২৮. মহা সুরসেন রাজ জাতক
“যে ধীরগণ দান দেন” ভগবান এ দেশনা জেতবনে বাস করবার সময় পূর্বকালে নিজের মস্তক দান সম্পর্কে বলেছিলেন। তখন এক কুলপুত্র অতিশয় শ্রদ্ধাবান ও প্রজ্ঞাবান ছিলেন। তিনি অতীতে ‘কোনাগমন’ ভগবান শাসনে প্রব্রজিত ছিলেন। এখনো। তিনি আমাদের বুদ্ধের শাসনে প্রব্রজিত হয়ে মহালাভী, যশস্বী। ও বহু শিষ্য-প্রশিষ্য নিয়ে মহা পরিবারশালী হলেন। এক সময় তিনি চিন্তা করলেন–‘এখন আমি বুদ্ধ রত্ন ও ধর্ম রত্ন পূজা করে, পুনঃ সংঘ রত্ন পূজা করব। এ মনে করে তার মনোভাব স্বীয় শিষ্য প্রশিষ্যগণকে জ্ঞাপন করে বললেন–“বন্ধুগণ, এখন। আমি এক সহস্র ভিক্ষু ও এক সহস্র শ্রামণ প্রত্যেককে ‘অষ্ট পরিখার’ ও বহুবিধ পরিভোগ্য বস্তু দান দেব।” এ বলে শিষ্য প্রশিষ্যকে আদেশ করলেন–“তোমরা মহা মণ্ডপ ও দানশালা তৈরী কর এবং আমার দায়কগণ হতে উক্ত দানীয় বস্তু সংগ্রহ করে ভাণ্ডার ঘরে রাশিকৃত করে রাখ।” শিষ্যগণ তা সানন্দে সম্পন্ন করলেন। তখন তিনি সঙ্কল্পিত সমস্ত ভিক্ষু ও শ্রামণগণ নিমন্ত্রণ করে এনে এই সুসজ্জিত মণ্ডপে বসালেন এবং তথায়। সপ্ত দিন ব্যাপী আগতাগত ভিক্ষু শ্রমণেরকে অষ্ট পরিখার দান দিলেন। উদ্বৃত্ত অষ্ট পরিক্খার আরো অন্যান্য ভিক্ষু। শ্রামণেরকে দান দিয়ে পরে দীন-কাংগালগণকে নানাবিধ বস্তু দান করলেন। ইহার পর তিনি ত্রয়োদশ ধুতাঙ্গ শীল গ্রহণ করে অরণ্যবাসী ধুতাঙ্গধারীদের সাথে অরণ্যে গিয়ে বাস করতে লাগলেন। তথায় তিনি বিদর্শন কর্মস্থান ভাবনা করে পঞ্চ অভিজ্ঞা ও অষ্ট সমাপত্তি উৎপাদন করলেন। তথায় নিরন্তর ধ্যানাবস্থায় জীবন যাপন করে পরমায়ুর অবসানে মৃত্যুর পর ব্রহ্মলোক পরায়ণ হলেন। একদা ভিক্ষু সংঘ ধর্মসভায় উপবেশন করে এরূপ কথার উত্থাপন করলেন–“অহো বন্ধুগণ, দান ইহালোকে এবং পরলোকে মহা ফল দায়কই হয়।” তখন ভগবান বুদ্ধ গন্ধকুটি হতে দিব্য কর্ণে ধর্ম সভায় ঐ ভিক্ষুগণের আলোচ্য বিষয় শোনলেন। তখন তিনি গন্ধকুটি হতে ধর্মসভায় এসে প্রজ্ঞাপ্ত শ্ৰেষ্ঠ বুদ্ধাসনে উপবেশন করে বললেন–“হে ভিক্ষুগণ, এখন তোমরা কি বিষয়ের আলোচনা নিয়ে এখানে উপবিষ্ট আছ?” তখন ভিক্ষুগণও বিনীতভাবে তাদের আলোচ্যমান বিষয় বস্তু তথায় ব্যক্ত করলেন। বুদ্ধ বললেন–“হে ভিক্ষুগণ, শুধু এখন যে নানাবিধ বস্তু আগত যাচকগণকে দান দেওয়া হয়েছে তা নয় পূর্বেও পুরাতন পণ্ডিতগণ নিজের মস্তক পর্যন্ত দান দিয়েছেন। এ বলে শাস্তা মৌণভাব অবলম্বন করলেন। তখন ধর্ম সভায় উপস্থিত ভিক্ষুগণ দ্বারা প্রার্থীত হয়ে বুদ্ধ সে অতীত বিষয় প্রকাশ করতে লাগলেন
