২৭. মহাপদুম জাতক
“মহারাজ, আপনি আমাদের পরাক্রম দেখুন।” ইহা ভগবান বুদ্ধ জেতবনে বাস করবার কালে মাতৃ পোষক জনৈক ভিক্ষুর সম্পর্কে বলেছিলেন।
তত্ত্বালে এক ভিক্ষু পিণ্ডাচরণ করে প্রত্যহ নিজের মাতাকে ভোজন করাতেন। তিনি নিজের মাতার সেবার্থ স্বীয় লব্ধ পালার পিণ্ডপাত বর্ষাবাসিক বস্ত্র ও অন্যান্য দানীয় বস্তু যা লাভ করতেন, সবই স্বীয় মাতাকে প্রদান করতেন। এরূপে মাতাকে পোষণ করার বিশেষ উদ্যোগ-শ্রম বিধায় কিছুদিনের মধ্যে তিনি কৃশ ও পাণ্ডু বর্ণ হয়ে পড়লেন তখন তাঁর একান্ত সুপরিচিত হিতৈষী ভিক্ষুগণ তার দৈহিক এ অবস্থা দেখে তাঁকে বললেন–“বন্ধো, পূর্বে তোমার স্বাস্থ্য ও দেহবর্ণ বড়ই সুন্দর ছিল কিন্তু এখন দেখছি কৃশ ও পাণ্ডুবর্ণ হয়েছ। তোমার কোন রোগ উৎপন্ন হয়েছে কি? ইহা শুনে তিনি স্বীয় মাতৃপোষণাদি সমস্ত বিষয় তাদের খুলে বললেন–। বন্ধো, আমার কোন রোগ নেই। তবে আমার মাতার সেবাই বড়ই উপদ্রব হচ্ছে।” ইহা শুনে ভিক্ষুগণ বললেন–“বন্ধো, আমাদের শাস্তা বুদ্ধ শ্রদ্ধা প্রদত্ত। বস্তু নষ্ট করতে দেন না। এখন তুমি শ্রদ্ধা প্রদত্ত বস্তু গ্রহণ করে স্ত্রী লোককে দিয়ে অযৌক্তিক কাজ করছ।” ভিক্ষুগণের এসব কথা শুনে বিশেষ লজ্জিত হয়ে নিজের বাসস্থানে ঢুকে পড়লেন। তৎপর ঐ ভিক্ষুগণ ভগবানের নিকট গিয়ে বললেন–“ভন্তে ভগবান, অমুক ভিক্ষু শ্রদ্ধা প্রদত্ত বস্তু গ্রহণ করে স্ত্রী লোককেই। পোষণ করছে। ভগবান বুদ্ধ ইহা শুনে সে মাতৃপোষক ভিক্ষুকে ডেকে বললেন–“তুমি সত্যই কি স্ত্রীলোক পোষণ করছ?” তখন সেই ভিক্ষু তাঁর সমস্ত বিষয় ভগবানকে বললেন–“সত্যই ভন্তে, আমি স্ত্রীলোক পোষণ করছি তবে সে স্ত্রীলোক আমারই মাতা।” বুদ্ধ ইহা শুনে তাকে উৎসাহ প্রদান করবার জন্য “সাধু, সাধু, সাধু” এরূপ বারয় সাধুবাদ দিয়ে বললেন–হে ভিক্ষু, তুমি আমার পূর্ব গমন-পথের অনুবর্তী হয়েছ। নিজের মাতা-পিতাকে পোষণ করা পণ্ডিত বংশধরেরই কর্ম।” এ বলে শাস্তা সে ভিক্ষুগণকে সম্বোধন করে বললেন–“তোমরা এ ভিক্ষুর প্রতি নিন্দা, অপবাদ বাক্য প্রয়োগ করবে না। পূর্বে পুরাতন পণ্ডিতগণ নিজের মাতার জন্য স্বীয় জীবন পর্যন্ত ত্যাগ করেছিল।” এ বলে বুদ্ধ মৌন হলেন। তখন উপস্থিত ভিক্ষুগণের প্রার্থনায় অতীত বিষয় বর্ণনা করতে আরম্ভ করলেন—
অতীতে “অগ্রবতী” নামক নগরে “অনঙ্গ সেন” নামক এক রাজা রাজত্ব করতেন। তাঁর অগ্রমহিষীর নাম ছিল ‘সুমেখলা দেবী। তিনি অতিশয় শীলবতী ছিলেন। তৎকালে বোধিসত্ত্ব তুষিত ভূবন হতে চ্যুত হয়ে সেই দেবীর জঠরে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করলেন। বোধিসত্ত্বের প্রতিসন্ধি গ্রহণ কাল হতে সুমেখলা দেবী অতিশয় রূপবতী দেব অপ্সরার ন্যায় চিত্তপ্রসাদকর দর্শনীয় হয়েছিলেন। দেবীর কুক্ষিতে বাসকারী বোধিসত্নের অনুভাব তেজে নানা রাজ্য হতে জনগণ নানাবিধ বহু শত সহস্র উপহার এনে অনঙ্গ সেন রাজাকে প্রদান করতেন। তখন অন্যান্য রাজ্যবাসী কূটরাজার অমাত্য বৃন্দ ও জনগণ সুমেখলা দেবীর অতিশয় শোভনীয় রূপের কথা নিজদের প্রভূকুট রাজগণকে এরূপ বলতেন–“মহারাজ, অগ্রবতী নগরে অনঙ্গ সেন রাজার ভার্যা অগ্রমহিষী দেবী অতিশয় উত্তম রূপধারিণী দেবপ্সরার ন্যায় প্রসাদকর দর্শনীয়া।” কূটরাজা ইহা শুনে কামতৃষ্ণায় অভিভূত হয়ে চিন্তা করলেন–“কি উপায়ে এ সর্বলক্ষণ সম্পন্না স্ত্রী রত্নকে লাভ করতে পারি।” এ চিন্তা করে অমাত্যগণকে একত্রিত করে বললেন–ভদ্রগণ, এখন আমি সর্বলক্ষণ সম্পন্না এমন স্ত্রী রত্ন লাভের জন্য অগ্রবর্তী নগর গ্রহণ করব।” কূটরাজার একথা শুনে সমস্ত অমাত্য একমত হয়ে বললেন–“সাধু দেব। এবলে স্বীয় স্বীয় সৈন্য সামন্ত ও যান বাহন প্রভৃতি যুদ্ধ সামগ্রী যোগার করে একস্থানে সমবেত হলেন। তৎপর কূটরাজা চতুরঙ্গিনী সেনা সামন্ত পরিবৃত হয়ে অগ্রবতী নগরের দিকে অভিযান করলেন। অনুক্রমে অগ্রবর্তী নগরের সমীপবর্তী হয়ে এক নিরাপদ স্থানে শিবির স্থাপন করলেন। সেখান হতে কুটরাজা। অনঙ্গসেন রাজ-সমীপে এবলে একদূত প্রেরণ করলেন–“যদি অনঙ্গসেন রাজা আমার সাথে যুদ্ধ করার ইচ্ছুক হন, তা হলে। স্বীয় সৈন্য সামন্ত দ্বারা পরিবৃত হয়ে এখানে এসে আমার সাথে যুদ্ধ আরম্ভ করুন।” অনঙ্গসেন রাজা দূত-মুখে এখবর শুনে মাথা নেড়ে চিন্তা করলেন–“যুদ্ধ করলে জনগণ বিনষ্ট হবে।” এমনে করে মহাবিচারালয়ে বসে রইলেন। তখন অনঙ্গসেন রাজার অমাত্য বৃন্দ কূটরাজ প্রেরিত খবর শুনে ক্রোধভরে নানাবিধ তীক্ষ্ণ মারণ-অস্ত্র লয়ে অনঙ্গসেন রাজার নিকট এস বললেন–“মহারাজ, আপনার জন্য আমরা সবাই আগত। বিপক্ষ রাজার সাথে যুদ্ধ করে প্রাণ বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠিত হবনা।” এরূপ বলে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
১। “মহারাজ, আপনি আমাদের পরাক্রম দেখুন। আমরা আপনার জন্য শত্রু রাজার সহিত যুদ্ধ করব।” এবলে সে অমাত্য-বৃন্দের সেনাগণ বিপক্ষ রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করবার প্রার্থনা করে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
