২৯. ব্রহ্ম ঘোষ রাজ জাতক
“ভদন্ত ভগবান, দেশনা করুন”, ইহা ভগবান জেতবনে বাস করবার কালে তাঁর বাক্যলহরী সম্পর্কে বলা হয়েছিল।
এক দিবস ভিক্ষুসংঘ ধর্ম সভায় উপবেশন করে এরূপ আলোচনা করতে লাগলেন–“অহো বন্ধুগণ, আমাদের শাস্তার বাক্যলহরী জগতে দেব-মনুষ্যদের প্রতিশরণ হয়েছে। তাই তার নাম প্রকট হয়েছে ‘লোকনাথ তথাগত। তখন বুদ্ধ গন্ধকুটি হতে ধর্মসভায় ভিক্ষুগণের আলোচনা দিব্য কর্ণে শুনে তখনই গন্ধকুটি হতে ধর্মসভায় এসে শ্রেষ্ঠ বুদ্ধাসনে উপবেশন করলেন এবং ভিক্ষুগণকে আহ্বান করে বললেন–“তোমরা। এখানে কি বিষয়ের আলোচনা নিয়ে বসে আছ?” তখন ভিক্ষুগণ তাদের আলোচ্যমান বিষয় যথাযথভাবে বুদ্ধের নিকট ব্যক্ত করলেন। তখন বুদ্ধ বললেন–‘শুধু এখনই তথাগত লোকনাথ এ জগতে দেব-মনুষ্যদের প্রতিশরণ হয়ে তথাগত লোকনাথ বলে যে প্রকট হয়েছে, তা নয়; পূর্বেও আমি শ্ৰমণদের চর্তুপ্রত্যয় ও মহাজনসংঘকে নানা বস্তু দায়ক বশে সবারই প্রতিশরণ ছিলাম। এ বলে বুদ্ধ নীরবতা অবলম্বন করলেন। তখন উপস্থিত ভিক্ষুসংঘ দ্বারা প্রার্থীত হয়ে। পূর্বকালের সে অতীত কাহিনী বলতে আরম্ভ করলেন–
অতীতে “কুসুম্ভ পুর” নামক এক নগর ছিল। সে নগর অতি নিরাপদ সম্পন্ন ও সুভিক্ষ ছিল। তথায় বহুবিধ পুষ্করিণী ও সরোবর ছিল। বহুবিধ অলঙ্কারে অলঙ্কৃত হস্তী, অশ্ব, রথ সমাকীর্ণ এবং বহুবিধ রতনে ভরপূর ছিল। সে নগরে বোধিসত্ত্ব ‘ব্ৰহ্মঘঘাষ’ নামক রাজা শম-দম গুণ সম্পন্ন হয়ে ধর্মতঃ রাজত্ব করতেন। তাঁর অগ্রমহিষীর নাম ছিল ‘নন্দা দেবী’। সে সময়ে পদুমুত্তর নামক সম্যক সম্বুদ্ধ জগতে উৎপন্ন হয়েছিলেন। এক সময়ে পদুমুত্তর বুদ্ধ কুসুম্ভপুর নগরে বাস করতেছিলেন। তখন ব্ৰহ্মঘোষ রাজা ষোল বৎসর ধরে একাক্রমে পদুমুত্তর বুদ্ধ প্রমুখ পঞ্চ সহস্র ভিক্ষুসংঘকে চারি প্রত্যয় দ্বারা সেবা করেছিলেন। সে রাজা স্বীয় রাজ্যবাসী মহাজনসংঘকে দান, প্রিয় বাক্য, সমদর্শী ভাব ও সুবিচার, চতুর্বিধ উপকারী বিষয় দ্বারা পালন করতেন। তখন সে রাজ্যবাসী সবাই নিরোগী, সুখী ও বহু ধনধান্যে সমৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছিল। এক দিবস ব্রহ্মঘোষ রাজা বুদ্ধের নিকট উপস্থিত হয়ে সর্বদা ধর্ম দেশনা করবার জন্য ও তাঁকে বন্দনা করবার সুযোগ দেওয়ার জন্য নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
