৩৭. বট্টঙ্গুলি রাজ জাতক
‘যে পণ্ডিত ব্যক্তি এ ধর্মদেশনা শাস্তা জেতবনে বাস করবার কালে নিজের অতীত জন্মে যে বুদ্ধমূর্তি সংস্কার করেছিলেন, সে সম্পর্কেই বলেছিলেন। পূরিত পারমী সত্তদের উপকার মানসে এক দিবস শাস্তা দেশ পর্যটনে বের হলেন। তৎপর দিবস পসেনাদি কোশল মহারাজ বহু জনগণ সহ সুগন্ধি দ্রব্য, পুষ্পমাল্য ও নানাবিধ পূজোপকরণ লয়ে বুদ্ধ দর্শনার্থ স্বীয় নগর হতে শ্রাবস্তীর জেতবন বিহারে উপস্থিত হলেন। তথায় বুদ্ধের দেখা না পেয়ে ভগ্নমনোরথ ও নিরাশ হয়ে বললেন–ওহে জনগণ, বুদ্ধ এখানে বর্তমান না থাকায় এ জেতবন শূন্য বোধ হচ্ছে। উপস্থিত মহাজনতা ও তথায় বুদ্ধকে দেখে মহাসংবেগ প্রাপ্ত হয়ে পরস্পর বলতে লাগলেন–‘অহো বন্ধো, সম্যক সম্বুদ্ধ বিনা এ জগত যেন শূন্য ও অশরণ বলে মনে হচ্ছে। এরূপ বলে রাজা প্রমুখ সবাই নানা পূজোপকরণাদি দ্বারা বুদ্ধের বাসস্থান পূজা করলেন। তৎপর পসেনাদি মহারাজ প্রমুখ মহাজনগণ বুদ্ধের অদর্শনে সংবেগ ও অপ্রসন্ন মনে প্রত্যাবর্তন করলেন। এদিকে ভগবান বুদ্ধ ও নানাদেশ পর্যটন করে বুদ্ধকৃত্য সম্পাদনের পর অনুক্রমে শ্রাবস্তী জেতবন বিহারে উপস্থিত হলেন। তখন কোশারাজ শোনলেন, “ভগবান বুদ্ধ বহু লোককে মার্গফলাদি দান করে, শ্রাবস্তীর জেতবন বিহারে এসেছেন।” এ খবরে তিনি অত্যন্ত সন্তোষ হয়ে পুনরায় নানাবিধ পূজোপকরণ সহ সপরিষদ জেতবন বিহারে বুদ্ধের নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁকে বন্দনান্তর একান্তে বসে বললেন–ভন্তে ভগবান, গতকল্য এ শ্রাবস্তীবাসী অনেক লোক ভগবানকে পূজা করবার জন্য এখানে এসেছিলেন। তারা আপনার দর্শন না পেয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত চিত্তে চলে গেলেন।” ইহা বলার পর পুনঃ বললেন–“ভন্তে ভগবন, জনগণ কোন কোন সময় আপনাকে না দেখে অনাথের ন্যায় দুঃখীত হয়। আপনি যখন অনুপাধিশেষ নির্বাণ ধাতুতে পরিনির্বাপিত হবেন, তখন আপনাকে না দেখে ভক্তবৃন্দ কিরূপে সুখী হবেন? সুতরাং ভন্তে পূজা বন্দনার জন্য ভগবানের প্রতিরূপ নির্মাণ করবার জন্য তারা প্রার্থনা করছেন। তাই আপনার প্রতিরূপ প্রস্তুত করবার জন্য অনুজ্ঞা প্রদান করুন।” বুদ্ধ রাজার কথা শুনে জগতের হিমঙ্গল চিন্তা করে রাজাকে বললেন–“মহারাজ, যেকোন শ্রদ্ধাবান ব্যক্তি আমার রূপ নির্মাণ করতে পারে। পূর্বেও পুরাতন এক পণ্ডিত ব্যক্তি বুদ্ধমুর্তির এক ভগ্ন অঙ্গুলি পতিত দেখে তা বুদ্ধমুর্তির হস্তে যথাস্থানে সংযোগ করে দিয়েছিলেন। এ কুশল কর্মের প্রভাবে সে ব্যক্তি জন্মান্তরে মহাতেজস্বী ও সুখ সাচ্ছন্দ্যের অধিকারী হয়েছিলেন। এবলে বুদ্ধ নীরব হলেন। তখন রাজা সে পূর্ব বৃত্তান্ত প্রকাশ করবার জন্য বুদ্ধের নিকট অনুরোধ জ্ঞাপন করলেন। তখন বুদ্ধ সে অতীত বিষয় বলতে আরম্ভ করলেন–
মহারাজ, অতীতে ‘অঙ্গুলি’ নামক নগরে অতি সমৃদ্ধশালী এক বণিক কুল ছিল। এ বণিক কুলে বোধিসত্ত্বের জন্ম হল। তখন তাঁর নাম ছিল ‘বন্ধু মানব’। এ বন্ধু মানব শ্রদ্ধা, জ্ঞান, উদ্যোগ ও তৎপরতায় শ্রেষ্ঠ ছিলেন। এক সময় তিনি সামুদ্রিক বাণিজ্যের জন্য ‘অজল তীর’ নামক এক প্রকাণ্ড নৌকা তৈরী করলেন। এ নৌকায় নিজের বিক্রির দ্রব্য ও সহস্র জন কর্মচারী সাথে করে নৌকায় আরোহণ করলেন। ত্রিরত্নের নাম স্মরণ করে মহানৌকা সমুদ্রের বক্ষে চালিয়ে দিলেন। কিয়দিন চলার। পর এক দ্বীপ পেয়ে তথায় নৌকা নঙ্গর করলেন। তখন। বোধিসত্ত্ব সপরিষদ ঐ দ্বীপে উঠে এদিক ওদিক ভ্রমণ করে একখানা বিহার দেখলেন। তখন তাঁরা সশ্রদ্ধায় সে বিহারে প্রবেশ করে দেখলেন, এক বুদ্ধমূর্তির হস্তাঙ্গুলি একটি ভগ্ন হয়ে পতিতাবস্থায় আছে। ইহা দেখে বোধিসত্ত্ব চিন্তা করলেনএখন আমার পুণ্য করবার মহা সুযোগ হয়েছে এ মূর্তির অঙ্গুলির সংযোগ সাধন করে সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেব। এ পুণ্য কর্ম আমার সুখ বিপাক দায়ক হবে।’ বোধিসত্ত্ব এ চিন্তা করে তথায় উপবেশন করলেন এবং নিজের কর্মচারীদের নিয়োক্ত গাথায় বললেন–
১। ভদ্রগণ, যে জ্ঞানী ব্যক্তি শ্রদ্ধাসহকারে আমার সাথে এ বুদ্ধমূর্তির ভগ্নাঙ্গুলি সংযোজন করবে, সে ব্যক্তি ধনলাভ করবে এবং মৃত্যুর পর দেব মনুষ্যলোকে বিপুল সুখের অধিকারী হবে। এ বলে মহাসত্ত্ব বুদ্ধমূর্তির ভগ্ন অঙ্গুলি নিজেই গ্রহণ করে অন্যমৃত্তিকা তৈলাদি দ্বারা মর্দন করলেন। তদ্বারা অঙ্গুলি সংযোজন করে মূর্তির সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিলেন। তৎপর তথায় স্থানীয় এক নারীকে কিছু অর্থ দিয়ে বললেন–“ভদ্রে, তুমি শ্রদ্ধাচিত্তে এ অর্থ হতে এ বুদ্ধমূর্তির সম্মুখে প্রত্যহ সন্ধ্যায় প্রদীপ পূজা করবে। এ বলে বুদ্ধমূর্তিকে বন্দনা করে নিন্মোক্ত গাথাটি ভাষণ করলেন–