২। “যখন আপনি সর্বদাই স্বীয় রাজ্যের প্রজাবৃন্দের হিতসুখকামী, আমাদের বিদ্যমানে আপনার রাজ্য বিনষ্ট না হোক।” রাজা তাদের এসব বাক্য শুনে স্বীয় অমাত্যবৃন্দকে নিবারণ কল্পে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয়ে বললেন–
৩-৪। “ভদ্রগণ, আপনারা কূটরাজার সাথে সপ্রহারে বিবাদ করে পাপ করবেন না। আমার কারণে তাদের সাথে যুদ্ধ করবার জন্য আমি আদেশ দেবনা। এখানে আগত জনগণ পরস্পর হনিত না হোক। আমার কারণে জনগণকে হিংসা না করুক।” এবলে অনঙ্গসেন রাজা সে অমাত্যবৃন্দকে উপদেশ প্রদান কল্পে নিতাক্ত তিনটি গাথায় বললেন—
৫-৭। “ভবৎগণ, আপনারা সবাই তাদের প্রতি মৈত্রী চিত্ত ভাবনা করুন।” এখানে আগত সেনাদের সাথে আপনারা যুদ্ধ করবেন না। এখানে আগত মহাজনগণ সহ আপনারা সবাই প্রীতমনে সকলকে অন্ন-পানীয় দানে সন্তর্পিত করুন, এখন সবাই নগরে চলে যান। আমার দান, শীল ও সংযম প্রভাবে আমি সমস্ত অমিত্রতে সর্বদা পরাজয় করে বাস করব।
এরূপে রাজা স্বীয় অমাত্যবৃন্দকে বারম্বার নিবারণ করা সত্ত্বেও নিবৃত্ত করতে পারলেন না। সুতরাং অমাত্য সবাই একমত হয়ে অগ্রবর্তী নগর হতে বের হয়ে বিপক্ষীয় রাজার সাথে যুদ্ধ আরম্ভ করলেন–। তখন অনঙ্গসেনের অমাত্যগণ “স্বীয় রাজা বিহীন রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ” এবিষয় বিপক্ষ সেনাদল জ্ঞাত হয়ে তীব্র বেগে আক্রমন চালালেন। ইহাতে অনঙ্গসেনের অমাত্য প্রমুখ সেনাগণ বিভ্রান্ত হয়ে পলায়ন করলেন। রাজা অনঙ্গসেন ইহা জ্ঞাত হয়ে দুঃখী দুর্মন হয়ে একাকী সুমেখলা দেবীর বাসস্থানে গিয়ে দেবীকে আপন মনোভাব জ্ঞাপন মানসে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয়ে বললেন–
৮-৯। “এখন আমাদের সেনাগণ যুদ্ধে পরাজিত। এনগরে আর তোমার সাথে বাস করতে পারবনা। ভদ্রে তোমার গর্ভ সুষ্ঠুরূপে রক্ষা করবে। এ সন্তানটি ছেলে না মেয়ে জানিনা।” সুমেখলা দেবী রাজার একথা শুনে শোক-বিহ্বল হয়ে হৃদয়ে যেন তার চুরমার হয়ে ভেঙ্গে গেল। তখন শোকে সংবরণ করতে না পেরে রোদন-বিলাপ পরায়ণ হয়ে নিজে গাথায় বললেন–
১০। “মহারাজ আপনি একাকী চলে যাবেন, তা আমার ধর্ম বিরুদ্ধ। সর্বদাই আমি আপনার সাথে গমন করব।” ইহা শুনে রাজা বললেন–“ভদ্রে, তুমি এখন অন্তঃসত্ত্বা। এমতাবস্থায় তোমাকে সঙ্গে করে গমন করতে সক্ষম হবনা। এ গর্ভ রক্ষার নিমিত্ত এগ্রামের কোনও স্থানে বাস কর। এবলে নিন্মোক্ত গাথাত্ৰয়ে বললেন–
১১-১৩। “ভদ্রে তোমাকে বলছি–আমি অরণ্যে যেতে ইচ্ছা করি। তথায় একাকীই বাস করব। আমার জন্য অনুশোচনা করবে না। ভদ্রে, আমি প্রচণ্ড হিংস্র জন্তু সমাকুল মহাবনে গমন করব। সেখানে আমার জীবন সংশয়াপন্নও হতে পারে। গণ্ডার ব্যাঘ্রাদি প্রচণ্ড হিংস্র জন্তু সমাকুল বনে কাউকে ও বধ না করে পুণ্যই করব। তুমিও এখানে বাস করে সর্বদা পুণ্যকর্ম কর।” ইহা শুনে দেবী অত্যন্ত দুঃখী দুর্মনা হলেন। তাঁর যেন হৃদয় সপ্তদা বিভক্ত হয়ে গেল। এঅবস্থায় তিনি রাজার সঙ্গে যাওয়ার জন্য নানাভাবে কথা উত্থাপন করলেন।
সে বিষয় প্রকাশ কল্পে অমিতাভ বুদ্ধ নিন্মোক্ত ছয়টি গাথায়। বললেন–
১৪-২০। “তখন সুমেখলা দেবী” অনঙ্গসেন রাজার কথা শুনে বললেন–“আমাকে অদ্ভুত বাক্য কেন বলছেন? ইহা আপনার বড়ই অযৌক্তিক বাক্য। ইহা আমার সুখের কারণ। বিনাশেরই বাক্য। মহারাজ আপনি একাকী যাওয়াটা ন্যায় সঙ্গত নয়। আমিও সর্বদা আপনার সহিত যাব। আপনার সঙ্গে অবস্থান করে যদি আমার মৃত্যু হয় তাও শ্রেয়। আপনি বিনা আমার জীবন ধারণ বৃথা। শ্মশানে অগ্নি উৎপাদন করে তথায় আমার মৃত্যুই শ্রেয়ঃ। তথাপি আপনি বিনা আমার জীবন বৃথা। আরণ্যিক হস্তী নাগ যেমন সম-বিসম গিরিগহবরে স্বীয় হস্তিনীকে সাথে নিয়ে যায়। সেইরূপ আমিও সর্বদা আপনার পশ্চাদানুবর্তী হব। আমাকে পোষণ করতে আপনার কোন ও দুঃখ হবেনা।” ইহা শুনে রাজা প্রিয় ভার্যাকে নিবারণ মানসে নানাবিধ প্রসঙ্গের অবতারণা করলেন এবং নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় ভাষণ করলেন—
২১-২২। “ভদ্রে, তুমি এখানে চন্দন-সুষমায় চর্চিত, সারা দেহে সূক্ষ ধূলিবালি নিবারণী আবরণে আবৃতা। সর্বদা সূক্ষ বস্ত্রই ধারণ করছ। কিন্তু অরণ্যে ড়ুমুর বৃক্ষের ছাল ও কুশ নির্মিত আবরণ পরিধান করতে হবে। ভদ্রে, তোমার দ্বারা তা কি সহ্য হবে? হে সুমেখলা, তুমি বনে যেও না। বনবাস সর্বদাই ভীষণ দুঃখকর। তুমি এখানেই বাস কর।” ইহা শুনে দেবী তথাপি রাজার সাথে যাওয়ার জন্য পাঁচটি প্রার্থনা গাথা বললেন—
২৩-২৯। “মহারাজ, আপনি বনে গেলে আমি এখানে কিরূপে জীবিত থাকব? হে রথাভ, আমিও আপনার সাথে বনে যাব। অরণ্যবাসীরা যেমন একাকী বাসহেতু চিরদুঃখী, আমিও তেমন আপনি বিনা বাস করে চিরদুঃখিনীই হব। আমি সর্বদা বনে বিচরণ করবার জন্য আপনার পশ্চাদানুবর্তিনী হব। আপনি বিনা আমি রাজ্যেও সুখ ইচ্ছা করিনা। আপনি প্রচণ্ড হিংস্র জন্তু সমাকীর্ণ বনে গমন করবার সময় সর্বদা সকল স্থানে আমিও আপনার পিছনে গমন করব। আপনার সাথেই আমার মৃত্যু হবে। আপনি জীবিত থাকলে জীবিত থাকব। আপনার নিকট আমার মৃত্যু হোক্। আপনি বিনা আমার জীবন ধারণ বৃথা।” দেবীর এসব প্রার্থনা বাক্য শুনে রাজা পুনঃ দেবীকে অরণ্যে নানা দুঃখ উৎপত্তির কারণ বললেন–। সে বিষয় প্রকাশ কল্পে নিন্মোক্ত দশটি গাথা ভাষণ করলেন–