অতীতে বারাণসী নগরে মহা সুরসেন নামক এক রাজা রাজত্ব করতেন। সে রাজার অগ্র মহিষীর নাম ছিল ‘বিদ্যুতা দেবী। তাঁর মহামাত্যের নাম ছিল সুচী সেন। তখন মহা সুরসেন রাজা প্রত্যহ পূর্বাহ্নে ও অপরাহ্নে অমাত্যাদি মহাজনগণকে উপদেশ দিতেন যে–“ভদ্রগণ আপনারা সবাই অপ্রমত্তভাবে যথাসাধ্য পূণ্যকর্ম করুন, দান দিন ও শীল রক্ষা করুন; ইত্যাদি বলে নিন্মোক্ত গাথাটি বলতেন—
১। “যে বীরগণ ধন অন্বেষণকারী যাচকদিগকে দান দেন, তাঁরা সর্বদা জগতে শ্রেষ্ঠ সুখ লাভ করেন।”
তিনি স্বীয় নগরের চার দ্বারে চারখানা, নগরের মধ্যভাগে একখানা এবং স্বীয় বাসগৃহের দ্বারে একখানা, এ ছয়খানা দানশালা তৈরী করে প্রত্যহ এক এক দানশালায় এক সহস্র ছয় শত টাকার নানাবিধ দান সামগ্রী সজ্জিত করে আগত যাচকগণকে প্রত্যহ মহাদান করতেন। অমাবস্যা পূর্ণিমার উপোসথ দিবসে প্রাতোনাদি কার্য সমাপন করে সর্বালংকারে বিভূষিত হয়ে মহা পুণ্ডরিক’ নামক মঙ্গল হস্তীতে আরোহণ পূর্বক অমাত্যগণসহ প্রত্যেক দানশালায় উপস্থিত হতেন। তথায় যাচকগণকে স্বহস্তে কিছুক্ষণ দান করতেন। তারপর ঠিক সেরূপ ভাবে দান দেওয়ার জন্য একজন অমাত্যকে নিযুক্ত করে অন্য দানশালায় উপস্থিত হতেন। এরূপে ক্রমান্বয়ে পর পর পাঁচটি দান শালায়ও গিয়ে স্বহস্তে কিছু কিছু দান দিয়ে, সর্বদা সেভাবে দান দেওয়ার জন্য অমাত্য নিযুক্ত করে নিন্মোক্ত গাথাটি বলতেন
২। ভদ্রগণ, এ দানশালায় রাশিকৃত ধন-ধান্য ও পরিভোগ্য বস্ত্রাদির মধ্যে যে যাহা যাঞ্চা করবে তাকে তা দেবেন।
অতঃপর মহা সুরসেন রাজা অমাত্যাদি মহাজন সংঘকে যথাযোগ্য উপহারাদি প্রদান করে মহাপুণ্ডরিক নামক হস্তীতে আরোহণ পূর্বক স্বীয় প্রাসাদে গমন করতেন। একদা প্রত্যুষকালে তিনি শয্যায় পদ্মাসনে বসে প্রত্যহ নিজের প্রদত্ত দান সম্বন্ধে চিন্তা করে চিত্তে প্রীতি উৎপাদন করলেন। আরো চিন্তা করলেন–“আমি বাহ্যিক বস্তুই দান দিচ্ছি। তাতে আমার মন তৃপ্ত হচ্ছে না। এখন আমি আধ্যাত্মিক বস্তুই দান দিতে ইচ্ছা করি। অদ্য প্রাতেঃ যাচকগণ বাহ্যিক বস্তু যাঞ্চা না করে, আমার চক্ষু, মস্তক, হৃদয়, মাংস, রক্ত, অর্ধ দেহ বা সম্পূর্ণ দেহের মধ্যে যে যা ইচ্ছা করে, তাকে তা দান করব–সর্বজ্ঞতা জ্ঞানের হেতু উৎপাদনার্থ।” রাজা এরূপ একাগ্র মনে আধ্যাত্মিক বস্তু দান দেওয়ার চিন্তাভাব-তেজে মহা পৃথিবী কম্পনাদি বিস্ময়কর ভাবের সৃষ্টি হয়েছিল। সে বিষয় প্রকাশ কল্পে শাস্তা নিটোক্ত ছয়টি গাথা ভাষণ করলেন–