২। দেবমনুষ্যলোকে সর্বসম্পত্তি দায়ক এ বুদ্ধমূর্তিকে আমি সৌন্দর্য দান করলাম। এ বলে মহাসত্ত্ব তথায় উপবিষ্ট হয়ে নিন্মোক্ত গাথায় যোগে প্রার্থনা করলেন
৩-৫। ভন্তে, এ পুণ্যকর্মের প্রভাবে আমি যেন অনাগতে এ জগতে অতুলনীয় জিন সর্বজ্ঞ বুদ্ধ হতে পারি। ভন্তে, সংসারে সঞ্চরণকালে আমি যেন সর্বদা অতিশয় রূপলাবণ্যময়, দীর্ঘায়ু সম্পন্ন ও জগত কল্যাণ কামী হতে পারি এবং কোনও চোর ও শত্রু ভয় কোন কালে আমার সম্মুখীন না হয়।’
মহাসত্ব তথায় ওরূপ প্রার্থনা স্থাপন করে বুদ্ধমুর্তিকে পুনঃ বন্দনা করার পর সপরিষদ তথা হতে প্রীতিফুল্লমনে স্বীয় স্থানে। প্রত্যাবর্তন করলেন। তখন সৎপুরুষ ‘বন্ধুমানব’ বোধিসত্ত্ব যথায়ুস্কাল মানবকুলে অবস্থান করে মৃত্যুরপর দেবলোকে উৎপন্ন হলেন। তথায় দীর্ঘকাল যাবৎ প্রমোদিত চিত্তে দিব্য সুখ সম্পত্তি পরিভোগ করার পর পরমায়ুর অবসানে তথা হতে সহস্র দেবপুত্র সহ চ্যুত হয়ে বোধিসত্ত্ব প্রতিসন্ধি গ্রহণ করলেন বারাণসীর অঙ্গু নামক রাজার অগ্রমহিষীর জঠরে। অপর সহস্র দেবপুত্র জন্ম নিলেন তথায় সহস্র অমাত্যের পুত্ররূপে। দশমাস পরিপূর্ণ হলে বোধিসত্ত্ব সহ অই সহস্র দেবপুত্র একই দিবসে ও একই লগ্নে ভূমিষ্ট হলেন। তখন বোধিসত্ত্বের পিতা অঙ্গরাজ সংবাদ পেলেন–তার পুত্রের জন্মদিবসে বারাণসীতে আরো সহস্র সন্তান সহস্র অমাত্যের গৃহে জন্ম নিয়েছে। রাজা এ সংবাদ জ্ঞাত হয়ে তখনি ঐ সহস্র অমাত্যের সন্তানগুলি। রাজবাড়িতে এনে স্বীয় পুত্রের সাথে সযত্নে প্রতিপালন করতে লাগলেন। বোধিসত্ত্ব সহস্র অমাত্য কুমারদের সাথে খেলা। করবার সময় যদি কোনও কারণে তাঁর চিত্তে ক্রোধভাব উৎপন্ন হয়, তাহলে তিনি একটি অঙ্গুলি দ্বারাই সকলকে শাসন করতেন। তাঁর তেজানুভাবে সম্মুখে কেহ তিষ্ঠিতে না পেরে স্বীয় স্থানে গিয়ে বসে পড়তো। অঙ্গরাজ বোধিসত্ত্বের ক্রম্বিধ তেজানুভাবে দেখে পুত্রের নাম রাখলেন ‘বট্টঙ্গুলি কুমার। তখন কুমার অতি তেজানুভাব সম্পন্ন হয়ে পিতার সাথে বাস করতে লাগলেন। অনন্তর অঙ্গরাজ পরলোক গমন করার পর বট্টলি কুমার রাজ্যাভিষিক্ত হয়ে ধর্মতঃ সমদমের মাধ্যমে। রাজত্ব করতে লাগলেন। সে সময়ে তিনি দান দিবার ইচ্ছায় নগরের চর্তুদ্বারে চারখানা, নগরের মধ্যভাগে একখানা এবং নিজের প্রাসাদের সমীপে একখানা, এ ছয়খানা দানশালা তৈরী করে প্রত্যহ প্রত্যেক দানশালায় ছয় সহস্র মুদ্রা ব্যয়ে যাচকগণকে দান দিতে লাগলেন। একদা বট্টলি মহারাজ মুখ হাত ধৌত করে স্বীয় বাসভবনের সমীপে প্রতিষ্ঠিত দানশালায় অমাত্যগণ সহ বসে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
৬। “যে কোন ব্যক্তি পরিভোগের জন্য আমার নিকট হতে ধন যাঞ্চা করলে, তাকে প্রচুর ধন দেব, একমাত্র আমার বুদ্ধত্ব লাভেরই জন্য।”
তারপর মহাসত্ত্ব সহস্র জম্বুদ্বীপে বাসকারী একশত ক্ষত্রিয় রাজার নিকট এরূপ সংবাদ পাঠালেন–“আপনারা নানাবিধ উপহার ও স্বীয় স্বীয় কন্যা সহ সহসা আমার নিকট উপস্থিত হউন।” রাজগণ দূত মুখে এ সংবাদ পেয়ে ক্রোধে অধীর হয়ে স্বীয় স্বীয় সেনাবৃন্দকে সমবেত করালেন। তারপর ঐ দূত ও সেনাগণকে সম্বোধন করে নিন্মোক্ত গাথা চতুষ্টয় যোগে বললেন–
৭-১০। “হে দূত, তোমার রাজা যেমন মাতৃ দুগ্ধ পান করে বর্ধিত হয়েছে, আমরাও সেরূপ বর্ধিত হয়েছি। সে রাজা যেমন বলশালী ও মহির্জি সম্পন্ন, আমরাও সেরূপ। সে রাজা যেমন মহাবলশালী পুরুষ, আমরাও সেরূপ। সে রাজা যেমন স্বীয় রাজ্যে পুরুষাকারে বাস করেন, আমরাও সে হিসাবে বাস করছি।” এ বলে রাজা মানে ও ক্রোধে স্ফীত হয়ে উক্ত রাজদূতকে বললেন–“হে রাজদূত, আমরা সবাই তোমার রাজাকে নানা উপহার দ্রব্য ও স্ব স্ব কন্যা দেব না।” আমরা সবাই পুরুষ। কেহ নারী নই। সে রাজার সাথে আমরা যুদ্ধ করব।” এ বলে সে দূতের হস্তে প্রত্যুত্তর পত্র দিয়ে পাঠিয়ে। দিলেন সে বিষয় প্রকাশ করার মানসে শাস্তা নিন্মোক্ত একাদশটি গাথা ভাষণ করলেন–
১১-২১। তখন ঐ শতজন রাজা অষ্ট অক্ষৌহিনী সেনা সহ একত্রিত হয়ে পরামর্শ করলেন। তারা রাজ মান-বশে বট্টঙ্গুলি রাজাকে কন্যা ও উপহারাদি দিল না। অপিচ তাহারা ক্রোধান্বিত হয়ে তার সাথে যুদ্ধ করবে।” এবলে দূত দ্বারা পত্র পাঠিয়ে দিলেন। যুদ্ধার্থে উক্ত রাজগণ বের হয়ে অনুক্রমে শীঘ্রই বারাণসী নগরের সমীপবর্তী হয়ে তথায় সেনানিবাস স্থাপন করলেন। তাঁরা বারাণসী নগরের চর্তুদিকে সেনার দ্বারা পরিবেষ্টন করালেন। তখন রাজগণ একমত হয়ে বট্টঙ্গুলি রাজার নিকট এবলে দূত পাঠালেন–“আমরা সবাই তোমার সাথে যুদ্ধ করবার জন্য এখানে এসেছি।” এখন কি রাজ্য দেবে, নাকি যুদ্ধ দেবে? “যথা সত্বর এর উত্তর দাও।” বট্টঙ্গুলি মহারাজ তাদের একথা শুনে ক্রোধান্বিত হয়ে সংকল্প করলেনতাদের সাথে যুদ্ধই করবেন। এসংবাদ নিয়ে পুনঃ দূত পাঠালেন। বটুলি মহারাজের সহজাত মহাবলশালী সহস্র অমাত্য পুত্র বললেন–তাদের সাথে আমরাই যুদ্ধ করব। আপনাকে যুদ্ধ করতে হবে না, রাজা আমাদের প্রভু। আপনি। কেবল রাজত্ব সুখই ভোগ করুন। আমাদের একথা রক্ষা করুন।”