২৮-৩৭। “তখন রাজা দেবীকে এরূপ বললেন–“ভদ্রে, তুমি বনে যাওয়ার আশা ত্যাগ কর। বনে সর্বদা নানা দুঃখের উৎপত্তি হয়। বনে বহু কীট, পতঙ্গ, মশক ও মধুমক্ষিকা আছে। তারা তথায় তোমাকে হিংসা করবে। একারণেও তথায় তোমার দুঃখ বর্তমান। অপর এক ভয়ের বিষয় পার্বত্য ক্ষুদ্র নদী সেবনকারী নির্বিষ মহাবলশালী ‘অজগর’ নামে এক সর্প দেখা যায়। তারা মনুষ্য, মৃগ ও দিষ্ট যে কোন প্রাণী দর্শন মাত্র স্বীয় দেহ দ্বারা পরিবেষ্টন করে নিজের বশে নিয়ে ভক্ষণ করে। অন্য এক প্রকার কালবর্ণ ‘অচ্ছ’ নামক অতি ভয়ঙ্কর প্রচণ্ড এক মৃগ আছে। তাদের আক্রমণ হতে পুরুষেরাও বৃক্ষে আরোহণ করে অব্যাহতি লাভ করতে পারেনা। অতি দুর্দান্ত, অতি দ্রুতগামী ও প্রচণ্ড হিংস্র মহিষ পরস্পর শৃঙ্গে শৃঙ্গে ঘর্ষণ জনিত মহাশব্দে নদী আশ্রয়ে মহাবনে বিচরণ করে। সেরূপ গাভীরাও পালনায়ক বৃষভকে পুরোভাগে রেখে বিচরণ করে। ভদ্রে, এরূপ । ভয়ানক বনে কেন তুমি যাবে? সর্বদা পর্বাগ্রে দারুণ মর্কট দেখে পলায়ণ করতে জানবে না। ইহাতেও তোমার মহাভয়ের কারণ। তুমি যে বায়স-শব্দ শুনে অতি সন্ত্রস্ত হও বলে মনে হয়, তবে কি প্রকারে বনে যাবে? দিবা-মধ্যাহ্নকালে পর্বতাগ্রে ভীষণ পক্ষী সমূহ ও মহারণ্যে বন্য কুকুরাদির উৎপাত। কেন তুমি সে বনে যেতে ইচ্ছা কর? রাজার এসব বাক্য শুনে রাণী আপন উৎসাহ জ্ঞাপন মানসে রাজার সাথে আলাপ আরম্ভ করলেন–। সে বিষয় প্রকাশ মানসে ভগবান নিন্মোক্ত সপ্তদশটি গাথা ভাষণ করলেন–
৩৮-৫০। “তখন মহারাণী স্বামীর কথা শুনে হৃষ্টান্তরে এরূপ বললেন–বনে যে মহা ভয় আছে বলে আমাকে বললেন–, সে সব দুঃখ বরণ করতে সর্বদা আমি উৎসাহিতা। কাশ, কুশ রুক্ষ, তৃণ, উশির, মঞ্ছতৃণ, পব্বজ তৃণ ও উরসা তৃণ পরিধান করব। আমি আপনার বোঝা স্বরূপ হবনা। কুমারিগণ বহুব্রতাদি আচরণ করার পর পতি লাভ করে। যেমন উদর ব্রত, গো হনুব্রত। অগ্নিচর্যা, জলে নিমগ্ন হওয়াব্রত। পিতামাতা দ্বারাও নারী আপোষনীয়া। তারা স্বামীর গৃহে উচ্ছিষ্ট ভোজন করেও জীবিকা নির্বাহ করলে শ্রেয়ঃ। স্বীয় স্বামীর হস্তে ধারণ করলে, স্বামী তাকে অনিচ্ছা সত্ত্বে দুঃখে কষ্টে হলেও আকর্ষণ করে নিয়ে যায়। রথার্ষভ আপনার দুঃখ উৎপাদন করে হলেও আমি আপনার সাথে যাব। জল বিহীনা নদী নগ্না, রাজা বিহীন রাজ্য নগ্না, বহু জ্ঞাতি-মিত্র-ভাই-বন্ধু থাকা সত্ত্বেও স্বামী বিহীনা নারীকে নগ্না বলা হয়। জগতে স্বামী না থাকা বড়ই কটু ফলপ্রদ। তাই আপনার সাথেই আমি বনে যাব। রথের প্রকাশ চিহ্ন ধ্বজা, অগ্নির প্রকাশক-চিহ্ন ধুম। রাজ্যের প্রকাশক চিহ্ন রাজা এবং নারীর প্রকাশক চিহ্ন স্বামী। স্বামী ছাড়া নারীর জীবন বড়ই কষ্টদায়ক। সুতরাং আপনার সাথেই আমি যাব। দরিদ্র দরিদ্রের সাথে এবং ধনাঢ্য ধনাঢ্যের সাথে যে মিলন তা দুঃখকর হলেও কিন্তু দেবগণও তা প্রশংসা করেন। আপনি বিনা সমগ্র পৃথিবীর, বহু ধন-রত্ন এবং বহু সুখ ভোগও ইচ্ছা। করি না। আমি আপনার সাথেই যাব। আপনার মুখ দর্শন না করে আমার এখানে বাস করতে ইচ্ছা করি না। সর্বদা মহাবনেই আপনার অনুগমন করব। আপনি বিনা আমি নানা রতনে পরিপূর্ণ বহু বিত্ত সম্পন্ন সসাগরা পৃথিবীও ইচ্ছা করি না। যে নারীর স্বামী দুঃখীত, সে নারী কখনও স্বীয় সুখ ইচ্ছা করে না। স্বীয় স্বামীর প্রতি আদর সম্পন্না নারীর হৃদয় যে কিরূপ জানেন না। আপনি রাজ্য-বৃদ্ধি কারক ও সর্বদা আমার ধন প্রদায়ক। আপনি এ নগর হতে বের হলে, আমি আপনার অনুগমন করব।” মহিষীর একথা শুনে রাজা অরণ্য বাসের দুঃখ বিষয় প্রকাশের জন্য নিন্মোক্ত আটটি গাথা ভাষণ করলেন–
৫১-৫৮। “ভদ্রে, তুমি নিত্য শালী ধান্যের অন্ন সমাংস ভোজন কর। তুমি কিরূপে সর্বদা বনে বৃক্ষের ফলাদি খেয়ে জীবন যাপন করবে? তুমি সুবর্ণ থালায় শত প্রকার ফল মূলাদি ভক্ষণ করছ, অরণ্যে তুমি কি প্রকারে সর্বদা বৃক্ষ-পত্রে আরণ্যিক ফল-মূল ভক্ষণ করবে? ভদ্রে তুমি সর্বদা কোসেয়্য, ক্ষৌম ও রেশমী পশমী বস্ত্রাদি ব্যবহার কর। তুমি বনে কিরূপে কুশ-চীর ধারণ করবে? ভদ্রে, সর্বদা হস্তী, অশ্ব, স্যন্দন ও রথে আরোহণ করে গমনাগমন কর। কিন্তু অদ্য কিরূপে পদব্রজে গমন করবে? তুমি সর্বদা কূটাগারেই শয়ন কর। কিন্তু অমনুষ্য গৃহীত অরণ্যে বৃক্ষ মূলেই আমার শয়ন হবে। তুমি কিরূপে তথায় শয়ন করবে? পালঙ্কে বিচিত্র সুখ স্পর্শ গালিচায় সর্বদা তুমি শয়ন কর। বনে আমি বৃক্ষ মূলে শয়ন করবার কালে তথায় তুমি কিরূপে শয়ন করবে? ভদ্রে, তুমি সর্বদা অগুরু। চন্দনাদি সুগন্ধি দ্বারা মণ্ডিত হয়ে থাক। পথে রৌদ্র ও ধুলাবালি ধারণ করতে হবে। তুমি তা কিরূপে সহ্য করবে? চামর ময়ুর পাখার বিচিত্র ব্যজনী দ্বারা সর্বদা তুমি সুখে পালিত। ডংশক ও মশকাদি প্রাণীর সংস্পর্শে তুমি কীইবা করবে?