৩-৮। তারপর মহান ব্যক্তি রাজা সুরসেন স্বীয় প্রাসাদে উপবেশন করে দান দেওয়ার জন্য এরূপ চিন্তা করলেন। যাচক আমার নিকট এসে চক্ষু, হৃদয়, মাংস এবং আমার শরীরাদির মধ্যে যে কোন একটা আধ্যাক দান যাঞ্চা করে, আর যদি কোন যাচক আমার দেহ যাঞ্চা করে, তাহলে তাকে আশ্বস্ত করে তার দাস রূপে আমার এ দেহ তাকে দান করব। একগ্র। চিত্তে এরূপ চিন্তা করায় মহাপৃথিবী কম্পিত হল, সুমেরু পর্বতরাজের অলংকৃত মস্তক অবনমিত হল। এরূপ স্বভাব চিন্তন প্রভাবে তখন বারাণসী নগরে ভীষণ লোমহর্ষণকর অবস্থা ঘটেছিল। তখন মহাসত্তার নিকট বিপুল ভাবে জন সমাগম হয়েছিল। তৎকলে দেবরাজ ইন্দ্রের বাস ভবন উত্তপ্ত হল। দেবরাজ এ উষ্ণভাব অনুভব করে তক্তারণ চিন্তা করতঃ নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
৯। “আমার আসন হতে আমাকে চ্যুত করবার জন্য কোন দেবতা বা মনুষ্য দান ও ব্রহ্মচর্য পালনাদি পুণ্যকর্ম পরিপূর্ণ করছেন কি?” তখন দেবরাজ চিন্তা করে দিব্য জ্ঞানে মহা সুরসেন রাজার একাগ্র মনে সঙ্কল্পিত বিষয় জ্ঞাত হয়ে অত্যন্ত সন্তুষ্ট চিত্তে চিন্তা করলেন–“মহা সুরসেন রাজা বুদ্ধাঙ্কুর মহাপুরুষ। তিনি প্রত্যহ মহাজনগণকে নানাবিধ বাহ্যিক বস্তু দান দিয়ে সন্তুষ্ট হতে না পেরে, এখন অনাগতে বুদ্ধ হবার মানসে আধ্যাক বস্তুই দান করতে ইচ্ছুক হয়েছেন। এখন আমি সে মহা সুরসেন রাজার মনোবাসনা পূর্ণ করব।” এ চিন্তা করে দেবলোক হতে এসে মস্তক বিহীন দণ্ডধারী মানববেশে রাজাঙ্গনে উপস্থিত হলেন। তখন রাজাঙ্গনে সমবেত জনগণ এ মস্তক বিহীন দণ্ডপরায়ণ পুরুষকে দেখে অতিশয় সংক্ষুব্ধ চিত্তে। পরস্পর বললেন–‘অহো ভবৎগণ একান্তই অভূতপূর্ব এ শিরহীন মানব এখানে এসেছে। তখন মহা সুরসেন মহাসত্ত্ব প্রাতেই আসন ত্যাগ করে প্রাসাদ হতে নিতে অবতরণ পূর্বক মঙ্গল হস্তীতে আরোহণ করে মহা জনগণ সহ স্বীয় দানশালায় যাওয়ার জন্য প্রাঙ্গণে উপস্থিত হলেন। তখন ঐ শিরহীন মানব একটু উচ্চ স্থানে দাঁড়িয়ে রাজার দিকে হস্ত প্রসারণ পূর্বক বললেন–“ভবৎ মহারাজের জয় হোক জয় হে, জয় হোক।” রাজা ইতঃস্তত অবলোকন করে দেখলেন, তথায় শিরবিহীন দণ্ডধারী এক পুরুষ। তিনি এ আশ্চর্য মানব দেখে অশ্রু সংবরণ করতে পারলেন না। তাই সাশ্রু নয়নে চিন্তা করলেন–“এখন আমি গৌণ না করে সকরুণ হৃদয়ে তার আগমন কারণ জিজ্ঞাসা করব। মহাসত্ত্ব এরূপ চিন্তা করে সকরুণ হৃদয়ে তার আগমন কারণ নিন্মোক্ত গাথা যোগে জিজ্ঞেস করলেন–