২২-৪৯। “মহারাজ অমাত্যদের একথা শুনে তাদের বললেন–তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করতে হবেনা। তাদের সাথে আমিই যুদ্ধ করব। আমার যুদ্ধ কিরূপ, তা তোমরা দেখবে। পুনঃবার তারা মহারাজের নিকট যাঞ্চা করলেন, “আমাদের হতে এক একজন যুদ্ধের জন্য পাঠিয়ে দিন। আমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করে সে রাজগণকে আপনার নিকট নিয়ে আসব। দেব, আমাদের যুদ্ধ কিরূপ, তা দেখুন। এরূপ কথিত হলে তাদের প্রতি নিত্য করুণাপরায়ণ বট্টঙ্গুলি অমাত্যদের নিবারণ করতে গিয়ে মধুর স্বরে বললেন–“ভদ্রগণ আমার বাক্য শ্রবণ কর। তোমরা আমার সাথে ভূমিষ্ট হয়েছ। তোমরা মহাশক্তিশালী বীর পুরুষ। তা আমি জানি। তবে আমি একাই গিয়ে তাদের সাথে যুদ্ধ করে আমার তেজ প্রভাবে সসৈন্য তাদের অক্ষতভাবে নিরাপদে আমার বশে নিয়ে আসব। সসৈন্য তাদের বিনষ্ট করতে আমার কোনই কষ্ট হবে না। তবে তোমরা তাদের মারণ, বন্ধন কিছুই করবেনা। এ বলে বট্টলি মহারাজ তাদের রণক্ষেত্রে না যাওয়ার জন্য নিবারণ করে বললেন–, আমার একজনের যুদ্ধই তোমরা দর্শন কর। তোমরা সবাই সসৈন্য ও স্যান বাহনে আমার সাথে তথায় গিয়ে আমার পেছনে দাঁড়িয়ে থেকে আমার যুদ্ধ দর্শন করবে। বট্টঙ্গুলি রাজা এবলে সসেনায় পরিবৃত হয়ে দেবরাজের ন্যায় শোভমানবস্থায় রণক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন। তিনি সসৈন্যে বিপুলভাবে সজ্জিত সমবেত শতরাজাকে দেখে বললেন–“ভদ্রগণ আপনারা এখানে কেন এসেছেন? তারা বললেন–আমরা এক শত রাজা অষ্টাদশ অক্ষৌহিনী সেনাসহ আপনার সাথে যুদ্ধ করবার জন্য এসেছি।” বট্টলি রাজ বললেন–ভদ্রগণ, আপনারা সত্যই কি আমার সাথে যুদ্ধ করার মানসে সসৈন্যে এখানে এসেছেন? শতরাজার পক্ষ হতে উত্তর হল, হাঁ। ক্ষত্রিয়, আমরা সত্যই আপনার সাথে যুদ্ধ করবার ইচ্ছায় এসেছি। আমরা জম্বুদ্বীপে একশত ক্ষত্রিয় রাজা আপনার সাথে যুদ্ধ করব। বঙ্গুলি রাজা সে শত্রু রাজগণকে বললেন–ভদ্রগণ, আপনারা আমার সাথে যুদ্ধ করবার ইচ্ছায় অষ্ট অক্ষৌহিনী সেনাসহ আমার নিকট এসেছেন।” এরূপ বলে পুনঃ একটিমাত্র অঙ্গুলি উত্তোলন পূর্বক বললেন–“আপনারা সবাই সসেনায় বসে পড়ুন।” একথা বলামাত্রই সসৈন্যে শতজন রাজা সবাই পলায়ন না করে হস্ত প্রসারণ পূর্বক সেখানেই বন্ধন দশাপ্রাপ্ত হওয়ার ন্যায় বসে পড়ল। অধোমুখে উপবিষ্ট সসৈন্য শতরাজাকে বট্টঙ্গুলি মহারাজ বললেন–“আপনারা সবাই দাঁড়ান।” তখন রাজগণ দাঁড়িয়ে করযোড়ে রাজাকে বন্দনা জ্ঞাপন করে এরূপে অভয় যাঞ্চা করতে লাগলেন–“মহারাজ আমরা সবাই আপনার বশে আসলাম। এখন আপনি আমাদের দুঃখ হতে মুক্ত করুন।” দয়ালু বট্টঙ্গুলি রাজা সসৈন্যে শত রাজ্যের একশত রাজার প্রতি মৈত্রী পরায়ণ হয়ে স্বীয় পুত্রের ন্যায় সে রাজগণকে অভয় দান করলেন এবং পঞ্চশীলাদি শিক্ষা দিয়ে উপদেশ প্রদান করলেন। তারপর তিনি সে রাজগণ দ্বারা পরিবৃত হয়ে দেবরাজ ইন্দ্রের ন্যায় বিরোচিতাবস্থায় স্বীয় নগরে প্রবেশ করলেন। তথায় তাহাদের বিপুল উৎসবের মাধ্যমে জয়পান ও ভোজন দান করলেন। তারপর নরেন্দ্র ঐ শতরাজার সাথে প্রমোদিত চিত্তে প্রিয় বাক্য ভাষণ করে অনাবিল দিব্য সুখ অনুভব করলেন। এরূপে তিনি রাজত্ব সুখ অনুভবে রত হয়ে এইরূপ চিন্তা করলেন, “আমি জন্মান্তরের। কোন পুণ্য কর্মের ফলে এরূপ সুখ লাভ করছি?” এরূপ চিন্তা করে সুখময় সুকোমল শষ্যায় শয়ন করলেন।” অতীত জন্মে তাঁর পূরিত পারমীর প্রভাবে সেক্ষণেই দেবরাজের বাসভবন উত্তপ্ত হল। তখন দেবরাজ এর কারণ চিন্তা করে সবই জ্ঞাত হয়ে তৎক্ষণাৎ স্বর্গ হতে এসে বট্টঙ্গুলির সম্মুখে আকাশে স্থিত হলেন। তাঁর সেই দিব্য প্রভায় চতুর্দিক প্রভাসিত হল। সে বিষয় প্রকাশ মানসে শাস্তা নিন্মোক্ত নয়টি গাথা ভাষণ করলেন–
৫০-৫৮। অতঃপর তার সংকল্প জ্ঞাত হয়ে দেবরাজ স্বর্গ হতে অবতরণ পূর্বক রাজার পূরোভাগে স্থিত হলেন। তাঁর দিব্যালোকে প্রাসাদ অবভাসিত হল। আকাশে স্থিত দেবরাজকে দেখে রাজা বললেন–“আপনি কি দেবতা, বা গন্ধর্ব নাকি দেবরাজ পুরন্দর, আপনার এতাদৃশ বর্ণ-প্রভা আমি কোথাও কখনো দেখিনি ও শুনিনি। আপনি কোন উদ্দেশ্যে এখানে এসেছেন, আমাকে বলুন। রাজার কথা শুনে নিজের পরিচয় দেবার ইচ্ছায় বললেন–আমি দেবরাজ ইন্দ্র। আপনি পূর্বে কি পুণ্য করেছেন, তা জানবার জন্যই আপনার নিকট এসেছি। হে। নরাধিপ, আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি যে–আপনি কেন এরূপ অমিত তেজ কোন পুণ্যে লাভ করছেন, তা আমাকে বলুন। দেবরাজ ইন্দ্র কর্তৃক এরূপ জিজ্ঞাসিত হলে শ্রেষ্ঠাসনে উপবিষ্ট বট্টঙ্গুলি মহারাজ নিজের কৃতপুণ্য-বিষয় চিন্তা কররেন-” তৎক্ষণে বোধিসত্ত্ব দেবরাজের অনুভাব বলে জাতিস্মর জ্ঞান লাভ করতঃ আকাশে পূর্ণচন্দ্র মণ্ডলের ন্যায় নিজের কৃতপুণ্য প্রকট হল। দেবরাজের নিকট সে পুণ্য প্রকাশ মানসে নিন্মোক্ত একবিংশতি গাথা ভাষণ করলেন—