রাজা অনঙ্গসেন এরূপে বহু প্রকার ভয় দেখালেও রাণীকে বারণ করতে না পেরে বললেন–“ভদ্রে, তা হলে তুমি আমার সাথেই যাবে।” তখন উভয় ক্ষত্রিয় একমত হয়ে পাথেয় থৈলা গ্রহণ করতঃ অজ্ঞাত বেশে অগ্রবতী নগর হতে বের হয়ে হিমালয়ের দিকে যাত্রা করলেন। তারা কিছুদূর অগ্রসর হলে রাণীর পদতলা ছিন্ন হতে রক্ত ক্ষরিত হতে লাগল। তাঁরা এরূপে পথ অতিক্রম করে অনুক্রমে এক নদী তীরে উপস্থিত হলেন। তখন রাজা একখানা ভেলা তৈরী করে দেবীকে বললেন–“ভদ্রে, তুমি এ ভেলাতে আরোহণ কর। আমরা উভয়ে এভেলার দ্বারা এগঙ্গা নদী উত্তীর্ণ হব। এ বলে দেবীকে ভেলায় বসিয়ে নিজে তা চালিয়ে গঙ্গা নদীর অপর পারের দিকে যাত্রা করলেন। ভেলা অনুক্রমে গঙ্গার মধ্য ভাগে পৌছল।। তখন গঙ্গার মহাঝড় আরম্ভ হল। সে তীব্র ঝড়ের বায়ু বেগে ভীষণ তরঙ্গ উৎপন্ন হল। তরঙ্গাঘাতে ভেলার বন্ধন-লতিকা ছিন্ন হয়ে বাঁশ গাছ সব ইতস্ততঃ ছুটে গেল। তখন ক্ষত্রিয়দ্বয় তীব্র বায়ুচালিত তরঙ্গাঘাতে ভাসিয়ে ড়ুবিয়ে ক্রমান্বয়ে পরস্পর অদৃশ্য হয়ে পড়ল। তখন দেবীর জঠরে বাসকারী বোধিসত্নের অনুভাব বলে এবং রাণীর অনাবিল স্বামী ভক্তির প্রভাবে তিনি নিরাপদে গঙ্গার অপর তীরে গিয়ে পৌছলেন। দেবী জল হতে গঙ্গার তীরে উঠে দেখলেন–রাজা গঙ্গার মধ্যভাগে ভাসছেন এবং ড়ুবছেন। এ মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে দেবী নিজকে সংবরণ করতে না পেরে ক্রন্দন ও বিলাপ করতঃ নিতাক্ত তিনটি গাথায় বললেন–
৫৯-৬১। “পূর্বে কোন দুঃখ অনুভব করিনি। কিন্তু অদ্য বহু দুঃখ ভোগ করছি। যেহেতু আমার স্বামী রোদন পরায়ণ হয়ে গঙ্গার মধ্যভাগে ভাসছে ও ড়ুবছে। আমার সুখের পরিবর্তে কেবল মহা দুঃখই উৎপন্ন হচ্ছে। এই বলে আমার স্বামী নিশ্চয়ই অনাথভাবে মৃত্যু বরণ করবেন। আমার স্বামী এখন অপ্রতিষ্ঠ গভীর জলে অতি দূরে জল ঘুর্ণিপাকে ভাসছে ও ড়ুবছে। কি উপায়ে আমি তাঁর উপকার করতে পারি?” রাণী এরূপে বিলাপ ও অনুশোচনা করে বললেন–“অহো! আমার স্বামী অনাথভাবে গঙ্গার মধ্যভাগে জলমগ্ন হয়ে মহা দুঃখ ভোগ করছেন। এখন আমি একমাত্র করতে পারি সত্যাধিষ্ঠান। সুতরাং নিশ্চয়ই আমি আমার স্বামীর আশ্রয় স্বরূপ সত্যাধিষ্ঠান করব। এ সত্যাধিষ্ঠান বলেই আমার স্বামীকে দুঃখ হতে মুক্ত করব।” এ চিন্তা করে মুখ-হাত ধৌত করার পর নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় বললেন–
৬২-৬৩। “হে দেবগণ, আপনারা যদি এখানে উপস্থিত থাকেন, তবে সবাই আমার কথা শ্রবণ করুন। আমার স্বামী এখন অনাথ। এ গঙ্গায় চেতনাহীন অবস্থায় আছেন। আমার অধিষ্ঠান বলে এ-গঙ্গা পৃথিবীর ন্যায় শক্ত হোক্। আমি যেন গঙ্গা-পৃষ্ঠে পদক্ষেপে গিয়ে জলমগ্ন আমার স্বামীকে উদ্ধার করতে পারি। গঙ্গাজল এখন পৃথিবীর ন্যায় হোক্।”
দেবী এরূপ সত্যক্রিয়া করার সাথে সাথেই গঙ্গা সচেতনের ন্যায় কঠিনভাব ধারণ করে পৃথিবীতলের ন্যায় হল। তখন দেবী জলের এ অবস্থা দেখে প্রমোদিত হল এবং তাড়াতাড়ি গঙ্গাপৃষ্ঠে দৌড়ে গিয়ে স্বীয় স্বামীর হাত ধরে বললেন–“মহারাজ, এখন। আপনি আমার সাথে চলুন আমরা উভয়ে এগঙ্গা নদী উত্তীর্ণ হব।” রাজা স্বীয় দেবীকে দেখে আশ্বস্ত হয়ে দেবীর সাথে গঙ্গার অপর তীরে গিয়ে বললেন–“ভদ্রে, অতি আশ্চর্য, অতি অদ্ভূত। তোমার দ্বারা আজ অভূতপূর্ব কর্ম সাধিত হল। এবলে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
৬৪। “ভদ্রে, তোমার এ অভূতপূর্ব কৃতকর্ম পূর্বে কখনো দেখিনি। মহাজলে তুমি আমার প্রতিষ্ঠা হয়ে আমাকে মৃত্যু হতে মুক্ত করলে। “ভদ্রে, অদ্য তোমার দ্বারাই আমার জীবন রক্ষা হল।” এবলে দেবী সহ হিমালয়ের দিকে যাত্রা করলেন। তনুহূর্তে দেবী জঠরাভ্যন্তরস্থ বোধিসত্ত্বের পুণ্য বলে দেবরাজ ইন্দ্রের বাসভবন উত্তপ্ত হল। দেবরাজ ইন্দ্র ইহার কারণ চিন্তা করে সম্যক বিষয় জ্ঞাত হলেন। তখন তিনি বিশ্বকর্মা দেবপুত্রকে আহ্বান করে বললেন–“বাবা, তুমি মনুষ্য লোকে গিয়ে হিমালয় প্রদেশে এক রমণীয় স্থানে একখানা পর্ণশালা তৈরী করে দাও এবং তথায় প্রব্রজিতের সমস্ত উপকরণ নিয়ে আস।” বিশ্বকর্ম দেবপুত্রও ‘সাধু দেব’ এবলে স্বীকৃতি দিয়ে হিমালয়ে উপস্থিত হলেন। ইন্দ্রাদেশে তথায় তিনি এক সুরম্য স্থানে একখানা পর্ণশালা নির্মাণ করে তার দ্বার দেশে লিখে রাখলেন–“যারা এখানে প্রব্রজিত হতে ইচ্ছুক হন, তাঁরা এখান হতে প্রব্রজ্যার উপকরণ সমূহ গ্রহণ করে প্রব্রজিত হয়ে এখানে বাস করুন। তারপর সে স্থানের অমনুষ্যের ভয়, ভৈরব ও কর্কশ শব্দ এবং মৃগ পক্ষীদের সর্ববিধ উপদ্রব বন্ধ করলেন। পর্ণশালায় গমনের একপদী রাস্তা তৈরী করে দিয়ে স্বীয় দেবলোকে প্রস্থান করলেন। তখন রাজা রাণীকে সাথে করে অনুক্রমে এই পর্ণশালা-গমনের একপদী পথ প্রাপ্ত হলেন। তারা সে পথে ঐ পর্ণশালায় উপস্থিত হলেন। পর্ণশালার দ্বারদেশে লিখিত বিষয়গুলি পাঠ করে বুঝতে পারলেন–“ইহা দেবরাজ ইন্দ্রেরই প্রদত্ত পর্ণশালা। পর্ণশালার দ্বার খুলে দেখলেন প্রব্রজ্যার উপকরণ অজিন মৃগের চর্ম ও দণ্ড প্রদীপ ইত্যাদি। তখন তারা তথায় প্রবেশ করে নিজের পরিহিত পোষাকাদি ত্যাগ করে বাক-চিরাদি ধারণ করে ঋষি প্ৰব্ৰজ্যায় প্রব্রজিত হলেন। অজিন মৃগ চর্ম স্কন্ধে ধারণ করলেন, জটামণ্ডল শিরে বন্ধন করলেন এবং ঋষিদণ্ড হস্তে ধারণ করলেন। তারপর এদিক ওদিক চংক্রমণে রত হয়ে ‘অহো, আমার প্রব্রজ্যা বড়ই সুখকর, বড়ই আনন্দ দায়ক” এ বলে পর্ণশালা হতে বের হয়ে রাণীকেও প্রব্রজ্যায় দীক্ষা দিয়ে পর্ণশালায় অবস্থান করতে লাগলেন। তৎকালে দেবী স্বামীর নিকট বর যাঞ্চা করে বললেন–“মহারাজ এ হতে আমিই আপনার সমস্ত কাজকর্ম সম্পাদন করব। আপনি যথা সুখে শ্ৰমণ ধর্ম সম্পাদন করুন।” ইহা শুনে রাজা তা সাধুবাদের সহিত সমর্থন করলেন। তদবধি সুমেখলা দেবী প্রত্যহ প্রাতে পা ধুইবার জল ও পানীয় জলাদি আনয়ন করে সমস্ত প্রাতঃ করণীয় সম্পাদন করার পর ঝুড়ি, ষষ্টি ও খন্তি লয়ে ফল-মূল আহরণের জন্য বনে প্রবেশ করতেন। তথা হতে মধুর ফলমূলাদি সংগ্রহ করে এনে রাজাকে প্রদান করতেন। রাজা তা ভক্ষণ করে শীতল জল পানে পরিতৃপ্ত হতেন। অবশিষ্ট ফলমূল দেবী ভক্ষণ করতেন। এ নিয়মে ক্ষত্রিয়দ্বয় তথায় তাপস ধর্ম পালন করতে লাগলেন। তথায় এরূপে দু’তিন মাস বাস করার পর রাজা দুরন্ত ব্যাধির আক্রমণে পরলোক গমন। করলেন। ইহাতে দেবী আলুতালু কেশে বক্ষে করাঘাত করে করে বিলাপ পরায়ণা হয়ে বললেন–“হায়! হায়! স্বামীন, আমায় অনাথিনী করে আপনি কোথায় গিয়েছেন? অহো! এখন আমাকে একাকিনী, অনাথিনী আশ্রয়বিহীনা হয়ে এ অরণ্যে বাস করতে হবে। এ বলে তিনি নিজে একাদশটি বিলাপ গাথা ভাষণ করলেন–
