২৬. বিপুল রাজ জাতক
“যদি আমার কেহ দাস রূপে” ইহা ভগবান বুদ্ধ জেতবনে বাস করবার কালে নিজের পুরিত দান পারমী সম্পর্কে বলেছিলেন।
একসময় ভিক্ষুসংঘ ধর্মসভায় এরূপ কথা উত্থাপন। করলেন–“অহো বন্ধুগণ! পূর্বে আমাদের ভগবান বুদ্ধ বোধিসত্ত্বাবস্থায় দানে সর্বদা অভিরত থাকতেন। নানাবিধ দানের দ্বারাই নিজের পারমী সম্ভার পূর্ণ করেছেন। এখন বুদ্ধকালেও তিনি মহাপুণ্যবান ও মহাযশস্বী হয়ে দেব মনুষ্যদের লৌকিক লোকুত্তর সম্পদ দায়কই হয়েছেন।” তখন ধর্মস্বামী বুদ্ধ গন্ধকুঠি হতে দিব্য কর্ণে ভিক্ষুগণের এ আলোচ্যমান বিষয় শুনে উক্ত ধর্মসভায় উপস্থিত হয়ে তথায় শ্রেষ্ঠ বুদ্ধাসনে উপবেশন করে বললেন–“হে ভিক্ষুগণ, তোমরা বর্তমান কোন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা নিয়ে উপবিষ্ট আছ?” ভিক্ষুগণ তখন তাঁদের আলোচ্য বিষয় বুদ্ধের নিকট যথাযথভাবে প্রকাশ করলেন–। বুদ্ধ তা শুনে বললেন–“হে ভিক্ষুগণ, তথাগত বুদ্ধ শুধু এখন দেব মানবের লৌকিক লোকুত্তর সম্পত্তি দায়ক তা নয়, পূর্বেও তথাগত বোধিসত্ত্বকালে মহাদানে অভিরত হয়ে দান পারমী পূর্ণ করেছিলেন এবং বুদ্ধত্ব লাভের জন্য নিজের ভার্যা, পুত্র, এমন কি নিজের শরীরও দান দিয়েছিলেন। এবলে। বুদ্ধ মৌণভাব অবলম্বন করলেন। তখন ধর্মসভায় উপস্থিত ভিক্ষুগণ দ্বারা প্রার্থীত হয়ে সে অতীত কাহিনী বলতে লাগলেন–
অতীতে সুধর্ম নামক নগরে বিপুল নামক এক রাজা রাজত্ব করতেন। তাঁর অগ্রমহিষীর নাম ছিল চন্দ্রাবতী। এ দেবী ষোড়শ সহস্র রাণীর প্রধান ছিলেন। রাজপুত্রের নাম ছিল বিজল কুমার। তখন বিপুল রাজ ধর্মতঃ ন্যায়তঃভাবে রাজত্ব করতেন। তিনি নগরের চারদ্বারে চারখানা মধ্যভাগে একখানা এবং নিজের বাসভবনের দ্বার সমীপে একখানা, মোট ছয়খানা দানশালা প্রতিষ্ঠা করে তাতে প্রত্যহ যাচকগণকে প্রত্যেক দানশালায় ছয় সহস্র টাকা ব্যয়ে দানীয় বস্তু দান দিতেন। সে ধার্মিক রাজা তখন মহামেঘ বর্ষণের ন্যায় দান দিয়াছিলেন। তিনি প্রত্যহ পূর্বাহ্নে ও সায়াহ্নকালে অমাত্য প্রভৃতি জনগণকে এরূপ উপদেশ দিতেন “হে ভবৎগণ, আপনারা সবাই যথাসাধ্য দান দাও শীল রক্ষা কর এবং উপোসথ দিবসে উপোসথ শীল রক্ষা কর।” একদা তিনি প্রাতে লন করে রাজ ভূষণে সর্বোতভাবে ভূষিত হলেন। তৎপর অমাত্যবৃন্দ পরিবৃত হয়ে স্বীয় বাসগৃহের দ্বার সমীপস্থ দানশালায় উপবেশন করে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
১। “যদি কোন ব্যক্তি আমায় দাসরূপে যাঞ্চা করে, তাকে আমার এদেহ দান করব, বুদ্ধত্ব লাভেরই জন্য।” বিপুল রাজ এরূপ বলে প্রত্যেক দানশালায় উপস্থিত হয়ে নিজ হস্তে কিয়ৎক্ষণ দানীয় বস্তু বিতরণ করে নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