১। “ভন্তে ভগবান, আমার ও মদীয় যোদ্ধা প্রমুখ জনগণের হিত সুখের জন্য নিরন্তর সদ্ধর্ম দেশনা করুন।” তখন সে ভগবান তথায় উপবিষ্ট ব্রহ্মঘোষ রাজ প্রমুখ মহাজনসংঘের নিকট চারি আর্য সত্য প্রকাশ মানসে নিতাক্ত গাথাদ্বয় ভাষণ করলেন–
২-৩। “দুঃখ সত্য, সমুদয় সত্য, নিরোধ সত্য ও মার্গ সত্য; এ চারি সত্য সর্বদা আমা দ্বারা কথিত। ত্রৈভূমিক দুঃখ সত্য, তৃষ্ণা সমুদয় সত্য, নির্বান নিরোধ সত্য এবং আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গই মার্গ সত্য।
পদুমুত্তর বুদ্ধের এ সত্য দেশনার পর অশীতি কোটি সহস্র দেব-মানবের ধর্মজ্ঞান লাভ হয়েছিল। তখন ব্রহ্মঘোষ রাজা প্রমুখ যোদ্ধা বৃন্দ ও মহাজনসংঘ বুদ্ধের ধর্ম দেশনা শুনে চিত্তে পরম প্রীতি উৎপাদন করে বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষু সংঘের সেবা করতেছিলেন। তক্ষণে দেবরাজ ইন্দ্রের বাস ভবন উত্তপ্ত হল।। দেবরাজ ইহা অনুভব করে তার কারণ চিন্তা করার পর নিন্মোক্ত গাথাটি ভাষণ করলেন–
৪। “কোন দেব মনুষ্য দান ব্রহ্মচর্যাদি পুণ্য কর্ম সম্যকরূপে পূর্ণ করছেন। সে পুণ্যকর্মকারীই বোধ হয় আমার এ আসন হতে চ্যুত করবেন।”
তৎপর দেবরাজ ইন্দ্র পুনঃ চিন্তা করে ইহার কারণ সম্যকভাবে জ্ঞাত হয়ে তুষ্ট চিত্তে চিন্তা করলেন–“সে ব্রহ্মঘোষ রাজা শম-দমে ধর্মতঃ রাজত্ব করছেন। এখন আমি তাকে পরীক্ষা করবার জন্য কুসুম্ভ পুর নগরে যাবো।” দেবরাজ এরূপ চিন্তা করে মাতলী দেব পুত্রকে আহ্বান করে বলেন–ভবৎ মাতলী, তুমি নিজের প্রকাণ্ড কুকুর বেশ ধারণ করে কুসুম্ভপুর নগরে যাও। আমিও কুকুর পালক বেশ ধারণ করে তোমার পশ্চাদগামী হব।” এবলে মাতলীকে কুসুম্ভপুরে পাঠিয়ে পরে নিজেও কুকুর পালক বেশ ধারণ পূর্বক কুকুর বেশ ধারী মাতলীর পশ্চাদামী হলেন। মাতলী কুসুম্ভপুরের মধ্যভাগে এসে ভৈরভ শব্দে বারত্ৰয় কুকুর শব্দ করলেন। সে মহাশব্দ সারা কুসুম্ভপুর বিস্তৃত হয়ে কম্পিত হল। তখন সে নগরবাসী সবাই ভীত সন্ত্রাসিত হয়ে চারিদিকে পর্বতে গুল্ম-ঝােপে ও বৃক্ষমূলাদিতে দৌড়ে গিয়ে পলায়ন করলেন। সে রাজাও ঐ ভৈরভ মহাশব্দ শুনে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে প্রাসাদের সপ্তমতলে আরোহণ করে লোকের নিকট জিজ্ঞাসভ করলেন–‘ভবৎগণ, ইহা কিসের শব্দ?’ লোকেরা বললেন–“মহারাজ এ শব্দটি কুকুরেরই শব্দ। ইহা শুনে রাজা বললেন–“ভবৎগণ, সে কুকুরের কোন পালক তথায় আছে কি?” লোকেরা বললেন–“মহারাজ, সে কুকুরের পেছনে একটি লোক দেখছি দাঁড়িয়ে আছে।” রাজা বললেন–“সে পুরুষই ঐ কুকুরের পালক হবে।। তোমরা তার নিকট গিয়ে সে কুকুরের শব্দ করার কারণটা কি তা জানিয়ে আস। তখন তারা তথাস্তু বলে ঐ কুকুর পালকের নিকট গিয়ে বলল–হে কুকুর পালক, আপনার কুকুর কি কারণে অশ্রুতপূর্ব এত বড় ভৈরভ শব্দ করল? কুকুর পালক বললেন–‘আমার কুকুরটি এখন বড়ই ক্ষুধার্ত। তাই এরূপ মহাশব্দ করছে।” তখন লোকেরা রাজার নিকট গিয়ে একথা ব্যক্ত করল। রাজা তখন লোকদিগকে আদেশ দিলেন। “প্রত্যহ ঐ কুকুরকে এক আড়ি চাউলের অন্ন খেতে দাও। তখনই রাজার নির্দেশ মত অন্ন তৈরী করে দেওয়া হল। কুকুর তা এক কবলেই নিঃশেষ করে পুনঃ পূর্বের মত ক্ষুধার্তভাব ব্যঞ্জক তিনবার ভৈরভ শব্দ করে দাঁড়িয়ে রইল। তখন কুকুর পালক রাজাকে বললেন–“মহারাজ, আমার কুকুর অত্যন্ত ক্ষুধার্ত বিধায় পুনঃ এরূপ শব্দ করছে।” রাজা ইহা শুনে অমাত্যকে বললেন–“এ নগরের লোকের জন্য যাই খাদ্য ভোজ্য তৈরী হয়েছে, সবগুলি সংগ্রহ করে এ কুকুরকে এনে দাও।” রাজপুরুষগণ তা ত্বরিত গতিতে রাজাদেশ পালন করলেন। তখনও সে কুকুর বিরাট রাশিকৃত খাদ্য ভোজ্য পলকের মধ্যেই গলাধঃকরণ করে, ভোজনে অতৃপ্তাবস্থাব্যঞ্জক পুনঃ তিনবার বিরাট শব্দ করে দাঁড়িয়ে রইল। ইহা শুনে রাজা সে কুকুর পালককে বললেন–“হে কুকুর পালক, তোমার কুকুর পুনঃ কেন এত বড় শব্দ করল?” কুকুর পালক বললেন–“মহারাজ আমার কুকুর অতিশয় ক্ষুধার্ত। তাই এত আহার খেয়েও তৃপ্ত হতে না পেরে, এবারও বিরাট শব্দে সে ক্ষুধার খবর জ্ঞাপন করছে।” ইহা শুনে ব্রহ্মঘোষ রাজা নীরব হলেন। তখন কুকুর। পালক রাজাকে সম্বোধন করে নিন্মোক্ত সাতটি গাথা বললেন–