১০। “বল, তুমি কি কারণে এখানে এসেছ? তখন ঐ মানব বেদনাতুর ও কম্পমান দেহে হস্ত উৎক্ষিপ্ত করে বললেন–“মহারাজ আমি জন্মগত মস্তক বিহীন তরুণ। তাই আমি মস্তক সম্পন্ন হবার জন্য আপনার মস্তকটি যাঞ্চা করবার জন্য এখানে এসেছি! এখন আমি আপনারই শরণ নিচ্ছি। আমাকে মস্তকটি দান করুন। এবলে নিন্মোক্ত গাথাটি ভাষণ করলেন–
১১। “পরিপূর্ণ নদীর জল যেমন কোন সময়েই জলশূন্য হয় না, আপনিও সে রূপ। তাই আপনার নিকট মস্তক যাঞ্চা করতে এসেছি। তা আমাকে দান করুন।”
বোধিসত্ত্ব ইহা শুনে বললেন–“হে মানব, মস্তক বিহীন মনুষ্য (দেবতা বিশেষ) এখানে এসেছ নয় কি? ইহা শুনে শিরহীন মানব বললেন–“মহারাজ, আমি এই রূপেই জন্মগ্রহণ করে অনাথ হয়েছি। অদ্য আমার মস্তক লাভ করে মনোরথ পূর্ণ করবার আশায় আপনার নিকট এসেছি। আপনি মস্তক দান জনিত পুণ্যে দীর্ঘায়ু লাভ করবেন।” ইহা শুনে বোধিসত্ত্ব প্রীতিফুল্ল মনে ‘আগামী কল্যই বুদ্ধত্ব লাভ করবার ন্যায় প্রীতিফুল্ল হৃদয়ে ও প্রসারিত হস্তে সহস্র টাকার থলি পতিত হওয়ার ন্যায় হয়ে বললেন–“হে শিরবিহীন মানব, তুমি যে আমার নিকট শির প্রার্থনা করছ, তা অতীব সাধু। তা পূর্ণ করব। এ বলে আনন্দিত মনে মহা পৃথিবী গর্জনের ন্যায় নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় ভাষণ করলেন–
১২-১৩। “হে মানব, তুমি যা প্রার্থনা করছ, আমি তোমার সে মনোরথ পূর্ণ করব। পূর্বে আমি দানের দ্বারা সমৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছি। এখন এ দানের দ্বারা অনাগতে নিশ্চয়ই বুদ্ধ হব। “হে মানব তা তোমাকে অকম্পিতভাবে শ্রদ্ধার সহিত দেব। দানই। আমার মন রমিত হয়। বোধি লাভের জন্য তা তোমাকে দেব। এখানে নিশ্চয় আমি বুদ্ধ হব।
এ বলে মহাসত্ত্ব পুনঃ বললেন–“হে মানব, এখানে দাঁড়াও। আমি তোমাকে আহ্বান করছি।” এ বলে বিচারালয়ের আসনে বসে অমাত্যাদি মহাজনগণকে সমবেত করিয়ে সূচী সেন অমাত্যকে আদেশ দিলেন যে “বাবা সূচীসেন, তুমি এখান হতে গিয়ে আমার রাজাঙ্গনে স্থিত শিরবিহীন মানবটিকে এখানে নিয়ে আস। অমাত্য “তথাস্তু দেব” এবলে রাজাঙ্গন হতে ঐ শিরবিহীন পুরুষটিকে বিচারালয়ে নিয়ে আসলেন। তখন রাজা সে শিরহীন পুরুষকে মহা পালংকে বসালেন। তখন স্বীয় পুত্র “বরজ কুমারের” হস্তে সুবৰ্ণ গাড় দ্বারা জল সিঞ্চন করে রাজত্ব প্রদান করলেন। তারপর স্বীয় অগ্র মহিষী বিদ্যোৎ লতা দেবীকে সম্বোধন করে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় বললেন–