২। “ধন-ধান্য পরিভোগ্যাদি বস্তু এবং বস্ত্রাদি আমার যা সম্পত্তি আছে, তা হতে যে যা যাঞ্চা করবে তাকে তা দেবো।” এবলে তিনি দানশালায় সজ্জিত দানীয় বস্তু সুশৃঙ্খলভাবে দান দেওয়ার জন্য অমাত্যদিগকে নিন্মোক্ত গাথায় আদেশ প্রদান করতেন
৩। “এ নিয়মে সর্বদা যাচকগণকে “আমার নানাবিধ দানীয় বস্তু ও অন্ন পানীয় দান দিয়ে পরিতৃপ্ত কর।”
তখন ধর্মরাজ্যবাসী জনগণ স্বীয় স্বীয় কর্ম কুশলতায় ধনধান্যে হিরক সুবর্ণে ও পরিতভাগ্য বস্তু ইত্যাদিতে সমৃদ্ধ হয়ে বাদ্যগীতে সর্বদা রমিত থাকতেন এবং যথেচ্ছা সুখে রত হয়ে স্বীয় বাসস্থানে বাস করতেন। একদা বিপুল রাজা স্বীয় প্রাসাদে শ্রীশয্যায় উপবিষ্ট হয়ে স্বীয় প্রদত্ত দান বিষয়ে চিন্তা করে চিত্তে পরম প্রীতি উৎপন্ন করলেন। তৎপর গবাক্ষ খুলে রাস্তার দিকে অবলোকন করে চিন্তা করলেন–“আমি বর্তমান বাহ্যিক বস্তুই দান করছি, এতে আমার চিত্ত তুষ্ট হচ্ছে না। অদ্যই আমি আধ্যাত্মিক দান দিতে ইচ্ছুক। অহো, অদ্যই আমার নিকট মহাজনগণ এসে বাহ্যিক দান প্রার্থনা না করে আধ্যাত্মিক দানই প্রার্থনা করুক, তাদেরকে আমি তাই দেব কেহ যদি আমার মস্তক প্রার্থনা করে, তাও তাকে দেব। যদি কেহ আমার হৃদয় মাংস প্রার্থনা করে, তাকেও আমার বক্ষ বিদীর্ণ করে হৃদয়মাংস দেব। আর যদি কেহ আমার চক্ষু, রক্ত, মাংস অর্ধ দেহ অথবা সর্ব দেহ যাঞ্চা করে, তাকে তাও দান করব। যদি কেহ এসে আমাকে এরূপ বলে, “বিপুল রাজ, আপনাকে আমার দাসরূপে চাই।” সে একথা বলা মাত্রেই আমি তার দাসরূপে আমার এদেহ তাকে দান দেব। আর যে কেহ আমার নিকট যা চায়, তা অকাতরে তাকে দান দেব। বিপুল রাজের এরূপ ঐকান্তিক আধ্যাত্মিক দান-চিন্তার তেজ-প্রভাবে একলক্ষ চুরান্নব্বই যোজন দল বিশিষ্ট এ মহা পৃথিবী মত্ত হস্তীর ন্যায় সুগর্জনে কম্পিত হল। মহাসমূদ্র সংক্ষুব্ধ হল। সুমেরু পর্বতরাজ সুভূমিতে বাপিত বীজাংকুরের ন্যায় অবনমিত হয়ে সুধর্মাবতী নগরাভিমুখী হল। মেঘগর্জন সহকারে ক্ষণিক বৃষ্টি বর্ষিত হল। আকাশে অসংখ্য বিদ্যুৎ লহরীর সৃষ্টি হল।
দেবরাজ ইন্দ্র করতালিতে আনন্দ জ্ঞাপন করলেন। মহাব্রহ্মা সাধুবাদে ব্রহ্মলোক মুখরিত করলেন। পৃথবীর তলদেশ হতে আরম্ভ করে ব্রহ্মলোক পর্যন্ত মহা কোলাহলের সৃষ্টি হল। বিপুল রাজের এরূপ ঐকান্তিক দান চেতনা তেজানুভাবে এরূপ আশ্চর্য ব্যাপারের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল। এবিষয় প্রকাশচ্ছলে নিন্মোক্ত আটটি গাথায় বললেন–