৫-১১। “মহারাজ, যে ব্যক্তি অশ্রদ্ধ, অধার্মিক, লোভী ও প্রাণী হত্যাকারী সে ব্যক্তিই জগতে মহা যশস্বী হয়। যে ব্যক্তি বুদ্ধের বাসস্থান এবং বিহার ভগ্ন করে ও ভগ্ন করায়, সে সর্বদা সুখী হয়। যে ব্যক্তি চৈত্য, বোধিবৃক্ষ ও দেব বৃক্ষাদি ধ্বংস করে, সর্ব সুখ প্রাপ্ত হয়। যে ব্যক্তি পঞ্চবিধ বৈরকর্ম করে ও করায় সে দীর্ঘায়ু হয়। যারা শ্ৰমণ ব্রাহ্মণকে নিন্দা, আক্রোশ ও ভৎসনা করে, তারা জগতে সুখ প্রাপ্ত হয়। যারা শ্ৰমণ, ব্রাহ্মণ, শীলবান ও বহুশ্রুতকে রক্ষা করেনা, তারা সুখ প্রাপ্ত হয়। যারা নিজের স্ত্রী, পুত্র, জ্ঞাতি, বন্ধু, মিত্র অমাত্য ও মহাজনগণে রক্ষা না করে, তারা সর্বদা সম্পত্তি ও শ্রেষ্ঠ সুখ লাভ করে।” এরূপে উক্ত সপ্ত গাথা দ্বারা রাজার চিত্ত পরীক্ষা করে দেবরাজ পুনঃ নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
১২। “রাজ, আমি যা বললাম তা একান্তই সত্য। অশ্রদ্ধ হয়ে এবম্বিধ সুখ লাভ করুন। বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ ক্ষেত্রে এবং মহাজনগণকে দান দাও, কিন্তু তাতে সুখ সম্পত্তি প্রাপ্ত হবেন না। ঐ সুখের কারণ হল অসদ্ধর্ম।” ইহা শুনে মহাসত্ত্ব নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
১৩। “হে, আমার বাক্য শ্রবণ কর। মিথ্যা বাক্য নিষ্ফল; তা আমার অমনোজ্ঞ। এসব বাক্য বল না। এখন তোমার নিকট যা শোনলাম, তা পূর্বে কখনো শুনিনি।” এ বলে মহাসত্ত্ব নিজের স্বভাব দেশনা করে নিন্মোক্ত তিনটি গাথা বললেন–
১৪-১৬। আমি সর্বদাই শ্রদ্ধাহীন হব না। বুদ্ধ ধর্ম ও ভিক্ষুসংঘকে সর্বদা শ্রদ্ধার সহিত দান করব, বোধিলাভের জন্য। তুমি ত্রিরত্বের প্রতি একাই অশ্রদ্ধ। আমি অনাগতে বোধি লাভের জন্য সর্বদাই পুণ্যকর্ম করব। আমি পুণ্যকর্ম। করে দেবলোকে যাব। কিন্তু তুমি সর্বদা পাপ কর্ম করে চতুর্বিধ অপায়ে উৎপন্ন হবে। তখন কুকুর বেশধারী মাতলী দেবপুত্র এদিক ওদিক সগর্জনে লাফালাফি করে যেন সে নগরের সকল মানুষকে ভক্ষণ করবে, সেরূপ ভাব দেখাতে লাগলেন। তখন। দেব রাজ সবারই মঙ্গলকামী ভাব ধারণ করে দুঃখীতের ন্যায় তথায় দাঁড়িয়ে রইলেন। তখন মহাসত্ব তথায় একত্রিত মহাজনগণ ও দেবরাজকে ধর্মদেশনাচ্ছলে নিন্মোক্ত একাদশটি গাথা ভাষণ করলেন–