৬৫-৭৫। “আমি একান্তই অনাথিনী। কিরূপে এ অরণ্যে একাকিনী বাস করব? আজ আমার প্রাণাধিক স্বামীকে দেখছিনা। কাকে স্বামী বলে বলব? কে আমাকে উপদেশ দানে সান্তনা দেবেন? কে-ই বা আমার সন্দেহ ভঞ্জন করবে? অদ্য আমার স্বামীকে দেখছিনা। কাকে স্বামী বলে বব? দেব, স্বীয় নগর হতে আমি আপনার সঙ্গে বের হয়ে নদীতে ভেসে ড়ুবেও সর্বদা আপনার পেছনে পেছনে গমন করেছি। আমি সারা পথে আপনার সঙ্গেই গমন করেছি। আপনার সঙ্গে এ মহাবনেই আমি প্ৰব্ৰজিতা হয়েছি। আমাকে এখন কি বলে ত্যাগ করলেন। হায়! হায়! আমার পূজ্য রাজার যদি স্বীয় নগরেই মৃত্যু হত, তাহলে সমস্ত জ্ঞাতি সমবেত হত। হায়! হায়! আমার হৃদয় রতন, যদি আপনি নগরে বাস করতেন এবং তথায় আপনার মৃত্যু হত তা হলে সমস্ত রাজ্যের জনগণ সমবেত হতেন। নানা রত্ন দ্বারা বিচিত্র শবাধারে আপনার পূত শবদেহ রক্ষা করে মহা জনগণ তা শ্মশানে নিয়ে যেতেন। মহাজনগণ সে শবাধার শ্মশানে সুসজ্জিত চিতায় রেখে দগ্ধ করতেন। আমি শ্মশানে বিদ্যমান থেকে আপনার পূত শবদেহকে নানা রত্ন সম্ভারে সবিলাপে পূজা করবার পর জনগণ আপনার শবদেহ সানন্দে দাহ করতেন, আমার বিরহ কাতর সরোদনের মাধ্যমে। দেব, এখন আমি আপনার কী-ই বা কর্ম করব? এ মহারণ্যে আমি একাকিনী আপনার এ পূত শবদেহকে কি প্রকারে দগ্ধ করব? রাজন, আমার জটরস্থ আপনার সন্তানকে দেখলেন না। এ অন্তঃস্বত্বা রমণীকে এখানে একাকিনী রেখে কেন চলে গেলেন? এখানে আমি একাকিনী আপনার শব দেহকে কিরূপে দগ্ধ করব? এখানে আমাকে কেই বা সাহায্য করবে?” দেবী এরূপে নানা প্রকার বিলাপ করার পর পর্ণশালা হতে বের হয়ে অরণ্যে প্রবেশ করলেন এবং কিছু কাষ্ঠ সংগ্রহ করে পর্ণশালার অনতিদূরে চিতা সাজিয়ে সত্যাধিষ্ঠান কল্পে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় ভাষণ করলেন–
৭৬-৭৭। “আমার স্বামী আমার বড়ই প্রিয় ছিল। আমিও তাঁর তেমন প্রিয় ছিলাম। এই সত্যক্রিয়া প্রভাবে রাজা অতিশয় হাল্কা হোক্। রাজা আমার সর্বদা প্রিয় ছিল। তাই তার সাথে আমি এখানে এসেছি। এ সত্যক্রিয়া প্রভাবে তাঁর পূত শবদেহ আমার পক্ষে গুরুভার না হোক।”
দেবী এভাবে সত্যক্রিয়া করার সাথে সাথেই রাজার শবদেহ তৃণের ন্যায় হাল্কা হয়ে গেল। তখন দেবী সে শবদেহ উঠায়ে নিয়ে ঐ সজ্জিত চিতায় শায়িত করায়ে বন-পুষ্পে পূজা ও বন্দনা করে চিতায় অগ্নি সংযোগ করে বলেন–হে স্বামি। আপনার সাথে মিলনের পর হতে এযাবৎ আপনার প্রতি কায়বাক্য-মনে যা দোষ করেছি তা ক্ষমা করুন। এ দর্শনই আমার আপনার সহিত শেষ দর্শন। এ বলে সূর্যাস্তকালাবধি তথায় বসে তৎপর পর্ণশালায় প্রত্যাবর্তন করলেন। সেদিন হতে দেবী একাকিনী বিলাপ পরায়ণা হয়ে বন্য ফল-মূলাদি আহরণ করে জীবন যাপন করতে লাগলেন। দশ মাস পর দেবী একটি পুত্রসন্তান প্রসব করলেন। মহাসত্ত্ব ভূমিষ্ঠ হওয়ামাত্র মহাপৃথিবী ভেদ করে গো-শকটের চক্র প্রমাণ একটি মহাপদ্ম উঠে তাঁর পদতলে স্থিত হল। এ অভূতপূর্ব আশ্চর্য ব্যাপার ঘটল একমাত্র মহাসত্বের পুণ্য প্রভাবে। ইহা দেখে দেবী চিন্তা করলেন“আমার পুত্র নিশ্চয়ই মহানুভব ও মহা তেজ সম্পন্ন আশ্চর্য মানুষ।” এ চিন্তা করে স্বীয় পুত্রের নাম রাখলেন ‘মহা পদুম কুমার’। তারপর দেবী স্বীয় পুত্রের মুখ অবলোকন করে নিজের চিত্ত স্থির রাখতে না পেরে তথায় নিন্মোক্ত দুটি বিলাপ গাথা ভাষণ করলেন–
৭৮-৭৯। “হে তাত, তোমার যদি অগ্রবর্তী নগরে জন্ম হত, তা হলে তখন তোমার জ্ঞাতি ও অন্যান্য জনগণ একত্রিত হয়ে তোমায় সর্বদা পরিবেষ্টন করে থাকতো। তোমার পিতার মৃত্যু হয়েছে; তাই তুমি তার দেখা পেলে না। তিনিও তোমাকে দেখলেন না। ইহাও আমার দ্বিতীয় শল্য। একারণে আমার হৃদয় কম্পিত হচ্ছে।”
দেবী মনোকষ্ট নিয়ে এরূপ বিলাপ করার পর মহাসড়কে বক্ষে ধারণ করেন করায়ে তথায় বহু কষ্টের মাধ্যমে বাস করতেছিলেন। বোধিসত্ত্ব ক্রমে ষোল বৎসর বয়ক্রমকালে অতি বুদ্ধিমান হলেন এবং অসাধারণ রূপলাবণ্যে দর্শনীয় সৌভাগ্যশ্রীতে বিমণ্ডিত ও সুলক্ষণ সম্পন্ন হলেন। কুমার সর্বদা লক্ষ্য করতেন; তাঁর মাতা একাকিনী অরণ্যে প্রবেশ করে বন্য ফল-মূলাদি আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। একদা তিনি স্বীয় মাতাকে মধুর বাক্যে বলেন–মাতঃ আমার পিতা কে? তিনি এখন কোথায়?” দেবী বললেন–প্রিয় পুত্র, অনঙ্গসেন নামক রাজাই তোমার পিতা। তিনি এখন পরলোকে। মহাসত্ব শুনে রোদন-পরায়ণ হয়ে বললেন–“অহো এখন আমি নিতান্তই অনাথ। আমার মাতা একাকিনীই এ অরণ্যে বাস করছেন। যদি আমার জীবিতাবস্থায় আমার মাতা এরূপ দুঃখ প্রাপ্ত হন, তা আমি দেখেও যদি উপেক্ষা করি, তা হলে তা আমার অকৃতজ্ঞতা হবে। উপকারীর উপকার স্বীকার করা হবে না।” এ চিন্তা করে নিজের মাতাকে বললেন–মাতঃ, আপনি এ হতে ফল-মূল আহরণের জন্য অরণ্যে যাবেন না। আমিই প্রত্যহ অরণ্যে গিয়ে ফল-মূলাদি আহরণ করে আপনাকে পোষণ করব। অধিকন্তু আপনার জন্য আমি জীবন ত্যাগ করতেও প্রস্তুত থাকব। “দেবী পুত্রের এবম্বিধ কথা শুনে প্রকম্পিত হৃদয়ে প্রিয় পুত্র বোধিসত্ত্বকে বললেন–“তাত প্রিয় পুত্র তুমি অরণ্যে যেও না। আমিই অরণ্য হতে পূর্বের ন্যায় ফল-মূল