৫৯-৭৯। “দেবরাজ, অতীতে আমি অঙ্গুলি নামক নগর বাসী ব্যবসায়ী ছিলাম। এক সময় বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে মহানৌকা নিয়ে সমুদ্র পথে যাত্রা করি। জনগণ সহ সমুদ্রের পরতীরে গিয়ে উপস্থিত হলাম। তীরে উঠে এদিক ওদিক বিচরণ করবার কালে এক বিহার দর্শন করে, তাতে প্রবেশ করেছিলাম। সেখানে দেখলাম এক বুদ্ধমূর্তি। তা বন্দনা ও প্রদক্ষিণ করার কালে দেখলাম এক বুদ্ধমূর্তির একটি অঙ্গুলি ভগ্নাবস্থায় তথায় পড়ে রয়েছে। তখন আমি তা সংযোজন করে দিয়ে সাদরে পূজা করেছিলাম। উক্ত বুদ্ধমূর্তিকে নিত্য প্রদীপ পূজা করবার জন্য তথায় এক নারীকে অর্থ দিয়েছিলাম। দেব, তখন আমি সর্বসম্পত্তি সাধক সে বুদ্ধমূর্তিকে ধীরমানসে বন্দনা করে এরূপ প্রার্থনা করেছিলাম–“ভন্তে আমার এ কৃত পুণ্যের প্রভাবে জগত বাসীকে মুক্তি দেওয়ার জন্য অনাগতে যেন। সর্বজ্ঞ বুদ্ধ হই। সর্বদা সংসারে সঞ্চরণ কালে যেন অতিশয় রূপবান ও শক্তিশালী হই, শত্রু ও চোরাগণ যেন আমার সম্মুখীন না হয়, সর্বদা যেন আমি ভয়াতীত হই।” এরূপে আমি বুদ্ধমূর্তির সম্মুখে প্রার্থনা করে এখন স্বীয় রাজ্যে বিপুল সুখ লাভ করছি। ঐ কৃতপুণ্যের প্রভাবেই এখন আমি মহাতেজ ও মহাঋদ্ধি সম্পন্ন এবং জ্যোতিমান ও যশস্বী হয়েছি। আমার শত্রু শতজন রাজা যুদ্ধার্থী হয়ে সসৈন্যে আমার সম্মুখীন হলে, তখন তারা সসৈন্যে আমার বশে এসে অভয় যাঞ্চা করল। দেব, তদ্ধেতু আমি যশস্বী, তেজবান, মহাশক্তিশালী “বট্টঙ্গুলি” নামক রাজা হয়ে স্বীয় রাজ্যে বাস করছি। সিংহ প্রভৃতি হিংস্র জন্তু আমাকে আক্রমণ উদ্দেশ্যে আমার সম্মুখীন হলে, তারা স্থিত স্থানেই নিপতিত হয়। হস্তী প্রভৃতি প্রকাণ্ড প্রাণী যুদ্ধ করবার জন্য আমার সম্মুখীন হলেই, আমার পুণ্য তেজে এরাও ভূমিতে লুঠিয়ে পড়ে। সর্বপ্রাণীর আশ্রয়ভূত মহাকুটধারী। মহাপবর্তও যদি বিশেষ ক্রোধবশে আমার দ্বারা স্পর্শিত হয়, তবে সেই পর্বতও আমার তেজ প্রভাবে তখনই ভস্মীভূত হবে। ভবৎ দেবরাজ, যে ধন আমার অঙ্গুলী দ্বারা স্পর্শিত হবে, সে। ধন আমার পুণ্য-তেজে কখনো ক্ষয় হয়না। দান দিয়া কখনো অনুতপ্ত হইনা বরং সর্বদা চিত্ত প্রসন্ন ও প্রসারিত করি। হে দেবরাজ পূর্বজন্মে বুদ্ধমূর্তির অঙ্গুলি মেরামত করার ফলে অনাগতে বুদ্ধত্ব লাভ করব। সে কর্মের দ্বারা আমি সম্বুদ্ধত্ব লাভ করে জগতের হিতের জন্য উত্তম ধর্মদেশনা করব।” দেবরাজ ইন্দ্র বট্টঙ্গুলি রাজার এবম্বিধ কথা শুনে প্রমোদিত চিত্তে আকাশে সমাসীন হয়ে পুনঃ নিজের ইন্দ্ৰত্বভাব প্রকাশ করলেন–। সে বিষয় প্রকাশ মানসে শাস্তা নিন্মোক্ত দশটি গাথা ভাষণ করলেন–
৮০-৮৯। দেবরাজ বোধিসত্ত্বের বাক্য শুনে প্রসন্নচিত্তে তাকে ইন্দ্রভাব প্রকাশ করলেন–। হে রাজন, আমি দেবরাজ ইন্দ্র। আপনার পুণ্যকর্ম জানবার ইচ্ছায় আমার এখানে আগমন। হে নরাধিপ, আপনি অনাগতে বোধিমূলে বসে পঞ্চমার বিধ্বংশ করে সর্বজ্ঞতা প্রাপ্ত হবেন। আপনি অনাগতে জগতে দেব মনুষ্যদের মধ্যে নিশ্চয়ই শাস্তা, শ্রেষ্ঠ ও অগ্ৰপুকাল হবেন। আপনি নিশ্চয়ই জগতের সুখদায়ক সৎদের শরণালয় ও সত্বগণের অনুকম্পকারী। জগতের হিতকারী,
কুশলকারীদের চক্ষু দানকারী ও ধর্মস্বামী তথাগত হবেন। আপনি অনাগতে নিশ্চয়ই চতুরার্য সত্য ও মোক্ষ বিষয়ে শ্রেষ্ঠ ধর্মদেশনাকারী এবং সর্বপ্রাণীদের হিতদায়ক হবেন। হে মহারাজ, অনাগতে আপনি বুদ্ধ হয়ে সংসারে নিমগ্ন সভৃদিগকে ধর্মনৌকায় আরোহণ করিয়ে নিশ্চয়ই উত্তীর্ণ করবেন। এবং সমস্ত নরক শূন্য করে সত্বদিগকে মুক্ত করবেন ও ধর্মামৃত পান করাবেন। তারপর যথায়ুষ্কাল পৃথিবীতে অবস্থান করার পর পরিনির্বাপিত হবেন। তখন বোধিসত্ত্ব তথায় দেবরাজের সাথে প্রীতি জনক আলাপ করার পর তাঁকে বুদ্ধমূর্তি তৈরী করে দান করবার ফল দেশনা প্রসঙ্গে নিন্মোক্ত দ্বাদশটি গাথায় বর্ণনা। করলেন
