বাহ্নে ও সায়হ্নে প্রত্যহ অমাত্যাদি মহাজনগণকে এরূপ উপদেশ দিতেন–“সজ্জনবৃন্দ আপনারা সবাই আমার প্রদত্ত দানীয় বস্তু হতে সর্বদা যথাসাধ্য দান দেবেন ও পঞ্চশীল রক্ষা করবেন। উপোসথ দিনে উপোসথ শীল রক্ষা করবেন।” সে হতে মহাসক্ত নিজের বারাণসী নগরে রাজসম্পত্তি পরিভোগ করে মৃত্যুর পর দেবলোকে উৎপন্ন হলেন। মহাসত্ত্বের উপদেশ রক্ষাকারী জনগণও মৃত্যুর পর দেবলোকেই উৎপন্ন হলেন। শান্তা এধর্মদেশনা আহরণ করে জাতক সমাপন করবার জন্য নিতাক্ত সমাপ্তি গাথা ভাষণ করলেন–
৫৮। “তখনকার দেবরাজ এখন অনুরুদ্ধ। আমার পিতা এখন শুদ্ধোদন। মাতা এখন মহামায়া। আর সমস্ত পরিষদ বৃন্দ এখন বুদ্ধ পরিষদ। সুবর্ণ কুমারই এখন আমি লোকনাথ।
(দ্বিতীয় সুবর্ণ কুমার জাতক সমাপ্ত।)
মিথুন বড়ুয়া
জাতক গুলো পড়ে ভালো লাগল।কিন্তু পিডিএপ ডাউনলোড করতে পারলে ভালো লাগত। যদি পিডিএপ ডাউনলোড করার সুযোগ করে দিলে ভালো হয়।