১৪-১৫। “ভদ্রে, আমার বাক্য শ্রবণ কর। তোমাকে সুভাষিত বাক্য বলছি। অনাগতে বোধিলাভের জন্য অদ্য শির দান পারমী পূর্ণ করব। সর্বজ্ঞ বুদ্ধের পরিচিত আমার সেই পুণ্য কর্ম অনুমোদন কর।”
এবলে মহাসত্ত্ব পুনঃ দেবীকে বললেন–দেবী এখন আমি মদীয় মস্তক শিরবিহীন মানবকে দান করব। তা তুমিও অনুমোদন কর।” ইহা শুনে দেবী প্রমুখ যোদ্ধাগণ এবং সুচীসেন অমাত্য প্রমুখ মহাজনগণ মহা কোলাহল শব্দ করে মহাসড়ের পাদমূলে পড়ে সরোদনে বললেন–“মহারাজ, আপনি কেন এরূপ অযুক্তিকর কর্ম করবেন? আপনি বিনা। আমরা সবাই অনাথ হব।” ইত্যাদি বলে সবাই রোদন করতে লাগলেন। তাদের এ রোদন–শব্দ শুনে মহাসত্ত্ব চিন্তা করলেন“আমি এখানে দান পরমার্থ পারমী পূর্ণ করতে সক্ষম হবনা। অদ্যই আমি এনগরের বহির্ভাগে গিয়েই দান পারমী পূর্ণ করব।” এ চিন্তা করে নিজের দেবী, যোদ্ধাগণ ও অমাত্যগণকে উপদেশ দিয়ে সুচীসেন অমাত্য, সুবর্ণ সূত্র রতন খড়গ ও শিরবিহীন মানবকে সাথে করে নিজের উদ্যানের দিকে যাত্রা করলেন। তখন সমস্ত যোদ্ধা, অমাত্য ও নগরবাসিগণ পৃষ্ঠ দেশে কেশ ছেড়ে দিয়ে আলুতালু বেশে উভয় হস্তে বক্ষ প্রহার পূর্বক বোধিসত্ত্বের পশ্চাদ্ধাবন করলেন। তখন মহাসত্ব এ মহাজনস্রোতকে প্রত্যাবর্তন করাতে না পেরে স্বীয় অমাত্যকে বললেন–তাত অমাত্য, তুমি এ খড়গ দ্বারা আমার শিরচ্ছেদ করে তা এ অশির মানবকে দান কর।” ইহা শুনে অমাত্য অনিচ্ছা প্রকাশ করে কৃতাঞ্জলি করপূটে রাজাকে নিবারণ করলেন। তখন মহাসত্ন নিজেই খড়গ হস্তে নিয়ে স্বীয় মস্তক ছেদন ইচ্ছায় আকাশ দিকে অবলোকন করে বললেন–ভবৎগণ আপনারা সবাই আমার দানোত্তম শির দান দর্শন করুন। আমার শির পরিত্যাগ দ্বারা জগতে চক্রবর্তী রাজ সম্পত্তি, ছয় কামাবচর সম্পত্তি ও ব্রহ্মলোক সম্পত্তি প্রার্থনা করছি না। অপিচ আমি অনাগতে সম্যক সম্বোধিই প্রার্থনা করছি। এ আমার মস্তক দান অনাগতে সমস্ত জগতের হিতসুখ প্রদায়ক সর্বজ্ঞ জ্ঞানের হেতু হোক।” এবলে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় বললেন–