৯০-১০১। “দেবরাজ, যে ব্যক্তি ক্ষুদ্র বা বৃহৎ বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ করে বা করান, সে ব্যক্তি জন্মান্তরে অতিশয় রূপবান, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সম্পন্ন এবং দেবনরের প্রিয়, মহাতেজস্বী, ঋদ্ধিবান, উত্তম রুচিকর বর্ণশালী ও মহাযশস্বী হয়। সে জন্মে জন্মে প্রজ্ঞাবান মহানুভব সম্পন্ন, তেজবান ও সর্বা প্রতিমনা এবং সুখী, সুস্থ, দীর্ঘায়ু, শত্রুবিহীন ও নির্ভীক হয়। সে বুদ্ধমুর্তি দায়ক সংসারে সঞ্চরণ কালে চতুর্বিধ অপায়ে গমন করেন না। সর্বদা দেবমনুষ্যলোকে উৎপন্ন হয়ে সবারই উত্তম হয়। তারা মনুষ্য লোকে উৎপন্ন হলে সর্বদাই ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণ কুলেই উৎপন্ন হয়। বিশাল বিভবসম্পন্নকুলে জন্মগ্রহণ করে দাস দাসী দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে। তাকে সবাই মান্য গণ্য করে, পূজা করে, সত্ত্বার সহকারে রমিত করে এবং মহাজনগণ তাঁর বশে অনুগমন করে। তাঁরা দেবলোকে উৎপন্ন হয়ে সর্বদা দেবগণ দ্বারা পরিবৃত হয়ে অতি দীর্ঘকাল ব্যাপী প্রমোদিত হয়। বুদ্ধমূর্তি দানের ফলে বিপুলভাবে মনুষ্যসুখ ও দিব্যসুখ লাভ করে পরে নির্বাণ সুখও লাভ করেন। বুদ্ধমূর্তি দানেরই ফল।
এরূপে দেবরাজ ইন্দ্র বোধিসত্ত্বের নিকট বুদ্ধমূর্তি দানের এসব ফল বর্ণনা শুনে সে রাজাকে কিছু উপদেশ প্রদান। করলেন। তারপর বোধিসত্ত্বের সাথে প্রিয় আলাপান্তে স্তুতি করে স্বীয় দেবলোকে চলে গেলেন। শাস্তা এ বিষয় প্রকাশ প্রসঙ্গে নিন্মোক্ত দশটি গাথা ভাষণ করলেন–
১০২-১১১। “তখন বট্টলি রাজার এসব বাক্য শুনে দেবরাজ সমবেত জনগণকে উপদেশ প্রদানান্তর বট্টঙ্গুলি রাজার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে প্রমোদিত চিত্তে বললেন–আমি বুদ্ধমূর্তি তৈরী করে প্রত্যহ পূজা করব।” এ বলে দেবরাজ স্বর্গে চলে গেলেন। তখন বট্টঙ্গুলি রাজা জনগণকে উপদেশাদি দিয়ে উপকার করতে লাগলেন। তিনি সবার সাথে প্রীতিজনক আলাপাদির পর সবাইকে পঞ্চশীলে প্রতিষ্ঠাপিত করে স্বীয় স্বীয় রাজধানীতে পাঠিয়ে দিলেন। ঐ একশত রাজা স্বীয় স্বীয় রাজ্যে গিয়ে প্রত্যেক বৎসর বট্টঙ্গুলি রাজার জন্য বহু ধন রত্ন উপহার স্বরূপ পাঠিয়ে দিতেন। তদবধি জনগণ তার উপদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পুণ্য কর্ম সম্পাদন করতে লাগলেন এবং পরমায়ুর অবসানে মৃত্যুর পর স্বর্গলোকে গমন করলেন। বট্টলি রাজাও নানা প্রকার পুণ্যকর্ম সম্পাদনে রত হয়ে রাজত্ব করতে লাগলেন। অনন্তর তিনিও মৃত্যুর পর সুগতি স্বর্গলোক প্রাপ্ত হলেন। তথায় তিনি সুদীর্ঘকাল দিব্য সম্পদ ভোগে নিরত হয়ে অনুপম সুখ ভোগ করতে লাগলেন।” এরূপে ভগবান কোশল রাজাকে এ অপূর্ব “বট্টলি” জাতক দেশনা সমাপ্ত করে জনসাধারণের ভবিষ্যৎ শ্রীবৃদ্ধির উপায় লক্ষ্য করে উপরন্তু স্বীয় শাসনের চিরস্থিতি কামনায় আপন প্রতিবিম্ব নির্মাণের জন্য রাজাকে অনুজ্ঞা প্রদান করলেন। তা ব্যক্ত করবার মানসে নিন্মোক্ত নয়টি গাথা ভাষণ করলেন–
১১২-১২০। “মহারাজ আমার শাসন চিরস্থিতির জন্য শ্রদ্ধার সহিত যে ব্যক্তি বুদ্ধের প্রতিমূর্তির মৃত্তিকা ও কাষ্ঠ ইত্যাদি দ্বারা নির্মাণ করায় সে মহাপুণ্য লাভ করবে। জনগণ পূজা ও বন্দনার জন্য যে ব্যক্তি তথাগত বুদ্ধের ছোট বড় যে কোন প্রকার মূর্তি তৈরী করে প্রতিষ্ঠা করে, তারা জন্মে জন্মে সূর্যের ন্যায় মহাতেজশালী হয়। মহারাজ, এসব পুণ্যবান জন্মজন্মান্তরে অপায়ে গমন না করে সুগতি স্বর্গ লোক লাভে সুখী ও প্রমোদিত হয় এবং জ্ঞাতীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হয়ে মহাসম্মান লাভ করে। অতঃপর ভবিষ্যতে নির্বাণ সুখ প্রাপ্ত হয়। যারা গৌরব চিত্তে সামর্থানুযায়ী বুদ্ধমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে, তারা জন্মান্তরে বুদ্ধশাসন হিতৈষী ও পরম শান্তি সুখের অধিকারী হয়। তারা ভবিষ্যতে দুঃখের অন্তসাধন করে নির্বাপিত হয়। তাই মহারাজ আপনি পরম সুখ উৎপাদক বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ করবেন এবং অপরকেও তজ্জন্য উৎসাহিত করবেন। সর্বদা সর্বসম্পত্তি সাধক এবিষয় এখন আমি বর্ণনা করলাম।”
পসেনাদি কোশল রাজা ভগবানের এ অনুজ্ঞা বাণী পেয়ে বললেন–“সাধু সাধু ভন্তে, আপনার বাক্যে আমি সানন্দে। অনুমোদন করলাম। তবে ভন্তে, এখন আমি জানতে চাই যে বুদ্ধমূর্তি কি বস্তু দিয়ে তৈরী করতে হবে? তা আপনার মুখে শুনতে চাই। তখন বুদ্ধও সমস্ত দেবনরের চিরকাল ব্যাপী হিতসুখ বৃদ্ধির জন্য নিজের প্রতিমূর্তি তৈরীর অনুজ্ঞা দিয়ে নিতাক্ত তিনটি গাথায় বললেন–
১২১-১২৩। “মহারাজ, মৃত্তিকা, কাষ্ঠ শিলা ও স্বর্ণ রোপ্যাদি দ্বারা দীর্ঘ, হ্রস্ব, বৃহৎ, ক্ষুদ্র ইত্যাদি যে কোন প্রকার বুদ্ধমূর্তি তৈরী করা উচিৎ। হে ক্ষত্রিয় রাজন, এরূপ বুদ্ধমূর্তি আপনি শ্রদ্ধার সহিত নির্মাণ করলে অসংখ্য অপ্রমেয় ফল প্রাপ্ত হবেন বলে ধারণা করুণ।” এবলে শাস্তা বুদ্ধমূর্তি তৈরী করার মহাফল আরো বিশেষ ভাবে জ্ঞাপন করবার জন্য আশ্চর্যজনক উপমাযুক্ত চারটি গাথা ভাষণ করলেন–