সংগ্রহ করে আনব। কারণ, অরণ্যে বহু প্রচণ্ড হিংস্র জন্তু আছে। যদি তুমি একাকী অরণ্যে যাও, তখনই আমার হৃদয় ভগ্ন হয়ে যাবে। তুমি আমার হৃদয় ভগ্ন করতে চাও কেন বাবা? বার বার এরূপ বলে দেবী বোধিসত্ত্বকে বারণ করলেন। ইহাতে কুমার মৌনভাব ধারণ করলেন। তৎপর সুমেখলা দেবী মহাসত্ত্বকে উপদেশাদি দিয়ে তাঁকে পর্ণশালায় রেখে নিজে ঝুড়ি, খন্তি ইত্যাদি লয়ে অরণ্যে প্রবেশ করলেন। মহাসত্ত্ব পর্ণশালায় বসে চিন্তা করলেন–“অরণ্যে বহুবিধ অন্তরায় আছে। যদি তথায় আমার মাতার কোনরূপ অন্তরায় ঘটে, তবে তা হতে আমার মাতাকে কে মুক্ত করবে? আমিও বা কি প্রকারে তাঁকে অন্বেষণ করব? এখন আমার মাতার গমন রাস্তা জেনে নিতে হবে। এ মনে করে মহাসত্ত্ব পর্ণশালা হতে বের হয়ে দেবীর গমন পথ অনুসরণ করে তার পশ্চাদানুগমন করলেন। কিয়দুর গিয়ে পুনঃ পর্ণশালায় ফিরে আসলেন। তিনি পর্ণশালায় বসে স্বীয় মাতা একাকিনী বনে প্রবেশ করছে” এবিষয় স্মরণ করে শোক সন্তপ্ত চিত্তে বিলাপ করতে লাগলেন। ভগবান বুদ্ধ নিন্মোক্ত সাতটি গাথায় উক্ত বিষয় প্রকাশ করলেন–
৮০-৮৫। “তখন পদুম কুমার একাকী পর্ণশালায় বসে। স্বীয় মাতার শোক-দুঃখ ও গুণ ইত্যাদির কথা চিন্তা করে বিলাপ সুরে বললেন–“হে মাতঃ, এখানে অতি দুঃখ করে আরণ্যিক ফল-মূলাদি আহরণ করে আমাকে সর্বদা পোষণ করছেন। এ ফল-মূল সংগ্রহ করা বড়ই কষ্টসাধ্য। যেমন কর্মকারের চুল্লীর ভিতর ভাগই দগ্ধ হয়, সেরূপ আমার অন্তরের অভ্যন্তরভাগও দগ্ধ হচ্ছে। এখন আমার অন্তর সর্বদা শোকদুঃখ সংযুক্ত। আমার অন্তর শোক-দুঃখে পরিপূর্ণ হয়ে ছোট নদীর ন্যায় বিশুষ্ক হচ্ছে।”
মহাসত্ব এরূপে মাতাকে লক্ষ্য করে অন্তরে নানা বিষয় উত্থাপন পূর্বক রোরুদ্যমানাবস্থায় পর্ণশালায় বসে রইলেন। দেবীও সেদিন অরণ্য হতে ফল-মূলাদি সংগ্রহ করে সন্ধ্যার সময় স্বীয় পর্ণশালার দিকে যাত্রা করলেন। তৎকালে আকাশে মহামেঘ উত্থিত হয়ে প্রবল ঝড়-বৃষ্টি আরম্ভ হল। এতদ্বিধায় ঘোর অন্ধকারের সৃষ্টি হল। ইহাতে দেবী গমন পথ দৃষ্টি গোচর না হওয়ায় এ ঘোর অন্ধকারে হাতড়ায়ে এক বৃক্ষমূলে আশ্রয় নিলেন। সে বৃক্ষমূলে এক উইয়ের ঢিবি ছিল। তাতে এক বিষধর সর্প বাস করত। সে সর্প তথায় মনুষ্য গন্ধ পেয়ে অত্যন্ত কুপিত হয়ে দেবীর পায়ে দংশন করল। তখন তিনি সে ভয়ংকর বিষবেদনার কথা চিন্তা না করে স্বীয় প্রিয় পুত্র বোধিসত্বের কথাই এরূপ চিন্তা করতে লাগলেন–“কিরূপে আমার পুত্র পদুম কুমার বেঁচে থাকবে?” অহো, আমার প্রিয়পুত্র এখনত অনাথ হল। কে বা আমার পুত্রের জন্য ফল-মূল আহরণ করবে? ইত্যাদি বলে বিলাপ করতে করতে নিতাক্ত গাথাগুলি ভাষণ করলেন–
৮৭-৯৪। “তাত, আমি নারী জন্ম লাভ করেছি। তজ্জন্য দুঃখিত নহি। কিন্তু পুত্রকে যে দেখছিনা; তাই আমার অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। আমার পুত্র এখন অনাথ। সে সেই পর্ণশালায় বাস করে, ফল-মূলাদি না পেয়ে ক্ষুধার জ্বালায় কাতর হবে।। আমার পুত্র এখন ক্ষুধার্ত নয় কি? আমি অরণ্য হতে আসতেছিনা, জ্ঞাত হয়ে এখন পর্ণশালা হতে বের হয়ে মহাবনে বিচরণ করছে। আমার পুত্র দুঃখিত মনে নানাদিকে আমাকে অন্বেষণ করছে নয় কি? আমাকে কোথাও না দেখে বোধ হয় সে জীবন ত্যাগ করতেছে। আমার পুত্র এ অর্ধরাত্রে অতি দুঃখিত অন্তরে আমাকে অন্বেষণের জন্য শুষ্ক নদীর ন্যায় এ বনে বিচরণ করছে নয় কি? পর্বতে, বনে, নদী-ঘাটে ও সরসীতে অধিষ্ঠিত হে দেবগণ, আমি আপনারা সবাইকে অবনত মস্তকে বন্দনা করছি। আপনারা আমার পুত্রকে এরূপ বলুন–“অচিরেই তোমার মাতার মৃত্যু হবে। অদ্য এ মহারণ্যে শায়িত তোমার মাতার মুখ দর্শনার্থ শীঘ্রই এ বৃক্ষ-মূলে আস।”
এরূপে দেবী বিলাপ পরায়ণ হয়ে প্রিয় পুত্রের শোক বেগ ও ঘোর বিষ বেগ সহ্য করতে না পেরে সে বৃক্ষ-মূলেই কালক্রিয়া করলেন। এদিকে বোধিসত্তের মাতার যে মুহূর্তে এরূপ মাত্মক দুঃখের সূচনা হল, সেক্ষণেই বোধিসত্ত্বের হৃদয়। কম্পিত হল। তাই তিনি চিন্তা করলেন–“অদ্য আমার মাতা এখানে পৌঁছতে এত গৌণ হচ্ছে কেন? আমার মনে হয়, তিনি। নিশ্চয়ই বনে বা পর্বতে কোন একটা অন্তরায়ের সম্মুখীন হয়েছেন। এখন আমার অন্তর প্রবোধ মানছে না। নিশ্চয়ই আমি অরণ্যে গিয়ে মাতার অন্বেষণ করব। এ চিন্তা করে কুমার তখনি পর্ণশালা হতে বের হয়ে নিন্মোক্ত গাথাটি বলে বলে মাতার গমন পথে যাত্রা করলেন।
৯৫। “হায় হায় মাতঃ, এ মহারণ্যে আপনি কোথায় আছেন? অদ্য আপনাকে না দেখে আমার মৃত্যু হবে বলেই বোধ হচ্ছে।” বোধিসত্ত্ব ঘোর অন্ধকার রাত্রে বিদ্যোৎলহরীর সাহায্যে মহারণ্যে পথ অতিক্রম করে ক্রমে ঐ বৃক্ষ-তলায়। গিয়ে উপস্থিত হলেন। বিদ্যোৎ আলোকে দেখলেন তথায় দেবী শায়িতা। মাতার দেহে হাত দিয়ে দেখলেন–তার দেহ শীতল ও শক্ত। ইহাতে তিনি বুঝলেন তাঁর মাতা মৃতা। তখন তিনি রোদন করতে করতে নিন্মোক্ত গাথাটি ভাষণ করলেন–।
৯৬। “মাতঃ, অদ্য আমি আপনাকে অন্বেষণ মানসে এদিক ওদিক বিচরণ করছি। মাতঃ, উঠুন, এখানে এভাবে শয়ন করবেন কেন? আমি আপনার পুত্র এসেছি। আপনাকে অন্বেষণ করবার জন্য। আপনি এখন উঠে বসুন। আমি আপনার সম্মুখেই আছি।” মহাসত্ব মৃত মাতার জন্য এরূপে কান্নাকাটি করে করে প্রবল শোক-বেগে অধৈর্য হয়ে দুঃখপূর্ণ হৃদয়ে মাতৃ-পদে নিপতিত হলেন এবং মাতার মস্তক উঠায়ে বলেন–মাতঃ, আপনি উঠুন। আপনি নীরব কেন? অহো, এখন আপনি বিনা আমি অনাথ। আমি কিরূপে বেঁচে থাকব? ইত্যাদি বলে রাত্রির প্রথম যাম পর্যন্ত রোদন করে করে উন্মাদের ন্যায় ইতস্ততঃ পরিভ্রমণ পূর্বক দেবগণকে বন্দনা করে নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
৯৭। “হে সমাগত মহাঋদ্ধিমান ভবৎ দেবগণ, আপনার আমার মাতার চিকিৎসা করুন। এ চিকিৎসার্থ আমার হৃদয়, রক্ত, মাংস, মস্তক, চক্ষু ও জীবন যা কিছুর প্রয়োজন হবে, তা আমি ঔষধের জন্য প্রদান করব।”