১৬-১৭। “হে দেবগণ, আপনারা সবাই আমার কথা শ্রবণ করুন। আমি বোধিলাভের কারণে মস্তক দান দিচ্ছি। আমার এ মস্তকে দান দ্বারা জনতাকে আমি জ্ঞান দান করব। অনাগতে আমি সংসার হতে উত্তীর্ণ হয়ে পরে জনতাকে উত্তীর্ণ করব।” এ বলে মহাসত্ত্ব নির্ভয়েই “আগামী কল্য যেন বুদ্ধত্ব প্রাপ্ত হবেন,” এ মনে করে প্রীতিফুল্ল চিত্তে মস্তক দানের ইচ্ছায় নিজেই গ্রীবাদেশ ছেদন করতে আরম্ভ করলেন–। তৎক্ষণেই মহাসড়ের মস্তক দান তেজে সসাগরা মহাপৃথিবী কম্পিত হল। আকাশ হতে দেবগণও সাধুবাদ প্রদান করে তথায় পুষ্পবৃষ্টি বর্ষণ করলেন। এবিষয় প্রকাশ প্রসঙ্গে শাস্তা নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় ভাষণ করলেন–
১৮-১৯। দিব্য মান্দার পুষ্প, পদুম পুষ্প ও পারিজাত পুষ্পদি আকাশ হতে দেবগণ নরলোকে দিবিদিকে বিকীর্ণ করতে লাগলেন। চম্পক, বেল, সলল, নাগেশ্বর, পুন্নাগ ও কেতকী পুষ্পদি ভূমিবাসী দেবগণ চারিদিকে বিকীর্ণ করতে লাগলেন।” বোধিসত্ত্ব নিজেই নিজের দক্ষিণ হস্তে গৃহীত খড়গ দ্বারা স্বীয় শির ছেদন পূর্বক সে সরক্ত মস্তক বাম হস্তে গ্রহণ করে অশির মানবকে দান করলেন। তখন অশির মানব তা লাভ করে অতি সুখী ও আনন্দিত মনে তথায় উপবেশন। করলেন। তৎকালে অনেক প্রকার পৃথিবী কম্পনাদি নানা প্রকার আশ্চর্য ব্যাপার সংঘটিত হয়েছিল। সে বিষয় প্রকাশ মানসে শাস্তা নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় ভাষণ করলেন–
২০-২১। “মস্তক দান করা হলে তখনই ভীষণ লোমহর্ষণকর ভাবে মহাপৃথিবী প্রকম্পিত হয়েছিল। এবং সারা নগর ভীষণ ও রোমাঞ্চকরভাবে সংক্ষুব্ধ হয়েছিল।”
তখন সূচীসেন অমাত্য মহাসত্ত্বের পাদে নিপতিত হয়ে বহু রোদন-বিলাপ করে রাজার গ্রীবাদেশ হতে গলিত রক্ত নিজের মস্তকে মেখে নিয়ে রাজ অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন। তথায় বিদ্যোৎলতা দেবী ও অন্যান্য জনগণকে রাজার মস্তক দান। বিষয় প্রকাশ করলেন–। ইহা শুনে দেবী প্রমুখ যোদ্ধাগণ, অমাত্যবৃন্দ ও নগরবাসিগণ সহ্য করতে না পেরে মহাশব্দে রোদন পরায়ণ হয়ে নগর হতে উদ্যানাভিমুখে ধাবিত হলেন। তাঁরা যথাকালে উদ্যানে পৌছে মহাসত্ত্বের পাদমূলে পতিত হয়ে বক্ষে করাঘাত করতঃ রোদন-বিলাপ করতে লাগলেন। বিদ্যোক্সতা দেবী ও বরজ কুমার এ উভয় ক্ষত্রিয় মহাসত্ত্বকে আলিঙ্গন করে স্বীয় বেণী সূক্ষ বস্ত্রের দ্বারা রক্ত মুছতে মুছতে তথায়ই উন্মাদিনীর