১২৪-১২৯। মহারাজ, ঋদ্ধিবান পণ্ডিত ব্যক্তি চারমহাদ্বীপ পরিপূর্ণ মূগমাষ জাতীয় শস্যাদি গণনা করতে সমর্থ হয় বটে, কিন্তু বুদ্ধমূর্তি দানফলের পরিমান করতে সমর্থ হয় না। সমগ্র চক্রবাল পূর্ণ সপ্তবিধ শস্য গণনা করতে সমর্থ এমন কোন মহাঋদ্ধিবান দেবপুত্র ও বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ করে দান করার পুণ্য ফল পরিমান করতে অক্ষম। হে নরাধিপ, সমস্ত চক্রবালের অগাধ মহাসমুদ্রে কত গণ্ডুষ জল আছে, তা গণনা করতে সমর্থ এমন কোন মহাঋদ্ধিবান দেবপুত্র ও বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ ও দানের ফল পরিমান করতে সক্ষম হবেনা। হে রাজ শ্রেষ্ঠ, কোন মহাঋদ্ধিবান দেবপুত্ৰ সমগ্ৰ চক্ৰবালে এবং পৃথিবী হতে ভবা। পর্যন্ত যত পরিমান স্বর্ণ রৌপ্য আছে, তা গণনা করতে সমর্থ হলেও বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ ও দানের ফল পরিমান করতে সমর্থ হবেনা।”
সপরিষদ পসেনাদি কোশলরাজা ভগবানের এ ধর্মদেশনা শুনে অত্যধিক আনন্দিত হলেন। ততোধিক প্রীতি সৌমনস্যের সঞ্চার হল, জগত বাসীর মহাকল্যাণকর বুদ্ধমূর্তি নির্মাণের অনুমতি পেয়ে। তদনন্তর তিনি চন্দনবন হতে চন্দনতরু এনে বুদ্ধের সমপরিমান চন্দনসারের এক অতি মনোরম বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ করালেন। মূর্তি লাক্ষারস ও যথোপযুক্ত রঙে রঞ্জিত করার পর একখানা মহার্ঘ আসনে বসালেন। রাজা তরুণ সূর্যের ন্যায় বিরোচমান বুদ্ধমূর্তি দেখে এ জগতে আমিই প্রথম বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ করছি।” এরূপ চিন্তা করে প্রসন্ন মনে পুনঃ বুদ্ধগুণ স্মরণ করতে লাগলেন। তখন রাজা তথায় সপ্তরত্নে সমলস্কৃত বিচিত্রময় মহামণ্ডপ প্রস্তুত করিয়ে তথায় ঐ বুদ্ধমূর্তি স্থাপন করলেন। তখন কোশলরাজ সে বুদ্ধমূর্তিকে অতি সাদরে ও শ্রদ্ধায় পূজা সকার করে জেতবন মহাবিহারে বুদ্ধের নিকট গিয়ে সানন্দে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় বললেন–
১৩০-১৩১। ভন্তে, আপনার অনুজ্ঞামতে আমি আপনার প্রতিমূর্তি নির্মাণ করেছি। এখন মূর্তিটি জীবন্ত অবস্থার ন্যায় দিব্য আভায় বিরোচিত হচ্ছে। এখন আমার বিশেষ অনুরোধ, আগামী কল্য আপনি আমার রাজাঙ্গনে গিয়ে সে প্রতিমূর্তিটি দেখুন। আগামীকল্য আমার বাড়ীতে আপনার আগমন একান্তই ইচ্ছা করছি। রাজার এরূপ প্রার্থনা শুনে শাস্তা মৌনভাবেই তাঁর প্রার্থনায় সম্মতি জ্ঞাপন করলেন। রাজা, “ভগবান নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন” জেনে তাঁকে বন্দনান্তর চলে গেলেন। পরদিবস শাস্তা সশ্রাবক পরিবৃত হয়ে নিজের প্রতিকৃতি দর্শনার্থ রাজাঙ্গনে রমনীয় মহামণ্ডপে উপস্থিত হলেন। তখন এ চন্দনসার নির্মিত মনোহর ও প্রভাস্বর বুদ্ধমূর্তি জীবন্ত অবস্থার ন্যায় সম্যক সম্বুদ্ধকে দর্শনমাত্র সম্মান প্রদর্শনার্থ সগৌরবে আসন হতে উঠে সম্মুখে অগ্রসর হতে লাগলেন। তখন ভগবান বুদ্ধ সুরক্তিম। মেঘবর্ণ প্রভাস্বর চীবর হতে ঐরাবত হস্তীর শুণ্ডের ন্যায় সুশোভনীর বিদ্যুত্সহরীর ন্যায় দক্ষিণ হস্ত বের করে নিবারণ করলেন। আর অগ্রসর না হওয়ার জন্য নিন্মোক্ত গাথাযোগে। বললেন–
১৩২। বন্ধো, তুমি স্থিত হও। চিরকালই আমি তোমার নিকট অধিষ্ঠিত থাকব। পঞ্চ সহস্ৰ বত্সর আমার শাসন জগতে বিদ্যমান থাকবে। তুমি সর্বদা বীরের ন্যায় আমার শাসনে চিরস্থির হয়ে থাক।” শাস্তা এরূপ বলে বুদ্ধমূর্তির নিকট নিজের শাসনের ভার অর্পণ মানসে নিরোক্ত গাথাটি বললেন–
১৩৩। সর্বলোকের হিতার্থ অদ্যই আমার শাসনের ভার তোমার উপর ন্যস্ত করা গেল। সুতরাং তুমিই আমার শাসনে স্থিত থাক।” তখন তথায় সমাগত মহাজনমণ্ডলী বুদ্ধমূর্তির এরূপ আশ্চর্য জনক ব্যাপার দেখে প্রত্যেকের বিপুল আনন্দে লোম হর্ষণ হল। তাই সবাই আনন্দ চিত্তে চাদর রুমাল উর্ধ্বে উৎক্ষেপণ পূর্বক প্রীতি জ্ঞাপন মানসে নিন্মোক্ত গাথাটি ভাষণ করলেন–
১৩৪। “অচেতন বুদ্ধমূর্তি শ্রেষ্ঠ বুদ্ধের প্রতি সচেতনের ন্যায় গৌরব করলেন। সুশান্বেষিগণ নিশ্চয়ই এরূপ গৌরব করবেন।” তখন পসেনদি কোশলরাজ মহাজনগণ দ্বারা পরিবৃত হয়ে তথায় সুপ্রজ্ঞাপ্ত শ্রেষ্ঠাসনে সশ্রাবক সম্যক সম্বুদ্ধকে বসায়ে। উস্কৃষ্ট পিণ্ডপাত ও নানাবিধ খাদ্য ভোজ্যে পরিবেশন করে পরিতৃপ্ত করলেন। ভোজনকৃত্য সমাপনের পর সপরিষদ রাজা বুদ্ধকে বন্দনান্তর একান্তে উপবেশন করে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয়ে বুদ্ধমূর্তি নির্মাণের ফল জিজ্ঞাসা করলেন–
১৩৫-১৩৬। ভন্তে, যে ব্যক্তি আপনার মূর্তি তৈরী করে বা করায়, সে অনাগতে কিরূপ ফল প্রাপ্ত হয়? এবং পরলোকে তাদের গতি কিরূপ হয় তা আমি শোতে একান্ত ইচ্ছুক। অনুকম্পা করে তা আমাকে বলুন।” রাজার এরূপ বিনম্র অনুরোধ শুনে শাস্তা বুদ্ধমূর্তি প্রতিষ্ঠা করার ফল সম্বন্ধে আরো নিন্মোক্ত ছয়টি গাথায় বর্ণনা করলেন–