এগাথা বলার সাথে সাথেই দেবরাজ ইন্দ্রের বাস ভবন উত্তপ্ত হল। দেবরাজ এ উত্তাপের কারণ চিন্তা করে বুঝলেন বোধিসত্ত্বের এ বিপদের বিষয়। তখন তিনি চিন্তা করলেন এখন আমি তথায় গিয়ে দেবীর জীবন দান করব।” এ মনে করে দেবরাজ ব্রাহ্মণ বেশে ঐ মহারণ্যে বোধিসত্তের নিকট অর্ধরাত্রে উপস্থিত হয়ে বললেন–এ মহারণ্যে আপনি কে? কি কারণেই বা আপনি এখানে এসেছেন?” মহাসত্ত্ব বললেন—
“ভবৎ ব্রাহ্মণ, আমার নাম পদুম কুমার। আমি এ অরণ্যে বাস করি।” দেবরাজ বললেন–“ভবৎ মহাপদুম কুমার, আমি পথভ্রান্ত হয়েছি। আমি বারাণসী যাব। এখন আমাকে সে পথের পরিচয় বলে দিন। বোধিসত্ত্ব বললেন–“হে ব্রাহ্মণ, আমার মাতা বিষধর সর্পের দংশনে কালক্রিয়া করেছেন। আপনি আমার প্রতি অনুকম্পা করে আমার মাতার জীবন লাভের ঔষধ প্রদান করুন।” দেবরাজ বললেন–ভবৎ আমি এখানে সে ঔষধ দেখছি না। সে ঔষধ পেলে এখনি আপনার মাতার দেহ নিবিষ করে আরোগ্য করে দিতাম। কুমার বললেন–মহাব্রাহ্মণ, তাহলে আমাকেই বলুন। আমি তা অন্বেষণ করে নিয়ে আসি।” দেবরাজ বললেন–“সে ঔষধ এখানে পাবেন না। তবে এখন যদি আমি মনুষ্য হৃদয় পাই, তা মন্ত্রপূত করে ঔষধ তৈরী করতে পারি। সে ঔষধ আপনার মাতার মুখে প্রক্ষেপ করা মাত্রেই সে জীবিত হবে। “ইহা শুনে। বোধিসত্ত্ব বললেন–“মহাব্রাহ্মণ, আমার হৃদয়ই দেব।” দেবরাজ বললেন–“আচ্ছা, তা দিয়ে দিন। এখনি আপনার মাতা জীবন লাভ করবেন।” তা শুনে মহাসত্ব নিজের হৃদয় ছেদন করবার উদ্দেশ্যে শস্ত্র সংগ্রহের মানসে আকাশ পানে অবলোকন করে নিন্মোক্ত গাথায় সত্যক্রিয়া করলেন–
৯৮। “অদ্য আমি আমার জীবন দান হেতু হৃদয় মাংস ছেদন করব। এ হৃদয় দানের দ্বারা আমি ভবিষ্যতে বুদ্ধত্ব লাভ করব। হে দেবগণ, আমার এ সত্য বাক্যের প্রভাবে আমি যেন শস্ত্র লাভ করি।”
এরূপে মহাসত্ন সত্যাধিষ্ঠান করা মাত্রই আকাশ বাসী দেবতা নানা রত্ন বিচিত্রিত রঞ্জুতে একখানা শস্ত্র বন্ধন করে আকাশ হতে মহাসক্তের সম্মুখে রেখে দিলেন। মহাসত্ত্ব তা দক্ষিণ হস্তে গ্রহণ করে দেবগণকে জ্ঞাপন করার উদ্দেশ্যে বললেন–“ভবৎ দেবগণ, আমার হৃদয় দান দ্বারা চক্রবর্তী রাজ-সম্পদ, ইন্দ্র, মার সম্পদ, ব্ৰহ্ম সম্পদ, পচ্চেক বুদ্ধত্ব লাভ ও শ্রাবকত্ব ভাব প্রার্থনা করছি না। অপিচ হৃদয় দান পুণ্য প্রভাবে সর্বজ্ঞতা জ্ঞান লাভের হেতু হোক। এ হৃদয় দানের দ্বারা আমি অনাগতে জগতের দেবমনুষ্যগণকে সংসার দুঃখ হতে মুক্ত করব। এ বলে পুনঃ নিজের হৃদয় মাংস দান। অনুমোদন করবার জন্য দেবগণকে নিন্মোক্ত গাথায়ে অনুরোধ জ্ঞাপন করলেন
৯৯-১০১। “এখানে সমাগত হে ভবৎ দেববৃন্দ! আমার মাতার জীবন দানের জন্য ব্রাহ্মণকে আমার হৃদয় দান। অনুমোদন করুন। এখানে আমার হৃদয় দেওয়া হচ্ছে। ইহা আমার মাতার হৃদয় হোক। অনাগতে বোধি লাভের জন্য আমার এ দান মহাফলপ্রদ। আমার হৃদয় হতেও সর্বজ্ঞতাই আমার অত্যধিক প্রিয়। তাই আমি হৃদয় দান করছি। আমার এ দান অনুমোদন করুন।”
এ বলে মহাসত্ত্ব নিজেই ঐ শস্ত্র দ্বারা স্বীয় বক্ষ বিদীর্ণ করবার পূর্বে প্রথমে অধিষ্ঠান পারমী পূর্ণ করবার ইচ্ছুক হয়ে বললেন–“এখনই আমি স্বীয় হৃদয় ছিন্ন করব। এদেহের রক্তাদি অতি ঘৃণ্য স্বভাবের। তাই রক্তাদি আমার দেহ হতে বের না হোক।” এরূপ অধিষ্ঠান পূর্বক স্বীয় বক্ষ বিদীর্ণ করলেন এবং সে শস্ত্রের দ্বারাই হৃদয় ছিন্ন করে দেবরাজের হস্তে অর্পণ করলেন। তিনি তা গ্রহণ করে বোধিসত্ত্বকে বললেন–“ভবৎ কুমার; আপনার মাতার জীবন দানের ভার এখন আমার উপরই রইল। এখন আমি আপনার মাতার জীবন। দান করব। আপনার হাতেই এহৃদয় আপনার মাতার মুখে দিন। আমি তাতে মন্ত্র জপ করব। তখন বোধিসত্ত্ব দেবরাজের হস্ত হতে স্বীয় হৃদয় নিয়ে দেবীর মুখে রাখলেন। তখন ব্রাহ্মণ বেশধারী দেবরাজ দিব্যানুভাবে এহৃদয় প্রতিচ্ছাদন করে স্বর্গীয় অমৃতোদক দেবীর দেহে সিঞ্চন করলেন। এতদ্ফলে সুমেখলা। দেবী জীবন লাভ করে দ্রিা হতে জাগ্রত হওয়ার ন্যায় উঠে বসলেন। তখন বোধিসত্ত্ব মাতাকে বন্দনা করে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় ভাষণ করলেন–
১০২-১০৩। “মাতঃ, অদ্য আমি আপনার জীবন দান দিয়েছি। ইহাতে আমি পারমী ধর্ম পূরণ করে ভবিষ্যতে বুদ্ধ হব। আপনি এরাত্রে আমাকে মৃত দেখবেন; আমার মুখ অদর্শনে আপনি সর্বদা রোদন করবেন।” এবলে বোধিসত্ত্ব স্বীয় মাতাকে শেষ দর্শন করে তাঁর নিকট ক্ষমা ভিক্ষা করনান্তর তথায় পতিত হয়ে কালক্রিয়া করলেন। দেবী প্রিয় পুত্রের এরূপ মৃত্যু দর্শনে শোকে দুঃখে অস্থির হয়ে উন্মাদিনীর ন্যায় রোদন পরায়ণা হয়ে ইতস্ততঃ ভ্রমণ করতে লাগলেন। তখন দেবরাজ দেবীকে বললেন–“ভদ্রে, তুমি এখনই জীবন লাভ করেছ। সুতরাং রোদন করোনা। ইহা শুনে দেবী তথায় বসে বক্ষে করাঘাত করে মহা শব্দে রোদন করতঃ নিন্মোক্ত দশটি গাথা ভাষণ করলেন–
১০৪-১১১। “সূর্যোপম আমার পুত্র এখানে পতিত হল। চন্দ্রোপম আমার পুত্র মাটিতেই নিপতিত হল। হে আমার প্রিয় পুত্র! উঠ, আমার হৃদয় দগ্ধ হচ্ছে। তোমার যদি এখানে মৃত্যু হয়, আমি একাকিনী কিরূপে বেঁচে থাকব? কেন মহা বনে শয়ন করেছ? ইহা দেখে আমি বড়ই মর্মাহত হচ্ছি। দল পরিত্যক্ত হরিণীর ন্যায় বনে সৰ্ব্বদা বিচরণ করছি। তোমার মৃত্যু যদি আমার পূর্বে হয়; তবে আমি মহা দুঃখ ভোগ করব। সে মহা দুঃখ আমার কে বিনোদন করবে? হে আমার কৃতজ্ঞ প্রিয় পুত্র, শয়ন হতে উঠে আমার নিকট বস। হে প্রিয় পুত্র, আমি পূর্বে দুঃখে নিপতিতা হলে তোমার মুখ দর্শনে শীঘ্রই দুঃখ হতে অব্যাহতি লাভ করতাম। আমি সারা রাত্রি সর্বদা কম্পিত হৃদয়ে দীর্ঘদিন রোদন করব। ইহাতে নদীর ন্যায়ই বিশুষ্ক হব। আমি নিশ্চয় পুত্র শোকে কম্পিত হৃদয়ে রোদন করতে করতে অরণ্যে শীঘ্রই জল বিহীন ক্ষুদ্র নদীর ন্যায় শুকিয়ে যাব। আমি এখানে তোমার মৃত দেহ দেখে অনাথিনী দুঃখিনী একাকিনী হয়ে কিরূপে জীবন ধারণ করব? হে তাত, এ মহারণ্যে আমি কিরূপে একাকিনী তোমা বিনা জীবন ধারণ করব?”