ন্যায় এদিক ওদিক গড়াতে লাগলেন। তৎক্ষণে রাজান্তঃপুরবাসিনী নারীগণ শীতল জল নিয়ে ঐ ক্ষত্রিয়দ্বয়ের দেহে সিঞ্চন করলেন। তারা এ শীতল জলে আর্জিত হয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস লাভ করলেন। তৎপর দেবী উভয় হস্তে স্বীয় বক্ষ প্রহার করতঃ বললেন– “হায় হায় স্বামি, এখন। আমি দীন হীন হলাম। অদ্য হতে আমার বৈধব্য দুঃখ ভোগ করতে হবে।” এরূপে নানা পর্যায়ে বিলাপ-লোদনাদি করে অনুতপ্ত হৃদয়ে তথায় স্থিত হলেন। সেখানে দেবরাজ ইন্দ্র স্বীয় দিব্যরূপ ধারণ করতঃ রাজ প্রদত্ত সেই মস্তকটি লুকায়ে সর্বালংকারে প্রতিমণ্ডিত তরুণ সূর্যের ন্যায় আকাশে বিরোচিত হয়ে সে বিলাপ ক্রন্দনময় বিরাট জনতা মধ্যে ক্রন্দন পরায়ণা দেবীকে সম্বোধন করে বললেন–“হে দেবী, তুমি রোদন ও বিলাপ করোনা। আমি এখন তোমার স্বামী রাজার জীবন দান করব।” এবলে তৎক্ষণে স্বীয় ইন্দ্ৰত্ব প্রভাবে সে রাজ প্রদত্ত মস্তকটি রাজার গ্রীবাদেশে বন্ধন করে অমৃতোদক সিঞ্চন পূর্বক রাজার স্বস্তিভাব আনয়ন করলেন। তখন জনগণ বোধিসত্ত্বকে তথায় নিরাময় সুস্থ দেখে আশ্চর্যান্বিত হয়ে সাধুবাদ শব্দে সর্বদিক মুখরিত করে বস্ত্র উৎক্ষেপে আনন্দ জ্ঞাপন করলেন। তৎপর দেবরাজ বোধিসত্ত্বের স্তুতি নতি করলেন। সে বিষয় প্রকাশ কল্পে শাস্তা নিন্মোক্ত সাতটি গাথা ভাষণ করলেন–
২২-২৮। “তার সংকল্প জ্ঞাত হয়ে দেবাজ তাঁকে এরূপ বললেন–“দেব-মানবের মধ্যে শুধু আপনারই জয়। আপনার একাজে মহা পৃথিবী পর্যন্ত ভৈরব শব্দে নিনাদিত হয়েছে। সে শব্দ দেবলোকে গিয়েছে। গিরি গহ্বরাদি সহ সমস্ত পৃথিবীতে বিদ্যুত্রহরীর চমক্কার ক্রীড়া হয়েছিল। নারদ পর্বতবাসী ও দেবলোকবাসী সবাই আপনার দান অনুমোদন করেছিল। তখন তারা স্বীয় স্বীয় বিমান দ্বারে আনন্দিত চিত্তে স্থিত ছিলেন। ইন্দ্র, ব্রহ্মা, প্রজাপতি, সোম, যাম ও বৈশ্রবনাদি সমস্ত দেবগণ আপনার এ দুষ্কর কার্য অনুমোদন করেছিলেন। অদেয় বস্তু দানকারীরাই দুষ্কর কর্ম সম্পাদন করতে পারেন। সে সৎলোকদের দুষ্কর কর্ম অশান্ত ব্যক্তিরা সম্পাদন করতে পারে না। তদ্ধেতু সৎ এবং অসতের গতি নানা প্রকার হয়। অসতেরা নিয়ে যায় এবং সতেরা স্বর্গ পরায়ণ হয়। মহারাজ, আপনি যে দানোত্তম মস্তক দান দিয়েছেন, তা অতি শ্রেষ্ঠ মনোকর্ম। এতদ্বারা স্বর্গেই উৎপন্ন হবেন।” এ বলে দেবরাজ চিন্তা করলেন–“আমি এখানে আর গৌণ না করে দেবলোকেই চলে যাওয়া উচিত।” এচিন্তা করে নিজের ইন্দ্রভাব প্রকাশ প্রসঙ্গে নিতাক্ত গাথাটি বলেন–