১৭-২৭। হে মহাজনগণ, যারা অশ্রদ্ধ, অধার্মিক, লুব্ধ, ও প্রাণীহত্যাকারী, তারা জগতে মহা দুঃখ প্রাপ্ত হয়। যারা ভগবানের গন্ধকুটি ও বিহার নষ্ট করে বা করায়, তারা সর্বদা বহু জন্মে দুঃখীই হয়। যারা পাপচিত্তে চৈত্য, বোধিবৃক্ষ ও দেবস্থান নষ্ট করে, তারা নিরয়ে উৎপন্ন হয়। যে ব্যক্তিগণ পঞ্চবিধ বৈরী কর্ম করে বা করায়, তারা চতুর্বিধ অপায়েই উৎপন্ন হয়। জগতে যারা শ্রমণ, ব্রাহ্মণগণকে নিন্দা, আক্রোশ ও ভৎসনা করে তারা জন্মজন্মান্তরে সর্বদা দুঃখ ভোগ করে। যারা শ্ৰমণ, ব্রাহ্মণ, শীলবান ও বহুশ্রুতকে রক্ষা করে না, ও দান দেয়না, নিজের পুত্র, দার, জ্ঞাতি, বন্ধু, মিত্র ও দাসদাসীকে যথাযোগ্যভাবে রক্ষা করে না তারা বিনাশ, অযশঃ ও ভয় প্রাপ্ত হয় এবং চারদিকে তাদের শত্রু উৎপন্ন হয়। সৰ্ব্বদা অতি কাঙ্গাল ও দরিদ্র হয়। তাদের নিকট সৰ্ব্বদা লোভ, দ্বেষ ও মোহ উৎপন্ন হয়ে তাদের শ্রেষ্ঠ সুখ হনন করে চতুর্বিধ অপায়ে উৎপন্ন হয়। ভবৎগণ, এবাক্যগুলি একান্তই সত্য। তোমরা সবাই ত্রিরত্নকে যথাশক্তি দান দেবে। তোমরা সবাই শ্রদ্ধা সহকারে বুদ্ধ, ধর্ম এবং ভিক্ষুসংঘকে নিশ্চয়ই দান দেবে এবং মহাজনগণকে অন্নপানীয় দ্বারা সর্বদা পরিতৃপ্ত করে দান দিয়ে স্বর্গে গমন করবে।”
এরূপে মহাসত্ত্ব একাদশ গাথাযোগে সমবেত জনমণ্ডলীকে ধর্ম দেশনা করলেন। তিনি সম্যক শ্রদ্ধাসম্পদে প্রতিষ্ঠিত হয়ে প্রত্যহ পদুমুত্তর বুদ্ধের শাসনে নানাবিধ শ্রেষ্ঠ খাদ্য ভোজ্যাদি দ্বারা পদুমুত্তর বুদ্ধ প্রমুখ পাঁচ হাজার ভিক্ষু সংঘকে পরিচর্যা করতেন এবং চতুর্বিধ উপকারী বস্তু দ্বারা নগরবাসীকে পালন করতেন। তখন দেবরাজ ইন্দ্র কুকুর পালক বেশ ত্যাগ করে দিব্য সর্বালংকারে সজ্জিত হলেন এবং সহস্র দেবগণ দ্বারা পরিবৃত হয়ে সূর্যের ন্যায় আকাশে স্থিত হলেন। তখন দেবগণের দিব্য প্রভায় সমগ্র কুসুম্ভ নগরে অব্ভাসিত হল। সে আকাশে সহস্র দিব্য বিমানের প্রাদুর্ভাব হল। প্রত্যেক বিমানে সহস্র সহস্র অরা দিব্য পঞ্চাঙ্গিক তুর্য ধ্বনি সহকারে চিত্ত বিনোদনকর নাচগানে রতা। নানাবিধ দিব্য সম্পদে বিমানগুলি পরিপূর্ণ। নানা দিব্য সম্পদে সমৃদ্ধ এ বিমানগুলি মানব দৃষ্টি গোচরে রেখে দেবরাজ সমবেত জনমণ্ডলীকে সম্বোধন করে বললেন–ভবৎগণ, এখানে সমবেত আপনারা দৃষ্ট এ দিব্য সম্পত্তি প্রার্থনা করে যথাশক্তি দানাদি পুণ্য ক্রিয়া সম্পাদন করুন। এ বলে মহাজনগণকে আরও উপদেশ প্রদান মানসে নিন্মোক্ত পঞ্চদশটি গাথা ভাষণ করলেন–