এরূপে সুমেখলা দেবী সচীকারে বিলাপ করনান্তর স্বীয় পুত্র মহাপদুম কুমারের মস্তক স্বীয় বক্ষে ধারণ করে রোদন করতে লাগলেন। তখন ব্রাহ্মণ বেশধারী দেবরাজ তথায় দাঁড়িয়ে দেবীকে বললেন–“ভদ্রে যদি তোমার পুত্রের পুনঃ জীবন ইচ্ছা কর, তাহলে তুমি এখানে রোদন বিলাপ করোনা। এখনই তুমি সত্যাধিষ্ঠান কর। ইহাতে নিশ্চয়ই তোমার পুত্র পুনঃ জীবিত হবে।” ইহা শুনে দেবী তখনি তথায় উপবেশন করে স্বীয় মস্তকে অঞ্জলীবদ্ধ করে বললেন–“ভবৎ দেবগণ, আপনারা আমার বাক্য শ্রবণ করুন। এখন আমি আমার প্রিয় পুত্র মহাপদুম কুমারের পুনঃ জীবন লাভের জন্য সত্যাধিষ্ঠান করব।” এরূপে ইহা দেবগণকে জ্ঞাপন করে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয়ে সত্যাধিষ্ঠান করলেন–
১১২-১১৩। “ভবৎ দেবগণ, আপনারা আমার বাক্য শ্রবণ করুন। আমার পুত্রের কৃতকর্ম সুকার্যই হয়েছে। আমার জীবন লাভের জন্য আমার পুত্র শস্ত্রের দ্বারা স্বীয় হৃদয় ছেদন করে দিয়েছে। এ সত্যাধিষ্ঠান বলে আমার পুত্র পুনঃ জীবিত হোক।
দেবী এ সত্যাধিষ্ঠান করার সময়ান্তরেই দেবরাজ স্বীয় দিব্য প্রভাবে দিব্যৌষধ ও অমৃতোদক দেবতোক হতে নিয়ে ঔষধগুলি কুমারের দেহে মেখে দিলেন। দিব্য জল দেহে সিঞ্চন করে দিলেন। তখন দেবরাজের দিব্যানুভাবে ও দেবীর সত্যাক্রিয়াধিষ্ঠানানুভাবে পদুম কুমার জীবন লাভ করলেন। তাঁর দেহ বর্ণ হল কাঁচা সোনার ন্যায়। কুমার তখন শয়ন হতে উঠে স্বীয় মাতাকে বারবার বন্দনা করে মাতার গুণ অনুসরণ করলেন। তনুহূর্তে মহাপৃথিবী কম্পনাদি বহু আশ্চর্য ভাবের প্রাদুর্ভাব হল। সে বিষয় প্রকাশ মানসে ভগবান বুদ্ধ নিন্মোক্ত পাঁচটি গাথা ভাষণ করলেন–
১১৪-১১৮। “সে পদুম কুমার পুনঃ জীবন লাভ করে স্বীয় মাতাকে বন্দনা করে মাতার নিকট উপবেশন করলে, মহা পৃথিবী সশব্দে কম্পিত হল। সে কুমারের কৃত গুণ অনুসরণ করা মাত্রই এ মহাপৃথিবী তার তেজানুভাবে মহাশব্দে কম্পিত হল। পদুম কুমারের তেজে সমুদ্র সংক্ষুব্ধ হল। মহা সুমেরু পর্বত রাজ অবনমিত হল এবং আকাশে “সাধুবাদ” শব্দ বিঘোষিত হল। দশদিক ও গিরি গুহা সমস্ত স্থানে আশ্চর্যভাবে বিদ্যোল্লহরী বিকশিত হল। সমস্ত আকাশ ও চারিদিকে অদৃষ্ট পূর্ব আশ্চর্যভাবের সৃষ্টি হল।” তখন দেবরাজ ইন্দ্র নিজের দিব্য স্বভাবে প্রজ্বলিত হয়ে তরুণ সূর্যের ন্যায় আকাশে স্থিত হয়ে নিজের দেবরাজ ইন্দ্ৰত্বভাব প্রকাশ কল্পে নিন্মোক্ত গাথায় ভাষণ করলেন–
১১৯-১২০। “হে কুমার আমি দেবরাজ ইন্দ্র, আপনার এ দুষ্কর কর্ম দেখে আপনার পদে বন্দনা করছি। এব্যাপারে আপনার মাতা যেরূপ আনন্দ লাভ করলেন, আপনিও সর্বদা তেমন আনন্দিত হবেন। এখানে এসে মাতা-পুত্রের জীবন দান করে আমিও প্রমোদিত হচ্ছি। এখন আমি আপনাদের জানিয়ে দেবলোকে প্রত্যাবর্তন করছি। এবলে দেবরাজ বোধিসত্ত্বকে নানাপ্রকার স্তুতি নতি করে স্বীয় স্থানে প্রস্থান করলেন। সে বিষয় প্রকাশ কল্পে শাস্তা নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
১২১। “তখন দেবরাজ পদুমের স্তুতি করে ও তাকে বলে স্বর্গে চলে গেলেন। তখন মহাসত্ত্ব স্বীয় মাতাকে সঙ্গে নিয়ে পর্ণশালায় এসে বললেন– মাতঃ, এ হতে ফল-মূলের জন্য অরণ্যে যাবেন না। শুধু এ পর্ণশালায় যথাসুখে বসে থাকবেন। আমিই অরণ্য হতে ফল-মূল আরহণ করব এবং আপনার সেবাদি সমস্ত কাজ সম্পাদন করব।” সে হতে মহাপদুম কুমার স্বীয় মাতার সেবা শুশ্রুষা সুন্দর রূপে করতে লাগলেন। তিনি প্রত্যহ অরণ্য হতে ফল-মূলাদি আহরণ করে স্বীয় মাতাকে পোষণ করেন। তাঁরা মাতা-পুত্র উভয়ে মহারণ্যে বাস করে সুচরিত ধর্ম পূর্ণ করতঃ পরমায়ুর অবসানে মৃত্যুর পর দেবলোকে উৎপন্ন হলেন। তখন ঐ কুটরাজও অতি লোভে গৃহীত অগ্রবতী রাজ্যে রাজত্ব করতঃ যথায়ুস্কালে মৃত্যুর পর কর্মানুগতি প্রাপ্ত হল। ভগবান এ ধর্মদেশনা আহরণ করে জাতক সমাপ্তির নিন্মোক্ত ছয়টি গাথা ভাষণ করলেন–
১২২-১২৭। “তখন আমার রাজ্য লুণ্ঠনকারী লুব্ধ কুটরাজা বর্তমান আমার শত্রু পাপধর্মী দেবদত্ত। দেবরাজ ইন্দ্র বর্তমান আমার শাসনে দিব্যচক্ষুলাভী বলে প্রসিদ্ধ অনুরুদ্ধ। অনঙ্গসেন রাজা এখন শুদ্ধোদন। সুমেখলা দেবী এখন মহামায়া দেবী। অগ্রবতী রাজ্যবাসী জনগণ বর্তমান আমার শাসন পূর্ণকারী শ্রাবকগণ। মৈত্রী ধর্মে স্থিত মহাপদুম কুমার এখন আমি লোকনাথ তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ। ত্রিবিধ সুখ প্রার্থনাকারী তোমরা সবাই অতি গৌরব চিত্তে এ জাতক ধারণ কর।”
(মহাপদুম জাতক সমাপ্ত।)
Leave a Reply