৪-১১। বিপুলরাজা ছয়টি শ্রেষ্ঠ দানশালা তৈরী করে প্রত্যহ মহাজনগণকে দান দিতেন। বিপুল নামক রাজা ধর্মতঃ
রাজত্ব করেছিলেন তিনি শ্রেষ্ঠাসনে বসে দান দেওয়ার জন্য চিন্তা করলেন। তখন তিনি গবাক্ষ বিবৃত করে মহাপথের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেন, তখন তার এরূপ মনোভাবের উদয় হত। যদি আমার নিকট কেহ এসে চক্ষু, হৃদয়, মাংস, রুধির ও দেহ এসব আধ্যাত্মিক বস্তু দান চায়, তখনই তা দেব। যদি কোন যাচক আমাকে দাসত্বের জন্য যাঞ্চা করে, তাকে আমার। এদেহ দান করব। এরূপে ঐকান্তিক চিন্তার তেজে এ মহাপৃথিবী কম্পিত হল, পর্বতরাজ সুমেরু অলংকৃত মস্তকের ন্যায় নমিত হল। তখন ঐকান্তিক দান চিন্তার প্রভাবে লোমহর্ষণকর ভীষণভাবে মহাপৃথিবী প্রকম্পিত হয়েছিল। তাঁর সে ঐকান্তিক দানচিন্তার তেজপ্রভাবে সুধর্মাবতী নগর তখন ভীষণ ললাম-হর্ষণকর বিপূল মহাশব্দে উদ্বেলিত হয়েছিল।” সেক্ষণে দেবরাজের বাসবিমান উত্তপ্ত হল। তিনি তা অনুভব করে সে বিষয় চিন্তা করণান্তর নিন্মোক্ত গাথা ভাষণ করলেন–
১২। “আমাকে এ ইন্দ্রাসন হতে চ্যুত করবার আশায় বোধ হয় কোন দেবতা বা মনুষ্য দান ধর্ম ব্রহ্মচর্যাদি পুণ্য কর্ম সম্পাদন করছেন।” এরূপ চিন্তা করার পর বোধিসত্নের এসব পুণ্য চেতনার বিষয় সম্যকভাবে জ্ঞাত হয়ে অতিশয় তুষ্ট হলেন। এবং আরো চিন্তা করলেন–এ বুদ্ধাংকুর বিপুল রাজা নগরবাসী মহাজনগণকে নানাবিধ বাহ্যিক বস্তু দান দিয়ে বিশেষ তুষ্টি লাভ করে পুনঃ অদ্য আধ্যাত্মিক দান দিতে ইচ্ছুক হয়েছেন। তিনি অনাগতে নিশ্চয়ই বুদ্ধ হবেন। এখন আমি বিপুল রাজার মনোবাসনা পূর্ণ করব।” এরূপ চিন্তা করে তরুণ ব্রাহ্মণ বেশে এক প্রাতে রাজাঙ্গনে উপস্থিত হলেন। সে দিবস প্রাতে বোধিসত্ত্বনকার্য সমাপন করে নানা শ্রেষ্ঠ রাজভোজ্য ভোজন করে চিন্তা করলেন–“এখন আমি প্রত্যেক দানশালায় গিয়ে মহাজনগণকে সঠিকভাবে দান দেওয়া হচ্ছে কিনা তা দেখব।” এ চিন্তা করে সর্বালংঙ্কারে বিভূষিত হলেন এবং শ্রেষ্ঠ মঙ্গল হস্তী-স্কন্ধে আরুট হয়ে অমাত্যগণ দ্বারা পরিবৃত হয়ে নগর মধ্যভাগে প্রতিষ্ঠিত দানশালায় প্রবেশ করতঃ প্রদত্ত দানক্রিয়া দেখছিলেন। তখন ঐ তরুণ ব্রাহ্মণ বেশ ধারী দেবরাজ নিজের দক্ষিণ হস্ত তুলে বললেন–“ভবৎ মহারাজের জয় হোক।” এরূপ বারয় জয় ঘোষণা করলেন। মহাসত্ত্ব এই জয় ঘোষণা শুনে চিন্তা করলেন–“এ ব্রাহ্মণ এখানে কি জন্য এসেছেন? এখন আমি তার আগমন কারণ জিজ্ঞাসা করব।” এ মনে করে নিতাক্ত গাথায় বললেন–