২৮-৪২। ভবৎগণ, যে সব শ্রদ্ধাবান ব্যক্তি বুদ্ধ শাসনে। ব্ৰজিত হয়ে শীলে প্রতিষ্ঠিত থাকেন, জগতে তাঁরাই শ্রেষ্ঠ ও অগ্র। যারা বোধিবৃক্ষ রোপন করেন বা করান ও বুদ্ধ প্রতিমুর্তি স্থাপন করেন, তারা নানাবিধ সুখ ভোগ করেন। যে গৃহীগণ সর্বদা পঞ্চশীল রক্ষা করেন ও একান্ত মনে পুণ্য কর্ম সম্পাদন। করেন, তাঁরা যশঃ কীর্তি লাভ করেন। যারা ধর্মতঃ পুত্র-দ্বারদাস-দাসী, ও কর্মচারীকে পোষণ করেন, তাঁরা সর্বদা স্বর্গে উৎপন্ন হন। যে নরগণ শ্রদ্ধাচিত্তে ভিক্ষু শ্রমণকে চারি প্রত্যয় দ্বারা সর্বদা সেবা পূজা করেন, তাঁরা স্বর্গেই উৎপন্ন হন। যারা ভিক্ষু শ্রামণের বাসোপযোগী কুঠির, বিহার, চৈত্য, সংঘারাম ও আবাস তৈরী করেন, তাঁরা স্বর্গে উৎপন্ন হন। যে ব্যক্তিগণ সগৌরবে সসম্মানে মাতা পিতাদি পোষ্যগণকে পোষণ করেন, তারা ইহ-পরকালে সর্বদাই সুখী হন। যে সব সৎপুরুষ কৃতজ্ঞ অর্থাৎ উপকারীর উপকার স্বীকারকারী ইত্যাদি গুণে প্রতিমণ্ডিত দানে রত ও পুণ্যানুমোদনকারী, তাঁরাই স্বর্গ পরায়ণ ব্যক্তি। যারা শীলবান ভিক্ষু শ্রামণকে অন্ন পানীয় দ্বারা সর্বদা পরিতৃপ্ত করেন, তাঁরা সর্বদা স্বর্গে উৎপন্ন হন। যে ব্যক্তি পুণ্য চিত্তে চৈত্য, বোধিবৃক্ষ ও দেবস্থান রক্ষা করেন, সে সর্বদা স্বর্গে উৎপন্ন হন। যে নারিগণ অসঙ্কোচ চিত্তে স্বীয় স্বামী ও শ্বশুরশাশুড়ীকে সেবা করে, তাঁরাও সর্বদা স্বর্গ পরায়ণ। যে নারী শীলবতী, শীলবান ভিক্ষু শ্রামণ ও স্বীয় স্বামীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনকারিনী হন, সে নারী ও ত্রিদিবগামিনী হন। যে নারীগণ পুণ্যচিত্তে পঞ্চ বাণিজ্য হতে বিরত হয়ে যথাশক্তি দান দেয়, তারাও সৰ্ব্বদা স্বর্গ পরায়ণা হয়। যে নারীগণ স্বীয় স্বামীকে নিন্দা আক্রোশ ও ভৎর্সনা করেনা, সে নারীও সৰ্ব্বদা ত্রিদিবালয়ে উৎপন্ন হয়। যে স্ত্রী স্বীয় পরিবারের প্রতি ও বাহ্যিক জনগণের প্রতি ক্রোধবিহিনা, সে স্ত্রী সর্বদা যশস্বিনী ও সুখলাভিনী হয়।” এ বলে দেবরাজ নিজের ইন্দ্ৰত্বভাব প্রকাশ করার মানসে নিন্মোক্ত পাঁচটি গাথা ভাষণ করলেন–