১৩৭-১৪২। মহারাজ, যে ব্যক্তি হস্তী দন্তময়, রত্নময়, লৌহময়, শিলাময়, মৃত্তিকাময়, পুষ্পময়, সুবর্ণময় বা ফলকাদি দ্বারা ক্ষুদ্র হোক বা বড় হোক যথেচ্ছানুযায়ী আমার মূর্তি পূজার জন্য তৈরী এবং প্রতিষ্ঠা করে, তারা অনাগতে বুদ্ধত্ব, পচ্চেক বুদ্ধত্ব বা শ্রাবকত্ব শ্রেষ্ঠ জ্ঞান লাভ করবে। তারা সর্বদা দেবমনুষ্যলোকে সংসরণ করবার কালে দীর্ঘায়ু, বর্ণশালী, নিরোগী, ভোগসম্পত্তিশালী ও সুখী হয়। তারা জগতে উৎপন্ন হলে সর্বদা কুশল সম্পদে সমৃদ্ধ পুণ্যবান, সবারই প্রিয়, মনোজ্ঞ ও সূর্যের ন্যায় তেজশালী হয়। মহারাজ তারা জগতে উৎপন্ন হলে, নক্ষত্র মধ্যে চন্দ্রের ন্যায় শোভামান হয় এবং জ্ঞাতী মধ্যে অতিশয় বিরোচিত হয়।” ভগবান বুদ্ধ এরূপে কোশল রাজাকে বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ করে প্রতিষ্ঠা করার ফল সম্বন্ধে প্রকাশ করলেন–। তারপর বুদ্ধমূর্তি প্রতিষ্ঠাকারী দুঃখজনক স্থানে অনুৎপন্নভাবে প্রকাশচ্ছলে পুনঃ নিন্মোক্ত সপ্তদশটি গাথা ভাষণ করলেন–
১৪৩-১৬০। “হে নরাধিপ, যারা শ্রদ্ধাচিত্তে আমার প্রতিমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে তাদের সর্বেচ্ছা পরিপূর্ণ হয়। তারা কখনো সঞ্জীবাদি নিরয়ে ও মাক শীতল লোকান্তরিক নিরয়ে পতিত হয়না। মহারাজ তারা কখনো অতি হীন ও ক্ষুদ্রকুলে এবং দুঃখময় প্রেতলোকে উৎপন্ন হয়না। আমার মূর্তিদানকারী সদ্ধর্ম-হিতৈষিগণ কোনও কালে তির্যগ জাতিতে উৎপন্ন হয়না। কখনো অধোশিরে উদ্ধপাদে দুঃখভোগকারী অসুর লোকে উৎপন্ন হয়না এবং অসংজ্ঞ ব্রহ্মলোকে অরূপ ব্রহ্মলোকে প্রত্যন্ত প্রদেশে ও অতিদুঃখময় স্থানে উৎপন্ন হয়না। তারা মনুষ্যত্ব প্রাপ্ত হলে, কখনো অন্ধ-বধির হয়না। যারা আমার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করবে অনাগতে তারা কখনো কুষ্ঠগণ্ডাদি রোগ ভোগ করেনা। কোনও মন্ত্রের দ্বারা, ভয়ের দ্বারা যে কোন উপদ্রব বিশেষের দ্বারা এবং শক্রর হিংসার দ্বারা মৃত্যুমুখে পতিত হবেনা। আমার প্রতিমূর্তি প্রতিষ্ঠাকারীরা ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ কুল ব্যতীত কখনো অন্য কোন চণ্ডাল কুলাদি হীনকুলে উৎপন্ন হয় না। তারা সর্বদা মাতৃগর্ভে সুখে বাস করে, সুখে ভূমিষ্ঠ হয় এবং সর্বদা সুখেই। বাস করে। তারা যে মহাকুলে উৎপন্ন হয় সে কুল সর্বদা বর্ধনশীল ও ধনবান হয়। তারা সর্বদা রূপলাবন্যে ভরপুর, দর্শনীয়, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পরিপূর্ণ জনগণের প্রিয়, ভোগৈশ্বর্যশালী ও যশস্বী হয়। সর্বদা তারা কর্ণসুখকর শ্রোত বা মধুর প্রিয়ভাষী ও সুদক্ষ পণ্ডিত এবং ক্ষেত্র বস্তু ভিঠা, দাস-দাসী, ভোগবান, ধনধান্য ও যশঃকীর্তিতে সমৃদ্ধ হয়। তারা দেব বা মনুষ্যলোকে উৎপন্ন হলে সর্বদা সবারই মনোজ্ঞ, প্রশংসনীয়, জনগণের গৌরবনীয় ও সবারই শ্রেষ্ঠ হয়। মহারাজ তারা সর্বদা জ্ঞাতিগণের মধ্যে উত্তম ও পূজনীয় হয়। হে নরাধিপ আমার মূর্তি-দানকারীরা সবসময় সর্বস্থানে পূজিত হয়। নরদেবের মধ্যে উত্তম ও প্রতিষ্ঠাবান হয়। এরূপে ভগবান বুদ্ধ কোশল । রাজাকে সুখ সম্পত্তির বিষয় প্রকাশ করে, এখন দেবলোকে লভিতব্য সুখ সম্পত্তি প্রকাশ মানসে নিন্মোক্ত দশটি গাথা ভাষণ করলেন–
১৬১-১৭৫। “মহারাজ, আমার মূর্তি প্রতিষ্ঠার পূণ্য প্রভাবে মনুষ্যলোকে শ্রেষ্ঠ সুখ পরিভোগ করনান্তর ত্রিবিধ সুচরিত ধর্মপূর্ণ করে যথায়ুষ্কালে মৃত্যুর পর নানা দেবলোকে উৎপন্ন হয়। তারা মনুষ্যলোক ত্যাগ করে দেবলোক প্রাপ্ত হয়ে নানা রত্নে বিচিত্রিত সুবর্ণ বিমানে শ্রেষ্ঠ দেবকন্যার সাথে রমিত হয়। তারা সর্বদা দিব্য সুখে সংস্থিত থেকে সর্ববিধ দিব্য বাদ্যে প্রমোদিত হয়ে শ্রেষ্ঠ সুখ সম্পত্তিতে নিমগ্ন থাকে এবং স্বর্গে যাহা পরমসুখ, তা অনুক্ষণ ভোগ করে। রাজন, তাদের দেহশোভা অত্যন্ত রুচিকর, পরম অলঙ্কারে অলঙ্কৃত পঞ্চকাম গুনে সন্তৰ্পিত এবং শরীর লাবণ্য-বিলাসে অতি শোভনীয় হয়। রাজন, তারা শ্রেষ্ঠ বিমান নিবাসী ও শ্রেষ্ঠ আসনে সমাসীন হয়। তারা সর্বদা দেবগণ দ্বারা পরিবৃত হয়ে নন্দন বনে রমিত হয়। মদীয় প্রতিমূর্তি দানকারীরা দেবলোকে চর্তুদিকে দেবগণ দ্বারা পরিবৃত হয়ে সর্বদা সর্বাবিধ দিব্য তুর্য ধ্বনিতে নন্দিত হয়। সর্বদা দিব্য নৃত্য-গীত-বাদ্যে দীর্ঘকাল ধরে প্রমোদিত হয়। যখন তারা তাদের বিমানে দিব্য শয্যায় শয়ন করে, তখন দেবগণ দিব্য বাদ্য-নৃত্য-গানে তাদেরকে রমিত করে। রাজন, মদীয় মূর্তি প্রতিষ্ঠাকারীরা শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মলোকে উৎপন্ন হয়ে প্রীতি ভক্ষণকারী হয় এবং ব্রহ্মদের সাথে সানন্দে ক্রীড়ায় রত থাকে। তারা ব্ৰহ্মলোকে অমৃত সুখ ভোগের মাধ্যমে পরিপূর্ণ ব্রহ্মায়ু লাভ করার পর সেখান হতে চ্যুত হয়ে এ বিশাল মনুষ্যলোকে উৎপন্ন হয়। তারা দেবমনুষ্যলোকে সংসরণ কালে সর্বদা সবারই উত্তম হয়। পরবর্তীভবে তারা বুদ্ধত্ব, পচ্চেক বুদ্ধত্ব বা শ্রাবকত্ব প্রার্থনা করলে, তা পূর্ণ হয়। তারা বুদ্ধত্ব, পচ্চেক বুদ্ধত্ব বা শ্রাবকত্ব প্রাপ্ত হয়ে জগতে যথায়ুষ্কাল স্থিত থেকে নির্বাণ প্রাপ্ত হয়।” ভগবান বুদ্ধ কোশল রাজাকে দেবলোকে লভিতব্য সুখ সম্পত্তি প্রকাশ করে পুনঃ রাজাকে সম্বোধন করে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয়ে বললেন–