১৩। “হে ব্রাহ্মণ, আপনি এখানে কিজন্য এসেছেন? আমার নিকট কিছু যাঞ্চা করতে ইচ্ছা আছে কি?” ইহা শুনে দেবরাজ বললেন–“আমি তরুণ, সুতরাং আপনার ভার্যা চন্দ্রা দেবীকে আমার ভার্যারূপে বরণ করবার জন্যই আপনার নিকট তাকে যাঞ্চা করতে এসেছি। এ বলে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
১৪। “নদীর জল যেমন কোনকালেই পরিক্ষীণ হয় না, আপনিও সেরূপ মনে করে এখানে এসেছি। আমার প্রার্থীত দেবীকে আমায় প্রদান করুন।”
ইহা শুনে বিপুল রাজার চিত্ত প্রীতিতে ভরপুর হয়ে গেল। তিনি যেন আগামী কল্যই বুদ্ধত্ব প্রাপ্ত হবেন, তেমনভাবেই সন্তুষ্ট হলেন। প্রসারিত হস্তে যেন স্বর্ণপূর্ণ সহস্র থলিয়া প্রাপ্ত হলেন। তিনি প্রীতি ভরে বললেন–সাধু ব্রাহ্মণ, এখনিই আপনার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করব। এবলে অতীত ও সতেজ মনোভাবে মহাপৃথিবীকে মুখরিত করে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
১৫। “হে ব্রাহ্মণ, আপনি আমার নিকট যা যাঞ্চা করলেন অকম্পিতভাবে তা আপনাকে দেব। দানেই আমার মন রমিত হয়। বস্তু থাকা সত্ত্বেও নাই বলে আমি গোপন করিনা।”
এবলে মহাসত্ত্ব নিজের ভার্যা চন্দ্রা দেবীর দিকে দৃক্পাত করে বললেন–“ভদ্রে এ ব্রাহ্মণ আমার নিকট অন্যধন যাঞ্চা করে তোমাকেই যাঞ্চা করছে। আমিও সর্বজ্ঞতা জ্ঞানই চাই। এখন আমি অনাগতে সর্বজ্ঞতা জ্ঞান লাভের জন্য ভার্যাদান পারমী পূর্ণ করব তোমাকেই দান দিয়ে।” মহাসত্ত্বের এবাক্য শুনে দেবী অতি তুষ্ঠা হলেন। মহাসত্ত্ব তা জ্ঞাত হয়ে শীঘ্রই সুবাসিত জলে পরিপূর্ণ সুবর্ণ গাড়লয়ে দেবীর হস্ত গ্রহণ করলেন এবং পৃথিবী সাক্ষী করে তথায়ই জল ঢেলে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় বললেন–
১৬-১৭। “হে মহাব্রাহ্মণ, আমি বোধিলাভের কারণে আপনাকে আমার ভার্যা দান করছি। আপনি দেবীকে গ্রহণ করুন। তাকে যথাসুখে নিয়ে যান।” বোধিসত্ত্ব অতি তুষ্ঠ মনে আরো বললেন–“ভবৎ ব্রাহ্মণ মদীয় ভার্যা চন্দ্রা দেবী আমার বড়ই প্রিয়া ও মনোজ্ঞা। অপিচ অনাগতে সর্বজ্ঞতা জ্ঞান লাভই আমার প্রিয় ভার্যা হতেও শত সহস্র গুণেই প্রিয়তর। তদ্ধেতু অদ্যই আমি আমার প্রিয়তমা দেবীকে আপনার হস্তে সমর্পণ করে এতে যে চক্রবর্তী সম্পদ, দেব-ব্রহ্মা সম্পদ প্রার্থনা করছি তা নয় অথবা অনাগতে বুদ্ধের শ্রাবকত্ব এমন কি পচেক বুদ্ধত্বও প্রার্থনা করছি না। আমার এ ভার্যা দান করে অনাগতে সর্বজ্ঞতা জ্ঞানই প্রার্থনা করছি।” এবলে বিপুল রাজা স্বীয় ভার্যা তরুণ ব্রাহ্মণকে দান করলেন। তৎক্ষণে মহা পৃথিবী কম্পনাদি আশ্চর্যজনক ব্যাপারের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল। সে আশ্চর্য বিষয় প্রকাশ মানসে তথাগত বুদ্ধ নিন্মোক্ত গাথা চতুষ্টয় বললেন–