২৯। “আমি দেবরাজ ইন্দ্র, আপনার মনোরথ পূর্ণ করবার জন্যই এখানে এসেছি। ইহা আপনার বোধিলাভের হেতু হবে।”
এরূপে দেবরাজ ইন্দ্র বোধিসত্ত্বের সাথে আলাপাদি করে প্রজ্বলিত দিব্যদেহে তরুণ সূর্যের ন্যায় আকাশে স্থিত হয়ে বললেন–“মহারাজ আপনি যাবজ্জীবন মহাজনসঙ্কে দান প্রদান ও শীল পালন করুন।” ইত্যাদি বলে উপদেশ প্রদান। পূর্বক পুনঃ বললেন–“মহারাজ, আপনার এ দান-পুণ্য-ফলে অনাগতে সম্যক সম্বুদ্ধত্ব লাভ করবেন। পূর্বে বোধিসত্ত্বগণ পঞ্চ মহাদান দিয়ে বুদ্ধত্বলাভ করেছেন।” এরূপ বলে তথা হতে অন্তহিত হয়ে দেবলোকে গমন করলেন। সে বিষয় প্রকাশ প্রসঙ্গে শাস্তা নিন্মোক্ত গাথাটি ভাষণ করলেন–
৩০। “দেবলোকের ঈশ্বর দেবরাজ ইন্দ্র রাজার স্তুতি করে স্বর্গে প্রস্থান করলেন।”
তখন মহাসুরসেন রাজার দেবরাজ ইন্দ্রের প্রভাবে নিজের জীবন লাভ করে সেখান হতে উঠে নিরাপদ স্থানে বসলেন। তৎপর বিদ্যোক্সতা দেবী নিজের স্বামীকে নিরোগ ও প্রাকৃতিকভাব দেখে চিত্তে প্রীতি সৌমনস্যভাব উৎপাদন করে বললেন–“সুখকামীরা সর্বদা দান দেওয়া উচিত। সমস্ত অমাত্য ও নগরবাসিগণ প্রীতি সৌমণস্য লাভ করে সেখানেই বোধিসত্ত্বকে অভিষেক প্রদানান্তর নগরে নিয়ে গেলেন। সে হতেও বোধিসত্ত্ব নিজের দানশালায় উপস্থিত জনগণকে মহাদান দিয়ে পরিশেষে মৃত্যুর পর তুষিত দেবলোকে উৎপন্ন হলেন। নগরবাসীরাও তার উপদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত থেকে যথায়ুষ্কালে মৃত্যুর পর কর্মানুযায়ী নানা দেবলোকে উৎপন্ন হলেন। ভগবান বুদ্ধ এ ধর্মদেশনা আহরণ করে বললেন–“এখন যে শুধু এরূপ মহাদান হয়েছে তা নয়। পূর্বেও আমা কর্তৃক এরূপ মহাদান দেওয়া হয়েছিল। ইহা বলে জাতক সমাপনার্থ নিন্মোক্ত পাঁচটি সমাপ্তি গাথা ভাষণ করলেন–
৩১-৩৫। “তখনকারের দেবরাজ ইন্দ্রই এখন দিব্যচক্ষুধারী অনুরুদ্ধ। সূচীসেন অমাত্য এখন আমার উপস্থায়ক আনন্দ। বরজ নামক রাজপুত্র এখন আমার কাজ রাহুল। বিদ্যোলতা দেবী এখন যশোধরা। সে সময়ের মাতাপিতাই এখন আমার মাতা-পিতা। অবশিষ্ট মহাজন সঙ্ বর্তমান আমার পরিষদ মণ্ডলী। পুণ্যকামী মহাসুরসেন মহারাজ এখন আমি লোকনাথ তথাগত সম্বুদ্ধ। তোমরা সবাই ত্রিবিধ সুখ প্রার্থনাকারীরা অতি গৌরব চিত্তে এ জাতক ধারণ কর।
(মহাসুরসেন রাজ জাতক সমাপ্ত।)
Leave a Reply