১৭৬-১৭৭। “মহারাজ, শ্রদ্ধাচিত্তে বুদ্ধমূর্তির ভগ্ন অঙ্গুলির সংযোজন বিধায় সর্বদা আমার এ বিপাক লাভ হয়েছে। বুদ্ধমূর্তি প্রতিষ্ঠার দ্বারা মহারাজ, আমি ব্যতীত অন্য কেহ তার ফল বর্ণনা করতে সক্ষম হবেনা। ভগবান বুদ্ধ এরূপে রাজাকে বুদ্ধমূর্তি প্রতিষ্ঠা করণের মহাফলভাব বর্ণনা করে এখন নানাবিধ পুণ্য ফল দেশনাচ্ছলে নিন্মোক্ত চতুর্দশটি গাথা ভাষণ করলেন–
১৭৮-১৯১। মহারাজ, স্বীয় সুখকামী যে ব্যক্তিগণ বুদ্ধমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে তারা সর্বদা দেবমনুষ্য ও ব্রহ্মলোকে উৎপন্ন হয় এবং যারা বুদ্ধমূর্তি প্রতিষ্ঠার পুণ্য অনুমোদন করে তারাও সর্বদা সুখলাভ করে। বুদ্ধমূর্তি পূজার জন্য যে ব্যক্তি ধন দান করে, সে সর্বদা ধনবান হয়। তদ্ধেতু স্বীয় সুখ ইচ্ছাকারী পণ্ডিত ব্যক্তি আমার দ্বারা বর্ণিত মদীয় মূর্তি প্রতিষ্ঠা কর। মূর্তি প্রতিষ্ঠাকারী সর্বদা সুখী, মহাপ্রজ্ঞাবান, রূপবান, মহাধনী ও মহাযশঃস্বী হয়। তারা সর্বদা দাস দাসী সম্পন্ন ভোগ সম্পদশালী, মহাজ্ঞাতী সম্পন্ন, প্রজ্ঞাসম্পন্ন ও দীর্ঘায়ু হয়। তারা সমস্ত শত্রু ও ভয়াতীত হয় এবং সর্বদা পূজিত হয়। ইহা বুদ্ধমূর্তি দানেরই ফল। আমার প্রতিকৃতি প্রতিষ্ঠাকারীগণ হীনকুলে উৎপন্ন হয় না, তারা সর্বদা উচ্চকুলে উৎপন্ন হয়। জন্মে জন্মে তারা সুগন্ধ জনপ্রিয় ও সুরূপ হয়। মধুরভাষী, পণ্ডিত ও প্রতিভাবান হয়। এসব বুদ্ধমূর্তি দানেরই ফল। তদ্ধেতু পণ্ডিত জনগণ স্বীয় সুখ। কামনা করে আমার প্রতিমূর্তি সাদরে তৈরী করে বা করায়। মহারাজ মৎ কর্তৃক বুদ্ধমূর্তি দানের মহাপুণ্য ফল বর্ণিত হল।”
পসেনদি কোশল রাজা ভগবানের মুখে এ ধর্মদেশনা শুনে অতিশয় উদার প্রীতি ও সৌমণস্য চিত্তে ভগবানের নিকট নিন্মোক্ত চারটি প্রার্থনা গাথা ভাষণ করলেন–
১৯১-১৯৫। ভন্তে, আমা দ্বারা চন্দনাসারে নির্মিত এ বুদ্ধমূর্তি প্রতিষ্ঠার পুণ্য ফলে ভবিষ্যতে জন্মে জন্মে যেন জাতিস্মর জ্ঞান লাভ করি। অনাগতে ভব সংসরণের সময় যেন সর্বদা নিজকে পাপ হতে রক্ষা করে বিশুদ্ধি ও সুখী হই এবং আমি যেন বুদ্ধ হতে পারি, আমার পিতা মাতা প্রভৃতি জনগণ সর্বদা নিরোগ, নির্ভয় ও সুখী হউক।” পসেনদি মহারাজ এরূপে প্রার্থনা স্থাপন করে অত্যন্ত শ্রদ্ধা প্রবণতা চিত্তে পুনঃ নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
১৯৬। “ভন্তে, আমার সপরিষদ রাজা, সপরিবার দেবসংঘ সবাই শ্রদ্ধাসংযুক্ত হয়ে আপনার শাসন জগতে রক্ষা করুন।” শাস্তা কোশল রাজের কথা শুনে বুঝলেন “তাঁর চিত্তে অতি উদার প্রীতি সৌমণস্য চিত্ত প্রবর্তিত হয়েছে।” তা আরো বৰ্দ্ধিত হবার জন্য নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় বললেন–
১৯৭-১৯৮। “মহারাজ, আপনি শ্রদ্ধাসহকারে চন্দনসার দ্বারা আমার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। এহেতু জগতে অনাগতে আপনি জাতিস্মর জ্ঞান লাভী অনুত্তর বুদ্ধত্ব লাভ করবেন। আপনার এ পুণ্য কর্মে আপনার ও মহাজনগণের তথা জগতের সর্বসত্ব সর্বদা যেন সুখী হোক এবং দেবগণ সর্বদা তাদেরকে রক্ষা করুন।” ভগবান এরূপে গাথাদ্বয় দ্বারা পসেনদি কোশল রাজার সহিত আলাপ সমাপ্ত করে বললেন–“এ চন্দনসার দ্বারা নির্মিত আমার মূর্তি আপনার দ্বারা কৃত হওয়ায় অনাগতকালে সারা জগতের শ্রীবৃদ্ধির জন্য কার্যকরী হবে। মহারাজ, এ বুদ্ধমূর্তি এ মহামণ্ডপে আপনার দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভবিষ্যতে ইহা আপনার অতিশয় উদার বিপুল সুখ বিপাক দায়ক হবে। এ বলে জাতক উপসংহার করে নিন্মোক্ত ছয়টি গাথা ভাষণ করলেন–
১৯৯-২০৪। “তখনকারের বট্টলি রাজার মাতা এখন মহামায়া দেবী। তখনকারের পিতা বর্তমান শুদ্ধোদন মহারাজ। তখন তাঁর অগ্রমহিষী ছিল বর্তমানের যশোধরা। তাঁর যে দূত ছিল, এখন সে আনন্দ। তখন দেবলোকের ঈশ্বর দেবরাজ ইন্দ্র এখন দিব্য চক্ষুলাভী প্রসিদ্ধ অনুরুদ্ধ। সমস্ত যোদ্ধাগণ এখন আমার শ্রাবক। তখনকারের জম্বুদ্বীপের সমস্ত রাজগণ এখন আমার পরিষদ মণ্ডলী। রাজাদের মধ্যে মহাতেজবান “বট্টঙ্গুলি” নামক রাজা এখন আমি লোকনাথ তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ। হে মহারাজ আপনি সর্বদা মদীয় শ্রেষ্ঠ শাসনে অতি গৌরব চিত্তে এ জাতক ধারণ করুন।
(বট্টঙ্গুলি রাজ জাতক সমাপ্ত।)
Leave a Reply