১৮-২১। “তখন সুধর্মবর্তী রাজ্যবর্ধন বিপুল রাজা বোধিলাভের জন্য স্বীয় ভার্যা ব্রাহ্মণকে দান করলেন। দেবীকে শ্রদ্ধার সহিত ব্রাহ্মণ-হস্তে প্রদান করা হলে, তখন পৃথিবী কম্পিত হল এবং সুমেরু পর্বত নমিত হল। লোমহর্ষণকর ভীষণ ভাবে মহাপৃথিবী প্রকম্পিত হল। লোমহর্ষণকর ভীষণ ভাবে সমস্ত রাজ্য সংক্ষুব্ধ হল।” এরূপে ব্রাহ্মণ বেশধারী দেবরাজের হস্তে চন্দ্রাদেবীকে দান দিয়ে মহাসত্ব প্রীতি প্রকাশ মানসে স্বীয় শিরে অঞ্জলিবদ্ধ করে বললেন– “নিশ্চয়ই আমার দ্বারা উত্তম দান করা হয়েছে। “এবলে নিন্মোক্ত গাথায় আনন্দ ধ্বনি প্রকাশ করলেন–
২২। “পত্নী দান দ্বারা অনাগতে বুদ্ধ হয়ে বুদ্ধকৃত্য সাধন করব। আমার এ প্রার্থনা পরিপূর্ণ হোক।” অতঃপর তরুণ ব্রাহ্মণ বেশধারী দেবরাজ দেবীকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন। দৈবিক প্রভাবে দেবীকে এক নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে রেখে নিজে অন্য এক ব্রাহ্মণ বেশে পুনঃ এক দানশালায় রাজার নিকট উপস্থিত হলেন। তথায় দক্ষিণ হস্ত উত্তোলন করে নিলো গাথাটি বললেন–
২৩। “মহারাজ আমি আপনার প্রিয় পুত্রকে দান চাচ্ছি। প্রসন্ন মনে তাকে আমায় দান করুন।” ইহা শুনে বিপুল রাজ প্রীতিফুল্ল মনে স্বীয় পুত্র বিজল কুমারের প্রতি দৃকপাত করে ব্রাহ্মণের প্রার্থনা বাক্য নিন্মোক্ত গাথায় প্রকাশ করলেন–
২৪। “আমি সর্বজ্ঞতা প্রাপ্তিই প্রার্থনা করছি। সে পুণ্য অনুমোদন কর। অনাগতে বুদ্ধত্ব প্রাপ্তির জন্য তোমাকে দান করছি। তুমি আমার বুদ্ধত্ব লাভের উপায় করে দাও।” ইহা। শুনে বিজল কুমার প্রীতিফুল্ল মনে বললেন–“মহারাজ, আমি আপনার মনোরথ পরিপূর্ণ করব। এবলে স্বীয় পিতার নিকট সিংহনাদে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
২৫। “আমি আপনার পুত্র, আপনিই আমার পিতা। সুতরাং আপনি আমার ঈশ্বর। অদ্য আপনার ইচ্ছানুসারে আমাকে বিক্রি করুন কিম্বা হনন করুন, সবিই আমি অনুমোদন করব। নির্বিবাদে আপনার বাক্য রক্ষা করব।” তখন রাজার প্রিয়পুত্র বিজল কুমারকোন করিয়ে উস্কৃষ্ট খাদ্যাদি ভোজন করালেন এবং সর্ববিধ অলঙ্কারে বিভূষিত করে নিজের ক্রোড়ে বসায়ে শির চুম্বন পূর্বক ব্রাহ্মণকে সশ্রদ্ধায় দানোত্তম পুত্রদান করলেন। সে বিষয় প্রকাশ মানসে সর্বজ্ঞ বুদ্ধ নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় বললেন–