৪৩-৪৭। আমি দেবরাজ ইন্দ্র, আপনার পুণ্যকর্ম অনুমোদন করবার জন্যই আপনার নিকট এসেছি। আপনি সৰ্ব্বদাই পুণ্যকর্ম করুন। হে জনেন্দ্র, পুণ্যই সর্ব প্রাণীদের প্রতিষ্ঠা। সুখই জগতের শ্রেষ্ঠ বস্তু। আপনি সর্বদা পুণ্যকর্ম করুন। আপনি পুণ্য ক্ষেত্রে ভোজন দান পূর্বক পুণ্য কর্ম করে অনাগতে বুদ্ধত্ব লাভের জন্য সর্বদা পারমী পূর্ণ করুন। হে রাজন, আপনি শ্রদ্ধাযুক্ত চিত্তে ত্রিরত্ন পূজা করে, যে পুণ্য সম্ভার উৎপন্ন হল, তাতে নিশ্চয়ই আপনি অনাগতে বুদ্ধ হবেন। রাজন, আপনি জগতে মহা যশস্বী নরুত্তম হয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন। এসব কৃত পুণ্য ফলে আপনি নিশ্চয়ই অনাগতে বুদ্ধ হবেন। এবলে দেবরাজ বোধিসত্ত্বকে জ্ঞাপন করে দেবলোকে চলে গেলেন। সে বিষয় প্রকাশ মানসে ভগবান বুদ্ধ নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
৪৮। “দেবরাজ, ব্রহ্মঘোষ রাজাকে ইহা বলে স্বর্গে প্রস্থান করলেন। সে হতে ব্রহ্মঘোষ রাজা স্বীয় রাজ্যে নন্দাদেবী সহ শম দম গুণে ধর্মতঃ রাজ্য শাসন কালে অমাত্যাদি মহাজনগণকে সর্বদা নিন্মোক্ত গাথায় উপদেশ দিতেন
৪৯। হে ভদ্র মণ্ডলী, আমি যেমন বর্তমান দান পারমী সম্পূরণ করেছি, আপনারাও তেমন অপ্রমত্ত হয়ে যথাশক্তি দান করুন।
তখন বোধিসত্ত্বের উপদেশ বাক্যে সুপ্রতিষ্টিত হয়ে মহা জনগণ পদুমুত্তর বুদ্ধের শাসনে দানাদি পুণ্য ক্রিয়া সম্পাদন করে মৃত্যুর পর নানা দেবলোকে উৎপন্ন হলেন। বোধিসত্ত্বও নিজের নন্দা দেবী সহ কুসুম্ভ পুর নগরে রাজ সম্পত্তি সুখ পরিভোগ করে পদুমুত্তর বুদ্ধ শাসনে দানাদি পুণ্য কর্ম সম্পাদন করার পর মৃত্যুর পর দেবলোকে উৎপন্ন হলেন। তখন জগতের সর্ব সত্ত্বের হিত সুখকারক পদুমুত্তর ভগবান সম্যক্ সম্বুদ্ধ যথায়ুষ্কাল জগতে বর্তমান থেকে আয়ু পরিশেষে স্কন্ধ ভেদ অনুপাদিশেষ নির্বাণ ধাতুতে পরিনির্বাপিত হলেন। ভগবান এ। ধর্মদেশনা আহরণ করে, জাতক সমাপন কল্পে নিন্মোক্ত পাঁচটি সমাপ্তি গাথা ভাষণ করলেন–
৫০-৫৪। তখনকার দেবরাজ ইন্দ্র বর্তমান সময়ের দিব্যচক্ষু লাভী অনুরুদ্ধ। সারথী মাতলী দেবপুত্র জিন সেবক। আনন্দ। তখনকারের পিতা মাতা এখন আমারই পিতা মাতা। আনন্দ দেবী নদী মহাকন্যা বর্তমান কালের উৎপল বর্ণা। অবশিষ্ট কুসুম্ভ পুরবাসিগণ সবাই এখন আমার শাসন পূর্ণকারী শ্রাবক সংঘ। দানে রত পুণ্যকামী ব্ৰহ্মঘোষ মহারাজ এখন আমি লোকনাথ তথাগত সম্বুদ্ধ। তোমরা সবাই সগৌরবে এ জাতক ধারণ কর।
(ব্রহ্মঘোষ রাজ জাতক সমাপ্ত।)
Leave a Reply