২৬-২৭। “তখন বিপুলরাজ নিজের পুত্র বিজল কুমারকে গান করিয়ে শুচী সূক্ষ বস্ত্র পরিধান করালেন এবং সর্বালঙ্কারে বিভূষিত করে নিজের অঙ্কে বসালেন এবং শির চুম্বন করে তাকে অভিরমিত করলেন। কুণ্ডলে বিভূষিত, মাল্যধারী সর্বাভরণে ভূষিত ও সুজাত রাজপুত্রকে ব্রাহ্মণ হস্তে দান করলেন। “তৎপর বিপুল রাজা সমস্ত দেবগণকে নিজের দানের সাক্ষী ও অনুমোদন করিয়ে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
২৮-২৯। “এখানে আগত ভবৎ দেবগণ, আপনারা সবাই আমার এদান অনুমোদন করে পুণ্য গ্রহণ করুন। ব্রাহ্মণকে আমার এ প্রিয় পুত্র দান দেওয়ার কারণে অনাগতে অমৃতপদ বোধিই লাভ করব। এবলে মহাসত্ত্ব নিজের প্রিয় পুত্র ব্রাহ্মণ দেশধারী দেবরাজকে প্রদান করলেন। তখন মহাসত্বের দানতেজে বহুবিধ আশ্চর্য ব্যাপারের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল। সে বিষয় প্রকাশ মানসে অপ্রতিপুদাল বুদ্ধ নিন্মোক্ত গাথা চতুষ্টয় ভাষণ করলেন–
৩০-৩৩। “প্রিয় পুত্র দান দেওয়া হলে এমহাপৃথিবী ভীষণ ভাবে ও লোমহর্ষণকর রূপে প্রকম্পিত হল। সমগ্র নগর সংক্ষুব্ধ হয়েছিল। রাজকুল হতে বিপুল ভাবে সাধুবাদ ধ্বনিত হল এবং মহা আনন্দ কোলাহলের সৃষ্টি হল। সমগ্র রাজ্যে মহা ভৈরভ শব্দ ও বিপুল কোলাহলের সৃষ্টি হল।”
বিপুলরাজ প্রিয়পুত্র বিজল কুমারকে ব্রাহ্মণ বেশধারী দেবরাজের হস্তে দান করে দানশালাতেই উপবেশন করলেন। তখন দেবরাজ ইন্দ্র কুমারকে দান গ্রহণ করে দৈবিক অনুভাব বলে তাকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে প্রচ্ছন্ন ভাবে রাখলেন এবং পুনরায় রাজার নিকট বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ বেশে দণ্ড হস্তে, পক্ককেশ, দীর্ঘদেহ, লোলচর্ম বিশিষ্ট বেশে নগর মধ্যভাগে দানশালায় রাজার নিকট উপস্থিত হলেন। তখন বিপুল রাজ এ বৃদ্ধ ব্রাহ্মণকে দেখে তাঁর আগমনের কারণ নিন্মোক্ত গাথায় জিজ্ঞাসা করলেন–
৩৪। “হে ব্রাহ্মণ, কোন উদ্দেশ্যে আপনি এখানে উপস্থিত হয়েছেন তা আমাকে বলুন।” রাজার এবাক্য শুনে দেবরাজ নিজের আগমন কারণ নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
৩৫। “মহারাজ, এখন আমি জীর্ণ শীর্ণ দুর্বল। দীর্ঘ রাস্তা আমার পক্ষে দুর্গমনীয়। আপনার কীর্তি শব্দ শুনেই আপনার নিকট এসেছি আপনার রাজ্য খানা যাঞ্চা করতে। সুতরাং এখন আমাকে আপনার রাজ্য খানা দান করুন।” ইহা শুনে মহাসত্ত্ব প্রীতিফুল্ল হৃদয়ে স্বীয় রাজ্য খানা বৃদ্ধ ব্রাহ্মণকে দান দেওয়ার কালে নিতাক্ত গাথাটি বললেন–
৩৬। “হে ব্রাহ্মণ, সৈন্যসামন্ত যানবাহন সহ আমার এ সমৃদ্ধ রাজ্য গ্রহণ করুন। আপনার মনোরথ পূর্ণ হোক। দানেই আমার মন রমিত হয়। তৎক্ষণেই রাজা সুবাসিত জলে পরিপূর্ণ সুবর্ণ ভিঙ্গার নিয়ে স্বীয় রাজ্যশ্রী বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের হাতে জল ঢেলে দান দিতে দিতে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
৩৭-৩৯। “হে মহাব্রাহ্মণ, আমার প্রিয় দানোত্তম রাজ্যশ্রী আপনাকে দান দিচ্ছি। আপনি তা গ্রহণ করুন অনাগতে আমার বোধি লাভের কারণে। ভবৎ ব্রাহ্মণ, সর্বদা রমণীয় ও সর্বেচ্ছা পূর্ণকারী এরাজ্য আমি আপনাকে দিচ্ছি, আমার অনাগতে বোধিলাভের জন্য। এ রাজ্যদান দ্বারা আমি অনাগতে বোধিলাভ করে দেব-মানবকে মুক্তি দান করে পরে আমিও নিবৃত্তি লাভ করব।”
এবলে মহাসত্ত্ব স্বীয় রাজ্যের সমস্ত রাজ্যশ্রী বৃদ্ধ ব্রাহ্মণকে দান দিলেন। দেবরাজ তার এ ব্যাপার দর্শনে বিস্মিত হয়ে “অহো! এ বিপুল মহারাজ বুদ্ধাঙ্কুরই ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই লোকনাথ বুদ্ধ হবেন।” এরূপ চিন্তা করে বিপুল রাজকে বললেন–“মহারাজ, আপনি নিশ্চয়ই বুদ্ধাঙ্কুর। অনাগতে আপনি লোকনাথ বুদ্ধ হবেন।” “মহারাজ, আমি ব্রাহ্মণ নহি। আমি দেবরাজ ইন্দ্র। আপনার পারমী ধর্ম পরিপূরণার্থ আমি এখানে এসেছি।” এবলে বিপুল রাজ্যের দান পুনঃ তাঁকে প্রত্যার্পণ করে নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
৪০। “আমি দেবরাজ ইন্দ্র। দেবী, পুত্র ও রাজ্য, এদানত্রয় পুনঃ আপনাকে প্রত্যার্পণ করছি। তা গ্রহণ করুন।” এবলে রাজাকে নিজের দেবত্বভাব জ্ঞাপন করলেন এবং দেবরাজ রাজার পত্নী, পুত্র ও রাজ্য দান অনুমোদন করে বললেন–মহারাজ আপনার পত্নী-পুত্র ও রাজ্যশ্রী আপনারই হোক, এবলে নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
৪১। “হে জনেন্দ্র, এখন আমি আপনাকে তদীয় ভার্যা, পুত্র এবং রাজ্য প্রত্যার্পণ করছি। সুতরাং আমার নিকট হতে দেবী প্রমুখ প্রত্যেকটি গ্রহণ করুন।” এবলে দেবরাজ ইন্দ্র বিপুল রাজার পুত্র ও পত্নীর সর্বালঙ্কারে বিভূষিত করে পুনঃ তাকে প্রদান করলেন। তখন রাজা হৃষ্ট প্রহৃষ্টচিত্তে অমাত্যগণ দ্বারা পরিবৃত হয়ে স্বীয় পুত্র-দার সহ সে দানশালায় উপবেশন। করলেন। দেবরাজ তখন রাজার সম্মুখভাগে উজ্জ্বল তরুণ সূর্যের ন্যায় আকাশে স্থিত হয়ে বিপুল রাজার স্তুতি আরম্ভ করলেন–। এ বিষয় প্রকাশ মানসে বুদ্ধ সাতটি গাথা ভাষণ। করলেন।
৪২-৪৮। “তখন দেবরাজ বিপুলরাজের সঙ্কল্প জ্ঞাত হয়ে তাঁর বহুবিধ স্তুতি করার পর পুনঃ তাঁকে এরূপ বললেন–“দেব মানবের মধ্যে আপনিই একমাত্র জয়ী। আপনার চিত্ত-বেগে পৃথিবীর নিভাগ হতে উর্ধভাগ পর্যন্ত শব্দ ঘোষিত হল। সসাগরা পৃথিবী এমন কি গিরিগহবরে পর্যন্ত বিদ্যোৎ লহরী প্রকট হল। দেবর এবং অচেতন পর্বতাদিও আপনার দান অনুমোদন করেছেন। ইন্দ্র, ব্রহ্মা, প্রজাপতি, সোম, যাম বৈশ্রবণাদি সমস্ত দেবতাও আপনার এদুষ্কর দান অনুমোদন করেছে। অশান্ত ব্যক্তিরা দুর্দেয় বস্তু দান এবং দুষ্কর কর্ম করেনা। এ দুরানুবোধ্য ধর্ম সত্ব্যক্তিদের জন্যই। তদ্ধেতু শান্ত এবং অশান্তের গতি নানা প্রকার হয়। অশান্তেরা নিয়ে যায় এবং শান্তগণ স্বৰ্গগামী হয়। হে রাজন, আপনি যে দান দিচ্ছেন, তা অতি উত্তম। আপনার সে শ্রেষ্ঠ মনোকর্ম আপনার স্বর্গ প্রদায়ক।” দেবরাজ ইন্দ্র এরূপ বিপুল রাজের স্তুতি করে সে দানশালায় সপ্তবিধ রত্ন বর্ষণ করলেন এবং নিজের উপস্থিতির কারণ বর্ণনা মানসে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় বললেন–
৪৯-৫০। “আমি দেবরাজ ইন্দ্র। আপনি পারমী পূর্ণ করে অনাগতে বুদ্ধত্ব লাভের সুযোগ দানের জন্য আপনার নিকট এসেছি। রাজন, আমি এখানে এসে আপনার পারমী পূর্ণতা সাধনের জন্য এসব করেছি। এখন আমি স্বর্গে যেতে ইচ্ছা করি।” এবলে দেবরাজ বোধিসত্ত্বকে রাজ্য প্রত্যার্পণ করে বললেন–মহারাজ, এ হতে আপনি অপ্রমত্তভাবে রাজত্ব করুন। এখন আমি দেবলোকে যাচ্ছি।” এবলে সেখানেই অন্তর্হিত হয়ে দেবলোকে প্রাদুর্ভূত হলেন। সে বিষয় প্রকাশ মানসে ভগবান বুদ্ধ নিন্মোক্ত গাথাটি ভাষণ করলেন–
৫১। “তখন দেবরাজ ইন্দ্র জনাধিপতি রাজ শ্রেষ্ঠকে এবলে স্তুতি করে স্বর্গলোকে প্রস্থান করলেন।
তৎপর হতে বোধিসত্ত্ব নিজের পুত্র-দার ও অমাত্যদের সাথে সুধর্মাবতী নগরে রাজত্ব সুখ ভোগ করে দেবরাজের উপদেশ রক্ষায় নিরত হয়ে জনগণকে দান দিতেন। এসব দানপুণ্য ক্রিয়া সম্পাদন করে। পরমায়ুর অবসানে এখান হতে চ্যুত হয়ে দেবলোকে দিব্য প্রাসাদে উৎপন্ন হলেন। সুধর্মাবতী রাজ্যবাসী জনগণও বিপুল রাজের উপদেশ প্রতিপালনে রত হয়ে দানাদি নানা পুণ্যক্রিয়া সম্পাদন পূর্বক মৃত্যুর পর দেবলোকে গিয়ে উৎপন্ন হলেন। তথাগত বুদ্ধ এ ধর্মদেশনা সমাপন করে বললেন–“হে ভিক্ষুগণ, তথাগত বোধিসত্ত্ব জন্মকালে বুদ্ধত্ব লাভের জন্য নিজের ভার্যা, পুত্র ও রাজ্যশ্রী পর্যন্ত দান করেছিলেন। এসব আশ্চর্য বিষয় বলে জাতক সমাপ্তি করতঃ নিটোক্ত সমাপ্ত গাথা ভাষণ করলেন–
৫২-৫৬। “তখনকারের রাজমাতা এখন আমার মাতা মহামায়া। সে রাজার পিতা এখন শুদ্ধোদন। চন্দ্রা নী রাজরাণী এখন যশোধরা বিজল নামক যে পুত্র, সে এখন আমার পুত্র রাহুল। দেবরাজ ইন্দ্র এখন অনুরুদ্ধ। অবশিষ্ট মহাজনতা এখন সবাই আমার শ্রাবক। পুণ্যকামী দানে রত বিপুল রাজা এখন আমি লোকনাথ তথাগত সম্বুদ্ধ। ত্রিবিধ সুখ প্রার্থনাকারিগণ তোমরা সবাই অতি গৌরব চিত্তে এ জাতক। ধারণ কর।”
(বিপুল রাজ জাতক সমাপ্ত।)
Leave a Reply